সুশোভন ধর
রাজনৈতিক কর্মী, রাজনৈতিক ভাষ্যকার
বিশ বছর। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যার নাম দিয়েছিল ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’, সেই আফগানিস্তান আক্রমণের কুড়ি বছর পর মার্কিন ফৌজ অবশেষে সে দেশ থেকে সরে আসছে। এই ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শব্দবন্ধটি, বলা বাহুল্য, মার্কিনরা আমদানি করেছিল তাদের সেই হানাদারিকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য। বর্তমানে আফগানিস্তান থেকে ফৌজ সরিয়ে আনার যে সিদ্ধান্ত জো বাইডেন নিয়েছেন, তাতে এটা স্পষ্ট যে তাঁর দেশের ইতিহাসের দীর্ঘতম যুদ্ধটিতে শেষমেশ মার্কিনিদের পরাজয়ই স্বীকার করতে হল। সাম্রাজ্যবাদী সমরপিপাসুরা এই বিষয়টি স্বীকার করতে না চাইলেও তাদের এই ব্যর্থতা পরিষ্কার করে দিচ্ছে যে দুনিয়াটাকে নিজের মর্জিমাফিক বানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা মার্কিনিদের নেই। এই দু দশকের দখলদারির সময়কালে ওয়াশিংটন আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক কি স্থানীয় কোনও ক্ষেত্রই ঠিক করে সামলাতে পারেনি, যার ফলে তথাকথিত শান্তিস্থাপন প্রক্রিয়া এক চূড়ান্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। ২০০৪-এর পর থেকে আফগানিস্তানের গ্রামাঞ্চলগুলিতে একদিকে মার্কিন দখল শিথিল হতে থাকে, এবং অন্যদিকে তালিবান গেরিলারা নিজেদের শক্তিবৃদ্ধি করতে থাকে দ্রুত লয়ে। ওয়াশিংটন সবরকম চেষ্টা করেছে। ট্রিলিয়ন ডলারের ত্রাণ প্রকল্প চালিয়েছে, নতুন করে এক লাখ সেনা মোতায়েন করেছে, কয়েক বিলিয়ন ডলারের মাদক যুদ্ধ চালিয়েছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। এমনকি এখনও— এই বিজিত পশ্চাদপসরণের মাঝেও— কেন যে এই চার দশক ব্যাপী সংঘাতে শেষমেশ তাদের পরাজয়ের কলঙ্ক মাথায় নিতে হল সে নিয়ে সরকারিভাবে ওয়াশিংটন এখনও ধন্দে।
বহিরাগত আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অপসারণ নিঃসন্দেহে সুখবর। কিন্তু এর ফলে আফগানিস্তানে ক্ষমতার কেন্দ্রে একটা শূন্যতা তৈরি হবে এবং সেই শূন্যতা ভরাট করতে এই যুদ্ধদীর্ণ দেশটি আবার এক রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হবে এমন আশঙ্কা অমূলক নয়। আর সেই গৃহযুদ্ধের ফলাফল যে পুরোপুরি তালিবানের পক্ষেই যেতে চলেছে এ সম্পর্কেও প্রায় সবাই নিশ্চিত। এবং তা হলে সেটা প্রকৃতই আশঙ্কার কথা।
আফগানিস্তানকে যাঁরা চেনেন তাঁদের স্মৃতিতে তালিবানি শাসন এখনও ফিকে হয়ে যায়নি। সেই ইসলামি আমিরাত, সেই আদিমকালের শরিয়তি শাসন…। সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিদেশি সেনা পুরোপুরি সরে যাওয়ার আগে যদি একটি রাজনৈতিক সুস্থিতি কার্যকর না-করা যায়, তবে সেই তালিবানি জমানা আমাদের তাড়া করে ফিরবেই। মনে রাখতে হবে, হাতে আর মাত্র দু মাস সময়।
যদি কোনও চুক্তি না হয় শেষ পর্যন্ত, তবে কি তালিবান জমানার সেই অন্ধকার দিনগুলিই আবার ফিরতে চলেছে? কিছু মানুষ মনে করেন, তালিবান আর তাদের অতীতের রাস্তায় হাঁটতে পারবে না। এই গত দু দশকে তারা আমেরিকার সঙ্গে একটা চুক্তিতে এসেছে; চিন, রাশিয়া, ইরান এবং অতি অবশ্য পাকিস্তানের সঙ্গেও তাদের মতবিনিময় চলছে। ভারতও তালিবানের সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি করেছে। কিন্তু এত সবের পরেও মাথায় রাখতে হবে যে তালিবানের মধ্যেও ভাগাভাগি এবং গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব আছে, অতএব সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে কোনও একটা ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তে আসা তাঁদের পক্ষে মুশকিল। আর এখানেই সর্বনাশের গোড়াপত্তন। গোষ্ঠীগুলো একে অপরকে টেক্কা দিতে চেয়ে কদর্যতার প্রতিযোগিতায় নামতে পিছপা হবে না।
তালিবানরা প্রথম দফায় ক্ষমতায় থাকাকালীন মেয়েদের কোনও পুরুষ সঙ্গী (পড়ুন রক্ষী) ছাড়া রাস্তায় বেরোনো নিষেধ ছিল। মেয়েদের পড়াশোনা শেখা নিষিদ্ধ ছিল। গানবাজনাকে অ-ইসলামীয় আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তালিবানরা বিশেষত শহরাঞ্চলগুলিতে একটা সাধারণ সন্ত্রাসের আবহ তৈরি করেছিল। যাবতীয় নৃশংসতাকে বিনোদনের মোড়কে পেশ করা হত, এবং হিংস্র মনোভাবাপন্ন মানুষজন সেগুলি দেখে পৈশাচিক আনন্দ পেত। সোভিয়েতপন্থী প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট নাজিবুল্লার কথা মনে হয় কেউই ভুলে যাননি। সে সময় যদিও তালিবান ছিল না— নাজিবুল্লাকে ধাওয়া করেছিল মুজাহিদিন যোদ্ধারা। নাজিবুল্লা বাঁচার জন্য কাবুলের রাষ্ট্রপুঞ্জের দপ্তরে গিয়ে ঢোকেন, কিন্তু সেখান থেকেই তাঁকে টেনে বের করে হত্যা করা হয়। তাঁর মাথা কেটে ল্যাম্পপোস্টে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। প্রতিহিংসামূলক হত্যাকাণ্ড সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেই স্মৃতি স্মরণে রেখেই বলা যায় বর্তমানের সরকারি কেষ্টবিষ্টুদের ভবিষ্যতও কিন্তু খুবই অনিশ্চিত। কারণ, ইতিমধ্যেই তাঁদের বিশ্বাসঘাতক বলে দেগে দেওয়া হয়েছে।
আশাবাদীরা ভাবছেন সেই অন্ধকার যুগ আর ফিরবে না। অনেকেই বলছেন যে, গত কুড়ি বছরে আফগানিস্তানে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। মানুষ মুক্তির স্বাদ পেয়েছে। ফলে তাদের আর অবরুদ্ধ করা যাবে না। আন্তর্জাতিক দুনিয়াও সেরকম পরিস্থিতি আর হতে দেবে না। এলাকায় মার্কিন এবং ন্যাটো বাহিনির উপস্থিতি রাখারও একটা আলোচনা হচ্ছে। যাতে আল কায়দা বা আইসিস আর ঘাঁটি গেড়ে না বসতে পারে। এ সবের ওপর নজর রাখার জন্য প্রতিবেশী পাকিস্তানেও সিআইএ সক্রিয়। যদিও ইমরান খান পাকিস্তানের মাটিতে কোনওরকম মার্কিন ঘাঁটি তৈরির দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বিরোধিতা করেছেন। যদি আল কায়দা আফগানিস্তানে আবার ঘাঁটি গাড়ে তবে এই অঞ্চলের যেকোনও জায়গা থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহার করে হস্তক্ষেপ করতে পারবে। তবে সরাসরি নিজেদের স্বার্থে আঘাত না লাগলে মার্কিন প্রশাসন সম্ভবত এইসব বিষয়গুলি আঞ্চলিক শক্তিগুলিকে দিয়েই মোকাবিলা করাবে।
আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি এবং মুখ্য শান্তি-মধ্যস্থতাকারী আবদুল্লা আবদুল্লা ইতিমধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে দেখা করেছেন। তাঁদের সাক্ষাৎ শেষে— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে তাদের আর্হিক সাহায্য অব্যাহত রাখবে— শুধু এটুকুই প্রকাশ্যে জানানো হয়। এর মধ্যেই গত ১৮ জুলাই থেকে কাতারের দোহায় আলোচনা শুরু হয়েছে। তালিবানরা প্রস্তাব দিয়েছে যে তারা তিন মাসের যুদ্ধবিরতি মানবে যদি সাত হাজার তালিবানকে জেল থেকে ছাড়া হয় এবং আশরাফ গনি তালিবানদের নিয়ে একটি সাময়িক অন্তর্বতীকালীন সরকার গড়তে রাজি হন।
আফগানিস্তানের মাটিতে কিন্তু ভয়ঙ্কর গৃহযুদ্ধ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। খবর পাওয়া যাচ্ছে তালিবানরা একের পর এক জেলার দখল করছে, প্রতিরক্ষা এবং সামরিক পোস্টগুলির দখল নিচ্ছে, সামরিক সাজসরঞ্জামও করায়ত্ত করছে। তালিবানকে মোকাবিলা করার জন্য আফগান ন্যাশনাল আর্মি বর্তমানে কি প্রশিক্ষণ কি সাজসরঞ্জাম কোনও দিক থেকেই যথেষ্ট প্রস্তুত নয়। এতদিন ধরে কোনও জটিল পরিস্থিতিতে পড়লেই মার্কিন বিমানবাহিনি এসে তাদের উদ্ধার করত। সেই সহায়তার হাত সরে যাচ্ছে— অতএব নিশ্চিতভাবেই তাদের কাজটা আরও কঠিন হতে চলেছে। এবং ইতিমধ্যেই বিভিন্ন জায়গা থেকে এরকমও খবর আসছে যে সরকারি সৈন্যবাহিনি দ্রুত তাদের আনুগত্য পালটে ফেলছে।
তালিবানরা যে কতটা অঞ্চলের দখল নিয়েছে সে নিয়ে বিভিন্ন সূত্রে বিভিন্ন খবর পাওয়া যাচ্ছে। সেই খবরগুলির মধ্যে পার্থক্য থাকলেও একটা বিষয় নিশ্চিত— ২০০১-এর পর থেকে আফগানিস্তানের এতটা অঞ্চল আর কখনও তালিবান দখলে আসেনি। আফগানিস্তানে রাষ্ট্রপুঞ্জের দূত ডেবোরা লায়নস-এর কথা অনুযায়ী চলতি বছরের মে মাস থেকে দেশের ৩৭০টি জেলার মধ্যে ৫০টি জেলায় তালিবান শাসন কার্যকর হয়েছে। আর যে জেলাগুলিতে তালিবানরা দখল নিয়েছে সেগুলি প্রদেশগুলির রাজধানী শহর ঘিরে অবস্থিত। বোঝাই যাচ্ছে তাদের যোদ্ধারা উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করছে। মার্কিন সেনারা চলে গেলেই হয়তো সেই সময় উপস্থিত হবে। অন্য আর একটি সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে দেশের অন্তত ১৪২টি জেলায় বর্তমানে তালিবানদের উপস্থিতি রয়েছে।
গজনি প্রদেশের ১৮টি জেলার মধ্যে ৭টিরই নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তালিবানরা, এবং আরও ৩টিতেও তালিবান যোদ্ধারা বর্তমানে রীতিমতো শক্তিশালী অবস্থায় রয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রে খবর। যদিও কেন্দ্রীয় জেলাগুলি এখনও সরকারি দখলেই আছে। একজন স্থানীয় রাজনীতিক জানাচ্ছেন, তার পর থেকে আরও ২টি জেলার পতন ঘটেছে। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে কুন্দুজ-এর উত্তর প্রদেশে আফগানিস্তানের সঙ্গে তাজিকিস্তানের মূল সীমান্তের দখলও নিয়ে নিয়েছিল তালিবানরা। যদিও সরকারি বাহিনি পরে সেটি পুনরুদ্ধার করে।
ফেব্রুয়ারি ২০২০-তে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আমলে তালিবান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি চুক্তি সই করেছিল। মার্কিনিরা আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারে সম্মত হতেই তালিবান নিজেদের বিজয় ঘোষণা করেছে। এটা সত্যি যে তালিবানের মূল লক্ষ্য হল আফগানিস্তান থেকে সমস্ত বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহার। তারা সেই শুরু থেকেই বলছে— যতক্ষণ না আফগানিস্তানের মাটি থেকে সমস্ত মার্কিন এবং ন্যাটো সৈন্যরা ফিরে যাবে ততক্ষণ তাদের লড়াই চলবে।
তালিবান প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করে আল কায়দা সহ আর কোনও সংগঠনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আঘাত হানবে না। কিন্তু বহু বিশেষজ্ঞই এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে একমত নন। তাঁদের বক্তব্য, তালিবানদের সঙ্গে আল কায়দার সম্পর্ক ওতপ্রোত— ঐতিহাসিকভাবে, বৈবাহিক বন্ধনে এবং উপজাতীয় আত্মীয়তায়।
যদি তালিবান তাদের পুরনো দিনগুলিতেই আবার ফিরে যায় তবে তা আফগানিস্তানের প্রতিবেশী, বিশেষ করে পাকিস্তানের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে। এবং এর প্রতিক্রিয়া অবশ্যই পৌঁছবে আমাদের দেশেও। তালিবান আফগানিস্তান দখল করলে তার আন্তর্জাতিক পরিণাম খুব একটা ভালো হবে না। ইসলামি মৌলবাদ উৎসাহিত হবে এবং বিভিন্ন দক্ষিণপন্থী শক্তি– বিশেষ করে ইসলামি দেশগুলিতে– বলীয়ান হবে। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ বাড়বে। আফগানিস্তানের আরেক প্রতিবেশী ইরানে শিয়া কট্টরপন্থীরা নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দখল করেছে। তাদের সঙ্গে আফগানদের সংঘর্ষ জটিলতার সৃষ্টি করবে। হয়তো এখনই এতটা আশঙ্কা করার সময় আসেনি, তবু লক্ষণগুলি যথেষ্টই উদ্বেগজনক।