সুদীপ্ত মুখোপাধ্যায়
এ নরকের নাম মারাঠওয়াড়া, এ নরকের নাম বীড, মারাঠওয়াড়ার সবচেয়ে খরাপ্রবণ জেলা। এ নরকের নাম মহারাষ্ট্রের চিনি বলয়। “মারাঠওয়াড়া” শব্দটার মধ্যেই কেমন যেন একটা রুক্ষতা রয়েছে। রুক্ষতা এর পরিবেশ, প্রকৃতি, স্বভাব সব কিছু জুড়ে। চারদিক ছোট ছোট টিলা পাহাড়, বছরের পর বছর খরায় ঝলসে যাওয়া একটা মালভূমি অঞ্চল, যার চড়াই-উৎরাইয়ের ঢাল বরাবর এখানে-ওখানে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত বাবলা কাঁটার ঝোপঝাড়। কেমন যেন একটা আসুরিক সহ্যশক্তি রয়েছে শব্দটার মধ্যে, রয়েছে একটা যুদ্ধ যুদ্ধ গন্ধ। হ্যাঁ একটা সময় মারাঠওয়াড়ার মারাঠারা একই সঙ্গে কৃষিকাজটাও জানতেন, আবার যুদ্ধের সময় শত্রুসৈন্যের ওপর কতটা ক্ষিপ্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়তে হয় সেটাও জানতেন। একদিকে ভূমি ও অন্যদিকে যুদ্ধক্ষেত্র দুয়েরই নিয়ন্ত্রক ছিলেন তারা। পরাধীন ভারতে মারাঠওয়াড়ার মারাঠারা নিজামের হয়ে লড়াই করতেন। কিন্তু তখনও আজকের মতো বধ্যভূমি হয়ে ওঠেনি মারাঠওয়াড়া।
১৯৪১-র পর থেকে পরবর্তী ৭০ বছরের একটা গড় হিসেব থেকে দেখা যাচ্ছে পরভনী, নান্দেড, লাতুর, ওসমানাবাদ, জালানা, বীড, অওরঙ্গাবাদ— যে জেলাগুলোকে নিয়ে মারাঠওয়াড়া অঞ্চল তাদের মধ্যে বীড, অওরঙ্গাবাদ, জালানার বৃষ্টিপাতের পরিস্থিতি সবচেয়ে উদ্বেগজনক (মাত্র ১৫০মিমি)। ২০১৪-১৫ সালেও এখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে ৪৪ শতাংশ কম। তাপমাত্রার ক্ষেত্রেও নান্দেড (৩৯.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ও পরভনী (৩৯)-র পরেই বীড (৩৮.১)। মারাঠওয়াড়া অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কম হওয়ার পেছনের কারণ হল জুন মাসে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু যখন পশ্চিমদিক থেকে মহারাষ্ট্রে ঢোকে তখন পশ্চিম উপকূল জুড়ে ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়, যার পরিমাণ প্রায় ২৫০০-৩০০০ মিমি। এরপর মৌসুমী বায়ু যত পূর্বে এগোয় তত দুর্বল হতে থাকে। এবং মারাঠওয়াড়া অঞ্চলে যখন গিয়ে পৌঁছায় সেখানে কোথাও ২০০মিমি, তো কোথাও বড় জোর বৃষ্টিপাত হয় ১৫০মিমি। তার ওপর এই খরাপ্রবণ এলাকায় সময় যত এগোচ্ছে জলসঙ্কট তত তীব্র হচ্ছে। মানে যেটা দাঁড়িয়েছে ১৯৭২ সালে যখন খরা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তখন মানুষ বা গবাদি পশুর খাদ্যসঙ্কট তৈরি হয়েছিল বটে কিন্তু ২০১২-র পরবর্তীতে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে খাদ্যসঙ্কটের সঙ্গে সঙ্গে পানীয় জলেরও তীব্র সঙ্কট শুরু হয়েছে যেটা ১৯৭২-এ ছিল না। জল এখন এ তল্লাটের এক মহার্ঘ বস্তু। জল পাওয়ার জন্য এখানে ২০০-৩০০ ফিট গভীর কুয়োর সামনে লাইন পড়ে। তবে মারাঠওয়াড়াতে ২০০ বা ৩০০ ফিট খুঁড়লেই যে জল পাওয়া যায় বিষয়টি কিন্তু মোটেই এত সরল নয়। জলের জন্য প্রতিদিনই কুয়োতে কাউকে না কাউকে চড়তে হয় অর্থাৎ নামতে হয়। তারপর সেখানে নেমে পাম্প চালিয়ে জল পাওয়া। সে জলও কিন্তু মোটেই পানের উপযুক্ত নয়, স্বচ্ছ নয়, বরং কালো… ঘোলাটে। সে জল দিয়ে বাসন মাজা, স্নান এসব করা যায়। আর সে জলের বরাদ্দও মাপা দুই কি তিন বালতি। স্নান বলতে আমরা যা বুঝি সেটা পুরো পরিবারের হিসেবে একেবারেই একটা অসম্ভব ভাবনা। তার মানে দাঁড়ালে এখানে মানুষ স্নান তো দূর অস্ত প্রতিদিন হাতে-মুখে দেওয়ার দু আঁজলা জল পেলেই বর্তে যায়। তবে মারাঠওয়াড়ার আজকের এই পরিস্থিতির জন্য শুধু যে প্রকৃতি দায়ী তা কিন্তু নয়। এর জন্য অনেকাংশেই দায়ী রাজনৈতিক উদাসীনতা অথবা স্বার্থপরতা। শুধু মারাঠওয়াড়া নয়, কৃষি বা শিল্প যাই হোক না কেন, সমগ্র মহারাষ্ট্র জলের জন্য মূলত জলাধারের ওপরই নির্ভরশীল। কিন্তু সেই জল নিয়ে বিশেষত মারাঠওয়াড়ার মতো খরাপ্রবণ অঞ্চলে রাজনীতি করে রাজনৈতিক দলের বাহুবলীরা। সাধারণ মানুষ পরিশ্রুত পানীয় জলের জন্য টাইম কলের সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা লাইন দিয়েও জল পায় না। সেখানে জলাধারের জল দেখা যাচ্ছে কোনও না কোনও চ্যানেল দিয়ে ক্ষমতাশালী মন্ত্রীর চাষের জমিতে অথবা চিনিকলে পৌঁছে যাচ্ছে। আর এভাবেই ওখানকার জলসঙ্কট তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে। আর এই জলসঙ্কট থেকেই তৈরি হয়েছে অস্তিত্বের সঙ্কট, কৃষিঋণ, আত্মহত্যার মত এক সামাজিক সঙ্কট।
‘মারাঠওয়াড়া’ মানেই এখন যেন এক মৃত ভূমি। প্রান্তরের পর প্রান্তর যে আবাদভূমি ফেটে চৌচির, যেন তার হাঁ মুখ দিয়ে সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি সব কিছুকে গিলে ফেলতে চায় সে। যেখানকার আকাশের নীল এতটাই স্পষ্ট নীল যে বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে ওঠে। যেখানকার বাতাস এতটাই তপ্ত যে শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। আকাশের অনেক ওপর দিয়ে উড়ে বেড়ায় ক্ষুধার্ত চিল, যেন মৃত্যুর আগাম খবর বয়ে বেড়াচ্ছে ওরা। যেখানকার অলি-গলিতে প্রতিধ্বনিত হয় শববাহকের হরিধ্বনি আর স্বজনের কান্নার রোল। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর টাইপরাইটারের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়তে থাকে আত্মহত্যার পরিসংখ্যান। যেখানকার শুকনো নদীখাত আর জলাধার দেখলে মনে হয় কোনও প্রত্নসভ্যতা। আর এই মাছিভনভন ভ্যাপসা গরমে শরীরের ওপর কয়েক পরোল নুন জমে যাওয়া মারাঠওয়াড়ারই সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জেলা হল বীড। যেখানে পশু আর মানুষের বিশেষত নারীদের বেঁচে থাকার মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই।
বীড-এর ৭৫ শতাংশ মানুষের বাসই গ্রামে। এবং তাদের মধ্যে ৬৭ শতাংশই দারিদ্রসীমার নীচের মানুষ। প্রতি ৩-৪ বছর ধরে মাঝারি খরা এবং প্রতি ১০ বছরে মারাত্মক খরার মোকাবিলা করতে করতে বীডের মানুষের জীবন-জীবিকা ভেঙে পড়েছে। আর সে কারণেই বীডের ৫ থেকে ৬ লক্ষ মানুষ আজ অভিবাসী কৃষিমজুরে পরিণত হয়েছেন। আজ তাঁরা সকলেই আখক্ষেতের মজুর। তাঁদের কাজ হল আখ কাটাই করা। আর এই মজুরদের অর্ধেকের বেশিই হলেন নারী। এখানে এক একজন মানুষকে এক একটি কাস্তে হিসেবে ভাবা হয়। এখানে মানুষ বাঁচে বাঁচার জন্য, সচরাচর কেউ মনেও আনে না ভালো থাকা কী, মন্দ থাকা কী? এখানে সে সব ভাবাটাও পাপ। এখানে মানুষ দারিদ্র, নিরক্ষরতা এবং ঋণের এক পঙ্কিল আবর্তে ঘুরপাক খেয়ে চলেছে। যে আবর্ত থেকে জন্ম নিচ্ছে নারীনির্যাতনের মতো এক সামাজিক ব্যাধি। এখানে প্রতিটি নারীর জীবনই অভিশপ্ত, যেন অন্ধকূপের মধ্যে প্রতিধ্বনিত এক একটা বোবা আর্তনাদ। আশ্চর্যের বিষয় হল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই নারকীয় নির্যাতনের রীতি বা নিয়মেও বদল ঘটেছে। কেমন সে সব বদল, কেমনই বা বিবর্তিত রূপ তার, এবার সে দিকেই দৃষ্টি ফেরানো যাক।
এক
হত্যা হত্যা হত্যা
এখানে স্তূপীকৃত গর্ভ-ওপড়ানো নারীদের লাশ
হ্যাঁ, বীডের শহরের মধ্যে দিয়ে নোংরা বয়ে নিয়ে যাওয়া এটাই সেই নর্দমা যেখান থেকে আমরা কথা শুরু করবে। সময়টা ২০০৯-এর জুন, বিবিসির দৌলতেই সে সময় বিশেষভাবে প্ৰথম খবরে আসে মহারাষ্ট্রের বীড জেলা। এর আগে অবশ্য খরার কারণে সংবাদে এসেছে বীড, কিন্তু এটা ছিল একেবারে চমকে দেওয়ার মতো, শহর সংলগ্ন কোনও এক নর্দমায় পড়ে থাকতে দেখা যায় গর্ভপাত পরবর্তী ১৫টি কন্যাভ্রূণ। এর পরের খবরটি ছিল আরও মারাত্মক যা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। সেখানে বলা হয় গর্ভস্থ কন্যাভ্রূণ নির্ধারণের পর সেই ভ্রূণ অপারেশন করে বের করার পর ডাক্তাররা নাকি তাদের পোষা সারমেয়দের খাওয়ার জন্য তা ব্যবহার করে। এমনকি এরকম কথাও সামনে আসে যে অনেক ডাক্তারের সারমেয় পোষার পেছনের কারণও নাকি সেটাই। কারণ এতে করে মৃত ভ্রূণ নিষ্পত্তি করার যে ঝামেলা সেটা আর পোহাতে হবে না। ভাবতে পারছেন, কখনও এরকম একটা দৃশ্য কল্পনা করতে পারছেন… মায়ের জঠোর থেকে উপড়ে আনা সদ্য একটা ভ্রূণ যে জানতই না কিছু, ছটফট করতে করতে একটু আগেই স্পন্দন হারিয়েছে, তাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে… ছিঁড়েখুঁড়ে ফালাফালা করছে দুই সারমেয়। দৃশ্যটা যিনি দেখেছিলেন ডাক্তারের সহকারী সেই শৈলজা যখন সাক্ষী দিতে গিয়ে ঘটনাটির বর্ণনা করছিলেন মাননীয় বিচারপতি তখন তাঁকে থামিয়ে দিয়েছিলেন। হ্যাঁ, এটা শোনাও অপরাধ। শৈলজা আদালতকে জানিয়েছিলেন, ওই ঘটনাটি দেখার পর তিনি দু রাত চোখের পাতা এক করতে পারেননি।
আসলে সে সময়টা বেশ কয়েক বছর ধরেই বীড জেলা জুড়ে লিঙ্গনির্ধারণ ও কন্যাভ্রূণ হত্যাকে কেন্দ্র করে এক অসাধু স্বাস্থ্যব্যবসা রমরমিয়ে চলছিল। সে সময় মহারাষ্ট্রে সরকারিভাবে নথিভুক্ত আল্ট্রাসাউন্ড সেন্টারের সংখ্যা ছিল ৬২৪০। যার মধ্যে ৭৬ শতাংশই সেইসব জেলাতে যেখানে নারী-পুরুষের অনুপাত কম ছিল। এবং আরও একটি মজার তথ্য হল, জেলাগুলোতে আল্ট্রাসাউন্ড সেন্টারগুলো যতগুলো মেশিন ব্যবহারের ছাড়পত্র পেয়েছিল তার থেকে ৫ গুণ মেশিন সেন্টারগুলোর আওতায় কাজ করছিল। অথচ সরকারিভাবে সেটা ছিল সম্পূর্ণ বেআইনি। স্বাস্থ্যবিভাগ থেকে যখনই তদন্তে আসত সেন্টারের পক্ষ থেকে মেশিনগুলোকে খারাপ হিসেবে দেখানো হত। অবশ্য এসব কিছুই আমরা জানতে পারতাম না যদি না সাতারার দলিত মহিলা বিকাশ মণ্ডলের নেত্রী বর্ষা দেশপান্ডে পথে নামতেন৷ দু দশকের বেশি সময় ধরে লিঙ্গনির্ধারণ ও কন্যাভ্রূণ হত্যার বিরুদ্ধে তিনি শুধু সোচ্চারই হননি, সরকারকে এক ছটাক হলেও ভাবতে বাধ্য করিয়েছেন। অবশ্য সে সময় বীড জেলার আল্ট্রাসাউন্ড সেন্টার ও অ্যাবর্শন সেন্টারগুলোর মধ্যের অশুভ আঁতাত নিয়ে তিনি বারবার যে অভিযোগ তুলছিলেন ২০১১-র জনগণনার তথ্য প্রকাশ পাওয়ার পর সেই সত্যতাই সর্বসমক্ষে চলে আসে। সে সময় বালক-বালিকার অনুপাত (০-৬ বছরের) যেখানে সারাদেশে ছিল ৯১৪, সেখানে বীডের অনুপাত শুধু ৮০৭-ই নয়, তার আগের ১০ বছরের হিসেবে সেই সূচক কমেছিল ৮৩ পয়েন্ট।
২০০৫ সালে “লেখ লেড়কি অভিযান’ নামে আস্ত একটা সংগঠনই তৈরি করেন বর্ষাজি। যে সংগঠন শিশুকন্যা রক্ষা করবার প্রচার চালাবার পাশাপাশি লিঙ্গনির্ধারণের বিরুদ্ধেও আওয়াজ তুলতে শুরু করে। ২০০৫ থেকে ২০১৩, এই সময়কালে বর্ষাজির নেতৃত্বে তাঁর সংগঠন সারা মহারাষ্ট্র জুড়ে সোনোগ্রাফি সেন্টারগুলোর জালিয়াতি ধরবার জন্য ৩৪টি স্টিং অপারেশন চালায়। এবং সেই অপারেশন মারফত যে তথ্যগুলো সামনে আসে তা যে শুধু চমকে দিয়েছিল তাই নয়, জনমানসের চিন্তা-চেতনার ভিতটাকেই নাড়িয়ে দিয়েছিল। এক নতুন অপরাধদুনিয়ার খোঁজ দিয়েছিল সেই স্টিং অপারেশন।
বেশিরভাগ টেস্ট রিপোর্টই মেল করত সোনোগ্রাফি সেন্টারগুলো। যদি কোনও মহিলা কন্যাসন্তান ক্যারি করে তবে তার রিপোর্টে বারবি ডলের ছবি পাঠানো হত। আর যদি পুত্রসন্তান ক্যারি করে তবে পুরুষ পুতুলের ছবি পাঠানো হত। এছাড়াও লিঙ্গ বোঝাবার জন্য আরও বিভিন্ন ধরনের সঙ্কেত ব্যবহার করত ডাক্তারবাবুরা। তার মধ্যে যেমন একটি হল সাপ্তাহিক দিনের ব্যবহার। কিছু ডাক্তার সপ্তাহের দিনগুলোর মধ্যে সোমবার আর শুক্রবারকে বেছে নেয় লিঙ্গ বোঝাবার সঙ্কেত হিসেবে ব্যবহার করবার জন্য। সোমবার ছিল শুধুমাত্র কন্যাভ্রূণদের জন্য আর শুক্রবারের রিপোর্ট মানেই সেই ভ্রূণ পুত্রসন্তান। ইংরেজি সংখ্যা 16 আর 19 ছিল আরেক ধরনের সঙ্কেত। 16 লেখা কোনও রিপোর্ট মানে সেটা পুত্রসন্তান কারণ ইংরেজি 6 সংখ্যাটি ইংরেজি অ্যালফাবেটের ছোট হাতের b-এর মতো দেখতে, আর b-তে বয়। ব্যস হিসেব মিলে গেল। একইরকমভাবে 9 সংখ্যাটি যেহেতু g-র মতো দেখতে সেকারণে 19-এর অর্থ হল কন্যা৷ 29-এর অর্থ হল যমজ কন্যা। আমরা আরও জানতে পারি এই ব্যবসা থেকে আয় হওয়া অর্থের পরিমাণ ১৫০০ কোটি। যেটা সবচেয়ে ভয়ের সেটা হল এইভাবে কন্যাভ্রূণ হত্যার কারণে প্রতি ১০ বছরে মহারাষ্ট্র হারাচ্ছে ৪.৫ লক্ষ নারীকে। প্রতি বছর হারাচ্ছে ৫০০০০ এবং প্রতি দিন হারাচ্ছে ১৪৮ জন করে। ২০১১-র জনশুনানি অনুসারে মহারাষ্ট্রে বালক-বালিকার অনুপাত কমে হয় ৮৮০। যা শুধু মারাত্মকই নয়, দুর্ভাগ্যের। ‘লেখ লেড়কি অভিযান’-এর সেই আন্দোলনের ফলে সে সময় ৪৯৪টি মামলা দায়ের হয় যার মধ্যে ৬৪টি ক্ষেত্রে অপরাধী হিসেবে দোষী সাব্যস্ত পর্যন্ত হয়েছিল সেন্টারগুলো। এছাড়াও লিঙ্গনির্ধারণ ও কন্যাভ্রূণ হত্যার সঙ্গে যুক্ত ৭০ জন ডাক্তারের সমস্ত বেআইনি কার্যকলাপ ফাঁস করে দেন বর্ষাজি এবং তাঁর সংগঠন। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় সাফল্যটি ছিল ২০১২-র বীডের ডাঃ সুদাম মুন্ডের কেসটি। যিনি দিনে গড়ে ৩৫টি অ্যাবর্শন করতেন। সুদাম মুন্ডে হলেন সেই ডাক্তার যিনি সারমেয় পুষতেন ভ্রূণহত্যার প্রমাণ লোপাটের জন্য।
বর্ষাজি নারীদের ক্ষমতায়ন, অধিকার, শারীরিক শুদ্ধতা ও মর্যাদা প্রচারের জন্য এক নিরলস যোদ্ধার মতো নিজেকে সমর্পন করেছিলেন সে সময়। শুধু তাই নয় প্রি-কনসেপশন অ্যান্ড প্রি-নাটাল ডাইগনোস্টিক টেকনিকস আইন ২০০২ প্রয়োগ করে যাতে ন্যায়বিচার পাওয়া যায় তার জন্য অত্যন্ত সাহসী পদক্ষেপ নেন তিনি। ২০১২-র ১৬ ডিসেম্বর দিল্লির গণধর্ষণ হওয়ার পর ‘লেখ লেড়কি অভিযান’ সারা মহারাষ্ট্র জুড়ে নারীদের সম্মানার্থে গণস্বাক্ষর চালিয়েছিল। সেই সঙ্গে নারীদের অধিকার, অসাম্য দূর করার জন্য গান, নাটক, পথনাটকের মাধ্যমে জনমত গড়ে তোলার কাজ শুরু করে। তাদের স্লোগান ছিল “নিজের মেয়ে নয়, ধ্বংস করো পণপ্রথা”।
যাই হোক, এই যে এতক্ষণ কন্যাভ্রূণ হত্যা এবং তার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনের ধারাবিবরণী আপনারা শুনছিলেন তা থেকে মোটেই এরকমটা ভাবার কোনও অবকাশ নেই যে বীড জেলায় কন্যাভ্রূণ হত্যা এই আন্দোলনের ফলে বন্ধ হয়ে গেছে। তবে আন্দোলনের ফলে ৩০ শতাংশ সাফল্য হয়ত এসেছে। বাকিটা সম্ভব হয়নি কারণ যাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন তাদের অর্থবল আর ক্ষমতা অনেক বেশি, অনেক দূর পর্যন্ত জান-পেহেচান। যাই হোক কথায় কথায় যে কথাটা বলাই হয়নি— এই যে হত্যা হওয়া ভ্রূণেরা… কোনও গর্ভে বড় হচ্ছিল এরা? এদের মায়েদেরও কি সম্মতি ছিল হত্যায়? না, এটা কোনও মতেই জানা সম্ভব নয়, কারণ এই মায়েদের ভালো-মন্দ কোনও কিছু মতামত দেওয়ারই কোনও অধিকার নেই। এই মায়েরা হলেন বীডের সেই পরিযায়ী ক্ষেতমজুর যারা দারিদ্র্যের কারণে বছরের আটমাস পশ্চিম মহারাষ্ট্রে আখ কাটাইয়ে যেতে বাধ্য হন। এখন প্রশ্ন হল কেনই বা এঁরা বাধ্য হন ভ্রূণহত্যা মেনে নিতে? একটা নয়, এর পেছনে রয়েছে অনেকগুলো কারণ। যেমন আপনারা শুনলে অবাক হবেন… এই যে গর্ভবতী মায়েরা, এই মায়েদের একটা বড় অংশ শুধু যে নিজেদের অনিচ্ছাতে গর্ভবতী হন তাই নয়, গর্ভধারণের সঙ্গে তাঁদের স্বামীদের কোনও যোগ নেই। অর্থাৎ তাঁরা ধর্ষিত হন এবং সেই ধর্ষণটা তাঁরা মেনে নিতে বাধ্য হন। কারণ, সেই ধর্ষণটা সংগঠিত হয় জমির মালিক অথবা দালাল দ্বারা। এটা শোনার পর নিশ্চয়ই আপনি ভাবছেন কেন ওখানে কি কোনও আইন নেই? কেউ কি কোনও প্রতিবাদ করে না? ধর্ষিতাদের স্বামীরাও কি চুপচাপ সব মেনে নেয়? কেন মেনে নেয়? জানি এই ২০২০-তে এসে এরকম একটা কথা মেনে নিতে আপনার অসুবিধে হচ্ছে। হ্যাঁ, আইন আছে, কানুন আছে, গণতন্ত্র আছে, নির্বাচন আছে, নির্বাচিত প্রতিনিধি আছে। কিন্তু সবাই তো ক্ষমতার দিকে। আর ক্ষমতা আবার ধর্ষকের দিকে। সুতরাং মুখ বুজে মেনে নেওয়া ছাড়া কী আর উপায়! তাছাড়া ধর্ষিতা একক বা সংগঠিতভাবে যদি থানা-পুলিশ করেন, তবে তাঁরা জানেন সেটা পাঁচ কান হলে সামনের মরসুমে কোনও দালাল বা ক্ষেতমালিকই তাঁদের কাজে নেবে না। এমনকি ধর্ষিতার গ্রাম যদি সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ জানায় তবে হয়ত পুরো গ্রামটাই কাজ পাবে না। আর কাজ না পাওয়া মানে অর্ধাহার, অনাহার। খিদের কাছে যে সবাইকেই হার মানতে হয়।
কন্যাভ্রূণ হত্যার আরও একটা বড় কারণ হল যুগ যুগ ধরে মেয়েদের নিয়ে তৈরি হওয়া সামাজিক ধারণা। বিশেষত বীডের মতো পিছিয়ে পড়া দরিদ্র, নিরক্ষর অঞ্চলে। যেখানে এখনও কোনও ব্যক্তিমানুষ বা একক-মানুষ, সে যদি আবার হয় দরিদ্র বা পিছিয়ে পড়া, তবে তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনও ক্ষমতা নেই। সে বিবাহই হোক বা পানীয় জলের নলকূপ— এখনও সেখানে সমাজপতি বা সরপঞ্চই সমস্ত সিদ্ধান্ত নেয়। যারা মূলত পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিনিধি। তো সেই সমাজ মনে করে মেয়েরা হল অন্যের সম্পত্তি। অর্থাৎ মেয়ে মানেই তাকে বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। সে অন্যের ঘরে চলে যাবে। বিয়ের আগে পর্যন্ত তাকে বড় করে তোলার যে খরচ সেটা তার মানে পুরোটাই জলে যাওয়া, বিশেষ করে এরকম অনটনের সংসারে। তারপর বিয়ের সময় পণ ও অন্যান্য খরচ তো আছেই। সেই পরিমাণটাও নাই নাই করে ২ থেকে ৩ লক্ষ। সবমিলিয়ে পুরোটাই গচ্ছা। এই ধারণাগুলোই বীডের গ্রামীণ মানসে এমনভাবে গেঁথে বসে আছে যে, গর্ভবতী মায়েরাও এখন আর কষ্ট পান না। তাছাড়া সুশীলাদেবীর মতো বয়স্কাদের মত হল, জন্মপরবর্তী নরকজীবনের থেকে পেটে থাকতে মরা তবু ভালো। আর যন্তরটা আইসে একদিক থেকে ভালোই হইছে। মাইয়াগুলানকে আর জন্মানের পর আছাড় খাইয়া মরতে হতিসে না। অতে থানা-পুলিশ, কোর্ট-কাছারিরও একটা ভয় ছেলো। হ্যাঁ, একদম সঠিক কথা— একটা সময় পর্যন্ত বীডে কন্যাভ্রূণ নয়, শিশুকন্যা হত্যারই প্রচলন ছিল। আর যারা হত্যা করতে পারত না, তারা ফেলে দিত। এমনও হত, ব্যথা ওঠাতে হয়ত প্রসূতিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, পথেই ট্রাক্টরের মধ্যে প্রসব হয়ে গেল। আর প্রসব হল কন্যাসন্তান। ঠিক তখন মেয়ের বাপ মেয়েকে কাঁথায় মুড়ে ছুঁড়ে দিল ট্রাক্টর থেকে। বীডে এরকম খুঁজলে ৪-৫ জনের সঙ্গে আপনার দেখা হওয়াটা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। কারণ তারা ছুঁড়ে ফেলার পরেও মারা যায়নি। শুধু তাই নয়, এখন তারাও এক একজন মা। বীডে বা ওই অঞ্চলে শিশুকন্যা হত্যার ঘটনাটা আকছারই ঘটত। এখনও অবশ্য হঠাৎ-মটাৎ সংবাদপত্রে এ ধরনের হত্যার খবর প্রকাশ পায়। যাইহোক সুশীলাদেবীর কথায় ফেরা যাক— “দেখো বাপু, দশমাস দশদিন পেটে ধরা সন্তান মাইয়াই হোক আর যাই হোক তার ওপর তো একটা মায়া হইয়াই যায়। তো সেই সন্তানরে মাইরা ফেলাটা কি কোনও মা মাইনা নিতে পারে! তার মনের ভিতর যে ঝড় সে তো শুধু আর কাইন্দা থামে না… অর থেইকে এই যন্তরটা আইসে একদিকে ভালো হইসে। ফুল ফুটনের আগেই খইসা পড়তেসে। মায়া তৈরি হওনের কোনও প্রশ্নই নাই। থানা-পুলিশ, কোর্ট-কাছারির খরচাপাতিও নাই।” আগে যে হত্যা ছিল অপরাধ, এখন যন্ত্রের কল্যাণে সেটাই আইনসঙ্গত। শুধু মধ্যেখানে কয়েক মাসের ব্যবধান। আর আইনসঙ্গত এই অপরাধটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাণিজ্য… অর্থপিশাচ চিকিৎসকের দল, সর্বহারা মানুষগুলোকে ধাপে ধাপে সর্বস্বান্ত করবার এক আশ্চর্য উপায়। অথবা শিশুকন্যা হত্যা থেকে কন্যাভ্রূণ নিষ্কাশন— এ যেন অনেকটা ওই নির্যাতনের বিবর্তিত রূপের মতো। তবে বীডের এই নারকীয় বিবর্তন এখানেই থেমে যায়নি। পরের ধাপটা আরও ভয়ঙ্কর।
দুই
গর্ভহীন এক নারীর দেশ
আমি মানডা উগালে, খরাপ্রবণ এই মারাঠওয়াড়ার বীড জেলার হাজিপুর গ্রামের বাসিন্দা। বীডের কয়েক লক্ষ ক্ষেতমজুরের মতো আমিও একজন মজুর যে আখ-কাটাইয়ে যাই। হঠাৎ করে কেন আমি কথা বলতে শুরু করলাম আপনাদের মনে হতেই পারে, আসলে নিজের কথা তার সঙ্গে সঙ্গে এখানকার মেয়েদের কথা, আমাদের বাঁচার কথা শোনাব… তাই আসা। আমরা বীডের মেয়েরা এখন এক নতুন অলঙ্কারে বিশেষ হয়ে উঠেছি। সারা দেশের মধ্যে যা বিরল। আমাদের গ্রামে জরায়ু রয়েছে এমন বিবাহিত নারী খুঁজে পাওয়াটাই অস্বাভাবিক। আমরা এখন জরায়ুহীন, জঠরহীন। আমার পাশের আর এক গ্রাম ভানজারওয়াডিতে ৫০ শতাংশ মহিলারই হিসটেরেকটমি হয়ে গেছে। দুই-তিন সন্তানের মা, যারা নিজের জরায়ু অপারেট করিয়ে ফেলেছে… এই বিষয়টা এখন এখানকার প্রতিটি গ্রামেরই রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতিমধ্যেই যাদের হিসটেরেকটমি হয়ে গেছে তাদের অনেকেরই বয়স মাত্র ২২ কী ২৩, কথাটা অস্বাভাবিক শোনালেও এটাই বাস্তব। কারণ খরাপ্রবণ এই অঞ্চলে দারিদ্র্যের কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মেয়েদের বিয়ে হয় ১৪, ১৫ বা ১৬-র মধ্যে। ফলে ২০ বা ২২-এর মধ্যেই সে দু-তিন সন্তানের মা হয়ে যায়। আর তারপর জরায়ু থাকলেই বা কী না থাকলেই বা কী। এভাবেই এখানকার মেয়েদের বোঝানো হয়, মেয়েরা বোঝেও তাই৷ বৈশালীর কথা শুনলে সেটা আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে। ডিসচার্জ এবং ইনফেকশনের কারণে আমাকে বারবার ডাক্তারের কাছে যেতে হত। তো ওখান থেকে বলা হল আমার জরায়ুটা নষ্ট হয়ে গেছে, বাদ দিলেই ভালো। আমিও ভাবলাম আমার তো দুই ছেলে। জরায়ুর যা কাজ ছিল সেটা তো হয়েই গেছে। ওটা না থাকলে যদি যন্ত্রণা কমে তবে সেটাই ভালো।
আর এভাবে না ভেবে উপায়ই বা কী। কারণটা তো সেই অর্থনীতি আর যৌননির্যাতন। সেটা অবশ্য সকলে প্রথমে স্বীকার করে না। যেমন ঘোডকা রাজুরী গ্রামের শীলা। শীলার বিয়ে হয়েছিল ওর ১২ বছর বয়সে। ওর দুই ছেলে এক মেয়ে। শীলাকে ওর জরায়ু বাদ দেওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করা হলে ও বলে, “আমার হোয়াইট ডিসচার্জ হত, ডাক্তারের কাছে গেলে তিনি বলেন এর কারণে আগামীতে ক্যান্সার হতে পারে। জরায়ু বাদ দেওয়াটাই জরুরি, তাই বাদ দিয়েছি। ভানজারওয়াডির সুমিতার সেই একই কথা। জরায়ু বাদ দেওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে ভানজারওয়াডির কম করে ১৫ জন মহিলা নিঃসঙ্কোচে বলেন, “বারবার ইনফেকশন হত তাই হিসটেরেকটমি করিয়েছি,” “মাঝে মাঝেই তলপেটে ব্যথা হত তাই এই সিদ্ধান্ত”— এটা মঙ্গলা আর গুনাবাঈয়ের বক্তব্য। কিন্তু আসল কারণটা হল বীড তথা সারা মারাঠওয়াড়ার সমস্ত অভিবাসী মহিলা ক্ষেতমজুর আমরা যারা আখ কাটাই করে আমাদের সকলের কাছেই আমাদের শরীরের ঋতুচক্রটা এখন একটা বোঝা। কারণটা সেই অর্থনীতি। একটু খুলেই বলি।
এই যে আখ কাটাইয়ের জন্য আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় এর শুরুটা হয় সুগার ফ্যাক্টরি এবং দালাল অর্থাৎ মুকাদামদের সঙ্গে চুক্তির মধ্যে দিয়ে। মুকাদামরা ফ্যাক্টরি থেকে কমিশন পায়। আর সেই কমিশনটা মজুরদম্পতিকে তারা যে টাকা দেয় তার ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ। সাধারণত আখ কাটাইয়ের মজুরদের দম্পতির হিসেবে ভাড়া করা হয়। অবশ্য এই অঞ্চলে এর একটা পরিচিত নাম রয়েছে, জোড়ী। মুকাদামরা প্রতিটা জোড়ীকে একটা ইউনিট হিসেবে ধরে, যার নাম এক কইতা। এক জোড়ীর রেট ৬ মাসের জন্য ৮০০০০ টাকা থেকে ১২ লাখের মধ্যে ওঠানামা করে। প্রতি বছর দিপাবলীর পর জোড়ীরা কাজে যোগ দেয়। এবং এই চুক্তিবদ্ধ সময় ধরে এক একটা জোড়ীকে দিনে ১২-১৮ ঘন্টা কাজ করতে হয়। যদি কম উৎপাদনের জন্য চুক্তিবদ্ধ সময়ের কাজ শেষ হয়ে যায় তবে জোড়ীকে অগ্রিম নেওয়া টাকার একটা অংশ মুকাদামকে ফেরত দিতে হয়। আর যদি সেক্ষেত্রে জোড়ী টাকা ফেরত দিতে না পারে, তবে টাকা ফেরত না দেওয়া পর্যন্ত তাদের আটকে রাখা হয়। অনেকটা দাসব্যবস্থার মত।
‘দাস’ শব্দটা যখন উঠলই, তাহলে শুনুন এক একটা জোড়ীর কাজ শুরু হয় সকাল ৬টা থেকে। অবশ্য মেয়েদের দিন শুরু হয় আরও ২ ঘন্টা আগে থেকে, ভোর ৪টে নাগাদ উঠে তাদের রাঁধাবাড়া সেরে ফেলতে হয় কারণ এরপর সারাদিন তারা আর খাবার তৈরির কোনও সময় পায় না। আর সময় না পাওয়ার পেছনের কারণ হল দিনে এক একটা জোড়ীকে ৩ থেকে ৪ টন আখ কাটতে হবেই। তাছাড়া চুক্তি মোতাবেক তারা পুরো মরসুমে ৩০০ টন আখ কেটে শেষ করতে পারবে না। আর শুধু তো আখ কাটা নয় সেই আখ আবার মাথায় করে বয়ে লরি বা ট্রাক্টরে তুলে দিতে হয়। আর সে জন্যই এই পুরো ব্যবস্থাটার মধ্যে সময় একটা বড় বিষয়। এখানে অবসর, বিশ্রাম বলে কিছু নেই, এমনকি কেউ অসুস্থ হলেও কাজ বন্ধ করে না… করতে পারে না। কারণ করলেই মজুরি কাটা যায়। দিন প্রতি ৫০০ টাকা। এখানে মজুরির হিসেব হয় আখ কাটাইয়ের হিসেবে, ১ টন আখ কাটাই করলে তার মূল্য ধরা হয় ২৫০ টাকা। আর মজুরি কাটার এই হিসেবটার সঙ্গেই জুড়ে রয়েছে আমাদের জরায়ু বাদ দেবার বিষয়টি।আসলে আমাদের ঋতুচক্র….প্রতি মাসে ওই সময়টা আসলে প্রথম দু’একদিন শারীরিকভাবে এতটা যন্ত্রণার মধ্যে থাকে যে কাজ করার মতো কোনও শক্তিই থাকে না।আর কাজ মানে তো শুধু আখ কাটাই নয়, এক একজনকে ৩০-৪০ কেজি আখ এক একবারে বইতে পর্যন্ত হয়। যা ওই দিনগুলোতে ওই শরীরে অসম্ভব। সুতরাং বাধ্য হয়েই কাজ বন্ধ করতে হয়। আর কাজ বন্ধ মানেই মুকাদাম টাকা কেটে নেবে। আর এই কারণে টাকা কেটে নেওয়া মানে ৫-৬ মাসের হিসেব করলে সব মিলিয়ে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা মোটের ওপর কেটে নেয় মুকাদাম। যদিও জোড়ীর একজন অর্থাৎ স্বামীরা কাজ চালিয়ে যায়। কিন্তু যেহেতু সব কিছু জোড়ীর হিসেবে ধরা হয় তাই এই নিয়ম। পাশাপাশি আরও একটা বিষয় হল মজুররা যেখানে থাকে সেটা টিন আর নারকেলের পাতা দিয়ে তৈরি কোনওমতে মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই, ঝুপড়িও বোধহয় ওর থেকে ভালো। সেখানে পেচ্ছাপ-পায়খানাও সারতে হয় মাঠেঘাটে। যার ফলে ঋতুচক্রের দিনগুলোতে শুধু যে সমস্যা হয় তাই নয়, সহজে ইনফেকশনও হয়। এখানে স্যানেটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের চলও নেই। তাছাড়া মুকাদাম বা মালিকদের চাপে অনিচ্ছাকৃত সহবাস তো আছেই। আর এই সবকিছুর থেকে মুক্তির সবথেকে বড় উপায় হল হিস্টেরেকটমি। আর সেকারণেই শুধু বীড নয় সারা মারাঠওয়াড়ার মহিলারাই মুক্তির উপায় হিসেবে গর্ভহীনতাকেই আঁকড়ে ধরেছে। কেউ কেউ হয়ত বলবেন ন্যাপকিন তো আশা কর্মীদের কাছেই পাওয়া যায়। পাওয়া যায় বটে সে দু-একটা, নিয়মিত ওরা দিতে পারে না। বীডের বাজারে সবচেয়ে কম দামের যেটা পাওয়া ১২টার প্যাকেট সেটার দাম ১০০ টাকা। বীডের মহিলাদের কাছে ওই ১০০ টাকাই অনেক। দুটো টাকার জন্য কত মানুষ এখানে অসুস্থ শরীরেই ক্ষেতে কাজ করতে করতে মারা যায়। হয়ত দু দিন বিশ্রাম নিলেই বেঁচে যেত, কিন্তু ওই যে ফাইনের ভয়। এ এক নরকজীবন আমাদের, এর থেকে মুক্তি নেই।
মানডের কথার পরিপ্রেক্ষিতে যে কথাটা এরপর সামনে আসে এই যে বীডের নারীদের মধ্যে হিস্টেরেকটমির ভাবনা এটা কি তাদের নিজেস্ব উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে তারা অনুধাবন করেছেন? একেবারেই না। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন মুকাদামরা, যুক্ত রয়েছেন বিভিন্ন বেসরকারি নার্সিংহোমের ডাক্তার আর এই সবকিছুর পেছনে রয়েছে বিরাট অঙ্কের অর্থ আয়ের এক দুষ্টচক্র। এখানে লক্ষ করার মতো বিষয় হল ৩৪ বছরের সঙ্গীতা, ২৮ বছরের রাধা মুগলে, ৩৭ বছরের পুস্পা, ৪৫ বছরের রুক্মিনী, গুনাবাঈ, মঙ্গলা, সুমিতা, শীলা, ছায়া এরা প্রত্যেকেই ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পর গল্পটা এক। মানে যখনই বীডের বা ওই অঞ্চলের কোনও মহিলা ইনফেকশন, হোয়াইট ডিসচার্জ বা তলপেটের ব্যথা নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে ডাক্তাররা প্রত্যেকেই ক্যান্সারের ভয় দেখাচ্ছে এবং প্রতিকার হিসেবে সহজ উপায় হিস্টেরেকটমি করার পরামর্শ দিচ্ছে। আর হিস্টেরেকটমির এই বিজ্ঞাপনটা বীডের মহিলা মণ্ডলের মধ্যে জনপ্রিয় করে তোলবার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছে মুকাদামরা। কারণ কমিশন। বেসরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররা জানে এক একজন মুকাদাম ক্ষেতে ২০০ কইতা সাপ্লাই করে মানে ১০০ নারী একজন মুকাদামের হাতে থাকে। তাছাড়া যেহেতু ওরা টাকার কারণে মুকাদামের হাতে বাধা থাকে। ফলে মুকাদামরাও জানে তার পক্ষে বোঝানোটাও সুবিধে। হিস্টেরেকটমি করলে ফাইন দিতে হবে না, এই টোপটা সহজেই সবাই গিলে ফেলে। তার ওপর হিস্টেরেকটমির জন্য যে ৩৫০০০ টাকা ডাক্তার-খরচ সেটাও ধার হিসেবে মুকাদামই জোড়ীদের দেয়, সঙ্গে ক্যান্সারের প্রচার। সব মিলিয়ে এক বিশাল স্বাস্থ্যব্যবসা চলছে বীড তথা মারাঠওয়াড়া জুড়ে। আর তারই সৌজন্যে ২০১৬-১৯ এই সময়কালে বীডে ৪৬০৫ জন নারী তাদের জরায়ু বাদ দিয়েছেন। যে সংখ্যাটা সারা দেশের সঙ্গে তুলনা করলে ১৪ গুণ বেশি। ২০১৮-তে সরকারি একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায়, বীডের ২০০ জন মহিলার মধ্যে ৭২ জনই গর্ভহীন। অর্থাৎ শতাংশের হিসেবে বীডের ৩৬ শতাংশ মহিলারই হিস্টেরেকটমি হয়ে গেছে। যেখানে সারা মহারাষ্ট্রে সংখ্যাটা ২.৬ শতাংশ এবং ভারতে ৩.২ শতাংশ। একইভাবে ২০১৯ সালে ২৭১ জন মহিলার ওপর সমীক্ষা চালিয়ে জনস্বাস্থ্য অভিযান যে তথ্য সামনে আনে সেটা ৫৬ জন অর্থাৎ ২১ শতাংশ মহিলা গর্ভহীন। এই যে অপারেশনগুলো হয়েছে তার বেশিরভাগটাই হয়েছে ১১টি হাসপাতালের মধ্যে। ২০১৮ এবং ২০১৯-এ যে অপারেশনগুলো হয়েছে তার ৮৫ শতাংশই হয়েছে বেসরকারি হাসপাতালে। তার মধ্যে একটি হাসপাতালে একজনও গাইনোকোলজিস্ট না থাকা সত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে সেখানে ২৪টি হিস্টেরেকটমির মতো অপারেশন হয়েছে। সব মিলিয়ে মহারাষ্ট্রে গর্ভহীন নারীর সংখ্যা ৩০০০০-এর বেশি। পরিস্থিতি এতটাই উদ্বেগজনক যে মহারাষ্ট্র বিধানসভাও নড়ে বসেছে। সেই সঙ্গে জাতীয় মহিলা কমিশনও মহারাষ্ট্রের চিফ সেক্রেটারিকে আইনসঙ্গত ব্যবস্থা নেবার জন্য নোটিস পাঠিয়েছে। এতে করে হিস্টেরেকটমির পরিমাণ কমবে কিনা সেটা সময় বলবে, তবে হিস্টেরেকটমির পরও কিন্তু বীডের নারীরা যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাননি। বরং জরায়ু বাদ দেওয়ার পর থেকে এরা প্রত্যেকেই মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার শিকার। হরমোনাল ইমব্যালেন্সের কারণে মেন্টাল হেলথ ইস্যু, স্থূলতা, ক্যালসিয়ামের ঘাটতি, আর সারা শরীর জুড়ে ব্যথা যেন প্রত্যেকের নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা এই ৩০-৩৫ বছর বয়সেই শারীরিক ক্ষমতার দিক থেকে প্রত্যেকে কেমন যেন বুড়িয়ে যাচ্ছেন। কেউ আর আগের মতো ভার বইতে পারছেন না। কারও কারও তো কোমরের ব্যথা এমন পর্যায়ে পৌচ্ছছে যে হাঁটতে পর্যন্ত পারছেন না। ফলে আবার খরচ। একদিকে অক্লান্ত অমানুষিক পরিশ্রম, পর্যাপ্ত ঘুম নেই, খাওয়া নেই, খাওয়া বলতে ওই জোয়ারের রুটি আর চাটনি… কাউকে কাউকে আবার অন্তঃসত্তা অবস্থাতেই কাজ করতে হয়, ফলে সব মিলে ওঁদের প্রতিটি শরীর এমনিতেই ঝাঁঝরা। এর ওপর আবার হিস্টেরেকটমি! হরমোনাল ইমব্যালেন্সের কারণে কী হবে ওদের ভবিষ্যৎ তা কেউ জানে না। পেটে আসা থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই এখানকার মেয়েদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
কথায় কথায় বলা হয়নি বীডে প্রতি বছর ৪০০০-৫০০০ কিশোরীর ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনা ঘটার পেছনেও রয়েছে আখ ক্ষেত। যে সব জোড়ীর ঘরে ১৩-১৪ বছরের মেয়ে রয়েছে তারা মেয়েদের বাড়ির বয়স্কদের হেফাজতে রেখে যায়। আর সেই সুযোগটাই নেয় এলাকার যুবকরা। প্রতি বছর বীড থেকে প্রায় ১০০০-এর মত কিশোরী দেশের বিভিন্ন ব্রথেলে পাচার হয়ে যায়। এই পাচারের সঙ্গে অবশ্য কম বয়সে বিবাহেরও একটা যোগ রয়েছে। সীমার গল্পটা থেকে যেটা পরিষ্কার হয়ে যায়। সীমার বিয়ে হয়েছিল ১৪ বছর বয়সে, ২৬ বছরের এক যুবকের সঙ্গে। বিয়ের পর সীমাকেও আখ কাটাইয়ে যেতে হয়েছিল। একদিকে আখ কাটাইয়ের অমানুষিক পরিশ্রম সেই সঙ্গে বৈবাহিক ধর্ষণ। টানা এক বছর ওভাবে চলার পর সীমা সেখান থেকে পালায় এবং পাচারকারীর খপ্পরে পড়ে পুনেতে পাচার হয়ে যায়। হ্যাঁ, ঠিক এভাবেই পাচার হওয়া কিশোরীদের একটা অংশ সীমার পথেই পাচার হয়।
কিন্তু এই নরক থেকে মারাঠওয়াড়ার নারীদের মুক্তির সত্যিই কি কোনও উপায় নেই? আমাদের রাষ্ট্রের হর্তা-কর্তা-বিধাতারা কি কোনও কিছুই জানেন না? জানেন সকলেই। গণতন্ত্র রক্ষার নিমিত্তে নির্বাচনব্যবস্থাও জারি রয়েছে বীডে। কী বিজেপি কী এনসিপি— ভালোভাবেই জানে অভিবাসী শ্রমিকদের ওপর মুকাদামরা কীভাবে দিনের পর দিন শোষণ চালিয়ে যাচ্ছে। এই দাদনব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে তারা বছরের পর বছর ধরে একটা দাসব্যবস্থা চালিয়ে যাচ্ছে। কোনও মজুর কোনও কারণে যদি কাজ না করতে পারে, সে যদি দাদনের টাকা ফেরত না দেয়, তবে মুকাদামরা মেরে পর্যন্ত ফেলে। আখ কাটাইয়ের মহিলাদের ওপর ধর্ষণ বা যৌন হেনস্থার কথাও জানে তারা। আর অ্যাবর্শনের পেছনেও যে মুকাদামদের যৌন হয়রানি দায়ী সেটাও আজ সর্বজনবিদিত। আসলে রাজনৈতিক দলগুলো সব জেনে না জানার ভাব করে কারণ আখ ক্ষেত বা চিনি কারখানাগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কোনও না কোনও নেতারই। তারপর ধরুন বাচ্চাদের ওপর যৌন নির্যাতন বন্ধ করবার জন্য যে হোস্টেলগুলো বানানো হয়েছে, তার ৯০ শতাংশই কোনও না কোনও রাজনীতিবিদদের দখলে। অথচ এই হোস্টলগুলো চালাবার জন্য ৭৫ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ করে সরকার। আর একটি আশ্চর্যের বিষয় হল বীড থেকে লোকসভা ভোটে মনোনীত সাংসদ একজন নারী। এমনকি ২০১৪-তে বীডের পার্লি বিধানসভা কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত প্রার্থী শুধু যে একজন নারী ছিলেন তাই নয়, তিনি সে সময় গ্রামীণ, নারী ও শিশুকল্যাণ দপ্তরের মন্ত্রী পর্যন্ত ছিলেন। কিন্তু তারপরও পরিস্থিতির এতটুকু রদবদল হয়নি। বরং ওই সময়কালেই সবচেয়ে বেশি হিস্টেরেকটমি হয়েছে। সত্যিই কি কোনওদিন এই নরক থেকে উদ্ধার পাবে বীড তথা মারাঠওয়াড়ার নারীরা। আছে কি কোনও গণতান্ত্রিক উপায়? জানি না, জানা নেই। তবে যেভাবে নিজের নারীত্বকে নির্দ্বিধায় বিসর্জন দিয়ে চলেছে বীডের নারীরা তাতে কখনও কখনও কেন জানি মনে হয় এই আত্মবলিদান আসলে এক নীরব প্রতিবাদ। পুরুষতান্ত্রিক এই রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বিনাশ করতেই গর্ভহীন নারীর দেশ নির্মাণে ব্রতী হয়েছেন তারা।
হে রাষ্ট্র, এখনও সময় আছে দায়িত্ববান হও… ব্যবস্থা নাও… গর্ভহীন, সন্তানহীন, প্রজন্মহীন, স্বপ্নহীন এক ভূখণ্ডের শাসক হয়ে তুমি করবেটা কী? কখনও ভেবে দেখেছ জরায়ুহীন ওই মেয়েগুলোর আখ কাটাই ছাড়া আর কোনও অস্তিত্বই নেই, ওরা প্রত্যেকেই এখন এক একটা মেশিন। আর তুমি সে মেশিনের মালিক হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে পারবে তো? এখনও সময় আছে, ভেবে দেখো…