শুভাশিস মৈত্র
প্রাবন্ধিক, গদ্যকার, সাংবাদিক
স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। একটা শিক্ষিত, শিল্পোন্নত ইওরোপের অন্যতম প্রধান দেশ ১৯০ বছর দখলে রেখে লুণ্ঠনের পর, যখন তারা ভারত ছেড়ে চলে গেল, আমাদের দেশের সেই সময়ের সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ১২ শতাংশ। এইরকম অবস্থায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় জওহরলাল-প্যাটেলরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, দেশের সব মানুষ একটি করে ভোট দিয়ে সরকার নির্বাচন করবে। সবার জন্য ভোট, এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে ইংল্যান্ড, আমেরিকাকে বহু বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ভারতে সে নিয়ম চালু হয়েছিল স্বাধীনতার পর ১৯৫২ সলের প্রথম নির্বাচন থেকেই। ১২ শতাংশ সাক্ষরের দেশে এমন একটা সিদ্ধান্ত, মানুষের উপর অফুরন্ত আস্থা এবং ভরসা না থাকলে নেওয়া যায় না। এই সিদ্ধান্ত ছিল প্রকৃত বামপন্থী এবং বৈপ্লবিকও বটে। যদিও এটা ঠিক, দেশের প্রধান বামপন্থী দলের অনেক নেতাই দেশ যে স্বাধীন হয়েছে, সে কথাটাই তখন মানতে চাননি।
নতুন ভারতের জন্ম হল। হিন্দুস্তানের যাত্রা শুরু হল। শুধু মুসলমানের জন্য পাকিস্তান, তেমন দেশ জিন্নারা চাইলেও, গান্ধি, জওহরলালরা চাননি যে এই সদ্যোজাত ভারত নামের দেশটি শুধুমাত্র হিন্দুর দেশ বলে পরিচিতি লাভ করুক। তাঁদের মত ছিল, যাঁরা ভারতে থেকে গেলেন, তাঁরা সবাই ভারতীয়। মুসলিম সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ পাকিস্তানে চলে গেলেও স্বেচ্ছায় তাঁদের মধ্যে অনেকেই থেকে গেলেন তাঁদের জন্মভূমি প্রিয় ভারতবর্ষে। ১৯৫২ সালে যখন দেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন হল, হিলাল আহমেদের ‘সিয়াসি মুসলিম’ বই ধেকে আমরা সেই সময়ের জানতে পারি; উনি লিখেছেন— মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় শতাংশের বিচারে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকার থেকে বেশি ভোট পড়েছিল। এই বাড়তি ভোট বাড়তি দেশপ্রেমের কথাই বলেছিল। যে দেশপ্রেমের আন্তরিকতা নিয়ে আজ এত বছর পরে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে! অপছন্দের প্রশ্নের মুখে প্রকাশ্যে জবাব দেওয়া হচ্ছে, না পোষালে সোজা পাকিস্তান চলে যাও।
স্বাধীনতা অর্জনে বাঙালির ভূমিকা ছিল উজ্জ্বল। বাঙালির বহু অবদানের মধ্যে খুবই উল্লেখযোগ্য হল, দুটি বাংলা শব্দ। ‘বন্দে মাতরম’। কাশ্মির থেকে কন্যাকুমারিকা, এই বাংলা বোঝেন না এমন মানুষ নেই। এর জন্য বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে বাঙালি ঋণী। ঠিক তেমনই দুটি শব্দ, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের শহিদ, রামপ্রসাদ বিসমিল, আসফাকুল্লা খান, ভগৎ সিং, চন্দ্রশেখর আজাদদের সংগঠন ‘হিন্দুস্তান সোসালিস্ট রিপাবলিক অ্যাসোসিয়েশন’-এর স্লোগান ছিল ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। এই দুটি শব্দও বন্দে মাতরমের মতোই পরিচিত সারা দেশে। এই স্লোগানের জন্মদাতা স্বাধীনতা সংগ্রামী উর্দু কবি হসরত মোহানি, যাঁর আসল নাম সৈয়দ ফজলুল হাসান।
আজাদ হিন্দ সরকারেরও আগে, ১৯১৫ সালের ১ ডিসেম্বর কাবুলে যে অস্থায়ী ভারত সরকার তৈরি হয়েছিল তার রাষ্ট্রপতি ছিলেন রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপ। দু খণ্ডে লেখা রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপের আত্মজীবনী ‘মাই লাইফ স্টোরি’, তাতে ১৮৮৬-১৯৭৯-এর বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। সেই সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন মৌলানা বরকতুল্লা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মৌলানা উবাইদুল্লা সিন্ধি, বিদেশমন্ত্রী চম্পক পিল্লম। আরএসএস সংগঠনের ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে কার্যত কোনও ভূমিকাই ছিল না। সেটুকু বাদ দিলে, দেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভারতের সব প্রায় সব সংগঠনকে, সব ধর্মের মানুষকেই পাওয়া যাবে। রয়েছে তাঁদের আত্মত্যাগের ইতিহাসও। অবশ্যই আরএসএস বাদে, যাদের রাজনৈতিক সংগঠনের নাম বিজেপি।
এই বাংলায়, মুসলমান সংস্কৃতির সঙ্গে বাংলা তথা ভারতীয় সংস্কৃতি, হিন্দুদের সংস্কৃতি, কীভাবে মিশে রয়েছে তার কিছু নমুনা আমাদের দেখিয়েছেন ডঃ শহিদুল্লাহ। তিনি তাঁর লেখায় দেখিয়েছেন, কীভাবে তখতপোষ, তোষক, তাকিয়া, বালিশ, এবং গালিচার ব্যবহার বাইরে থেকে আসা মুসলমানদের থেকে হিন্দু বাঙালিরা শিখেছে। ইসলাম ধর্ম আসার আগে বাঙলায় এগুলোর চল ছিল না। মুসলমান আগমনের আগে হিন্দু বাঙালির পোশাক ছিল ধুতি, গায়ের কাপড় উড়ানি, জুতো এবং মহিলাদের শাড়ি। বাঙালি হিন্দু এবং বাঙালি মুসলমান সেলাই করা পোশাক পরা শেখে বাইরে থেকে আসা মুসলমানদের থেকে। মুসলমান আসার আগে বাঙালিদের মধ্যে দর্জি বলে কোনও পেশা ছিল না। যে কারণে এখনও পূজা-পার্বণে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হিন্দু বাঙালি সেলাই-ছাড়া পোশাক পরে। মুসলমানের কাছে হিন্দু বাঙালি জামা, মোজা, কামিজ, রুমালের ব্যবহার শিখেছে। আপনি গোটা রামায়ণ মহাভারত খুঁজে কোনও রুমাল পাবেন না। আতর, গোলাপজল, সাবান, চশমার ব্যবহার আমরা শিখেছি মুসলমানের থেকে। ঢোল (দহল), সেতার, তবল, রবাব নামের বাদ্যযন্ত্র মুসলমানের হাত ধরে ভারতে প্রবেশ করেছে। পোলাও, কোর্মা, কোফতা, কালিয়া, কাবাব, শিরকা, আচার, মোরোব্বা, শরবৎ, শিন্নি, পনির, চিনি, হালুয়া বাঙালি খেতে শিখেছে বাইরে থেকে আসা মুসলমানের কাছে। মুসলমানরাই এদেশে শালগম, তরমুজ, খরবুজ, নাশপাতি, তুত, পেস্তা, বাদাম, আঙুর, মুনাক্কা, এবং পুদিনা এনেছে। আগে হাট বসত সপ্তাহে একদিন বা দুদিন। এখনও অনেক জায়গায় সে নিয়ম আছে। সব সময় যেখানে জিনিসপত্র খরিদ করা যায়, এমন বন্দোবস্ত আগে বাংলায় ছিল না। মুসলমান আসার পর বাজার, দোকান, মুদিখানার যাত্রা শুরু হয়। আর হিন্দু বাঙালি শিখল নতুন শব্দ, পাল্লা, মুনাফা, লোকসান, নমুনা, বদল, রসিদ, বেবাক, বাকি, ফাজিল, জমা, খরচ, হিসাব, নিকাশ, তহবিল, ফর্দ, বায়না, সরবরাহ, মৌজুদ, দাদন, নগদ, মন, সের, গজ ইত্যাদি। মুসলমানরাই প্রথম এই দেশে ব্রাহ্মণ থেকে চণ্ডাল, সবার জন্য এক আইন চালু করে। সেই কারণেই উকিল, মোক্তার, আইন-কানুন, এগুলো একটাও সংস্কৃত শব্দ নয়। এইসব বৃত্তিও চালু হয় মুসলমান আমলে। এভাবেই সাল, তারিখ, রোজ, ওজর, কর্জ, ক্রোক, খাজনা, খুন, জখম, জবাব, জবানবন্দি, জমা, জমি, জায়গা, জল্লাদ, জাল, জোর, দখল, দফা, দাগি, দাঙ্গা, নকল, নাবালক (ফার্সি— বালেগ থেকে), নালিশ, পেশা, ফেশাদ, ফসল, ফেরেব, ফেরার, বাকি, বাতিল, বাবৎ, রায়ত, মাফ, মুনিব, রদ, রাজি, রফা, সাজা, সুদ, হক, হুকুম ইত্যাদি আরবি, ফার্সি শব্দ বাঙালির অস্থি-মজ্জাগত হয়ে ওঠে। মুসলমান বাদশা, নবাবদের দেওয়া উপাধি কানুনগো, সরখেল, মহলানবিশ, খাশনবিশ, মল্লিক, রায়, সরকার, খাঁ, মজুমদার, মুস্তফি, মুনশি প্রভৃতি আমাদের সবার পরিচিত।
মুসলমান শাসনকালেও এই বাংলার সমাজ কেমন ছিল তার একটা বিবরণ আমরা পাই, মধ্যযুগে বাংলায় হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক নিয়ে ১৯৮০ সালের ১২ এবং ১৩ জুলাই জগদীশ নারায়ণ সরকার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এ যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন (পরে বই হয়ে প্রকাশিত), তা থেকে। কয়েকটি উদ্ধৃতি এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক।
…চাটিগাঁয়ে (চট্টগ্রামে) হুসেন শাহের সেনাপতি লস্কর পরাগল খান ও তাঁহার পুত্র নসরৎ (ছুটি) খানও গৌড়ের অনুরূপ সাংস্কৃতিক পরিবেশ গঠন প্রচেষ্টায় বাঙালি (হিন্দু) কবির পৃষ্ঠপোষকতা করেন। পরাগল খানের পোষকতায় কবীন্দ্র পরমেশ্বর মহাভারতের আদিপর্ব হইতে স্ত্রী পর্ব পর্যন্ত প্রথম বঙ্গানুবাদ করেন।
কেমন ছিল সেই সময়ের সমাজ বলতে গিয়ে জগদীশ নারায়ণ বলছেন,
রামায়ণ, মহাভারত ও শ্রীমদ ভাগবত এই তিনটি পবিত্র সংস্কৃত গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ মাতৃভাষায় চিত্রিত লৌকিক সাংস্কৃতিক প্রাধান্যের প্রতীক স্বরূপ। ইহা জনসাধারণের, হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরই মানসিক চাহিদা পূরণ করে। পরেমশ্বরের পরাগলী মহাভারতের প্রভাব তৎকালীন বংলার হিন্দু ত’ বটেই, মুসলমান সমাজেও এত গভীর ছিল যে সমসাময়িক প্রখ্যাত লেখক সৈয়দ সুলতান লিখিয়াছেন (হিন্দু এবং) মুসলমান ঘরে ঘরে ইহা পাঠ করিত এবং কেহই ঈশ্বর ও তাহার পয়গম্বরকে মনে রাখিত না।
মেঘনাদ দেশাই তাঁর ‘দ্য রাইসিনা মডেল’ বইয়ে লিখেছেন,
Indian history is full of small large kingdoms. There were a few large empires— the Maurya, Gupta and Mughal empires in the north and Chola, Pandya and Vijaynagara in the south— but none of them encompassed what became India on 15th August 1947 (despite Partition). The north-east remained beyond the reach of all emperors. …. India has never been a single administrative entity of this sort (China) …. Empires based in Delhi seldom advanced to the south of the Vindhyas; those with their principal territory in the south seldom went north … India as an old civilization is a cultural idea, a religious community, but it was not a territorial idea, not a nation state, till the time of independence.
অর্থাৎ হিন্দুত্বাদীরা যে হিন্দু, হিন্দি, হিন্দুস্তান এবং এক দেশ এক ধর্মের ভারতের ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালাচ্ছে, ভারতের ভৌগোলিক চরিত্র তেমন কোনওদিনই প্রায় ছিল না। ফলে, ভারতীয়ত্ব বলতে বৈচিত্রই প্রাধান্য পেয়েছে যুগ যুগ ধরে। এক ভাষা এক মত এক পরিধানের দেশ ছিল না বলেই তার এত জোরালো, স্পষ্ট আঞ্চলিক পরিচয় প্রদেশে প্রদেশে। তাকে জয় শ্রীরাম-এর স্লোগান দিয়ে বাঁধা যাবে না। বন্দে মাতরম দিয়ে বাঁধা গিয়েছিল, কারণ তখন একটা সাধারণ শত্রু ছিল, বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ। আর তাই, হিন্দু, হিন্দি, হিন্দুস্তানের তত্ত্বকে বৈচিত্রময় ভারতের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে, হিন্দুত্ববাদীরা দেশের ভিতরে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিকল্প শত্রু খুঁজে বের করেছে— মুসলিমদের। স্বাধীনতার ৭৫ বছরের শেষ পর্বে এসে একটা জোরালো প্রচার চালানো হচ্ছে, ‘মুসলিম ভোটব্যাঙ্ককে’ তুষ্ট করতে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলি হিন্দুদের বঞ্চিত করে মুসলিম তোষণের রাজনীতি করছে। এই মিথ্যা ফাঁস করতে সম্প্রতি ‘অকার প্যাটেল’ তাঁর ‘আওয়ার হিন্দু রাষ্ট্র’ বইয়ে বিভিন্ন রিপোর্ট উল্লেখ করে দেখিয়েছেন, এই তোষণের অভিযোগ শুধু যে মিথ্যা তাই নয়, সাধারণভাবেই মুসলিমরা পিছিয়ে আছেন সব অর্থেই। স্বাধীনতার সময় বলা হয়েছিল ভারতে যারা আছেন তারা সবাই ভারতীয়। হিন্দুত্ববাদীরা এখন বলছেন, ভারতে যারা আছেন তারা সবাই হিন্দু। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ধর্ম নিয়ে কোনওরকম বৈচিত্রকেই তারা আমল দিতে রাজি নয়। প্যাটেল লিখেছেন, ভারতে এতদিনেও জম্মু-কাশ্মির বাদে কোনও রাজ্যে কোনও মুসলিম মুখ্যমন্ত্রী ফুল টার্ম মানে টানা পাঁচ বছর মুখ্যমন্ত্রী থাকতে পারেননি। জনসংখ্যার শতাংশের বিচারে লোকসভায় ৭৪ জন মুসলিম সাংসদ থাকার কথা। কিন্তু তা কখনওই ঘটেনি। লোকসভায় সবচেয়ে বেশি মুসলিম সাংসদ ছিলেন ১৯৮০ সালে। সংখ্যাটা ছিল ৪৯।
সম্প্রতি অসম এবং উত্তরপ্রদেশ তাদের টু-চাইল্ড পলিসি ঘোষণা করেছে। দুই রাজ্যেই বিজেপি সরকার। উত্তরপ্রদেশে সামনে ভোট। কলকাতার ‘ইনস্টিটিউট অফ ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ’-এর গবেষক শুভনীল চৌধুরী এবং শাশ্বত ঘোষ সম্প্রতি ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলেছেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির ভয় এই দুই রাজ্যে একেবারেই অমূলক, কাল্পনিক। বরং বলা যায় অসমে জনসংখ্যা এবার কমতে শুরু করেছে। উত্তরপ্রদেশও খুব তাড়াতাড়ি সে জায়গায় পৌঁছাবে। তাঁদের লেখা থেকে একটু দীর্ঘ উল্লেখ এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক:
The Chief Ministers of these States don’t seem to have read the document on population projection, published by the Union Ministry of Health and Family Welfare in 2019. According to this document, U.P. will reach a replacement rate (the rate at which women give birth to enough babies to sustain population levels) of 2.1 by 2025, and Assam by 2020. If the replacement fertility rate has already been achieved in Assam and will be achieved by 2025 in U.P., what is the need for any drastic population policy?
Decreasing fertility rates
The need arises because population policy is an important weapon in the arsenal of the Hindutva brigade to attack the Muslim population in the country. The Assam Chief Minister’s ‘population army’ in Muslim areas and the U.P. Chief Minister’s many utterances prove this. However, even on this score, their policy framework is wrong. According to the National Family Health Survey (NFHS)-2 data, the total fertility rate (TFR), which is the average number of children that women of reproductive age group have had in their lifetime, in 1998-99 in U.P. was 3.87 for Hindus and 4.76 for Muslims. In 2015-16, it decreased to 2.67 for Hindus and 3.1 for Muslims. This means that the TFR declined by 1.2 for Hindus and by 1.66 for Muslims, which is higher. The NFHS-5 data for 2019-20 for U.P. have not been published. When it is published, data will show that the fertility rate for both Hindus and Muslims has declined even further.
তাহলে কেন এই উদ্যোগ হিন্দুত্বাদীদের? কারণ দেশের ভিতরে একটা ‘শত্রু’ ছাড়া তারা ভোটে জিততে পারবে না। এটা হল বর্তমানের শত্রু। এর সঙ্গে আছে অতীতের শত্রু। মুসলিম শাসকরা (যদিও শাসকের কোনও ধর্ম থাকে না, শাসক অত্যাচারীই হয়) কত অত্যাচার করেছে হিন্দুদের উপর সেই কাহিনিও ভোটের অস্ত্র। সঙ্গে আছে ভয় দেখিয়ে জোর করে অতীতের ধর্মান্তরকরণের নানা কাহিনি। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে নিরলস সংগ্রামী অধ্যাপক রাম পুনিয়ানি একটা প্রশ্ন তুলেছেন ধর্মান্তরকরণ নিয়ে। তিনি বলেছেন, সব মুসলিম রাজাদের রাজধানী ছিল দিল্লি। যদি মুসলিম রাজারা ভয় দেখিয়ে ধর্মান্তরিত করতেন, তাহলে ৭০০ বছরের মুসলিম শাসনের পর দিল্লিতে আজকে হিন্দু জনসংখ্যা ৮০.২০ শতাংশ আর মুসলিম জনসংখ্যা শতাংশের বিচারে মাত্র ১২.৭০ শতাংশ হত কি? কখনওই হত না। মুসলিমের সংখ্যা বেশি হল কোন রাজ্যে? কেরল, অসম, বাংলায়। আসলে যাদের ওপর হিন্দুরা অত্যাচার করত, যাদের অপমান করত, মন্দিরে ঢুকতে দিত না, ছোঁয়া লাগলে স্নান করত, কুয়ো, পুকুর থেকে জল খেতে দিত না, স্কুলে হয় পড়তে দিত না, দিলেও সবার সঙ্গে একাসনে বসতে দিত না, যাদেরকে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা বলত নিচু জাত, মনুবাদীদের অত্যাচারে সেই অত্যাচারিতদেরই একটা বড় অংশ সামাজিক স্বীকৃতির আশায়, ন্যূনতম সম্মানের আশায়, অত্যাচার, নিপীড়ন থেকে বাঁচতে হিন্দু ধর্ম ছেড়ে মুসলিম হয়েছিলেন। ভারতে মুসলিমদের ৮০ শতাংশই এই অত্যাচারিতরা। কেউ তাদের ভয় দেখিয়ে গায়ের জোরে ধর্মান্তরিত করেনি। আমাদের সংবিধান কমিটির প্রধান ছিলেন বাবা সাহেব আম্বেদকার। ছোটবেলা থেকে উচ্চবর্ণের হাতে এত অপমানিত হয়েছেন এবং দলিতদের এত অপমানিত হতে দেখেছেন যে নিজে জীবনে স্বীকৃতি পেলেও দলিতদের সম্মানের স্বার্থে প্রায় ৫ লক্ষ দলিতকে নিয়ে ১৯৫৬ সালে তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। কেউ তাঁদের ভয় দেখিয়ে ধর্মান্তরিত করেনি। তাঁরা সবাই অপমানে মাথা নিচু করে মুখ ফিরিয়ে হিন্দু ধর্ম ছেড়ে চলে গিছেন। সিরিয়ান খ্রিস্টান মিশনারিরা ভারতে এসেছেন প্রায় ১৯০০ বছর আগে। ভারতে খ্রিস্টানের সংখ্যা কত? তিন শতাংশও নয়। যদি তাদের কাজ হত জোর করে ধর্মান্তরকরণ তাহলে এই সংখ্যাটা বহুগুণ বেড়ে যেত। কোথায় খ্রিস্টান বেড়েছে? আদিবাসীদের মধ্যে। কেন? কারণ আমরা তাদের অবহেলা করতাম। তাদের উন্নয়ন, শিক্ষা নিয়ে কিছু ভাবিনি। সে কেরলই বলুন আর মিজোরামই বলুন এই রাজ্যগুলি যে শিক্ষায় দেশের মধ্যে সবার চেয়ে এগিয়ে, তার কারণ খ্রিস্টান মিশনারিদের অবদান।
২০০৪ সালে ভারতের পরিকল্পনা কমিশনে স্বাধীনতার পর থেকে উন্নয়নের জন্য জমি অধিগ্রহণ কোথায় কোথায় কতটা হয়েছে তাই নিয়ে একটি রিপোর্ট জমা পড়ে। সেই রিপোর্টে বলা হয়েছিল, স্বাধীনতার পর থেকে শিল্পের জন্য, উন্নয়নের জন্য সরকার যে কয়েক লক্ষ একর জমি অধিগ্রহণ করেছে তার ৮০ ভাগই হয় আদিবাসীদের জমি নয়তো দলিতদের জমি। অর্থাৎ ভারতের উন্নয়নের জন্য লক্ষ লক্ষ আদিবাসী এবং দলিতকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। ক্রমাগত মিথ্যা প্রচার চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে খ্রিস্টানরা জোর করে ধর্মান্তরিত করাচ্ছে। ক্রমাগত এই ধরনের প্রচার হিংসার জন্ম দেয়। হিংসাকে স্বীকৃতি দেয়। এই ধরনের প্রচারেরই ফল, অটলবিহারি বাজপেয়ি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ওড়িশার কেওনঝড়ে গ্রাহাম স্টেইনস নামের এক অস্ট্রেলিয়ান মিশনারি আর তার দুই শিশুপুত্রকে ঘুমন্ত অবস্থায় একটি গাড়ির ভেতরে জীবন্ত পুড়িয়ে খুন করা হয়েছিল। যে হত্যা করল, উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা সেই দারা সিং, দেখা গেল হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বজরং দলের সদস্য। সেই দারা সিং ছিল সেই সময়ের গোরক্ষা কমিটির সক্রিয় নেতা। বিশিষ্ট ভারতীয় গায়ক, সুরকার এ আর রহমান তো হিন্দু ছিলেন। তাঁর জীবনে এক অস্থির সময়ে তাঁর পরিচয় হয় এক সুফি ধর্মগুরুর সঙ্গে। ভালো লেগে যায়। তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। কেউ তাঁকে ভয় দেখিয়ে ধর্মান্তরিত করেনি। কয়েকশো বছরের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে ভয় দেখিয়ে ধর্মান্তরিত করার ঘটনা ব্যতিক্রম। ৯০ ভাগ ধর্মান্তরের ঘটনা ঘটেছে স্বেচ্ছায়, ভালোবেসে। কিন্তু হিন্দুত্ববাদীদের তো আর ইতিহাসে নজর নেই।
হিন্দুত্ববাদীরা প্রচার করে বিজেপি বাদে বাকি সব দল মুসলিম তোষণের রাজনীতি করে। এটাও তথ্য হিসেবে এক বিরাট মিথ্যা। যদি তোষণ করা হত তাহলে মুসলিমরা সর্বক্ষেত্রে এতটা পিছিয়ে থাকত না। জনসংখ্যার শতাংশের বিচারে মুসলিমদের যতটুকু প্রাপ্য, তা তারা অতীতেও কখনও পায়নি। এখনও পায় না। এই না-পাওয়াটা বেড়েই চলেছে। Majoritarian State, How Hindu Nationalism is Changing India. Edited by Angana P. Chatterjee, Thomas Blom Hansen, Christophe Jaffrelot, এই বইয়ে তথ্য দিয়ে লেখকরা দেখিয়েছেন, ৫০-এর দশকে দেশে মুসলিম জনসংখ্যা যেখানে ছিল ১০ শতাংশ, তখন মুসলিম আইপিএসের সংখ্যা ছিল ৫ শতাংশের নীচে। ২০১১-এর সেন্সাস অনুসারে দেশে মুসলিম জনসংখ্যা যখন বেড়ে ১৪ শতাংশ তখন ২০১৬ সালের হিসেব বলছে, দেশে মুসলিম আইপিএস-এর সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৩ শতাংশের নীচে। রাজ্য সরকারের পুলিশের চাকরিতে পরীক্ষা দিয়ে যে অফিসারেরা পদোন্নতির জেরে আইপিএসের পদমর্যাদা পান, সেখানেও দেখা যাচ্ছে, এমন আইপিএসদের ৭ শতাংশ মুসলিম ছিল ২০০৬ সালে, ২০১৬ সালে সংখ্যাটা কমে হয়েছে ৩.৮ শতাংশ।
প্রশাসনে যেমন মুসলিমদের উপস্থিতি কমছে, তেমনই কমছে রাজনীতিতেও। ১৯৮০ থেকে ২০১৯, এই সময়ে নির্বাচিত মুসলিম সাংসদের সংখ্যা কমে প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। ১৯৮০ সাল। তখন ভারতের জনসংখ্যার ১১.৪ শতাংশ ছিল মুসলিম, মোট সাংসদ ৫৪২, মুসলিম সাংসদ ৪৯, অর্থাৎ ৯ শতাংশ। ২০১৯ সাল। মুসলিম জনসংখ্যা ১৪.২ শতাংশ, মোট সাংসদ ৫৪৩, মুসলিম সাংসদ ২৭, অর্থাৎ প্রায় ৫ শতাংশ। কেন কমছে মুসলিম সাংসদ? প্রধান কারণ জনসংখ্যার বিচারে মুসলিম রাজনীতিকদের যে কটি আসন প্রাপ্য হতে পারত, তার থেকে অনেক কম আসন মুসলিমদের জন্য ছাড়ে রাজনৈতিক দলগুলি। ব্যতিক্রম কিছুটা বামপন্থীরা এবং তৃণমূল কংগ্রেস, আরজেডি সহ কয়েকটি আঞ্চলিক দল। তৃণমূল কংগ্রেসের মুসলিম প্রার্থী এবং মহিলা প্রার্থী প্রায় সবসময়ই অন্য অনেক দলের থেকে তুলনায় বেশি। এটা তোষণ নয়, সুবিচারের চেষ্টা। তাহলে তোষণটা হল কোথায়! হিন্দুত্ববাদীদের এটাই সাফল্য যে তারা এই তোষণের ভুল ধারণা বেশিরভাগ হিন্দুর মনের গভীরে গেঁথে দিতে সফল হয়েছেন।
এত অপপ্রচার সত্ত্বেও, তুলনায় হিন্দুদের থেকে একজন মুসলিম এখনও তার প্রতিবেশী হিসেবে একজন হিন্দুকে পেতে বেশি আগ্রহী। এই তথ্য জানা গেল অতি সম্প্রতি ‘পিউ রিসার্চ সেন্টার’-এর সমীক্ষা ‘রিলিজিয়ন ইন ইন্ডিয়া: টলারেন্স অ্যান্ড সেগ্রিগেশন’ থেকে। ওই সমীক্ষা উল্লেখ করে ক্রিস্তফ জাফরলট ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ পত্রিকায় লিখেছেন,
…only 16 per cent of them would not be willing to accept a Hindu as a neighbour, whereas 36 per cent of Hindus would not be willing to accept a Muslim as a neighbour.
Similarly, Muslims are imbued with Hindu religious notions: 77 per cent of them believe in karma, 27 per cent in reincarnation and 26 per cent in the Ganga’s power to purify. This is a clear legacy of what “unity in diversity” used to mean in India…
কংগ্রেস সাংসদ শশী থারুর ভারতের ধারণার একটা উদাহরণ দিয়েছেন তাঁর ‘দ্য ব্যাটেল অফ বিলঙ্গিং’ বইয়ে। তিনি লিখেছেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থনের জন্য যখন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয়েছিল, সেই সময়,ভারতের নর্দান সেক্টরে ভারতীয় বায়ুসেনার দায়িত্বে ছিলেন এক মুসলিম অফিসার, এয়ার চিফ মার্শাল ইদ্রিশ হাসান লতিফ। ভারতের সেনাপ্রধান তখন একজন পার্সি, জেনারেল স্যাম মানেকশ। পূর্ব পাকিস্তানে যে ভারতীয় সেনা যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাকে পরাজিত করেছিল, তার কমান্ডিং ইন চিফ ছিলেন একজন শিখ, লেফ্টেন্যান্ট জেনেরাল জগজিৎ সিং অরোরা। আর শেষপর্বে যে জেনারেলকে আকাশপথে উড়িয়ে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছিল, পাকসেনার আত্মসমর্পণের বিষয়টি কার্যকর করতে, তিনি ছিলেন একজন ইহুদি, লেফ্টেন্যান্ট জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব। এই হচ্ছে ভারত। পৃথিবীতে এমন আর দ্বিতীয় দেশ নেই যেখানে এত বৈচিত্র। এই হল যত মত তত পথের ভারতবর্ষ। রবীন্দ্রনাথ এরই জয়গান করেছেন তাঁর ‘ভারততীর্থ’ কবিতায়। স্বাধীনতার ৭৫ বছর যখন সামনে, তখন আঘাত আসছে এই যত মত তত পথের উপরেই, এই বৈচিত্রময় বহুস্তর ভারতের ধারণার উপরেই।