প্রতিভা সরকার
প্রাবন্ধিক, গল্পকার, অধ্যাপক, সমাজকর্মী
সন্তান দুটির বেশি হওয়ার অর্থ দেশের জনসংখ্যার লাগামহীন বৃদ্ধি। কড়া হাতে এর মোকাবিলা না করলে সমস্ত ন্যাচারাল রিসোর্স কম পড়বে। সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া যাবে না পাওনা সুযোগসুবিধা। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে সাম্যাবস্থার জন্য এই আইন খুব জরুরি। নাহলে কোনও বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায় ধর্মের দোহাই দিয়ে নিজেদের সংখ্যা বাড়িয়েই যাবে, সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে অন্যান্য সম্প্রদায়গুলি। শেষেরটি অত্যন্ত বিপজ্জনক, কারণ এর ফলে দেখা দেবে ডেমোগ্রাফিক চেঞ্জ বা জনবিন্যাসের আনুপাতিক পরিবর্তন।
এইসব যুক্তিতে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলো দুই সন্তানের নীতি কার্যকরী করতে চাইছে। উত্তরপ্রদেশ, অসম, এখন কর্নাটকেও।
অতশত কথার তো দরকার নেই, শেষ কথাটাই সেরা কথা, আর সেটা কাদেরকে বলা তাও একেবারে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। হিমন্তের কথার টার্গেট যদি ‘অনুপ্রবেশকারী মুসলমান সম্প্রদায়’, আদিত্যনাথ আর এক কাঠি ওপরে উঠে নিশানায় রাখে সেই ‘সম্প্রদায়কে যারা জনসংখ্যার ব্যালান্স নষ্ট করতে’ ওস্তাদ। দুই মুখ্যমন্ত্রীই দুটির বেশি সন্তান যাদের তাদের বিরুদ্ধে কড়া আইনি ব্যবস্থা নেবার পক্ষপাতী। এছাড়া সরকারি চাকরি না পাওয়া, রেশন কার্ড বাতিল হয়ে যাওয়া, নির্বাচনে দাঁড়াতে না পারা, এইসব শাস্তির নিদান তো আছেই। রাজনীতিকদের লাগাতার ঢাকের আওয়াজে বিভ্রান্ত আমরা, সাধারণ নাগরিকেরাও এখন সংখ্যাতত্ত্ব হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে জনসংখ্যা বিস্ফোরণের সব দায় চাপিয়ে দিই মুসলমানদের ওপর। ‘ওদের তো চারটে বৌ, ডজন দুয়েক বাচ্চা প্রতি ঘরে’— এই কথাগুলি আমাদের মুখের লব্জ। এগুলোর চেয়ে বেশি মিথ্যে কথা আর নেই, আর বিজেপি ভরসা করে আছে অনেকদিন ধরে একটু একটু করে বানানো এই পোক্ত মিথ্যেটার ওপরেই।
হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে ভারতীয়দের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমতে শুরু করেছে সত্তরের দশক থেকে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তা মোট জনসংখ্যার গুণতিতে প্রতিফলিত হয় না। রাশিবিজ্ঞানীদের মতে ২০৫০ সালের সেন্সাসে এই কমার ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে যাবে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী ১৯৭১ সালে ভারতবর্ষে জন্মহার ছিল হাজারে ৩৮.৮২, ২০২০ তে তা হয়েছে ১৭.৪৪ জন। আত্মসন্তুষ্ট হতে হবে না, কিন্তু এটাকে আরও ত্বরান্বিত করতে হলে আর যাইই হোক, শাস্তির ব্যবস্থা না করলেও চলে। কারণ শাস্তি দিয়ে ভালো কাজ হয়েছে এইরকম উদাহরণ পৃথিবীর কোথাও নেই।
গোপন কথাটি প্রায়শই গোপন থাকে না আর, তাই আদিত্যনাথ এবং হিমন্তের আসল অভিপ্রায় নিয়ে কারও সন্দেহ নেই। বলার মধ্যে শুধু এই যে ভারতের একমাত্র ইউনিয়ন টেরিটোরি যেখানে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ তা হল কাশ্মির। লাক্ষাদ্বীপও তাই, সেখানকার জনবিন্যাস ও পরিবেশ ধ্বংসের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে বিজেপি সরকার। মূল ভূখণ্ড থেকে ব্যবসায়ী ছদ্মবেশে দলে দলে সেখানে যাচ্ছে এ-ই ধ্বংসের কারিগররা। কাশ্মির কিন্তু সারা দেশের মধ্যে পরিবার পরিকল্পনায় সেরা, জাতীয় গড়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে। পরিবার পরিকল্পনায় জাতীয় গড় ৫৩.৫ শতাংশ, কাশ্মির ৫৭.৩ শতাংশ। আর যত ভারতীয় দম্পতির দুটির বেশি সন্তান আছে, তাদের মধ্যে মাত্র ১৩ শতাংশ মুসলমান।
যে ভূত ঘাড় থেকে নিজেই নামতে শুরু করেছে, তাকে নামাব বলে হঠাৎ করে ওঝা ডাকা, লঙ্কাপোড়া দেওয়া, কেমন যেন অদ্ভুত, তাই না? জনসংখ্যার বৃদ্ধি কমানোর চেষ্টার নামে একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে হীন দেখাবার ষড়যন্ত্র এটি৷ যে কাজে শিক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নতি এবং নারীর ক্ষমতায়নই হচ্ছে আসল, সে কাজে শাস্তির ভয় কতটা ফলপ্রসূ হতে পারে! এইভাবে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ হতে পারে, প্রতিশোধ চরিতার্থ করা যেতে পারে, ঘৃণা ছড়ানো যেতে পারে, কিন্তু কাজের কাজ কোথাও হয়নি, এখানেও হবে না।
কাজ হবে না বুঝেই চিন তার এক-সন্তান নীতি পরিত্যাগ করেছে। তিনটে প্রজন্মের একটি বংশলতিকা নিয়ে বসলে খুব সহজেই বোঝা যাবে কেন এই নীতি ভ্রান্ত। দু জোড়া দাদু-ঠাকুমাকে বা চারজন প্রাপ্তবয়স্ককে দিয়ে শুরু করা যাক এই বংশলতিকা। এদের একটি করে সন্তান, অর্থাৎ দুজন অ্যাডাল্ট যোগ হল দ্বিতীয় প্রজন্মে। এই দুই অ্যাডাল্ট তৃতীয় প্রজন্মে যোগ করছে মাত্র এক সন্তানকে। অর্থাৎ তৈরি হচ্ছে এক উল্টো পিরামিড যার চওড়া ভিতটি ওপরে, চূড়াটি নিচে। ওপরে ধাপে ধাপে রয়েছে ছয় প্রাপ্তবয়স্ক, যারা বিজ্ঞানের আশীর্বাদে অনেকদিন বাঁচবে। একেবারে নিচের নিঃসঙ্গ সন্তানটি প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে বিয়ে করবে, তারও একটিই সন্তান হবে। অর্থাৎ কালে কালে একজন উৎপাদনশীল প্রাপ্তবয়স্ককে দেখভাল করতে হবে আটজন মানুষকে যাদের মধ্যে ছজনই বয়স্ক এবং অনুৎপাদক।
এই অবস্থাটি যে কোনও দেশের পক্ষেই মারাত্মক। স্বাস্থ্যখাতে খরচ, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা, উৎপাদন, রাষ্ট্রের দায়িত্ব কর্তব্য, নাগরিকের মানসিক স্বাস্থ্য, সবকিছুর পক্ষেই মারাত্মক। এতে জনসংখ্যার বৃহত্তম অংশ হয়ে পড়ে বুড়ো মানুষেরা, যারা ইচ্ছে থাকলেও উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতে পারে না। চিন সেটা বুঝে এক-সন্তান নীতি তো বর্জন করেইছে, উপরন্তু এখন বেশি সন্তান উৎপাদনের কথা বলে চলেছে। তাতে অবশ্য ভবি ভোলবার নয়। ছিমছাম সংসারের অভ্যাস থেকে ও দেশের জনগণ এখন আর বেরোতে চাইছে না।
আমাদের দেশ জনসংখ্যা হ্রাস সম্পর্কিত শাস্তির কুৎসিত মুখখানি ইমার্জেন্সির সময় খুব ভালো করেই দেখে নিয়েছে। সঞ্জয় গান্ধি মায়ের মদতে লাগামছাড়া হয়ে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের ধরে ধরে নাসবন্দি করবার খেলায় মেতেছিল। অনেক অনিচ্ছুক, এমনকি অবিবাহিত তরুণও তখন চরম রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়েছে। ২১ মাসেই সে খেলা সাঙ্গ হলে এতদিন কোনও শাসক আর সেই আগুনে হাত দেওয়ার সাহস পায়নি। এই এতদিন পর আবার আদিত্যনাথ, হিমন্ত বিশ্বশর্মার জুটি সে কাজে নেমেছে। হয় তারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে ভুলে গেছে অথবা ক্ষমতার মদে মত্ত হয়ে সেই শিক্ষাকে তুচ্ছ করছে।
ভালো করে তাই জেনে রাখা দরকার বর্তমানে ভারতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির যে হার তাতে ১ জন মায়ের ২.১ সন্তান থাকার কথা, গড়ে তাই-ই আছে। এই হার দেশের সর্বত্র, নেই শুধু উত্তরপ্রদেশ আর বিহারে। তবুও এই দুটি রাজ্যেও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার আগের থেকে কম। এটা শুধু সময়ের অপেক্ষা যে ভারতের জনসংখ্যা স্থিতিশীল হবে আর দু/তিন দশকের মধ্যেই। হয়তো তা হবে ১.৫-১.৬ বিলিয়নের মধ্যেই।
ততদিন সাধারণ নাগরিকদের সম্প্রীতি বজায় রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করে যেতে হবে। হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির পাঠ নিলে চলবে না, শাসকের স্বরূপ সম্বন্ধেও ওয়াকিবহাল থাকতে হবে। আমরা যেন মনে রাখি কাশ্মিরে এই শাসকই ডেমোগ্রাফিক চেঞ্জের জন্য সংবিধান পরিবর্তন করতে পিছ-পা হয়নি। কাশ্মিরে যাতে বিশেষ সম্প্রদায়কে সংখ্যালঘু করে দেওয়া যায় তার জন্য এর অপচেষ্টার কোনও শেষ নেই। মুখোশের আড়ালে এর আসল মুখকে চিনে নিতে যেন ভুল না করি। আর সরকারের যদি কারও জন্য কিছু করতেই হয় সে তা করুক দেশের বর্তমান জনসংখ্যার যারা ৫০ শতাংশ সেই ত্রিশ বছরের নিচে তরুণদের জন্য, যারা এই অতিমারিতে কাজ হারিয়েছে বা একেবারেই কাজ পায়নি।
খুব জরুরী লেখা। দশকের পর দশক ধরে চলা রক্তক্ষয়ী জঙ্গি রাজনীতির আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকা অন্য কাশ্মীরকে চিনিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
এই) লেখাটি থেকে বোঝা যায় যে বিজেপি ৫রাজ্যের নির্বাচনের পরা আসন্ন উত্তরপ্রদেশ গুজরাট হিমাচল ও পাঞ্জাব নির্বাচনে মুসলিম বিরোধী কম্যুনাল তাসটাই খেলবে। বহু ব্যবহারে জীর্ণ এই কায়দাই এখন ভরসা। কিন্তু পশ্চিবংগ পর্যুদস্ত হওয়ার পরে বিজেপির ভেতরে অন্তররবিস্ফোন ঘটছে বাংলার উত্তরপ্রদেশ কর্ণাটকে। নিয়ন্ত্রণের বজ্রমুঠি শিথিল হওয়ায় দেশের ন্যায়ালয়গুলিও সরকার বিরোধী নির্দেশ দিচ্ছে।
এর সাথে যদি গণ আন্দোলনের জোয়ার থাকতো তবে ২০২৪ স@ল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো না।
চমৎকার তথ্যসমৃদ্ধ বিশ্লেষণ