স্বপন ভট্টাচার্য
প্রাবন্ধিক, গদ্যকার, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
নরেন্দ্র মোদি সরকার যে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে নিয়ে বাজারে আসবেন এটা কোনও আকস্মিকভাবে ঘটে যাওয়া ঘটনা নয়। স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে কদম কদম বঢ়ায়ে যাওয়ার এই এক শপথ রাখার উদ্দেশ্যে পার্লামেন্টের বর্ষাকালীন অধিবেশনে সরকার চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি। মন্ত্রীসভার যে বিশেষ বিভাগটির এই বেচার কাজটি করার কথা তার নাম বেশ শ্রুতিমধুর— দীপম। DIPAM হল ‘ডিপার্টমেন্ট অফ ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড পাবলিক অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট’ এর ছোট করে রাখা নাম, ডাকনামও বলা যেতে পারে। তা এই ‘দীপম’-এর সেক্রেটারি তুহিন কুমার পান্ডে বাদল অধিবেশনের শেষে বেশ প্রত্যয় নিয়েই বলেছেন এয়ার ইন্ডিয়া, শিপিং কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া, ভারত পেট্রোলিয়াম, সরকারি হেলিকপ্টার সার্ভিস পবন হংস, ভারত আর্থ মুভার্স লিমিটেডের মত কিছু রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানির বেসরকারিকরণ এই মার্চের মধ্যেই সম্পন্ন হবে। স্মরণে রাখা দরকার, এই অর্থবর্ষের (২০২১-২২) বাজেট পেশ করে মোদি সরকারের অর্থমন্ত্রী ১.৭৫ লক্ষ কোটি টাকার একটা মামুলি বেসরকারিকরণ লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছিলেন যা এই সমস্ত রাষ্ট্রীয় গরিমার নিরিখে নামমাত্র বলেই মনে হয়েছিল। তথাপি, সে লক্ষ্যমাত্রা খুব সহজে অর্জিত হবে এমন আশা বাতুলতা বলেই মনে হচ্ছিল, কেননা এই লেখা লেখার দিন পর্যন্ত সরকার তাদের হাতে থাকা অ্যাক্সিস ব্যাঙ্ক, মিনারেল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন ইত্যাদির মত গোটা তিনেক সংস্থার আংশিক বেসরকারিকরণ করে মাত্র ৮৩৬৮ কোটি টাকা জোগাড় করতে পেরেছে। বাজার ভাল নয় বুঝে এখন সরকার লাইফ ইন্সিওরেন্স অফ ইন্ডিয়াকে স্টক মার্কেটে নথিভুক্তিকরণের কাজটিও যত শীঘ্র সম্ভব সেরে ফেলতে চান এবং সরকার আশা করেন এলআইসি-কে বাজারে এনে ফেলতে পারলে এ লক্ষ্যমাত্রার খুব কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারেন তারা। এই আগস্টেই তারা পার্লামেন্টে কোনও আলোচনা ছাড়াই পাশ করে নিয়েছেন ‘দি জেনারেল ইন্সিওরেন্স বিজনেস (ন্যাশানাইলেজশন) অ্যামেন্ডমেন্ট বিল, ২০২১’ যা সরকারের হাতে থাকা এলআইসি বা অন্যান্য রাষ্ট্রীয় বীমাসংস্থাগুলোর মালিকানা বাজারে বেচতে কাজে লেগে যাবে। শ্রী পান্ডে নিজেই বলছেন, চেঞ্জ অফ কন্ট্রোল, চেঞ্জ অফ লিডারশিপ মানেই সংস্থার বাজারে দাম বেড়ে যাওয়া। নিজেদের নেতৃত্বের ওপর এরকম অপরিসীম ভরসার কথা সচরাচর সরকারি স্তরে শোনা যায় না। ফলে বিক্রয়যোগ্য মালের তালিকা দীর্ঘতর হচ্ছে। বলা হয়েছে এই অর্থবর্ষেই অন্তত দুখানি ব্যাঙ্ক তারা বেচে দিতে চান। মজার কথা হল, এদেশের অর্থনীতিতে সরকারি ব্যাঙ্ককে ঋণের বোঝায় ন্যুব্জ করে যারা লক্ষকোটিপতি হয়েছে, সরকারি সম্পত্তি ক্রয়যোগ্যতার ক্ষেত্রে তাদেরই ওজন দাঁড়াবে সব চাইতে বেশি। ফলে যে কর্পোরেটের দায় চুকোতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে তাদের হাতেই মানুষের সম্পদ তুলে দেওয়ার সব ব্যবস্থাই পাকা হয়ে আসছে এবং তা নিয়ে পার্লামেন্টে আলোচনা হওয়ারও কোনও অবকাশ থাকল না। আর সদর্থক আলোচনা যা কর্পোরেটের স্বার্থের পরিপন্থী হতে পারে, তেমন আলোচনায় জনজীবনে আলোড়ন ফেলার মত বিরোধী স্বর কোথায়? করোনা যতটা না মেরেছে তার চেয়ে ভয় বা ভয়ের অজুহাত হয়েছে অনেক বেশি। ফলে, কৃষক আন্দোলন চলছে এই পর্যন্ত, কিন্ত তা এখনও নির্ণায়ক দিশার সন্ধানে আর ডিসইনভেস্টমেন্ট নিয়ে যতটা সমস্বর হওয়ার পরিসর ছিল তা কার্যত পেগাসাসই দখল করে নিল, সুতরাং হাতে সেই পেনসিল।
রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে বা পাবলিক সেক্টরকে যে মোদি-শাহ-র সরকার বেসরকারি হাতে তুলে দিতে চান এ তো কোনও গোপন অ্যাজেন্ডা নয়। এই চাওয়ার পিছনে যতটা মোড়ঘোরানো অর্থনীতির যুক্তি কাজ করছে তার চেয়ে বেশি ঘোষিত যুক্তি হল টাকা তোলবার— এই উপায়ে সরকার রিসোর্স বাড়াতে চান। ভারতে এয়ার ইন্ডিয়া বা এলআইসি বা শিপিং কর্পোরেশনের মত সংস্থা কিন্তু ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে দেশজ অহঙ্কারের প্রতীক। ঔপনিবেশিকতাবাদ বলতে তো কেবল বিদেশি শক্তির রাজনৈতিক আগ্রাসন বোঝায় না, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশজ সম্পদের উপর বিদেশি মালিকানা স্থায়ী করার অভিপ্রায়। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামও কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের লড়াই ছিল না, তা একই সঙ্গে ছিল এই সম্পদগুলিকে বিদেশিদের হাত থেকে উদ্ধার করার সংগ্রাম। ভারতে পাবলিক সেক্টর হল এই ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী সংগ্রামের উত্তরাধিকার। কর্পোরেটের একার পক্ষে সেই দেশগঠনের কালে এই কাজ সম্ভব হত না যদি সরকার এ দায় নিতে অস্বীকৃত হত। উদাহরণ হিসেবে জাতীয়করণের আগে ও পরে সাধারণ মানুষের জীবনে ব্যাঙ্কের ভূমিকার কথা বলা যেতে পারে। ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ আপাতদৃষ্টিতে স্বাধীনতা অর্জনের অনেক পরের ঘটনা, কিন্তু যে মেট্রোপলিটন পুঁজি এবং স্বার্থ বিদেশি শাসকের অগ্রাধিকার ছিল, জাতীয়করণের পূর্বেকার ভারতীয় ব্যাঙ্ক ছিল সেই উত্তরাধিকার বয়ে নিয়ে চলা উপনিবেশ যেখানে কেবল কিছু ব্যক্তি বা কর্পোরেটের স্বার্থই সিদ্ধ হচ্ছিল, দেশগঠনে তাদের ভূমিকা ছিল নেহাতই প্রান্তিক। জাতীয়করণের পরেই যথাযথভাবে ব্যাঙ্ককে ভারতবর্ষ রিসোর্স এগ্রিগেটরের ভূমিকা থেকে আজকের রিসোর্স মবিলাইজারের ভূমিকা নিতে দেখেছে। সামান্য কৃষক থেকে কর্পোরেট, সরকারি ব্যাঙ্ককে বাদ দিয়ে যেমন ভারতবর্ষ আজকের ভারতবর্ষ হয়ে উঠতে পারত না তেমনই কর্পোরেট প্রতারণাও ওই জাতীয় স্বার্থ নামক শতচ্ছিন্ন ছাঁকনিটির ফাঁক দিয়ে গলে যেত না যেটাকেও আর না রাখতেই সরকার বদ্ধপরিকর।
মনে রাখা দরকার যে বিজেপির ডিএনএ-তে ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরোধিতা কোনওদিনই ছিল না, কিন্তু মনে এটাও রাখা দরকার যে নিও-লিবারেলিজমের ছিদ্রখানি দিয়ে কালকেউটে লখিন্দরের বাসরঘরে ঢুকল তার আমদানি কংগ্রেসের আমলে মনমোহন সিং-এর নয়া অর্থনীতির হাত ধরে। কংগ্রেস বা নতুন বা পুরনো শরিকদের আজকের প্রতিবাদে যে প্রত্যাশিত ঝাঁঝ থাকবে না এ তো স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু বাম স্বরও আজ খুব কান পেতে শুনতে হচ্ছে। লাভ করতে না পারলে, অথবা বলা ভালো কর্পোরেটের সঙ্গে তুলনীয় লাভ না করতে পারলে নয়া অর্থনীতি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে বেচে পুঁজি আমদানিকে অগ্রাধিকার দেয় এবং এই পুঁজির গন্তব্য অনিশ্চিত জেনেই তা দেয়। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকে ‘নন-ডেট ক্রিয়েটিং’— ধার না করা পুঁজির উৎস বলে চালাতে চাইছেন অনেকে। কিন্তু এও তো করতে হবে সে শিল্প থেকে ভবিষ্যৎ পুঁজি আহরণের সম্ভাবনাকে লাটে তুলে। ফলে, খাতার লাভ ও হাতের লাভ একই জায়গায় এসে মিলে যাওয়ার ষোল আনা সম্ভাবনা রয়েই গেল। আর সেই শিল্প যদি লক্ষ কোটি টাকা দেনা হজম করে দেওয়া কর্পোরেটের হাতেই স্থানান্তরিত হয় শেষ পর্যন্ত তাহলে যা দাঁড়াবে তা হল আপনার আমার সরাসরি সঞ্চয় যা ব্যাঙ্ক বা লাইফ ইনসিওরেন্সে এতাবৎ সুরক্ষিত ভেবে এসেছি তা নিয়ে তাদের খেলাধূলার অধিকার জন্মে গেল। উপরন্তু পাবলিক মানি বলতে আমরা যা বুঝি, যা রাষ্ট্রগঠনে, প্রতিরক্ষায়, শিক্ষায়, স্বাস্থ্যে, কৃষিতে হয়ত ইঁদুরের নুড়ি, কিন্তু তার সেটুকু ভূমিকাও অন্তর্হিত হবে। কোন অর্থনীতির কোন সে হিসেব যা দিয়ে এর পরিমাপ হয়? কর্পোরেটের উপর ট্যাক্সের হার যুক্তি মেনে বাড়ালেই তা বেচার বিকল্প হয়ে উঠতে পারে কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এই সুযোগসন্ধানী ক্রেতাকেই হয়ত ট্যাক্স হলিডে মঞ্জুর করে সরকার আর একটু বর্ধিষ্ণু হওয়ার সুযোগ করে দিয়ে বলবেন— ইসি মে সবকা ভালাই হ্যায়।