অংশুমান দাশ
পরিবেশবিদ ও খাদ্যসুরক্ষা বিশেষজ্ঞ, কবি ও প্রাবন্ধিক
–কলকাতা শুনছি জলে ডুবে যাবে!
–সে তো প্রতি বছরই বর্ষায় হাঁটু জল পেরিয়ে বাজার যেতে হয়। সে আর নতুন কী!
–না না সেরকম নয়, আইপিসিসি বলছে[1] ২০৫০-এর মধ্যে নদী সমুদ্রের কাছাকাছি পৃথিবীর অনেকগুলো দেশই ডুবে যাবে।
–কোন শিশি?
–শিশি নয়! আই-পি-সি-সি— ইন্টারগভর্মেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করা জাতিসঙ্ঘের একদল বিজ্ঞানী।
–অ, বুঝলাম। আমার তো পাঁচতলায় বাড়ি। তাছাড়া দার্জিলিং-এ একটা বাংলো আছে, পাহাড়ের উপরে— তদ্দূর জল উঠবে না।
–কিন্তু খাবেন কী?
–কেন নৌকা করে দিয়ে যাবে!
–ফসলই হবে না তো প্রায়। এই ধরুন আর্কটিকের বরফ ২০৫০-এর মধ্যে সাফ। প্রতি সেপ্টেম্বর মাস নাকি শুধু জলে জল হয়ে থাকবে আর্কটিক।
–চিন্তার বিষয়! কিন্তু সে তো আর্কটিক— কিন্তু তাতে আমাদের কী?
–অত জল গলে যাবে কোথায়? আগে একশো বছরে একবার সমুদ্রের জল বেড়ে কেলেঙ্কারি ঘটনা ঘটত। ২১০০ সালের মধ্যে নাকি এমনি ঘটনা প্রায় প্রতি বছর হবে। সমুদ্রের জল দু মিটার তো বাড়বেই। হিমালয়ের বরফই কী আর গলবে না? আমাদের গঙ্গা-অববাহিকার জমিও তো সব বন্যায় যাবে। ১৯০১ থেকে-১৯৭১, এই সত্তর বছরে সমুদ্রের তল যে হারে বাড়ছিল, এখনই সেই হার বেড়ে প্রায় তিনগুণ।
–সে তো সত্যি ঝামেলার ব্যাপার! তবে একটা ভালো ব্যাপার হল যে যেখানে বরফ ছিল সেখানে মাটি বেরিয়ে চাষবাস করা যাবে।
–হ্যাঁ, তা যাবে। কিন্তু আপনি বলছেন হিমালয়ে আর গ্রিনল্যান্ডে ধান চাষ করবেন? জমি থাকলেই সেখানে যা খুশি চাষ করা যাবে নাকি?
–যাবে না?
–ফসল তো তাপমাত্রার উপরেও নির্ভরশীল নাকি? তাপমাত্রার কথায় মনে পড়ল— ২০৪০-এর মধ্যে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বাড়বে ১৯০০ সালের তুলনায় ১.৫ ডিগ্রি।
–দেড় ডিগ্রি মাত্র— তাই নিয়ে এত লাফালাফি!
–‘গড়’ তাপমাত্রা— মানে যেমন ধরুন কোথাও হয়ত সাড়ে তেইশ ডিগ্রি বাড়ল, তো কোথাও কুড়ি ডিগ্রি কমল— মানে গড় তাপমাত্রা তো দেড় ডিগ্রি বাড়ল, তাই না? ১৮৫০ থেকে হিসেব করলে গত পাঁচ বছর পৃথিবীর তাপমাত্রা ছিল সবচেয়ে বেশি। ধান, গম আর ভুট্টা খেয়ে সারা পৃথিবীর ক্যালরির যোগান আসে। ১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা বাড়লে ৬ শতাংশ গম, ৩.২ শতাংশ ধান আর ৭.৪ শতাংশ ভুট্টার উৎপাদন কমে যাবে[2]।
–বলেন কী মশাই! তাহলে তো পয়সাকড়ি জমানোর দিকে মন দিতে হয়। খাবারের দাম তো ব্যাপক বেড়ে যাবে।
–শুধু আপনার খাবার হলেই চলবে তো? গত কয়েকবছর ধরে প্রতি বছর সুন্দরবনে সাইক্লোন হচ্ছে দেখছেন? আগে ৪-৫ বছরে একবার হত— এখন প্রতি বছর।
–উঃ আবার এর মধ্যে সাইক্লোন ঢোকাচ্ছেন কেন? তবে সেটা অবশ্য চিন্তার বিষয়। সুন্দরবন থেকে ওই সময়গুলোয় কাজের লোক আসতে পারে না।
–আচ্ছা এই ঝড়, সাইক্লোন কী করে হয় বলুন তো?
–ওই তো ইয়ে…
–নানা কারণে হতে পারে। তবে একটা সাধারণ নিয়ম হচ্ছে— গরম হাওয়া হালকা হয়ে উপরে উঠে যায়, ঠান্ডা হাওয়া সেই জায়গার দখল নিতে তাড়াতাড়ি ছুটে আসে। সমুদ্রের স্রোতও হয় একই নিয়মে। এইসব স্রোত, হাওয়ার প্রবাহ, তার সঙ্গে জড়িয়ে বৃষ্টি, ঋতু— এইসবেরই একটা নিয়ম আছে। সব নির্ভর করে ওই পৃথিবীর তাপমাত্রার উপরে। এখন তাপমাত্রা যদি গুলিয়ে যেতে থাকে— তাহলে এই চেনা হাওয়া, স্রোত, ঋতু পরিবর্তন সব এলোমেলো হয়ে যাবে। তার সঙ্গে, বুঝতেই পারছেন, ফসলের পরিমাণ, মানুষের বেঁচে থাকা— আর হ্যাঁ, সেই সঙ্গে আপনার বেঁচে থাকাও।
–এই সব বলে বেফালতু ভয় দেখাচ্ছেন কেন? আমি সাতে পাঁচে নেই। কে কী শিশি বোতলের রিপোর্ট বলল আর আপনি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন।
–শিশি নয়— বললাম যে আইপিসিসি। আর জঙ্গলে আগুন লাগার কথা তো বলিইনি এখনও। আমাজনে আগুন লেগেছিল জানেন তো? এই মুহূর্তে কালিফোর্নিয়ায় জঙ্গল জ্বলছে, কানাডায় ১৫৭টা জয়গায় জঙ্গলে আগুন লেগে আছে। তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে— এইসবও বেড়ে যাচ্ছে।
–উঃ, কী সব ভয় দেখানো কথাবার্তা বলছেন! আমি জঙ্গলে থাকিও না— আর তাপমাত্রাও বাড়াইনি।
–আমি বলিনি। আইপিসিসি বলেছে— বলছে, লাল সঙ্কেত— বিপদবার্তা, কোড রেড। মানে কিছু কিছু অবস্থা এমন হয়ে গেছে তা আর কিছুতেই পুরনো জায়গায় ফিরে যাবে না। যেমন তাপমাত্রা বাড়বেই— ওই দেড় ডিগ্রি, আর তার জন্য যা যা হওয়ার হবেই। এখন দু ডিগ্রিতে বেঁধে রাখা যায় কি না সেটাই লড়াই।
–লড়াই, ওরে বাবা। কিন্তু আমি তো…
–২০১৫-তে প্যারিসে সব দেশের নেতারা মিলে ঠিক করেছিলেন তাঁরা এই পৃথিবীর তাপমাত্রা ২ ডিগ্রির মধ্যে আটকে রাখতে যা করতে হয় করবেন। এমনকি চেষ্টা করবেন দেড় ডিগ্রির মধ্যে রাখতে। খুব পেরে উঠছেন একথা বলা যাবে না। কার্বন ডাই অক্সাইড বাড়ছে তো বাড়ছেই।
–আবার কার্বন ডাই অক্সাইড কোথা থেকে এল? সে তো ছিল এবং আছে— আমরা তো নিঃশ্বাসে ওই কার্বন ডাই অক্সাইডই ছাড়ি। কী ঝামেলা। নিঃশ্বাস বন্ধ করে থাকব নাকি?
–কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণের একটা মাত্রা আছে। আমরা এত কারখানা তৈরি করেছি, এত গাড়ি, জঙ্গল কেটে শহর বানিয়েছি, ভুলভাল ক্ষেতখামার করছি, যে কার্বন ডাই অক্সাইড বেড়ে গেছে প্রচুর। আর পৃথিবী থেকে যে তাপ বিকিরণ হয়ে ফিরে যাওয়ার কথা মহাকাশে, তা ওই কার্বন ডাই অক্সাইডের অণুতে ধাক্কা লেগে আবার পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ফিরে আসছে, ঘুরপাক খাচ্ছে, আর তাপ বাড়াচ্ছে।
–তা হলে আর নিঃশ্বাস ছাড়ব না বলছেন? কার্বন ডাই অক্সাইড বেড়ে যাবে?
–চেষ্টা করতে পারেন যতক্ষণ পারেন— তবে ভোগ্যপণ্য, কারখানার জিনিস ব্যবহার যতটা কমাতে পারেন দেখুন। সকলকে উদ্বুদ্ধ করুন আর সরকারের উপর চাপ দিন, প্রশ্ন করুন, দাবী তুলুন— সেই সরকারকেই ভোট দিন যারা এই বিষয়টাকে গুরুত্ব দেবেন।
–ভোট? তাহলে আপনাকে বলি শুনুন— এতক্ষণ তো আপনি বললেন। রাজনীতির ব্যাপারটা আপনি আমাকে ছেড়ে দিন। আপনাকে জলের মতো বুঝিয়ে দিচ্ছি। এই মদনা… এ দিকে দুটো হাফ লাল চা…
[1] https://www.ipcc.ch/report/ar6/wg1/
[2] https://www.pnas.org/content/114/35/9326