স্থবির দাশগুপ্ত
প্রাবন্ধিক, ক্যান্সার-বিশেষজ্ঞ
বহু কথা বলা হয়ে গেছে, স্বাস্থ্য আর স্বাস্থ্যব্যবস্থা, জনস্বাস্থ্য আর স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে। দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর থেকে, বা বলা উচিত তার কিছুকাল আগে থেকেই, আজ অবধি এসকল বিষয় নিয়ে অনবরত কথা হয়েছে। কথা বলার কারণও ছিল, আজও আছে, আগের চেয়ে হয়তো বেশি পরিমাণেই। সেসকল কথায় যুক্তি থাকে, জবরদস্ত তথ্য, অঙ্গুলিনির্দেশও থাকে। কোনও কথা সরকার মানে, কখনও শুধু কথার ভগ্নাংশ মানে, আবার কখনও সে বধির। তাই কথকতার ফাঁকে ফাঁকে থাকে দাবি, হুমকি, বিদ্রোহের ডাক, ভ্রূকুটি, বিদ্রুপ, মিনতি আর পরিতাপের সমারোহ… সবই আমরা লক্ষ করেছি।
কিন্তু তাতে হলটা কী? গেল শতকের পঞ্চাশ আর ষাটের দশকে আমরা শুধু অপেক্ষা করেছি আর ভেবেছি, জনস্বাস্থ্যের ঊষর জমিতে দেশের নতুন শাসকরা হয়তো জলসিঞ্চন করবে। শাসকরা যে একেবারে নিষ্ক্রিয় ছিল তাও বলা যায় না, তবে যতটা আশা ছিল তার তুলনায় পাওয়ার পরিমাণ যে অকিঞ্চিৎ ছিল সেকথা বলা যায়। কারণ, শাসক গোষ্ঠীতে যারা বিত্তে আর কূটবুদ্ধিতে বলীয়ান তাদের অনেক দায়; তাদের কাছে জনস্বাস্থ্যের দিকে মনোযোগ দেওয়ার চেয়ে রাজনৈতিক আর কূটনৈতিক পেঁজোমি অনেক বেশি আকর্ষণীয় ছিল। বাকি যারা তাদের চেষ্টায় আন্তরিকতা কতটা ছিল বলা মুশকিল, তবে তা যে গতিশীল আর প্রাণবন্ত ছিল না তা ঠিক। এই অন্যমনস্কতার পরিণাম ঘটল সত্তরের দশকে; স্বাধীনতার প্রাক্কালে গড়ে ওঠা মধুর স্বপ্ন যেন কখন কোন হাওয়ার তোড়ে কোথায় বেপাত্তা হয়ে গেল, আমরা খেয়াল করিনি।
একটা তুলনা টানা যায়। যেমন, ক্রিকেট। এই খেলাটি ‘ভদ্রলোকের খেলা’ বলে পরিচিত ছিল; খেলোয়াড়দের আদ্যন্ত সাদা পোশাক একটা পবিত্রতার গন্ধ ছড়িয়ে দিত। খেলার গতির সঙ্গে নিয়মকানুনের একরকম ভারসাম্য ছিল। হঠাৎ এক অস্ট্রেলীয় ধনকুবের জানাল, ‘এভাবে ঠিক হয় না।’ কীভাবে হয় বুঝতে গিয়ে দেখলাম, সাদা পোশাকের জায়গা দখল করেছে নানান রং, সেই রং ছড়িয়ে পড়েছে মাঠের সর্বত্র, এসেছে জানা-অজানা, চেনা-অচেনা ‘স্পনসর’, চলছে ‘কেনারাম বেচারাম’। ক্রিকেট তখন পক্ষীরাজ ঘোড়া, ‘টি২০’ উড়িয়ে দিল ধৈর্যের অপচয়; এল তাৎক্ষণিক জয়-পরাজয়ের চমৎকার, আর তার সঙ্গে বিপুল অর্থের ঝনৎকার। খেলা হয়ে গেল যুদ্ধ, খেলার আনন্দ পরিণত হল বজ্রমুষ্ঠির উল্লাসে। সে ‘বীভৎস মজা’! আমরা মজে গেলাম। আসলে খেলা চলে গেল ক্রীড়ামোদীদের হাত থেকে কর্পোরেটদের হাতে। সে ছিল সত্তরের দশকের শেষের দিকের ঘটনা। আমরা সেই মর্ম বুঝিনি। একটুখানি ভালোবাসার ভঙ্গি ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল চমক আর ছল; আমরা তার নাম দিয়েছিলাম, রৌদ্রকরোজ্জ্বল!
আজ জনস্বাস্থ্যের বেসামাল অবস্থা নিয়ে বারবার নব্বুইয়ের দশকের উদারনীতিকরণ আর বিশ্বায়নের অভিঘাতের বর্ণনা শুনতে পাই। তা মিথ্যে না, কিন্তু কখনও কি ভেবেছি, পুঁজি উসখুস করতে করতে তার অন্তত এক দশক আগে থেকেই ভোল পালটাচ্ছিল! বিশ্বায়ন ইত্যাদি তো সেই রিহার্সালের যুক্তিগ্রাহ্য পরিণতি। ডাক্তারি শিক্ষার প্রকরণগুলোতেও পরিবর্তন এসেছে তখন থেকেই। দৃষ্টিভঙ্গিও ক্রমশ পালটে গেছে। ‘মেডিসিন সামটাইমস কিওরস, অফ্ন রিলীভস, বাট অলওয়েস কনসোলস’, এই ভাবধারা ক্রমশ উবে গেল। এল তাৎক্ষণিক ফল পাওয়ার নেশা, এল নতুন নতুন প্রযুক্তির ঢেউ, তার সঙ্গে মুদ্রামূর্ছনা। আমরা ভাবলাম, ‘ইল’ যদি থাকে তবে তার কোনও না-কোনও ‘পিল’ তো থাকবেই। আর সেটার নাগাল পেলেই কেল্লা ফতে, ডাক্তারিও সার্থক। ডাক্তারি হয়ে গেল রোগ সারানোর মন্ত্রগুপ্তি, আর কিছু না। সেই ‘পিল’-এর নাগাল পেতেই বিচিত্র গবেষণার সমারোহ… সাগরের গভীরেই তো অমৃতকুম্ভ।
প্রযুক্তি অতি দরকারি বস্তু, গবেষণা তো বটেই। মানুষ তো চিরটাকাল গবেষণাই করেছে। কিন্তু তা কীজন্যে? রোগ সারানোর অভিলাষে, সুস্বাস্থ্যের খোঁজে, অস্বাস্থ্যের মুণ্ডচ্ছেদ করতে? তাহলে স্বাস্থ্য বলতে ঠিক কী বোঝায়? কীভাবে তাকে চিনব, তার কি কোনও সংজ্ঞা আছে? আমরা আজও জানি না, কোনওদিন জানতামও না; সে শুধু ছিল আমাদের অনুভবে। যে-সংজ্ঞা আমরা খুঁজে বেড়াই তা আজও আছে শুধু আমাদের বোধের মধ্যে। এই অনুভব নিয়েই আমরা হাজার বছর কাটিয়ে দিয়েছি, তাতে যাপনে আর উদযাপনে বিঘ্ন ঘটেনি। যাপনের যন্ত্রণা ছিল, খুবই ছিল, তবে তা ছিল জীবনেরই অঙ্গ। তাতে বিরক্তি, অসহায়তা, ক্ষোভ ছিল, তাই অপূর্ণতাও ছিল। বহুতর স্বাচ্ছন্দ্যের খোঁজে আমরা কত কীই না করেছি, করেই চলেছি। তাই নতুন নতুন গবেষণারও দরকার ছিল। জীবন নিয়ে, স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পালটে গেছে; কিন্তু তাই বলে সেই কর্মকাণ্ডে শুধু কালিমার দিকগুলো দেখলেই চলে না, উজ্জ্বল দিকগুলো কম না।
একথা তো ঠিক যে, সদ্যোজাতদের মৃত্যুর হার ক্রমশ কমে গেছে, অন্তঃসত্ত্বাদের মৃত্যুর হারও। চিকিৎসা যে আগের চেয়ে অনেক পরিশীলিত হয়েছে তা অস্বীকার করার সাধ্য কার? ডাক্তারের সংখ্যা বেড়েছে, হাসপাতালের সংখ্যাও। রোগের ধর্ম আর আচরণ নিয়ে আমাদের জ্ঞানও বেড়েছে। আশি আর নব্বুইয়ের দশক জুড়ে জানলাম, স্বাস্থ্যের সংজ্ঞা জানা চাইই। শুধু অনুভবে থাকলে চলবে না, নতুন প্রযুক্তি আর গবেষণা দিয়ে স্বাস্থ্য আর অস্বাস্থ্যের উপকরণগুলো বাছাই করা চাই, তারপর সেগুলোকে অঙ্কের ভাষায় বোঝা চাই। বুঝলাম, স্বাস্থ্য আর অস্বাস্থ্যের উপকরণগুলো বাছাই করতে শিখলাম, রাশি রাশি তথ্যের জোগানদারিও শিখে ফেললাম। পণ্ডিতরা আমাদের জানালেন, একে বলে উন্নত, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান; এতকাল আমরা স্বাস্থ্যহীন ছিলাম, এবার থেকে অস্বাস্থ্যের ঘৃণ্য উপাদানগুলোকে একে একে বর্জন করে, নির্মূল করে, আমরা ক্রমাগত স্বাস্থ্যবান হতে থাকব।
মনে পড়ল, ‘কমরেড, আজ নবযুগ আনবে না?’ কলহসর্বস্ব অতিবোদ্ধা থেকে শুরু করে আধা-পণ্ডিতদের দল জানাল, বটেই তো। শুরু হল, নতুন স্বাস্থ্যচেতনার জয়যাত্রা। … অথচ স্বাস্থ্যের সংজ্ঞা এল না। কারণ, প্রেমের কি কোনও সংজ্ঞা হয়? অনুরাগের? স্নেহের? এ সবই তো শুধু উপলব্ধি মাত্র। একই সঙ্গে এল অন্য এক উপলব্ধি, এতসব কর্মকাণ্ডে স্বাস্থ্য পরিষেবা যে আগের চেয়ে অনেক বেশি ব্যয়সাধ্য হয়ে গেল, তার কী হবে? স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়বরাদ্দ যে কমতে কমতে কণিকামাত্র হয়ে গেল, তার কী হবে? তাতে জনস্বাস্থ্য যে চকচকে ঝকঝকে রাস্তার ধারে ভিখিরির মতো দাঁড়িয়ে রইল, তার বেলা? ক্রমশ আমরা বুঝলাম, আসলে এই আধুনিকতা জনস্বাস্থ্য নিয়ে পীড়িত না। এই আধুনিকতার কলধ্বনিতে কারও কারও স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে বটে, আভরণও জুটেছে প্রচুর, কিন্তু স্বস্তি আসেনি। বরং স্বাস্থ্যবৈষম্য বেড়েছে। অথচ আমরা শুধু চেয়েছিলাম স্বস্তি, স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা।
নিরাপত্তা আমাদের জোটে না, কেননা জনস্বাস্থ্যের বনিয়াদগুলো মজবুত করার উপায় আমাদের শাসক খোঁজে না, সেই ইচ্ছাও নেই। সমস্ত জনমানুষের জন্য তিনবেলা আহার, মাথার উপরে ছাদ, পরিস্রুত পানীয় জল, শৌচাগার, আর মহিলাদের হাতে আর্থিক ক্ষমতা। এই তো জনস্বাস্থ্যের বনিয়াদ; স্বাস্থ্য নিয়ে বাদবাকি সবই তো ইমারতের অংশ। সেই বনিয়াদ অতি দুর্বল, তাই জনস্বাস্থ্যও। তাই স্বাস্থ্য নিয়ে যেমন স্বস্তি আর নিরাপত্তা নেই, তেমনি স্বাস্থ্যরক্ষার স্বাধীনতাও নেই। নতুন শতকের শুরু থেকেই দেখলাম, স্বাস্থ্য পরিষেবার যাবতীয় দায় আর দায়িত্ব দ্রুত গতিতে বিলি হয়ে যাচ্ছে নিকৃষ্ট-উৎকৃষ্ট কর্পোরেটদের হাতে। এ-দুর্ঘটনা সব দেশেই, এমনকী আমাদের ‘শিক্ষিত’, সুভদ্র মানুষের স্বপ্নরাজ্য, আমেরিকাতেও। তাই প্রথিতযশা আমেরিকান ডাক্তার প্রশ্ন তোলেন, আধুনিক ডাক্তারি কোন পথে? বই লেখেন, যার শিরোনাম হল, ‘দি লাস্ট ওয়েল পার্সন’! আর উপশিরোনামে লেখেন, এই উন্নত স্বাস্থ্য পরিষেবা সত্ত্বেও কীভাবে সুস্থ থাকা যায়!
এখন, এই কোভিডকালেও জনস্বাস্থ্য নিয়ে মহারব চলছে; কিন্তু খেয়াল করলে বোঝা যায়, মাইকটা শ্রেষ্ঠীদের হাতে। এতকালের আন্দোলনকারীরা আজও শতচ্ছিন্ন বস্ত্রে ঢাকা সরকারের ছিদ্র অনুসন্ধানে উদয়াস্ত ব্যস্ত অথবা বিস্ময়বোধক চিহ্ন হয়ে পথ পরিক্রমায় ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। শ্রেষ্ঠী আমাদের মাথায় গাঁট্টা মেরে বুঝিতে দিল, স্বাস্থ্য একটি অতি লোভনীয়, উৎপাদনশীল ব্যবস্থা, চিকিৎসাবিজ্ঞানও। তাই স্বাস্থ্যবিধি, বিধিনিষেধ আর পরিসংখ্যান অনবরত উৎপাদিত হচ্ছে, ব্যাধি আর নির্ব্যাধির সংজ্ঞা কর্পোরেটের দরকারমতো ক্রমাগত পালটে যাচ্ছে। এইভাবে রচিত হচ্ছে ব্যাধির নতুন, সামাজিক তত্ত্ব; তার হাত ধরে আছে জিনতত্ত্ব। এই দুই তত্ত্বই রোগের কারণ, তার মতিগতি এবং তা থেকে কীভাবে মুক্তি মিলবে তার পথ অনুসন্ধান করে। অনুসন্ধানকাণ্ড নিরীহ, সন্ত্রস্ত মানুষের প্রিয়, তাই তাঁরা আশান্বিত; স্বাস্থ্যবিজ্ঞানী এবং স্বাস্থ্যকাতর মানুষজনও যথেষ্টই অনুপ্রাণিত। কিন্তু এইভাবে কি জনস্বাস্থ্যের মর্মে পৌঁছনো যায়? এ কীসের অনুসন্ধান, স্বাস্থ্যের না আতঙ্কবিলাসের?
আশির দশক থেকে আজ অবধি নতুন, কর্পোরেট বিজ্ঞান আমাদের মনোভূমিতে শুধু যুদ্ধের প্রেরণা ছড়িয়ে গেছে। আমাদের অপছন্দের সবকিছুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ। কোভিডকালেও আমরা যুদ্ধে রত, যতক্ষণ পূর্ণ বিজয় না-ঘটছে। তাই আমরা যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতিগুলোকে সামরিক ভাষায় বলি, ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’! অথচ আমরা একটা বুনিয়াদি কথা ভুলে যাই যে, যুদ্ধের প্রেরণা দেওয়া বিজ্ঞানের কাজ না। যুদ্ধের উন্মাদনায় আমরা ইতিহাসও ভুলে যাই। সম্রাট অশোক যুদ্ধে জিতেছিলেন ঠিকই; কিন্তু বিপর্যস্ত মানুষজন আর রক্তস্নাত জলভূমি দেখে তাঁর মনে আহ্লাদ জাগেনি। কুরুক্ষেত্রে বিজয়ী হয়ে পাণ্ডবরাও উৎসবে মাততে পারেনি। আজকের ‘কোভিডযুদ্ধে’ যে-কোল্যাটারাল ড্যামেজ ঘটে যাচ্ছে তাও সুস্থ মানসিকতায় অসহনীয়। ডাক্তারি পত্রিকাগুলোও নীরব থাকতে পারছে না। যুদ্ধের কোপ পড়েছে দরিদ্র মানুষজনের ঘাড়ে, সব দেশেই। যুদ্ধের খরচখরচার দায় পড়েছে তাদেরই মাথায়। ‘শারীরিক দূরত্ব’ আসলে ধনী-দরিদ্রের ‘সামাজিক দূরত্বই’ আরও বাড়িয়ে দিল।
আমাদের দেশের গণ্যমান্য বোদ্ধার দল এই সহজ সত্যি কথাটা ভুলে গেলেন যে, মহামারি এর পর থমকে থাকবে না, অন্যান্য ব্যাধিগুলোও তাদের আচরণ পালটে ফেলবে না। আমরা কিন্তু তাদের সামনে অসহায় হয়েই দাঁড়িয়ে থাকব, কেননা যুদ্ধের ভাবঘোরে আমরা আমাদের স্বাস্থ্যরক্ষার যাবতীয় সাজসরঞ্জাম কোভিড-এর খাতে ব্যয় করে ফেলেছি। সেই বোধ যখন উঁকি মারবে ততদিনে অন্তত চল্লিশ কোটি মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে নেমে যাবে। গেল শতকে চিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমাদের সামরিক অপদার্থতা প্রমাণিত হয়েছিল। আজকে সেই চিন থেকেই ধেয়ে আসা ভাইরাস আবার আমাদের স্বাস্থ্য পরিষেবার অপদার্থতা প্রমাণ করে দিল। আজও আমরা কার্ফিউ জারি করে জনজীবন স্তব্ধ, নিথর করে রাখি; এমন কার্ফিউ যা চিন বা পাকিস্তান যুদ্ধেও দরকার পড়েনি। অদ্ভুত আমাদের বোধবুদ্ধির দৌড়— বলছি স্বাস্থ্যের সঙ্কট, আর বন্ধ রেখেছি ডাক্তারি শিক্ষা; কোনও শিক্ষাই এখন আর অপরিহার্য না।
তাহলে জনস্বাস্থ্যের আঙিনায় কর্পোরেট যে-নতুন হাওয়া নিয়ে এল তা আসলে বদ হাওয়া। এই হাওয়ার স্বস্তির নিশ্বাস অসম্ভব, এ শুধু আতঙ্ককে চিরস্থায়ী করে রাখে। ‘চিকিৎসা সঙ্কট’-এ পরশুরামের ‘নন্দ’ চরিত্র বেকায়দায় পড়েছিলেন, বলা যায়, মহাসঙ্কট। ট্রাম থেকে পদস্খলন হওয়ার পর থেকে ‘মিস বিপুলা মল্লিক’-এর সাক্ষাৎপ্রাপ্তি পর্যন্ত সেই সঙ্কটের নিরসন হয়নি। ‘নন্দ’কে পরীক্ষা করে ‘ডাক্তার তফাদার’ বলেছিলেন, ‘ভেরি ব্যাড’, ‘ওয়াচ’ করতে হবে। এখন সর্দি হলে শিরস্ত্রাণশোভিত ডাক্তার বাচস্পতি বলেন, ‘ভেরি অ্যালার্মিং, কোভিড চলছে তো!’ ‘তফাদার’ ভেবেছিলেন, ‘সেরিব্রাল টিউমার উইথ স্ট্র্যাংগুলেটেড গ্যাংলিয়া’; আর বাচস্পতি ভাবেন, ‘ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট’ উইথ ‘লং কোভিড’। ‘তারিণী’ কবিরাজ অনুপান নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন; আমরা ভাবছি, থার্ড ডোজ ভ্যাক্সিন না-পড়লে বুঝি নিস্তার নেই। ‘নন্দ’বাবুর সেই মানসিক মহাসঙ্কটের পর একশো বছর কেটে গেছে; অথচ আমাদের জনস্বাস্থ্যের তিমিরদশা কাটে না। এখন আমাদের আশপাশে যে কোনও ‘মিস বিপুলা’ও নেই।
জনমানুষ নিরুপায়। জনস্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের স্বাধীন ভারতে আন্দোলনের বয়স অনেক হল, এখন প্রায় বৃদ্ধ। বয়সের সঙ্গে প্রজ্ঞারও আসার কথা ছিল, আসেনি; বয়স একলাই এসেছে। তাই আমরা যথাসময়ে বুঝতে পারিনি যে, আধুনিকতা মানে আসলে পরিমিতিবোধ। অসীম ক্ষমতায় বলীয়ান হওয়া না, অসীম ভ্রান্তি থেকে মুক্তির নামই আধুনিকতা। ইদানিং টিকা-চঞ্চলতায় আমরা এসব ভুলতে বসেছি। আমরা ভুলে যাচ্ছি যে, ডাক্তারি-বিজ্ঞান আমাদের জীবনের যাপনপথটাকে মসৃণ করতে চায়, দেহপ্রকৃতির অপরিবর্তনীয় সূত্রগুলোকে মেনেই আরও আধুনিক হয়। কিন্তু আজকের কর্পোরেট-লালিত বিজ্ঞান ভাবে যে, সে প্রবল শক্তি আর প্রবলতর বুদ্ধি দিয়ে দেহপ্রকৃতির খোলনলচে পালটে দেবে। অমন চিন্তাভাবনা আসলে সভ্যতারই সঙ্কট। সব সভ্যতারই স্বাভাবিক নিয়তি হল, উত্থান এবং পতন, আর শেষপর্যন্ত ধূলিসাৎ হয়ে যাওয়া। এযাবতকালের সভ্যতা এখন চূড়ান্ত পতনের মুখে, আমরা এক নতুন সভ্যতার দ্বারপ্রান্তে। আমরা কি তা নিয়ে পরিতাপ করব?
পরিতাপের কিছু থাকত না, যদি তাতে জনমানুষের কল্যাণ হত। তেমন কোনও সুলক্ষণ নেই। কারণ, বিজ্ঞান তো আসলে বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ। আর বুদ্ধিমত্তা মানুষকে অকারণে, ঘন ঘন সক্রিয় হতে শেখায় না, বরং চিন্তাশীল পদক্ষেপ নিতে শেখায়। কিন্তু আজকের নতুন, কর্পোরেট ভাবনা একেবারে আলাদা। তার নতুন ব্যবস্থায় আছে রোগ-ব্যাধি একেবারে নির্মূল করার বজ্রকঠিন আহ্বান। সে অনন্যোপায়, তাই এই মিথ্যাকে সে লালন করে, কেননা তাকে আরও বহুকাল বেঁচে থাকতে হবে। তাই আমাদেরই বুঝে নিতে হবে যে, তার অনৃতভাষণের যুক্তিগুলো মেনে নিলে পরিসংখ্যানের হিসেবমতো আমরা হয়তো নির্বোধ, জড় পদার্থের মতো আরও কিছুদিন ধরিত্রীর আশ্রয়ে থেকে যাব, তার পর মারাই যাব। সেই মৃত্যু হয়তো ঘটবে অন্য কোনও অজানা রোগে, চিকিৎসা-ঘটিত রোগে, আরও ধীরে, অনেক বেশি অর্থদণ্ড দিয়ে। এই দৃশ্য ভয়ঙ্কর।
এই শিশুমৃত্যু, অনাহার, কর্মহীনতা আর পৈশাচিক ধ্বংসকাণ্ড দেখেও আমাদের বিদগ্ধ বোদ্ধারা নিশ্চুপ থাকতে পারেন, কিন্তু আমরা ভাবতে বাধ্য। কারণ, আমাদের হাতে প্রায় কিছুই আর নেই, শুধু বারবার ভেবে দেখবার ক্ষমতাটুকু ছাড়া। জনস্বাস্থ্য এখন নষ্ট চরিত্রের অধিকারে। তাই মনে পড়ে, ‘আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে … রাহুগ্রস্ত সভ্যতার অবশিষ্ট সামান্য আলোক/আমি জানি তারা সব নষ্টদের অধিকারে যাবে’।
এক কথায় অনবদ্য।।