অর্ক ভাদুড়ি
সাংবাদিক, গদ্যকার, বাম রাজনীতিতে উৎসাহী
১৯৪৭ সালের ১১ আগস্ট সকালে উত্তরবঙ্গের নাটোরে একটি ওষুধের দোকানের সামনে শহীদ ক্ষুদিরাম বসুর স্মরণে প্রভাতী অনুষ্ঠান হচ্ছিল। ওই দোকানটির মালিক ছিলেন আমার ঠাকুরদা। মধ্যবিত্ত মানুষ। ফরওয়ার্ড ব্লকের সমর্থক। বাড়িতে স্ত্রী আর দুটো কোলের বাচ্চা। এই প্রভাতী অনুষ্ঠানের কথা আমি বহুবার শুনেছি। প্রতিবছর ১১ আগস্ট আমাদের বাড়ি-সহ আশেপাশের বেশ কিছু পরিবারে অরন্ধন হত। তার আগে, ভোরবেলা হত প্রভাতী অনুষ্ঠান। সাতচল্লিশ সালের ওই অনুষ্ঠান গত সাত দশক ধরে বার বার আমাদের পারিবারিক স্মৃতিতে ঘুরেফিরে এসেছে। আগামীতেও আরও অনেক বছর হয়তো আসবে৷ ওই প্রভাতী অনুষ্ঠানটিই ছিল দেশের মাটিতে আমাদের শেষ কোনও ‘সামাজিক’ কর্মসূচি।
স্বাধীনতা দিবস নিয়ে কথা বলতে গেলেই আমি সাতচল্লিশ সালের আগস্ট মাসের ১১ থেকে ১৭ তারিখে আটকা পড়ে যাই। এই ৭টা দিন আরও অসংখ্য মানুষের মতো আমাকেও বুঝতে শিখিয়েছে, রিফিউজির কোনও স্বাধীনতা দিবস নেই। যে স্বাধীনতা নিয়ে এত আলোচনা, এত নিবন্ধ, এত সেমিনার, আমার কাছে তাকে ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে— দেশভাগ। আমাদের ভিটে থেকে উৎখাত করেছিল যে রাজনৈতিক ঘটনা, আমাদের ওষুধের দোকান জ্বালিয়ে দিয়েছিল যে রাজনৈতিক ভাগ-বাঁটোয়ারা, আমার ঠাকুমার শাড়ি খুলে নিয়েছিল যে উন্মত্ত উল্লাস, তাকে নিয়ে আমার কোনও ‘নিরপেক্ষ’ বিশ্লেষণ নেই। একজন তৃতীয় প্রজন্মের রিফিউজি হিসেবে আমি ‘স্বাধীনতা দিবসে’র মোচ্ছবকে প্রত্যাখ্যান করি৷ দেশভাগের যে ট্রমা প্রজন্মের পর প্রজন্ম আমাদের মতো অসংখ্য পরিবারকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে, সেই যন্ত্রণার সামনে সব কিছু মিথ্যে হয়ে যায়।
অনেকে বলার চেষ্টা করেন, প্রায় সাড়ে সাত দশক পরে আর এসবের তেমন গুরুত্ব নেই, রক্তপাত কমতে কমতে বন্ধ হয়ে এসেছে প্রায়। বিনয়ের সঙ্গে বলব, একবার মতুয়া এলাকায় যান, বাইপাসের দু ধারের যে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে একাত্তর-পরবর্তী রিফিউজিরা থাকেন, তাঁদের কাছে যান, নাগরিকত্ব নিয়ে কেন এত সংবেদনশীল তাঁরা, একটু কান পেতে শুনুন। বুঝতে পারবেন, এই রক্তপাত বন্ধ হয় না। শপিং মল, জাতীয় পতাকা এবং ফ্লাইওভারের নিচে চাপা পড়ে থাকে হয়তো, কিন্তু মরে না৷ কংক্রিটের বুক ফাটিয়ে যেমন জেগে ওঠে সবুজ বিদ্রোহ, তেমনই ভারত রাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবসের দেওয়াল ভিজিয়ে দেয় রিফিউজির রক্ত। আমার কাছে ‘স্বাধীনতা দিবস’ নিয়ে প্রায় সব আলোচনাই অর্থহীন, কারণ সে সব আমাদের উচ্ছেদ হওয়ার গল্পগুলো ভুলে যায়। আমার দুই জেঠু এবং বাবার গায়ের রং টকটকে ফর্সা। আমার ঠাকুরদা এবং ঠাকুমাও ছিলেন ফর্সা৷ কিন্তু এক জেঠুর গায়ের রং কালো। এই গল্প জানে কেবল দেশভাগ, জানে ১৫ আগস্ট, জানে তাড়া খেতে খেতে সীমান্তের দিকে ছুটতে থাকা আমার ঠাকুমা৷
১১ আগস্ট রাতে আমাদের ওষুধের দোকান জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ক্ষুদিরাম বসুর ছবি আছড়ে ভাঙা হয়। ১২ তারিখ সকালে আমাদের বাড়ি ভাঙচুর ও লুট হয়। ওই দিন রাতে আমরা স্থানীয় এক মুসলিম লিগ নেতার বাড়িতে গিয়ে উঠি৷ তিনি আমার ঠাকুরদার ছোটবেলার বন্ধু ছিলেন৷ ১৩ তারিখ রাতে তাঁর বাড়িতেও চড়াও হয় দাঙ্গাবাজরা। ওরা কোনও ধর্ম দেখেনি৷ ওই ভদ্রলোককে মারধর করে। বলে, আমাদের বের করে দিতে হবে। ১৪ তারিখ সকালে আমরা হাঁটতে শুরু করি৷ আমি শুনেছি আমার ঠাকুরদার হাতে ছিল টিনের বাক্স। সাদা ধুতি, বাংলা শার্ট, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো আঁচড়ানো চুল। ঠাকুমার কোলে দুটো বাচ্চা, গায়ে সাদা থান। আমাদের সঙ্গে হাঁটছিলেন আরও অনেক অনেক মানুষ৷ একই গ্রামের মানুষ, প্রতিবেশী। একসঙ্গে, বেঁধে বেঁধে হাঁটলে বিপদ কম।
আমরা জমিদার ছিলাম না। আমাদের বাগান ছিল না৷ আমাদের থাকার মধ্যে ছিল একটা ছোট বাড়ি, ওষুধের দোকান, একটা পুকুর। আমরা হাঁটছিলাম আর ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছিল চরণবিল। সরে যাচ্ছিল ছোট্ট নদী অশ্ব কুহকিনী। ভাস্করখিলার গা ছুঁয়ে বইছিল ফুলেশ্বরী। পূর্ববঙ্গের তিরিশ হাজার নদনদীর দুজন— অশ্ব কুহকিনী আর ফুলেশ্বরী— আমার ঠাকুমার দুই সখী— সরে যাচ্ছিল। প্রতিটি পদক্ষেপে ক্রমশ মরে যাচ্ছিল কয়েক শো বছরের ভিটে। আমরা স্মৃতি আর স্বপ্ন ফেলে রেখে হাঁটছিলাম।
সীমান্তের একটু আগে নেমে এসেছিল রাত। অসহায় মানুষের সামনে দানবের হাঁ-এর মতো রাত যেমন নামে, তেমন রাত। দূরে আগুন জ্বলছে। ছুটে আসছে উন্মাদ জনতা। আমার ঠাকুমার গায়ে সাদা থান। গয়না নেই গায়ে। এই আশ্চর্য রাতের অনেক রাত পরে, শিয়ালদহ স্টেশনের কাছে জন্ম নেবে একটি শিশু, যার গায়ের রং বাকি ভাইবোনদের মতো নয়।
এই জন্মবৃত্তান্ত বাদ দিয়ে অন্য কোনও স্বাধীনতা দিবসের কথা আমি জানি না।
প্রান্তিক মানুষ কেমন করে স্বাধীনতা দিবসকে দেখেন, তা আমি কী করে বলব, ধর্মাবতার? প্রান্তিক মানুষ কারা, কোথা থেকে শুরু হচ্ছে কে প্রান্তিক তা মাপার ফিতে, তাই তো জানার চেষ্টা করছি গত সাড়ে সাত দশক ধরে।
আপনাদের দেশে আমরা ১৫ আগস্ট ঢুকতেই পারিনি। ঠাকুমার কোমরের নিচ থেকে অবশ হয়ে ছিল। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। তাই চলতে হচ্ছিল থেমে থেমে। অবশেষে নদী পেরোনো গেল। অবশেষে ট্রেনের ছাদে বসে মাথা গোঁজার দেশ— ইন্ডিয়া। ১৮ আগস্ট, ১৯৪৭— আমরা নিজেদের দেশ ছেড়ে ইন্ডিয়ায় ঢুকে পড়লাম। তার পর থেকে এতদিন ভারত ইউনিয়নেই আছি। ভারতীয় ইউনিয়ন আমাদের খাইয়ে পরিয়ে রেখেছে। আমরা ট্যাক্স দিই, ভোট দিই, চাকরি করি। কিন্তু ভুলে যাই না, কখনও ভুলে যাই না, গত ৭৪ বছর ধরে, মাত্র ৭৪ বছর ধরে আমরা এই দেশে থাকি। এর আগে সাড়ে তিনশো বছর আমরা থাকতাম চরণবিলের আশপাশে। আমাদের সেখান থেকে উপড়ে ফেলেছিল ১৫ আগস্ট।
এসব নিয়ে বহু উপন্যাস লেখা হয়ে গিয়েছে, হাজার হাজার সিনেমা, নিবন্ধ, পিএইচডি হয়ে গিয়েছে। আমি নতুন কথা কিছু বলছি না। উচ্ছেদের গল্পে নতুনত্ব খুব কিছু থাকে কি আদৌ? সেই একইরকম বাড়ি জ্বালানো, একইরকম ধর্ষণ, একইরকম ভয় পাওয়া, ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে কেঁপে কেঁপে ওঠা। একইরকমভাবে পরের প্রজন্মকে সেই ভয়ের উত্তরাধিকার দিয়ে যাওয়া। এটা জেনেই যে, যাকে দিচ্ছি সে হয়তো মনে রাখবে না এই ক্ষতচিহ্নের কথা। হয়তো তাকে এই নতুন দেশ, তার সহস্র বিনোদন আর জটিলতায় বুঁদ করে দেবে। সে ভাবতে থাকবে এটাই আমার দেশ, আমার অন্য কোনও দেশ ছিল না কখনও… কিন্তু তবুও বলে যেতে হবে। ভুলে যাওয়ার বিরুদ্ধে মনে রাখার লড়াই। যেমন কুন্দেরা বলেছেন, ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের যুদ্ধের কথা, তেমন।
বিশেষ করে এই ১৫ অগস্টের সময়টায়, যখন ‘স্বাধীনতা’ নিয়ে কথা বলার জন্য লকলক করে বিশ্লেষকদের জিভ, তখন আরও বেশি করে, আরও হিংস্র, অমার্জিত, মরিয়াভাবে চিৎকার করে বলতে হবে, ‘শোন শুয়োরের বাচ্চারা, আমি এই স্বাধীনতা দিবসের মোচ্ছবকে মানি না… ১৫ আগস্ট বলতে আমি দেশভাগ বুঝি… কেবল দেশভাগই বুঝি… তাড়া খেতে খেতে তাড়া খেতে খেতে পালিয়ে আসার যৌথ স্মৃতিকে বুঝি… আর কিছু না..’
দানিশ সিদ্দিকির তোলা ছবিতে দেখছিলাম, একজন মানুষকে আরও অনেকগুলো লোক ঘিরে ধরেছে। উনি লুটিয়ে পড়েছেন মাটিতে, হাঁটু ভাঁজ করা, কনুই দুটো মাটিতে ঠেকানো। মনে হচ্ছিল, ঠিক এইভাবেই হয়তো ঈশ্বর, জাতীয় পতাকা বা ক্ষমতার সামনে মাথা নিচু করে মানুষ৷ ক্লান্ত, বিষণ্ণ এক প্রাণ, যাকে তার ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া গিয়েছে, সে হয়তো এমন করেই মাটির গন্ধ নিতে চায়। মনে হচ্ছিল, ১৯৪৭ সালের মধ্য আগস্টে আমার ঠাকুমাও হয়তো এমন করেই ক্ষমতার সামনে কুঁকড়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর নাকে ঝামড়ে পড়ছিল পূর্ববঙ্গের মাটির গন্ধ। কী আশ্চর্য কাব্যিক ব্যাপার, তাই না? একদিকে পূর্ব বাংলার মাটি বর্ষার আদরে আদরে ধুয়ে যাচ্ছে, মধ্যরাত, সোঁদা গন্ধ… অন্যদিকে এক সদ্যযুবতী…
দিল্লির দাঙ্গার সময় দেখেছিলাম, মুসলিম মহল্লার মেয়েরা, শিশুরা হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছেন। যেন প্রাণে না মারা হয়, ধর্ষণ না করা হয় যেন… দেখছিলাম, সমুদ্রতীরে একটি শিশু শুয়ে আছে… তার গায়ে লাল-নীল পোশাক… আয়লান… নাফ নদী পেরোতে গিয়ে টুপটাপ ঝরে যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের লাশ… বসনিয়ার জঙ্গলে শরণার্থীর দল… কাশ্মিরে একটি মেয়ের হাসি হাসি মুখ, দুষ্টুমি ঝিলমিলিয়ে উঠছে চোখে… আসিফা, মেয়ে আমার… আসানসোলে টুকরো টুকরো করে কাটা সিবঘাতুল্লার লাশ। তার বাবা, নুরানি মসজিদের ইমাম বলছেন, ”প্রতিশোধ নয়, আল্লাহ্ যতটুকু জীবন ওকে দিয়েছেন, ও ততদিনই বেঁচেছে…”
এদের সবার মাথার উপরে যে চাঁদ ওঠে, সেই চাঁদ উঠেছিল ১৪ আগস্টের রাতে… ১৫ আগস্টের রাতে… আমার ঠাকুমা শুয়েছিলেন সেই চাঁদের তলায়। মধ্যরাতে সমগ্র পৃথিবী ঘুমিয়ে ছিল না, পণ্ডিত নেহরু৷ আমরা জেগে ছিলাম। রিফিউজিরা জেগে ছিল। আমরা দেখেছিলাম পূর্ববাংলার বিস্তীর্ণ প্রান্তরে জন্ম নিচ্ছে স্বাধীনতা দিবস। তার গায়ে চাপ চাপ রক্তের দাগ।
একেবারে মনের ভেতর ঢুকে সব তছনছ করে দিল।আমি ঐ দিন ভুলতে চাই না।আমি ঐ দিন মনে রাখতে চাই না। হেঃ স্বাধীনতা!
দুর্দান্ত লেখা।