স্টেশনমাস্টারের কলম
ভজুখুড়ার কথা আসিতে পারে। সেই নিরক্ষর, দরিদ্র কৃষক ভজুখুড়া, যিনি দ্বারে উপস্থিত ভোটপ্রার্থী রাজনৈতিক কর্মীটিকে অবলীলায় বলিতে পারিয়াছিলেন, “বাবা, কথা বলতে তো ব্রিটিশরাও দিত… ওদের পক্ষে কথা বললে!”
কিংবা, আসিতে পারে যমুনাবতীর কথা। জ্বরে বেহুঁশ সন্তানকে লইয়া যে জননী এক বর্ষণস্নাত রাত্রিকালে ১৮ কিলোমিটার পথ হাঁটিয়া পঁহুছিয়াছিলেন তাঁহার গৃহ হইতে সর্বাপেক্ষা নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিতে। এই পরিক্রমায় তাঁহাকে ডিঙাইয়া আসিতে হইয়াছিল দুইখানি পাহাড়। যমুনার সন্তান, স্বাভাবিকতা হেতুই, বাঁচে নাই।
কিংবা, সরস্বতী লোহার। বালিকা বয়স হইতেই ইটভাঁটার শ্রমিক সরস্বতী, বয়স বাড়িয়াছে, পেশা বদলাইয়াছে, কিশোরী বয়সে বিবাহ হইয়াছে এবং বয়ঃসন্ধিকালে উপনীত হইতে হইতেই সরস্বতীর চারটি সন্তান পৃথিবীর আলোও দেখিয়া ফেলিয়াছে। প্রথম তিনটিই বাঁচে নাই। করোনা জাতীয় কোনও অতিমারির গল্প নহে— সরস্বতীর সন্তানদের মৃত্যুর কারণ ছিল সাধারণ জ্বর-সর্দি-কাশি, কিংবা হয়তো নিউমোনিয়া। সেগুলি যে অতি সহজে নিরাময়যোগ্য, সরস্বতী তাহা জানিত না। সে তো জানিত না টিকার খবরও। শ্রদ্ধেয় পাঠক, পুনরায় স্মরণ করাইয়া দেই, এই করোনাক্রান্ত অপকালে যে মহার্ঘ্য টিকানিচয় বর্তমানে আমাদিগের মন-মগজ আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে, এ-টিকা সে-টিকা নহে। বিসিজি, ট্রিপ্ল অ্যান্টিজেন-আদি যে সামান্য টিকাসকল সদ্যোজাতদের দেওয়া হইয়া থাকে, তাহারই উল্লেখ হইল।
অষ্টাদশ-বর্ষীয় স্নাতক ছাত্র শিবার কথাও আসিতে পারে। সম্প্রতি সে একাদশ দিবস গাছে কাটাইল। দিবস-রাতি আহার-নিদ্রা— সবই বৃক্ষশাখায়। শখে নহে, বাধ্যতায়। কোভিড হইয়াছিল, যেহেতু একখানিই ঘর, স্ব-বিচ্ছিন্নকরণের আর পন্থাই বা কী!
অথবা, আসিতে পারে সাগিরচাচার কথা। বছর-বছর গঙ্গার করাল গ্রাসে ঘর-বাড়ি-ভিটা-মায় গোটা গ্রাম বিলীন হইয়া যাইতে দেখিয়াও যে বৃদ্ধ অনায়াসে বলিতে পারেন, “এসব লদীর নিজের ভিটা, হামাদের থাকত্যে দিব্যে ক্যানে? উয়ার গোঁসা তো ল্যায্য বটে!”
কিংবা সেই ষষ্ঠ শ্রেণির বালকটির কথা। বন্ধুদের প্ররোচনায় অনলাইন গেম খেলিতে গিয়া মায়ের অ্যাকাউন্ট থেকে ৪০০০০ টাকা ব্যয় করিয়া যে বালকটি ঝুলিয়া পড়িল সিলিংবন্ধনে।
এই অলিম্পিক-অবসরে মীরাবাই চানু, রানি রামপাল কিংবা পায়াত্তু রবীন্দ্রন সৃজেশের নামও আসিতে পারে বই কী! যে মীরাবাই চানুর গ্রামের মানুষ আশায় বুক বাঁধিতেছেন, এইবার হয়তো তাহাদের গ্রামের রাস্তাটি পাকা হইবে। অলিম্পিকে রৌপ্যপদকজয়ীকে সংবর্ধনা জানাইবার মতো পবিত্র কর্ম করিতে মাননীয় নেতৃবর্গ তো আর তাহাদের মতো কাঁচা রাস্তায় পদব্রজে আসিবেন না! অলিম্পিক হকির চার দশকের পদক-খরা ঘুচাইল যে দল তাহার দুর্গরক্ষক সৃজেশের ক্রীড়া উপকরণগুলি খরিদ করিতে যে পারিবারিক আয়ের উৎস তাহার পিতার একজোড়া গরু বিসর্জন দিতে হইয়াছিল— তাহাও তো আমরা জানিলাম এইমাত্র!
আসিতে পারিত আরও বহু নাম। তাহাদের মধ্যে কয়েকটি কিঞ্চিদধিক আলোচিত হইবার সৌভাগ্য অর্জন করিয়াছে। যেমন জামলো মকদম, যেমন ফাদার স্ট্যানিস্লাউস লৌরডুস্বামী…
সেই ট্রেনগুলির কথা আসাও তো আবশ্যক। যাহার একটি আসিয়া থামিয়াছিল আমাদের এই শিয়ালদহ ইস্টিশনে, এবং কয়েকটি গিয়াছিল তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে। যেগুলি লইয়া কৃষণ চন্দরের পেশোয়ার এক্সপ্রেস, খুশবন্ত সিংয়ের ট্রেন টু পাকিস্তান, ঋত্বিক ঘটকের ছবি, সদত হসন মন্টোর গল্প, অন্নদাশঙ্কর রায়ের মর্মভেদী ছড়া। স্মরণ করিব না তাঁহাদের, উর্বশী বুটালিয়া ‘দ্য আদার সাইড অফ সাইলেন্স’-এ যাঁহাদের কথা নথিভুক্ত করিয়াছেন?
এককোটি কুড়িলক্ষ মানুষ বাস্তুহারা হইয়াছিলেন। প্রায় দশ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারাইয়াছেন। ৭৫০০০-এর আশেপাশে নারী ধর্ষিত হইয়াছেন, অপহৃত হইয়াছেন, বন্দি হইয়াছেন, ‘অন্য’ ধর্মের পুরুষদের দ্বারা বলপূর্বক গর্ভবতী হইয়াছেন। কয়েকসহস্র পরিবার বিচ্ছিন্ন হইয়াছে, হাজার-হাজার বাড়ি জ্বালাইয়া দেওয়া হইয়াছে, ধ্বংস করা হইয়াছে, গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হইয়া পরিত্যক্ত হইয়া গিয়াছে।
আসা আবশ্যক। কারণ, আমরা আলোচনা করিতে বসিয়াছি এমন একটি মাহেন্দ্রক্ষণ লইয়া যে-ক্ষণে ইঁহাদের উল্লেখ না-করা অপরাধ-তুল্যই বোধ হয়। আমাদের স্বাধীনতা তাহার সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষের প্রাক-কালে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। এই স্বাধীনতা কেমন, ইন্ডিপেন্ডেন্স বা ফ্রিডম শব্দগুলির সহিত ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস শব্দবন্ধটির পার্থক্য কতটা গূঢ়, এবং ভারতবর্ষের প্রকৃত অর্জনটি কী— সেইসব লইয়া অজস্র তর্ক বর্তমান। এবং এই যে ৭৫ বৎসরের সফর, ইহাও কি সমতলে কোনও বর্তুলাকার বস্তু যেমন গড়গড় করিয়া গড়াইয়া চলে তেমনই; নাকি রুক্ষ এবড়োখেবড়ো পথে যথেচ্ছ ঠোক্কর খাইতে-খাইতে, থমকাইতে-থমকাইতে, বিশ্রাম লইতে-লইতে এ সফর— সেও যথেষ্ট গুরুগম্ভীর আলোচনার দাবি রাখে। তাহার কোনওটিই অবশ্য এ-ক্ষণে আমাদিগের অভিপ্রায় নহে। যেহেতু চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের আগস্ট সংখ্যার বিষয় স্বাধীনতা ৭৫, এই সম্পাদকীয় নিবন্ধে অতএব আমরা কেবল অতিক্রান্ত এই পঁচাত্তর বৎসরের পথটির দিকে আলো ফেলিতে চাহিব।
আমরা বাছিয়া লইয়াছি কয়েকটি ক্ষেত্র। সেই ক্ষেত্রগুলির মধ্য দিয়া আমরা ধরিতে চাহিয়াছি এই পঁচাত্তর বৎসরের সফরটিকে। ক্ষেত্রগুলির মধ্যে রহিয়াছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারী, সংখ্যালঘু জনগণ, আমাদের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি। দেখিতে চাহিয়াছি আমাদের সংবিধানের আলোকে বাকস্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার তিন মহান মূল্যবোধকে। আর যেহেতু এই তিনটি মূল্যবোধ আমাদিগকে যথেষ্ট শ্লাঘা প্রদান করিয়া থাকে, সেই হেতু একই সঙ্গে আমরা দেখিতে চাহিয়াছি যুক্তিবাদী মানসিকতার বিকাশে আমাদের অগ্রগমনকে। ধরিতে চাহিয়াছি দেশভাগের মর্মন্তুদ যন্ত্রণা যাঁহারা অনুভব করিয়াছেন সেই তাঁহাদের এবং দেশের যুবসম্প্রদায়ের দৃষ্টিতে স্বাধীনতা এবং এই যাত্রাটি কী রূপে প্রতিভাত হয়। সর্বোপরি, দেখিতে চাহিয়াছি মানবিক এবং সাংস্কৃতিক দিক হইতে আজ পঁচাত্তর বৎসর পর আমাদের অবস্থানটি ঠিক কোথায়। বিষয়গুলির উপর আলোকপাত করিয়া আমাদের ঋণী করিয়াছেন সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, স্থবির দাশগুপ্ত, শুভোদয় দাশগুপ্ত, অশোক মুখোপাধ্যায়, স্বাতী ভট্টাচার্য, শুভাশিস মৈত্র, শুভাশিস মুখোপাধ্যায়, সুমন কল্যাণ মৌলিক, মানস প্রতিম দাস, অর্ক ভাদুড়ি এবং শিমূল সেন।
রিজার্ভড বগির সঙ্গে রহিয়াছে অন্যান্য বিভাগগুলিও, যথারীতি। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, বিশেষ নিবন্ধ, ধারাবাহিক উপন্যাস ও রচনা, অনুবাদ সাহিত্য, ফটোফিচার, অন্যগদ্য, অণুগল্প-এর মতো নিয়মিত বিভাগগুলি। তৎসহ মেল ট্রেনের কিছু বিশেষ বিভাগ, যথা, স্টিম ইঞ্জিন, সবুজ স্লিপার, ডিসট্যান্ট সিগনাল, হুইলার্স স্টল এবং ভালো খবর। পড়িবেন। জানাইবেন আপনাদের মূল্যবান মতামত।
শেষ করি কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উচ্চারণ দিয়ে—
কোথাও মানুষ ভালো রয়ে গেছে বলে
আজও তার নিঃশ্বাসের বাতাস নির্মল;
যদিও উজির, কাজী, শহর-কোটাল
ছড়ায় বিষাক্ত ধুলো, ঘোলা করে জল
তথাপি মানুষ আজও শিশুকে দেখলে
নম্র হয়, জননীর কোলে মাথা রাখে,
উপোসেও রমণীকে বুকে টানে; কারও
সাধ্য নেই একেবারে নষ্ট করে তাকে।
ভালো থাকিবেন…
চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষে,
সোমেন বসু