প্রবুদ্ধ ঘোষ
সাহিত্য গবেষক, দাবা প্রশিক্ষক, প্রাবন্ধিক
কিউবার নাম দুটো কারণে বহুশ্রুত— চে গেভারা এবং হাভানা চুরুট। বিশেষত বামপন্থী মহল এই দুটির নাম অমৃতসমান মনে করে। করোনাক্রান্ত সময়ে কিউবার নাম শোনা গেছে তাদের উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্যে। প্রথম ঢেউয়ে খুব দ্রুত কোভিড-১৯ সংক্রমণের মোকাবিলা করে অন্যান্য বিপর্যস্ত দেশের সাহায্যে কিউবার চিকিৎসাদল ছুটে গেছিল। এছাড়াও বিশ্ব রাজনীতিতে কিউবা সহ কয়েকটি লাতিন আমেরিকান দেশের নাম প্রায়ই জেগে ওঠে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতার জন্যে। সোভিয়েত ব্লক বনাম আমেরিকান ব্লকের ঠান্ডা যুদ্ধের যুগ থেকে এবং তৎপরবর্তী সময়েও বিশ্বের আর্থ-রাজনীতিতে ‘সাপে-নেউলে’ বাগ্ধারার সমার্থক যুক্তরাষ্ট্র-কিউবা। যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ধারে-ভারে ছোট হলেও, কিউবা এমনই একটা দেশ যাকে দীর্ঘ কয়েক দশকের চেষ্টাতেও গ্রাস করতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। ফিদেল কাস্ত্রোর সময়ে গুপ্তচর সংস্থা সিয়াকে দিয়ে অরাজকতা তৈরির চেষ্টা, কাস্ত্রোকে খুন করার চেষ্টা কিংবা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কিউবাকে বিভিন্নভাবে দমিয়ে রাখা— কোনও প্রচেষ্টাই বাকি থাকেনি। কিউবার ওপরে বিভিন্ন বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে, জাতিপুঞ্জকে প্রভাবিত করে কিউবার আবেদন নামঞ্জুর করে দেওয়া হয়েছে এবং কিউবার না-পুঁজিবাদী সাংস্কৃতিক পরিসরকে বিষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। নব্বই দশকের শুরুতে সোভিয়েত ব্লকের পতন হয়েছে, বিশ্বায়ন-উদারনীতিকরণের জবরদস্তি সকলের মগজ-মন দখল করে নিয়েছে। সমাজতান্ত্রিক আদর্শ দেশ বলে কিছু আর নেই বরং একদা সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখানো দুটি দেশ রাশিয়া ও চিন পুঁজিবাদের (কখনও বাজার-সমাজতন্ত্রের আড়ালে) লাগামছাড়া দৌড় শুরু করে দিয়েছে; যুক্তরাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদকে পাল্লা দিতে চাইছে। কিউবা তবুও প্রতিরোধ চালিয়ে গেছে। বাতিস্তা সরকারকে উচ্ছেদ করে এবং আমেরিকার চক্রান্ত ব্যর্থ করে ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে বামপন্থী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল চক্রান্ত চালিয়ে গেছে কিউবার বিরুদ্ধে। ১১ জুলাইয়ের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ সেই দীর্ঘমেয়াদি চক্রান্তের নতুন প্রচেষ্টা বলে চিহ্নিত করেছে অধিকাংশ বামপন্থী শিবির— যেহেতু কিউবার বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু, এই বিক্ষোভকে শুধুমাত্র বামপন্থী সরকারের বিরোধী আমেরিকান চক্রান্ত বললে বোধহয় সরলীকরণ হয়ে যায়; কিউবার অর্থনীতি এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিসরে কিন্তু অসন্তোষের উপাদান রয়েছে।
#
The Cuban people have the same right to freedom of expression and peaceful assembly as all people. The United States stands with the brave Cubans who have taken to the streets to oppose 62 years of repression under a communist regime… Advancing human dignity and freedom is a top priority for my Administration…
–Joseph R. Biden, 22nd July, 2021-07-25
আমেরিকার সম্পর্কে বিশ্বরাজনীতিতে ‘অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ’টি হল, আমেরিকা নিজের দেশের গণতন্ত্র রক্ষায় যতটা দায়িত্ববান, অন্যান্য দেশের গণতন্ত্রকে বিপন্ন করতে ঠিক ততটাই দায়িত্ববান। আমেরিকার রাষ্ট্রপতির তথা বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তির উপরোক্ত মন্তব্যে কমিউনিজমের প্রতি ঘৃণা উপচে পড়ছে! এই ভেবে হাসি পায় যে, ট্রম্পকে হারিয়ে বাইডেন জেতার পরে ভারতের সিংহভাগ সংসদীয় বামপন্থীরা বিগলিত হয়ে কী উচ্ছ্বাসই না প্রকাশ করেছিলেন! অথচ সহজ সত্য এই যে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান যেই হোক, যুদ্ধ তথা বিশ্ব-অশান্তি জিইয়ে রাখা ছাড়া তার গদি টিঁকবে না। আর, ট্রুম্যান থেকে নিক্সন থেকে বুশ থেকে ওবামা বা বাইডেন— আমেরিকা বারবার অন্য দেশে শান্তি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার ‘হোয়াইট ম্যানস্ বার্ডেন’ কাঁধে তুলে নিয়েছে স্বেচ্ছায় (আসলে মুনাফার লোভে)। তারপর সেই দেশটি শ্মশানে পরিণত হয়েছে ও বহু আভ্যন্তরীণ ক্ষয়ক্ষতির স্বীকার হয়েছে— মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকার বহু দেশ, দক্ষিণ আমেরিকার নানা দেশ এর জ্বলন্ত উদাহরণ। কিউবার স্বাতন্ত্র্যে আঘাত করতে আমেরিকার নিরন্তর চেষ্টা সেই ষাটের দশক থেকেই চলছে। পাঠকবর্গ নিশ্চয়ই ‘বে অফ পিগস্ ইনভেশন’ সম্পর্কে জ্ঞাত। ১৯৬০ সালে প্রথমে আইসেনহাওয়ার পরে কেনেডি কিউবার সদ্যগঠিত বামপন্থী সরকারের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ ষড়যন্ত্রে সামিল হয়। কিউবা থেকে বিতাড়িত বাতিস্তা সমর্থক ও বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীকে একত্র করে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে সিয়া ‘বে অফ পিগসে’ পাঠায় যাতে তারা হাভানায় গিয়ে কাস্ত্রোর সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভ্যুত্থান করতে পারে। কিন্তু, কাস্ত্রোর নেতৃত্বাধীন কিউবার সামরিক বাহিনির তৎপরতায় সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং সহস্রাধিক বিশৃঙ্খলাকারীকে গ্রেপ্তার করে কাস্ত্রোর সরকার। ফিদেলের জাতীয়করণ নীতি এবং আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদকে কাঁচকলা দেখিয়ে স্বাবলম্বী আর্থ-রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার দশকব্যাপী প্রয়াস আমেরিকার শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে থেকেছে। কিউবায় ‘গণতন্ত্র’ স্থাপন করতে আমেরিকা ‘সম্ভবামি যুগে যুগে’ হতে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছে। সাম্প্রতিক ১১ জুলাইয়ের বিক্ষোভেও আমেরিকার মদতের স্পষ্ট কিছু প্রমাণ রয়েছে। সমাজতান্ত্রিক মডেলের বিরুদ্ধে ধনতান্ত্রিক মডেলের অন্যতম প্রধান দুটি অভিযোগ— ব্যক্তির গুরুত্ব নগণ্য এবং সরকারি আদেশে বিলাসদ্রব্যের যোগান ইচ্ছাকৃতভাবে বন্ধ রাখা। কিউবার রাস্তায় যাঁরা বিক্ষোভরত, তাঁদের স্লোগান— ‘We want liberty’ ও ‘Down with the Dictatorship’। মজার ব্যাপার, যে বাইডেন তার পূর্বসূরিদের জুতোয় পা গলিয়ে কিউবার ‘গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা’ নিয়ে উদ্বিগ্ন, সেই বাইডেনের সরকারও বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে কিউবার ওপরে। প্রায় ছ দশক কিউবার সঙ্গে বাণিজ্যে হরেক নিষাধাজ্ঞা চাপানো রয়েছে, যে কোম্পানিগুলি কিউবার সঙ্গে বাণিজ্য করতে চেয়েছে তাদের কালো-তালিকাভুক্ত করা হয়েছে; কিউবায় উৎপাদিত পণ্য রপ্তানিতে ও দ্রব্য আমদানিতে রয়েছে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা। রাষ্ট্রপুঞ্জে আমেরিকা আর ইজরায়েল নিষেধাজ্ঞার পক্ষে ভোট দেওয়ায় কিউবার আবেদন বারংবার নাকচ করা হয়েছে। ‘হাতে না মেরে ভাতে মারা’-র এই ফন্দি ওবামার সময়ে কিছুটা শিথিল করা হয়েছিল কিন্তু ট্রাম্পের সময়ে ফের চাপানো হয়। বাইডেন নিষেধাজ্ঞা তোলার প্রতিশ্রুতি দিলেও কার্যকরী করেনি বরং ডেমোক্র্যটরা দ্বিধাবিভক্ত এই বিষয়ে। আর, সাম্প্রতিক বিক্ষোভে মদত দিয়ে যদি কিউবার রাজনীতিকে আরও অশান্ত করে তোলা যায়, তাহলে বাইডেনের নামে জয়ধ্বনি উঠবে উদারনৈতিক পুঁজিকামী রাষ্ট্রগুলিতে।
#
রাউল কাস্ত্রোর রাষ্ট্রপতিত্বে কিউবা কিছু উদারনৈতিক পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছিল গত দশক থেকে। বর্তমান শাসনে তার গতি ত্বরান্বিত হয়েছে। মাঝে কিউবার সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কের উন্নতির ব্যাপারে কিছু চেষ্টা হলেও তা দীর্ঘস্থায়ীভাবে ফলপ্রসূ হয়নি। বর্তমানে কিউবা এক অভূতপূর্ব সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এমন অর্থনৈতিক মন্দা প্রায় তিন দশক পরে ফিরে এসেছে, বেকারত্বের হার বেড়েছে। কোভিড মহামারির বিরুদ্ধে কিউবার সাফল্য প্রথমে বেশ প্রচারিত হলেও, পরবর্তীতে দেখা গেছে যে, কিউবার স্বাস্থ্যব্যবস্থার মধ্যেও গলদ রয়েছে অনেক। বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর অভিযোগও উঠেছে অনেকের বয়ানে। এই মাসের প্রথম দিকে কিউবায় কোভিড ঢেউয়ে দৈনিক গড়-আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছ হাজার এবং দৈনিক মৃত্যুসংখ্যা প্রায় ৩০। অর্থনীতিও ধাক্কা খেয়েছে মহামারির সময়ে। আখচাষের সঙ্গে সঙ্গে পর্যটন কিউবার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ভিত্তি। কিন্তু, করোনাকালে পর্যটনব্যবসা প্রায় তলানিতে ঠেকেছে। আর, এর সঙ্গেই জুড়েছে খাদ্যসঙ্কট ও মূল্যবৃদ্ধি। দিয়াজ-ক্যানেল বছরের শুরুতে কিছু অর্থনৈতিক সংস্কারের কথা বললেও, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি, আগাম অনুমানে মূল্যবৃদ্ধি আগামী কয়েকমাসে কয়েকশো শতাংশ বাড়তে পারে। তেল-সাবান, মাংস ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের দাম আকাশছোঁয়া, ময়দা অমিল। বহু স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সাধারণ ওষুধের সঙ্কট চলছে। আর, দেশের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে হচ্ছে। রাউল কাস্ত্রোর সময়ে এই দ্বীপদেশে ইন্টারনেট ব্যবস্থার সূচনা হয়েছিল; সমাজতান্ত্রিক মডেলের বিরুদ্ধে উদারনৈতিক পুঁজিবাদী দেশের আরও এক গুরুতর অভিযোগ মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে, কিন্তু, উদারনৈতিক-বিশ্বায়িত সময়ে বৃহত্তর বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ রুদ্ধ করে থাকার উপায়ও নেই। কিউবায় এই ১১ জুলাইয়ের বিক্ষোভের পূর্বপ্রস্তুতি কিন্তু সামাজিক মাধ্যমগুলোতে আগেই শুরু হয়ে গেছিল। এই বিক্ষোভকারীদের সিংহভাগই তরুণ প্রজন্মের; ইন্টারনেট ও সামাজিক মাধ্যমে সাবলীল তারা। ফলে, বিক্ষোভের মুহূর্তগুলি বাইরে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি এবং ঠিক এই মুহূর্তগুলিকেই রাজনৈতিক ফায়দায় কাজে লাগাতে চাইছে আমেরিকাসহ অন্যান্য ক্ষমতাশালী দেশ। অথচ, সুপরিকল্পিতভাবে কিউবাকে অর্থনৈতিক অবরোধে ফেলে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনাই মূলত দায়ী কিউবার এই সঙ্কটের জন্যে— “Both the Cuban government and the United Nations have estimated that the embargo has cost the Cuban economy $130 billion over six decades. It’s also worth noting that the US Chamber of Commerce estimates that the embargo costs the US economy billions of dollars each year, as well.”[1]
গত বছরে প্রায় সাড়ে পাঁচ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে কিউবার। মহামারির সময়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের অনুরোধ সত্ত্বেও আমেরিকা ও ইজরায়েল নিষেধাজ্ঞা সরানোয় কর্ণপাত করেনি বরং সঙ্কট বাড়তে দিয়েছে ভবিষ্যতে মুনাফালাভের আশায়। কিউবার একদা-নিকটতম বন্ধু সোভিয়েত অর্থনৈতিক অবরোধের যুগে কিউবাকে ‘শত্রুর শত্রু’ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিভিন্ন সহায়তা করত। কিন্তু, সোভিয়েত ব্লকের সঙ্গী হতে গিয়ে কিউবা অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতায় দুর্বল থেকে গেছে। প্রজাতান্ত্রিক চিন ও প্রজাতান্ত্রিক কিউবার সম্পর্ক নব্বই দশক থেকে ঘনিষ্ঠ হয়েছে এবং কিউবার দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যসঙ্গী চিন। গত দশকের মাঝামাঝি থেকে কিউবার পরিবহন, বাণিজ্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ইত্যাদি পরিসরে চিন প্রধান রপ্তানিকারী এবং বিনিয়োগকারী। কোভিড মহামারির সময়ে ইন্টারফেরন আলফা-২বি তৈরির গবেষণায় চিনের প্রচুর বিনিয়োগ ছিল; প্রায় ৮০ টন চিকিৎসা সরঞ্জাম কিউবাকে দিয়েছিল চিন। ২০১৭ সালে কিউবাতে প্রথম কম্পিউটার অ্যাসেম্বলি প্ল্যান্ট তৈরি করে Haier কোম্পানি, বলাবাহুল্য কিউবার প্রযুক্তিক্ষেত্রে চিনই একমাত্র বিনিয়োগকারী। এছাড়া, কিউবার উপকূলে তেলের খনিগুলিতেও চিনের বড় বিনিয়োগ রয়েছে। “Chinese firms also have a presence in the Mariel Special Economic Zone (SEZ) — an ambitious initiative that has suffered from Havana’s “two steps forward, one step back” model of economic reform and the country’s dual currency system”[2]
কিউবা চিনের আগ্রাসনবাদী বাজার-সমাজতান্ত্রিক মডেলের অন্যতম গবেষণাকেন্দ্র। আমেরিকার সঙ্গে পাল্লা দিতে বিশ্ববাণিজ্যে ও আর্থ-রাজনীতিতে চিনের কিছু ‘গিনিপিগ’ প্রয়োজন ছিল বিগত কয়েক দশকে— নিশ্চিতভাবেই কিউবা তার অন্যতম। চিনের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রভাবও কিউবায় ভালভাবেই রয়েছে। সোভিয়েত ব্লক এবং তৎপরবর্তী চিন-ব্লকের ছায়াসঙ্গী হয়ে কিউবার নিজস্ব অর্থনীতি কিন্তু আখ-উৎপাদন ও পর্যটনেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে; এরই সঙ্গে কিউবার নিজস্ব আমলাতান্ত্রিক রাজনীতি ও আমেরিকা-ইজরায়েলের পরিকল্পিত নিষ্পেষণ জুলাই-সঙ্কটকে ঘনীভূত করেছে আরও। আমেরিকার নেতৃত্বাধীন ধনতান্ত্রিক ব্লকের কাছে সুযোগ রয়েছে এই সঙ্কটকে প্রসারিত করার। যদিও, চিন কিউবার পাশে দাঁড়িয়েছে এবং বিক্ষোভদমনে দিয়াজ-ক্যানেলের ভূমিকার প্রশংসা করে আমেরিকাকে হুমকি দিয়েছে। বেজিং ছকে বাঁধা স্বরে আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকার নিন্দে করে রাষ্ট্রপুঞ্জকে অনুরোধ করেছে কিউবার ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তোলার জন্যে। কিন্তু, কিউবার আভ্যন্তরীণ সঙ্কট তাতে শেষ হচ্ছে কি?
#
Who is bothered by the Cuban political system, the way we do things? Not our people, not the majority of our people, because they are the ones who have built that system… We are calling on all the revolutionaries in the country, all the Communists, to hit the streets wherever there is an effort to produce these provocations.
–-Diaz-Canel, 12th July 2021
১১ জুলাইয়ের বিক্ষোভে প্রতিক্রিয়াশীল শিবিরের ভূমিকা এবং আমেরিকার ভূমিকা থাকলেও, শ্রমিকদের অসন্তোষও কিন্তু রয়েছে। তাঁদের জীবনযাপনের মানের অবনতি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় সুযোগসুবিধা না-পাওয়ার ক্ষোভ রয়েছে। বহু বামপন্থী একে লুম্পেনদের বিক্ষোভ, অপ্রয়োজনীয় ভাংচুর ও অরাজকতা তৈরির চেষ্টা বলে একপেশে ভাবে দেগে দিয়েছেন। কিন্তু, কিউবার অভ্যন্তরে নাগরিক জীবন খুব সুখে নেই। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বচ্ছলতা কিউবায় কখনওই ছিল না, তবু ব্যাপক সংখ্যক মানুষ হয়তো স্বস্তিতে দিনযাপন করতেন, তাঁদের মৌলিক অধিকারের দাবিগুলি পূর্ণতা পেত। কিন্তু, বর্তমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে সেই স্বাচ্ছন্দ্য অন্তর্হিত। বুদ্ধিজীবী মহল বাক্স্বাধীনতা হরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন, আমলাতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে জনরোষে সামিল হয়েছেন। দিয়াজ-ক্যানেল বলেছেন ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ তাঁদের সরকারের সাথে আছেন, হয়তো সেটাই সত্যি, কিন্তু সংখ্যালঘিষ্ঠের মতামতও শোনা-বোঝা প্রয়োজন একজন রাষ্ট্রনায়কের। কলকাতায় বসে কিউবার সম্পূর্ণ খবর পাওয়া সম্ভব নয়; কিউবার আভ্যন্তরীণ বিষয়ে রাজনৈতিক মতামত হেঁকে দেওয়া আরওই অসম্ভব। আমেরিকান ব্লকের দীর্ঘমেয়াদি ভূমিকা, কিউবার আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট ও বিভিন্ন সংবাদপত্র সামাজিক মাধ্যমের খবর দেখে কিছুটা হয়তো আঁচ করা যায়। অন্য দেশের গণতন্ত্র নির্মাণে (আসলে ধ্বংস করতে) আমেরিকার ভূমিকার কথা মাথায় রেখে কিউবায় তাদের হস্তক্ষেপের প্রতিবাদ জানানো জরুরি। কিন্তু, কিউবার প্রজাতান্ত্রিক সরকারেরও উচিত জনগণের ক্ষোভকে যথাযোগ্য মর্যাদায় বিচার করা এবং দেশের সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক অবক্ষয়কে বামপন্থী চেতনায় বিশ্লেষণ করা। কিউবা-চে-ফিদেল পৃথিবীর মুক্তিকামী জনগণের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য নিদর্শন— যুক্তরাষ্ট্রীয় নিষ্পেষণের মুখে দীর্ঘ ছ দশক টিঁকে থাকা নিশ্চয় তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৫৯ সালে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে কিউবার মানুষের সংগ্রাম এবং অর্জিত অধিকার মিথ্ হয়ে আছে আজও। কিন্তু, মনে রাখা দরকার যে, মিথ্ আর ইতিহাস দিয়ে বর্তমানের সঙ্কট মেটানো যায় না। জীবনযাপনের মান নেমে যাওয়া অভুক্ত মানুষ মিথ্ আর ইতিহাসের উজ্জ্বলতা দিয়ে স্বস্তি পান না, ভালো থাকেন না। আর, এই বিক্ষোভকারীরা কিউবা বিপ্লবের প্রায় দু প্রজন্ম পরের সময়ে রয়েছেন। চে-ফিদেলের ছবি এতদিনে যথেষ্ট বাণিজ্যিকীকরণ হয়ে গেছে— চে গেভারার মতাদর্শের থেকে বাণিজ্যিক আবেদন পুঁজিবাদী-সমাজতান্ত্রিক সব মডেলেই ছড়িয়ে দেওয়া গেছে অনেক গভীরে। সমাজতান্ত্রিক ব্লক আর নেই কোনও সাম্যবাদমুখী দেশও এই মুহূর্তে নেই। ধনতান্ত্রিক প্রতিক্রিয়শীলতা কিন্তু বিভিন্ন মুখোশের আড়ালে কার্যকরী রয়েছে! তারা চাইবেই কিউবার দখল নিতে, তারা চাইবেই উদারনৈতিক মতবাদ আর পুঁজিবাদের ‘মানবিক মুখের’ আড়ালে বিষ ছড়িয়ে দিতে। কিউবাকে প্রতিরোধ করতেই হবে। প্রবল প্রতাপশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অসম লড়াই খুবই কঠিন— তবু, কিউবা অন্তত বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শিবিরকে (এবং বাজার সমাজতন্ত্রের হাঁসজারুকে) ঠেকিয়ে রেখে আত্মসমালোচনার পথে এগিয়ে স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা করুক, প্রকৃত সমাজতন্ত্রমুখী হয়ে উঠুক। আরেকটি ২৬ জুলাইয়ে দাঁড়িয়ে ভারতবর্ষ থেকে এটুকু শুভাকাঙ্খাই পাঠানো যেতে পারে…
[1] The US embargo on Cuba has failed, Christopher Rhodes, Al Jazeera, 21st July, 2021
[2] Sino-Cuban Relations: No ‘New Cold War’ in Havana, Bradley J. Murg and Rasheed J. Griffith, 24th December, 2020