মার্ডার অ্যাট দ্য মুশায়ারা— একটি খুনের রহস্য ও অস্তমিত ভারতভাগ্যের রূপরেখা

সোমরাজ ব্যানার্জী

 

কুছ ইয়াকিন কুছ গুমান কি দিল্লি
আনগিণত ইমতিহান কি দিল্লি
বে-জুবানি কা হো গয়ি হ্যায় শিকার
আসাদুল্লাহ খাঁ কি দিল্লি

–মির্জা গালিব

মে, ১৮৫৭। মুঘল রাজধানী দিল্লির ভাগ্যাকাশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির আধিপত্য তখন চরমে। নগরীর আনাচেকানাচে কান পাতলে শোনা যায় প্রায় তিন শতকের এক সুদূরপ্রসারী সাম্রাজ্যের ক্রমান্বয়ে ভেঙে পড়ার শব্দ। প্রতিক্রিয়াস্বরূপ তার শরীরে ক্রমশ দানা বাঁধছে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ এবং তৎপরবর্তী প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ। শহর থেকে গ্রাম, গ্রাম থেকে পল্লী, সব জায়গাতেই ঘনীভূত হচ্ছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের লেলিহান শিখা। কলকাতা, মিরাট, লখনৌ, দিল্লি— গোপনে যোগাযোগ রক্ষার পরিকল্পনায় নিজেদের জীবন বাজি ধরেছেন হাজার হাজার সৈনিক। রাজা মীরের রহস্য উপন্যাস মার্ডার অ্যাট দ্য মুশায়ারা-র রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে এই ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের উপস্থিতি ও অনুরণন।

এই অস্থির সন্ধিক্ষণের পটভূমিকায় দিল্লির এক হাভেলিতে আয়োজিত মুশায়ারাতে একটি খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় উপন্যাসের ঘটনাক্রম। মৃত ব্যক্তি সেই আসরে আমন্ত্রিত একজন কবি, যাকে আপাতভাবে ছুরিবিদ্ধ করে খুন করা হয়। দিল্লির আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব তখন ব্রিটিশদের হাতে। এই খুনের তদন্তকে তাঁরা অত্যধিক গুরুত্ব দেন এবং জরুরিকালীন ভিত্তিতে কাজ শুরু করেন। নায়েব-কোতোয়াল কিররিমালের অনুরোধে এই তদন্তের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন কবিবর মির্জা গালিব। তদন্তের কাজে নেমেই গালিব তলব পাঠান তাঁর বন্ধু বিজ্ঞানী রামচন্দ্রকে। কাহিনির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক নিয়মে ক্রমশ উন্মোচিত হতে থাকে রহস্যের জট। সামনে আসতে থাকে একের পর এক চরিত্র, তাঁদের পারস্পরিক সম্পর্ক, দিল্লির তৎকালীন অভিজাত জীবনের অস্তমিত আগামী, কোম্পানির বাড়তে থাকা আগ্রাসন, ভারতের প্রথম গণবিদ্রোহের গতিপথ রচনা এবং তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। রহস্য উপন্যাসের সমস্ত উপাদান বয়ে বেড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে একটা কাহিনি কীভাবে ইতিহাসের দলিল হয়ে উঠতে পারে, ফুটিয়ে তুলতে পারে আসন্ন যুদ্ধের প্রহর গুনতে থাকা এক নগরীর বুকের ক্রমবর্ধমান স্পন্দন— রাজা মীরের এই উপন্যাস তার যথাযোগ্য প্রমাণ।

বস্তুত, ১৮৫৭ সালের ভারতের মাটিতে সংঘটিত প্রথম গণ-অভ্যুত্থানের ইতিহাস কারও অজানা নয়। স্বাভাবিকভাবেই, সাহিত্যের বিভিন্ন পর্বে সেই প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে কাহিনি রচিত হয়েছে। ব্রিটিশ সাহিত্যের একটি নির্দিষ্ট ধারা ‘mutiny novel’-এর নির্মাণ এই সূত্র ধরেই, যাতে এই সময়ের ভয়াবহতা ও নিদারুণ হিংস্রতা বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু এই উপন্যাসগুলোর অধিকাংশই ইংরেজ লেখকদের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাধান্য দেয়, তাঁদের ক্ষয়ক্ষতি ও আতঙ্কের খতিয়ান তুলে ধরে। সেইসঙ্গে যুদ্ধপরবর্তী ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘটনাকে ব্রিটিশ রাজের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায় বলে দাবি করা হয়। পরবর্তীতে উত্তর-ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গির অগ্রাধিকার যত বাড়তে থাকে, এই ধরনের ঐতিহাসিক উপন্যাসের ধারায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ করা যায় যা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আগ্রাসী মনোভাবের প্রতি সহজাতভাবেই সমালোচনামূলক ভূমিকা নেয়। সময়ের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব সেখানে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দুটি ভয়ঙ্করভাবে বিরোধী শিবিরের লড়াইতে কীভাবে সমাজের প্রতিটা স্তরের মানুষ জড়িয়ে পড়ে, সেই বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তোলে। আমাদের আলোচ্য এই ঐতিহাসিক উপন্যাস তার ব্যতিক্রম নয়।

মার্ক্সিস্ট দার্শনিক György Lukács তাঁর The Historical Novel গ্রন্থে ঐতিহাসিক উপন্যাসের সার্থক উদাহরণ হিসেবে স্যার ওয়াল্টার স্কটের ‘Waverly Novels’ এর প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট সময়ের প্রেক্ষাপটে লেখা কোনও কাহিনি নয়, বরং সেই সময়ের বুকে গজিয়ে ওঠা অসংখ্য ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র চরিত্রের অংশীদারিত্বকে যাপন করার একটা মাধ্যম। তাঁর তত্ত্ব অনুযায়ী, ঐতিহাসিক উপন্যাসের কাজ শুধুমাত্র ইতিহাসের ঘটনার পুনর্নির্মাণ নয়, বরং সেই ঘটনায় যারা অংশ নিয়েছিল তাঁদের জাগরণের কাব্যিক উপস্থাপনা, যাতে আমরা সেই ঘটনাগুলোকে পুনরায় প্রত্যক্ষ করতে পারি এবং সেই চরিত্রগুলোর মননে পৌঁছে এটা নিরীক্ষণ করতে পারি যে কেন তাঁরা এই ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে নিজেদের অস্তিত্বকে জুড়ে দিয়েছিলেন। মার্ডার অ্যাট দ্য মুশায়ারা-র পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে এই ধরনের বহু মানুষের আলো-ছায়ার মতো উপস্থিতি, যার মধ্যে কিছু চরিত্র ঐতিহাসিক, কিছু আবার কল্পনাপ্রসূত। মীর নিজেই তার একটি হিসেব দিয়েছেন বইয়ের শেষে। ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কীভাবে এক একটা চরিত্র সমসাময়িক বৃহত্তর রাজনৈতিক বৃত্তের অংশ হয়ে উঠতে পারে, এই উপন্যাস তারই সাক্ষ্য বহন করে। কাহিনি শুরুর আগে অনেকটা নাট্যকারের ভঙ্গিতে মীর প্রত্যেকটি চরিত্রের একটি তালিকা তৈরি করেছেন। যেখানে ভারতীয়দের পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছে কয়েকটি মুখ্য ইংরেজ চরিত্র। সেইসঙ্গে মীর আরও জুড়ে দিয়েছেন কাহিনির মূল পর্বের ঘটনাস্থলগুলোর রেখাচিত্র যা পাঠকের কাছে এই লেখনীকে আরও জীবন্ত করে তোলে। রহস্য উন্মোচনের নিজস্ব ছন্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে থাকে নানান সম্পর্কের ভাঙাগড়া, পারস্পরিক রাগ-অভিমান-ক্রোধ ছাপিয়ে আবার বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয় প্রেমিক যুগল, খুব সাবলীন ভঙ্গিমায় উঁকি দিয়ে যায় শিক্ষক ও ছাত্রের সমকামী প্রেমের বাহ্যিক অভিব্যক্তি, অভাবের সংসারে হঠাৎ করে জ্বলে ওঠা উচ্ছ্বলতায় উৎফুল্ল ইচ্ছেবিলাসের গল্প, হার না মানা জেদ নিয়ে কোনও এক সিপাহির রক্তাক্ত অবস্থায় বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড পেরিয়ে আন্দোলন সংঘটিত করার মরণপণ অঙ্গীকার, ইত্যাদি। সংলাপেও ফুটে উঠে তারই প্রকাশ, যা বারবার ফিরে ফিরে আসে—

‘শতসহস্র উপহারের চেয়েও বেশি দামি কোন জিনিস?’
‘একটা হৃদয় যার কোনও দাবিদাওয়া নেই।’

Murder at the Mushaira
Raza Mir
Publisher: Aleph Book Company (Hardcover)
Year: 2021
Price: 799

এবার একটু উপন্যাসের সময়কালের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনায় আসা যাক। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সূর্য মধ্যগগনে। ভারতের মাটিতে রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি ধর্মীয় ক্ষেত্রে রূপান্তরকরণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই চালু হয়ে গিয়েছে। কাহিনিতে মাস্টার রামচন্দ্রের মতো একজন প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানী ও অধ্যাপকের খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করা তারই প্রামাণ্য বহন করে। তাঁর কথায়, ‘রেভারেন্ড জেনিংস আমাকে রূপান্তরিত করেননি। আমি স্বইচ্ছায় নিউটন, ডারউইন, প্রিস্টলি আর ডেকার্ট-এর ধর্মে রূপান্তরিত হয়েছি’। তিনি ইউরোপের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ও যুক্তিবাদী প্রগতিশীলতায় মোহিত হয়ে ছিলেন। খুনের তদন্ত করতে নেমে রামচন্দ্রের ক্ষুরধার বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি ও আধুনিক নানান কৌশলের প্রতি তাঁর দক্ষতা গালিবকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল। একইসঙ্গে এই কাহিনির একটি বিশেষ পর্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে রয়েছে ১৮৩৮-৪২ সালে সংঘটিত প্রথম ব্রিটিশ ও আফগানদের মধ্যে যুদ্ধ, যার প্রভাব খুনের রহস্যের সঙ্গেও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ইংরেজরা ভারতে আসার পর থেকেই তাঁদের আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে এবং এদেশের মানুষদের থেকে প্রশ্নাতীত আনুগত্য আদায়ের অভিপ্রায়ে সরাসরি দমননীতি প্রয়োগের পাশাপাশি নেটিভদের ব্যবহার করেই সমাজের প্রতিটা স্তরে চরবৃত্তির প্রচলন করেছিলেন। তাই সমাজের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে পড়া ভয় আর আতঙ্কের পরিবেশ এই উপন্যাসের অন্যতম সঙ্গী। এক ইংরেজ সৈন্যের রোষের মুখে পড়ার পর কিররিমালকে করা গালিবের উক্তিতে এই আশঙ্কার ছাপ স্পষ্ট, ‘আমরা যদি এখনও সতর্ক না হই, এই লোকগুলোই খুব তাড়াতাড়ি আমাদের শাসন করা শুরু করবে।’

মুঘল আমলের শেষ পর্যায়ে এসে রাজধানী দিল্লির চেহারা কীভাবে ক্রমশ বদলে যাচ্ছে, মীর খুব দক্ষতার সঙ্গে সেই চিত্র তুলে ধরেছেন— যেখানে হনুমান চল্লিশার সঙ্গে মিশে যায় বাইবেল পাঠের সুর, গুরুদ্বারের প্রার্থনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে থাকে রমজানের প্রস্তুতি। চরিত্রায়ণেও বিশেষভাবে ধরা পড়ে এই বৈচিত্র্য। নবাবপত্নী রোশন আরা বেগম হাভেলির জেনানা মহল দাপিয়ে বেড়ান। নৃত্যশিল্পী রত্নাবাইয়ের আস্তানা সবার অগোচরে মিশে যায় বিদ্রোহের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। গৃহকর্ত্রী উমরাও বেগম দক্ষ হাতে সামলান সংসার, গালিবের শৃঙ্খলাহীন জীবনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলে তাঁর দিনযাপন। চিত্রকর হিসেবে হাইদেরি জুতশির সুনাম সর্বত্র। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে তিনি মনে-প্রাণে ঘৃণা করেন। তাঁর স্বামী মোহনও সেই রোষের স্বীকার যা প্রভাব ফেলে তাঁদের সম্পর্কে। নবাবের কন্যা জনাব আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে স্বাধীনচেতা এক ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। প্রতিটি চরিত্রই অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে নিজেদের অস্তিত্বের পরিচয় দিয়েছেন গোটা কাহিনি জুড়ে। কবি হিসেবে গালিবের প্রতিপত্তির পাশাপাশি এখানে তিনি একজন আদ্যোপান্ত সাংসারিক মানুষ হিসেবে ধরা দেন। তাঁর চরিত্রের রূপায়ণে লেখক যে বিশেষ যত্ন নিয়েছেন, তা বলাই বাহুল্য। নবাবের মেয়েকে কবিতা লেখার পাঠ দিতে তিনি নিয়মিত হাভেলিতে যান। তাঁর সঙ্গে নবাবপত্নীর সম্পর্ক নিয়ে স্ত্রী উমরাও তাঁর প্রতি তির্যক মন্তব্য করেন। তাঁদের নাতি নাতনি বাড়িতে এলে মুহূর্তে বদলে যায় গোটা পরিবারের চেহারা, উৎফুল্লতার কলরোল খেলে যায় সারা বাড়ি জুড়ে। আনমনা গালিব দোকান থেকে কোনও জিনিস আনতে ভুলে গেলে তাঁকে আবার ফেরত পাঠানো হয়। এসবের মাঝে তিনি খুনের রহস্য সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ঘুরে বেড়াচ্ছেন নগরীর পাকস্থলীর ভেতর, তাঁর যুক্তিবাদী মননকে সঙ্গী করে। কবি হিসেবেও তাঁর সমাদর তখন তুঙ্গে। আবার এই রহস্যের জট ছাড়াতে গিয়েই তিনি জড়িয়ে পড়েছেন গালিব মহাবিদ্রোহের সুবৃহৎ পরিসরে, হঠাৎই। তাই অসুস্থ ভাইয়ের মাথা কোলে নিয়ে তাঁর মগজে ঘুরতে থাকে মুশায়ারার কথা, যেখানে তাঁকে যেতেই হবে, তাঁর উপরে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভার। তাঁর এখন অনেক সাহসের দরকার। অনুরূপ আর একটি সঙ্কট মুহূর্তের প্রেক্ষিতে কাহিনিকার গালিবের মনের অন্দরে লুকিয়ে থাকা দ্বন্দ্বের সন্ধান করতেও ভোলেননি, ‘কিন্তু ভেতরে ভেতরে মির্জা আসলে একজন ভীতু মানুষ। সে নিজে সেটা জানে এবং তা স্বীকার করতেও রাজি। …. কবিতায় তার প্রতিস্পর্ধী সত্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ঠিকই, কিন্তু এই জগৎটা তার চেনা, আসল জীবনে তিনি বিপদ থেকে দূরে থাকতেই পছন্দ করেন।’ অর্থাৎ, গালিব এখানে কোনও অতিমানব নয়, বরং সাফল্য-ব্যর্থতার নাগপাশে জড়িয়ে থাকা একজন সাধারণ মানুষ। বাকি চরিত্রদের মতো সেও খুঁজে চলেছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাত থেকে মুক্তির পথ, নিজের জীবনকে বাজি রেখে। তাই যখন দিল্লি পুড়ে ছাই হয়ে যায়, বিদ্রোহের দাবালন স্তিমিত হয়ে আসে, অসম লড়াইয়ের অনিবার্য পরিণতি গ্রাস করে গোটা শহরকে, মাটিতে মিশে যায় স্বাধীনতার কঙ্কাল, প্রেম-অপ্রেমের স্বপ্ন— তখন গালিবের কলমেও নেমে আসে সময়ের অন্ধকার—

চৌক জিস কো কহেঁ ওয় মকতল হে
ঘর বনা হে নমুনা জিন্দান কা
ইস তরাহ কে ভিসাল সে গালিব
কেয়া মিটে দিল সে দাগ হিজরান কা

এই উপন্যাস নিয়ে কথা বলতে গেলে যে বিষয়ের উল্লেখ না করলেই নয়, সেটি হল উর্দু কবিতার সঙ্গে এই কাহিনির সম্পৃক্ততা। লেখক রাজা মীর উর্দু কবিতার একজন বিদগ্ধ সমালোচক ও অনুবাদক। এছাড়া মির্জা গালিবের জীবনী ও তাঁর কবিতার অনুবাদ সম্বলিত তাঁর একটি বই Ghalib: A Thousand Desires ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে ২০১৯ সালে। অর্থাৎ, বলা বাহুল্য যে এই উপন্যাসেও তাঁর গালিবপ্রীতির নিদর্শন ভীষণভাবে উপলব্ধ হয়। প্রতিটা অধ্যায় শুরু হয় গালিবের কবিতার পংক্তি ও সেটির একটি অনুবাদ দিয়ে। কবিতা চয়ন ও অনুবাদের প্রত্যেকটিই উপভোগ্য এবং যথাযথ, যা কাহিনির বর্ণনায় আনে এক অন্য স্বাদ। অনেকটা নাটকের কোরাসের মতো এই পংক্তিগুলোর অন্তর্ভুক্তিকরণ কাহিনির ঘটনাপ্রবাহের উপর লেখকের প্রতিফলনকে আরও স্পষ্ট করে। একইসঙ্গে পাঠকদের মনেও ফেলে যায় এক দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব।

সবশেষে, একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে রাজা মীরের এই উপন্যাস সর্বতোভাবেই একটি অভূতপূর্ব সৃষ্টি। এই অভিজ্ঞতাকে যাপন করার মধ্যে দিয়ে পাঠক নিঃশব্দে হেঁটে যেতে পারে ভারতবর্ষের ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ের সাক্ষী এক যুদ্ধবিধ্বস্ত নগরীর বুকের উপর দিয়ে। বইটির নির্মাণও অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে সম্পন্ন করেছেন প্রকাশক, যা নিঃসন্দেহে সংগ্রহযোগ্য।


*এই লেখায় ব্যবহৃত সমস্ত অনুবাদ লেখকের নিজস্ব

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...