প্রসঙ্গ আফগানিস্তান: পাথরে তা দিলে মুর্গি বেরোয় না

অশোক মুখোপাধ্যায়

 



প্রাবন্ধিক, সেস্টাস-এর প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক

 

 

 

 

আফগানিস্তানের বর্তমান সমস্যার কথা ভাবতে গিয়ে আমার বহুকাল আগেকার, বলা যেতে পারে রাজনৈতিক শৈশবের এক পাঠস্মৃতি জেগে উঠল। সেদিন আবার নতুন করে কমরেড মাও সে-তুং-এর “দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে” পুস্তিকাটির একটা সুপরিচিত সূত্রের কথা মনে পড়ল:

The fundamental cause of the development of a thing is not external but internal; it lies in the contradictoriness within the thing. There is internal contradiction in every single thing, hence its motion and development. Contradictoriness within a thing is the fundamental cause of its development, while its interrelations and interactions with other things are secondary causes. . . . Simple growth in plants and animals, their quantitative development, is likewise chiefly the result of their internal contradictions. Similarly, social development is due chiefly not to external but to internal causes. . . . According to materialist dialectics, changes . . . in society are due chiefly to the development of the internal contradictions in society, that is, the contradiction between the productive forces and the relations of production, the contradiction between classes and the contradiction between the old and the new; it is the development of these contradictions that pushes society forward and gives the impetus for the supersession of the old society by the new. Does materialist dialectics exclude external causes? Not at all. It holds that external causes are the condition of change and internal causes are the basis of change, and that external causes become operative through internal causes.

কাটছাঁট করার পরও উদ্ধৃতিটা বেশ বড়ই হল। এতে মাও বলছেন, প্রকৃতি ও সমাজ, যেদিকেই তাকানো যাক, তার পরিবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু হয় অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব থেকে, ভেতরের বিকাশের চাহিদা থেকে। সেই দ্বন্দ্ব থাকলে এবং সক্রিয় হলে, বাইরে থেকে তাকে কিছু বাড়তি শক্তি জোগান দেওয়া যায় মাত্র। যে দেশের আর্থসামাজিক ব্যবস্থার ভেতরে পরিবর্তনের তাগিদ ভালো করে জন্ম নেয়নি এবং সমাজবদল প্রক্রিয়া চালু হয়নি, তাকে বাইরে থেকে দুটো লাল বই এবং চারটে কালো রাইফেল সরবরাহ করে বিপ্লবের দিকে ঠেলে দেওয়া যায় না। ঠিক যেমন শুকনো পাথরের চাঁইতে তা দিয়ে মুর্গি বের করে আনা যায় না!

দুঃখের বিষয়, অন্যরা এই বদল নিয়ে মাথাই ঘামায়নি, সোভিয়েত ইউনিয়ন আগ্রহ দেখিয়েছিল। কিন্তু সম্পূর্ণ ভুলভাবে। মাওকে ওরা মানত না। সে না হয় বোঝা গেল। মার্ক্সবাদের সার কথাও যদি মানত, লেনিনকে মনে রাখত, তাহলেও বাইরে থেকে ওখানে বিপ্লব রপ্তানি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ত না। নিজেদের সমর্থক একটা দলকে ক্ষমতায় বসিয়ে পাথরে তা দিয়ে মুর্গি বের করতে যেত না।

কিন্তু সেই যে গেল, তারই প্রতিক্রিয়ায়— সেও জানা কথা— আমেরিকা পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে আজকের এই তালিবানদের তৈরি করে ফেলল। ভিয়েতনামের পরাজয়ের পর আমেরিকার তখন এশিয়ায় আর দু-একটা জায়গা দরকার ছিল যেখানে সে পেন্টাগনি তাকত দেখাতে পারে।

তবুও লক্ষণীয়, ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত বাহিনি চলে যাওয়ার পর পেছনে রেখে যাওয়া সরকারি দল খানিক লড়াই করেছিল। অন্তত তিন বছর তারা তালিবান শক্তিকে কাবুল থেকে দূরে ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছিল। সোভিয়েত ট্রাক বা বিমানের পেছন পেছন নাজিবুল্লা বাহিনির কেউ দৌড়ায়নি। পালিয়ে যাওয়ার এই হিড়িকও দেখা যায়নি। অর্থাৎ, তাদের অন্তত তালিবানদের ঠেকানোর একটা তাগিদ বা দায়বোধ ছিল।

সোভিয়েতের ডবল সময় (২০০১-২১) আফগানিস্তান দখল করে থেকেও আমেরিকা নিজের তৈরি সেই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনদের সামলাতে পারেনি। বহুত বোমাটোমা মেরেও তালিবানদের ঘাঁটি খুব একটা ভাঙতে পারেনি। পয়সা সে কম খরচা করেনি। ৯৮৭ বিলিয়ন বা প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার। একের পিঠে বারোটা শূন্য। ভারতীয় লব্জে এক লক্ষ কোটি। যদিও এই ডলারগুলির প্রায় সবটাই খরচ হয়েছে দখলদার আমেরিকান সেনাদের এবং কর্তাদের ভরণপোষণ ও সুরক্ষার জন্য। আফগানবাসীর শিক্ষা স্বাস্থ্য নিরাপত্তার জন্য তারা খরচ করেছে মোট দু কোটি ডলার। শতকরা হিসাব নিতে গেলে পড়তায় পোশাবে না; ০.০০০০২ শতাংশ আসবে। একশো টাকায় দু পয়সার মতো।

স্বভাবতই, আমেরিকা যখন চলে গেল, যাদের সে রেখে গেল, সেই মার্কিনি দালাল পায়রাবাবুদের সেই তাগিদ বা দায়বোধ— কোনওটাই নেই। তারাও চেয়েছিল পালাতেই। নাজিবুল্লার কী দশা করেছিল এই তালিবানরা সেই কথা মনে রেখেই। আমেরিকা গণতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাধীনতা, মুক্ত দুনিয়া, আরও কী কী সব বলে যেন। সেই সব বুক্‌নি হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে পালাল। অত বড় একটা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে পালাতে দেখলে আমাদের খারাপ লাগে না। তালিবানের তাড়ায় পালাচ্ছে দেখলেও না। প্রায় পাঁচ দশক আগে দক্ষিণ ভিয়েতনামের সায়গন থেকে এমনি করেই ওরা পালিয়েছিল। বাঁচোয়া যে সেকালে এত ছবি তোলার এবং আন্তর্জালে ছড়িয়ে দেবার ব্যবস্থা ছিল না। থাকলে এরকমই ছবিই পাওয়া যেত।

 

[২]

আমেরিকা চলে যাওয়ার পর আফগানিস্তানে এই মুহূর্তে তালিবানদের উত্থানের ফলে সকলেরই আশঙ্কা যে ওরা আফগান নারীদের উপর ভয়ঙ্কর অত্যাচার নামিয়ে আনবে। মধ্যযুগীয় ধর্মীয় অনুশাসনের নামে তাদের শিক্ষা চাকরি থেকে দূরে সরিয়ে পর্দা ঢাকা গৃহকোণে বন্দি করে ফেলবে। ইতিমধ্যেই তার সমস্ত লক্ষণ ফুটে উঠতে দেখা গেছে।

কিন্তু এটাই তালিবান সমস্যার মূল কথা নয়। রাশিয়া এবং আমেরিকার হাতফেরতা হয়ে যে আফগানিস্তান এখন বিশ্বের ভূগোলে পড়ে আছে, তাতে খুব শক্তিশালী সমাজবাদী, নিদেনপক্ষে একটা গণতান্ত্রিক শক্তি যদি উঠে আসতে না পারে— পারবে এরকম কোনও নিশ্চিত তথ্যাভাস আমার কাছে অন্তত নেই— পরদেশি আগ্রাসকের হাত থেকে দেশ মুক্তির উদ্ধারকারী হিসাবে তালিবান, আল কায়দা, আইসিস, ইত্যাদি জঙ্গি জেহাদি ইসলামিক সংগঠনেরই উঠে আসার কথা।

আসার কথা, কেন না, চারপাশে এরকম শক্তির উত্থানের জন্য সমস্ত আয়োজন তৈরি আছে। খোদ সৌদি আরবেই এর চাষ চলছে রীতিমতো জোরশোর। শরিয়তি শাসন, হাত পা কেটে নেওয়া, মুন্ডুচ্ছেদ, পাথর ছুঁড়ে নারী হত্যা— ইত্যাদি আদিম বর্বর শাস্তি প্রদানের নামে নরহত্যার প্রমোদ সেখানে নিয়মিত বিধিবদ্ধ রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়া। যে রাষ্ট্র আবার আমেরিকার বন্ধু। আসলে তেলবন্ধু বলা উচিত। গলায় গলায় ভাব।

একটা সুপ্রতিষ্ঠিত ইসলামি রাষ্ট্র যদি ধর্মের নাম করেই এটা এই একুশ শতকেও করতে পারে, তাহলে আশেপাশে যারা বিদ্রোহ করে সমাজে পাত পাড়ার চেষ্টা করছে, তারা যে আরও বেশি করেই এটা চালু করে নিজেদের ধর্মিষ্ঠ প্রমাণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে— এ আর বেশি কথা কী?

অধ্যাপক রাম পুনিয়ানি এক বিবৃতিতে সঠিকভাবেই একে “ডাবল ট্র্যাজেডি” বলেছেন:

We mourn with the Afghan people their double tragedy. The first tragedy—the US’s illegal and utterly unjustified military invasion twenty years ago—helped prepare the ground for today’s tragedy, the accession to power of the Islamo-fanatical Taliban. Condemnation of the latter must not mean any softening of the criticism of US and Western imperialism or in shedding tears at its departure from the country.

আর, ব্যাপারটা এমনও নয় যে ইসলামি শাস্ত্রীয় অনুশাসনে এই সব মধ্যযুগীয় বর্বরতার বিধিবিধান নেই। কোরান থেকে শুরু করে বিভিন্ন ইসলামি শাস্ত্রেই এর প্রতিটি নির্দেশ খুঁজে পাওয়া যাবে।

তবে হ্যাঁ, সান্ত্বনার কথা দুটো বলে রাখি:

প্রথমত, ইসলামি অনুশাসনে শুধু এগুলোই নেই। আছে অনেক ভালো ভালো দামি কথা। যা মানুষকে সুপথ দেখাতে পারে। জ্ঞানে বিজ্ঞানে বিদ্যাচর্চায় আগ্রহান্বিত করে তুলতে পারে। অন্তত তিনশো বছর সেরকম পথ দেখিয়েওছিল। বাগদাদ থেকে কসোভায় যে জ্ঞানচর্চার বিশাল আয়োজন হয়েছিল ইসলামি আদি শাসকদের অনুপ্রেরণায় ও আর্থিক মদতে, সেই মূলধন ভাঙিয়েই ইওরোপে পনেরো শতকে এসেছিল নবজাগরণ। ভারতের অনেকটা এবং গ্রিসের সমস্ত প্রাচীন জ্ঞানভাণ্ডারও ওরাই বাঁচিয়ে রেখেছিল ইতিহাসের কোলে।

কিছুকাল আগে আমি ডাঃ সুমিতা দাসের লেখা “অন্য এক রেনেসাঁস: আরবি-ইসলামীয় সভ্যতার স্বর্ণযুগে জ্ঞানবিজ্ঞানের বিকাশ” গ্রন্থের বিস্তৃত পর্যালোচনা করতে গিয়ে “একুশ শতকের যুক্তিবাদী” পত্রিকার পাতায় লিখেছিলাম: “মহম্মদ নিজে নিরক্ষর হলেও ছিলেন সত্য ও জ্ঞানের পূজারী। তাঁর কিছু উক্তি থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্বন্ধে তাঁর অভিমত বোঝা যায়। যেমন, তিনি বলেছেন: “বিশ্বস্রষ্টার সৃষ্টিকে ভক্তিচিত্তে এক ঘন্টা অনুধাবন করা সত্তর বৎসর প্রার্থনার চেয়ে শ্রেষ্ঠতর”; “হাজারটা শহিদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দেওয়ার চেয়ে এক ঘণ্টার জন্য বিজ্ঞান ও জ্ঞানের শিক্ষা গ্রহণ করা অনেক বেশি প্রশংসনীয়— এমনকি হাজার রাত্রি নামাজি কাতারে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়েও প্রশংসনীয়”; “জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ অর্ধেক ভালো থেকে গুণের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছতে পারে”; “জানার জন্য প্রয়োজনে চিনেও যেতে রাজি আছি”; “দুনিয়া শুধু হিম্মতওয়ালাদের নয়, আরও বেশি করে হিকমতদারদেরও”; ইত্যাদি।

এই চেতনা সঞ্চারিত হয়েছিল তাঁর উত্তরসূরিদের মধ্যেও। মহম্মদের জামাতা আলি, যিনি চতুর্থ খলিফা হয়েছিলেন, জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বক্তৃতা দিতেন। তাঁর কয়েকটি প্রসিদ্ধ উক্তি: “বিজ্ঞানে বিশিষ্টতা অর্জন করা হচ্ছে সর্বোচ্চ সম্মান”; “সে মরে না যে জ্ঞানের জন্য জীবন উৎসর্গ করে”; “পাণ্ডিত্যই হচ্ছে মানুষের মহত্তর মুহূর্ত”। মহম্মদ ও তাঁর শিষ্যদের এইরকম অনুভব আরবের সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে জ্ঞানার্জনের স্পৃহাকে ধীরে ধীরে জাগিয়ে তোলে। মহম্মদের জীবনকালে যে সমস্ত শিক্ষাকেন্দ্র ছিল সেগুলিই ভবিষ্যতে মুকুলিত হল বাগদাদ, সালের্নো, টলেডো, কর্ডোবা, কায়রো, গ্রেনাদা ইত্যাদি বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে। মহম্মদের মৃত্যুর ১০০ বৎসরের মধ্যে ইসলামিক সাম্রাজ্য পশ্চিম এশিয়া থেকে শুরু করে স্পেন পর্যন্ত এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।” [একুশ শতকের যুক্তিবাদী; বইমেলা, ফেব্রুয়ারি ২০১৯]

দ্বিতীয়ত, শুধু ইসলাম নয়, দুনিয়ার সমস্ত ধর্মই এরকম দ্বিচারী অনুপ্রেরণায় বিদীর্ণ। ধর্মের পক্ষে এরকম হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। প্রেমের পাঠও দিতে হয়, ঘৃণা এবং হত্যায় প্ররোচনাও দিতে হয়। মধ্যযুগান্তে ইওরোপে বাইবেল মেনেই সার্ভেতাসকে বা ব্রুনোকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। বাইবেল মানলে সেদিন ওছাড়া অন্য কিছু করার উপায় ছিল না। ব্রাহ্মণ্য ধর্মেও যেমন ব্রহ্ম আছে, শূদ্রও আছে; “সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম”, কিন্তু শূদ্রে ব্রহ্ম নেই। মনুর বিধানে ব্রাহ্মণকে হত্যা করা মহাপাপ, কিন্তু শূদ্রকে হত্যা করলে পুকুরে ঢিল ছোঁড়ার বেশি অপরাধ হয় না। নরেন্দ্রনাথ দত্ত পাঠে আপনি আরএসএস-এর পক্ষেও প্ররোচনামূলক অনেক বাণী পাবেন (যার দ্বারা ওরা উদ্বুদ্ধ হয়), আবার আরএসএস-বিরোধী অনেক উদ্ধৃতিও পাবেন, যা নিয়ে আমাদের সংসদীয় বামপন্থীরা মহা ব্যস্ত!

প্রশ্নটা হচ্ছে কে কী নেবে।

আইসিস, বোকো হারাম, আল কায়দা, তালিবান— এরা ইসলামের পূর্বোক্ত পাঠ নিয়েছে। ধর্ম মেনেই। ওরা কেন আল খোয়াজমি বা ওমর খৈয়ামের মতো করে ইসলামের শিক্ষা নেয়নি— এই প্রশ্ন করলে ওরা তার উত্তর দিতে বাধ্য নয়।

ওদেরকে সেইসব শিক্ষা গ্রহণে বাধ্য না করতে পারলে, ওরা এমনটাই করবে। আজকের যুগে যে ধর্মকে নিয়ে চলা যাবে না, ধর্মকে ঘরে রেখে রাস্তায় আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান হাতিয়ার করে বেরোতে হবে— এটা শুধু বাণীর আকারে দিলে ওরা কখনওই মানবে না। গ্যালিলেও যেমন প্যাপাল বিচারকদের বিজ্ঞান বোঝাতে পারেননি, উলটে জান এবং জ্ঞান বাঁচাতে পোপের আদেশই শিরোধার্য করতে হয়েছিল, যারা তালিবানকে বোঝাতে যাবে তাদেরও সেই দশা হবে।

তবে হ্যাঁ। আমেরিকা চলে যাওয়ার পর চিন এবং রাশিয়া এখন আফগানিস্তানের ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছে। জায়গাটার উপরে তাদের লোভ আছে দারুণ। চিন এখন আফ্রিকায় আস্ত আস্ত এক একটা পাহাড় কিনে নিচ্ছে (আসলে ঋণ দিয়ে ঋণগ্রস্ত করে ধার শোধের উপায় হিসাবে পাহাড় জঙ্গল দিয়ে দিতে বলছে), আফগানিস্তানেও সেরকম হলে মন্দ হয় না। রাশিয়ার পুরনো জেনারেলদের অনেকের দেশটা নিয়ে কিছু অভিজ্ঞতাও আছে। তালিবানদেরও করে খেতে হবে। শুধু কালাশনিকভ চালিয়ে লোকজনকে ভয় দেখানো যাবে, নিজেদেরও পেট ভরবে না। ব্যবসাবাণিজ্য লেনদেন করতে হবে কিছু না কিছু। তার চাপ অনেক। ধর্মের অনেক কিছুতে তখন তাদেরও ছাড় দিতে হবে।

তবে যাই ঘটুক, একটা সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। আফগান জনগণ আপাতত গণতন্ত্র এবং সুশাসন পাচ্ছেন না। কদ্দিনে পাবেন বলা মুশকিল। পালিয়ে বা লুকিয়ে তা পাওয়া যাবে না। পেতে হলে পালটা শক্তি সমাবেশ ঘটাতে হবে। এখন থেকেই। ধীরে ধীরে। ধর্মের বেড়া ভেঙে। ইসলামের পতাকা হাতে তুলে গণতন্ত্র আসবে না। দুনিয়ার কোথাও আসেনি। আসার কথা নয়। ভেতরে কিছু কিছু শক্তি লড়াই দিচ্ছে বলে খবর ভেসে আসছে। সেই সব খবর কতটা সত্য এখনই বলা মুশকিল। সালিমা মাজারি যে চেষ্টা করছিলেন, তা সফল হয়নি। তিনি ধরা পড়েছেন, হয়ত তাঁকে কোতলও করে দিয়েছে, বা দেবে। নর্দার্ন অ্যালায়েন্স আর একটা প্রয়াস চালাচ্ছে। তাদেরও সামর্থ্য কতটা বা তাদের লক্ষ্যই বা কী— ভালো করে জানা নেই। ধর্মের পতাকা ঝেড়ে ফেলতে না পারলে অন্যরকম কিছু হওয়ার নয়।

বিপ্লব বা সমাজতন্ত্রের কথা পরে হবে। আপাতত একটা সভ্য গণতান্ত্রিক সমাজের কথাই ভাবা যাক। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের সুশিক্ষা সুস্বাস্থ্যর বন্দোবস্ত হোক। সকল সক্ষম নারী-পুরুষের চাকরিবাকরির ব্যবস্থা থাকুক। সমস্ত নাগরিকের মত প্রকাশের ব্যক্তিস্বাধীনতা আসুক। হিজাব বোরখা নামক মধ্যযুগের বর্বর পোশাক দু-চার পিস জাদুঘরে যেন অবশ্যই থাকে। এটুকু হলেই আপাতত আফগানিস্তান একুশ শতককে ধরে ফেলতে পারে!

 

[৩]

আফগান জনগণকে প্রয়োজনে ভারত থেকে শিক্ষা নিতে হবে। এখানেও ধর্মের নামে গণতন্ত্রের পতাকা ভূলুণ্ঠিত। রাম রাজত্বে এই সেদিন স্ট্যান স্বামীর বিনা বিচারে জেলের মধ্যে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হল। দাভোলকর হত্যার দিবস সদ্য পার হল। গৌরী লঙ্কেশ, কালবুর্গি, গোবিন্দ পানসারেকে হত্যা করা হয়েছে। ৪৩ জন জওয়ানকে হত্যা করা হয়েছে একটা খুনে সন্ত্রাসীকে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী বানানোর জন্য। দিল্লিতে বিক্ষোভরত চারশো কৃষকের মৃত্যুতেও আম্বানি-আদানির ভৃত্য সরকার নির্বিকার। আকস্মিক লকডাউনে সারা দেশে দুহাজার ঘরছুট শ্রমিকের মৃত্যু। অসমে উনিশ লক্ষ নাগরিক দেশহারা হয়ে দিশাহারা। যাদের গন্তব্য ডিটেনশন ক্যাম্প। ধর্ম নিয়ে রাজনীতির ব্যবসায় নামলে সে কী দিতে পারে, সঙ্ঘ পরিবার প্রতি দিন ভারতবাসীকে দেখিয়ে দিচ্ছে। আর্যাবর্তে যা হচ্ছে, গান্ধারে তার অন্যথা হবে ভাবার কোনও কারণ নেই। গেরুয়া বা সবুজে ইতরবিশেষ হওয়ার নয়। খোসা যেমনই হোক, ভেতরের শাঁসটা একইরকম। তেতো। বিষাক্ত। মরণান্তিক!

এই কথাগুলি এখন সাহস করে সবাইকেই বলতে হবে। দুনিয়া জুড়ে!

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

আপনার মতামত...