বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
পূর্ব প্রকাশিতের পর
The Duck and the Kangaroo
৩
সত্তর ফুট উঁচু মইয়ের উপর দাঁড়িয়ে দেখার পৃথিবীটা অন্যরকম। পৃথিবী মানে অ্যারিস্টেক কেমিক্যালসের ইথাইল হেক্সানল প্ল্যান্টের চত্বর। বিজুর চারপাশে লম্বা লম্বা স্টেনলেস স্টিলের গম্বুজ নিশ্চুপ বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে। যদিও এগুলোর বুকের ভিতরে বিষাক্ত রসায়নের ধূম্র ঘূর্ণি, বাইরে শুধুই তীক্ষ্ণ শব্দতরঙ্গ। কানের পর্দা না ফাটালেও এই শব্দে মশার বিনবিনানির মতো বিরক্তি জমতে থাকে। বিজু কানে ইয়ারমাস্ক লাগিয়ে আসতে ভুলে গেছিল, তাই ভোগান্তি। যে কোনও কেমিক্যাল প্ল্যান্টেই গন্ধের তীব্রতা থাকে। উঁচুতে সেই গন্ধে লাগে দখিনা বাতাস।
মই থেকে লাফ দিয়ে প্ল্যাটফর্মে পা রাখল। পায়ে ভারী ইন্ডাস্ট্রিয়াল শু, মাথায় হলদে হেলমেট। কোনও দিক থেকেই এই অবস্থান সুখকর নয়। কিন্তু কন্ট্রোল প্যানেলগুলো সবই উঁচুতে। না এসে উপায় নেই। টিপটিপ করে জ্বলা অসংখ্য এলইডি খচিত প্যানেলের সামনে দাঁড়িয়ে উচ্চতার শিহরন হল বিজুর। এমন নয় যে আজই প্রথম এত উঁচুতে উঠেছে। প্রসেস কন্ট্রোলে ডক্টরেট করার সময় থেকে নিয়ে এমন সব জায়গায় উঠে কাজ করেছে অনেক। আজকের অভিজ্ঞতা তবুও নতুন। নিচে চলে ফিরে বেড়ানো প্ল্যান্টের অন্য কর্মীদের থেকে সে আলাদা। ওরাও তারই মতো জিন্স পরনে, পায়ে ভারী বুট, মাথায় হলদে শক্ত হ্যাট। কিন্তু এইখানে সে একমাত্র মেয়ে। একমাত্র এশিয়ান-আমেরিকান। কয়েকশো একর জুড়ে ছড়ানো এই প্ল্যান্টের সেই চিফ কন্ট্রোল ইঞ্জিনিয়ার। প্ল্যান্টের এই নতুন শাখাটা চালু করার দায়িত্বে। শিখর এটা নয়, কিন্তু যেখানে পৌঁছানোর বিশ্বাস পুঁজি করে যাত্রা শুরু করেছে তার একটা বেস ক্যাম্প তো বটেই।
এই উঁচুতে দাঁড়িয়ে মার কথা খুব মনে পড়ছিল। জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে ছায়ার মতো আগলে রাখা মা। মইয়ের প্রতিটা সিঁড়ি উত্তরণে সাহসের উৎসস্থল। অথচ তাকে নিজের মতো লড়তে দিয়েছে। পড়ে যাওয়ার উপক্রম না হলে হাত ধরতে আসেনি কখনও। মাও তো ইঞ্জিনিয়ার, কিন্তু নিজে পড়ানোর বাইরে বেরোতে পারেনি। সব সময়ে বিজুকে বুঝিয়েছে, আমি তো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েও লেক্টার্নের বাইরে পা বাড়াবার সাহস দেখাতে পারিনি, তোর যেন এমন না হয় বিজু!
মার গলায় পরাজয়ের গ্লানি চাপা থাকত না কোনওদিন। আমার সময়ে মেয়েরা ইঞ্জিনিয়ার হয়ে কন্সট্রাকশান সাইটে মিস্ত্রি মজুরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ভাবাও যেত না রে।
–কেন মা, ছেলেদের কি দুটো শিং আছে আর আমাদের নেই?
–এই যে আমাদের বুকের দুটো! এই দুই পাহাড় পেরিয়ে মেয়েদের মগজ যেচে দেখার লোক কোথায়? তাই দ্যাখ না, এ দেশের প্রধানমন্ত্রী মেয়ে হতে পারে, ব্রিজ ইনঅগারেট করতে পারে। কিন্তু সেই ব্রিজ বানাতে মাথায় ভারা বয়ে নেওয়া কোনও জোগালির থেকে বড় পদে মেয়েদের নেওয়া যায় না। এটাই আমাদের দেশ!
মার ক্ষোভ কোনওদিন চাপা থাকেনি।
বিজু জানে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া মার জন্য সহজ ছিল না। অনেক বাধা পেরোতে হয়েছিল। এসব পড়ে কী লাভ মেয়েদের? তোর দাদুর এমনি বক্তব্য ছিল।
–দিদা কিছু বলল না মা?
–তোর দিদা তো আরেক জেনারেশান পিছনে, লড়াইয়ের ময়দানেই নামেনি কখনও। ভাগ্যিস তোর মামাদাদু ছিল!
–মামাদাদু অনেক বেশি মডার্ন, তাই না মা?
মা অন্যভাবে ভাবছিল। শোন বিজু, একটা কথা মনে রাখিস। আমি যে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছি তাতেও একজন পুরুষকে আমার পিছনে পেতে হয়েছে। মানে তোর মামাদাদু। কিন্তু তোর এগিয়ে যাওয়ার পিছনে কোনও পুরুষের আশীর্বাণী নেই বিজু।
মুখে না ভাসালেও মা বুকের কোনায় এই গর্বটাকে খেলতে দিত।
মার না হওয়া জীবনের স্বপ্ন শুধু তাকে ঘিরে। তাকে বারবার সাবধান করত, জীবনে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় নিজেকে হারিয়ে ফেলিস না বিজু। সমঝোতা আমি কি কম করেছি? কিন্তু কি লাভ হল?
এই কথাটা উঠলে বিজু একটু বিপদে পড়ে যেত। সে তো মেয়ে। মা আর বাবার মধ্যে কী হয়েছিল, কেন তাদের সম্পর্ক ভেঙে গেছিল, সেটা কি শুধুই মায়ের কাজের জন্য— সেসব জানার বয়েস তার তখনও হয়নি। শুধু কিছু ছেঁড়া ছেঁড়া ঝগড়ার মুহূর্ত মাথায় গেঁথে গেছে। তারপর মা তাকে নিয়ে একাই কীভাবে জীবন কাটিয়ে দিল সেটা দেখেছে। বাবার নতুন সংসার হয়েছে, দূরত্বের জন্য যোগাযোগ কমেছে। বাবার অভাবটা ছিলই। চাকরি সামলে তাকে একা হাতে বড় করার, প্রতিষ্ঠিত করার মায়ের অদম্য জেদের সামনে মুখ ফুটে এই নিয়ে কিচ্ছু বলেনি কোনওদিন।
মা চাইত বিজু যেন সব গণ্ডি পেরিয়ে এগিয়ে যেতে পারে। ও যখন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিঙের দিকে ঝুঁকল মা নিজেই ইউএসে আসবার জন্য ঠেলেছিল। এদেশে শপ ফ্লোরের ধারেকাছে মেয়েদের আসতে আরও এক যুগ লাগবে বিজু। সত্যি যদি কিছু করতে চাস এই লাইনে, তোকে বাইরে যেতেই হবে। সেখানে মেয়ে বলে তোকে কেউ টেনে রাখবে না। নাহলে আমার মতো প্রফেসার হয়ে শুধু বইয়ের পাতা উল্টানো।
মা কেমনভাবে একা থাকবে এই ভাবনাটা বিজুকে ভাবাত। মানুষের মনের মধ্যে কী ঝড় চলে সেটা কি আর বাইরে থেকে বোঝা যায়? মার চোখে কখনও তার ছায়া পড়েনি। বরং বলেছে, মানুষের একটাই জীবন বিজু। আর মজাটা কী জানিস? যত লোকের মধ্যেই থাকিস না কেন এর বেশিরভাগ সময়টাই তুই একা। আমি তো দেখি আমার বিবাহিত কলিগদের। ফারাকটা হচ্ছে ওরা একটা খাঁচার মধ্যে একা, আর আমি মুক্ত আকাশে। বলতে বলতে কোথাও কি মার গলায় দুঃখের আভাস থাকত? নাকি জয়ের দুন্দুভি? বিজু ঘুমিয়ে পড়ার পর একা ঘর থেকে ঘরে ঘুরে ঘুরে গোছগাছ করা, পরের দিনের যুদ্ধপ্রস্তুতির মাঝখানে মার কি সত্যিই একা লাগত না? বিজুর কি লাগে না এখন?
হেরে পিছিয়ে যাওয়া আর জিতে সামনে এগোনো, দুটোতেই একাকিত্ব থাকে। এই বোধ অর্জন করতে সময় লাগে। এইসব নিয়ে যখন মার সঙ্গে বেশি সহজে সমানে সমানে কথা বলা যেতে পারত, তখন বিজু চলে এলো অন্য দেশে। স্বপ্নপূরণের হাতছানি বুকে নিয়ে। দূর থেকে এই দেশে মেয়েদের কাজের রাস্তাটা যত সহজ মনে হয়েছিল, সামনে এসে বুঝল অতটা নয়। এগিয়ে নিশ্চয়। মেয়েরা শুধু স্কুলে, লাইব্রেরিতে কিংবা রিসেপশানে আটকে নেই। বাস ট্রাক চালাচ্ছে। আর্মিতে যাচ্ছে। মেশিন চালাচ্ছে। কম হলেও তার মতো আরও মেয়েরা আসছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিঙের দুনিয়ায়, শুধু রিসার্চের কাজে আটকে নেই। তাদের সঙ্গে দেখা হয় কোথাও কোনও কনফারেন্সে গেলে। কিন্তু রোজকার ওঠাবসায় তারা নেই। যাদের সঙ্গে রোজ কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে কাজ করতে হয় তারা সবাই পুরুষ। বসেরা অবশ্যই। কোনও মিটিং শুরুর আগে ফুটবল আর গলফের গল্পে নিজের পা রাখার জায়গা খুঁজে পায় না বিজু।
সে তো শুধু মেয়ে নয়, ভিনদেশিও। কারও যদি মনে হল বিজুকেও গল্পে অংশীদার করা উচিত তাহলে কথা ফুটবল ছাড়িয়ে সে গরুর গাড়ি করে স্কুলে যেত কিনা সেই প্রশ্নে পৌঁছায়। ভারত বলতে যাদের চোখে শুধু কৌপীন পরা গান্ধির ছবি, তাদের প্রশ্ন মেয়েরাও কি ওমনি পোশাকেই থাকে তোমার দেশে? এরকম কথার মধ্যে এরপর যৌন রসিকতা মিশে যায়, বহুবার গেছে। কাঁহাতক সহ্য করা যায়? ফটফট সেও জবাব দিয়েছে। চাপানউতোরে তুখোড় হয়েছে। পাথরে ঘষে ঘষে শান দেওয়ার মতো।
সব কিছু কথায় থেমে থাকে না। একবার কনফারেন্সে গিয়ে তার সেই সময়কার বস মাইক এক হাতে ওয়াইন গ্লাস ব্যালান্স করতে করতে অন্য হাত কাঁধে রেখেছিল। কথা হচ্ছিল আরও দুজন আমেরিকান ম্যানেজারের সঙ্গে। মাইকের হাত তার কাঁধ থেকে নেমে পিঠে আলগা হাত বোলানো অবধি ঠিক ছিল, কিন্তু একসময় সেটা আরও নিচে নেমে তার পাছা খামচে ধরল। বিজু বুঝতেও পারছিল না কী করবে। তার ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনীয়ারিঙের বইয়ের পাতায় এরকম সমস্যা নিয়ে আলোচনা থাকে না। আরক্ত মুখে সবার সঙ্গে সাবলীলভাবে কথা চালিয়ে যাওয়াই উত্তরণের পথ বলে মেনে নিয়েছিল। মাইক এটা সম্মতি ভেবে বসায় আরও বিপদ। রুমে ফেরার পথে লিফটে তাকে দেওয়ালে চেপে ধরে জোর করে চুমু খেল। মাইকের হাতের মোটা মোটা আঙুলগুলো মুঠো করে ধরতে চাইছিল ওর বুক। স্টপ মাইক, স্টপ বলে তার আর্তচিৎকার কামুক লোকটাকে একটুও দমাতে পারছিল না। লিফট তার ফ্লোরে পৌঁছানোর আগেই মাইকের হাত ব্লাউজের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল। তার মুখের উপর ভারী নিঃশ্বাস ফেলে মাইক হাসছিল। লিফটের দরজা খুলতেই নিজের ঘরের দিকে দৌড়েছিল বিজু। বন্ধ দরজার পিছনে ভেঙে পড়া কান্না ছিল শুধু তার একার। বাথটাবে বসে বুক থেকে ঘষে ঘষে তোলার চেষ্টা করেছে লোকটার হাতের স্মৃতি। কিন্তু যে ছাপ সেদিন বুকের অতলে গেঁথে গেছিল সেটা বের করবে কোনও চিমটে দিয়ে?
লোকটা কী শয়তান! পরদিন যখন ব্রেকফাস্টে দেখা হল ভাবটা যেন কিছুই হয়নি। নিশ্চয় অন্য মেয়েদের সঙ্গেও এমন চান্স নিয়েছে আগে। এরপর আরও ছয় মাস ওর আন্ডারে কাজ করতে হয়েছে বিজুকে। কীভাবে যে সামলে চলতে হয়েছে! মাইক যাবে জানলে সেই কনফারেন্সেও যায়নি। কোনও মিটিং-এর জন্য অন্য শহরে গেলে আগে থেকে খবর নিয়ে মাইক যে হোটেলে থাকবে সেটাকে সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছে। কখনও ভেবেছে ওর এগেনস্টে কমপ্লেন করবে। কিন্তু কী লাভ? আসলে এই দেশটা যত এগিয়ে বলে মা ভাবত সেরকম মোটেই নয়।
বরং প্রতিটা ইঞ্চি দখলের লড়াই চলতে দেখেছে। মেয়েদের হারতেও দেখেছে। সেই সময়ে সারা আমেরিকা জুড়ে অনিতা হিলের টেস্টিমনি নিয়ে তুলকালাম। কিন্তু কী হল, পারল কি কেউ ক্লারেন্স থমাসের কনফারমেশান আটকাতে? বরং হরেক মশলাদার আলোচনা মহিলাকে নিয়ে। সেই তুলনায় বিজু তো চুনোপুঁটি। তাই সেই পথে হাঁটেনি বিজু। এমন কি মণীশকেও কখনও বলেনি। যদি ও ভুল বোঝে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিঙের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামালনোর প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে একলব্যের মতো।
আজ পিছনে তাকালে এমন অনেক লড়াইয়ের চিহ্ন ছড়ানো দীর্ঘ পথের দুধারে। কিছু ছোটখাট পাহাড় তাকেও টপকাতে হয়েছে। এভারেস্ট জয় করেনি, কিন্তু সত্তর ফুট এই মই থেকে নিচে তাকিয়ে সে বলতে পারে এই পুরো প্ল্যান্টটা চলছে তার রক্ষণাবেক্ষণে। এক প্রাপ্তির আবেগ শরীরের অধিকার নিচ্ছিল। মাকে ফিসফিস করে বলতে ইচ্ছা করছিল, মা আমি তোমার কথা রেখেছি।
কিন্তু এই কথা রাখার জন্য বাড়িতেও কিছু কম দাম দিতে হয়নি। এখনও ভাবলে সমস্ত শরীরে অসহায় ঘৃণার বীজ দানা বাঁধে। দশ ঘণ্টা প্ল্যান্টে হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর কীভাবে ছুটতে ছুটতে বাড়ি ফিরত। মেয়েকে ডে কেয়ার থেকে নিয়ে বাড়ির গণ্ডি পেরোলেই এক ঘর কাজ থাকত তার অপেক্ষায়। এদেশে থাকার এটাই উপরিপাওনা। সব কাজ নিজের হাতে। মণীশ অনেক সময়ই ট্যুরে থাকত। কিন্তু বাড়িতে থাকলেও টিভির স্ক্রিন থেকে ওকে টেনে বের করা মুশকিল ছিল। টেক্সাস লংহর্নের খেলা থাকলে তো একেবারেই নয়। অনেক বলে দেখেছে। কিন্তু একটা পাথরের দেওয়ালে ধাক্কা খেতে খেতে কেমন অসহায় বোধ করত বিজু। একথা বোঝাতে পারেনি যে সেও মণীশের মতো রোজ দশ ঘণ্টা বাইরে কাজ করছে। তবে বাড়িতে এসে সেও কেন মণীশের মতো গা ছেড়ে দিতে পারে না? সেই দিক থেকে দেখতে গেলে এখনকার একা থাকাটা অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দের। প্রত্যাশাহীন।
আসলে মণীশের ভাবনাগুলোর গোড়ায় গলদ। বাড়ির পরিবেশ একদমই আলাদা যে। মণীশের মা বাঁকুড়ার এক বনেদি জমিদারবাড়ির মেয়ে। মণীশরা বাড়িতে তার প্রতাপে তালপাতার মতো কাঁপত। সেই সংসারে মণীশের বাবা ছিলেন এক অতিথি। যেমন বাড়ির কোনও বড় বড় সিদ্ধান্তে তার কোনও ভূমিকা ছিল না, তেমনি কোনও কাজেও কুটোটি নাড়তে হত না। প্রফেসার মানুষ এটা নিয়ে খুব সুখেই ছিলেন। বিজু বোঝেনি মণীশকে কেন নিজের বাবাকেই রোলমডেল বানিয়ে রাখতে হবে।
–হয় বিজু, হয়। তুমি যেমন নিজের মাকে রোলমডেল বানিয়ে রেখে সবসময় যুদ্ধং দেহি। বানাওনি? মণীশের নির্বিকার উত্তরে কী বলবে বিজু?
রাগে কি এরপর মাথা কুটবে? বিজু বোঝাতে চেয়েছে। আমেরিকা তোমাদের দুর্গাপুরের বাড়ি নয় মণীশ। ওখানে সকাল বিকেল তিনটে কাজের লোক আসছে, আর তোমার মা জমিদারগিন্নির মতো বসে হুকুম জারি করছেন। এখানে—
–জমিদারবাড়ির মেয়ে, সেটাই তো স্বাভাবিক। মুখের কথা কেড়ে নিয়েছে মণীশ।
–ওঁর দশ ঘণ্টার চাকরি ছিল না। সওয়াল জবাব করতে গিয়েও থমকে যেত বিজু। কী লাভ? মণীশ কি এতই বোকা যে এই পার্থক্যটুকু বুঝতে পারত না? বুঝতে চায়নি, কারণ এতেই ওর সুবিধা।
বরং উল্টে মণীশের দোষারোপ ছিল সে নাকি সারাক্ষণ ন্যাগ করে! মণীশের এত কাজের চাপ, তার মধ্যে যদি সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে একটু রিল্যাক্স না করতে পারে কী করে পরের দিন সামলাবে? বিজু কি চায় না ও চাকরিতে উন্নতি করুক? না কি সে আসলে মণীশের উন্নতিতে হিংসে করে? অদ্ভুত! সেও কি একই কথা বলতে পারত না? তার চাকরিটাও তো সামলাতে হয়! বিজু প্রতিটা পদে না ঠেললে এখানে পৌঁছাতে পারত এত তাড়াতাড়ি? কিন্তু ওটাই ছিল মণীশের তুরুপের তাস। জানত যে বিজু মনেপ্রাণে চায় মণীশের দ্রুত উন্নতি অব্যাহত থাকুক। সেই তপস্যায় নিজে প্রাণপাত করতেও পিছপা হবে না।
ওটাই ভুল ছিল বিজুর। এখন বোঝে। মণীশ ওগুলোকে নিজের পাওনা বলে ধরে নিয়েছিল। ভালোবাসায় সবারই যে কিছু দেওয়ার থাকে সেটা ভুললে চলে না। এখন কী করছে? মেক্সিকান বউকে কি ওইভাবে ট্রিট করতে পারবে?
মণীশের মা বাবা এসে ছিলেন মাস তিনেক। কীভাবে যে তিয়াসকে নিয়ে, অফিস সামলে সব কিছু করেছে। অন্তত সেই সময়ে মণীশ বাড়িতে থাকলেই কাজে হাত লাগানোর চেষ্টা করছিল। সেখানেও ওর মায়ের আপত্তি। ছেলেরা কবে থেকে এইসব কাজ করছে মানু? মাউগাপনা কোরো না। মায়ের সামনে মণীশ মণি হারা ফণী। সুড়সুড় করে তার টিভির দুনিয়ায় ফিরে গেছে। যতদিন ছিলেন মণীশের মা তাকে গার্হস্থের পাঠ পাখিপড়া করিয়েছেন। তার ছেলে নাকি অযত্নে দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। তার উপর মার্কিন দেশের কোনও কিছুই ওঁর পছন্দ হত না। এমন এমন জিনিস চাই, তার খোঁজ করতে করতে হয়রান। মুড়ি ছাড়া ওঁর চলে না। কথায় কথায় শোনাতেন, ‘আঁকুড়া বাঁকুড়াবাসী/মুড়ি খায় রাশি রাশি’। খুঁজে খুঁজে ইন্ডিয়ান স্টোর থেকে আনতে হল বিজুকেই। সেবেলা মণীশ কোনওখানে নেই। তাতেও হল না। কলে ভাজা মুড়ি উনি খান না, হাতে ভাজতে হবে। এসব হয় কেমন করে? ওঁর কী, বলেই খালাস। ওই তো তোমাদের ডেকে একটা খাম্বা দাঁড় করিয়ে রেখেছ। মানে গ্রিল। ভালো করে ধুয়ে মুছে চিকেনের গন্ধ যাতে না থাকে ওটাতেই কাঠকয়লার আগুনে ফাসক্লাস মুড়ি ভাজা হবে। অথচ উনি হাত লাগাবেন না। এমন নয় যে নতুন জিনিস শিখতে বিজু ভালোবাসে না। ওঁর কথা অনুযায়ী চালে নুন মাখিয়ে জলে দিয়ে মাখল। মাটির মালসা জোগাড় করে আনল ওয়ার্ল্ড মার্টের গার্ডেন সেকশান থেকে। সেটাতেই বালি দিয়ে মুড়ি ভাজল কাঠের হাতা দিয়ে। ঠিক যেমন যেমন উনি বলে দিলেন। খেয়ে একটু প্রশংশা? তাহলে তো বর্তে যেত। এমনভাবে ঠোঁট ওলটালেন তার মানে এর চাইতে আর তোমার কাছ থেকে কী বা আশা করা যায়? মণীশ কোনওদিন তার হয়ে বলতে আসেনি। তিনমাসের ব্যাপার মনে করে দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলে রেখেছিল বিজু। যতটা পারত ওঁকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করত। ঠিক যেমন মাইকের সঙ্গে অফিসে একা থাকার সম্ভাবনাগুলোকে এড়িয়ে চলত, তেমনি যে কদিন ওঁরা ছিলেন শাশুড়ির সঙ্গে একান্তে কথা বলাটা এড়িয়ে চলেছিল বিজু। এইভাবে তারকাঁটা এড়িয়ে কত চলা যায়। চাইলেও এড়ানো যায় কি? দিনের শেষে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে এইসব গ্লানি একটা একটা করে চোরকাঁটার মতো উপড়ানোর জন্য একমাত্র আশ্রয় তার রবীন্দ্রসঙ্গীত। গান শুনতে শুনতেই কত রাত সোফায় এলিয়ে পড়েছে। সকালে উঠেছে পিঠ আর ঘাড় ব্যাথা নিয়ে। কিন্তু সব ভুলে আবার ঝাঁপ দিয়েছে দিনের আঠেরো ঘণ্টার রুটিনে। কেন করত ওইভাবে? এই প্রশ্নটা বিজু নিজেকে করেছে। মণীশের ব্যবহার অনেক সময়েই অসহ্য লেগেছে। সময়ে প্রতিবাদ করেনি কেন? সে তো বোকা নয়। অসহায়, সম্বলহীন নয়। কেন মুখ বুজে সহ্য করেছে? নিজেকে খুঁড়ে খুঁড়ে এই প্রশ্নটা বারবার করেছে বিজু। বিয়ের প্রথম দিন থেকে শুনেছে ঘরভাঙা বাড়ির মেয়ে, এ কি ঘরসংসার বজায় রাখতে পারে কখনও! কেন যেন মনে হত এ তার মায়ের অপমান। এই ভবিষ্যদ্বাণীকে সত্যি হতে দেবে না বলে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যেত অনেক কিছু। কিন্তু কী লাভ হল? বেশি বালি কম সিমেন্টে বানানো সস্তা দেওয়ালের মতো একদিন চুরচুর করে ঝড়ে পড়ল। যে মণীশের জন্য এত করল, কেমন চোখের সামনে ধোঁকা দিল? ভালোবাসা যদি না থাকে কৃতজ্ঞতা তো থাকতে পারত!
যাকগে ভালো হয়েছে। তিয়াসকে নিয়ে তার একার জীবন শতগুণে ভালো। চাপ খুব, তিয়াস বড় না হওয়া অবধি সেটা থাকবে। তবু এর মধ্যেও যে এগিয়ে যেতে পারেছে সেটা ভেবে হালকা লাগে। এতদিনের পরিশ্রমের ওটাই সার্থকতা। শুধু এই আনন্দ শিহরন কারও সঙ্গে যদি শেয়ার করতে পারত! মাকে আজ ঠিক বড় করে মেল লিখবে, নিজেকে শাসাল বিজু। দিনের পর দিন, কাজের রুটিনে চরকিপাক মারতে মারতে কখন যে সময় পেরিয়ে যায়, গুছিয়ে লেখার অবকাশ হয় না।
হঠাৎ একটা জোরালো ধাতব আওয়াজে চিন্তাসূত্র ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। নিচে কন্সট্রাকশানের কাজ চলছে, আওয়ারলি ওয়ার্কাররা ভারী একটা প্যানেল টেনে নিয়ে চলেছে। আকাশকুসুম ভাবার আর সময় নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই প্যানেলটা চেক করে নিচে নেমে যেতে হবে। আর সাতদিনের মধ্যে কমিশান করতে হবে, সময় বড় অল্প। বগলের মধ্যে চেপে রাখা রোল করা সার্কিট ডায়াগ্রামটা এবার প্ল্যাটফর্মের মেঝেতে বিছিয়ে দিল বিজু। প্রেশার কন্ট্রোলটা ঠিক সময়ে ট্রিগার করছে না। ব্যারি এসে দেখে বলেছিল একটা ওভারফ্লো রিলে অফ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেন সেটা ধরতে পারেনি। তাই বিজু নিজে এসেছে। প্যানেলটা খুলে রিলেটাকে রিসেট করল। অ্যাম্মিটারের তারটাকে লাগাল কতটা কারেন্ট যাচ্ছে দেখার জন্য। এইরকম সময়ে বিজু এত একাগ্র থাকে যে বাইরে কী হচ্ছে একদম ভুলে যায়। তাই নিচ থেকে যে ব্যারি ডাকছে সেটা বুঝতে অনেক সময় লেগে গেল।
–What’s up? প্ল্যাটফর্মের রেলিং ধরে মাথা ঝুঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল। একদম খুশি হয়নি এইসময় বিরক্ত করায়। ওকে অ্যানেক্স প্ল্যান্টে অন্য একটা কাজে পাঠিয়েছিল। সেখানেও হেল্প চাই হয়ত। একটা বিরক্তি দানা বাঁধছিল বিজুর মধ্যে।
–তাড়াতাড়ি নেমে আসো বিজ। হারি!
–কেন কী হয়েছে, আমার এখনও কাজ বাকি আছে ব্যারি। তুমি নিচটা সামলাও এখন।
–Please come right now. It’s emergency. ব্যারির গলায় ব্যস্ততা। কী হতে পারে। কোনও বড় কিছু হলে এমারজেন্সি হুটার বেজে যেত। ব্যারির কথায় মনে হচ্ছে সেরকমই জরুরি কিছু, কিন্তু কোনও হুটার তো শোনেনি। অ্যাম্মিটারটা খুলে ছড়িয়ে রাখা সার্কিট ডায়াগ্রামটাকে চাপা দিল। তারপর সাবধানে কিন্তু যত দ্রুত সম্ভব নিচে নেমে এল।
ব্যারি অনেকদিন ধরে আছে অ্যারিস্টেক কেমিক্যালসে। অনেক দেখেছে। সাধারণত কোনও সেফটি সিচুয়েশানেও টসকায় না। বোঝা যায় অনেকটা দৌড়ে এসেছে, হাঁফাচ্ছে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ওর মুখে চোখে আতঙ্ক দেখে বিজুর অস্বস্তিটা বেড়ে গেল। কী হয়েছে ব্যারি? এত টেন্স কেন?
–বিজ, তুমি এখুনি চলো। অফিসে তোমার একটা ফোন এসেছিল। পার্সোনাল। ওর মুখের দিকে না তাকিয়ে লম্বা পায়ে ব্যারি হাঁটা দিল।
বুকের মধ্যে একেবারে ধক করে উঠল বিজুর। তিয়াসের কিছু হল? কী হয়েছে ব্যারি? কার ফোন?
–ফরসাইথ প্রাইমারি স্কুলে তোমার মেয়ে পড়ে না? তোমার এক বন্ধু মিশেল ফোন করেছিল। ওর মেয়েও বোধহয় ওই স্কুলে পড়ে। ওখানে ফায়ার আর্মস নিয়ে একটা লোক ঢুকে গেছে।
বিজুর ভিতরে কিছু ভাঙছিল। অনেক কাঁচের বাসন একসঙ্গে শক্ত মাটিতে গড়িয়ে পড়লে যেমন আওয়াজ হয় তেমনি এক শব্দমালা বিজুর কানে ভিতর থেকে ধাক্কা মারছিল। সে ভাঙনের শব্দ শুধু বিজুর নিজের। একটু আগেই সে এক আকাশে বিচরণ করছিল, আর এখন একদম চুপসানো বেলুন হয়ে নিচে নেমে এল। কিন্তু মিশেল আর কিছু বলেছে কিনা সেটা জিজ্ঞেস করার সাহস অবধি পাচ্ছে না।
ব্যারি সেটা বুঝল। বলল, মিশেল নিজেও এর বেশি কিছু জানে না। আরও কিছু প্যারেন্টসদের সঙ্গে ও স্কুলের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশ এসে গেছে। কিন্তু বাচ্চাদের সঙ্গে লোকটা এখনও ভিতরে। তোমাকে এখুনি ওখানে যেতে বলল।
বিজুর মাথা ঘুরছিল। এইসব সময়ে মানুষ কাউকে পাশে চায়। শক্ত করে জড়িয়ে ধরার জন্য। তার ছোটবেলায় মা এরকম সময়ে হয়তো হাতের কাছে বাবা মা ভাই মামা এদের সবাইকে পেয়েছে। তার জন্য কেউ নেই। ডিভোর্সের পর সমস্ত দোষ নিজের ঘাড়ে বহন করতে করতে স্থানীয় বাঙালি সমাজেও একলা চলার পথ। লোহার রেলিং ধরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিচে নামতে নামতে কী কী করণীয় সেই কথা মনের মধ্যে সাজিয়ে নিচ্ছিল বিজু। এখন সিঁড়ি দিয়ে পা পিছলানোর অধিকারও তার নেই। তিয়াসের এখন তাকে খুব দরকার।
৪
জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত চেহারায় সময়ের পদচিহ্ন রেখে যায়। আবার অনেক মানুষ বালুতটে নুড়ি পাথরের মতো। নিরন্তর ঢেউয়ের আঘাতে পায় পেলবতা। হাসিমুখে গাড়ির আয়নায় হাত রেখে যে ভদ্রমহিলা মণীশকে বললেন, Young man, we had a beauty like yours. Same color, but Camero, 1969— তার চেহারায় তেমনি সৌম্যতা।
বিকেলে মায়া আসছে। মণীশ বুশে এসেছিল ল্যাম্ব চপ আর ওয়াইন নিতে। ব্যাগটা ডিকিতে রেখে হলুদ মাস্তাংটা নিয়ে পার্কিং লট থেকে বেরোবে ভাবছে, সাদার ছিট লাগা চুল হাওয়ায় উড়িয়ে এই ভদ্রমহিলা এগিয়ে এলেন। চোখে গড়িয়ে যাওয়া মুখের হাসিতে নীলহ্রদে উপচে পড়া রৌদ্রের হাতছানি। পরনে প্যাস্টেল শেডের ফুলছাপা ফ্রক এমন কিছু আহামরি নয়, কিন্তু মুখের অনাবিল হাসির অন্তরঙ্গতা সব আড়াল করে দেয়।
ছুটির দিনে একলা সকাল কাটাতে কাটাতে বিষণ্ণ লাগছিল মণীশের। তিয়াসের কথা খুব মনে পড়ছিল। এত কাছাকাছি থাকে, কিন্তু মেয়েকে চাইলেই দেখতে যাওয়ার উপায় নেই। এখন মনটা আচমকা ভালো হয়ে গেল। আকাশে ঝকঝকে রোদ, গাড়ির মাথার থেকে কালো ছাউনি নামানোই ছিল। কিন্তু এতক্ষণ আলোর উপস্থিতি অনুভব করেনি। কিছু কিছু লোক এমনই হয়! মহিলার মুখের হাসি ধার করে জবাব দিল, ধন্যবাদ, তোমার এখনও আছে সেই গাড়ি?
–না, রিকের সঙ্গে শেষ চড়েছি একাত্তরে। বলতে বলতে মুখের উপর দিয়ে একটা হালকা মেঘ উড়ে চলে গেল যেন। সেদিন হাওয়ায় আমার চুল উড়ে উড়ে যাচ্ছিল, ভেবো না তখন এমন রং ছিল চুলের। একদম স্ট্রবেরি ব্লন্ড। চুলে উড়ে এসে এসে চোখে মুখে জড়িয়ে যাচ্ছে, আর আমি রিককে বলছি আরও জোরে, রিক। আরও জোরে। এমনভাবে বলছিলেন মনে হল সেই চুলের স্পর্শ এখনও অনুভব করছেন গালে, চোখের পাতায়। একটু কি আনমনা হয়ে গেছিলেন? চমক ভেঙে আবার মুখে হাসি ছড়িয়ে হাতটা বাড়িয়ে দিলেন, ভাবছ কে এই মহিলা নিজের গল্প শোনাতে এসে গেল। আসলে তোমার গাড়িটা আমাকে অনেক পুরনো কথা মনে করিয়ে দিল। আমার নাম এলেনা। এলেনা এফেমোভা।
–আমি মণীশ। তোমার সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব ভালো লাগছে এলেনা। যাবে আমার সঙ্গে, আমার মাস্তাং-এ হাওয়া খেতে? সত্যিই ইচ্ছা করছিল এলেনাকে ড্রাইভে নিয়ে যেতে। কিছু কিছু মানুষকে দেখলেই খুব আপন মনে হয়, যতই স্বল্প পরিচিতি হোক না কেন। তাছাড়া মণীশ এমন পারে। চট করে অপরিচিত কারও সঙ্গে জমিয়ে ফেলে। খুব তাড়াতাড়ি বন্ধুত্ব গড়ে তোলে।
এলেনাকে একটু দ্বিধাগ্রস্ত লাগল। তোমার বয়সি গার্লফ্রেন্ডকে পাশে বসিয়ে ঘুরবে, আমার মতো বুড়িকে কেন? তাছাড়া তোমার অন্য কাজ আছে বোধহয়।
–একটা সুন্দর গাড়ি অপেক্ষা করে থাকে কোনও সুন্দরীর জন্য। মুচকি হেসে বলল মণীশ। দেখছ তো কেমন রোদ ঝলমলে দিন! এলেনা, তুমি এলেই সর্বাঙ্গসুন্দর হয়ে উঠতে পারে।
এলেনা ইতস্তত করছিল। একটা দ্বিধা। মণীশ আবার জোর দিল। আমার গার্লফ্রেন্ড আসতে সেই বিকেল। তুমি আমার গাড়িতে একটু চড়লে আমার খুব ভালো লাগবে, এলেনা।
এলেনা সৌম্য সুন্দর। একসময় নিশ্চিত চোখটানা সুন্দরী ছিল। জীবনের গোধূলিতে এসে অন্যমাত্রা পেয়েছে। পোশাক দেখে মনে হয় না আর্থিকভাবে খুব স্বচ্ছল। কিন্তু আত্মমর্যাদাবোধে খাপখোলা তরোয়াল। আচ্ছা, আমি তোমার সঙ্গে আসব। কিন্তু একটা শর্তে, আমি তাহলে তোমাকে কফি খাওয়াব। নিজের হাতে বানিয়ে। বড় বড় নীল চোখে দুষ্টুমিভরা হাসি।
মণীশ গাড়ি থেকে বেরিয়ে অন্যদিকের দরজাটা খুলে বলড্যান্সে আমন্ত্রণ জানানোর নাটকীয় ভঙ্গিতে এলেনার বাঁহাত ধরে পাশের সিটে বসিয়ে দিল। গালে লজ্জার লালিমা ছড়িয়ে বসতে বসতে এলেনা খুশিতে আবিল হল। Maneesh, you know how to treat women. Your girl must be a very lucky one.
কথাটাকে মনের চোরাকুঠুরি উন্মুক্ত করতে না দিয়ে মণীশ জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবে বলো এলেনা। আমার হাতে অনেক সময়, তাই একদম ইতস্তত করো না। তোমার কোনও তাড়া নেই তো?
গাড়ি ছুটছিল নব্বই মাইলের গতিতে। সারা চোখে মুখে জড়িয়ে যাচ্ছে কথা কেড়ে খাওয়া হাওয়া। বাতাসে সাদা চুল উড়ে নিচের ঘন সোনালী চুল ফুরফুর করছে। এলেনার ভিতর থেকেও যেন এক ছটফটে যুবতী বাইরে বেরিয়ে ডানা মেলেছে। উত্তেজনায় ডানহাতে কাচ নামানো দরজার মাথাটা আঁকড়ে ধরেছে। খুশিতে মাঝে মাঝে মণীশের দিকে তাকীয়ে হেসে উঠছে। একদম বাচ্চা মেয়ের মতো। দেখতে দেখতে সেই এলেনাই ধীরে ধীরে কেমন শান্ত হয়ে গেল। চোখ থেকে টলটল করে জল গড়িয়ে পড়ল। মণীশ প্রথমে ভেবেছিল হাওয়ায় ধুলো এসে চোখে ঢুকেছে। কিন্তু আড়চোখে দেখল কণ্ঠনালী দ্রুত ওঠানাবা করছে। এলেনা কাঁদছে। নদীর চোরাস্রোতের মতো।
–তুমি ঠিক আছ এলেনা? আমি কি গাড়ি থামাব?
ধরা পড়ে যাওয়ার সলজ্জ হাসি মুখে টেনে এলেনা বলল, সরি। রিকের কথা বড্ড মনে পড়ে গেছিল। ও যেন ঠিক তোমার মতো, বড্ড মনে করিয়ে দিচ্ছ। কিন্তু আমি ঠিক আছি। আনন্দের যে অনেক রকম প্রকাশ থাকে মানীশ। কিন্তু চোখের জল মুছলও না। গালের উপর মুক্তোদানার মতো জলের ফোঁটা কাঁপতে কাঁপতে হাওয়ার সাথী হয়ে উড়ে চলে গেল।
মানীশ, আমার বাড়ি মিল্ডেন স্ট্রিটে, নাম্বার ফিফটিন। এখান থেকে কাছাকাছি। দেখবে একটা গাঢ় বাদামী রঙের কন্ডো। এলেনা হাত দিয়ে দিকনির্দেশ করছিল। মণীশ দেখল এলেনার লম্বা আঙুলে অনেকরকম রঙের রয়ে যাওয়া দাগ, নখপালিশ নয়। এলেনা মণীশের চোখ অনুসরণ করে হেসে উঠল আবার। সকালবেলায় একটা ছবি নিয়ে বসেছিলাম, তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেছিলাম। হাতে রং লেগে আছে।
তার মানে এলেনা শিল্পী। মণীশের মনে হল অন্য কিছুতে যেন এলেনাকে মানাত না।
–আমার অ্যাপার্টমেন্ট তিনতলায়। বাইরের রাস্তায় পার্ক করতে পারো।
লিফটে করে তিনতলার ঘরটায় পৌঁছাল ওরা। চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে খুট করে আলো জ্বেলে দিল এলেনা। Welcome to my home, Manish.
বাইরে যদিও বেশ রোদ আর দিনের আলো, ঘরে ছায়া ছায়া ভাব। ব্লাইন্ডগুলো নাবানো। মণীশ লক্ষ করল ব্লাইন্ডগুলোতেও এলেনা নানান রঙের মেলা বসিয়েছে। এলেনা দ্রুত হাতে ব্লাইন্ডগুলো তুলে দিতেই গোল গোল রোদের ছটা এসে ঘরের দখল নিল। চারদিকে চোখ বুলিয়ে ঘরের আন্দাজ নেওয়ার চেষ্টা করছিল মণীশ। গোছানো, নিরাড়ম্বর। কয়েকখানা বই এদিক ওদিক ছড়ানো। দেওয়ালে বেশ কিছু অয়েল পেন্টিং ফ্রেম করে রাখা। সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখল মণীশ। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। জানালার পাশে একটা ইজেল। কাজ এখনও চলছে। এইটা নিয়েই বোধহয় সকালে বসেছিল এলেনা।
–তোমার কাজগুলো অসাধারণ!
–ভালো লাগছে তোমার? সলজ্জ হাসি এলেনার মুখে।
জানালার পাশের অর্ধসমাপ্ত ছবিটার কাছে এক পা এগিয়ে গেল মণীশ। এটা কারও পোর্ট্রেট? এলেনার সঙ্গে ভীষণ মুখের মিল, কিন্তু জামার ফুলকাটা গলার কাজ, মাথার বারান্দা দেওয়া টুপিটা যেন অতীত থেকে ধার করা।
–বলতে পারো, আমার গ্রেট গ্রেট গ্র্যান্ডমাদারের। আমি অবশ্যই তাকে কক্ষনও চোখে দেখিনি। এলেনা কাপে কফি ঢালতে ঢালতে মুখ তুলে তাকাতেই ছবির মহিলাকে খুঁজে পাওয়া গেল।
মণীশ বুঝতে পারছিল এলেনা একাই থাকে। তাহলে রিক কোথায়? এলেনার বয়েস পঞ্চাশ টঞ্চাস হবে। আমেরিকায় লোকের আয়ু দীর্ঘ। রিক যদি ওর স্বামী হয়, স্বাভাবিকভাবে এত তাড়াতাড়ি মারা যাওয়ার কথা নয়। এলেনার মতো কাউকে যে কেউ ছেড়ে যেতে পারে সেটা মনে হয় না মণীশের। বিদ্যুৎ চমকের মতো বিজুর কথা ভেসে উঠল মাথায়। বিজু আর এলেনার মধ্যে অবশ্যই কোনও মিল নেই, একলা থাকা ছাড়া। বিজুর সঙ্গে তিয়াস আছে, এলেনাকে মনে হল নিঃসঙ্গ। সেজন্যেই কি কাঁদছিল? এখনও কেমন বেতালা লাগছিল এলেনাকে। এ কথা সোজাসুজি জিজ্ঞেস করা যায় না। বরং হাওয়া হালকা করার জন্য মণীশ জিজ্ঞেস করল, তুমি অরিজিন্যালি কোন দেশের এলেনা? মানে কোন দেশ থেকে আমেরিকায় এসেছিলে?
ফিক করে হাসল এলেনা, মেঘ কেটে রোদ চলকে বেরোনোর মতো। মজার কথা মনে পড়ে গেছে এমন একটা অভিব্যক্তি ওর মুখে। আসলে আমাদের ইতিহাস একটু গোলমেলে। আমি কোনও দেশের ছিলাম কিনা, সেটাই তো বুঝতে পারি না।
–মানে?
এলেনার চোখ খুশিতে ঝিকমিক। মণীশের মনে হল সবসময়েই বুঝি এমনি। চোখের মণিতে গাঢ় নীল জল টলটল করছে যার মধ্যে এক খুশিয়াল কিশোরী যেন জলতরঙ্গ বাজাচ্ছে।
–আমি তো আসিনি, এসেছে আমার গ্রেট গ্রেট গ্র্যান্ডফাদার। আমার ঠাকুমা তো আসতেই পারেনি। কিংবা এসেছিল, পৌঁছে গেছে অন্য কোথাও।
এলেনার কথায় বাচ্চাদের ধাঁধা, গলায় ছেলেমানুষি। ঠাকুরদা এসে এখানে একটু গুছিয়ে বসার পর, ঠাকুমাকে আনতে চেয়েছিল। উনি জাহাজেও চেপেছিলেন। কিন্তু এলিস আইল্যান্ডে এসে পৌঁছেছেন এমন কোনও প্রমাণ নেই।
না দেখা বড়ঠাকুমার জন্য কষ্ট হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু এলেনার গলায় তবু আর্দ্রতা। মনে করো, স্বামীর সঙ্গে একত্র হবে বলে আসছিলেন জাহাজে দিনের পর দিন। ছেলেমেয়েকে মায়ের কাছে রেখে একাই জাহাজে চেপেছিলেন সেই বড়ঠাকুমা। কী বা বয়স তার তখন? চোখে কত স্বপ্ন, নতুন দেশ, নতুন জীবন। কিন্তু কোনওদিন সেই জীবন তার হল না। স্বপ্ন পূরণ না হওয়ার যে কী কষ্ট— একটা দীর্ঘশ্বাস হাওয়ায় কাঁপতে কাঁপতে মিলিয়ে গেল। মণীশ ছবিটার দিকে তাকাল। ছবির ঠাকুমার চোখে কি সেই স্বপ্নভঙ্গেরই বেদনা? এলেনার তুলির টান সেই অনুভবকে বাঙ্ময় করে তুলছে।
গল্পকে এগিয়ে দেওয়ার চাহিদা নিয়ে মণীশ প্রশ্ন করল, তাহলে তোমার ঠাকুরদা কীভাবে এলেন?
–ঠাকুরদা আর তার বোন। ওরা দুই ভাই বোনে তাদের কাকার সঙ্গে আরও ছয়মাস বাদে এসে পৌঁছায়। ততদিনে আমার গ্রেট গ্র্যান্ডফাদার আবার বিয়ে করে নিয়েছেন এই দেশে। অবশ্য শুনেছি ছেলেমেয়ের কোনও অযত্ন হয়নি। কফি হাতে ধরাতে ধরাতে বলল এলেনা। Cream and Sugar? How many?
চামচ দিয়ে কফিতে চিনি গুলছিল মণীশ। এলেনার হাতে ব্ল্যাক কফি। বাতাসে স্মৃতি রোমন্থনের আমেজ। এদের কাউকেই আমি চোখে দেখিনি। বড় হতে হতে বাবা আর পিসিদের কাছে যেটুকু গপ্পো শুনেছি আর কী। এছাড়া একটা পুরনো বাক্সে কিছু ছবি। ছড়ানো ছিটানো এই যে সব গল্প, তার থেকেই জেনেছিলাম যে আমার জন্মস্থান বিয়ালশোক বলে একটা জায়গায়।
–বিয়ালশোক? কেমন একটা ইন্ডিয়ান গন্ধমাখা এই নামে। কোনও দেশে?
–পিংপং বলের মতো সে কখনও এক কূলে, কখনও আরেক। হাসতে হাসতে দুহাত উল্টাল এলেনা। ওর নিটোল আঙুলে রঙের ছিটের মতোই বর্ণময় ওর জন্মস্থানের ইতিহাস। অনেক আগে এটা ছিল লিথুয়ানিয়ায়, তারপর পোল্যান্ড, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর প্রুশিয়া। নেপোলিয়ানের বাহিনির ঘাঁটি হয়েছিল একসময়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি আর রাশিয়া বিয়ালশোককে বম্ব প্র্যাকটিসের জন্য বেছে নিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আবার জার্মানরা দখল নিল।
–এখন?
–কে জানে, আমি তো যাইনি কক্ষনও। শুনেছিই শুধু।
–মনে হয় না সে দেশের কথা? একবারও?
–যা দেখিনি তা কী করে মনে করব মানীশ? এলেনা প্রশ্নটায় একটু অবাক হয়েছিল। তাছাড়া কোনটা আমার দেশ?
–না, কিন্তু কেমন ছিল তোমার পূর্বপুরুষ, কী ভাষায় কথা বলত, এইসব জানতে ইচ্ছে হয় না? অনেকগুলো প্রশ্ন একসঙ্গে করে ফেলে কেমন লজ্জা লাগল মণীশের। বড্ড বেশি ব্যাক্তিগত কথা জানতে চেয়ে ফেলছে।
কিন্তু এলেনা কিছু মনে করেনি, বেশ মজা করেই উত্তর দিল। ওরে বাবা, সে তো একেকজন একেক ভাষায়।
–তার মানে? তাহলে তোমরা কী ভাষায় বাড়িতে কথা বলতে?
–আমি তো ইংরাজিতেই। ভাবছিল এলেনা। কিন্তু আমার ঠাকুরদার সময়ে না রাশিয়ান, না পোলিশ। ওরা বলতো ইদ্দিশ। ভাবতে পারো কতটা আঁকড়ে ধরে থাকলে সামান্য হলেও তিন জেনারেশনের পরে শব্দ, গন্ধ আর রঙের স্মৃতি মাথায় জমিয়ে রাখা যায়? আমার প্রজন্মে শুধু তার কিছু শব্দ বেঁচে ছিল। মিটমিট চোখে হাসল এলেনা। যত খারাপ কথাগুলো আর কী।
আবার কী ভেবে মুচকি হেসে বলল, এইটা সার বুঝেছি একেকটা ভাষায় একেকটা কিছু ভালো করে বোঝানো যায়। যেমন কোনও মানুষের কী খুঁত, সেটার জন্য ঝকঝকে ধারালো ভাষা ইদ্দিশ! আবার দেখো ইনুইটে হয়তো অতি সহজে বোঝানো যায় জাপানি বৃষ্টিকে। আসলে আমার কী মনে হয় জানো, মানুষগুলোর দেখার যেমন যেমন ভাব, ভাষাও তেমনি ধারা রূপ পায়। অন্য ভাষায় সেই স্বাদ গন্ধ পাবে না। তোমার মনে হয় না?
–হ্যাঁ, এটা ঠিক বলেছ তো! যেমন আমার নিজের ভাষা বাংলা। বাংলায় এমন অনেক কথা বলা যায়, আমি ইংরাজিতে সেগুলো যেন সেভাবে বোঝাতেই পারি না।
–কীরকম? আমাকে একটা এগজাম্পল দাও।
এলেনার জানার ইচ্ছাটা জেনুইন। মণীশ ভাবছিল কী বলে। জানে, কিন্তু বোঝাতে গিয়ে যত মুশকিল! এই যেমন ধরো আমাদের বাংলা ভাষায় অনেক শব্দ আছে যেটা কোনও একটা সাউন্ডকে রিপিট করে হয়। তুমি বললে না ইনুইটে বৃষ্টি ভালো বোঝানো যায়? আমাদের বাংলায় বৃষ্টি পড়ার আওয়াজ থেকে শব্দ তৈরি হয়েছে রিমঝিম, টিপটিপ, ঝমঝম।
এলেনা চোখ বন্ধ করে এই শব্দগুলো অস্ফুটে ঊচ্চারণ করার চেষ্টা করছিল। তারপর হঠাৎ উদ্ভাসিত মুখে বলল, আচ্ছা মানীশ, এই যে ঝামঝাম বৃষ্টি, তার মানে কি খুব জোরে বৃষ্টি হচ্ছে?
–এগজ্যাক্টলি! অবাক হল মণীশ। তুমি কী করে বুঝলে?
–মনে হল। এই শব্দটা উচ্চারণ করতে আমার মুখ অন্য দুটো শব্দের চেয়ে বেশি খুলতে হচ্ছিল তো, তাই ভাবলাম— হাসল এলেনা। আমেরিকা এই জন্যে আমার ভালো লাগে। কত নতুন নতুন শব্দ শুনতে পাই।
এলেনার সঙ্গে কথা বলতে খুব ভালো লাগছিল মণীশের। ওর বিষয়ে জানার ইচ্ছাটাও বেড়ে যাচ্ছিল। অর্ধসমাপ্ত ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, আচ্ছা এলেনা, একটা কথা বলি? তুমি কেন তোমার না দেখা এই মহিলার ছবি আঁকছ যাকে দেখতে তোমারই মতন লাগছে।
এলেনা উত্তর না দিয়ে মৃদুমন্দ হাসছিল।
–সেটা কি সেই না দেখা দেশের কথা ভেবেই আঁকছ? হয়তো তুমি নিজেকেও সেই দেশের মেয়ে হিসেবে কল্পনা করছ।
মণীশ জানে আবার একটি ব্যক্তিগত প্রশ্নে চলে গেছে। সাধারণত এমন কথা এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। কেউ কিছু মনে করতেই পারে। কিন্তু কিছুক্ষণের কথোপকথনে কেন যেন মনে হচ্ছে এলেনাকে বলা যায়, সদ্যপরিচিত হলেও।
হাসল এলেনা, একটু ভাবলও। চোখ কুঁচকে কিছু মনে করার মতো ভাবা নয়, বরং কীভাবে বলবে সেটাই যেন মনের মধ্যে সাজিয়ে নিচ্ছে। আমি ওঁর ছবি আঁকছি আর সেখানে নিজের মুখের আদল খুঁজে পাচ্ছি তার কারণ আমি ওর জীবনের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করতে পারি। এটা ঠিক দেশের টান নয়। মানুষ যখন ভালোবাসার স্বপ্ন দেখে, তখন তার মুখে একটা পবিত্র বেদনা ছায়া ফেলে। মানুষের মুখ তো তার মনের আয়না। সেই ভাবনা প্রতিফলিত হয়ে এক সৌন্দর্যের জন্ম হয়। বলতে বলতে থেমে গেল এলেনা। না থাক, বড্ড ভারী ভারী কথা বলে ফেলছি।
–প্লিজ বলো এলেনা। আমি জানতে চাই।
–না মানীশ, ছবি নিজের কথা নিজে বলবে, শিল্পীর কাজ শুধু আঁকা। বোঝা গেল, এই ব্যাপারে এলেনার মতামত খুব দৃঢ়।
–আমি বরং তোমায় আমার সেই নিজের দেশ নিয়ে ভাবনার বিষয়ে বলি। জানো তো সব অভিবাসীরই অমনি প্রশ্ন থাকে, একটা টানাপোড়েন। তুমি প্রথম প্রজন্ম, তোমার মনে তো এই কথা আসবেই। আমি আমার এক কাজিনকে জানি যে নিজের দেশ দেখতে গেছিল। কিন্তু সেও যেন বিদেশ ঘোরার মতোই। আসলে সেও তো ফো্র্থ জেনারেশান। আবার আমার এক স্কুলের বন্ধু আরলিন— ওরা অবশ্য আইরিশ। দ্বিতীয় প্রজন্মের। সে ডাবলিনে ফিরে গেছে। ওখানেই বিয়ে করে সেটল করেছে। আর ফিরে আসেনি।
–তার মানে এই নিজের দেশ, নিজের ভাষা এগুলো তোমাকে সেভাবে হন্ট করে না।
–সেরকম না। আমিও এই বিষয়ে ভাবি মাঝেমাঝে। তবে অন্যভাবে। আমার কী মনে হয় জানো? যা আমাদের জীবনে কোনওদিন ছিলই না, কিংবা থাকলেও অনেক আগে ধুয়েমুছে গেছে সেই মাটি, আকাশ কিংবা ভাষার জন্য এমন আকুতির কী আছে? নতুন দেশে, নতুন ভালো লাগায় নিজেদের ডুবিয়ে দেওয়া না গেলে সবসময়েই নতুন দেশ তোমার কাছে বনবাস। একটা কথা মনে রেখো মানীশ, যে দেশ থেকে তুমি চলে আসো সেই আসল দেশটা কিন্তু ক্রমাগত বদলে যাচ্ছে। আমি দেখেছি অনেকে সেই ফেলে আসা দেশটাকে আঁকড়ে ধরে থাকে আর যখন দেখে নিজের দেশ, মানুষ বদলে গেছে তখন কেমন অসহায় বোধ করে।
–That’s a great insight Elena! সত্যিই কথাটা খুব ভালো বলেছে এলেনা। তার ভারতবর্ষ কী এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে আর? অথচ তার স্মৃতিতে তো এখনও সেই পনেরো বছর আগের দুর্গাপুর।
–আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরও আলাদা। যে মানুষটা চলে এসেছিল আমি তো সে নই। কিছু ভাবনা রয়ে গেছিল, শেখানোর চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু আমি মনে করি, ভুলে যেতে হয়, শিকড় চারিয়ে দিতে হয় গভীরে, নতুন দেশটাকে শুষে নিতে হয় মজ্জায়। রিক তেমনি করেছিল। রিকের বাবা মা গ্রিস থেকে এসেছিল। রিকের জন্মও ওই দেশে। কিন্তু নিজেকে একদম এই দেশের করে ফেলেছিল, এক প্রজন্মেই। মানুষের আন্তর্জাতিকতায় খুব বিশ্বাস করত।
এলেনা নিজেই রিকের কথা তুলল আবার, তাই মণীশ সাহস করে জিজ্ঞেস করল এবার। রিক এখন কোথায় এলেনা?
–চলে গেছে আজ কত বছর! খুব ধীরে ধীরে চোখের পাতা একটুও না কাঁপিয়ে বলল এলেনা। মণীশের মনে হল এলেনার এই সংযত আবেগ অনেক অভ্যাসের ফলশ্রুতি। একাত্তর সালের জুলাই মাস, একটা রোদ ঝলমলে দিন হঠাৎ করেই হয়ে গেছিল এক মর্মান্তিক দুপুর!
এলেনা বলতে বলতে থেমে গেল। কিচেন টপের ওপর থেকে খুঁটিনাটি জিনিস সরানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়ল হঠাৎই। তখন ওরা লটারি করছিল। ভিয়েতনামের যুদ্ধের ড্রাফটিং চলছে। রিকের জন্যেও এল সেই পরোয়ানা। শুকনো হাসি নিয়ে চোখ তুলল এলেনা। জানি তো মরতে যাওয়ার চিঠি! রিকের বয়স তখন তেইশ, আমি একুশ। যাওয়ার আগে আমাদের বাগবন্ধন হল খুব তাড়াতাড়ি করে। ওই শেষ।
–ফেরেনি?
ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল এলেনা। আমেরিকার স্বপ্নের জীবন কী তাড়াতাড়ি দুঃস্বপ্নে বদলে গেল!
মণীশ অবাক হয়ে এলেনার দিকে তাকীয়েছিল। তার মানে কী এলেনা রিকের স্মৃতি নিয়েই নিজের যৌবন কাটিয়ে দিয়েছে। সারা জীবন?
আমাকে রেখে রিক চলে গেল। আমি নার্সিং-এর ক্লাস নেওয়া শুরু করলাম। ভেবেছিলাম নার্স হয়ে আমিও ভিয়েতনামের যুদ্ধে চলে যাব। একসঙ্গে থাকতে না পারি, এক দেশে চাই কি একই ডিপ্লয়মেন্টে পেয়ে যেতে পারি। কিন্তু তার আর দরকার হল না। রিকের বডিব্যাগ ফেরত এল আমার নার্সিং পাশ করার আগেই। তারপরে তো যুদ্ধই থেমে গেল।
ঘরের হাওয়া থমথমে। চক্রাকার আলোয় এক অদ্ভুত আলোছায়া। সেটা নিজেই ভাঙল এলেনা। কোনও কোনও জীবন এক দিনেই যাপন করতে হয়। সারাজীবনের সম্পদ হয়ে থেকে যায়। চোখে সেইদিনটার স্বপ্ন মেখে মণীশের দিকে হাসিমুখে তাকাল এলেনা। যাবার আগে ওই হলদে ক্যামেরোতে চেপে আমাকে ডালাস নিয়ে গিয়েছিল রিক। আমরা সারাদিন ডালাসের ডাউনটাউনে ঘুরে বেড়ালাম।
এলেনা রিকের ছবির উপর নরম হাতে আঙুল বোলাচ্ছিল। রিক একদম তোমার মতো ছিল মণীশ, আমার খুব খেয়াল রাখত। পারলে আমি যে পথে হেঁটে যাব, সেই রাস্তায় নিজেই শুয়ে পড়ে। আমার কপাল দেখো, সারা জীবন একাই হেঁটে গেলাম। আমার চুল পেকে গেল, চামড়া ঝুলে গেল। রিক রয়ে গেল তেইশ বছরের তরতাজা তরুণ। এই অয়েল পেন্টিংটা রিকের। আমার আঁকা। এখনও আমার দিকে চেয়ে হাসে।
মাথাভর্তি কোঁকড়া সোনালী চুলের যুবক, মণীশের মনে হল ইতিহাসের বইতে দেখা আলেকজান্ডার।
কীরকম ভালোবাসা থাকলে এইভাবে স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকা যায়? বিজুকে ছেড়ে সত্যিই কি মিস করছে মণীশ? কিংবা মায়ার প্রতি তার আবেগকে এইরকম ভালোবাসার সঙ্গে এক পাত্রে রাখা যায়? একা একা বাড়ি ফেরার সময় সেটাই ভাবছিল মণীশ। এলেনাকে আবার বুশের ওখানে নামিয়ে দিয়ে এসেছে, ওখানেই ওর গাড়ি রাখা ছিল। বিদায় নেওয়ার আগে এলেনা ওকে সাদর আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছে। কখনও মনে হলে ওর বাড়ি চলে আসতে পারে। যাবে হয়তো কখনও। হয়তো না, নিশ্চয় যাবে। এলেনাকে খুব ভালো লেগেছে মণীশের। একটা নরম ভালোলাগা নিয়ে বাড়ি ফিরল।
মায়া মণীশের ছুটির দিনে একসঙ্গে থাকবে বলে পরপর তিনটে ফ্লাইটে কাজ করেছে। কি-হোল দিয়ে অপেক্ষারত মায়াকে দেখছিল মণীশ। চোখে রাতজাগা ক্লান্তি, একটু ঝুঁকে ট্রলি ব্যাগটার হ্যান্ডেলে শরীরের ভার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখেমুখে কি এলেনার ছবির মতো ভালোবাসার স্বপ্নের আঁকিবুকি? এলেনার কথাগুলো এখনও মাথায় ঘুরছিল মণীশের। তার দেখার ভঙ্গিতে নতুন এক মাত্রা জুড়ে দিয়েছে এলেনা। অনুভূতির এই কোমলতা যেন এই প্রথমবার পেল। মায়াকে দেখতে দেখতে আবেগাপ্লুত হচ্ছিল মণীশ। এই কি তাহলে সত্যি ভালোবাসা? ভাবনাটাকে মাথায় নিয়ে মণীশ দরজা খুলতেই হাসিতে ঝলমল করে উঠল মায়া। Eres mi amor. No podría vivir sin ti. দুহাতে ওর গলা জড়িয়ে ধরে লম্বা একটা চুমু খেল, নিজের সমস্ত উষ্ণতা মণীশের মধ্যে চারিয়ে দিয়ে। আমি খুব ক্লান্ত মণীশ। দাঁড়াতেও পারছি না আর। তুমি আমাকে কোলে করে নিয়ে চলো। যাবে না?
আবদেরে ভঙ্গিতে দাঁড়ানো মায়াকে টিজ করতে ইচ্ছে হল। আর তোমার ট্রলি ব্যাগটার কী হবে?
মায়া ওর তর্জনী মণীশের ঠোঁটের উপর রাখল। চুপ, এত বেশি কাজের কথা বোলো না। আমি তোমার স্বপ্ন দেখতে দেখতে এসেছি, সেটা ভেঙে দিও না প্লিজ।
মায়ার ছটফটে দুষ্টুমিভরা আবদারে মণীশ অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এক ঝটকায় কোলে তুলে নিল। মায়ার বাদামী চুল ঊর্ধ্বমুখে উঠে মণীশের চোখে মুখে আদরের পরশ দিতে দিতে নিচে নেমে এল। মায়ার খেলায় সাগ্রহে যোগ দিয়ে মণীশ প্রশ্ন করল, এবার বলো কোথায় নিয়ে যেতে হবে আমার রাজকুমারীকে। চোখমুখের যা অবস্থা দেখছি, সোজা বেডরুমে নিয়ে গেলেই বোধহয় ভালো হয়।
–উঁহু, বেডরুমে নয়। আজকে টেক্সাস লংহর্নের সঙ্গে ওকলাহামা সুনারের খেলা আছে। বেডরুমে আমার পাশে বসে তুমি ওই খেলার কথা ভাববে আর আমি কখন ঘুমিয়ে পড়ব তার জন্য অপেক্ষা করবে সেটা হবে না। মায়া এমনভাবে বলছিল যেন ও মণীশের মনের সব কথা পড়তে পারে। তার চেয়ে আমি তোমার কোলে সোফায় শুয়ে থাকব। তুমি খেলা দেখতে দেখতে আমায় আদর করবে।
–তুমি তো ফুটবল অত ভালোবাসতে না, তাহলে এত খোঁজ রাখো কী করে?
–তোমার সব ভালোবাসাতেই আমার অধিকার। সব। তুমি যদি ফুটবল ভালোবাসো, আমিও বাসব।
মায়ার এটা মুখের কথা নয়, সেটা মণীশ জানে। দেখেছে বারবার এই কদিনেই। তবু আবারও শুনে মনটা কেমন করে উঠল। মায়ার কপালে চুমু খেয়ে বলল, তাহলে আজ এমন একটা ঘটনা ঘটল, সেটা তো তোমাকে জানাতে হয়।
শুনেই মায়া তড়াক করে উঠল। বলো, বলো কী হয়েছে?
–আহা, বলছি তো। তুমি কফি খাবে না ওয়াইন নেবে? রোজ ওয়াইন আছে।
–ওকে, ওয়াইন দিতে পারো। কিন্তু আমি মাটিতে পা রাখবই না। আমাকে কফি টেবলটায় বসিয়ে দাও।
মণীশ বুঝল মায়া আজ পুরোপুরি খেলার মুডে আছে। টেবিলে বসিয়ে দুটো গ্লাসে ওয়াইন ঢেলে আনল। মণীশ চেয়ারে বসে মায়ার পায়ের জুতো খুলে ওর পায়ের পাতা দুহাতে নিয়ে বসল। তোমাকে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে, পায়ে একটু দলাইমলাই করে দিই তোমার?
–আগে বলো, কী ঘটনা হয়েছে আজ।
এলেনার কথা খুব মন দিয়ে শুনল মায়া। শুনতে শুনতে ওর চোখ জলে ভরে গেল। টলটল করছিল জলের ফোঁটা। ভোরের পাতায় শিশিরের মতো।
–একি মায়া কাঁদছ কেন? তুমি তো এলেনাকে চেনোও না। আর ওর বয়ফ্রেন্ড রিক মারা গেছে তিরিশ বছর হতে চলল।
মায়ার মুখ কেমন একটা ব্যথায় ভরে গেল। তুমি কিচ্ছু বোঝো না মণীশ। আমি ওদের কথা ভেবে কাঁদছি না। আমি ভাবছি তোমার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে আমি কীভাবে বাঁচব। আমি তো তোমাকে ছাড়া এক মুহূর্ত বাঁচতে পারব না, তিরিশ বছর দূরের কথা। চুল ধরে মণীশের মাথাটা নিজের দু চোখের সামনে নিয়ে এল মায়া। তুমি বোঝো মণীশ, আমি তোমাকে কত ভালোবাসি। কতটা?
এই মেয়েকে কদিনই বা চেনে মণীশ? আগে যখন জানত, তখন ভাষার বেড়া ভেদ করে ভিনদেশের এই মেয়ের মনের কথা জানতেও পারেনি। মাঝে মাঝে অবাক লাগে। মায়া তার মধ্যে কী দেখেছিল যে কোনও কথা না বলেও এত ভালোবাসা বুকে বয়ে বেড়াচ্ছিল। নিজের জীবনে না ঘটলে মণীশ বিশ্বাস করত না এমনটাও সম্ভব।
মায়ার আবেগ সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো মণীশের উপর আছড়ে পড়ল যেন। আর সমুদ্রতটের বালুকনার মতো মণীশ তাতে ভেসে গেল। অন্তত যেতে চেয়েছিল। সেই সময়ে একটা ফোন এল। ধরবে না ভেবেছিল। কিন্তু মায়া ওর প্যান্টের বেল্টের সঙ্গে ঝোলা ওয়্যারলেসটা বের করে নিজের চোখের সামনে আনল। ফরসাইথ স্কুল? তোমার মেয়ের স্কুলের ফোন মণীশ? বোধহয় কিছু জরুরি খবর।
তিয়াস ফোন করেছে? স্কুল থেকে? ইচ্ছা না থাকলেও মণীশ ফোনটা নিল।
–হ্যালো, মণীশ হিয়ার।
শুনতে শুনতে ওর মুখের রং বদলে যাচ্ছিল। মায়া ওদিকের কথা শুনতে পাচ্ছিল না, শুধু মণীশের উত্তর শুনে বুঝল গুরুতর কিছু হয়েছে। মণীশ ফোন রাখতেই জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? ইজ ইওর ডটার অলরাইট?
–ওদের স্কুলে একটা গানম্যান ঢুকে পড়েছে। তিয়াস ছাড়াও আরও বারোটা বাচ্চাকে হোস্টেজ করে একটা ঘরে বন্ধ হয়ে বসে রয়েছে। বলতে বলতে কাঁপছিল মণীশ। ওরা বিজুকে কানেক্ট করতে পারেনি, তাই আমাকে ফোন করেছে। আমাকে এখুনি যেতে হবে। সরি মায়া, আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে।
মুখে হাত চেপে নিজেকে সামলাচ্ছিল মায়া। Oh Dios mío! এক্ষুনি চলো, আমিও আসব তোমার সঙ্গে।
–না, না তোমার যাওয়ার দরকার নেই। ওখানে বিজু এসে যাবে। মায়ার সঙ্গে থাকলে আর একটা কমপ্লিকেশান। মনে মনে সেটা ভেবেই প্রমাদ গুনল মণীশ। মুখে বলল, তুমি টায়ার্ড হয়ে এসেছ, ততক্ষণ রেস্ট নিয়ে নাও।
–একদম নয়, মণীশ। বলেছি না তুমি যা ভালোবাসো, যাকে ভালোবাসো তাতে আমার সমান অধিকার। ভালোবাসার অধিকার। আর তুমি কাছে থাকলে, আমি একদম তরতাজা। সবসময়। আর কথা নয়, আমাদের দেরি করলে চলবে না।
মায়ার হাত শক্ত করে ধরতেই একটু আগের ডুবে যাওয়া মানুষের অনুভূতি মিলিয়ে গেল মণীশের। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে স্কুলে পৌঁছাতে হবে। এখুনি।
৫
স্কুলের দিকে যাওয়ার সব রাস্তাই পুলিশের গাড়ি দিয়ে আটকানো। এত লাল নীল আলোর ঝলকানিতে একটা অপার্থিব পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। মণীশ আর মায়া ওয়াশবার্ন টানেলের কাছাকাছি এসে দেখল আর সামনে যাওয়ার উপায় নেই। গাড়ি পার্ক করে হাঁটা শুরু করল। একটু এগোতেই এক ডেপুটি দাঁড় করিয়ে দিল। Stop Sir! You can’t go no more!
মণীশ কী করবে বুঝতে পারছিল না। অনুনয় করল, অফিসার! আমার মেয়ে স্কুলের মধ্যে আছে, আমাকে যেতেই হবে।
দশাসই চেহারার ডেপুটি বেশ কড়া ধাতের। কিন্তু মণীশের মুখের চেহারা দেখে নিশ্চয় বুঝেছে। চেহারার তুলনায় বেশ নরম গলায় বলল, বুঝতে পারছি। কিন্তু এখান দিয়ে তো যাওয়া যাবে না। বাচ্চাদের বাবা মাকে শিপ চ্যানেল ব্রিজের দিক দিয়েই শুধু যেতে দেওয়া হচ্ছে। অন্য কাউকে স্কুলের কাছে যেতেই দেওয়া যাবে না।
–থ্যাঙ্ক ইউ অফিসার। স্কুলে এখন কী অবস্থা একটু বলবে? কিছু প্রশ্ন করতে হয়, করা দরকার কিন্তু উত্তর না শোনার ইচ্ছাটা বেশি থাকে। এটা সেরকম একটা প্রশ্ন।
–এখনও কোনও ক্যাজুয়াল্টির খবর পাওয়া যায়নি। সাসপেক্ট তিন রাউন্ড গুলি করেছে, কিন্তু হাওয়ায়। মোটিভ বোঝা যাচ্ছে না। কোনও বাচ্চা ইঞ্জিওরড হয়েছে বলে খবর নেই। কথার সমতোল থেকেও লোকটা রাস্তার দিকে নজর রাখছিল। আরেক বাবা মা মণীশদের মতোই আসছিল। এবার তাদের থামাতে স্টে আউট! স্টে আউট! বলে এগিয়ে গেল।
শিপ চ্যানেল ব্রিজ থেকে নামতে নামতেই আরও কিছু গাড়ির জটলা চোখে পড়ল। কয়েকটা নিউজ চ্যানেলের গাড়িও। ওখানেই ব্যারিকেড করে দেওয়া হয়েছে। লোকজন তার বাইরে। জনা তিরিশ হবে। স্কুলের গেট এখান থেকে চার-পাঁচশো ফুট দূরে। বুঝল এর বেশি এগোনো যাবে না। গাড়ি থেকে নেবে মণীশ চেনা মুখ খুঁজছিল। দু-একজন পেরেন্টসকে চেনে। কিন্তু তাদের কাউকে দেখল না। ঠিক সেই সময়েই ওর চোখ বিজুর উপর আটকে গেল। এসে গেছে।
বিজু মিশেলের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল এক কোনায়। একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। মিশেল আর অ্যাডাম— ওদের মেয়ে সিন্থিয়াও ভেতরে আছে। মিশেলের মাথা অ্যাডামের বুকে, মাঝে মাঝে কেঁপে কেঁপে উঠছে মিশেলের শরীর। অ্যাডাম চুলে বিলি কেটে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে।
যখন ছিল পাশেই ছিল, এমন দূর থেকে এভাবে কবেই বা দেখেছে। স্কুল গেটের ধার ঘেঁষা একটা রেডবাড গাছের তলায় দাঁড়িয়ে বিজু। গাছের গোলাপি ফুলের পাপড়ি কয়েকটা ঝরে পড়েছে বিজুর মাথায়, পায়ের চারপাশে। বিজুর স্তব্ধ অবয়ব যেন পাথরের মূর্তি। অথবা ছুটতে ছুটতে কেউ গো স্ট্যাচু বলে দিয়েছে। ডান হাতটা গালের উপর, মাথাটা একটু ডানদিকে ঝুঁকানো। ওই ভঙ্গিতেই হয়তো অনেকক্ষণ।
এখনও সন্ধ্যা নামেনি। দিনের শেষ আলোয় তেমন রং নেই। তবু সেই বিবর্ণ আলোয় ওর কান্নাভেজা মুখ বেশ স্পষ্ট বুঝতে পারছে মণীশ। তিয়াসের সঙ্গে দেখা হয়, বিজুর সঙ্গে তো হয় না। বছর খানেক আগে শেষ দেখার দিনও বিজুর ওমনি কান্নাভেজা মুখ পিছনে ফেলে এসেছিল। সে মুখ আরও নরম ছিল, বহু ভাঙচুর। তবু ফিরে না তাকিয়েই বেরিয়ে যেতে পেরেছিল। কিন্তু আজ মনে হল কাছে থাকা দরকার। পাশে।
মায়া বিজুকে কোনওদিন দেখেনি। মণীশের চোখকে অনুসরণ করে খুঁজে পেয়ে গেল একা বিধ্বস্ত বিজুকে। মণীশের কাঁধে আসতে চাপ দিয়ে চোখের ইশারায় বলল, যাও। মণীশ ইতস্তত করছিল। মায়া ফিসফিস করে বলল, ওর তোমাকে দরকার হবে আজ। Por amor de dios, Go!
ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে যেতে মণীশের মাথায় ঘুরছিল কীভাবে শুরু করবে। এতগুলো বছর একসঙ্গে কাটিয়ে এসেছে, কত কথা বলেছে। কিন্তু একবার কথারা হারিয়ে গেলে, তাদের ল্যাজামুড়ো পাওয়া যায় না কিছুতেই। কী বলবে, কীভাবে বলবে তার মাপজোক করতে হয় এমন পরিবেশেও। মণীশ যখন প্রায় কাছে এসে গেছে বিজু চোখ তুলে তাকাল। ওর চোখভরা শূন্যতা দেখে বুকটা কেমন হু হু করে উঠল। একটু আগের দুবিধারা দমকা হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছিল। আসলে কোনও সম্পর্কই বোধহয় একদম মরে যায় না। ক্যামেরায় তোলা ছবির মতো কত কত দিনের স্মৃতি ফ্ল্যাশ লাইটের মতো ঝলসে উঠছিল চোখের সামনে। মণীশ যখন বলল, বিজু তুমি ঠিক আছ? তখন সেই স্বরে স্মৃতিরা জড়িয়ে ছিল।
বিজু কিছু বলতে চাইল। ঠোঁট কেঁপে কেঁপে উঠল, কিন্তু শব্দ বেরোল অনেক দেরিতে। আমাদের তিয়াস ঠিক নেই মণীশ। ওকে বোধহয় আর— বলতে বলতে দুহাতে জড়িয়ে মণীশের কাঁধে কান্নায় ভেঙে পড়তে পড়তে শেষ মুহূর্তে নিজেকে সরিয়ে নিল বিজু।
–It’s OK Biju. I am here for you and Tias. মণীশের বাড়ানো হাত বিজুকে ফিরিয়ে আনতে চাইছিল। কিন্তু বিজু এক পা পিছনে সরে গেল। নিজের চারপাশ গণ্ডি কেটে দিল দূরত্বের।
–কোনও খবর পেয়েছ?
নিঃশব্দে মাথা নাড়ল বিজু। মণীশ কী করবে বুঝতে পারছিল না। অনেকদিনের চেনা দুজন লোককে যখন অচেনার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হয় সে বড় যন্ত্রণার। সামনে না থাকলে একরকম। কিন্তু এরকম কোনও পরিস্থিতি এসে গেলে কী করবে বুঝতে পারা যায় না। মায়া দাঁড়িয়ে আছে অনেকটা দূরে, ক্লান্ত বিষণ্ণ প্রতিমার মতো।
বিজু, মণীশ, মায়া তিনটে বিন্দুর মতো, যাদের একটা রেখায় আনা যায় না।
চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাবা মায়ের মৃদু গলার কথোপকথন থেকে মণীশ অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছিল। বেশিরভাগ কণ্ঠস্বর কান্নায় জড়ানো বলে কথা খেয়ে যাচ্ছে, স্পষ্ট নয়। স্কুলের গেটের কাছে অন্তত পাঁচ সাতটা গাড়ি ক্রিশক্রশ করে রাখা। নিউজ চ্যানেলের একজন ঘুরে ঘুরে কথা রেকর্ড করার চেষ্টা করছিল। সেই কথা থেকে বুঝতে পারল দুজন ডেপুটি পেছন দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করছে। কিন্তু গুলি চললেও কেউ মারা যায়নি। শেরিফ মেগাফোন মুখে কিছু বলছে, এখান থেকে তার মানে উদ্ধার করা মুশকিল। হয়তো লোকটাকে কথা বলে বোঝানোর চেষ্টা করছে অথবা অন্যমনস্ক রাখছে যাতে পিছন দিয়ে ওরা ঢুকে যেতে পারে। এমনি সময়ে একটা শোরগোল। গেটের কাছে বন্দুকধারী ডেপুটিদের মধ্যে আকস্মিক তৎপরতা। এবার দেখা গেল একটা লোককে দুদিক থেকে বন্দুক ঠেকিয়ে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে। বাবা মায়েরা কথা থামিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই ওদের সামনে দাঁড়ানো পুলিশের লোকটা আটকে দিল। না এখনও নয়, অপেক্ষা করতে হবে আরেকটু।
বেশ অকিঞ্চিতকর চেহারার লোকটা গাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে ছটফট করে চেঁচিয়ে উঠল শ্যুট মি, শ্যুট মি বলে। কিন্তু এই মুহূর্তে তার কোনও দরকার ছিল না। ধাক্কা মেরে ওকে শেরিফের গাড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে দিতেই দাঁড় করানো অ্যাম্বুলেন্স থেকে দুটো স্ট্রেচার নিয়ে প্যারামেডিক্সের লোকজন দৌড়ে ঢুকে গেল স্কুলের গেট দিয়ে। বাবা মায়েদের সব চাঞ্চল্য থেমে গেল এক মুহূর্তে। তবে কি কোনও ক্যাজুয়াল্টি হয়েছে? কার? সবার চোখে এক জিজ্ঞাসা। মণীশ দেখল বিজুর ঠোঁট নড়ছে, কিন্তু কোনও শব্দ নেই। মণীশের বুকে কথারা জমাট বেঁধে গেছে। শুধু তিয়াসের মুখটা ভেসে উঠল মনের পর্দায়। ওকে সুস্থ দেখতে পাবে তো?
সেই মুহূর্তে পুলিশ রেডিওতে খবর এল। বাবা মায়েদের আটকে রাখা ডেপুটি একমুখ হেসে বলল, God is great! তোমরা ভয় পেও না। কেউ ইঞ্জিওরড হয়নি। কিন্তু বাচ্চাদের সাইকোলজিক্যাল স্ট্রেস হয়েছে খুব। প্রিলিমিনারি চেক করে যাদের ছেড়ে দেওয়া হবে তাদের একজন একজন করে নিয়ে আসা হচ্ছে। আমি নাম ডাকব, তোমরা তখন এগিয়ে এসে বাচ্চাদের নিয়ে নেবে। যাদের ফারদার চেক আপ করতে হবে তাদের হান্টিংটনের ট্রমা কেয়ারে নিয়ে যাওয়া হবে। ওদের বাবা মা অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গেও ওখানে যেতে পারে। নিজের গাড়িতে গেলেও অসুবিধা নেই।
তিয়াসের নামটা যখন ডাকা হল মণীশ ইতস্তত করছিল। বিজুরই আগে যাওয়া উচিত। ও পিছন পিছন।
একজন ডেপুটির হাত ধরে তিয়াস এগিয়ে আসছিল। মেয়েটার সারা মুখে ক্লান্তি, চোখে শুকিয়ে যাওয়া কান্না। বিজুকে দেখেই মাম্মি বলে ছুটে এল। বিজু ততক্ষণে হাঁটু গেড়ে রাস্তায় দুহাত বাড়িয়ে বসে পড়েছে। বিজুর মুখে মাথা গুঁজে ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদছিল তিয়াস। ওর ছোট্ট শরীরটা কান্নায় ফুলে ফুলে উঠছিল। বিজুর মুখে থেকে বেরোনো অস্পষ্ট শব্দেরা ওকে উষ্ণ কম্বলের আবিলতায় জড়িয়ে ফেলছিল দ্রুত। এই ছবিতে মণীশ আর কোনওদিন অংশগ্রহণ করতে পারবে না। তবু এক পা এগিয়ে নিচু হয়ে আলতো করে তিয়াসের মাথায় হাত রাখল। How are you Tias? Your daddy is here.
তিয়াস ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রথমে খুব কান্নাকাটি করলেও মেয়েটা খুব শক্ত। হয়তো জীবনের পালাবদল ওকে বয়সের তুলনায় সবল করে দিয়েছে বেশি। বিজুও কি হয়নি? ঘটনার আকস্মিকতায় একটু দুর্বল হয়ে পড়েছিল, কিন্তু ঠিক সময়ে নিজেকে সংযত করে নিয়েছে। আজ ভুল করেও মণীশকে স্পর্শ করে ফেললে এখন আত্মদাহ হত। তাই বলে তিয়াসকে আটকাবে না কোনওদিন। আদালতের হিসাবে মণীশের পনেরোদিনে একবার দেখা করবার অধিকার আছে। এরকম ঘটনায় ও এসে পড়বে সেটা স্বাভাবিক। তিয়াস যখন ড্যাডি বলে ওর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল কোনও অসুবিধা হয়নি বিজুর। যন্ত্রণা পেয়েছিল শুধু মণীশের গা ঘেঁষে মায়াকে দেখে। মায়াকে আগে কখনও দেখেনি বিজু। অদ্ভুত কমনীয়তা ওর মুখে, বেদনার ছায়ায় ঘিরে এক অনুপম সৌন্দর্যে টলটল সেই রূপ। রাগে জ্বলে উঠতে পারেনি কিছুতেই। এমন কি হালকা আঙুলে মেয়েটা যখন তিয়াসের চুল ছুঁয়ে দিল। তখনও। যেদিন থেকে তিয়াসের বাবা-মা দুটোই হওয়ার দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে, বিজু নিজেকে শুধু দুটো কথাই বলেছে। তিয়াসের কাছ থেকে ওর বাবাকে কোনওদিন সে কেড়ে নেবে না। পিতৃহীন বেঁচে থাকার শূন্যতা নিজে জেনেছে জীবন দিয়ে। মেয়ের সামনে নিজের ব্যবহারে এমন কিছু দেখাবে না যাতে বিয়ে নিয়ে ওর কোনও অপ্রীতিকর ধারণা গড়ে ওঠে। বাচ্চাদের মনে কোনও দিনকার কী ছবি সারা জীবনের জন্য ধরা পরে যায় কিছুতেই বলা যায় না। নিজের ছোটবেলায় বাবা মায়ের তীব্র তিক্ততাকীর্ণ বাদপ্রতিবাদ এমন কি শারীরিক লাঞ্ছনও দেখেছে। হয়তো তারও আগের সুখের স্মৃতি কিছু ছিল। অন্তত কোনও কোনও অ্যালবামে তেমন ছবি দেখেনি তা নয়। কিন্তু মনের অ্যালবাম থেকে সেগুলো মুছে গিয়ে শুধু রয়ে গেছে শেষ কদিনের ক্লেদ।
তবু জ্বালা তো হয় মানুষের। সে তো আর কোনও দেবী নয়। নেহাতই দোষেগুণে ভরা এক মানুষ। সব কিছু চুকেবুকে যাওয়ার পর মনটা তাই বিক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছিল বারবার। মণীশের জীবন তো ভরে গেছে, পেয়ে গেছে তার প্রেমিকাকে। তিয়াসের জন্য নিয়ম করে টাকা দেওয়া আর পনেরো দিনে একবার দেখা করেই খালাস। কিন্তু সে? মায়ের মতো সেও কি সারা জীবন একা লড়াই করতে করতে ধীরে ধীরে খিটখিটে আর একরোখা হয়ে যাবে? কিংবা তিয়াসের কিছু হলেই নিজেকে দুষে বেড়াবে। যেমন এখন?
বারেবারে সেই কথাটাই মনে হচ্ছিল। ছোট্ট তিয়াসকে স্কুল ছুটির পর আফটার কেয়ারে থাকতে হয় রোজ। তা না হলে এই গানম্যান যখন স্কুলে ঢুকল ওর তো বাড়িতে থাকারই কথা। যদিও এটা স্কুল চলার সময়েও হতে পারত, কিন্তু এই মুহূর্তে সেই লজিক্যাল ধারণাগুলো তুচ্ছ হয়ে যাচ্ছে বিজুর কাছে। মনে হচ্ছে কিছুটা দোষ তার নিজেরও। কেন নিজের মাথায় এত কাজ রাখে যে অফিসের নিয়মকরা সময়ের বাইরেও এমন খেটে মরতে হয়? তাছাড়া এই ঘটনার পর কয়েকদিন আফটার কেয়ার বন্ধ থাকতে পারে বলে স্কুল জানিয়ে দিয়েছে আজ সন্ধ্যাবেলায়। ওদিকে প্ল্যান্টে সাইট কমিশনিং-এর কাজ চলছে, সব তার দায়িত্বে। কী করে সামনের কটা দিন সামলাবে সেটাই ভাবছিল বিজু। এখন দুদিন তিয়াসকে স্কুলে না পাঠাতে হলে ভালো হত। ভবিষ্যতেও ওকে এমন আফটার কেয়ারে রাখতে পারবে কি না জানে না। ট্রমা শুধু তিয়াসের নয়, তার নিজেরও। চিন্তায় মাথাটা ঝাঁ ঝাঁ করছিল বিজুর।
এমন সময় বারবার করে বেল বেজে উঠল। রাত সাড়ে আটটা বেজে গেছে। কে এল এখন কে জানে। সন্ধ্যা থেকে বেশ কিছু ফোন এসেছে। লোকের সমবেদনা গ্রহণ করাটাও একটা বিশাল কাজ। দরকারে কাউকে পাশে পাওয়া যাবে ভাবতে ভালো লাগে, কিন্তু সময় যাদের ভেবেচিন্তে খরচ করতে হয় তাদের পক্ষে সামাজিকতার দাবীটা বড্ড চাপ।
দরজা খুলতেই দেখে সুভদ্রাবৌদি, মৃণালদা, জয়ন্ত, কোমলা।
–কী হয়েছে বিজু, আমাকে একবার জানাতে হয় না? গলায় আর্দ্রতা নিয়ে বিজুকে দুহাতে জড়িয়ে ধরতে ধরতে বলল সুভদ্রা। বিজুর কী হল নিজেই জানে না। সুভদ্রা বৌদির বুকে মুখ গুঁজে হাইহাউ করে কেঁদে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে কণ্ঠনালীতে কষ্ট হচ্ছিল, দম আটকে আসছিল যেন। এ কান্না কি শুধু আজকের না এতদিনের জমানো কষ্টের কে বলতে পারে। কিন্তু স্বয়ংসম্পূর্ণ হবার সাধনায় আত্মস্থ বিজু আজ নিজেকে আটকানোর চেষ্টাও করল না। সুভদ্রা বিজুর মাথা কোমল হাতে বুলিয়ে দিচ্ছিল। বাচ্চা ভুলানোর নরম ভালোবাসায় বারবার বলতে থাকল আমরা আছি না বিজু তোর পাশে, আমরা আছি তো সবাই।
মণীশের সঙ্গে ছাড়াছাড়ির সময় থেকে স্থানীয় বন্ধুসমাজকে দুহাতে ঠেলে রেখেছিল বিজু। নিজে থেকে কারও কাছে হাত পাতেনি সাহায্যের। কেউ যেচে ফোন করলেও নিজের বুকের কপাট আলগা করেনি। জিততে ভালোবাসা বিজু টিপিক্যাল হেরোদের মতো বালিতে মুখ গুঁজেছিল কি? সেই কথা মনে করে সুভদ্রা বৌদির বুকের নরম উষ্ণতা থেকে মাথা সরিয়ে সলজ্জ হাসল বিজু। তোমার এত সুন্দর জামাটা একদম ভিজিয়ে দিলাম ছিঃ!
কোমলা এগিয়ে এল। বেশ করেছ। কোনও কোনও সময়ে মানুষের হালকা হওয়ার জন্য নিজেকে উজাড় করে দিতে হয়। কিন্তু আমাদের সাহসী মেয়েটা কোথায়? ওর জন্য এত্ত বড় একটা চকোলেট আনলাম, ওকে তো দেখছি না।
–ও ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে গো। দাঁড়াও ডেকে দিচ্ছি।
মৃণালদা বলল থাক থাক। এখন যত ঘুমাবে তত তাড়াতাড়ি এই ট্রমা থেকে বেরোতে পারবে। ভিতরে চলো আর এইগুলো তুলে রাখো দেখি।
মৃণালদার হাতে একটা ঢাউস টিফিন ক্যারিয়ার। জয়ন্তর হাতে প্লাস্টিকে মোড়া স্টাফড মারমেড। একটা অদ্ভুত কৃতজ্ঞতায় একটু আগের শূন্যতার অনুভূতি দ্রুত বুঁজে যাচ্ছিল। সব কিছু একা করতে হবে ভাবনাটা একটা জেদের জন্ম দেয়, আর করতে হবে না এই নিশ্চিন্ততা জীবনের নরম শাঁসটা বাঁচিয়ে রাখে। বিজু হাত ধরে লিভিং রুমে টেনে নিয়ে চলল সুভদ্রাবৌদিকে, পিছনে পিছন আর সবাই।
মৃণালদা বসতে বসতে বলল, দেখো আমরা সবাই টিভিতে দেখেছি কী হয়েছে, তাই সেসব কথা শুনতে চেয়ে তোমার দুঃখের মুহূর্তগুলো আবার করে জাগিয়ে তুলতে চাই না। শুধু একবার বলে দাও আমাদের তিয়াস সোনার কিছু হয়নি তো, কোনও ব্যাথা পায় নি।
সুভদ্রাবৌদি মৃণালদাকে এক কথায় নাকচ করে দিল। সেসব বললে হবে না। আমি বাবা শুনব সব বিজুর মুখ থেকে। প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান শোনার মজাই আলাদা। কারও যখন কিছু হয়নি, সবাই সুস্থ আছে তাহলে মুখ ঝুলিয়ে বসে থাকার কিছু নেই। কী বল বিজু?
–শোনো আর তারপর পার্টিলাইনে সেই নিয়ে দশ কাহন করো। মৃণালদাকে একটু বিরক্ত মনে হল।
–হ্যাঁ, হ্যাঁ পার্টি পার্টি! জয়ন্ত সোৎসাহে ঘাড় দোলাল। আমার গাড়ির ডিকিতে একটা বিয়ারের প্যাক আছে। নিয়ে আসি?
তার দরকার নেই জয়ন্ত। আমার ফ্রিজিডেয়ারে থাকবে কয়েকটা। সেগুলো বরং ঠান্ডা হবে বেশি। জয়ন্তর অতি উৎসাহে রাগ না করে ভালোই লাগছিল বিজুর, সারা দিনের টানাপোড়েনের পর একটু বাতাস বইতে দেওয়া ভালো।
বিজুর মুখে শুনতে শুনতে সবাই কম বেশি প্রশ্নোত্তরে ডুবেছিল। কোমলা বলল, টিভিতে দেখলাম যে লোকটা ঢুকেছিল বয়েস বেশি নয়, বছর চব্বিশের একটা লোক। ডিপ্রেশান থেকে সুইসাইড করার চেষ্টা করছিল। নিজে করতে পারছিল না, ভেবেছিল এইরকম কিছু করলে পুলিশের গুলি খেয়ে মরতে পারবে। অদ্ভুত না?
–ও তাই! সেই জন্যেই লোকটা কাউকে গুলি ছোঁড়েনি, হাওয়ায় ছুঁড়েছিল। আহা রে! ওর কষ্টটাও ভাব।
সুভদ্রা বৌদির কথায় জয়ন্ত হাঁ হাঁ করে উঠল। ওর মরতে ইচ্ছে হয়েছে বলে এতগুলো বাচ্চাকে এইভাবে আটকে রাখবে? কেউ মারা যায়নি ভালো কথা, কিন্তু এই ঘটনা থেকে কতরকমের সাইকোলজিক্যাল ট্রমা ডেভেলপ করতে পারে ভেবেছ?
–কথা হল এরা এত সহজে হাতে বন্দুক পায় কী করে কে জানে!
–সেকেন্ড অ্যামেন্ডমেন্ট রে বাবা, বন্দুক হাতে রাখা ওদের বার্থ রাইট। আঠেরো হল তো গটগটিয়ে দোকানে ঢুকে বন্দুক ঝুলিয়ে বেরিয়ে আসবে।
–আর স্কুলের বাচ্চাদের সিকিউরিটি কে দেখবে? আমাদের বাচ্চাগুলোর জীবন?
–আমার কী ভয় করে জানো? সুভদ্রাবৌদি চিন্তিত গলায় বলল, শোভনটা বড় হচ্ছে। আঠেরো হলেই ও যদি এমনি বন্দুক বাগাতে চায়, তখন কী করব?
মৃণালদা উড়িয়ে দিল। শোনো আমরা হলাম কলমের গাছ। বাঙালি মায়ের রূপরস চাড়িয়ে দেওয়া আছে কলমে। বললেই অমন বন্দুক ধরে ফেলব নাকি?
–কেন বাঙালি স্বদেশি করেনি? বোমা ছোঁড়েনি? অতদূরের কথাই বা কেন? নকশাল আন্দোলনের সময় কম বোমা বন্দুক চলেছে?
–এখনও হচ্ছে। দেশের কাগজ পাও না বলে জানো না। আমার কাছে সপ্তাহে সপ্তাহে আনন্দবাজার আসে। সিপিএম আর কংগ্রেস— এখন আবার হয়েছে তৃণমূল। এ একে মারছে, ও ওকে কোপাচ্ছে। বন্দুক ওখানেও আছে, তবে ইললিগ্যালি।
–সে তবু দলের লোক মরছে, রাজনীতি থেকে। এখানে তো যেদিকে তাকাই ডিপ্রেশান আর সাইকোতে ভর্তি। আমাদের ছেলেমেয়েদের এই মেন্টাল কেসের ফ্যাশান থেকে কীভাবে যে বাঁচাব!
–ওটা পরিবার থেকে আসে। পরিবার মানে শুধু নিজের পরিবার নয়, এই যে আমরা দশ বিশ মাইল দূরে দূরে থেকেও প্রতিবেশী— এ এক বিশাল ছাউনি। Antidote to mental depression.
জয়ন্ত ভালো আবৃত্তি করে। বলে উঠল— আয় আরও হাতে হাত রেখে, আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি।
–বাঃ বাঃ বেড়ে লিখেছ তো জয়ন্ত। মৃণালদা খুব খুশি হয়ে উঠলেন। বেশ কথাটা বেঁধে বেঁধে থাকি, সেইভাবেই আছি কিন্তু আমরা। সেইভাবেই থাকতে হবে।
–আরে না না, আমি কেন লিখব মৃণালদা। এ তো শঙ্খ ঘোষের একটা বিখ্যাত কবিতা, হঠাৎ মনে পড়ে গেল।
এমনি সময়ে ফুঁফাতে ফুঁফাতে তিয়াস উঠে এলো। মাম্মা, মাম্মা বলে ঝাঁপিয়ে পড়ল বিজুর কোলে।
–কী হয়েছে সোনা? স্বপ্ন দেখেছ কোনও? মায়ের স্পর্শে আস্তে আস্তে শান্ত পুঁটুলির মতো হয়ে ঝুলতে থাকল তিয়াসের শরীরটা বিজুর কোল থেকে।
–আমাদের দিকে একবার তাকাবি না তিয়াস মনা? দেখ তোর জন্যে কী এনেছি। তিয়াস একচোখ খুলে পিটপিট করে তাকাল কোমলার দিকে। কোমলার হাতে মারমেড আর চকোলেট দেখে আস্তে আস্তে পুরো মাথাটা তুলে সোজা হয়ে বসল। মায়ের দিকে তাকিয়ে সম্মতি পেতেই ছুট্টে গিয়ে কোমলার কাছ থেকে হাত বাড়িয়ে নিল পুতুলটা। নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছিল এবার। কোমলার পাশে বসে সোফা থেকে ঠ্যাং ঝুলিয়ে দোলাল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, You guys know what happened with me today? ওই রিনরিনে গলায় অমনভাবে অন্যদিন বলতে শুনলে হয়তো হেসে ফেলত সবাই। কিন্তু আজ বিজু একটু সন্ত্রস্ত হল। নিজেও বেশি কিছু জানতে চায়নি আজ, চায়নি ছোট্ট মেয়েটা নতুন করে ওই দুঃস্বপ্নের মুহূর্তগুলো নিয়ে ভাবুক। তাড়াতাড়ি বলে উঠল, Sweety pie, I have already told them you were very brave and did not cry much.
–হ্যাঁ হ্যাঁ তিয়াস সোনা ইজ দ্য চ্যাম্প! মৃণালদাও কথাটা চাপা দেওয়ার চেষ্টায় ছিল।
–কালকের কথা কী ভেবেছিস বিজু? তুই যে বললি তোর প্ল্যান্টে কমিশনিং চলছে, না গেলে খুব বিপদ।
–তাই তো ভাবছি বৌদি। স্কুলে দুই-তিনদিন পাঠাতে চাইছি না। গ্রেচেন ডে কেয়ারটায় আগে থেকেছে, ওখানে দেব ভাবছি। তবে পারমানেন্টলি এবার কাউকে হাউজকিপার পাওয়া যায় কিনা দেখতে হবে। আগে একবার রেখেছিলাম, একটু ব্যাড এক্সপিরিয়েন্স আছে।
–শোন কালকেই ওর স্কুলে ফিরে না যাওয়াই ভালো। কিন্তু প্রথমদিনটা বাড়ির পরিবেশ বেটার হবে। আমি অফ নিয়ে নেব কাল, তোর অসুবিধা না থাকলে আমার বাড়িতে থাকুক না হয়।
–আমার জন্য তুমি ছুটি নষ্ট করবে? সুভদ্রাবৌদির প্রস্তাবে খুব অবাক হয়ে গেছিল বিজু।
–নষ্ট? দ্যাখ আমরা সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে এই কটা বাঙালি পরিবার। আত্মীয়পরিজনের মতো একসঙ্গে জীবন। একে অপরকে না দেখলে কী করে হবে বল তো? তোর জন্য কী দূর হয়ে যাবে পৌঁছে দেওয়া? তা না হলে না হয় আমি এসে নিয়ে যাব।
মৃণালদা সায় দিল। এই যে শুনলে না বেঁধে বেঁধে থাকার কথা? সেইটাই। শুধু কথায় তো চিঁড়ে ভেজে না বাবা, কাজেও দেখাতে হয়।
–আত্মীয়তা শুধু মজা লোটার জন্য তো হয় না। আমার বোনের ছেলেটার জন্য কোনওদিন কিছু করতে পারিনি, তুই আমার বোনের থেকে কম কী রে? তোর মেয়ের জন্য একদিন অফ নিলে সেটা নষ্ট করা বলবি না খবরদার। সুভদ্রাবৌদির কথায় আন্তরিকতার ছোঁয়াটা এত বেশি ছিল যে আবার চোখ জলে ভরে এল বিজুর। দেখেছ, আজ কী হয়েছে কথায় কথায় ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে ফেলছি বাচ্চাদের মতো।
–তবে পার্মানেন্ট ব্যাবস্থা যদি চাস তাহলে আমি একজনের খোঁজ দিতে পারি বিজু। সেরেনা বলে একজন আমার বাড়িতে বছর দেড়েক ছিল শোভন ছোট থাকার সময়। দশ বছর হয়ে গেছে, কিন্তু মহিলা এত ভালো ছিল আমার সঙ্গে এখনও যোগাযোগ আছে। বাড়িতে পার্টি থাকলেই হেল্পের জন্য ডেকে নিই। মাস দুয়েক আগেও আমার কাছ খোঁজ করছিল সবসময়ের কোনও কাজ আছে কি না। কথা বলবি?
–তাহলে তো খুব ভালো হয় বৌদি। প্লিজ ওর সঙ্গে কথা বলে আমার কাছে কালকেই পাঠিয়ে দাও। আস্তে আস্তে ওর সব কটা মুশকিল আসান হয়ে যাচ্ছে যেন। সন্ধ্যাবেলায় কেমন নেতিয়ে পড়ছিল, এখন আবার চনমনে লাগছে।
ওরা চলে যাওয়ার পরে তিতাসকে আবার ঘুম পাড়াতে পাড়াতে সেই কথাই ভাবছিল বিজু। মৃণালদা খুব মজার মজার কথা বলে। যাওয়ার সময় বলছিল, যেটা বলেছি মনে রেখো, আমরা হলাম এক কলমের গাছ। আমাদের বাড়ি তোমার বাড়ি থেকে বিশ মাইলের বেশি দূরে হলেও মনেপ্রাণে আমরা তোমার প্রতিবেশী। কু ডাকলে সাড়া দিতে পারব না, কিন্তু আমাদের পার্টি লাইন যুগ যুগ জিও। এইসব ভাবতে ভাবতে তিয়াসের খাটেই কখন গুড়িমুড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল নেই। কপালের ভাঁজগুলো মুছে ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি ঝুলছিল এখন। ব্লাইন্ড নামানো জানালা দিয়ে চাঁদের আলো এসে ছড়িয়ে পড়ছিল মা মেয়ের মুখে। সূর্য ডুবলেই আলো ফুরায় না, রাতের আকাশেও সৌন্দর্য আছে অঢেল।
(এরপর আগামী সংখ্যায়)