সত্যব্রত ঘোষ
প্রাবন্ধিক, চলচ্চিত্রবেত্তা
গত ২১ জুন সিনেম্যাটোগ্রাফ (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল ২০২১-এর খসড়া প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক জানিয়ে দেয় ২ জুলাই, ২০২১ অবধি এই খসড়া বিষয়ে মন্তব্য প্রকাশ করতে পারবে জনসাধারণ। সময়সীমা অতিক্রম হলেও এই বিষয়ে কিছু কথা বলবার অবকাশ রয়েই যায়। বিশেষ করে, করোনা ভাইরাসের ভয়ঙ্কর দাপটে যখন অক্সিজেন, ওষুধ এবং প্রতিষেধকের জোগান ও সরবরাহ নিয়ে সরকারের নাস্তানাবুদ হওয়ার কথা, তখন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের এই অতিসক্রিয়তা দুশ্চিন্তারই উদ্রেক করে।
অবশ্য শুধু তথ্যমন্ত্রকই কেন, বশংবদ বাহুবলীর মতো কেন্দ্রীয় সরকারের অন্যান্য বাহুগুলিও ডেলটা প্লাস ভ্যারিয়েন্টের ভয় উপেক্ষা করে প্রধান সেবকের ইচ্ছাপূরণ অথবা আশঙ্কা দূর করতে সমানভাবে সচেষ্ট। বস্তুত, করোনা অতিমারি, লকডাউন এবং বিভিন্ন সতর্কবিধির আড়ালে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকার যে পরিকল্পনাগুলিকে কার্যায়িত করতে চাইছে তাতে সাধারণ দেশবাসীর সাংবিধানিক অধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্বের চেষ্টা প্রকট। নাগরিক সংশোধনী আইন, কৃষি আইন ইত্যাদির ধারাবাহিকতা মেনেই তাই সিনেম্যাটোগ্রাফ (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল ২০২১-এর খসড়াটি জনসমক্ষে এসেছে।
এই বিলটিতে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক প্রস্তাব দিচ্ছে যে সিনেম্যাটোগ্রাফ অ্যাক্ট (১৯৫২)-র ৫খ ধারায় নির্দেশিত নিয়মগুলি মেনে এ যাবত সেন্সর সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়েছে, সেখানে কোনও ‘উল্লঙ্ঘন’ ঘটে থাকলে তা মোকাবিলার জন্যে এই সরকারকে সিদ্ধান্ত সংশোধনের ক্ষমতা দেওয়া হোক। অথচ দেখা যাচ্ছে, যে কোনও সিনেমার সার্টিফিকেট সংক্রান্ত সব নথি পরীক্ষার এক্তিয়ার ইতিমধ্যেই এই আইনের ৬ ধারায় সরকারকে দেওয়া রয়েছে। তবুও মন্ত্রকের আবদার আলোচ্য সংশোধনীটির দ্বারা “সরকারকে পরিস্থিতি সাপেক্ষে (সার্টিফিকেশন) বোর্ডের সিদ্ধান্তকে পাল্টে দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হোক।”
আবদারের ফর্দতে সিনেম্যাটোগ্রাফ অ্যাক্ট (১৯৫২)-র এই ৬ নম্বর ধারাটিতে নতুন একটি উপধারা যোগ করার কথাও বলা হয়েছে যার সুবাদে আরেকটি ক্ষমতা চায় সরকার। ইত্যাবধি ৫খ ধারা অনুসরণ করে যে ছবিগুলিকে সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে, সেগুলির কোনওটি যদি এই সরকারের ভাবমূর্তির বিরুদ্ধে যায়, তাহলে সার্টিফিকেশন বোর্ডের সভাপতি পুনরায় ছবিটি সার্টিফিকেট পাওয়ার যোগ্য কি না তা ৬খ নামক নতুন উপধারা মাফিক বিবেচনা করবেন। অর্থাৎ, পুরনো একটি ছবি— যেমন ধরা যাক, ১৯৯২ সালে আনন্দ পটবর্ধন নির্মিত ‘রাম কে নাম’ তথ্যচিত্রটি সেন্সর সার্টিফিকেট পেয়েছে। কিন্তু আসন্ন উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে ছবিটি প্রধান সেবক এবং অযোধ্যা মন্দিরের ধ্বজাধারীদের অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অতএব নতুন করে ছবিটিকে সেন্সর সার্টিফিকেট দেওয়া হবে কি না তা বিবেচনা করবেন সার্টিফিকেশন বোর্ডের সভাপতি।
কুযুক্তির এই জাল বিস্তার করে সরকার প্রস্তাব দিয়েছে এযাবৎ সেন্সর সার্টিফিকেটে যে দশ বছরের মেয়াদ দেওয়া আছে, তা তুলে দেওয়া হোক। তার পরিবর্তে নতুনভাবে সার্টিফিকেশন বোর্ড যে সার্টিফিকেট জারি করবে, তা হবে ‘চিরস্থায়ী’। আদুর গোপালকৃষ্ণের মতো প্রতিষ্ঠানবিরোধী বরিষ্ঠ চিত্রপরিচালক যে সেন্সর ব্যবস্থার এই নতুন অবতারকে ‘সুপার সেন্সর’ বলে সমালোচনা করবেন, তা স্বাভাবিক। প্রসঙ্গক্রমে, ছবির সেন্সর সার্টিফিকেট পাওয়া সংক্রান্ত সমস্যায় চিত্রনির্মাতারা যে ফিল্ম সার্টিফিকেট অ্যাপেলেট ট্রাইবিউনাল-এ এতকাল আবেদন করতে পারতেন তা ট্রাইবিউনাল রিফর্মস অর্ডিন্যান্স ২০২১ জারি করে এপ্রিল মাসেই তুলে দেওয়া হয়েছে। সেন্সর প্রসঙ্গে আদুর গোপালকৃষ্ণ উক্ত বিশেষণটিকে এই পরিপ্রেক্ষিতেও দেখা প্রয়োজন।
এই খসড়া বিলের প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকে মুম্বাই ও দক্ষিণ ভারতের চিত্রপরিচালক ও অভিনেতাদের যে ১৪০০ স্বাক্ষরসম্বলিত অনলাইন চিঠিতে স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে যে এই ধরনের পদক্ষেপ ‘অভিব্যক্তির স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক প্রতিবাদের ক্ষেত্রে সর্বনাশের’ কারণ হবে। সেই বিষয়ে আরও কিছু বলবার আগে ওই খসড়া বিলের প্রস্তাবটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশটি নিয়ে উল্লেখ করা প্রয়োজন।
ছবির সেন্সরের ক্ষেত্রে আমরা সাধারণত তিন ধরনের সার্টিফিকেট দেখতে অভ্যস্ত— সব বয়সের জন্যে ‘U’, অভিভাবকদের তদারকিতে ১২-অনুর্ধ্ব শিশুদের প্রদর্শনযোগ্য ‘UA’ এবং শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ‘A’। খসড়া প্রস্তাবে বলা হচ্ছে নতুন আরও তিনটি বয়স-ভিত্তিক U/A 7+, U/A 13+ এবং U/A 16+ শ্রেণিকরণ করা হোক। করোনা অতিমারির সময়ে লকডাউন জারি হবার পর অনলাইন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলির জনপ্রিয়তা অনেকগুণ বেড়ে যায়। এবং সেই জনপ্রিয়তার উপর নির্ভর করে অনেকগুলি সিনেমার বাণিজ্যিক মুক্তিও ঘটছে ওটিটিগুলিতে। সেই সিনেমাগুলি ছাড়াও বেশ কিছু ধারাবাহিকও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলিতে স্রোতস্বিনী, যা বর্তমান সরকারের চোখে আপত্তিজনক।
একথা তো ঠিক, দীর্ঘ একশো বছরের বেশি সময় ধরে সাধারণ ভারতীয় দর্শকদের যে তথাকথিত ‘শালীনতা’র মোড়কে বাণিজ্যিকভাবে সিনেমা দেখাতে অভ্যস্ত করে তোলা হয়েছে, অনলাইন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলিতে তা অনেকটাই অনাবৃত। ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক পরম্পরা অনুসরণ করে যে সেন্সর ব্যবস্থার দ্বারা সরকার ও প্রশাসন এতকাল ছবির বাণিজ্যিক প্রদর্শনকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল, তাতে কর্তৃপক্ষের সাবেক চোখরাঙানিকেই একমাত্র অব্যর্থ উপায়টুকুই সম্বল। ডিজিটাল যুগে চিত্রপ্রেক্ষণ পদ্ধতির আমূল পরিবর্তনের ফলে এবং প্রযুক্তির চিহ্নমাত্র না থাকবার ফলে কিন্তু নিয়ন্ত্রণের সেই চিরাচরিত প্রথা তেমন কার্যকর নয়। বিশেষ করে অতিমারির সময়ে আন্তর্জাতিক ওটিটি-গুলিতে ভারতকেন্দ্রিক যা দেখানো হচ্ছে, তার ‘আপত্তিজনক’ অংশ জবরদস্তি বাদ দিতে না পারার ক্ষোভ থেকেই এই নতুন বয়সভিত্তিক শ্রেণিকরণের প্রস্তাব।
সেন্সরব্যবস্থার অসাড়তার সুযোগ নিয়ে কিছু ক্ষেত্রে যে অপব্যবহার ঘটেছে, তা অনস্বীকার্য। কিন্তু সরকারের ‘আপত্তি’ তো শুধু যৌনকেন্দ্রিক বা ‘উস্কানিমূলক’ বিষয় ঘিরেই নয়। তার উদ্দেশ্য আরও গভীর এবং সুদূরপ্রসারী। যে দমনমূলক মানসিকতায় স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতে বই, নাটক ও সিনেমায় জাতীয়তাবাদী অভ্যুত্থানের গন্ধ পেলেই যেভাবে উদগ্র শাসকের লাঠি ‘স্পর্ধা’-কে আক্রমণ করত, স্বাধীনোত্তর ভারতে যে মানসিকতায় জরুরি অবস্থার প্রতিবাদে বানানো ছবি ‘কিসসা কুর্সি কা’-র নেগেটিভকে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেই মানসিকতা নিয়েই বর্তমান সরকার সেন্সর প্রথা ব্যবহার করে সারা দেশ জুড়ে চলা বৈষম্যগুলি বিষয়ে প্রশ্নের অভিমুখগুলিকে স্তব্ধ করতে চাইছে। বিভাজনদীর্ণ, জাতপাতমূলক যে রাজনীতিতে দেশ আজ অতিষ্ঠ, সেই রাজনীতিকে সিনেমার ভাষায় আর সমালোচনা করা চলবে না। যে ধর্মীয় মেরুকরণ আজ ভারতীয় সমাজব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রকট, সেই মেরুকরণের বাস্তব চিত্র সিনেমা বা ধারাবাহিকে দৃশ্যায়িত করা যাবে না। কর্পোরেট সংস্কৃতির প্রাবল্যে দেশের বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয় উপাদান ও সংস্কৃতির বিনাশ ঘটলেও তা সিনেমার বিষয় হবে না। এগুলি নিশ্চিত করাই বর্তমান সরকারের অন্যতম এক অগ্রাধিকার। চিত্রমাধ্যমের দ্বারা শাসনব্যবস্থার অন্যায্যতা বিষয়ে স্বাধীন কোনও বক্তব্য দর্শকদের অন্তরে প্রবেশ করে প্রতিরোধ না গড়ে তোলে। এবং ইতিমধ্যে তা ঘটে থাকলে, অবিলম্বে সেগুলিকে জনমানস থেকে বিস্মৃতির ব্যবস্থা হোক। সিনেম্যাটোগ্রাফ (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল ২০২১-এর খসড়াটি সেই লক্ষ্য নিয়েই রচিত।
সংবেদনশীল ও প্রতিবাদী যে চিত্রপরিচালকেরা বর্তমানের এই জটিল সামাজিক পরিস্থিতিকে নিজেদের ছবিতে ফুটিয়ে দর্শকদের ভাবাতে চান, স্বাভাবিকভাবেই এই খসড়া বিলটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর। দিবাকর ব্যানার্জি-র কথাই ধরা যাক। ২০২০-তে নেটফ্লিক্স-এ মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ঘোস্ট স্টোরিস’-এর চারটি ছবির একটি ‘মনস্টার’। যে গ্রামটিকে আমরা ছবিটিতে দেখি সেখানে জীবিত রয়েছে শুধুমাত্র দুটি শিশু। বাদবাকি সবাইকে শহরবাসীরা খেয়ে ফেলেছে। আপাত-অসম্ভব নরখাদকদের কথা বলে দিবাকর ব্যানার্জি যেভাবে কাশ্মিরের ইন্টারনেট-ব্লকেড, উত্তর ও মধ্য ভারতের ‘অনার কিলিং’ এবং অন্যান্য সামাজিক বৈকল্যের অনুষঙ্গ রচনা করেন তা যেমন বিবমিষা জাগায়, পরাবাস্তবতার সঙ্গে সমকালীনতাকে জুড়ে বাস্তবতার নানা স্তরকে তেমন দর্শকদের সামনে তুলেও ধরে।
চিত্রভাষার এই সুচারু শক্তি বিষয়ে শুধু যে যুক্তিনিষ্ঠ প্রতিবাদমুখর চিত্রনির্মাতারাই অবহিত এমনটা নয়। জনবিরোধী বিভিন্ন অপ্রিয় এবং প্ররোচনামূলক ঘটনা ঘটিয়ে ক্ষমতা অর্জন করা রাজনীতির নেতারাও জানেন চিত্রমাধ্যমে তাঁদেরই কীর্তিকলাপ বিভিন্ন অনুষঙ্গে নথি হিসেবে ইতিহাসে রয়ে যাবে। তাই নীরব থেকেও যদি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এই ধরণের প্রতিবাদী চিত্রপ্রয়াসের উদ্যোগকে ইতিবাচক সঙ্কেত দেওয়া হয়, তাহলে মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে সাধারণ মানুষদের মনে রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি যতটুকু প্রথাগত সম্ভ্রম অবশিষ্ট আছে, তা নিয়েও অচিরে টানাটানি শুরু হয়ে যাবে। এমতাবস্থায় বর্তমান সরকারের ইচ্ছা নেই সিনেমার মধ্যে দিয়ে সৃজনশীল সংবেদনশীলতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য প্রকাশের পরিসরটুকুর বিস্তৃতি ঘটুক।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের দায়িত্ব প্রকাশ জাভড়েকরের হাত থেকে কেড়ে সম্প্রতি অর্থ দপ্তরের পূর্বতন প্রতিমন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুরকে দেওয়া হয়েছে। অর্থনীতি বিষয়ে উনি তেমন উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারেননি বটে। তবে সদ্য পাওয়া এই দপ্তরটিকে দিয়ে প্রধান সেবকের বার্তা প্রচারে উনি যথেষ্টই সক্ষম। বার্তাটি সরল। কর্পোরেটদের দাক্ষিণ্যে আদৌ যদি সিনেমাকে টিকে থাকতে হয়, তাহলে তা থাকুক মাপসই মনোরঞ্জনের মাধ্যম হয়ে। রাষ্ট্রের দায়িত্বে থাকা বর্তমান সরকারের ভাবাদর্শ বা কার্যকলাপকে যেন কখনোই না প্রশ্ন করে চিত্রমাধ্যম। আকর্ষণী মনভুলানো রঙের মতো সেই অপ্রাপ্তবয়স্কসুলভ ছবিগুলিতে ঘৃণা, হীনতা, হিংসা বা ক্রোধের উপস্থিতি থাকলে থাকবে। তবে সেই আগুনকে কিন্তু শেষে অবিনাশী প্রেমের জোয়ারে প্রশমিত হতেই হবে।