কণিষ্ক চৌধুরী
প্রাবন্ধিক, শিক্ষক
রাজা মিলিন্দ বৌদ্ধ ভিক্ষু নাগসেনকে বললেন:
ভন্তে নাগসেন! ভগবান বলিয়াছেন, ‘ভিক্ষুগণ! আমি যাচকযোগী ব্রাহ্মণ!’ পুনরায় ইহাও বলিয়াছেন ‘হে শৈলরাজ! আমি রাজা।’
ভন্তে, যদি ভগবান বলিয়া থাকেন, ‘ভিক্ষুগণ, আমি যাচকযোগী ব্রাহ্মণ,’ তাহা হইলে তিনি ইহা মিথ্যা বলিয়াছেন যে, ‘শৈল, আমি রাজা।’ আবার ইহা সত্যি হইলে ইহা মিথ্যা প্রমাণিত হয় যে তিনি ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি হয়তো ক্ষত্রিয় হইবেন, অথবা ব্রাহ্মণ হইবেন। এক জন্মে দুই বর্ণ কখনও হইতে পারেন না।
(মিলিন্দ প্রশ্ন। ২০১৩ : ১৯০)
মিলিন্দর মন্তব্যের জবাবে নাগসেন বললেন:
মহারাজ, ভগবান ঠিকই বলিয়াছেন, ‘ভিক্ষুগণ, আমি যাচকযোগী ব্রাহ্মণ।’ আর ইহাও ঠিক বলিয়াছেন, ‘শৈল, আমি রাজা।’ এই ক্ষেত্রে এমন কারণ আছে যদ্বারা বুদ্ধ ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয় উভয় হইতে পারেন।
(পূর্বোক্ত: ১৯১)
সংলাপের এই অংশটুকু পাঠ করেই যে সম্ভাবনাগুলি মনের মধ্যে উঁকি দেবে তা মোটামুটি এইরকম। নাগসেন সচেতন (বা অসচেতন)-ভাবেই ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক স্তরবিন্যাসের একটি বিকল্প বৌদ্ধ ব্যাখ্যা উপস্থিত করেছেন। ইহজাগতিক কর্তৃত্বের সঙ্গে পরজাগতিক কর্তৃত্বের মিলিত অবস্থানের কথা বলেছেন। একই সঙ্গে ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক সমাজের মৌল প্রতিজ্ঞা বর্ণভেদকে স্বীকার করে নিয়েছেন এবং অংশত অস্বীকার করেছেন। এই স্বীকার বা অস্বীকারের পেছনে সন্দেহাতীতভাবে রয়েছে সমকালের সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতির ভূমিকা। এখানে যে সমকালের কথা বলা হয়েছে তা আসলে দুটি কালপর্বে বিভক্ত। প্রথমটি খোদ গৌতম বুদ্ধের সময় (খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ-পঞ্চম শতাব্দী), এবং দ্বিতীয়টি হল ‘মিলিন্দ পঞহ’ বা ‘মিলিন্দ প্রশ্ন’ রচনার সময়কাল। অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতক থেকে খ্রিস্টাব্দ তৃতীয় শতক। স্পষ্টতই দুটি সময়কালের মধ্যে ব্যবধান বেশ অনেকটাই। প্রথমটি দ্বিতীয় নগরায়নের সূচনাকাল আর দ্বিতীয়টি পৌরাণিক যুগের যৌবনকাল। পর্ব দুটির মধ্যেকার কয়েকশো বছরের মধ্যে ঘটে গেছে নানা পরিবর্তন। বুদ্ধচিন্তার মধ্যে যে তীব্র প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা ছিল, ইতিমধ্যে তার হ্রাস ঘটেছে। বৌদ্ধ রাষ্ট্রের আবির্ভাব বৌদ্ধ আন্দোলনে নতুন নতুন ধারার জন্ম দিয়েছে। বৌদ্ধ চিন্তা এখন ধর্ম রূপে আবির্ভূত হওয়ায় পুরনো বিদ্রোহী পোশাক ছেড়ে সে অনেকটাই শাসকের পোষ মানা ধর্মমতে রূপান্তরিত হয়েছে। ফলে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র-বিরোধী বুদ্ধ নিজেই হয়ে পড়েছেন ‘ব্রাহ্মণ’। একই সঙ্গে হিংসা-বিরোধী/রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা-বিরোধী বুদ্ধ এবার ক্ষত্রিয় পোশাকে আবির্ভূত। ‘মিলিন্দ পঞহ’-তে এটাই দেখবার বিষয়।
এখানে বিস্মিত হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। বিপরীতের ঐক্যই প্রকৃতির নিয়ম। দ্বন্দ্বতত্ত্বের এই সূত্রটি (লেনিনের মতে একমাত্র সূত্র) শেখায় বিপরীতের ঐক্যই পরিবর্তন ও ধারাবাহিকতার মূল কারণ। বৌদ্ধচিন্তার প্রথম যুগে ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক সামাজিক স্তরবিন্যাস বর্ণভেদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম একটি প্রগতিশীল পদক্ষেপ। কিন্তু পরবর্তী কয়েকশো বছরের মধ্যে তার পরিবর্তন ঘটে যায়। ব্রাহ্মণ্য-গ্রাসের মধ্যে বৌদ্ধচিন্তার সদর্থক দিকগুলি ধীরে ধীরে অপসৃত হতে থাকে। ধরা যাক ‘মিলিন্দ পঞহ’-র মধ্যেকার দ্বান্দ্বিক ধারণা। এখানে প্রদীপশিখার মধ্যে দিয়ে বস্তুর অস্তিত্ব অরবাহের দ্বান্দ্বিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।[1] বুদ্ধ নিজে কোনও ধর্ম তৈরি করেননি। তাঁর ‘ধম্ম’-র মধ্যে স্থান পেয়েছে বেশ কিছু নৈতিক ধারণা ও ইহজগৎ সম্প্ররকে দার্শনিক প্রত্যয়ের ভ্রূণ। কয়েক শতকের মধ্যেই বুদ্ধ-শিক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গড়ে উঠল বৌদ্ধ ধর্ম। এই বৌদ্ধ ধর্মেই বুদ্ধ চিহ্নিত হলেন ভগবান হিসেবে। নিরীশ্বরবাদী বুদ্ধের[2] ঈশ্বর হয়ে ওঠার এই পরিক্রমাটি কোনও মনোগত বিষয় থেকে নয়, বরং রাষ্ট্র ও প্রাধান্যকারী শ্রেণির প্রয়োজনের থেকেই।
বৌদ্ধ-শাস্ত্রবিদ রিস ডেভিডস দেখান যে, বুদ্ধ জনগণের উদ্দেশে জনগণের ভাষায় তাঁর মত প্রচার করেছিলেন। বৌদ্ধ সঙ্ঘের মধ্যে নিম্নবর্ণের অনেকে শুধু স্থানই পাননি, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও পালন করেছেন। যেমন, উপালি ছিলেন নাপিত, সুনীত পুক্কুস নামের নিম্ন গোষ্ঠীর সদস্য, সাতি জেলের সন্তান, নন্দ গোয়ালা, পন্থকদ্বয়ের জন্ম এক উচ্চবর্ণের নারীর গর্ভে কিন্তু ক্রীতদাসের ঔরসে, পুন্না ও পুন্নিকা দাসীকন্যা, সুভা কামারের মেয়ে। এইরকম আরও বহু দৃষ্টান্তের সাহায্যে দেখানো যায় যে বুদ্ধ তাঁর সঙ্ঘে জন্মগত ও শ্রেণিগত ক্রমোচ্চতা ও দূরত্বকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা ও অস্বীকার করেছিলেন।[3] বুদ্ধের কার্যাবলির মধ্যে পাওয়া যাবে প্রচলিত সামাজিক বিন্যাস, ধর্ম, যাগযজ্ঞ, ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস, পশুহত্যা, কুসংস্কার, রাষ্ট্র ইত্যাদির ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক ব্যাখ্যার বিরোধিতা। এক কথায় ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ অস্বীকার।
বুদ্ধ-চিন্তায় ব্রাহ্মণ্য-অসাম্যের বিরোধিতা এবং প্রাচীন উপজাতীয় গণতন্ত্রের এই আভাসটি নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। তবে আজকের দিনে গণতন্ত্র বলতে যা বোঝায়, তা সে-দিনের সঙ্গে রূপগত দিক দিয়ে ভিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক। এই প্রসঙ্গে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ভাবনা—
প্রাচীন পৃথিবীতে গণতন্ত্রর একমাত্র যে-রূপটির পরিচয় সম্ভবপর তা হল তথাকথিত ট্রাইবাল গণতন্ত্র। ‘তথাকথিত’ শব্দ ব্যবহার করছি, তার কারণ আধুনিক যুগে আমরা গণতন্ত্র বলতে একরকম রাষ্ট্রযন্ত্র বুঝে থাকি এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য হল একটি শ্রেণির পক্ষে অপরাপর শ্রেণিকে জোর করে অবদমন করে রাখবার আয়োজন। কিন্তু ট্রাইবাল সমাজ যতদিন পর্যন্ত আদি অকৃত্রিম রূপে বর্তমান থাকে— তা আসলে হল প্রাক-বিভক্ত সমাজ। তার মধ্যে শ্রেণিবিভাগ ফুটে ওঠেনি; তাই কোনও এক শ্রেণির পক্ষে অপরাপর শ্রেণিকে অবদমন করার সম্ভাবনাও দেখা দেয়নি। তার সঙ্গে গণতন্ত্রের সাদৃশ্য শুধু এইদিক থেকে যে, প্রকৃত ট্রাইবাল সমাজেরও মূল মন্ত্র হল সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা। এবং মনে রাখা দরকার যে, সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার অমন চূড়ান্ত বিকাশ ঐতিহাসিকভাবে আমাদের জানা কোনও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মধ্যেই দেখতে পাওয়া সম্ভব নয়। এই কারণেই, গণতন্ত্রের বদলে এর সঠিক বর্ণনা হিসাবে আদিম সাম্য-সমাজ বা প্রিমিটিভ কমিউনিজম পরিভাষাটি ব্যবহার করাই বাঞ্ছনীয়।
(দপচ। ২০১০ : ১৪)
আদিম সাম্যবাদী সমাজে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্খাই বুদ্ধকে সঙ্ঘ গঠনের প্রেরণা জুগিয়েছিল। আর এ কাজ তিনি করেছিলেন বেশ সচেতনভাবেই। বস্তুত এটা ছিল সমসাময়িক কালের রাষ্ট্র-সমাজ-ধর্ম সম্পর্কে একটি অসন্তুষ্টির প্রকাশ। বিষয়টি আরও একটু স্পষ্ট করে বলা দরকার।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতে ষোলটি মহাজনপদের সঙ্গে সঙ্গে আবির্ভাব ঘটে নগরায়নের। কোসাম্বি, রামশরণ শর্মা, রোমিলা থাপার প্রমুখ ঐতিহাসিকেরা মনে করেন বর্তমান বিহার ও ঝাড়খণ্ড রাজ্যে আকরিক লোহার যে সুপরিচিত উৎস রয়েছে, তার ব্যবহার নিয়মিতভাবে শুরু হয়ে যায় খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ নাগাদ। মধ্যগঙ্গা উপত্যকায় অবস্থিত মহাজনপদগুলি— বিশেষত মগধ— লোহার উত্তরোত্তর ব্যবহার বৃদ্ধির সুফল ভোগ করেছিল। কি গভীর বনাঞ্চল পরিষ্কার করতে, কিংবা কৃষির বিকাশের জন্য, কি যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণের জন্য লোহার উপযোগিতা অপরিসীম। তাই মধ্যগঙ্গা উপত্যকায় অধিকাংশ ক্ষমতাধর মহাজনপদগুলির অবস্থিতি; এর ব্যতিক্রম অবশ্যই দেখা যাবে অবন্তী মহাজনপদের ক্ষেত্রে, যেটি গাঙ্গেয় উপত্যকার বাইরে নর্মদা উপত্যকায় বিদ্যমান ছিল।[4] এই অঞ্চলে (মধ্য গাঙ্গেয় উপত্যকায়) মহাজনপদগুলির গড়ে ওঠার আরও বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী নির্দেশ করেছেন। বৃহদায়তন গাঙ্গেয় উপত্যকা এক বিস্তীর্ণ সমতলভূমি, কোনও বড় ধরনের প্রাকৃতিক বাধা এখানে নেই বললেই চলে। রাজনৈতিক ক্ষমতা, বিস্তার ও একীকরণের জন্য এটি একটি আদর্শ এলাকা। এখানে বনজ সম্পদ যেমন আছে, তেমনই আছে উর্বর কৃষিজমি। নদীপথে যাতায়াত করাও খুব একটা কঠিন নয়।[5]
মহাজনপদগুলির আবির্ভাব ও বিকাশের ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণগুলির মধ্যে লোহার ব্যবহারের তাৎপর্য সীমাহীন। পূর্বে লাঙলে তামার ফলা ব্যবহার করা হত। এই অঞ্চলের মাটি ঘন ও আঠালো। তাই মাটি কর্ষণে লোহার ফলা অনেক বেশি কার্যকরী। লোহার তৈরি হাতিয়ার অনেক বেশি টেকসইও বটে। তাই লোহার হাতিয়ার ব্যবহার করে প্রচুর পরিমাণে অরণ্য কেটে বসতভূমি বৃদ্ধি ও কৃষিজমির পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব হল। ফলে কৃষি উৎপাদনে প্রাচুর্য আসে, যা গ্রামীণ চাহিদা মিটিয়েও বাড়তি খাদ্যশস্য দ্বারা পেশাদার কারিগর, বিভিন্ন বৃত্তির গোষ্ঠী এবং বণিকদের খাদ্যসংস্থান নিশ্চিত করল। এই ধরনের উদ্বৃত্ত ছাড়া মহাজনপদগুলির রাজপুরুষ ও সৈন্যের ভরণপোষণ করা সম্ভব হত না। সংক্ষেপে “কৃষি অর্থনীতিতে উদ্বৃত্ত উৎপাদনের মধ্যেই গঙ্গা উপত্যকায় নগরায়নের চালিকাশক্তি নিহিত ছিল।”[6]
নগরজীবনের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটায় সমাজ অপেক্ষাকৃত সরল অবস্থা থেকে ক্রমেই জটিলতর আকার ধারণ করে। পুরনো ধারণাগুলির কোনও কোনওটা যেমন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল, তেমনি আবার কোনও কোনওটার পুনর্বিন্যাস ও পুনর্নবীকরণও ঘটতে শুরু করে। একই সঙ্গে সামাজিক অসাম্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য সামাজিক বিন্যাসকে নতুন করে সাজানোর প্রক্রিয়াও শুরু হল। মহাজনপদের পূর্বেই বর্ণব্যবস্থা ও ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি— মোটামুটি একরকম প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। এবং এই বর্ণগত বিভাজনের মধ্যে দিয়েই শ্রেণিগত বিভাজনটি স্পষ্ট হয়ে উঠল— আরও সুস্পষ্ট ও তীব্রভাবে। প্রায় সকল ধরনের মাতৃতান্ত্রিক অধিকারের এবার বিলোপ ঘটল, দৈহিক শ্রমকে হীন বলে মনে করা হল, যৌথ জীবনের প্রায় সমস্ত সূত্রগুলিরই বিলোপ ঘটল, শূদ্র ও নারী স্থান পেল সর্বনিম্ন। মাথা ও হাতের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটল পাকাপাকিভাবে। মাথা ও হাতের মধ্যে বিচ্ছেদ হল পাকাপাকিভাবে। সরদেশাই লিখেছেন:
With greatly increased production, the contrast between the luxuries of the rich and the misery of the toiling poor became glaring. Hence the ferment was both social and intellectual, and the two aspects were not unconnected.
(Sardesai. 1994 : 117)
মহাজনপদের সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে রণবীর চক্রবর্তীর পর্যবেক্ষণটি এইরকম: মহাজনপদের সময়ে বৈদিক ঐতিহ্যবাহী সমাজাদর্শকে দৃঢ়ভিত্তিক করার তাগিদে রচিত হল সূত্র সাহিত্য, যার রচনাকাল অধিকাংশ পণ্ডিত খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২০০ সময়সীমার মধ্যে নির্ধারণ করেছেন। সূত্র সাহিত্যের সংখ্যা তিন— শ্রৌত্য, গৃহ্য ও ধর্মসূত্র। শ্রৌত্যসূত্রে আছে বৈদিক যাগযজ্ঞ ও আচার-অনুষ্ঠানের জটিল নিয়মাবলি। গার্হস্থ্য জীবন সংক্রান্ত বিধিবিধান দেওয়া হল গৃহ্যসূত্রে। ধর্মসূত্র প্রণয়ন করল বেদসম্মত সামাজিক, অর্থনৈতিক এমনকি রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্ম। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের স্বার্থেই ব্রাহ্মণরা এই সব নিয়মের প্রবর্তন করল। সামাজিক আদর্শ হিসেবে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রকেই তুলে ধরা হল। কঠোর হাতে বর্ণব্যবস্থাকে প্রয়োগ করা হল। অসবর্ণ/মিশ্র বিবাহ এই ব্যবস্থায় নিষিদ্ধ। শূদ্রের ও বৈশ্যের মর্যাদা এখন একেবারে তলায় এবং অবশ্যই আরও নিম্নমুখী। রাজার কাজ ব্রাহ্মণ্য স্বার্থ ও বর্ণব্যবস্থাকে রক্ষা করা।[7]
এখানে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে, এই মহাজনপদগুলির কয়েকটি রাজতান্ত্রিক এবং অন্যগুলি প্রজাতান্ত্রিক/উপজাতীয় গণরাজ্য। এই দুই ধরনের রাজনৈতিক সংগঠনগুলির মধ্যে দীর্ঘকাল সংঘাত চলেছিল।
রাজতন্ত্র তখন একেবারে নতুন। কোনও অঞ্চলে স্থায়ী বসতি শুরু হলেই সেখানকার অধিবাসী উপজাতিগুলির একটা আলাদা ভৌগোলিক স্বাতন্ত্র্য জন্মে যেত। জায়গাটির নামকরণ হত সেই উপজাতির নামানুসারে। জায়গাটির ওপর নিজেদের অধিকার বজায় রাখার জন্যে প্রয়োজন হত কোনও রাজনৈতিক সংগঠনের— রাজতন্ত্র বা গণরাজ্য [প্রজাতন্ত্র] সংগঠন।
(থাপার। ২০০৪ : ৩১)
এই প্রজাতান্ত্রিক বা গণরাজ্যগুলি রাজতন্ত্রের চেয়ে বা বৈদিক নিয়মের চেয়ে উপজাতীয় নিয়ম-রীতি-নীতি মেনে চলত। এদের ওপর বৈদিক ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক প্রভাব, বর্ণবিভাজনের পরিমাণ ছিল অকিঞ্চিৎকর। অন্যদিকে রাজতান্ত্রিক জনপদগুলিতে বৈদিক নিয়ম ও ব্রাহ্মণ্য আদর্শকে কঠোরভাবে অনুসরণ করা হত। প্রজাতন্ত্রগুলির ওপর রাজতন্ত্রের প্রাধান্য বৃদ্ধি, গণরাজ্যের ধ্বংস সহ সামাজিক বৈষম্যজনিত নানা কারণে সাধারণের মধ্যে একটি অসন্তুষ্টির আবির্ভাব হয়। এই সাধারণ অসন্তুষ্টির প্রকাশ ঘটে বুদ্ধ-চিন্তার মধ্যে। এ চিন্তা সমকালীন রাজতান্ত্রিক জনপদগুলির সমাজ-সংস্কৃতি-দর্শনের বিরুদ্ধে এক চমৎকার বিপ্লবী প্রকাশ।
আদিম সাম্যবাদী সমাজের ভাঙন ঘটল। যৌথতাভিত্তিক গোষ্ঠীজীবনের ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই জন্ম নিল উদ্বৃত্তভোগী শ্রেণি, শ্রেণি-বৈষম্য, এবং অবশ্যই— রাষ্ট্র। যদিও সে রাষ্ট্র ছিল রাষ্ট্রের আদি রূপ বা অপরিপক্ব রূপ। বৈদিক-আর্য ভাষাভাষী গোষ্ঠীগুলি যে সাহিত্য রচনা করেছিল (যদিও তা ছিল আস্য বা মৌখিক), তার মধ্যে তাদের পূর্ববর্তী আদিম সাম্যবাদী সমাজের স্মৃতি বেশ কিছু পরিমাণে থেকে যায়। শ্রেণিবৈষম্যের আবির্ভাবের ফলে তারা যখন তাদের গোষ্ঠীভিত্তিক যৌথতাকে হারিয়ে ফেলে তখন তাদের মধ্যে আবার সেই যৌথতাকে ফিরিয়ে আনার আকাঙ্ক্ষার জন্ম হল। তারা অতীতের ‘ঋত’র শাসনের কথা বলল। প্রত্যাবর্তন চাইল ‘ঋত’র।
‘ঋত’ কী? ভিনটারনিথস-এর মতে, ‘ঋত’ মানে বিশ্বের নিয়মানুবর্তিতা। ম্যাকডোনেলের মতে, ‘ঋত’ শুধু জড়জগতের নিয়মানুবর্তিতাই নয়, নৈতিক নিয়মানুবর্তিতাও।[8] সরদেশাই বলেছেন:
Rita was the period of “classical” primitive communism of the Indo-Aryan tribes. (…) It was pre-Vedic and we find many nostalgic references to it in Vedic literature as a bygone age in which justice, truth, unity, equality and brotherhood ruled supreme. The references also bring out that in Rita society the tribe worked together, labour was collective, and the produce of labour, meagre as it was, was shared more or less equally by all. There was no rich and no poor, no selfishness, no greed. Each for all, all for each was the rule in all social activities, every sphere of social life.
(Sardesai. 1994 : 108-9)
প্রাচীন বৈদিক কবিরা ‘ঋত’র মধ্য দিয়ে সমস্ত জাগতিক ঘটনার মূলে কোনও এক অমোঘ নিয়মানুবর্তিতাকে অনুভব করেছিলেন। এই ‘ঋত’ বরুণের ইচ্ছাধীন বা আজ্ঞাধীন না হলেও তিনি ‘ঋত’র পালক, ধারক ও অনুগামী।[9] এই ‘ঋত’ বৈদিক আর্যদের সুপ্রাচীন যৌথজীবনের ইঙ্গিত দেয়। যেখানে (যেমন সরদেশাই ও দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন) কোনও বৈষম্য ছিল না, ভোগ ও অভাব উভয়ই ছিল যৌথ। কিন্তু পরবর্তীকালে তা অপসারিত হয়ে গেলেও, তার অস্তিত্ব বজায় থাকল মানুষের সুখস্মৃতিতে। নিদারুণ অভাব, দারিদ্র্য, বৈষম্য ও নানাবিধ সামাজিক অসামঞ্জস্যের সামনে বিপর্যস্ত বৈদিক কবিরা সেই ‘ঋত’র যুগে ফিরতে চেয়েছেন: “পূর্বের সেই ঋত কোথায় গেল? আমি দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করছি নতুন করে ‘ঋত’র জন্ম হোক।”[10] এভাবেই প্রকাশ পেল অতীতের যৌথজীবনে প্রত্যাবর্তনের প্রতি তাঁদের আগ্রহ।
আদিম সাম্যবাদী প্রাকবিভক্ত সামাজিক কাঠামোর অবলুপ্তি ঘটলে তার নৈতিকতা ও নিয়মের পালক বরুণও অপসারিত হলেন সমাজ থেকে। আবির্ভাব ঘটল নতুন নেতা, নতুন দেবতা— ইন্দ্রের। লুণ্ঠন ও আগ্রাসনের দেবতা ইন্দ্র। ইন্দ্রকে কেন্দ্র করেই জন্ম নিল নতুন (রাজনৈতিক) কাঠামো— পরিণতিতে তা-ই হয়ে উঠল ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের আদিমতম রূপ।[11] ‘ঋত’ পরিপূর্ণরূপে অপসারিত হল সমাজ থেকে। সর্বজনীন মঙ্গলের ধ্বংসস্তূপের ওপর জন্ম নিল ব্যক্তিগত লোভ। অতীতের সুখস্মৃতি তাই বারংবার সামাজিক মানুষকে পীড়া দিত। আর তারা ভাবত কীভাবে সেই ভালো সময়ে ফিরে যাওয়া যায়। উপনিষদ রচনার কালেও এই আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ দেখা যাবে। ঈশোপনিষদের প্রথম সূক্তেই বলা হয়েছে: “মা গৃধঃ কস্য স্বিদ্ধনম”।[12] অর্থাৎ ধনের আকাঙ্ক্ষা কোরো না, লোভ কোরো না, ধনসম্পত্তি আবার কার? ধন কোনও ব্যক্তির নয়, সময়ের। সুতরাং সেই ধনসম্পত্তিতে লোভ কোরো না। বৈদিক আর্যদের আদিম সাম্যবাদী সমাজের স্মৃতি এখানে প্রতিফলিত হতে দেখা যাবে। সে সমাজ এখন অতীত, আর সেই অতীতের বিপরীতে এমন এক সমাজ গঠিত হয়েছে, যা হিংসা, লোভ, মিথ্যা ও অসাধুতায় পরিপূর্ণ। জন্ম নিয়েছে এমন এক রাজনৈতিক সংগঠন (বা রাষ্ট্র) যার কাজ এই অসাম্যগুলিকে রক্ষা করা। উপনিষদের কবির তাই আকুল প্রার্থনা, ধনসম্পদের ওপর লোভ কোরো না। ধনের ধর্ম অসাম্য ও লোভ। এই লোভকে সম্বরণ করো। ধন সমষ্টির। ফিরে চলো অতীত মূল্যবোধে। ঔপনিষদিক যুগের পরবর্তীকালে মহাজনপদের আবির্ভাবের যুগে এই আকাঙ্ক্ষা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। উপনিষদের কবিদের মতোই বুদ্ধ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন ব্যক্তিগত সম্পদের কুফল, আদিম সাম্যবাদী সমাজের পতনের যন্ত্রণাগুলিকে।
২.
উৎপাদন পদ্ধতির সবচেয়ে সচল ও বৈপ্লবিক উপাদান হল উৎপাদিকা শক্তি। উৎপাদিকা শক্তির উন্নতির ফলে সমাজের সাম্য অবস্থা ভেঙে যায় এবং সেই ধ্বংসস্তূপের ওপর শ্রেণিবিভক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রশক্তির আবির্ভাব হয়। সমাজবিকাশের এই সাধারণ নিয়মটি যথাযথভাবেই ধরা পড়েছিল বৌদ্ধ চিন্তায়। বৌদ্ধ গ্রন্থ ‘মহাবস্তু অবদান’-এ রাজার আবির্ভাবের পিছনে একটা বস্তুবাদী ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। এখানে দেখানো হয়েছে যে পৃথিবীতে এমন একটা সময় ছিল যখন সমাজের আবির্ভাব ঘটলেও রাষ্ট্র, রাজা ইত্যাদির সৃষ্টি হয়নি। ‘মহাবস্তু অবদান’-এ রাষ্ট্রের/রাজার জন্মবৃত্তান্তে যা বলা হয়েছে তা হরপ্রসাদ শাস্ত্রী উপস্থিত করেছেন এইভাবে:
“… [শালি] ধানের কণা নাই, তুষ নাই, অতি সুগন্ধ। সন্ধ্যায় ধান কাটিলে, সকালে আবার গজাইয়া উঠে, সকালে কাটিলে সন্ধ্যায় আবার গজাইয়া উঠে; শুধু গজাইয়া উঠে এমন নয়, একেবারে ধান পাকিয়া উঠে, বারো ঘন্টায় একেবারে পাকা ধান পাওয়া যায়। এই ধান খাইয়া লোকে কতকাল রহিল। প্রথম প্রথম সকলেই সকাল-সন্ধ্যা দুইবেলা ধান ঝাড়িয়া আনিত। সকাল-সন্ধ্যায়ই খাইত, সঞ্চয়ের নামটিও করিত না; কিন্তু ক্রমে দু-একজন ভাবিল, দুবেলায়ই ধান কাটিতে হইবে কেন? এক বেলাতেই দু বেলার ধান জোগাড় করিয়া আনি। তাহারা তাহাই করিতে লাগিল। তাহাদের দেখাদেখি অনেকেই সেইরূপ করিতে লাগিল, বরঞ্চ সঞ্চয়ের মাত্রা বাড়িয়ে গেল। এখন আর দু বেলার সঞ্চয়ে কুলায় না, দুই দিনের সঞ্চয় হইতে লাগিল, ক্রমে দুই সপ্তাহেরও সঞ্চয় হইতে লাগিল। ক্রমে ধানের কণা আর তুষ বাড়িতে লাগিল। সকালে ধান কাটিলে সন্ধ্যায় আর গজায় না।
… কণাওয়ালা, তুষওয়ালা ধান ক্ষেত না করিলে আর জন্মায় না। কতকগুলি দুষ্ট লোকে অন্যায় করিয়া সঞ্চয় করিতে গিয়া আমাদের এমন সুখের খোরাকে ছাই দিল। যাহা হউক, এখন আমাদের এক কাজ করিতে হইবে। এখন ক্ষেত ভাগ করিতে হইবে, সীমাসরহদ্দ বাঁধিয়া দিতে হইবে, কাহার কোন ক্ষেত ঠিক করিয়া দিতে হইবে— এই ক্ষেত তোমার, এই ক্ষেত আমার, এই ক্ষেত রামের, এই ক্ষেত শ্যামের। এইরূপে আবার কিছুদিন চলিল।
একজন বসিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিল— আমার তো এই ক্ষেত, এই ধান। যদি কম জন্মায়, কী করিয়া চলিবে? সে মনে মনে ঠাহরাইল, দিক আর না দিক, অন্যের ধান আমি তুলিয়া লইব। সে আপনার ধানগুলি সঞ্চয় করিয়া অপরের ক্ষেতের ধানগুলি উঠাইয়া লইয়া আসিল। তৃতীয় ব্যক্তি দেখিতে পাইয়া বলিল, “তুমি করো কী? পরের ধান তাহাকে না বলিয়া তুলিয়া আনিতেছ? আর এরূপ করিবে না।” কিন্তু আবার সে পরের ধান না বলিয়া তুলিয়া আনিল। তৃতীয় ব্যক্তি দেখিতে পাইয়া আবার বলিল, “তুমি ফের এই কাজ করিলে?” সে বলিল, “আর এরূপ হইবে না।” কিন্তু কিছুদিন পরে সে আবার পরের ধান উঠাইয়া আনিল। তৃতীয় ব্যক্তি এবার আর চুপ করিয়া রহিল না। সে তাহাকে বেশ উত্তমমধ্যম দিয়া দিল। তখন ধানচোর হাত তুলিয়া চিৎকার করিতে লাগিল, “দেখো ভাই, আমাকে মারিতেছে, দেখো ভাই, আমাকে মারিতেছে, কী অন্যায়! কী অন্যায়!” এইরূপে পৃথিবীতে চুরি, মিথ্যা কথা ও শাস্তির প্রাদুর্ভাব হইল।
তখন সকলে মিলিয়া পরামর্শ করিতে লাগিল— আইস, আমরা একজন বলবান, বুদ্ধিমান, সকলের মন জোগাইয়া চলে— এমন লোককে আমাদের ক্ষেত রাখিবার জন্য নিযুক্ত করি। তাহাকে আমরা সকলের ফসলের অংশ দিব। সে অপরাধের দণ্ড দিবে, ভালো লোককে রক্ষা করিবে, আর আমাদের ভাগমতো ফসল দেওয়াইয়া দিবে। তাহারা একজন লোক বাছিয়া লইল। তাহাকে তাহারা ফসলের ছয় ভাগের এক ভাগ দিতে রাজি হইল। সকলের সম্মতিক্রমে সে রাজা হইল, এইজন্য তাহার নাম হইল মহাসম্মত। এইরূপে তেজোময় জীব অনন্ত আকাশে ঘুরিয়া বেড়াইতে বেড়াইতে ক্রমে লোভে পড়িয়া মাটিতে মাটি হইয়া গেল। শেষে তাহাদের ক্ষেত আগলাইবার জন্য একজন ক্ষেতওয়ালার দরকার হইল। সেই ক্ষেতওয়ালাই রাজা, ফসলের ছয় ভাগের এক ভাগ তাহার মাহিনা।”
(হশর। ২২০১ : ৩ : ৪৭৭-৭৯)
‘মহাবস্তু অবদান’-এর রাজা (মহাসম্মত) ও রাষ্ট্রের সূত্রপাত সংক্রান্ত আখ্যানটির অনেকগুলি দিক যথেষ্ট চিত্তাকর্ষক।
প্রথমত, কাহিনিটি ধর্মগন্ধমুক্ত। রাজা/রাষ্ট্রের আবির্ভাবে দৈব ক্ষমতার কোনও ভূমিকাই নেই। এই দিক থেকে এই ব্যাখ্যাটিকে সেকুলার বললে বোধহয় খুব একটা ভুল হবে না। এ কারণেই এই মতটি বিশেষ প্রচার পায় না। আর যেখানে এর উল্লেখ থাকে, সেখানেও কঠোর সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। ‘মহাবস্তু অবদান’-এ উল্লেখিত কাহিনির মতোই ‘দীঘ নিকায়’-তে রাষ্ট্র/রাজার সৃষ্টির একটি বিবরণ পাওয়া যায়। উভয় আখ্যানের মধ্যে প্রচুর সাদৃশ্য আছে। ‘দীঘ নিকায়’তেও তাই সেকুলার দৃষ্টিভঙ্গির প্রাধান্য বজায় রয়েছে। আপ্টেকার ‘মহাবস্তু অবদান’-এর কথা উল্লেখ না করলেও ‘দীঘ নিকায়’-এর কাহিনিকে বেশ কড়া সমালোচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন:
It is now generally recognised that the contract theory of origin of government is bad history and worse logic; it can no doubt explain the origin of a particular form of state among people who have already developed governmental institutions, but it cannot explain how the first argument took place among the members of a community, which was still in the state of nature. Contract is possible only in a society where mutual rights and obligations are respected, and this is obviously impossible in a society where the law of the jungle prevails.
(Aptekar. 2005 : 31)
আপ্টেকারের এই সমালোচনার প্রধান দুটি দুর্বলতা হল, আইন সংক্রান্ত আধুনিককালের ধারণাকে তিনি প্রয়োগ করেছেন প্রাচীন অতীতের এমন এক সমাজের ক্ষেত্রে যেখানে এই আধুনিক ভাবনাটি ছিল অনুপস্থিত। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার যে গভীর সম্পর্ক আছে, তা প্রকাশিত হয়েছে এই বৌদ্ধ আখ্যানের মধ্যে— আপ্টেকার তা বুঝতে চাননি। এই বুঝতে না-চাওয়ার পেছনে অবশ্যই কার্যকরী তাঁর হিন্দুত্ববাদী ইতিহাস-চিন্তা। আপ্টেকার তাই রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে সামাজিক চুক্তি মতবাদটিকে নস্যাৎ করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। এই মতবাদের নেতিকরণই রাষ্ট্র সম্পর্কে দৈবিক মতটি প্রতিষ্ঠার সহায়ক। সে-কথাই আপ্টেকার বলতে চেয়েছেন।
প্রাচীন ভারতে রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে দুই ধরনের মত গড়ে উঠেছিল। একটি ঐশ্বরিক বা দৈবিক মতবাদ, অন্যটি সেকুলার মতবাদ। এই দুই ধরনের মতের দুই ধরনের উৎসস্থল। মহাজনপদগুলি মূলত দুই ধরনের সরকার দ্বারা পরিচালিত হত— প্রজাতান্ত্রিক (অভিজাততান্ত্রিক ও নির্বাচিত ব্যক্তির দ্বারা পরিচালিত গণসমূহ) এবং রাজতান্ত্রিক। বুদ্ধচিন্তার সামাজিক চুক্তি মতবাদের মতো সেকুলার ধারণার আবির্ভাব ঘটেছিল এই প্রজাতন্ত্রগুলিতে। অন্যদিকে রাজতন্ত্রের অধীনে থাকা রাজ্যগুলিতে রাজার শাসনের ঐশ্বরিক বৈধতা সরবরাহ করত ধর্মীয় নেতারা, ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা। রোমিলা থাপারের কাছ থেকে এই সম্পর্কটি সম্বন্ধে একটু জেনে নেওয়া যাক।
প্রথম যুগের বৈদিক রাজারা ছিলেন প্রধানত সামরিক নেতা। যুদ্ধে দক্ষতা ও গোষ্ঠীর রক্ষাকার্যে সাফল্যের ওপরেই তাঁর রাজা থাকা না-থাকা নির্ভর করত। তিনি স্বেচ্ছায় দেওয়া উপহার গ্রহণ করতেন। কিন্তু জমির ওপর তাঁর কোনও অধিকার ছিল না এবং নিয়মিত কোনও করও তিনি পেতেন না। যুদ্ধ বা গো-হরণ থেকে যা পাওয়া যেত তার একটা অংশ তাঁর প্রাপ্য ছিল। ধর্মীয় ব্যাপারে তাঁর ভূমিকা ছিল সামান্যই, কেননা পুরোহিতদের নির্দিষ্ট ক্রিয়াকলাপও ছিল। কিন্তু রাজার ওপর ক্রমশ দেবত্ব আরোপ করায় এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটল। পরবর্তী যুগের কাহিনি থেকে জানা যায়, সে-সময়ে বিশ্বাস ছিল যুদ্ধজয়ের জন্য দেবতারাই রাজা নির্বাচন করতেন। এবং নির্বাচিত রাজা কিছু বিশিষ্ট ভগবদ্দত্ত গুণের অধিকারী বলে গণ্য হতেন। এইভাবে নশ্বর মানুষের ওপর স্বর্গীয় গুণ ও লক্ষণ আরোপিত হল। মানুষ ও দেবতার যোগসূত্র ছিলেন পুরোহিতরা। তাঁরা রাজাদের ওপর দেবত্ব আরোপের জন্য বিশেষ পশুবলির বিধান দিতেন। রাজাদের ওপর দেবত্ব আরোপের সঙ্গে সঙ্গে পুরোহিতদেরও একটা বিশেষ স্থান ও ভূমিকা নির্দিষ্ট হয়ে গেল। রাজা ও পুরোহিতদের পারস্পরিক নির্ভরতা শুরু হল এভাবেই।
(থাপার। ২০০৪ : ২০)
রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে ঐশ্বরিক মতবাদের এটাই ছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট। রাজার দৈব উৎপত্তি প্রতিষ্ঠা কেবল রাজার ক্ষমতাবৃদ্ধি ও রাজক্ষমতাকে বংশানুক্রমিক করে তোলেনি, এই দৈবশক্তির উপাসক ও ব্যাখ্যাকার হিসেবে ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের ক্ষমতার বৃদ্ধি ঘটে। তাই যে পরিমাণে রাজতন্ত্র শক্তিশালী হয়ে ওঠে ও প্রজাতন্ত্রগুলির ওপর আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়, সেই অনুপাতেই ব্রাহ্মণ্য-প্রাধান্য সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। ঐশ্বরিক মতবাদে দেখানো হয় রাজা স্বয়ং ঈশ্বর বা ঈশ্বরের প্রতিনিধি। মনুসংহিতায় রাজার আবির্ভাব ও স্বরূপ সম্বন্ধে বলা হয়েছে:
ক. “জগৎ যেহেতু অরাজক বা রাজশূন্য হলে বলবানের ভয়ে সকলেই ব্যাকুল হয়ে ওঠে, তাই সর্বস্রষ্টা পরমেশ্বর সমুদয় চরাচরের রক্ষার জন্য রাজাকে সৃষ্টি করেছেন।”[13]
খ. “ইন্দ্র, বায়ু, জল, সূর্য, অগ্নি, বরুণ, চন্দ্র ও কুবের—এই আটজন দিকপালের সারভূত অংশ গ্রহণ করে পরমেশ্বর রাজাকে সৃষ্টি করেছেন।”[14]
গ. “যেহেতু ইন্দ্র প্রভৃতি প্রতাপান্বিত দেবতাদের অংশ থেকে রাজার সৃষ্টি হয়েছে, তাই তিনি শৌর্য বীর্যের আতিশয্যে সকল প্রাণীকে অভিভূত করতে পারেন।”[15]
ঘ. “সূর্যের মতো দর্শনকারীদের চোখ এবং মনকে রাজা সন্তপ্ত করেন। তাই পৃথিবীতে কোনও লোকই রাজাকে সামনে থেকে দেখতে পায় না।”[16]
ঙ. “প্রতাপে রাজা অগ্নি, বায়ু, সূর্য, চন্দ্র, যম, কুবের, বরুণ ও মহেন্দ্রের তুল্য।”[17]
চ. “… [রাজা] মহান দেবতা, মানুষ রূপে পৃথিবীতে অবস্থান করছেন মাত্র।”[18]
(দত্ত, চৈতালী। ২০০৮ : ১৫৫)
রাজার সৃষ্টি/আবির্ভাবের সঙ্গে দৈবশক্তি/ঐশ্বরিক ক্ষমতার সংযোগ মনুসংহিতায় স্পষ্টভাবেই স্বীকৃত। অর্থাৎ এখানে রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত জাগতিক ব্যাখ্যাটি সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত। বৌদ্ধ ব্যাখ্যায় রাজা জনগণের অধীন। মনুর ব্রাহ্মণ্যবাদী ব্যাখ্যায় এর উল্টোটাই প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। সমর্থন জানানো হয়েছে চরম রাজতন্ত্রকে, যেখানে রাজা জনগণের সেবক নয়, বরং জনগণের প্রভু। মহাভারতের শান্তিপর্বেও এই রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আবির্ভাবের বর্ণনা পাওয়া যায়। এ বর্ণনাটিও ধর্মতাত্ত্বিক ও অলৌকিক।
মহাভারতের শান্তিপর্ব যুধিষ্ঠির ভীষ্মকে অভিবাদনের পর প্রশ্ন করলেন, ‘পিতামহ ‘রাজা’ শব্দের উৎপত্তি কী করে হল তা বলুন। রাজা কী প্রকারে পৃথিবী রক্ষা করেন? লোকে কেন তাঁর অনুগ্রহ চায়?’
ভীষ্ম বললেন, ‘নরশ্রেষ্ঠ, সত্যযুগের প্রথমে যেভাবে রাজপদের উৎপত্তি হয় তা বলছি শোনো। পুরাকালে রাজা ছিল না, রাজ্য ও দণ্ডও ছিল না, দণ্ডার্হ লোকও ছিল না, প্রজারা ধর্মানুসারে পরস্পরকে রক্ষা করত। ক্রমশ মোহের বশে লোকের ধর্মজ্ঞান নষ্ট হল, বেদও লুপ্ত হল, তখন দেবতারা ব্রহ্মার স্মরণ নিলেন। ব্রহ্মা এক লক্ষ অধ্যায়যুক্ত একটি নীতিশাস্ত্র রচনা করে তাতে ধর্ম-অর্থ-কাম এই ত্রিবর্গ এবং মোক্ষ বিষয়ক চতুর্থ বর্গ বিবৃত করলেন। এই শাস্ত্রে তিন বেদ, অন্বীক্ষিকী (তর্কবিদ্যা), বার্তা (কৃষি বাণিজ্যাদি বৃত্তি), দণ্ডনীতি, সাম-দান-দণ্ড-ভেদ-উপেক্ষা এই পঞ্চ উপায়, সন্ধিবিগ্রহাদি, যুদ্ধ, দুর্গ, বিচারালয়ের কার্য এবং আরও অনেক বিষয় বর্ণিত হয়েছে। মানুষ অল্পায়ু, এই বুঝে মহাদেব সেই নীতিশাস্ত্রকে সংক্ষিপ্ত করলেন, তারপর ইন্দ্র, বৃহস্পতি ও যোগাচার্য শুক্র ক্রমশ আরও সংক্ষিপ্ত করলেন।
দেবগণ প্রজাপতি বিষ্ণুর কাছে গিয়ে বললেন, মানুষের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ হওয়ার যোগ্য তা বলুন। বিষ্ণু বিরজা নামে এক মানসপুত্র সৃষ্টি করলেন। বিরজার অধস্তন পুরুষ যথাক্রমে কীর্তিমান কর্দম অনঙ্গ নীতিমান (বা অতিবল) ও বেণ। বেন অধার্মিক ও প্রজাপীড়ক ছিলেন। সেজন্য ঋষিগণ মন্ত্রপূত কুশ দিয়ে তাঁকে বধ করলেন। তারপর তাঁরা বেণের দক্ষিণ ঊরু মন্থন করলেন। তা থেকে এক খর্বদেহ, কদাকার, দগ্ধকাষ্ঠতুল্য পুরুষ উৎপন্ন হল। ঋষিরা তাঁকে বললেন, ‘নিষীদ’— উপবেশন করো। এই পুরুষ থেকে বনপর্বতবাসী নিষাদ ও ম্লেচ্ছ সকল উৎপন্ন হল। তারপর ঋষিরা বেণের দক্ষিণ হস্ত মন্থন করলেন, তা থেকে ইন্দ্রের ন্যায় রূপবান একটি পুরুষ উৎপন্ন হলেন। ইনি ধনুর্বাণধারী, বেদ-বেদাঙ্গ-ধনুর্বেদে পারদর্শী এবং দণ্ডনীতিজ্ঞ। দেবতা ও মহর্ষিগণ এই বেণপুত্রকে বললেন, তুমি নিজের প্রিয়-অপ্রিয় এবং কাম ক্রোধ লোভ মান ত্যাগ করে সর্বজীবের প্রতি সমদর্শী হবে এবং ধর্মভ্রষ্ট মানুষকে দণ্ড দেবে; তুমি প্রতিজ্ঞা করো যে কায়মনোবাক্যে বেদনির্দিষ্ট ও দণ্ডনীতিসম্মত ধর্মপালন করবে, দ্বিজগণকে দণ্ড দেবে না এবং বর্ণসঙ্করদোষ নিবারণ করবে। বেণপুত্র প্রতিজ্ঞা করলে শুক্রাচার্য তাঁর পুরোহিত হলেন, বালখিল্য প্রভৃতি মুনিরা তাঁর মন্ত্রী হলেন এবং গর্গ তাঁর জ্যোতিষী হলেন।”
(বসু, রাজশেখর। ১৩৯৪ বাংলা : ৫৬২-৬৩)
বুদ্ধের মতের সঙ্গে ব্রাহ্মণ্যবাদী মতের পার্থক্যটি কেবল ইহজাগতিক ও দৈবিক-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, রাজার (বা রাষ্ট্রের) অবস্থানের সঙ্গেও গভীরভাবে যুক্ত। ব্রাহ্মণ্যবাদী মতে, রাজা ধর্মের অধীন। এ ধর্ম হল ব্রাহ্মণ্য ধর্ম। রাজার কাজ বর্ণসঙ্করকে রোধ করা এবং ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রতিষ্ঠা করা। সাধারণ মানুষ এখানে একান্তভাবেই নিষ্ক্রিয়। তার ভূমিকা শুধুমাত্র আদেশ-নির্দেশ পালন করা। বুদ্ধচিন্তায় মানুষ নিষ্ক্রিয় নয়। আবার রাজা ঈশ্বরের প্রতিনিধিও নয়। রাজার কাজ সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষা করা। তিনি জনগণের দ্বারা মনোনীত, জনগণের বেতনভোগী কর্মচারী মাত্র। বুদ্ধ তাই রাজাকে খুব একটা সম্মান-মর্যাদা দিতে রাজি ছিলেন না। চন্দ্রকীর্তি নামের বৌদ্ধ চিন্তাবিদকে তাই বলতে শোনা যায়, “[ওহে রাজা] তুমি তো দেশের লোকের দাস। ফসলের ছয় ভাগের এক ভাগ মাহিনাই তোমার জীবিকা। তুমি আবার গুমর করো কী!”[19] সুতরাং বুদ্ধ কেবল রাজা ও রাষ্ট্রকে ধর্ম ও দৈবিক ব্যাখ্যা থেকে পৃথক রাখলেন তাই নয়, রাজাকে সাধারণ মানুষের ভৃত্যেও পরিণত করলেন।
৩.
বুদ্ধের পূর্ববর্তী বৈদিক যুগকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়— ঋক বৈদিক যুগ (খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০-খ্রিস্টপূর্ব ১০০০) পরবর্তী বৈদিক যুগ (খ্রিস্টপূর্ব ১০০০-খ্রিস্টপূর্ব ৬০০)। এই যুগে রাজার ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল ধর্মীয় সমর্থন। এই ধর্মীয় ব্যাখ্যা প্রদানে ব্রাহ্মণরাই অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। আরও স্পষ্ট করে বললে প্রাকবুদ্ধ পর্বে রাষ্ট্র সৃষ্টির বিষয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদী ব্যাখ্যা রাজতন্ত্রের ওপরেই গুরুত্ব দিয়েছিল। অন্যদিকে বুদ্ধচিন্তায় প্রাধান্য পেয়েছিল প্রজাতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক ধারণা। তবে এ-কথা বলা বোধহয় ঠিক হবে না যে, বর্তমানে রাজতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র বা গণতন্ত্র বলতে যা বোঝা হয় তা সেই সুদূর প্রাচীন অতীতে হুবহু একই রকম ছিল। বরং ধারণাগুলির আদি রূপটি তখন সবেমাত্র বিকশিত হতে শুরু করে। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটেই ধারণাগুলির অর্থ অনুধাবন করা প্রয়োজন। এই প্রয়োজনেই রাজা/রাজন শব্দটির ওপর কয়েকটি প্রাথমিক কথা বলা হল।
বৈদিক যুগ বলে যে সময়টিকে চিহ্নিত করা হয় সেটি বেশ দীর্ঘ, প্রায় ১০০০ বছর। এই সময় রাজা/রাজন/রাষ্ট্রকে একই অর্থে বোঝানো হত না। ঋকবৈদিক যুগে রাজা বলতে যা বোঝানো হত, তা পরবর্তী যুগে পরিবর্তিত হয়ে যায়। ঋকবেদে রাজা শব্দটি বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে। বৈদিক সাহিত্য ও ইতিহাসের রক্ষণশীল আলোচকরা এই রাজা শব্দটিকে রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তাঁরা দেখানোর চেষ্টা করেছেন, বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের আবির্ভাব আদি বৈদিক (বা ঋকবৈদিক) যুগেই ঘটেছিল। আপ্টেকার বেশ জোরের সঙ্গেই ঘোষণা করেছেন: “There is thus no doubt that monarchy had become normally hereditary long before the later Vedic period.”[20] কিন্তু সমস্যা হল বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের আবির্ভাব ঋকবেদের সময়ে দেখা যায় না। সে সময় তা বোধহয় সম্ভবও ছিল না। সে সময়কালের অর্থনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতির কারণেই। রাজতান্ত্রিক বংশের আবির্ভাব অনেক পরের ঘটনা। রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য প্রয়োজন একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, অনুগত প্রজাসাধারণ, প্রশাসকগোষ্ঠী, স্থায়ী সেনাবাহিনি, কর/রাজস্ব ব্যবস্থা ও তার সংগ্রহের ব্যবস্থা। ঋকবৈদিক যুগে এই বৈশিষ্ট্যগুলির একটিও উপস্থিত ছিল না।
‘রাজা’ শব্দটির ব্যুৎপত্তি ‘রঞ্জ’ ধাতু থেকে। রাজা শব্দটির তাই উৎসগত অর্থ হল যিনি নেতৃত্ব দেন, যিনি অতি উজ্জ্বল এবং যিনি মানুষকে আনন্দে রাখেন।[21] ঋকবেদে রাজা ‘বিশপতি’, অর্থাৎ ‘বিশ’ বা কৌম (Clan)-র প্রধান বা দলপতি। তিনি যুদ্ধের সময় তাঁর গোষ্ঠী বা কৌমকে নেতৃত্ব দেন, সম্পদ লুঠ করার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেন এবং লুণ্ঠিত সম্পদ কৌমের সদস্যদের মধ্যে বণ্টন করে দেন। সে সময় ঋকবৈদিক মানুষরা কৃষিকাজ জানত না। পশুপালনই ছিল তাদের বেঁচে থাকার প্রধান উপায়। ফলে পশুচারণের ক্ষেত্র তাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাদের স্থায়ী বাসস্থান ছিল না, তারা যাযাবরের জীবন যাপন করত। গবাদি পশুর গুরুত্ব তাদের জীবনে অসীম। তাই তারা গবাদি পশুর জন্য যুদ্ধ করত। ঋকবেদে যুদ্ধের সমার্থক হল ‘গবিষ্টি’। শব্দটির আক্ষরিক অর্থ, গবাদি পশু লাভের ইচ্ছা। রাজাকে এই যুদ্ধে গোষ্ঠীর নেতা হিসেবে ভূমিকা পালন করতে হত। এই রাজা অবশ্যই বংশানুক্রমিকভাবে ক্ষমতা ভোগ করতেন না, তাঁর ক্ষমতার ভিত্তি ছিল যুদ্ধে নেতৃত্বদানের দক্ষতা। অর্থাৎ আরোপিত মর্যাদা নয়, অর্জিত মর্যাদাই গুরুত্ব পেত সেই সময়।
‘কর’ সংগ্রহের প্রশ্নটি এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উদ্বৃত্ত উৎপাদন ছাড়া নিয়মিত কর সংগ্রহ সম্ভব নয়। ফলে যতদিন পর্যন্ত স্বয়ংসম্পূর্ণ কৃষিভিত্তিক সমাজের আবির্ভাব ঘটেনি, রাজা বা দলপতির পক্ষে নিয়মিত কর সংগ্রহও সম্ভব হয়নি। ঋকবেদে কৃষি মোটেই গুরুত্ব পায়নি। পশুপালক সমাজে এটাই স্বাভাবিক। ঋকবেদে কৃষি ও হালচাষের কথা পাওয়া যায় মোট ২১ বার। এগুলির মাত্র কয়েকটি চতুর্থ মণ্ডলের অন্তর্ভুক্ত। এগুলি আবার পরবর্তীকালের সংযোজন বলে মনে করা হয়। বাকি উল্লেখগুলি পাওয়া যায় ঋকবেদের প্রথম ও দশম মণ্ডলে (ঋকবেদের অর্বাচীন অংশ)। “ঋকবেদের জনগণ যে-সব শস্য উৎপাদন করতেন তার মধ্যে প্রধানতম ছিল যব বা বার্লি, যা পাকতে ষাট দিন লাগে, যা মানুষের খাদ্য হিসেবে আবার গবাদি পশু বা ঘোড়ার জাব হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। দেশের দুই প্রধান শস্য ধান ও গম তাদের কাছে পরিচিত ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই ঋকবেদে শস্য উপহার দেওয়ার উল্লেখ নেই, এবং কর বা রাজস্ব হিসেবে রাজাকে দান করার প্রশ্ন নেই। অতএব, শুধুমাত্র যুদ্ধ বিজয়ের পর অর্জিত দ্রব্য বা লুঠের মাল, যেমন গবাদি পশু ও নারী এবং তার সঙ্গে মাঝে মাঝে পরাজিত উপজাতির দ্বারা প্রদত্ত গবাদি পশু, অন্য প্রাণী, এবং দুগ্ধজাত দ্রব্যের উপহার সামগ্রী, নিজ উপজাতীয় মানুষদের দেওয়া ওই ধরনের উপহার— এসবই ছিল উপজাতীয় রাজাদের কাছে বণ্টনের সামগ্রী।”[22] এখানে এটা স্পষ্ট যে প্রণালীবদ্ধভাবে শোষণের পরিস্থিতি সেসময় গড়ে ওঠেনি কারণ কৃষিনির্ভর সমাজের অনুপস্থিতি, অর্থাৎ উদ্বৃত্ত আহরণের সুযোগ না থাকা। পূর্ববর্তীকালে কোনও কোনও ক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত থাকলেও সেগুলি মোটেই সঞ্চয়যোগ্য ছিল না। এই সঞ্চয়যোগ্য উদ্বৃত্তের অভাব ঋকবৈদিক যুগের আদিপর্বে সমাজকে শোষক-শোষিত এবং শাসক-শাসিত— এই দুই পরস্পরবিরোধী শ্রেণিতে বিভক্ত করে ফেলেনি।
ঋকবৈদিক যুগের এই পর্বে গোষ্ঠীর সকলেরই অস্ত্রধারণের অধিকার ছিল। কারণ তারা গোষ্ঠীবদ্ধভাবেই অন্য গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করত বা লুঠপাট চালাত। এর বিপরীত কোনও দৃষ্টান্ত ঋকবেদে পাওয়া যায় না। যুদ্ধের ক্ষেত্রে শুধু পুরুষ নয়, নারীর ভূমিকাও ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। বিশপলা, বধ্রিমতী, শশীয়সী প্রমুখ নারী যোদ্ধার কথা এখানে পাওয়া যায়।[23] এই কালপর্বে তাই স্থায়ী কোনও সৈন্যবাহিনি গড়ে ওঠেনি। গোষ্ঠীর সকলকেই যুদ্ধ করতে হত, সকলেরই ছিল অস্ত্রধারণের অধিকার। তাছাড়া পেশাদার সৈন্যদের পোষার মতো উদ্বৃত্ত উৎপাদনও তখন সম্ভব ছিল না। পেশাদার ও স্থায়ী সৈন্যবাহিনি গড়ে ওঠে আরও পরে। রাষ্ট্রের আবির্ভাবও তাই পরের ঘটনা। ফলে ‘রাজা’ শব্দটি ঋকবেদে অবশ্যই রাষ্ট্র ও তার শাসক হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি। রাজা তাই ‘বিশ’ বা ‘গণ’-এর দলপতি মাত্র, বংশানুক্রমিক স্বৈরাচারী রাজা নন।
ঋকবেদের রাজা যে সীমাহীন ক্ষমতা ভোগ করতেন না, তা আরও বোঝা যায় সে সময়কার প্রতিনিধিসভা বা ‘বিদথ’-এর অস্তিত্বের মধ্যে। বৈদিক সভা ও সমিতি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়ে থাকে। কিন্তু বিদথ নিয়ে প্রায় কোনও কথাই হয় না বা কম উল্লেখিত হয়। অথচ ঋকবেদে শব্দটির ১২২ বার উল্লেখ আছে এবং অথর্ববেদে আছে ২২ বার। ‘বিদথ’ কী? রামশরণ শর্মা দেখিয়েছেন, বৈদিক সমাজের সভাগুলির মধ্যে প্রাচীনতম হল বিদথ।[24] এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায় যে, বিদথ হল ইন্দো-আর্যদের আদি পর্বের এমন একটি সাধারণ সভা বা সমাবেশ যেখানে নারী ও পুরুষ উভয়েই উপস্থিত থেকে সকল ধরনের কাজ সম্পাদন করত— অর্থনৈতিক, সামরিক, ধর্মীয় এবং সামাজিক। সেই সমাজে শ্রমবিভাজন তখনও সৃষ্টি হয়নি বা প্রতিষ্ঠিত হয়নি নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্য। গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য একটি সাধারণ ব্যবস্থাই বর্তমান ছিল।[25] ঋকবৈদিক যুগের বিশ বা গণের জীবনে বিদথের এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকায় রাজা বা দলপতি কখনওই স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতা ভোগ করতেন না বরং তিনি নিয়মিত হতেন এই বিদথ দ্বারা। এই বিদথই রাজাকে নির্বাচিত বা মনোনীত করত। শ্রমবিভাজনের অনুপস্থিতির কারণে পৃথক পুরোহিতশ্রেণির জন্মও সে-সময়ে ঘটেনি।[26] এখানে আরও দুটি দিকের ওপর আলোকপাত করা দরকার। প্রথমত, বিদথ ও রাজার ভূমিকা ও আবির্ভাব বিষয়ক ঋকবৈদিক সাক্ষ্য কোনও ধর্মীয় বা দৈবিক ব্যাখ্যাকে হাজির করেনি। বরং তা পুরোপুরি ইহজাগতিক (সেকুলার শব্দটিও এখানে ব্যবহার করা যেতে পারে)।
ঋকবৈদিক যুগের রাজার সঙ্গে পরবর্তী বৈদিক যুগের রাজার অনেক ফারাক। কারণ ততদিনে ঘটে গেছে সমাজ-অর্থনীতির নানা পরিবর্তন। পরিবর্তন ঘটেছে বহু প্রথা-আচরণ ও মূল্যবোধের। সমাজ আগের তুলনায় হয়ে পড়েছে অনেক জটিল। প্রধান পরিবর্তনগুলি এখানে উল্লেখ্য। প্রথমত, পরবর্তী বৈদিক যুগে স্থায়ী কৃষিজীবী সমাজের আবির্ভাব। দ্বিতীয়ত, বর্ণ বলতে আর গাত্রবর্ণ বোঝানো হয় না। তা এই পর্বে চতুর্বর্ণের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামাজিক ভেদাভেদ আগের তুলনায় অনেক স্পষ্ট। তৃতীয়ত, ব্রাহ্মণদের উত্থান। এই যুগে যাগযজ্ঞের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা ব্রাহ্মণদের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছিল। “শুরুতে ব্রাহ্মণরা ছিল ষোলটি পুরোহিতশ্রেণির মধ্যে একটি। কিন্তু তারা ক্রমে অন্যান্য পুরোহিতশ্রেণিকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যায় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রাহ্মণদের উত্থান এক বিশেষ ব্যতিক্রমী ঘটনা যা ভারতের বাইরে অন্যত্র আর্য সমাজে পরিলক্ষিত হয় না। ব্রাহ্মণ্য বর্ণ গঠনে অনার্য উপাদানের কিছুটা ভূমিকা আছে বলে মনে হয়। ব্রাহ্মণরা তাদের নিজেদের এবং যজমানদের জন্য অনুষ্ঠানাদি এবং যজ্ঞ করত এবং কৃষিকার্যের সঙ্গে যুক্ত উৎসবে পৌরোহিত্য করত। তারা যুদ্ধে তাদের পৃষ্ঠপোষকদের সাফল্যের জন্য প্রার্থনা করত। এর পরিবর্তে রাজাকে দেখতে হত যাতে তাদের কোনও ক্ষতি না হয়। রাজন্যবর্গ, যারা ছিল যোদ্ধৃ-অভিজাতদের প্রতিনিধি, তাদের সঙ্গে কখনও কখনও প্রাধান্য নিয়ে ব্রাহ্মণদের সংঘাত বাধত। কিন্তু এই দুই উচ্চবর্গ যখন নিম্নবর্গের সঙ্গে মোকাবিলা করত তখন তারা নিজেদের বিরোধ মুছে ফেলত। পরবর্তী বৈদিক যুগের শেষ দিক থেকে দেখা গেল সমাজের বাকি অংশকে শাসন করার জন্য এই দুটি বর্ণ পারস্পরিক সহযোগিতা করত।”[27] এই সময়কার সাহিত্যে স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল এবং একে অপরের পরিপূরক।[28]
চতুর্থত, ঋকবৈদিক যুগে বর্ণ-জাত প্রথা না থাকলেও পরবর্তী বৈদিক যুগে তার আবির্ভাব ঘটে। ব্রাহ্মণের পৌরোহিত্য হয়ে পড়ে বংশানুক্রমিক। রাজার ক্ষেত্রেও এ-কথা সত্য। কালে কালে আবির্ভাব ঘটে রাজবংশের। বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের। রাজা কৌমের প্রধান বা গোষ্ঠীপতি হিসেবে যে ভূমিকা পালন করতেন ঋকবৈদিক যুগে, তা পরবর্তী বৈদিক যুগে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেল। রোমিলা থাপার লিখেছেন:
In the later Vedic period the consecration of the Raja became more elaborate with claims to ksatra and consecration became an avenue to power. Claims to sovereignty and increasing demands of prestations were sought to be justified through consecration rituals.
(Thapar. 2010 : 36)
অর্থাৎ ঋকবৈদিক যুগের গোষ্ঠীপতির ভূমিকা ত্যাগ করে রাজা পরবর্তী বৈদিক যুগে এক নতুন ভূমিকা গ্রহণ করলেন। রাজার অভিষেক অনুষ্ঠান আরও সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হতে শুরু করে। রাজা এবার ক্ষেত্র বা জমির দাবি করতে থাকে, যা আবার তার ক্ষমতাবৃদ্ধির সহায়ক হয়ে ওঠে। এই অভিষেক অনুষ্ঠান রাজার সার্বভৌমিকতার দাবি এবং কর পাওয়ার দাবিকে বৈধ করে তোলে।
ঋকবেদে রাজা/রাজন্য (আসলে দলপতি বা গোষ্ঠীপতি) পরিণত হয়েছেন পরবর্তী বৈদিক যুগে ক্ষত্রিয়তে।[29] ঋকবৈদিক যুগে রাজার আয়ের উৎস কী ছিল? তিনটি উৎসকে চিহ্নিত করা যায়। প্রথমটি হল লুঠের মালের ভাগ। দ্বিতীয়টি বিশ-এর প্রদত্ত ‘বলি’ বা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত উপহার। তৃতীয়টি হল রাজার নিজের পরিশ্রমলব্ধ জিনিস। এর মধ্যে দিয়ে রাজা বা গোষ্ঠীপতি বিশ বা গোষ্ঠীর মধ্যে বিশেষ স্থান পেয়ে যান। পরবর্তী বৈদিক যুগে এই ‘বলি’ হয়ে ওঠে বাধ্যতামূলক কর। বিশ ও রাজন্যর মধ্যে দ্বিবিভাজন ঘটে। রাজন্যদের যোদ্ধা, তীরন্দাজ এবং নায়ক হিসেবে বর্ণনা করা হত। এই রাজন্যরাই পরবর্তীকালে শাসক পরিবারে রূপান্তরিত হয়।[30] এই পরিবারগুলির মধ্য থেকেই রাজাকে বেছে নেওয়া শুরু হয়ে যায়। রাজা তখনও বিশ-এর সদস্য হলেও বিশ-এর সঙ্গে তার বিভাজন ঘটতে শুরু করে। এটা পাকাপাকিভাবে ঘটে পরবর্তী বৈদিক যুগে। কৃষির আবির্ভাব ও বিকাশের ফলে পরবির্তী বৈদিক যুগে কৃষিক্ষেত্রের গুরুত্ব বিরাটভাবে বৃদ্ধি পায়। ফলে রাজন্য/ক্ষত্রিয়রা কৃষিক্ষেত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রসারে আগ্রহী হয়ে ওঠে। তারা তাদের এই সম্পত্তির একটি অংশ ব্রাহ্মণদের দান করত। আর বিপরীতে ব্রাহ্মণরা রাজার দেবত্ব প্রচার করত। এবং এইভাবে বৈশ্য ও শূদ্রদের ওপর ক্ষত্রিয়-ব্রাহ্মণ আধিপত্যকে বৈধ করে তুলত। আর এভাবেই সমাজে দুই ধরনের বিভাজন এল— একটি শ্রেণি-বিভাজন ও অপরটি বর্ণ-বিভাজন। এই বর্ণগত বিভাজনের আরালেই ছিল শ্রেণিগত বিভাজন।[31][32]
রাজার পরিবর্তন সংক্রান্ত এই আলোচনায় দেখা যাবে যে, ঋকবৈদিক যুগে ‘রাজা’ শব্দটির মধ্যে দিয়ে কোনও রাষ্ট্রব্যবস্থার ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। সে-সময় রাষ্ট্র নামক কোনও কিছুর অস্তিত্বই ছিল না। রাষ্ট্রের আদি রূপের আবির্ভাব ঘটে পরবর্তী বৈদিক যুগে। অন্য ভাষায় এটি হল পূর্ণ রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রাক-পর্ব বা রাষ্ট্রপ্রতিম রাজনৈতিক পরিস্থিতি বা প্রায়-রাষ্ট্র (Proto-state) পর্ব। “পরবর্তী বৈদিক আমলে শাসক যেহেতু অনিয়মিত বলি জাতীয় আদায়ের বেশি সম্পদ আহরণে অক্ষম, সেই কারণে শক্তিশালী সেনাবাহিনী রাখা তাঁর আয়ত্তাতীত। আবার সেনাবাহিনী-নির্ভর দমনের ব্যবস্থা না-থাকায় রাজস্ব আহরণের জন্য অপরিহার্য চাপ সৃষ্টির কোনও উপায়ও তাঁর কাছে ছিল না। এই সমস্যার কারণেই শাসকীয় প্রভাবের বৃদ্ধি ঘটলেও পরবর্তী বৈদিক আমলে রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর উদ্ভব হল না।”[33] রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটল আরও পরে দ্বিতীয় নগরায়নের (খ্রিস্টপূর্ব ৬০০) পর্বে।
এই পর্বে রাষ্ট্র সংক্রান্ত দুটি প্রাধান্যকারী মত গড়ে উঠেছিল— একটি ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদ এবং অপরটি বুদ্ধর সামাজিক চুক্তিবাদী সেকুলার মত। এই বৌদ্ধ মতটি কয়েকশো বছরের ব্যবধানে সম্পূর্ণরূপে পালটে গেল। ‘মিলিন্দ পঞহ’-তে খোদ বুদ্ধকেই বর্ণনা করা হল ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় হিসেবে। অর্থাৎ ইহজগৎ ও পরজগতের প্রতিনিধি রূপে। নাগসেন বুদ্ধকে ব্রাহ্মণ হিসেবে চিহ্নিত করতে গিয়ে বললেন:
…ব্রাহ্মণ তাঁহাকেই বলে যিনি অগ্র, শ্রেষ্ঠ, বর, প্রবর, দিব্যবিহার বহুল হন। বুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে এই রূপে গুণবান। এই কারণে তাঁহাকে ব্রাহ্মণ বলা হয়। … ব্রাহ্মণ তাঁহাকেই বলে, যিনি স্বয়ং অধ্যয়নশীল হইয়া পরকে বিদ্যা দান করেন, দান গ্রহণ করেন, ইন্দ্রিয়দমন ও আত্মসংযম করেন, কর্তব্যপরায়ণ হন; আর যিনি বংশের ঐতিহ্যপ্রবাহ বজায় রাখেন। প্রকৃতপক্ষে বুদ্ধ এইরূপ গুণান্বিত, সুতরাং তাঁহাকে ব্রাহ্মণ বলা যায়।
(মিলিন্দ প্রশ্ন। ২০১৩ : ১৯১)
মজার কথা হল, যে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের বিরুদ্ধে বুদ্ধ সারাজীবন সংগ্রাম করে এলেন সেই বুদ্ধকেই বুদ্ধভক্তরা ব্রাহ্মণ বানিয়ে ছাড়ল। এটা হল এই কারণেই যে, এতদিনে রাষ্ট্র অনেক পরিপক্বতা লাভ করেছে, আবির্ভাব ঘটেছে ‘বৌদ্ধ ধর্ম’ নামক একটি ধর্মের, এবং রাষ্ট্রের সঙ্গে তার চমৎকার সামঞ্জস্য বিধান সম্ভব হয়েছে। বৌদ্ধ রাষ্ট্রযন্ত্র ব্রাহ্মণ্য রাষ্ট্রযন্ত্রের মতোই পীড়ন ও শোষণমূলক এবং বৈষম্য সৃষ্টিকারী ও রক্ষাকারী সংগঠন। আর তাই বুদ্ধ-চিন্তা সেখানে পরিত্যক্ত। বুদ্ধচিন্তার পরিবর্তে সেখানে স্থান করে নিয়েছে বৌদ্ধ ধর্ম। যদিও বুদ্ধ কোনও ধর্ম তৈরি করেননি, কতগুলি নৈতিক ও দার্শনিক মত প্রচার করেছিলেন। কিন্তু কালান্তরে বুদ্ধচিন্তা সরে যায় এবং গড়ে ওঠে বৌদ্ধ ধর্ম। আর কিছুকালের মধ্যেই তা রাষ্ট্রের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে রূপান্তরিত হয় প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে।
[1] মিলিন্দ প্রশ্ন। ২০১৩ : ৩৫
[2] সাংকৃত্যায়ন। ১৯৯৯ : ৯-১১
[3] দপচ। ২০১০ : ১২
[4] চক্রবর্তী, রণবীর। ২০০৭ : ১৩৭
[5] পূর্বোক্ত: ১৩৬
[6] পূর্বোক্ত: ১৬৪
[7] চক্রবর্তী, রণবীর। ২০০৭ : ১৩৬-৩৭
[8] দপচ। ২০০৩ : ১৮৫
[9] দ্রষ্টব্য দপচ। ২০০৩ : ১৮৬
[10] দত্ত, ডঃ রাসবিহারী। ২০১৬ : ৩৫
[11] দ্রষ্টব্য শর্মা। ১৯৯৮ : ৩৭-৫৩
[12] উ, গ্র। ২০১৫ : ৩
[13] মনুসংহিতা। ৩/৭
[14] পূর্বোক্ত। ৪/৭
[15] পূর্বোক্ত। ৫/৭
[16] পূর্বোক্ত। ৬/৭
[17] পূর্বোক্ত। ৭/৭
[18] পূর্বোক্ত। ৮/৭
[19] হপশ। ২০০১ : ৩ : ৪৮০
[20] Aptekar. 2005 : 81
[21] Thapar. 2010 : 48
[22] শর্মা, রামশরণ। ১৯৯৮ : ৪০
[23] ভট্টাচার্য, সুকুমারী। ২০২০ : ২
[24] শর্মা, রামশরণ। ২০১১ : ৮৮
[25] Sharma. 2012 : 103-4
[26] পূর্বোক্ত: ৭৭
[27] শর্মা, রামশরণ। ২০১১ (ক) : ১৩০
[28] চক্রবর্তী, রণবীর। ২০০৭ : ১১৬
[29] পূর্বোক্ত: ১১৬
[30] Thapar. 2010 : 30
[31] কোসাম্বি। ২০১৩ : ৯২
[32] ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত দেখিয়েছেন, ঋকবৈদিক যুগে রাষ্ট্রে তিনটি শ্রেণি উদ্ভূত হয়— ব্রাহ্মণ, ক্ষত্র, বল (বিশ)। (অথর্ববেদ ৯, ৭, ৯; ৩১৯, ১)। জীবিকার বৈশিষ্ট্য অনুসারে বোধ হয় এই তিনটি শ্রেণি ক্রমশ বিবর্তিত হয়। বিশ ও বলকে এক বলে মনে করা হত— যার থেকে রাষ্ট্র সাধারণের হাতেই ছিল বলে বোঝা যায়। রাজা তখনও ভগবানের প্রতিনিধি বা স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠেননি। (দত্ত, ডঃ ভূপেন্দ্রনাথ। ২০০১ : ১ : ৫৪)
[33] চক্রবর্তী, রণবীর। ২০০৭ : ১০৫
অত্যন্ত সুন্দর ব্যাখা ও তথ্য সমৃদ্ধ রচনা। খুব ভালো লাগল। এটি save করে রাখলাম ভবিষ্যতে reference রূপে ব্যবহারের জন্য। আশা করি আপত্তি করবেন না।
খুবই ভালো ও মূল্যবান লেখা। এই মানের লেখা প্রকাশের জন্য ৪নম্বরপ্ল্যাটফর্মকে ধন্যবাদ।