জয়রাজ ভট্টাচার্য
নাট্যকর্মী, সমাজকর্মী
একটা পর্যায়ের পর টেক্সট পেরিয়ে যাওয়াই অভিনেতার কাজ। টেক্সট পেরিয়েই সে পারফর্মেন্স টেক্সটকে মূর্ত করে তোলে। একজন সক্ষম অভিনেতা নিজের সক্ষমতা অনুযায়ী টেক্সট থেকে খুঁড়ে তোলে সাবটেক্সট। কিন্তু যিনি সাধারণ সক্ষম অভিনেতার চেয়ে আরও খানিক দূর অগ্রসর হন, তিনি শুধু সাব টেক্সটই নয়, তাঁর পারফর্মেন্সকে বিয়ন্ড টেক্সট একটা অবস্থানে নিয়ে যেতে পারেন। যেমন মেসি বা জোয়ান ক্রুয়েফের ফুটবল, যেমন বি বি কিং-এর গিটার, যেমন রাধাকান্ত নন্দীর তবলা— সেইরকমই স্বাতীলেখা সেনগুপ্তের অভিনয়।
অজিতেশ-উত্তর নান্দীকারের নান্দনিক দৈন্য এবং শূন্যতা অনেককাল একাই ভরাট করার চেষ্টা করেছেন স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। স্বাতীলেখার নান্দীকারপর্বে যুগপৎ অজিতেশ এবং কেয়া নেই। সেই খামতি পূর্ণ করতে পারেন এমন কেউ নেই, তখন চ্যালেঞ্জটা নেন স্বাতীলেখা। কেয়ার ছেড়ে যাওয়া চরিত্রে তিনি অভিনয় করতেও রাজি হয়ে যান, এরকমটা খুব সহজ কাজ নয়। ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের সাত নম্বর জার্সি, যা জর্জ বেস্ট ঐতিহাসিক করে দিয়ে গেছেন, সেই জার্সি বেকহ্যাম ছাড়তেই এক সতেরো বছরের তরুণ ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো গলিয়ে নেন, আর কী আশ্চর্য জর্জ বেস্ট নন, বেকহ্যাম নয়, দুনিয়া সাত নম্বর জার্সিকে সি আর সেভেন বলে ডাকে!
স্বাতীলেখার অভিনয়ে এক অনুচ্চার আছে। এক ধরনের উইথড্রয়াল আছে। যেহেতু আমার এই লেখার লক্ষ্য নবীন অভিনেতারা, তাই আমি সহজ উদাহরণ বারবার রাখতে চেষ্টা করব, উদাহরণের, তুলনার সীমাবদ্ধতার কথা জেনেও। এই যে বললাম, উইথড্রয়াল— আর্টিস্ট সাধারণত ইনডালজেন্ট হয়ে থাকেন, আরও অনেক পরে গিয়ে সে এই উইথড্র করে নেওয়ার ম্যাচিওরিটি রপ্ত করেন, অনেক সময় খুব সক্ষম অভিনেতাও সারা জীবন পারফর্ম করেও ইনডালজ করতে থাকেন, উইথড্র করতে পারেন না। উদাহরণ— অমিতাভ বচ্চন, নানা পাটেকর, নওয়াজ উদ্দিন সিদ্দিকী, গৌতম হালদার। আর উইথড্র করে নেওয়ার সবচেয়ে এভেইলেবল উদাহরণ রঘুবীর যাদব, দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়। এটা ভালো খারাপের প্রশ্ন নয়, ঘরানার প্রশ্ন, অ্যাক্টিংকে অ্যাপ্রোচ করার প্রশ্ন। দুই ধারাতেই অবিস্মরণীয় অভিনয় সম্ভব। কিন্তু দ্বিতীয় ধারার অভিনেতা অপ্রতুল। স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত এই দ্বিতীয় ধারার অভিনয়ের সম্রাজ্ঞী। বললাম বটে কেয়ার ছেড়ে যাওয়া চরিত্রে মঞ্চে উঠতে, স্মৃতি টাটকা থাকতে থাকতেই আন্তিগোনে হয়ে ওঠার চ্যালেঞ্জ স্বাতীলেখা নিয়েছিলেন, কিন্তু আসলে স্বাতীলেখা সেনগুপ্তের মধ্যে এক অপূর্ব গ্রেস ছিল, যাকে ‘চ্যালেঞ্জ’ শব্দটা কিছুটা লঘু করে দেবে। স্বাতীলেখার অভিনয়ে কোনও ‘চ্যালেঞ্জ’ ছিল না, ইনডালজেন্স ছিল না, আন্তিগোনের বিষণ্ণতাকে যেন খুব আলগোছেই ধারণ করে নিতেন এলাহাবাদ থেকে কলকাতায় আসা বাঙালি মেয়েটি। মনে রাখতে হবে সমকালীন বাংলা থিয়েটারের শ্রেষ্ঠ অভিনয় শিক্ষক, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় তখন নান্দীকারে নেই। সমকালীন বাংলা থিয়েটারের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা, কেয়া সদ্য প্রয়াত, যাঁর ছেড়ে যাওয়া চরিত্র আন্তিগোনে! এ একেবারে নিজস্ব শিক্ষা স্বাতীলেখার। কেউ তাঁকে গড়েপিটে নেননি, আজ যে যাই দাবি করুক, কারণ স্বাতীলেখা তাঁর সব মেন্টরের চেয়ে অভিনয়কলার প্রয়োগে অনেক বেশি পারদর্শী। সিনেমা মাধ্যমটি মাস লেভেল পপুলার হওয়ার কারণেই বারবার ‘ঘরে বাইরে’ ছবিতে ওঁর অভিনয় প্রসঙ্গ উঠে আসছে, সেখানেও উনি সৌমিত্র-ভিক্টরের মত এস্ট্যাবলিশড অভিনেতার পাশে অনুপ্রাণিত অভিনয় করেননি। নিখিলেশ যখন, সন্দীপের অসাধু অভিপ্রায় উন্মোচন করছেন, তখন বিমলার চরিত্রে স্বাতীলেখার আসক্ত অথচ মিনিমালিস্ট অভিব্যক্তিটি স্মর্তব্য। এই অভিব্যক্তির হদিশ বা তল সত্যজিৎ দেন না, এমনকি রবীন্দ্রনাথও দেন না। ওই নির্মাণ এককভাবে অভিনেত্রীর, কিন্তু তা আরোপিত নয়, উৎসারিত।
অজিতেশ-পরবর্তী পর্বের নান্দীকারে প্রতিটি অভিনেতা অধিক মাত্রায় ম্যানারিজম আক্রান্ত। একমাত্র ব্যতিক্রম স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। একসময়, গৌতম হালদার যখন নান্দীকার জুড়ে বিরাজ করছেন, তখন অনেক নাটকে ত্রিশজন অভিনেতা থাকলে, ত্রিশজন গৌতম হালদার দেখছি বলে মনে হত। অথচ গৌতমের বাংলা থিয়েটারের শ্রেষ্ঠ কীর্তি, মাইকেল বিরচিত ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এর দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে, স্বাতীলেখার বেহালাবাদনের মসৃণ ভঙ্গিমাটি সুগন্ধি আতরের মত সারা প্রেক্ষাগৃহে ছড়িয়ে থাকত। এখন প্রযোজনাটি নান্দীকার থেকে অন্য দলে গেছে, গৌতম হালদারের সাথে সাথেই। গৌতম মঞ্চে সমকালের শ্রেষ্ঠ নট, তবু নতুন প্রযোজনায় ওই আতরের মৃদু গন্ধর মত স্বাতীলেখার প্রেজেন্সটা মিসিং। বাংলা থিয়েটারেই স্বাতীলেখা সেনগুপ্তর অনুপস্থিতি একটা ভয়েড তৈরি করবে। উনি যখন এক্সিট নিলেন, তখন মঞ্চ চালু নেই, মঞ্চ খুললে ওঁর অভাব আমাদের দরিদ্র থিয়েটারে প্রবলভাবে অনুভূত হবে। বিমলা তাঁর গয়নাগাটি সন্দীপের হাতে তুলে দিত, কিন্তু সে শুধু সন্দীপকে ভেবে নয়, দেশকে ভেবে। তেমনই স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত দরিদ্র থিয়েটারে তাঁর যে ঐশ্বর্য অকাতরে দিয়ে গেলেন, তাকে ব্যক্তি বা দলের লাভ-ক্ষতির হিসেবে সীমাবদ্ধ করা যাবে না। সে ঐশ্বর্য সামগ্রিকভাবে বাংলা থিয়েটারের।