রাহুল সিনহা
আগরতলা থেকে প্রকাশিত ডেইলি দেশের কথা পত্রিকার সহকারী বার্তা সম্পাদক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ত্রিপুরা হঠাৎই রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের আগ্রহের বিষয়সূচিতে একেবারে ওপরের দিকে জায়গা করে নিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের একের পর এক নেতা প্রায় রোজ কলকাতা থেকে ত্রিপুরায় আসছেন। তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক ব্যানার্জি দুবার রাজ্য সফর করে গেছেন। অন্য অন্য নেতারাও আসছেন। পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রচারিত নিউজ চ্যানেলগুলোর পর্দায় ত্রিপুরা এখন প্রায় রোজ প্রাইমটাইম নয়তো প্যানেল আলোচনার বিষয় হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে।
একজন সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী ও বিশ্লেষক হিসেবে বিষয়টি কৌতূহলের। এটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে মোদি-শাহ নেতৃত্বাধীন বিজেপিকে হারিয়ে দেওয়ার পর মমতা ব্যানার্জি এখন সর্বভারতীয় রাজনীতির অঙ্গনে প্রধান বিজেপি-বিরোধী মুখ হয়ে উঠতে চাইছেন। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের (যদি আদৌ তা হয়) পর দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নও দেখছেন। সেই বৃহত্তর পরিকল্পনারই অঙ্গ হিসেবে ২০২৩-এ ত্রিপুরা বিধানসভা নির্বাচনকে আপাতত তৃণমূল তার পাখির চোখ করেছে। আর তাকে সামনে রেখেই এই যাবতীয় রাজনৈতিক তৎপরতা এবং তাতে হাওয়া দিচ্ছে অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম।
কিন্তু ত্রিপুরা কেন? ৪০ মাস আগে ত্রিপুরায় বিজেপি এবং আইপিএফটির জোট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এরাজ্যের রাজনৈতিক ও নির্বাচনী ইতিহাসে ১৯৫২ থেকে মূল লড়াই কমিউনিস্ট পার্টি [প্রথমে সিপিআই, ১৯৬৪র পর থেকে সিপিআই(এম)] এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। ২০১৩র বিধানসভা নির্বাচন, এমনকি ২০১৪র লোকসভা নির্বাচনেও এই ধারা বজায় থেকেছে। ২০১৩র বিধানসভা নির্বাচনে পরাজিত হয়েও কংগ্রেস প্রায় ৪৪ শতাংশ ভোট পেয়েছে। বিজেপি বা তৃণমূল কংগ্রেসের কার্যত কোনও উল্লেখযোগ্য নির্বাচনী অস্তিত্বই ছিল না। এর থেকে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া খুব কঠিন নয় যে ত্রিপুরার রাজনীতি চিরাচরিতভাবে দুটি স্পষ্ট শিবিরে বিভক্ত। একটি শিবির বামপন্থী, অন্যটি অবাম এবং এই দ্বিতীয় শিবিরের মূল শক্তি ২০১৮-র বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত মূলত কংগ্রেসই ছিল। ২০১৮-র নির্বাচনে কংগ্রেস বিধানসভায় শূন্য হয়ে যায়। বিজেপি প্রথমবার তার জোটসঙ্গী আইপিএফটির সঙ্গে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জিতে সরকার গঠন করে। ফলে রাজ্যে বামবিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের প্রধান মুখ হয়ে ওঠে বিজেপি।
গত ৪০ মাসে বিপ্লব কুমার দেবের নেতৃত্বে পরিচালিত বিজেপি জোট সরকার ত্রিপুরায় একটি অভূতপূর্ব দুঃশাসন কায়েম করেছে। যে ত্রিপুরা গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য, অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য, সর্বোচ্চ ভোটদানের নজির গড়ে সারা দেশের সামনে এক উদাহরণ হয়ে উঠেছিল, সেখানে গত ৪০ মাসে একটিও অবাধ নির্বাচন হয়নি। মানুষের ভোটদানের ন্যূনতম সাংবিধানিক, গণতান্ত্রিক অধিকার লুঠ হয়ে গেছে। ২০১৮র ৩ মার্চ বিধানসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর সেই বিকেল থেকেই বিরোধী দলের বিশেষ করে সিপিআই(এম)-এর ওপর যে নির্বিচার সন্ত্রাস শুরু হয়েছে তা এখনও বন্ধ হয়নি। সিপিআই(এম) সহ বিরোধী দলের, ট্রেড ইউনিয়নের অসংখ্য অফিস (এর মধ্যে কংগ্রেস দলের অফিসও রয়েছে) সরকার বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দিয়েছে, এমন নজির সারা দেশের আর কোথাও পাওয়া যাবে না। বিরোধী দলের বহু অফিস পোড়ানো হয়েছে, লুঠ হয়েছে, জবরদখল করে নেওয়া হয়েছে।
বিরোধী দলনেতা মানিক সরকার সহ বিধায়করা বারবার আক্রান্ত হয়েছেন, উপনেতা বাদল চৌধুরীকে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করে তিন মাস জেলবন্দি করে রাখা হয়েছে। বিধায়করা নিজের বিধানসভা এলাকায় যেতে পারেন না। আক্রান্ত সংবাদমাধ্যম। এই ১৫ আগস্ট-এ ৪২ বছর পূর্ণ করা, রাজ্যের বহুল প্রচারিত সংবাদপত্র ডেইলি দেশের কথাকে বেআইনি আদেশে বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। হাইকোর্ট সেই বেআইনি আদেশ খারিজ করে দেওয়ার পর পত্রিকা আবার প্রকাশিত হচ্ছে। বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বারবার। প্রচারে বাধা জারি রয়েছে প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার তরফে সরকারকে অবাধ প্রচারের ব্যবস্থা করার নির্দেশকে সম্পূর্ণ অবমাননা করে। কোনও মোটরস্ট্যান্ড থেকে বাসে ডেইলি দেশের কথা পরিবহন না করার ফতোয়া এখনও বহাল রয়েছে। অন্য আরও সংবাদমাধ্যম যারা এই সরকারের জনবিরোধী সিদ্ধান্ত ও ব্যর্থতা নিয়ে সরব হয়েছেন, তাঁদের ওপর সরকারের আক্রমণের খাঁড়া নেমে এসেছে।
এবং এই সরকার চরমতম বিশ্বাসঘাতকতা করেছে রাজ্যের ৪০ লক্ষ মানুষের সঙ্গে। সেসময়ের কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রয়াত অরুণ জেটলিকে দিয়ে বিজেপি ভোটের আগে যে ভিশন ডকুমেন্ট প্রকাশ করেছিল, তাতে ২৯৯টি প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। ৭ম কেন্দ্রীয় বেতন কমিশনের সুপারিশ কার্যকর, বছরে ৫০ হাজার সরকারি চাকরি, সব অনিয়মিত কর্মচারীকে নিয়মিত করা, রেগায় ৩৪০ টাকা মজুরি, সামাজিক ভাতার অঙ্ক বাড়িয়ে ২০০০ টাকা করা সহ সেসব প্রতিশ্রুতির একটিও বাস্তবায়িত হয়নি। মানুষের হাতে কাজ নেই। জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছুঁতে চলেছে, গণবণ্টন ব্যবস্থার অবস্থা শোচনীয়। গ্রামীণ ও উপজাতি এলাকায় রাস্তা, জল, বিদ্যুৎ সহ পরিকাঠামোর অবস্থা বেহাল। উপজাতি এলাকায় কাজের অভাব, অনাহার, অসুখের ছায়া দীর্ঘ হচ্ছে। এবং এসবের স্বাভাবিক পরিণতিতে মাত্র ৪০ মাসের মধ্যেই বিজেপি সরকারের জনপ্রিয়তা অতি দ্রুত হ্রাস পেয়েছে। এত কম সময়ের মধ্যে কোনও নির্বাচিত সরকারের প্রতি মানুষের মোহভঙ্গ, ক্ষোভ এবং বিরক্তির স্পষ্ট প্রকাশ ত্রিপুরায় এর আগে কখনও দেখা যায়নি।
সেজন্যই ত্রিপুরা। মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস এই সুযোগকেই কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। তাদের খানিকটা সুবিধা করে দিচ্ছে বিজেপির ঘরোয়া কোন্দলও। মন্ত্রিসভা থেকে বিতাড়িত সুদীপ রায় বর্মণ এবং মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেবের তিক্ততা সর্বজনবিদিত। বিজেপির বিধায়কদল এবং সংগঠনেও বিপ্লব দেবের একটি বিরোধী শিবির রয়েছে। এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে ২০১৮র বিধানসভা নির্বাচনের আগে সুদীপ রায় বর্মণ সহ ৬ জন বিধায়ক প্রথমে কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেস এবং তারপর বিজেপিতে যোগ না দিলে এবং কংগ্রেস বিজেপির কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে তার ভোটের প্রায় ৪০ শতাংশ বিজেপির ঝুলিতে ঢেলে না দিলে বিজেপির পক্ষে ত্রিপুরায় ক্ষমতা দখল করা সম্ভব হত না।
আজকের ত্রিপুরায় বিজেপির জনপ্রিয়তা এতটাই তলানিতে ঠেকেছে, একটিও অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনে তাদের জয়ী হওয়া কঠিন। কংগ্রেস সারা দেশের মতোই ত্রিপুরাতেও কঙ্কালসার, অসংগঠিত এবং নেতৃত্বহীন। বিপরীতে সিপিআই(এম), বামফ্রন্ট এবং বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন এবং ছাত্র-যুব, নারী, কৃষক, খেতমজুর, জুমিয়া সহ বিভিন্ন অংশের মধ্যে কর্মরত গণতান্ত্রিক সংগঠনগুলো প্রতিদিন, তীব্রতম আক্রমণের মুখেও মানুষের দাবি ও সমস্যা সমাধানে লড়াইয়ের মধ্যে রয়েছে। কোভিড অতিমারি, লকডাউনে মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়া, অসুস্থ মানুষকে রক্ত, অক্সিজেন, ওষুধ, অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে দেওয়া সবখানেই সবার আগে রয়েছেন বামপন্থী ছাত্র-যুবরা।
এই পরিস্থিতিতে ত্রিপুরায় তৃণমূল কংগ্রেস কী চাইছে? রাজনৈতিক দল হিসেবে তৃণমূল কংগ্রেস নিশ্চয়ই ত্রিপুরায় আসতে পারে, তার সংগঠন গড়ার, ভোটে লড়ার সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে। কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসের ত্রিপুরা বা কোথাও বিজেপির প্রকৃত বিরোধী হওয়ার মতো রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা আছে কি? হ্যাঁ, আমি পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের কথা মাথায় রেখেই এ কথা বলছি। এ কথা কি ইতিহাস থেকে মুছে যাবে যে মমতা ব্যানার্জিই বিজেপিকে পশ্চিমবঙ্গে ‘ফোরফ্রন্টে’ এনেছেন। দুবার বাজপেয়ি সরকারে শরিক তৃণমূলই ছিল। তৃণমূল জমানাতেই পশ্চিমবঙ্গে আরএসএস-এর ব্যাপকতম সাংগঠনিক প্রসার ও বিস্তৃতি ঘটেছে। গুজরাটের সংখ্যালঘু গণহত্যার (হ্যাঁ, গণহত্যা; দাঙ্গা নয়) পর গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী যখন ফের ভোটে জিতলেন, তাঁকে ফুলের শুভেচ্ছা পাঠিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি, যিনি বিজেপির আদর্শগত উৎসস্রোত আরএসএস-এর কাছে ‘দুর্গা’।
না, তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি এক নয়। তথাকথিত ‘বিজেমূল’ তত্ত্বও অবাস্তব। কিন্তু যা বাস্তব তা হল আরএসএস-বিজেপির প্রধান মতাদর্শগত শত্রু কমিউনিস্টরা এবং দেশের বৃহত্তম সংগঠিত কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে সিপিআই(এম)। অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম এবং অস্তিত্বের উৎসই হল সিপিআই(এম)-বিরোধিতা। তাই তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপিকে এক শিবিরে, এক ছাতার নিচে না এনেও এ কথা বলতে কোনও অসুবিধা নেই যে দুই দলেরই মূল শত্রু সিপিআই(এম) তথা বামফ্রন্ট। আর বামবিরোধী শক্তিগুলির প্রকাশ্যে বা গোপনে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে একত্রিত হওয়ার ঘটনা ইতিহাসে বারবার ঘটেছে, ভবিষ্যতেও ঘটবে। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে সংসদে একের পর জনবিরোধী বিল পাস করানোর সময়ে তৃণমূলের অনুপস্থিতি, দিল্লিতে কৃষকদের পাশে বিরোধীদের সংহতির মঞ্চে তৃণমূলের অনুপস্থিতিতে বরং এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে বিজেপির চরম জনবিরোধী, কর্পোরেটমুখী অর্থনৈতিক নীতির বিরোধিতার প্রশ্নে তৃণমূল আন্তরিক নয়। সারদা, রোজভ্যালি, নারদায় অভিযুক্তরা আজ তৃণমূলে কাল বিজেপিতে, পরদিন আবার তৃণমূলে। কে যে কবে কোথায় সেটা মনে রাখতে তাদের নিজেরই যে প্রবল অসুবিধা হচ্ছে তার সাম্প্রতিক উদাহরণ মুকুল রায়।
তাহলে তৃণমূল কোন বিশ্বাসযোগ্যতায় ত্রিপুরায় বিজেপির বিরোধী শক্তি হতে চাইছে? ২০১১ থেকে পশ্চিমবঙ্গে যেভাবে কলেজ ছাত্রসংসদ থেকে পঞ্চায়েত, পুরসভা সহ সমস্ত নির্বাচনকে তৃণমূল কংগ্রেস প্রহসনে পরিণত করেছে, তাতে প্রমাণিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি তৃণমূলের কোনও আস্থা নেই এবং বিজেপির মতোই মমতা ব্যানার্জিও চূড়ান্ত একদলীয় স্বৈরাচারী শাসনই পশ্চিমবঙ্গে কায়েম করেছেন। সারাদেশের মতো পশ্চিমবঙ্গেও বেকারি বাড়ছে, নিয়োগ বন্ধ, শিল্পে কোনও নতুন বিনিয়োগ নেই। পশ্চিমবঙ্গে কৃষির সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে শিল্প গড়ে তোলার যে চেষ্টা বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে শুরু হয়েছিল, তার সর্বনাশ করার পর বিনিয়োগকারীরা পশ্চিমবঙ্গ থেকে মুখ ফিরিয়েছেন। তিনি ত্রিপুরায় নতুন কী দিতে পারেন?
মমতা ব্যানার্জি তৃণমূল কংগ্রেসকে ত্রিপুরায় কাদের ভরসায় গড়ে তুলবেন? মূলত কংগ্রেসের একটি ছোট হতাশাগ্রস্ত অংশ যাদের পক্ষে চিরাচরিত বামবিরোধিতার জন্য বাম শিবিরে যাওয়া সম্ভব নয়, অথবা বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শের সাথে মানিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়, অথচ কংগ্রেসের নিষ্ক্রিয়তায় যারা হতাশ। আর তৃণমূলে ভিড় করতে পারেন বর্তমান বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী এবং দলে তার গোষ্ঠীর সঙ্গে লড়াইয়ে পেরে না ওঠা কিছু বিজেপি নেতা ও কর্মী। সুদীপ রায় বর্মণ সহ বিক্ষুব্ধ কিছু বিধায়ককে দলে টানার চেষ্টা হবে। কিন্তু ৫ বছরে কংগ্রেস, তৃণমূল হয়ে বিজেপিতে যাওয়া রায় বর্মণ ও তার অনুগামী বিধায়কদের বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে স্বয়ং তৃণমূল নেত্রীই নিশ্চিন্ত থাকতে পারবেন কি? এ প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যৎই দিতে পারে।
ত্রিপুরার রাজনীতির আরেকটি বৈশিষ্ট্য যা তৃণমূল কংগ্রেসের জন্য আদৌ স্বস্তির নয় তা হল উপজাতি এলাকার রাজনীতি। এর সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের বিশেষ পরিচয় নেই। তাছাড়া ত্রিপুরা এবং অসমের বরাক উপত্যকায় বাঙালি জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্য বলে ত্রিপুরা এবং বরাককে পশ্চিমবঙ্গের একটি বর্ধিত অংশ তথা বাঙালি উপনিবেশ ভাবার দীর্ঘদিনের অভ্যাস পশ্চিমবঙ্গের বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলো এবং সংবাদমাধ্যমের মধ্যে রয়েছে। ত্রিপুরার রাজনীতিতে, উন্নয়নে সমতলবাসী বাংলাভাষী মানুষের সঙ্গে পাহাড়ের কোলে বসবাসকারী উপজাতি অংশের জনগণের সমান ও গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারি রয়েছে। আরও সঠিকভাবে বললে উপজাতি ও বাঙালিদের সহাবস্থান এবং ঐক্যই ত্রিপুরার মূল সুর। তৃণমূল কংগ্রেসের মতো পশ্চিমবঙ্গভিত্তিক দল সেখানে ব্রাত্য। যদি না তারা কোনও উপজাতিভিত্তিক, পরিচিতিসত্তা-সর্বস্ব দলের হাত ধরেন। আপাতত সে সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
নিশ্চিতভাবেই রাজনীতি এক অনিঃশেষ সম্ভাবনা এবং অঙ্কের ভাযায় বললে সীমাহীন বিন্যাস ও সমবায়ের খেলা। বুর্জোয়া সংসদীয় রাজনীতিতে এই খেলা এবং তার বহিঃপ্রকাশ যাকে আমরা নির্বাচন বলি, তা এখন কর্পোরেট পুঁজির ইচ্ছেয় পরিচালিত হয়। সুতরাং ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে ত্রিপুরায় আগামী বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল কী হবে তা এখনই বলার সুযোগ নেই। আগামী সপ্তাহ ও মাসগুলোতে নিঃসন্দেহে ত্রিপুরায় রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয়তা, নিজেদের শিবির শক্তিশালী করার চেষ্টা এবং নতুন নতুন রাজনৈতিক বিন্যাসের সাক্ষী আমরা থাকব।
এতে মিডিয়ারও ভূমিকা থাকবে। মার্কসবাদী, কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের কাছে নির্বাচন একটি উচ্চতর স্তরের রাজনৈতিক সংগ্রাম। তাদের কাছে সামগ্রিকভাবে রাজনীতি সমাজ পরিবর্তনের অস্ত্র এবং একটি আদর্শের বিরুদ্ধে আরেকটি আদর্শের যুদ্ধ বা battle of ideas। কিন্তু আজকের সময়ে বুর্জোয়া সংসদীয় রাজনীতি ও নির্বাচন মূলত অর্থ ও পেশীশক্তির লড়াই এবং সিংহভাগ মিডিয়ার কাছে প্রচারের চাকচিক্য ও দেখনদারিই মূল উপজীব্য। অধিকাংশ মিডিয়া হাউসই ত্রিপুরাতেও বিপুল অর্থশক্তির সামনে নতজানু হবে এটাও আগে থেকেই বলা যায়। আমরা এখন মিডিয়ায় যা দেখছি তা থেকে এই ধারণাই তৈরি হবে যে ত্রিপুরা এখন বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেসের একটি নতুন বক্সিং রিং। লড়াই এই দুই শিবিরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, এমন একটি ধারণা তৈরি করার এবং সেই ধারণা জনমানসে প্রোথিত করার চেষ্টা চলছে। নির্বাচন শুধু ভোটের দিনের লড়াই নয়। বরং একটি ধারণার লড়াই বা battle of perceptionও বটে। ত্রিপুরায় কার্যত অস্তিত্বহীন তৃণমূল কংগ্রেসকে মূল বিজেপি-বিরোধী শক্তির জায়গায় বসানোর জন্যই এই চেষ্টা।
অভিষেক ব্যানার্জির কনভয়কে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে বিজেপি। নিন্দনীয় ঘটনা। সে খবর সারা দেশের টিভিতে ব্রেকিং নিউজ হয়েছে। অথচ গত ৪০ মাস ধরে বামপন্থীরা প্রতিদিন রক্ত ঝরিয়ে, সব আক্রমণের মুখেও যে লড়াই রোজ লড়ছেন তার ছিটেফোঁটাও মিডিয়ায় নেই। ২০ বছরের মুখ্যমন্ত্রী বর্তমান বিরোধী দলনেতার কনভয় কয়েকবার আক্রান্ত হয়েছে, সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদকের গাড়িতে আক্রমণ হয়েছে, অসুস্থ বিরোধী দলের উপনেতা বাদল চৌধুরীকে পুলিশ হাসপাতাল থেকে টেনে বের করে থানার লকআপে নিয়ে গেছে। বিধায়করা আক্রান্ত হয়েছেন। অসংখ্য সিপিআই(এম) কর্মী ২০১৮র ৩ মার্চের পর থেকে এখনও ঘরছাড়া, অনেকে রাজ্যছাড়া। প্রতিদিনই আক্রমণ হচ্ছে আজও। কিন্তু এসব সম্পর্কে সেই একই মিডিয়া নীরব, অন্ধ ও বধির। এঙ্গেলস একেই বলেছিলেন নীরবতার রাজনীতি, Politics of silence।
আসলে ত্রিপুরায় তৃণমূল কংগ্রেস কতটা কী করবে সে হিসেব করার সময় এখনও অনেক দূরে। আপাতত যা হচ্ছে তা হল এই battle of perception-এ বিজেপির বিকল্প হিসেবে তৃণমূলকে তুলে ধরা।
এই যুদ্ধেই জিততে হবে বামপন্থীদের। তাঁরা আছেন। প্রতি পাড়ায় আছেন, প্রতিদিন লড়াইয়ে আছেন, সরকারে নেই, কিন্তু সমস্ত সাধ্য নিয়েই মানুষের সঙ্গে আছেন। কিন্তু সেই উপস্থিতিকেই দৃশ্যমান করতে হবে। আরও আগ্রাসী, আক্রমণাত্মক হতে হবে শরীরী ভাষায়। আয়ত্ত করতে হবে প্রচারের সমসাময়িক কৌশল। জানান দিতে হবে জনবিরোধী বিজেপিকে হারানোর ক্ষমতা তারাই রাখেন। যারা দোদুল্যমান ও ত্রিশঙ্কু, তাদের এই ভরসা দিতে হবে, যে বামপন্থাই ভবিষ্যৎ এবং ত্রিপুরাকে এই দুঃশাসন থেকে মুক্ত করতে পারে বামপন্থীরাই। এই বিশ্বাস মানুষের মধ্যে তৈরি করাই আপাতত ত্রিপুরার সত্যিকার লড়াই।