সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
যা আছে মহাভারতে
মহাভারত। ভারতবর্ষের অন্তর্লীন যাপনের এক আশ্চর্য ইতিকথা। ব্যাসদেব বিরচিত এই মহাকাব্যিক আখ্যানের রোমাঞ্চকর কাহিনির সঙ্গে আপামর ভারতবাসীর পরিচিতি দীর্ঘদিনের। মোট আঠেরোটি পর্বে বিভক্ত এই মহাকাব্যের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে নানান কাহিনি। নানা পর্বের পাকদণ্ডী পেরিয়ে ব্যাসদেবের লেখনীর হাত ধরে আমরা পৌঁছে যাই প্রায় একেবারে অন্তিম পর্বে— মহাপ্রস্থান পর্বে (সপ্তদশ পর্ব)। এই পর্বের কিছু অংশের পাঠপর্ব থেকেই আমরা শুরু করব আজকের আখ্যায়িকা।
অর্জুনের কাছে ব্যাসদেবের উপদেশের কথা শুনতে পেয়ে যুধিষ্ঠির রাজ্য ছেড়ে মহাপ্রস্থানের সঙ্কল্প গ্রহণ করলেন।
অভিমন্যুর পুত্র পরীক্ষিৎকে রাজসিংহাসনে অভিষিক্ত করা হল। তার এবং দুর্যোধনের বৈমাত্রেয় ভাই যুযুৎসুর ওপরে রাজ্যভার অর্পণ করে ভ্রাতাদের এবং দ্রৌপদীকে নিয়ে যুধিষ্ঠির চললেন মহাপ্রস্থানের পথে। তাঁরা সকলে রাজভূষণ এবং রাজবেশ পরিত্যাগ করে বল্কল গ্রহণ করলেন, বিধিপূর্বক হোম করলেন, তারপরে করলেন পদব্রজে যাত্রা শুরু। রাজ্যের অশ্রুমুখ সব নরনারীদের পিছনে রেখে তাঁরা চলে গেলেন নগরের বাইরে। তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে চলল একটি…
শশিভূষণ দাশগুপ্ত কৃত ‘ছোটদের মহাভারত’ গ্রন্থ থেকে সঙ্কলিত এই নির্বাচিত অনুচ্ছেদটি পাঠ করে পাঠকদের অনেকেই হয়তো মহাপ্রস্থানযাত্রী সপ্তম চরিত্রটিকে চিহ্নিত করতে পারছেন। না-পারলে উৎকণ্ঠিত হওয়ার কারণ নেই, কারণ সপ্তদশ পর্বের পাট চুকিয়ে আমরা এবার প্রবেশ করব মহাকাব্যের অন্তিম পর্বে— স্বর্গারোহণ পর্বে।
নানান পার্থিব স্খলনের কারণে দ্রৌপদী সহ একে একে চার পাণ্ডব ভ্রাতা সহদেব, নকুল, অর্জুন ও ভীমের পতন হল স্বর্গপথে মহাযাত্রাকালে। একে একে প্রিয়জনদের পেছনে ফেলে যুধিষ্ঠির এগিয়ে চললেন তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্যে।
চলতে চলতে যুধিষ্ঠির সহসা দেখতে পেলেন, স্বর্গ থেকে ইন্দ্র তাঁর রথ নিয়ে উপস্থিত। ইন্দ্র যুধিষ্ঠিরকে বললেন, ‘আপনি রথে চড়ুন, আমি আপনাকে স্বর্গে নিয়ে যাব।’ ….
যুধিষ্ঠির বললেন, ‘এই …. কিন্তু আমার সঙ্গে যাবে।’
ইন্দ্র বললেন, ‘তা তো হয় না মহারাজ; আপনার অশেষ পুণ্যের জন্যে আপনি সশরীরে স্বর্গে যেতে পারবেন, কিন্তু …. স্বর্গে যাবে কী করে?’
যুধিষ্ঠির বললেন, ‘আমার আশ্রিতকে আমি ত্যাগ করতে পারব না।’
ইন্দ্র বললেন, ‘তবে আপনি সারা জীবনের পূণ্যকর্মের দ্বারা লাভ করেছেন যে স্বর্গের অধিকার তা এই ….. জন্য ত্যাগ করবেন?
যুধিষ্ঠির বললেন, ‘হ্যাঁ, তা-ই ত্যাগ করব।’
তখন ….. স্বমূর্তি ধারণ করে বললেন, ‘মহারাজ যুধিষ্ঠির, আমি …. নই, আমি ধর্ম; তোমাকে পরীক্ষা করবার জন্য …. বেশে তোমার সঙ্গে সঙ্গে এসেছি। … তুমি স্বর্গে চলো।’
মাননীয় পাঠকগণ! এবার নিশ্চয়ই মহারাজ যুধিষ্ঠিরের সঙ্গীটিকে আপনারা সঠিকভাবে চিনতে পেরেছেন। আর যদি সেটা এখনও সম্ভব না হয়ে থাকে, তাহলে আরও খানিকটা সময় এই অধম গদ্যকারের সঙ্গে পথ চলতে হবে আপনাদের, ধৈর্য্য ধরে।
যাত্রা হল শুরু…
ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে প্রতিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে খাইয়ে নিজেকে নানাভাবে গড়েপিটে নিয়ে মানুষ আজকের অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। এ এক দীর্ঘ অভিযাত্রার কাহিনি। আজ, এই মুহূর্তে যত সহজে এই কথাগুলো বলতে বা লিখতে পারছি, মানুষের এই আশ্চর্য উত্তরণ কিন্তু কখনওই এত সহজে ঘটেনি। নানা প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার সঙ্গে মানুষকে লড়তে হয়েছে; প্রত্যেক পর্বের লড়াই থেকেই মানুষকে একটু একটু করে শিখতে হয়েছে নিজেকে টিকিয়ে রাখার কৃৎকৌশলগুলিকে। আর এর সুবাদেই একটু একটু করে মানুষ অনিশ্চিত জীবনের স্তর থেকে এক সুস্থিত জীবনযাপনের স্তরে নিজেকে উত্তীর্ণ করেছে। বিষয়টি নিয়ে সমাজবিজ্ঞানী ও নৃতাত্ত্বিকদের মধ্যে বিতর্ক থাকলেও একটা বিষয়ে দুই পক্ষই প্রায় সহমত যে, প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নিয়ে যেদিন মানুষ নিজের ইচ্ছে মতো আগুন জ্বালাতে পারল সেদিন থেকেই যেমন তার দৈনন্দিন কৃচ্ছ্রতার স্তরে পরিবর্তন এল, ঠিক তেমনই পরিবর্তন এল আরও দুটি প্রয়াসের সূত্র ধরে। কী সেই দুটি প্রয়াস? এক, চারপাশের গাছগাছালির জীবনচক্রকে বুঝতে পারা— বীজ থেকে গাছ জন্মানোর আশ্চর্য প্রকৌশল রপ্ত করা; আর দুই, বনের পশুকে বন্যতামুক্ত করে তাদের ক্রমশ মানুষের বশ্য করে তোলা। এই দুটো কাজের বা দক্ষতার সূত্র ধরেই আদিমানুষের অস্থিত যাযাবর জীবনে স্থায়ী যাপনের পরশ লাগল। তবে কোন কাজটা মানুষ আগে শিখেছিল তা নিয়ে কিন্তু বিতর্ক আজও চলছে। সেই বিতর্কে না ঢুকে আমরা পশু ও মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে দু-একটি কথা আলোচনা করব।
মানুষ ও সারমেয়— এক অনন্য মিথোজীবিতা
মানুষ আর পশুর মধ্যে আন্তঃসম্পর্কের বিষয়টি কিন্তু সুপ্রাচীন। এখানেও বিতর্ক রয়েছে। কোন পশুকে আমাদের আদি পূর্বজরা প্রথম বশ্য এবং পোষ্য বানিয়েছিল? এক দল পণ্ডিত মনে করেন মানুষের প্রথম পোষ্য হল তুরগ, আর এক দলের মতে সারমেয়দের বশ করানোর বিদ্যাই মানুষ সর্বপ্রথম রপ্ত করেছিল। এখানে অবশ্য দ্বিতীয় মতাবলম্বীরাই সংখ্যাগুরু, অর্থাৎ অধিকাংশ বিশেষজ্ঞদের অভিমত হল সারমেয়ই প্রথম পোষ্য। কী করে এই সিদ্ধান্ত নিলেন তারা? সেই কাহিনি কিন্তু যথেষ্ট রোমাঞ্চকর। অল্প কথায় এই রহস্যের ওপর কিঞ্চিৎ আলোকপাতের চেষ্টা করা যাক।
ইতিহাসকে আশ্রয় করেই যেমন মানুষের অতীত কীর্তির কথা প্রকাশ পায়, ঠিক তেমনই অতীতের অমানুষীদের কথা আমরা জানতে পারি জীবাশ্মবিদদের গবেষণার সূত্রে। অস্মীভূত জীবদেহের অন্তরে পড়ে থাকা কাহিনি উদ্ঘাটনের সূত্রে তাঁরা আমাদের জানিয়েছেন যে, সারমেয়রাই হল প্রথম চতুষ্পদ প্রাণী যারা দুপেয়ে মানুষের বশ মেনেছিল। তবে সেই আদি-বশ্য প্রাণীটি তার দেহগঠন ও স্বভাববৈচিত্রের বিচারে আজকের সারমেয়দের সমতুল ছিল— এমন কথা বলা বেশ মুশকিল।
পুরাতাত্ত্বিক খননের সূত্রে যে-সব তথ্য হাতে এসেছে তার ভিত্তিতে প্রত্নবিদরা আদি মানবজীবনের প্রামাণ্য ইতিবৃত্ত রচনা করেছেন বটে, কিন্তু তাতে মানুষ ও পশুর পারস্পরিক সম্পর্ক ও নির্ভরতার বিষয়টি তেমন স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। এই কাজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন জীবাশ্মবিদরা। আদি জনগোষ্ঠীর আবাসস্থলের আশেপাশে স্তূপ হয়ে থাকা আঁস্তাকুড়ের উপকরণগুলিকে নেড়েচেড়ে, ঘেঁটেঘুঁটে যেসব প্রাণিজ বর্জ্যের সন্ধান তাঁরা পেয়েছেন, তা থেকেই জানা গিয়েছে যে সারমেয়রাই হল মানুষের আদিতম দোসর। আজ থেকে আনুমানিক ৮ থেকে ১০ হাজার বছর আগে আমাদের আদিপূর্বজরা সারমেয়দের সঙ্গে এক নিবিড় সখ্যের সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল।
সারমেয়দের ওপর মানুষের এই নির্ভরতার কারণ কী? এই বিষয়েও এক চমৎকার অনুমিত আখ্যান শুনিয়েছেন প্রত্ন-জীবাশ্মবিদেরা। তাঁরা বলছেন, শিকারের কাজে যেদিন থেকে মানুষ তীর-ধনুকের ব্যবহার শুরু করল, সম্ভবত সেদিন থেকেই মানুষের নির্ভরতা বেড়েছে সারমেয়দের ওপর। কেন এমনটা বলছেন পণ্ডিতেরা? আসলে, তীর-ধনুকের উদ্ভাবন শিকারজীবী মানুষের জীবনকে অনেকটাই নিশ্চিন্ত করল। এখন আর শিকারের জন্য ভারী পাথরের অস্ত্র নিয়ে হিংস্র পশুদের মুখোমুখি হওয়ার প্রয়োজন রইল না, ফাঁদ পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার প্রয়োজন রইল না, প্রয়োজন রইল না ঝোপঝাড়ে ওঁৎ পেতে শিকারের জন্য দীর্ঘ সময় অতিবাহনের। তীর-ধনুকের সাহায্যে এখন বেশ খানিকটা তফাতে থেকে শিকার সম্ভব হল, কমল ঝুঁকি এবং অনিশ্চয়তা। কিন্তু এতে করেই যে সব সমস্যার সমাধান হল তা নয়। শরবিদ্ধ হলেই যে পশুটির মৃত্যু অনিবার্য ছিল তা তো নয়, অনেক পশুই আহত হয়ে নিরাপদে দূরে চলে যেত। ফলে শিকারের পরেও আহার্য সংগ্রহের খানিকটা সমস্যা রয়েই গেল। তাহলে উপায়?
ডাক পড়ল পোষ্য সারমেয়দের। সুতীব্র ঘ্রাণশক্তিকে কাজে লাগিয়ে এই পোষ্য সারমেয়রা খুঁজে বের করত আহত পশুদের। তারপর যূথবদ্ধ শিকারির দল মহোল্লাসে ঝাঁপিয়ে পড়ত আহত শিকারের ওপর তার ভবলীলা সাঙ্গ করার জন্য। শিকারের সহায়ক হিসেবে এমন কার্যকর সহচারিতার কারণেই সারমেয়দের সঙ্গে এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল আমাদের পূর্বজরা। বলা বাহুল্য সেই ট্র্যাডিশন আজও চলেছে। আমাদের জীবনের বহু বিচিত্র ক্ষেত্রে আজও মানুষ সারমেয়দের ওপর নির্ভরশীল।
কামাল— নাকের জোরে
শক্তিশালী ঘ্রাণ-ক্ষমতার কারণেই সারমেয়রা মানুষের কাছে বহুকাল আগেই পরম আদরণীয় হয়ে উঠেছিল পোষ্য হিসেবে। নাসিকা বা নাকের সাহায্যেই প্রাণীরা তাদের ঘিরে থাকা নানা উপকরণের আঘ্রাণ নেয়। আমাদের নাকের ভেতরে রয়েছে অলফ্যাক্টরি রিসেপ্টর নামের একটি সংবেদী স্নায়ু। এইটি উৎপন্ন হয়েছে নাকের ওপরের অংশে অবস্থিত অলফ্যাক্টরি মিউকোসা থেকে। এই অলফ্যাক্টরি রিসেপ্টর নিউরনের অন্তর্বাহী স্নায়ুতন্ত্রের কাজ হল গন্ধ সংক্রান্ত স্নায়বিক উদ্দীপনাকে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে বহন করে নিয়ে যাওয়া। এই অলফ্যাক্টরি স্নায়ুটি অন্যান্য করোটিক স্নায়ুগুলির তুলনায় খানিকটা স্বতন্ত্র চরিত্রের, কারণ কোনও কারণে যদি এটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলেও পরবর্তীকালে আবার এইটি সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। এই ঘ্রাণ-সংবেদী স্নায়ুর দৌলতেই মানুষ সহ অন্যান্য প্রাণীরা গন্ধ বিচার করতে সক্ষম হয়। গন্ধবিচারের এমন আশ্চর্য ক্ষমতার কারণেই মানুষ-সারমেয় পরস্পর এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা পড়েছে যুগ যুগ ধরে।
সারমেয়দের এমন ক্ষমতার পেছনে কী রহস্য রয়েছে সেই ব্যাপারে একটু উঁকি মেরে দেখা যাক।
প্রশ্ন হল সারমেয়দের নাসিকার গঠনে কী এমন বিশেষতা রয়েছে যার কল্যাণে ঘ্রাণ-ক্ষমতার বিচারে মানুষকেও ছাপিয়ে গিয়েছে তারা? অনুসন্ধান সূত্রে যা জানা গেছে তা হল— সারমেয়দের এমন অতীন্দ্রিয় ঘ্রাণশক্তির আসল রহস্য লুকিয়ে রয়েছে তাদের নাসিকা তথা অলফ্যাক্টরি রিসেপ্টরের গঠনবৈশিষ্ট্যের মধ্যে। মানুষের নাসিকায় এই সংবেদী স্নায়ুটির সংখ্যা যেখানে ৬ মিলিয়ন, একটি সারমেয়ক নাকের ভেতরে সেখানে রয়েছে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন অলফ্যাক্টরি রিসেপ্টর। এতেই শেষ নয়— ঘ্রাণ নেওয়ার পর যে স্নায়বিক উদ্দীপনার সৃষ্টি হল তাকে যথাযথভাবে বিশ্লেষণের জন্য মস্তিষ্কের কার্যকর অংশের আয়তন মানুষের তুলনায় প্রায় ৪০ গুণ বড়। এছাড়া সারমেয়দের একটি বিশেষ আসক্তি হল নতুন নতুন গন্ধের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া, যা পরিভাষায় নিওফিলিয়া (neophilia) নামে পরিচিত।
অবাক হওয়ার আরও কিছু বোধহয় এখনও বাকি আছে। সারমেয়দের গন্ধবিচারের এই ক্ষমতা মানুষের তৈরি অতি-সংবেদী ঘ্রাণ-নির্ণায়ক যন্ত্রকেও অনায়াসে লজ্জায় ফেলে দেবে। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, অলিম্পিকের সন্তরণ প্রতিযোগিতার জন্য তৈরি খান কুড়ি সুইমিং পুলের সমআয়তনের পরিসরে পড়ে থাকা মূল বস্তুর এক ট্রিলিয়ন ভাগের মাত্র এক ভাগ অংশ থেকেই গন্ধ সংক্রান্ত তথ্যকে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা রয়েছে মানুষের এই অতি বিশ্বস্ত সহচরদের। যথাযথ তালিম পেলে গন্ধবিচারের সূত্রে অসাধ্য সাধন করতে পারে এরা। সারমেয়দের এই আশ্চর্য ক্ষমতার বিষয়টিকে আবিষ্কার করার পর থেকেই মানুষ নানান ধরনের তথ্য সংগ্রহের কাজে লাগিয়েছে সুপ্রশিক্ষিত সারমেয়দের। আর এভাবেই মানুষের ও সারমেয়দের পারস্পরিক সহাবস্থানের সম্পর্কটি দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে সময়ের তাবৎ সীমানা পেরিয়েও।
সারমেয়র সাতকাহন ও পিসিমা…
আমার এক পিসিমার গপ্পো বলি। তিনি তাঁর সারমেয়প্রীতির জন্য আমাদের পারিবারিক স্বজনমহলে রীতিমতো খানদানি মর্যাদা পেতেন। পিসেমশাই পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হলেও নিতান্ত নির্বিরোধ চরিত্রের মানুষ ছিলেন। মূলত তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় পিসিমার এক বৃহৎ সারমেয়বাহিনি গড়ে তোলা। সে অনেক কাল আগের কথা, কী একটা উপলক্ষে পিসিমার বাড়িতে যাওয়া। দলে আমরা বেশ কয়েকজন। বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কে আগে কলিংবেল বাজাবে, তা নিয়ে আমার সহযাত্রী বাবা-জেঠা-কাকাদের রীতিমতো জল্পনা চলছে। আমি ছোট, তাই আগ বাড়িয়ে কিছু করতে যাওয়া সৌজন্যসুলভ নয়, তাই পেছনে দাঁড়িয়ে তেনাদের কাণ্ড দেখছি। শেষে আমার কাকা হাত বাড়িয়ে কলিংবেলে চাপ দিয়ে তফাতে এসে দাঁড়ান। তাঁর দেখাদেখি আমরাও। গৃহপরিচারিকা দরজা একটু ফাঁক করতেই নানা গড়নের, নানা ধরনের, নানা আকারের সারমেয় এসে হামলে পড়ল আমাদের ওপর— তাদের কেউ নাক বাগিয়ে আমাদের শরীরের ঘ্রাণ নিতে থাকে, কেউ আমাদের মাঝখানে রেখে সাত পাক প্রদক্ষিণ করতে থাকে, কেউ অভ্যাগতদের গা বেয়ে ওঠার চেষ্টা করে, আবার কেউ আগন্তুকদের থেকে কোনও বিপদের আশঙ্কা নেই বুঝে বেশ রাশভারি ভঙ্গিতে লেজ গুটিয়ে ভেতরে ঢুকে যায়— বোধহয় মালকিনকে অভ্যাগতদের খবর দিতে ছোটে। আমরা ন যযৌ ন তস্থৌ হয়ে চিত্রার্পিতের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি। খানিক পরে মালকিনের কথা শোনা যায়।
–মালতী, কেডা রে?… কথা কস না ক্যান?
–আ… ম… রা… (সমবেত কম্পিত কণ্ঠে)
–ও! তোরা! তা খাড়ায়ে আছস ক্যান? ভিতরে আয়…
–আসুম কী! তর …গুলান আমাগো ঢুকতে দিলে তবে তো!
পিসিমা রেগে আগুন। কেন তাঁর প্রিয় পোষ্যদের অশালীন ভাষায় ডাকা হবে! যাই হোক, ভ্রাতা-ভগিনী, যুযুধান দুই পক্ষের বাকবিতণ্ডার, মান-অভিমানের পালা চলতে চলতে একসময় থেমে যায় পিসেমশাইয়ের হস্তক্ষেপে। সাময়িক স্বস্তি ফিরে এলেও আমার রাশভারী, পৃথুলা পিসিমা তাঁর আদরের সারমেয়দের অমন চটুল ভাষায় গাল দেওয়ার জন্য মনে মনে গজগজ করতে থাকেন। চা-জলখাবারের পর্ব মিটতেই পিসিমা তাঁর সারমেয়প্রীতির সমর্থনে সাতকাহন আমাদের সামনে পেশ করেন যাতে অন্তত তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রটির হৃদয়ে সারমেয়দের প্রতি একটা গভীর প্রীতির মনোভাব গড়ে ওঠে। আজ এতকাল পরে সেই সারমেয়কথা পাঠকদের সামনে নিবেদন করছি:
১. সারমেয়দের ঘ্রাণশক্তি অতুলনীয়, তবে সবার নাকের গড়ন তো সমান নয়। কারও বেশ টিকোলো, লম্বাটে; আবার কোনও কোনও সারমেয় নতনাসিক, যেমন বুলডগ। লম্বা নাকের সারমেয়দের তুলনায় খাঁদা নাকের সারমেয়দের ঘ্রাণক্ষমতা খানিকটা কম।
২. তবে গন্ধবিচারের ব্যাপারে সেরার সেরা প্রজাতির সারমেয় হল ব্লাড হাউন্ড প্রজাতির সারমেয়রা। এদের নাসিকাগহ্বরে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন গন্ধনির্ণায়ক রিসেপ্টর থাকে। অবশ্য এদের ঠিক পেছনেই আছে ব্লুটিক কুনহাউন্ড, লাব্রাডর রিট্রিভার এবং জার্মান শেফার্ড বর্গের সারমেয়রা।
৩. আসলে সারমেয়দের ঘ্রাণবিচারের প্রকৌশলটি আমাদের মানে মানুষের থেকে একেবারেই আলাদা। আমরা শ্বাস ও ঘ্রাণ গ্রহণের জন্য একই নাসাপথকে ব্যবহার করি। অর্থাৎ, একই পথে শ্বাসবায়ু ও ঘ্রাণবায়ু চলাচল করে। কিন্তু সারমেয়দের নাসারন্ধ্রের ভেতরে থাকা বিশেষ ধরনের স্নায়ু এই দু ধরনের বায়ুকে আলাদা করে দেয়।
৪. শুকনো নাকের তুলনায় ভেজা নাকে সারমেয়রা অনেক বেশি ভালো করে গন্ধবিচার করতে পারে।
৫. মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের এই নিবিড় নৈকট্যের কারণে পোষ্য সারমেয়রা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের হালহকিকত যেমন ভয়, দুশ্চিন্তা, দুঃখ, ক্ষোভ ইত্যাদি সম্পর্কে আগাম আঁচ করতে পারে। এমনকি রোগনির্ণয়ের ক্ষেত্রেও এরা অতুলনীয়।
৬. বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত গন্ধবিচারক সারমেয়রা একই সঙ্গে নাসিকা গহ্বরে ভেসে আসা হাজারো গন্ধ থেকে কেবল প্রয়োজনীয় গন্ধটিকে আলাদা করে নিতে পারে। সন্ধানী সারমেয়রা বাতাসে ভেসে আসা গন্ধকেও আলাদা করে নিতে পারে আশ্চর্য ক্ষমতায়।
“এইবারে তোরাই ক এমন উপকারী প্রাণীগুলানরে আদর না কইরা কেউ থাকতে পারে?” একটানা অনেকক্ষণ কথা বলে পিসিমা একটু থামেন। বৈঠকখানা ঘরে আমাদের ঘিরে বসে থাকা পিসিমার আদরের পোষ্যরা কেঁউ কেঁউ রবে সায় দেয়— ঠিক, ঠিক, ঠিক!
আমরা হালকা স্বরে হেসে উঠি।
অতিমারি ও এক বিশ্বস্ত পোষ্য
এই অতিমারি পরিস্থিতিতে যখন লকডাউন, ভ্যাক্সিনেশন, কো-মর্বিডিটি, সোশাল ডিস্টেন্সিং, নিও নর্মালের মতো অশ্রুতপূর্ব শব্দবন্ধ নিয়ে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছি আমরা, তখন আমাদের নিত্য-সহচর সারমেয়রা নেমে পড়েছে এক দুরূহ কর্মে— করোনাভাইরাস আক্রান্ত মানুষদের চিহ্নিতকরণের কাজে। রোগাক্রান্ত মানুষদের খুঁজে বের করার কাজটা সারমেয়রা এই প্রথম করছে তা কিন্তু নয়, কেননা এর আগে ক্যানসার রোগাক্রান্ত মানুষদের চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে সারমেয়দের অতুলনীয় ঘ্রাণশক্তিকে সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছেন চিকিৎসক তথা গবেষকরা। আর সেই ধারার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই এবার সারমেয়দের কাজে লাগানোর প্রয়াস শুরু হয়েছে।
খুব সম্প্রতি করোনাক্রান্ত রোগীদের খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে পোষ্য সারমেয়দের দক্ষতা বিষয়ে গবেষণা চালিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। গবেষণালব্ধ ধারণাগুলি পিএলওএস-ওয়ান জার্নালে প্রকাশ করেছেন তাঁরা। এই গবেষণাপত্র থেকে জানা যাচ্ছে যে মোট নয়টি সারমেয়, যারা নির্দিষ্ট রোগে আক্রান্তদের খুঁজে বের করার কাজে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত, সংগৃহীত নমুনা থেকে আক্রান্ত মানুষের নমুনাগুলিকে চিহ্নিত করতে পেরেছে সুনির্দিষ্টভাবে। এ-কাজে তাদের সাফল্যের হার ৯২ শতাংশ, যদিও ভুয়ো নেগেটিভ নমুনাগুলোকে খুঁজে দেখার ক্ষেত্রে তাদের সাফল্যের হার বেশ কম।
প্রায় একইরকম ফলাফল ধরা পড়েছে লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন-এর সঙ্গে যুক্ত গবেষকদের গবেষণায়। এরা মোট ছয়টি অনুসন্ধানী সারমেয়কে এ-কাজে ব্যবহার করেন। প্রায় এক বছর ধরে গবেষণার পর গবেষকদের অভিমত, যেখানে আরটি-পিসিআর টেস্ট মারফত কোভিড রোগীদের ৯৭.২ শতাংশ চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে, সেখানে রোগনির্ণায়ক সারমেয়দের সাফল্যের হার ৯৪ শতাংশ। এই হার রীতিমতো ঈর্ষণীয়।
আমাদের বিশ্বস্ত সারমেয়দের এহেন সাফল্য একদিকে যেমন আশ্বস্ত করে, তেমনই মনের মধ্যে উসকে দেয় নতুন এক জিজ্ঞাসা। সার্স-কোভ ২ ভাইরাসের কি গন্ধ আছে? গবেষকরা দেখেছেন যেসব মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন তাঁদের বর্জ্য সামগ্রীতে এক বিশেষ ধরনের গন্ধ থাকে। আমাদের মূত্র, লালারস, স্বেদ প্রভৃতিতে উপস্থিত থাকে এক ধরনের সংবেদী রাসায়নিক পদার্থ— ভোলাটাইল অরগ্যানিক কম্পাউন্ডস। কোনও মানুষ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন কি হননি তা মানুষটির রেচনজাত পদার্থ থেকে সহজেই জানা যায়। এমন তথ্য আমাদের সামনে পেশ করেছেন ফ্রান্সের আলফর্ট শহরের ন্যাশনাল ভেটেরিনারি স্কুল-এর ফরাসি বিজ্ঞানী অধ্যাপক ডোমিনিক গ্রান্ডিয়েন পিএলওএস-ওয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর সাম্প্রতিক নিবন্ধে। তিনি জানিয়েছেন, “ভাইরাসটি যখন মানবশরীরে তার প্রতিরূপ নির্মাণ করে অথবা কোষগুলি যখন টক্সিক মলিকিউল উৎপন্ন করে, তখন শরীর ছেড়ে তাদের মেটাবোলাইটস অথবা ক্যাটাবোলাইটস হিসেবে বাইরে আসতে হয়, এবং তখন বাইরের বাতাসে ভেসে বেড়ানো অণুগুলি থেকে সার্স-কোভ ২-কে সারমেয়রা তাদের অলফ্যাক্টরি রিসেপ্টরের সাহায্যে সহজেই চিনে নিতে পারে আলাদা করে। দীর্ঘ সময় ধরে সারমেয় দলের ছয় সদস্য মার্লো, টালা, মিলি, লেক্সি, কিপ এবং অ্যাশার-কে নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরই এমন চমকপ্রদ সফলতা এসেছে।
সারমেয়দের এমন সাফল্যের পর আমরা কি এ-কথা বলতে পারি যে আগামী দিনে করোনা সংক্রমণ নির্ণয়ে ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ পিসিআর পরীক্ষার প্রয়োজন ফুরোল? “আমরা কিন্তু এমনটা মনে করছি না। আমাদের পোষ্য সারমেয়রা প্রায় নিখুঁতভাবে আক্রান্ত রোগীদের চিহ্নিত করতে পারছে মানে এই নয় যে পিসিআর অথবা এলএফটি পরীক্ষার আর দরকার নেই। আসলে সারমেয়দের এ কাজে ব্যবহার করার সুবিধা এই যে, সংক্রামিত রোগীদের খুঁজে নেওয়ার কাজটা অনেক দ্রুততার সঙ্গে করা এখন সম্ভব হবে এবং এর ফলে পিসিআর পরীক্ষার সংখ্যাও অনেকটা কমানো সম্ভবপর হবে। তবে বাস্তব পরিস্থিতিতে এই উপায় কতটা কার্যকর করা যাবে তা ভবিষ্যৎই বলবে”— অভিমত অধ্যাপক জেমস লোগান-এর।
লোগান সাহেবের কথার রেশ টেনে এটুকুই আমরা বলতে পারি, আমরা আশাবাদী। সেই মহাভারতের কাল থেকে মানুষ আর সারমেয়দের পারস্পরিক নির্ভরতার যে পরম্পরা আমরা দেখতে পাই, আগামী দিনে এইটিই হয়তো তার নবতর অধ্যায় রচনা করবে।
Oshamanyo lekha! Jey dhoroner porishrom korechen tothyo shongrohor jonyo, ta proshongsha korar jogyota ba bhasha nei Amar! Dhanyobad ei lekha prokash karar jonyo!
পুরো গবেষণা ধর্মী লেখা। তবে কুকুরের নাক সাধারণত ভিজেই থাকে। কুকুরের নাক শুস্ক হওয়া মানে সাধারণত তার শারীরিক অসুস্থতা নির্দেশ করে। আর গন্ধ বিচারের ব্যাপারে আমাদের দেশি অর্থাৎ ইন্ডি ব্রিড যথেষ্ট শক্তিশালী। এদের শারীরিক গঠন একটু ছোট হওয়ায় এরা পুলিশ বা সেনাবাহিনীতে জায়গা কম পায়। যারা পায় তারা তাদের যোগ্যতা প্রমান করেছে। ভারতীয় কুকুরের কিছু ব্রিড যেমন রামপুর হাউন্ড, রাজপালিয়ান হাউন্ড, টিবেটিয়ান ম্যাস্টিফ, ঢোল বা বুনো কুকুর, গদ্দিদের পোষা কুকুর খুবই শিকারি হয়। বাঘের সাথেও লড়ে যায় এরা বিশেষত ঢোল আর গদ্দি ডগ।