সত্যব্রত ঘোষ
প্রাবন্ধিক, চলচ্চিত্রবেত্তা
সেই ক্রনোলজির কথাই আবার এসে যায়। ইদানিং যা কিছু ঘটমান, তার ক্রনোলজি। নতুন করে যখন ‘ক্রনোলজি’ শব্দটিকে ভারতের নাগরিকদের জমকালোভাবে ‘সমঝানো’ হল, তার পরের ক্রনোলজি। ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত এই দেশে নাগরিক পঞ্জিকরণের ছুতোয় নতুন করে ‘বিধর্মী’-দের চিহ্নিতকরণের প্রয়াস নেওয়া থেকে যার শুরু। তখন থেকে এখন— যখন আফগানিস্তানে তালিবানি শাসনের ‘আতঙ্কে’ ঘুরপথে আবার সেই নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আড়ালে-আবডালে ফিসফিসিয়ে আলোচনা হয়।
নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে শাহিনবাগে এবং দেশের বিভিন্ন কোণে ধর্নায় বসা মহিলাদের জমাট হয়ে থাকা ক্রোধকে যখন সাম-দান-দণ্ড-ভেদ দিয়েও প্রশমিত করা গেল না, তখন টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে উঠল প্রধান সেবকের মুখ। শান্ত কণ্ঠে ‘পেয়ারে দেশবাসীয়োঁ-দের প্রথমে জানিয়ে দেওয়া হল ‘জনতা কারফিউ’-এর কথা। তারপরে কয়েক ঘণ্টার নোটিসে সারা দেশে জারি হল একুশ দিনের লকডাউন। দিব্যজ্ঞানপ্রাপ্ত এক যোগীর সমাহিত দেহভঙ্গি নিয়ে তিনি আশ্বাস দিলেন এই একুশ দিনের মধ্যেই ভারত এই ভাইরাস প্রতিরোধ করবে। সেই একুশ কবে যে দুশো দশ অতিক্রম করে চারশো কুড়ি হল, তা এখন অলিখিত ইতিহাসের পাতায়। তবে সেই সুযোগে অত্যন্ত সুচতুর উপায়ে ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রাখাকে বাধ্যতামূলক করে সব ধরনের অবস্থান-বিক্ষোভকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হল।
লকডাউন করে অতিমারিকে কতটা প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে, তা বিশেষজ্ঞরাই বলতে পারবেন। তবে লকডাউনের দীর্ঘায়িত অধ্যায়গুলিতে সাধারণ মানুষের স্মৃতিতে চিরদিন রয়ে যাবে ‘বন্দে ভারত’ বলে নিরবচ্ছিন্নভাবে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানগুলিতে বিভিন্ন দেশ থেকে অভিবাসী ভারতীয়দের এনে তাঁরা ইতিমধ্যেই সংক্রামিত কিনা তা পরীক্ষা না করেই রাজ্যে রাজ্যে পাঠিয়ে দেওয়া হল। আবার এই দেশেতে বসবাসকারী যে মানুষগুলি অভিবাসী শ্রমিকের দীনতা নিয়ে বেঁচে থাকে, তাঁদের বাড়ি ফেরার প্রাণান্তকর প্রয়াসের প্রতি প্রধান সেবকের দলের অমানবিক নির্বিকারত্ব।
সংবাদপত্র এবং বিশেষ করে নিউজ চ্যানেলের দৈনিক শিরোনামগুলিতে এর পরে আসে ‘আত্মনির্ভর ভারত’-এর কথা। দেশের অধিকাংশ মানুষ যখন কাজ হারিয়ে অনিশ্চয়তার অন্ধকারকেই নিয়তি বলে মেনে নিয়েছেন, ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোগকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার নামে ঘটা করে যে প্যাকেজ ঘোষিত হল, তা মূলত অঙ্কের মারপ্যাঁচ। সোজাসাপটা ভাষায় প্রধান সেবক বললেন, না, টাকা দিয়ে দেশবাসী ও তাঁদেরকে পরিবারকে সাহায্য করবেন না। কারণ, তাতে হাত পেতে থাকা ব্যক্তিমানুষদের আত্মসম্মান নিয়ে যে টানাটানি হবে তা তিনি সইতে পারবেন না। তাই ব্যক্তিদের নয়, সংস্থাগুলিকে ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কল্যাণকারীর ছদ্মবেশে তিনি দেশবাসীকে আত্মনির্ভর হওয়ার পরামর্শ দিলেন।
অতিমারি মোকাবিলার নামে বেপরোয়া লকডাউন চললে অজস্র মানুষ কর্মহীন হবেন— হয়েছেনও। গত বছর লকডাউনের শুরুর দিকেই অক্সফ্যাম-এর রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে যে, বিশ্বের সর্বাধিক কড়া লকডাউন চালুর ক্ষেত্রে আমাদের দেশ ছিল প্রথম সারিতে। অথচ লকডাউন চলাকালীন সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে ব্যয়ের হিসেবে আমরা ছিলাম একেবারে তলানিতে৷ এই দুইয়ের মিশেলের প্রতিফল যেমন হওয়ার, তেমনই হয়েছে। লাগাতার ইশকুল বন্ধের ঠেলায় আস্ত একটি প্রজন্ম স্কুলছুট হয়ে পড়েছে— যাদের মধ্যে কতজন আবার স্কুলে ফিরবে, বলা মুশকিল। যে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাই নড়বড়ে, সেখানে অতিমারি রুখতে লকডাউনই সহজতম পথ। সহজতম, কেননা লকডাউনের শেষে সমাজের যে অংশটি সবচেয়ে ধনী, দেখা যাচ্ছে সেই অংশটির সম্পদ এই সময়েতেই উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। তাই এমনটা ধরে নিতেই হবে যে দ্বিতীয়-তৃতীয়-চতুর্থ… একটির পর একটি করোনার ঢেউ আসতেই থাকবে।
তাই ক্রনোলজি ধরে এর পরের শিরোনামগুলিতে তোলপাড় তুলেছে ভাইরাসের প্রতিষেধক নিয়ে প্রধান সেবকের কূটনীতি, বিদেশনীতি তথা সঙ্কীর্ণ রাজনীতি এবং পিএম কেয়ার ফান্ড-এর প্রচার। সেই লকডাউনের সুযোগে গরিষ্ঠপ্রধান রাজনীতি যে অবিশ্বাস্য ধূর্ততার সঙ্গে বিরোধীদের প্রতিবাদ এবং সংসদীয় রীতিনীতি জলাঞ্জলি দিয়ে লোকসভায় এবং রাজ্যসভায় তিনটি কৃষি-বিরোধী আইন পাশ করিয়ে নেয়, তার জের চলে দেশের ৭৫তম স্বাধীনতা দিবস যাপন অবধি— যখন দিল্লির লালকেল্লাকে দেশেরই কৃষকদের ‘হামলা’ থেকে বাঁচাতে অভূতপূর্ব সুরক্ষায় ঢেলে ফেলে প্রধান সেবকের বাহিনি।
জনকল্যাণের চিন্তা নয়, প্রধান সেবক যে একের পর এক ব্যবসায়িক স্বার্থ পূরণের প্রক্রিয়াকে নিয়মে পরিণত করেছেন তা আমরা সম্প্রতি সরকারি সম্পত্তির নিলামের প্রস্তুতিপর্বে দেখছি। এবং টের পাচ্ছি, তাঁর বিরোধীদের আগামী পদক্ষেপগুলি গোড়া থেকে জানতে গোয়েন্দা নজর বাড়ানোর প্রতি তাঁর অতিরিক্ত উৎসাহ। অথচ ২০১৭ সালে ইজরায়েল সফরে গিয়ে বিপুল টাকার বিনিময়ে তিনি পেগ্যাসাস স্পাইওয়্যারের শরণ নিয়েছেন, তা নিয়ে টুঁ-শব্দটি উচ্চারণ করলেন না তিনি। উল্টে, বিরোধী সদস্যরা বর্ষাকালীন সংসদ অধিবেশনের প্রতিটি দিনে এই নিয়ে তদন্তের দাবি তুললে তাঁর দলের মুখপাত্ররা শুধু দেশের অন্দরের সুরক্ষা বাড়ানোর গুরুত্বটিকে শ্রোতা, দর্শক এবং পাঠকদের বুঝিয়ে গেছেন।
দেশের অন্দরকে সুরক্ষিত করবার প্রতি প্রধান সেবকের দলের এই আগ্রহ যে তাঁকে শীর্ষে বসিয়ে নিজের নিজের আখের গোছানো ছাড়া যে আর কিছুই নয়, তা বোঝা যাচ্ছে অনবরত তৈরি হওয়া শিরোনামের চয়নে। বস্তুত, নিউজ চ্যানেল তথা সোশ্যাল মিডিয়ায় শিরোনাম উৎপাদনে যে একমাত্রিক তৎপরতা ইদানিং আমরা লক্ষ করছি, তা একমাত্র তখনই সম্ভব যখন সংবাদজ্ঞাপন দেশের একটি অন্যতম পণ্যে পরিণত হয়। সব শিয়ালের এক রা হলে অবশ্য একা গোঁসাইয়ের বিশেষ তাৎপর্য থাকে না। এখন তালিবানের আফগানিস্তানে মানবিক বিপর্যয়কে নিয়ে সব মাথা এক হয়ে তাই তাঁদের চ্যানেলে প্রধান শিরোনাম করাটাকেই শ্রেয় মনে করেছেন।
আফগানিস্তানে কুড়ি বছর পরে তালিবান দখলকে সংবাদ শিরোনাম উৎপাদন উদ্যোগ যেভাবে ব্যবহার করে চলেছে, তাকে সামরিক ভাষায় ‘decoy’-ও বলা যায়। কারণ, আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানি প্রধানদের সঙ্গে তালিবানের জটিল সমীকরণটিকে আড়াল করলে প্রধান সেবক কোন কোন উপায়ে সমস্ত বিরোধিতাকে অগ্রাহ্য করবার স্পর্ধা নিয়ে ভারতের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং জাত-পাতের বিভাজন-নীতিগুলিকে নিজেদের শাসন কায়েম রাখবেন, সেই বিষয়ে আলোকপাতের গুরুত্ব আর থাকবে না। হাজার হোক, নিজের শিশুকে সীমানার দেওয়াল টপকে অন্যের হাতে দিয়ে দেওয়াটাকে পর্দায় বারবার দেখালে যে আবেগ সঞ্চারিত হবে, ব্যাঙ্ক, ট্রেন, জীবন বিমা-র মতো সংস্থার সুচারু নিলাম প্রক্রিয়ার দরুণ তৈরি জনসাধারণের অনিশ্চয়তাকে খানিকটা হলেও কম গুরুত্বপূর্ণ সাব্যস্ত করা যায়। যাই হোক, সংবাদ শিরোনাম উৎপাদক ও ম্যানেজাররাই এখন ঠিক করে নিয়েছেন দেশ-বিদেশে যাই হোক না কেন, জনসাধারণের ভাগ্যে আসবে সেই কালনেমির লঙ্কাভাগ। অলমিতি বিস্তারেন।
মৃণাল সেন নির্মিত ‘খারিজ’ (১৯৮২) দেখেছিলাম দূরদর্শনে, কোনও এক শনিবার সন্ধ্যায়। রমাপদ চৌধুরীর উপন্যাসের এই চিত্ররূপ দেখবার পর দমবন্ধ লাগছিল, মনে আছে। মৃণাল সেনকে এক দর্শক জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “ছবির শেষে ছেলেটির বাবা কেন (গৃহস্বামী) অঞ্জনের গালে ঠাসিয়ে একটা চড় মারল না?” উত্তরে ছবির পরিচালক সহাস্যে বলেছিলেন, “মারলে, আপনাদের রাগ যে জল হয়ে যেত। আমি চেয়েছি ওই রাগটুকু নিয়ে বাড়ি ফিরুন আপনারা।” ভাবলে অবাক লাগে, এমন ঘোর লাগা সময়ে আমরা বড় হয়েছি। এই বিশ্বাস নিয়ে যে, যা কিছু খারাপ তা পাল্টে একদিন ভালো হয়ে যাবে। পাল্টালও তো। অবশ্য তা ভালোর জন্যে নয়।
অসাম্য, অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার— জমানো সব ক্রোধ যে ক্রমশ আকাঙ্খা চরিতার্থের লোভে পরিণত হচ্ছে বুঝতে পারিনি। তখন দেখেছিলাম ওনিডা কোম্পানির একটি বিজ্ঞাপন— পড়শির ঈর্ষা, আপনার গর্ব (Neighbour’s envy, your pride)। এমন সহজ ভাষায় সাধারণ মধ্যবিত্ত ভারতীয়দের মানসিকতার রূপান্তরটিকে প্রকাশের মধ্যে দিয়ে শুধু কপিরাইটরের মুন্সিয়ানাই প্রতিষ্ঠিত হয় না। দেশের উপভোক্তাদের মধ্যে নিবিড় সমীক্ষা থেকে আর একটি সহজ সত্যিও প্রকাশ হয়— ভারতবর্ষ পাল্টাচ্ছে।
খুব ভালো বিশ্লেষণ! আমি কিন্তু “ভারত পাল্টাচ্ছে” র জায়গায় বলবো “ভারত ওল্টাচ্ছে”!