সন্দীপ পাণ্ড্যে ও মহম্মদ শোয়েব
লেখকদ্বয় সমাজকর্মী, রাজনৈতিক কর্মী
পুলিশ বিভাগের অবাধ দুর্নীতি একটি সাধারণ অভিজ্ঞতা মাত্র। তবে তা ছাড়াও সেখানে এমন এক ধরনের দুর্নীতি চলে যা ব্যক্তি ও তাঁর পরিবারের জীবন তছনছ করে দেয়। ইদানিং প্রায়শই যেটা দেখা যাচ্ছে তা হল, মিথ্যা অভিযোগ রুজু করে মানুষকে দীর্ঘ সময় কারাবন্দি করে রাখছে পুলিশ। কিছু ক্ষেত্রে সেই কারাবাসের মেয়াদ এতটাই দীর্ঘ যে তা অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণের পর আদালতের দেয় শাস্তির মেয়াদকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। প্রমাণের অভাবে অনেক ক্ষেত্রে বন্দিদের খালাস দেওয়া হচ্ছে অথবা শেষ অবধি জামিনে মুক্ত করা হচ্ছে বটে, কিন্তু ইতিমধ্যে তাঁদের জীবনে যে ক্ষতি হয়ে গেছে তা আর পূরণ হওয়ার নয়।
ফাদার স্ট্যান স্বামী মিথ্যা অভিযোগে কারাবন্দি ছিলেন। ভীমা কোরেগাঁও-এ কী ঘটেছে তিনি তা জানতেনও না, সেখানকার কোনও সভায় তাঁর অংশগ্রহণ করা অথবা ২০১৮ সালে সেখানে হিংসাকাণ্ডের সময়ে তাঁর উপস্থিত থাকা তো অনেক দূরের কথা। বয়স এবং অসুস্থতা সত্ত্বেও আদালত তাঁকে প্রাপ্য জামিনটুকুও দেয়নি। ফলে নয় মাস কারাবাসের পর তাঁর মৃত্যু ঘটে।
জাতীয় সুরক্ষা আইনের দায়রায় সম্প্রতি দুই মাসের কারাদণ্ড ভোগ করলেন মণিপুরের সমাজকর্মী ইরেন্দ্র লাইচনবাম। করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে গোবর এবং গোমূত্র আদৌ কার্যকর কিনা, সেই বিষয়ে ফেসবুকে উনি সমালোচনামূলক পোস্ট করেছিলেন। অথচ, এই অপরাধের বিরুদ্ধে সাধারণ কোনও দণ্ডবিধিও প্রয়োগ করা যায় না।
উগ্রবাদ সংক্রান্ত কোনও মামলার ক্ষেত্রে সুরক্ষা বিভাগের বিভিন্ন দপ্তর এবং মিডিয়া সেই মামলা রুজু হওয়ার আগেই অথবা আদালতে মামলার শুনানির আগেই অভিযুক্তকে আতঙ্কবাদী তকমা দিয়ে দেয়। অন্যদিকে, কোনও রাজনীতিবিদ যদি গুরুতর অপরাধ সংঘটনের পরে জেলবন্দি হন, সেখান থেকেই তিনি যেকোনও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন, যতক্ষণ না তাঁকে অপরাধী সাব্যস্ত করা হচ্ছে। আনলফুল অ্যাক্টিভিটি (প্রিভেনশন) অ্যাক্ট (UAPA) দিয়ে বড়জোর ২ শতাংশ অপরাধীকে সাব্যস্ত করা গেছে। যার থেকে বোঝা যায়, উগ্রবাদী সন্দেহে অধিকাংশ ক্ষেত্রে গ্রেপ্তার করা মানুষদের শেষ অবধি বেকসুর খালাস দিতেই হয়। তবে আইনের বিধান এতটাই কঠোর যে অভিযুক্তের জামিন পাওয়াটাই কঠিন।
গত ১১ জুলাই, ২০২১-এ ত্রিশ বছরের মিনহাজ আহমেদ এবং পঞ্চাশ বছরের মাসিরুদ্দিনকে অ্যান্টি-টেররিজম স্কোয়াড (ATS) গ্রেপ্তার করে। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ যে আল-কায়দা-র সহযোগী আনসার গাজওয়াতুল হিন্দ দলের সদস্য হিসেবে তাঁরা স্বাধীনতা দিবসের আগে উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন শহরে বিস্ফোরণ ঘটানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। তাঁদের থেকে দুটি প্রেশার কুকার বোমা এবং দুটি পিস্তল উদ্ধার করা গেছে, যা সম্ভবত ATS-এর সদস্যরা মাসিরুদ্দিনের বাড়িতে তল্লাশি অভিযানের সময়ে সুটকেসে নিয়ে গিয়ে রেখে দেয়। সেই দিনই মহম্মদ মুস্তাকিমকেও গ্রেপ্তার করা হয়। ১৩ জুলাই, ২০২১, অর্থাৎ দুই দিন পরেই ২৭ বছরের শাকিল এবং ২৯ বছরের মহম্মদ মোইদকেও গ্রেপ্তার করা হয়। এঁদের মধ্যে মিনহাজ বাদে বাকি সবাই গরিব ঘরের মানুষ। ইলেট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিপ্লোমাপ্রাপ্ত মিনহাজ একটি ব্যাটারির দোকান চালান। তাঁর বাবা দ্বিতীয় গ্রেডের অবসরপ্রাপ্ত সরকারি অফিসার। মাসিরুদ্দিন আর সাকিল ব্যাটারি-চালিত অটো চালান। কিস্তিতে শোধ দেওয়ার কড়ারে মিনহাজের থেকে ব্যাটারি কিনেছিলেন তাঁরা। জনৈকের রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় মোইদ নিযুক্ত ছিলেন। মামুলি একজন ঠিকাদার হিসেবে ছোটখাটো বাড়ি নির্মাণের জন্যে শ্রমিক ভাড়া করতেন মুস্তাকিম। পুলিশ যখন মাসিরুদ্দিনের খোঁজে যায়, মাসিরুদ্দিন তখন পাশেই তাঁর ভাইয়ের নির্মীয়মাণ বাড়ির তদারকি করছিলেন। পুলিশ এসে মুস্তাকিমের মোবাইল ফোন এবং পরিচয়পত্র নিয়ে চলে যায়। পরে তাঁকে থানায় হাজির হতে বলা হয় এবং সেখানেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
অভিযোগে বলা হয় এই “উগ্রবাদীদের” জন্যে বিদেশি সংগঠন থেকে টাকা আসত। মাসিরুদ্দিনের অর্ধ-নির্মীয়মাণ বাড়িটিতে তাঁর স্ত্রী, শ্বাশুড়ি এবং চার ছেলেমেয়ে কোনওক্রমে থাকেন। তাঁর স্ত্রী সৈদা জানান সম্প্রতি তিনি একটি প্রেশার কুকার, একটি ইস্ত্রি আর একটি স্টোভ কিনে এনে বাড়িতে রেখেছিলেন মেয়ের বিয়েতে দেওয়ার জন্যে। খানাতল্লাশির পর ATS চলে যাবার পর কী ভেবে দলটি আবার ফিরে আসে এবং প্রেশার কুকারটি বাজেয়াপ্ত করে। তাঁর ৬ বছর বয়সের মেয়ে জেবা ডায়বিটিসে ভুগছে। স্কুল চলাকালীন মাসিরুদ্দিন তাঁর মেয়েগুলিকে নিজের রিক্সায় নিয়ে রাস্তায় অন্য মেয়েদেরও তাতে তুলে নিয়ে স্কুলে পৌঁছে দিতেন। মিনহাজ একই সঙ্গে তাঁর মায়ের ছেলে আর মেয়ে। তিনি তাঁর মায়ের চুল আঁচড়ে দিতেন, পা মালিশ করতেন। ওদের ছেলের বয়স মাত্র দেড় বছর। শাকিলের স্ত্রী সাত মাসের গর্ভবতী। শাকিলের ভাই ইলিয়াস জানতে চান, পাঁচ টাকা ভাড়া নিয়ে যে মানুষটা যাত্রীদের নিয়ে যায় আসে, সে কীভাবে একজন উগ্রবাদী হতে পারে? দৈনিক যতটুকু রোজগার হয়, তার ওপরেই সম্পূর্ণ নির্ভরশীল শাকিল আর মাসিরুদ্দিনের পরিবার। মুস্তাকিমকে দিয়ে আগে যারা ঠিকাদারির কাজ করিয়ে ছিল, গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাদের কেউ বাকি টাকা চোকাতে চাইছে না। এদিকে নিজের ছোট ছেলে আর মেয়ের স্কুলের বাকি পড়া মাইনে দিতে হলে পরিবারের হাতে টাকা প্রয়োজন। বড় তিন মেয়ের একজনের চিকিৎসা চলছে— তার জন্যেও টাকা চাই। ভাড়াবাড়িতে থাকে ওরা সবাই। মিনহাজ আর মোইদের প্রতিবেশীরা জোর গলায় জানাচ্ছেন ওরা নির্দোষ। দুঃস্থ, সন্তপ্ত পরিবারগুলিকে জন্যে দুবেলার খাবার যোগাচ্ছেন ওঁরাই। গ্রেপ্তার হওয়া এই ৫ জনের কোনও একজনের বাড়িতে পা দিলে কারওই এই ধারণা হবে না বিদেশ থেকে আসা টাকার মদতে ওঁদের দিন গুজরান হত। তাছাড়াও, যে পরিবারগুলিতে ছোট ছোট ছেলেদের বাবারা আয়কর্তা, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই ছোট ছেলেরাই উগ্রবাদের মতো বিপজ্জনক কিছুতে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি নেয়।
উত্তরপ্রদেশের পঞ্চায়েত নির্বাচনে নাস্তানাবুদ হওয়ার পর ভারতীয় জনতা পার্টি সম্পূর্ণ রাজ্যটিকে আতঙ্কগ্রস্ত করে জেলা এবং ব্লকগুলির পঞ্চায়েত সভাপতির পদ গায়ের জোরে দখলে সরকারি যন্ত্রের অপপ্রয়োগের জন্যে দলকে খারাপ প্রচারের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। যা পরিস্থিতি, তাতে মনে হচ্ছে মানুষের নজর সরাতে দল এখন ব্যতিব্যস্ত। অযোধ্যার রামমন্দিরের জমি বিক্রির কেলেঙ্কারি এবং কোভিড প্রতিরোধে অব্যবস্থার কারণে তৈরি হওয়া অস্বস্তিতে দলের ভয় আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে তারা হেরে যেতে পারে। ভোটের মেরুকরণ ঘটানোর মরিয়া চেষ্টায় বহুল-ব্যবহৃত কৌশল হিসেবেই তাই ATS-এর অপারেশন। প্রসিদ্ধ কবি মুনাব্বার এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন উগ্রবাদীদের নয়, ATS কয়েকটি প্রেশার কুকার গ্রেপ্তার করেছে।
উপরিউক্ত ৫ অভিযুক্তকে UAPA-র মামলার সম্মুখীন হতে হবে। মনে হচ্ছে ওঁদের জীবনও সেইভাবে বিপর্যস্ত হবে, যেভাবে ইতিমধ্যে অনেকেরই হয়েছে।
পুলিশিব্যবস্থার যে সংশোধন ভারত চায়, তা আটকে রাখা হয়েছে। যাতে নির্দোষ মানুষদের মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত করা যায়। সে রাজনৈতিক চাপের জন্যেই হোক, খেতাব বা পদক জেতার লোভে অথবা শুধু এই কারণে যে ATS, National Investigation Agency প্রভৃতি সুরক্ষা বিভাগগুলির প্রচারের মাত্রা বাড়িয়ে চড়িয়ে নিশ্চিত করা হিসাব-বহির্ভূত তহবিল যেন বজায় থাকে।
সময় এসেছে সবাই এবার বলুক— যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়।
*লেখাটি মূল ইংরাজি থেকে অনুবাদ করেছেন সত্যব্রত ঘোষ