স্টেশনমাস্টারের কলম
অতঃপর বেদব্যাস শোকবিহ্বলা সত্যবতীর নিকটে আসিয়া কহিলেন, মাতা সুখের দিন গত হইয়াছে, পৃথিবী বিগতযৌবনা, ক্রমশ পাপের বৃদ্ধি ঘটিবে…
(মহাভারত, আদিপর্ব, ১২২ অধ্যায়)
মাসান্তে চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম ওয়েবপত্রের প্রচ্ছদ-ভাবনার বিষয় নির্বাচন, আপাতদৃষ্টিতে, অতীব জটিল প্রক্রিয়া, সম্পাদকমণ্ডলীর শিরঃপীড়ার কারণ। রসিক পাঠকের আনুকূল্যে ইতিমধ্যে আমাদিগের ক্ষুদ্র উদ্যোগটির পঞ্চমবর্ষ অতিক্রান্ত। পুরাতন সংখ্যার পৃষ্ঠা নাড়িয়া-চাড়িয়া দেখিবার চেষ্টা করিতেছিলাম, আমাদের বিষয়ভাবনার মধ্যে অদ্যবধি কোনও ‘সাধারণ সূত্র’ রহিয়া গিয়াছে কি না। পাঠকের স্মরণে থাকিবে, গত মাসের প্রচ্ছদকাহিনিতে আমরা ফিরিয়া দেখিয়াছি মোদি সরকারের সপ্তম বর্ষপূর্তির ক্ষণটিকে, বাছিয়া লইয়াছি সর্বনাশের সপ্তপদী, অর্থাৎ বিগত সাত বৎসরে শাসকের দ্বারা রাষ্ট্রজীবন মথনকারী সাতটি ক্ষতির চিহ্নকে। বিগত বৎসর অর্থাৎ ২০২০ সালের একাধিক প্রচ্ছদভাবনার বিষয়, স্বভাবতই, অতিমারি; পুনরুক্তির ফাঁদ এড়াইয়া আমরা স্মরণ করিয়াছি অতিমারির সামাজিক রাজনৈতিক প্রভাব ও দীর্ঘমেয়াদী সঙ্কটের অভিমুখগুলিকে। একটি প্রচ্ছদকাহিনির বিষয় ‘মিডিয়ার গ্রাস’— পুঁজির পদতলে বিক্রিত সংবাদমাধ্যমগুলি কীভাবে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভটিকে প্রত্যহ দুর্বল ও ধ্বস্ত করিতেছে, তাহার সন্ধান করা হইয়াছিল তাহাতে। একটি সংখ্যায় আমরা স্মরণ-বিশ্লেষণ করিয়াছিলাম জন্মের দুইশত বৎসর পর বিশ্রুত দার্শনিক-সমাজবিদ ফ্রেডরিক এঙ্গেল্স-এর কীর্তির প্রাসঙ্গিকতাকে।
অতএব, শ্বাস-শব্দটি, এক্ষেত্রে, স্মরণ। পাঠক দ্বিমত হইতেই পারেন, কিন্তু পত্রিকার বিষয়ভাবনার পশ্চাদ্পটে সাধারণ সূত্র হিসাবে যে নিষ্কর্ষটি উঠিয়া আসিল— আমরা মূলত স্মরণ করিয়াছি, এবং স্মরণ করাইতে চেষ্টা করিয়াছি। কী স্মরণ করিয়াছি? আমরা বারংবার স্মরণ করিয়াছি আমাদের চারিপাশে ঘটিয়া চলা নানা ঘটনাবলির অন্তরালে বহমান অন্তর্লীন সঙ্কটকে। তাহা কখনও কেব্দ্রীয় শিক্ষানীতির ঘোষণাপত্রে উঁকি দেওয়া পুঁজি ও মুনাফার গোপন মুখ, কখনও তাহা অতিমারিকে শিখণ্ডী করিয়া প্রান্তিক নাগরিকদের রাষ্ট্র-কর্তৃক নির্লজ্জ শোষণ। যে অপ্রিয় কথাগুলি জনমোহিনী সংবাদমাধ্যমগুলি কদাপি উচ্চারণ করে না, বা তুচ্ছতার চর্চায় মাতিয়া ভুলাইয়া রাখিতে চাহে, তাহাই আমরা কতিপয় কৃষ্ণ অক্ষরে টুকিয়া রাখিতে চাই, পাঠককে স্মরণ করাইয়া দিই। অর্থাৎ বিস্মরণের বিরুদ্ধে, বলা ভালো, বিস্মরণের রাজনীতির বিরুদ্ধে আমাদের নিঃশব্দ বিক্ষোভ— এই অক্ষরমালা। অবশ্য কেবলমাত্র চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম এই দায়িত্বপালনে রত, এমন দাবি একইসঙ্গে ধৃষ্টতা ও বাতুলতার নামান্তর— প্রতিটি সমাজ-রাজনীতি-সচেতন গণমাধ্যমের কাজ সম্ভবত ইহাই।
এই ‘বিস্মৃতির বিরুদ্ধে লড়াই’-এর ধারাবাহিকতায় আমাদের জুলাই সংখ্যার সংযোজন— ক্ষত যত ক্ষতি তত। প্রসঙ্গত বলিয়া রাখি, এই ভাবনাটিকে দফতরের টেবিলে আনিয়া হাজির করিবার দায় অংশত ঘূর্ণিঝড় ইয়াস-এর। পূর্ব-সর্তকতা থাকায় এই ঝড়ে প্রাণহানির ঘটনা বিশেষ না-ঘটিলেও, দক্ষিণবঙ্গ ও ওডিশার তটবর্তী অঞ্চল তছনছ করিয়া গিয়াছে ইয়াস— গণস্মৃতিতে ফিরাইয়া আনিয়াছে বৎসরকাল পূর্বের আমফানের ভয়াবহ স্মৃতিকে। সহসা আমরা সচকিত হইয়া উপলব্ধি করিয়াছি, ভারতের পূর্ব উপকূলীয় বঙ্গোপসাগর, এমনকী একদা-শান্ত পশ্চিম উপকূলের আরবসাগরও ক্রমশ অস্থির, অতিমাত্রায় ঘূর্ণিঝড়-প্রবণ হইয়া উঠিতেছে। অকস্মাৎ যেন বড় বেশি উপদ্রবময় হইয়া উঠিয়াছে উপমহাদেশের জলবায়ু।
বলাই বাহুল্য, শুধু ভারত নয়, এ-হেন সঙ্কটের বিস্তার বৈশ্বিক। সারা পৃথিবীর জল-বায়ু-আকাশ-নদী-অরণ্য প্রতিনিয়ত তাহাদের চরিত্র বদলাইতেছে, কোনও-কোনও ক্ষেত্রে সে পরিবর্তন আর নিরাকরণযোগ্য নহে। যেমন, তথ্যপ্রমাণ বলিতেছে, অদূর ভবিষ্যতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে আমাদের দেশে মানুষের বসতি ও চাষযোগ্য ভূমির ১০ শতাংশ সমুদ্রগর্ভে বা নদীগর্ভে তলাইয়া যাইবার সম্ভাবনা। ইতোমধ্যেই পুনঃপুনঃ বন্যায় অসমের ৪০ শতাংশ ফসলি জমি অব্যবহারযোগ্যতার পথে। এই সম্পাদকীয় সন্দর্ভ রচিত হইবার সময়, তাহার আগে ও পরে, অর্থাৎ সর্বক্ষণই, বিশ্ব জুড়িয়া একের পর এক হিমবাহ ক্রমসঙ্কুচিত হইয়া আসিতেছে, যাহার অর্থ, ক্রমশ উত্থিত হইতেছে সমুদ্রপৃষ্ঠের জলস্তর। মেরুপ্রদেশ হইতে নামিয়া আসিয়া নরওয়ের আবর্জনা স্তূপে অসহায়ের ন্যায় ঘুরিয়া বেড়াইতেছে খাদ্যান্বেষী শ্বেতভল্লুক— গতবৎসরের এই সংবাদচিত্র সারা বিশ্বের নিকট এক চরম অশনিসঙ্কেত। এতদ্ব্যতীত হিমবাহগুলি বিশ্বের মিষ্ট জলের একমাত্র আধার। ভারতীয় উপমহাদেশে হিমালয়, কারাকোরাম এবং হিন্দুকুশ পর্বতের বিপুলসংখ্যক হিমবাহ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গলিতে শুরু করিয়াছে, যাহার ফলে গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রবল জলসঙ্কট ঘনাইয়া আসা শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা।
জলবায়ুর এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আমাদের সম্মুখে হাজির করিয়াছে সঙ্কটের একটি নূতন পরিভাষা— জলবায়ু শরণার্থী। কারণ, প্রকৃতির এই চরিত্রবদল তাহার খামখেয়ালমাত্র নহে, বরঞ্চ মানুষ নামক আপাত-বুদ্ধিমান অথচ লোভী ও স্বার্থপর এক প্রাণীর অবিমৃষ্যকারিতার ফলশ্রুতি। সেই অবিমৃষ্যকারিতার ফল প্রকৃতি যখন সুদসমেত ফিরাইয়া দেয়, তাহা ভোগ করিতে হয় আবিশ্ব মানুষকেই, কিন্তু প্রকৃতির রোষের সর্বপ্রথম শিকার প্রান্তিক মানুষজন— মূলত দরিদ্র জনজাতি। প্রসঙ্গত, জনজাতির মানুষেরা পৃথিবীর সর্বমোট জনসংখ্যার মাত্র ৪-৫ শতাংশ হইলেও ইহারাই পৃথিবীর ভূভাগের এক-চতুর্থাংশ রক্ষা করেন; আগলাইয়া রাখেন ১১ শতাংশ বনভূমি, ৮০ শতাংশ জৈববৈচিত্র্য ও সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ৮৫ শতাংশ। জাতিসঙ্ঘের ‘দ্য ওয়ার্ল্ড মাইগ্রেশন রিপোর্ট-২০২০’ এই আশঙ্কা করিতেছে যে, ২০৫০ সালের ভিতর ২০০ নিযুত প্রান্তিক জনজাতির মানুষ বাস্তুচ্যুত হইতে বাধ্য হইবেন। এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে এই মানুষগুলি বাস্তুহারা হইবার অর্থ প্রকারান্তরে তাহাদের আবাসভূমি যে বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড ও জলভাগ, তাহাকেই একপ্রকার অনাথ করিয়া তোলা। অর্থাৎ ইহা এক অন্তহীন বৃত্তাকার অলাতচক্রে চংক্রমণ, অন্তিমে সামূহিক সর্বনাশ ভিন্ন যাহার অপর কোনও পরিণতি নাই।
আমাদের আপাতশান্ত যাপনের নিম্নে বাজিয়া চলা অমোঘ সময়বোমাটির দিকে নজর ফিরাইতেই চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর জুলাই সংখ্যার প্রচ্ছদকাহিনি— ক্ষত যত ক্ষতি তত।
আমাদের সৌভাগ্য, এই আবিশ্ব সঙ্কটের নানা দিক লইয়া আলোচনা করিতে চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম্নের এই ক্ষুদ্র অথচ গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগে সামিল হইয়াছেন অমিতাভ আইচ, জয়িতা রায়চৌধুরী, বিবর্তন ভট্টাচার্য ও মৃণাল মুখার্জী। সঙ্কটের রেখচিত্র ও তাহা হইতে উত্তরণের পথ খোঁজা সফল হইল কি না, সে বিচারের দায় পাঠকের।
ইহার সহিত সম্প্রতি যে সকল কৃতকৃত্য মানুষেরা আমাদিগকে ছাড়িয়া গিয়াছেন, তাঁহাদিগের মধ্যে আমরা স্মরণ করিলাম ফাদার স্ট্যান স্বামী, মিলখা সিং, স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত, দিলীপকুমার, কবি গৌতম বসু, সমাজকর্মী শর্মিষ্ঠা চৌধুরী ও লেখক প্রবীর গঙ্গোপাধ্যায়কে।
স্টিম ইঞ্জিন বিভাগে পুনঃপ্রকাশিত হইল কবি ও চলচ্চিত্রকার বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত-এর একটি পুরাতন সাক্ষাৎকার।
এছাড়াও রহিল কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, বিশেষ নিবন্ধ, ধারাবাহিক রচনা, অনুবাদ সাহিত্য, ফটোফিচার, অন্যগদ্য এবং অণুগল্পের ন্যায় আমাদের অন্যান্য নিয়মিত বিভাগগুলি। থাকিল হুইলার্স স্টল, ডিসট্যান্ট সিগনাল এবং ভালো খবর-এর মতো বিশেষ বিভাগগুলিও।
পড়িবেন, ভাবিবেন, স্মরণ করিবেন, এবং, অত্যবশ্য, মতামত দিবেন।
চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষে,
দেবব্রত শ্যামরায়
১০ জুলাই ২০২১