সেই ছেঁড়া পোস্টার

বিপ্লব

 

মাঝে মাঝেই নানারকম দূষণের ফলে সৃষ্ট আতঙ্ক আমাকে তাড়া করে বেড়ায়।মাস খানেক আগে ‘SBI lowbalance’ আতঙ্ক আমার পিছু নিয়েছিল। SBI এর সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে,কোনোমতে মুক্তি পেয়েছিলাম। বিগত দিন দুই ধরে আমাকে ‘পূজাআতঙ্ক’ তাড়া করে বেড়াচ্ছে। আমার ভাষায় একে ‘দূর্গাফোবিয়া’ বলে। ডাক্টারের ভাষায় কী বলে জানিনা। নেট খুললেই ‘শুভ অষ্টমীর শুভেচ্ছা’।জানিনা কোন মহান ব্যাক্তি এত খেটেখুটে এই ছবিগুলি বানান। টিভিতে খবরের চ্যানেল খুললেই, ‘অমুক পাড়ার বাজেট এত। তমুক বাড়ির পূজো ১৫০ বছর পূর্ণ করলো। ‘ আবহাওয়ার চ্যানেলে, ‘ অষ্টমীর বিকেলে হালকা বৃষ্টি হতে পারে। ‘ অন্যসব চ্যানেলে সিনেমার হিরো,হিরোহিন রা ৩২টি দাত দেখিয়ে বলেচলেছে, ‘ সপ্তমীর দিনে এটা পরলে স্মার্ট লাগবে। নবমীতে এটা পরবেন। ‘

এদেরকে নকল করতে গিয়ে মধ্যবিত্রদের ভাতের হাঁড়ি বেচে যাওয়ার যোগাড়। প্রেমিকদের অবস্থা যত কম বলা হয় ততই ভালো। আমার বাবু ওসবের বালাই নেই। গ্রামের থেকে একটু দুরে জঙ্গলের ধারে হারুদার চা দোকানে, পূজোর কটাদিন হোলটাইম কাস্টমার পদে দ্বায়িত্ব নিয়েছি। ইলেট্রিক লাইনের ভাঙা পিলার ও বাঁশের খুটি, মাথার উপর পচা খড়ের ছাওনি।চালের উপর এতধরনের ছাতু ফুটে আছে কোনো ‘বটানিবিদ’ সারাজীবন ছাতুনিয়ে গবেষনা করতে পারবেন। বড়ো বোল্ডারগুলির উপর ভাঙা ইলেট্রিকের পিলার ফেলে বসার জায়গা হয়েছে। এইটি হচ্ছে হারুদার চায়ের দোকান। খদ্দের বলতে মূলত, আশেপাশের আদিবাসী গ্রামগুলি থেকে সাইকেলের সীটে পুরুষ, পিছনে মহিলা, হাতে ঝুড়ি ও কোদাল নিয়ে কাজে যাওয়ার সময় এককাপ চা ও চপ খেয়ে যায়। এখানে পূজা দূষণের বালাই নেই। এককাপ চা নিচ্ছি আর একটার পর একটা ‘wbp’ বার করছি। আর নির্বাক শ্রোতা হয়ে মানুষের গল্প শুনছি তবে এখানে সবজান্তা ব্যাক্তিদের সংখ্যা হাতেগোনা। আজকে চা খেতে গিয়ে দেখি দোকানের দেওয়ালে কে বা কারা পোস্টার মেরেছে।

“দান নয়, ভিক্ষা নয়
অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা পাওয়া,
আপনাদের অধিকার।
আপনারা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন বলে,
বখসিস বা পয়সা ছুড়ে অপমান করার অধিকার ওদের নেই।”

ঠিক তার পাশেই আর একটি পোস্টার, “আপনারা ভালো রকমেই অবগত আছেন যে, ইদানিং গ্রামগুলিতে চোলাই মদের ব্যাবসা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রশাসনের তরফ থেকে ব্যাবসা বন্ধ করার কোনো ইতিবাচক ভুমিকা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। তাহলে কি আমরা ধরে নেবো সরকারি আমলারা, চোলাই মদ দোকানির থেকে মাসোহারা পায় বা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মাইনে নেয়।” বাকিটা পড়া যাচ্ছে না কেউ ছিঁড়ে ফেলেছে। আমি একদৃষ্টি পোস্টারের দিকে চেয়ে আছি দেখে,হারুদা এককাপ চা এনে বলল, ” কালকে সন্ধ্যায় দোকান বন্ধ করার সময় থাকেনি। রাত্রে কেউ মেরে থাকবে। সকালে ছাতু কুড়াতে আসা কতকগুলি ছেলে পোস্টারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে দেখেই, ‘মার মার ছুট’। ওরাই ছিঁড়ে থাকবে। তা কি লেখা আছে? ”

“পড়েই দেখো না “,দেওয়ালের দিকে আঙুল বাড়িয়ে বললাম। “আমি মূর্খ্যসূর্খ্য মানুষ। তোমরা সব শিক্ষিত ছেলে। “, বলে বানান করে করে পড়তে লাগল। হুম, শিক্ষিত’ই বটি। ইংরেজি’টা চারবার লাগলেও বাংলা’টা একবারেই পড়তে পারি। শাহজাহানের চোদ্দগুষ্ঠি’র ঝামেলা থেকে শুরুকরে জাপানের রাজধানী ঠোটে লেগে থাকে। ইংল্যান্ডের ‘পাউন্ড’ থেকে ভিয়েতনামের কারেন্সি, হাতের তালু ঘষে বলেদিতে পারি। আমেরিকা ও উত্তরকোরীয়ার ঝামেলা বলা, আমার এক কাপ চায়ের চুমুকের ব্যাপার। এখন যদি আমাকে আর হারুদা’কে আলাদা ভাবে নির্জন স্থানে বছর দশেকের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়। অশিক্ষিত হারুদা ঠিক চাষের জন্য জমি খুঁজে চাষ করতে পারবে। গাছের ডাল দিয়ে লাঙ্গল বানাতে পারবে। লতাপাতা দিয়ে থাকার জন্য বাড়ি বানাতে পারবে। কোনো বন্য মুরগী কে প্রতিপালন করে খাবারের সংস্থান করতে পারবে। আর এই ‘শিক্ষিত’ পেটে গামছা বেঁধে ‘মোঘল সাম্রাজ্য আর জাপানের প্রধানমন্ত্রী’কেই খুঁজে বেড়াবে। যতদিন না শিক্ষাকে জীবনমুখী করা হবে ততদিন আমার মতো ‘শিক্ষিতই বটি’ গন্ডায় গন্ডায় তৈরি হবে। চিন্তা ভাবনা আর এগোলো না ,একটি লাল রং-এর জাইলো গাড়ি আমাদের সামনে এসে পার্কিং করলো। ভেতর থেকে একজন ভদ্রলোক বছর পাঁচেকের একটি ছেলের হাত ধরে, আমাদের সামনে এসে ব্যাস্ত ভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, “দাদা বিবড়দা যাওয়ার রাস্তা কোনটা। ” হারুদা’কে সাইড করে আমি পা ঠুকে বললাম, “এইটা দিয়ে চলে যান। সোজা বিবড়দা’য় উঠবেন।”

“থ্যাংকস”বলেছেলের দিকে ঘুরে বললেন,” দেখ অর্ক কতবড়ো ফরেস্ট।”

আমিও ঘুরে দেখলাম ফরেস্ট’কে, গোটা পঞ্চাশেক কাজুবাদাম গাছ আর গোটা কুড়ি ইউক্যালপটাশ গাছ যদি ফরেস্টের মর্যাদা পায়। পরবর্তী প্রজন্মে একটা কলাগাছও দাঁত কেলিয়ে ফরেস্টের সার্টিফিকেট গলায় ঝোলাবে। ইতিমধ্যে ছেলেটি বায়না জুড়েছে,”ড্যাডি আমি ফরেস্টের ভেতরে যাবো। আমাকে নিয়ে চলোনা। ”

“না সোনা! চারদিন ধরে তুমি একটি পাতাও পড়োনি। আগের বার মার্কস কম আসার পর ম্যাডাম কি বলেছিলেন মনে আছে। পুরো হোম ওর্য়াক বাকি আছে।”

ছেলে সমানে বায়না চালিয়ে যাচ্ছে। শেষমেষে বাধ্য হয়ে বাবা বললেন, ” ঠিক আছে নিয়ে যাচ্ছি তবে ‘জনি জনি ‘ ছড়াটা বলতে হবে। ”
বাবার হাত ধরে ছেলে ফরেস্টে চলেগেল, পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছিলাম,

ছেলে বলছে,” বাবা এটা কি ট্রি? ”

বাবা বলছেন, ” সোনা জনি জনি কবিতা’টি একবার বলো। না বললে চলে যাবো বলছি।”

শিক্ষার কি হাল। একটা ছেলে বই থেকে যত না শেখে তার থেকে কয়েকগুণ বেশি শেখে পরিবেশ থেকে। সত্যি, কতকিছু শেখাতে পারতেন। কাজুবাদাম ফল নয় বীজ। একটা গাছকে জড়িয়ে আর একটা গাছ কীভাবে বাঁচে? ছাতু কোথায় পাওয়া যায়? ইউক্যালপটাশ গাছের নীচে অন্য গাছ জন্মাতে পারে না কেন? জঙ্গলকে ঘিরে কীভাবে এখানের মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে? আর অনেক কিছু শেখাতে পারতেন তিনি কিন্তু ছেলেকে ‘জনি জনি ‘ মুখস্ত করিয়ে ছাড়বেন। আসলে দোষ ওনার নয়, কর্পোরেট’রা চায় লেখাপড়া শিখে মানুষ নয় যন্ত্র তৈরী হোক। যারা নীরবে ওদের স্বার্থে কাজ করবে। এই কর্পোরেটরাই ঠিক করে দেয়, একটা শিশু কি শিখবে কি বাদ দেবে। ঔই ভদ্রলোক টেন্ড ফলো করছেন মাত্র। যে দাড়িওয়ালা বুড়ো’টা এই কাট্টাখোট্টা শিক্ষার প্রতি বিরক্ত হয়ে প্রকৃতির মধ্যে শিক্ষাদানের জন্য ‘শান্তিনিকেতন’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তারই জন্মদিনে হয়তো ঔই ভদ্রলোক ছেলেকে দিয়ে ‘ওরা কাজ করে’ কবিতা’টি আবৃতি করাবেন। আমি তখনও শুনতে পাচ্ছিলাম ছেলেটি গোমড়া মুখ করে বলছে, “জনি জনি “

Be the first to comment

আপনার মতামত...