সারওয়ার্দ্দি মণ্ডল
সম্প্রসারক, সিতানগর মাদ্রাসা শিক্ষাকেন্দ্র, মুর্শিদাবাদ
পশ্চিমবঙ্গে এই সময়ে সর্বজনীন আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে শিক্ষকদের আন্দোলন। গত ২৪-০৮-২০২১ তারিখ থেকে এই আলোচনা সবার কাছে অতিমাত্রায় প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। অনেকের মনে প্রশ্নের জন্ম নিয়েছে— কেন এই শিক্ষক আন্দোলন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা যা জানতে পারছি তা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। এই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এই আন্দোলনে যাদের ভূমিকা সবার আগে উল্লেখ করতে হয় তারা হলেন এসএসকে-এমএসকে (শিক্ষাদপ্তর, মাদ্রাসা শিক্ষাদপ্তর, পৌরসভার) শিক্ষক শিক্ষিকাগণ। এই শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিয়োগ করা হয় ২০০০ সালের পর থেকে। প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকার যে সমস্ত শিশু বিদ্যালয়ের আঙিনায় বিভিন্ন কারণে পৌঁছতে পারে না, যার ফলস্বরূপ গোটা পৃথিবীর কাছে ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা লজ্জার কারণ হয়ে উঠেছিল, সেই লজ্জার হাত থেকে বাঁচতে সেই সময়ের কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের যৌথ উদ্যোগে এসএসকে (যেখানে প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি) ও এমএসকে (পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে) বিদ্যালয়গুলো তৈরি করা হয়েছিল। সরকারের আর্থিক সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রেখে নামমাত্র সাম্মানিক ভাতার বিনিময়ে বিদ্যালয়ের কাছাকাছি অবস্থিত সেই গ্রামের ৪০-ঊর্ধ্ব ছেলেমেয়েদের কাজে লাগিয়ে বিদ্যালয়ের আঙিনায় না আসা বাচ্চাদের বিদ্যালয়ে আনয়ন করাই ছিল এদের মূল কাজ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশের শিক্ষার হার বৃদ্ধি করতে এই বিদ্যালয়গুলি সরকারের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে। সরকার তার সাধ্যমত প্রতি বছর তাঁদের ন্যূনতম সাম্মানিক বৃদ্ধি করে এই বিদ্যালয়গুলিকে টিঁকিয়ে রাখার চেষ্টা করে। স্বভাবতই এই বিদ্যালয়গুলিতে কর্মরত শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ তাঁদের জীবন-জীবিকা নির্বাহের জন্য এই কাজটিকেই একমাত্র পথ হিসেবে মেনে নেন। ২০০৯ সালে এসএসকে শিক্ষিকাদের ৫৮০০ টাকা ও এমএসকে শিক্ষকদের ৮০০০ টাকা মাইনে প্রদান সহ তাঁদের কাজের মেয়াদ ৬৫ বছর পর্যন্ত সুনিশ্চিত করা হয়।
এইভাবেই রাজ্যের প্রতান্ত এলাকার ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদান করে গেলেও এই এসএসকে-এমএসকে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সময়ের দাবি মত তাঁদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চনার পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। বয়সের কারণে অবসর নিতে থাকা অনেক পরিবারেই দিনের পর দিন অসহায় অবস্থার সৃষ্টি হতে থাকে। ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের একটি রায় সমকাজে সমবেতনের স্বীকৃতি প্রদান করে, সেই সময়ে দেশের শ্রম দপ্তর ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করলেও পশ্চিমবঙ্গের এই শিক্ষক-শিক্ষিকারা তা থেকে বঞ্চিত হতে থাকে। আর এই বঞ্চনার মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে তা থেকে মুক্তি পেতে রাজ্যের এসএসকে এবং এমএসকে-র শিক্ষক-শিক্ষিকারা ২০১৯ সালে বঞ্চিত শিক্ষকদের নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষক মইদুল ইসলামের উদ্যোগে একটি মঞ্চ গঠন করেন, যার নাম শিক্ষক ঐক্য মুক্ত মঞ্চ। এই মঞ্চের নেতৃত্বে শিক্ষকরা শিক্ষকদের প্রতি বঞ্চনার অবসান ঘটাতে এবং তাঁদের ন্যায্য দাবি আদায় করতে রাজ্যের শিক্ষা দপ্তর বিকাশ ভবনের নিকট ওয়াই চ্যানেলে প্রথমে সাত দিন ধর্নায় বসেন। সেই সময় মাননীয় রাজ্যপালের আশ্বাসে ধর্না তুলে নেওয়া হয়। প্রায় ৩ মাস ধরে তাঁদের দাবি না মানার কারণে আবার ঐ একই স্থানে সাত দিন ধর্নায় বসেন। শেষের সাত দিন ধর্না করার পর রাজ্যের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় সেই ধর্নামঞ্চে উপস্থিত হয়ে শিক্ষকদের আশ্বাস দিলে সেই আশ্বাসে আশ্বস্ত হয়ে শিক্ষক ঐক্য মুক্ত মঞ্চ ধর্না তুলে নেয়। পরবর্তীতে সেই আশ্বাসের কিছুটা মান্যতা দেয় তৎকালীন সরকার। এবং তাদের বেতন বৃদ্ধি করা হয়। এসএসকে শিক্ষকদের বেতন দশ হাজার টাকা ও এমএসকে শিক্ষকদের তেরো হাজার টাকা করা হয় এবং পঞ্চায়েত দপ্তরে থাকা এসএসকে এবং এমএসকে-গুলিকে শিক্ষাদপ্তরের অর্ন্তভুক্ত করা হয়।
অন্যান্য দাবি নিয়ে ২০২০ সালে শিক্ষক ঐক্য মুক্ত মঞ্চের উদ্যোগে রাজ্যের সমগ্র শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত চুক্তিভিত্তিক সমস্ত কর্মীদের বঞ্চনা দূর করতে পার্শ্বশিক্ষক, শিক্ষাবন্ধু, শিক্ষামিত্র, কম্পিউটার শিক্ষক সকালে যৌথভাবে একত্রে নতুন করে আন্দোলন আরম্ভ করেন। সেই আন্দোলনের মাধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ১১ জানুয়ারি ২০২১ নবান্ন অভিযান করতে গেলে পুলিশ বাধা সৃষ্টি করলে মহামান্য হাইকোর্টের অনুমতি নিয়ে সেই অভিযান হয় ও ধর্মতলার শহিদ মিনারের পাদদেশে তিনদিন যাবৎ অবস্থান করা হয়। পরবর্তীতে তৎকালীন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখ রানি রাসমণিতে একটি সভা করেন এবং বলেন যে শিক্ষক ঐক্য মুক্ত মঞ্চের উত্থাপন করা দাবিসমূহ নিয়ে নিশ্চিতভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সেই মতোই সমগ্র শিক্ষায় যুক্ত চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক-শিক্ষিকা সহ সমস্ত কর্মী আশায় বুক বাঁধেন। রাজ্যে নির্বাচন হয়, ব্যাপক সমর্থন নিয়ে রাজ্যে আবার সরকার গঠন হয়। রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পরিবর্তন হয়। কিন্তু নির্বাচনের আগে শিক্ষকদের প্রতি দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে কোনও প্রকার উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি রাজ্যের সরকারকে। এই অবস্থায় শিক্ষক ঐক্য মুক্ত মঞ্চ রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ও রাজ্যের শিক্ষাদপ্তরের আধিকারিকদের নিকট বারবার আলোচনা করার চেষ্টা করলে তা ব্যর্থ হয়। একাধিকবার রাজ্যের বর্তমান শিক্ষামন্ত্রীর ব্রাত্য বসুর সাক্ষাৎ চেয়ে চিঠি করা হয়, রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চেয়ে আবেদন করা হয় কিন্তু কোনও কাজ না হওয়ায় নেতৃত্বদের মনে হতাশার জন্ম হয় এবং ক্ষোভের সঞ্চার ঘটে। এ দিকে জাতীয় শিক্ষানীতি অনুসারে শিক্ষা দপ্তরের বাইরে কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকবে না বলা হলেও রাজ্যের পৌরসভার এসএসকে, এমএসকেগুলিকে এখনও শিক্ষা দপ্তরের অধীনে নেওয়া হয়নি। পৌরসভার শিক্ষিক-শিক্ষিকারা উৎকণ্ঠায় থাকায় গত ৬ আগস্ট শিক্ষামন্ত্রীর বাড়ি দেখা করতে যান, কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী বাড়িতে থেকেও দেখা দেননি। ১৭ আগস্ট শিক্ষাদপ্তর বিকাশ ভবনে তাঁরা যান স্মারকলিপি দিতে, তখন বিধাননগর উত্তর থানার পুলিশ জোরপূর্বক তাঁদের গ্রেপ্তার করে। দীর্ঘদিন শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে না পেরে গত ১৮ আগস্ট ২০২১ নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যান তারা, সেখানে শিবপুর থানার পুলিশ তাঁদেরকে জোরপূর্বক গ্রেপ্তার করে। এর পরের দিন ১৯ আগস্ট ২০২১ শিক্ষিকাদের প্রতি বেআইনিভাবে হিংসাপরায়ণ হয়ে শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশে শিক্ষা দপ্তরের আধিকারিকগণ তাঁদের দূরবর্তী জেলা উত্তরবঙ্গে বদলির আদেশ দেন। বদলির আদেশ দেখলেই বোঝা যাবে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীর আচরণ কতটা হিংসাত্মক।
রাজ্য সরকার হিংসাত্মক রূপ প্রকাশ করতে শুধুমাত্র তাঁদের বদলি করেই ক্ষান্ত হয়নি। এই বদলির আদেশের বিরুদ্ধে শিক্ষিকারা মহামান্য হাইকোর্টের দারস্থ হওয়ার জন্য কলকাতায় উপস্থিত হলে তাঁদের কোর্টে যেতে বাধাদান করতে দিনভর লালবাজারে আটকে রাখা হয়। একদিকে সরকারের বঞ্চনা, অসহযোগিতা, অপরদিকে পুলিশি নির্যাতন এসবের মধ্যেই নিজেদের অসহায়তা চেপে রাখতে না পেরে পাঁচজন শিক্ষিকা শিক্ষা দপ্তর বিকাশ ভবনের সামনে বিষ পান করে আত্মহত্যা করতে যান, যা একটা রাজ্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত লজ্জাজনক। রাজ্যের এই শিক্ষিকাদের কথায় রাজ্য সরকার যখন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলনের কোনও মর্যাদাদান করে না, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পরিসর যখন রাষ্ট্রশক্তি কুক্ষিগত করে রেখে আন্দোলনের অধিকারকে গলা টিপে হত্যা করে, তখন মানুষের দমবন্ধ হয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়, তখন তাদের মৃত্যু ছাড়া আর কোনও পথ খোলা থাকে না, তখন তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়।
আজ রাজ্যের শিক্ষিকারা যখন বিষপান করে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে, তখন আবারও আমাদের মনে প্রশ্ন উঠছে, তাহলে রাজ্যের শিক্ষার হাল কী? প্রশ্ন করুন, ভাবুন। পাঁচশত দিনের অধিককাল যাবৎ স্কুল বন্ধ, রাজ্যের বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ, প্রতিনিয়ত নিয়োগ করতে গিয়ে দুর্নীতি, চাকরিপ্রার্থীরা প্রতিদিন রাস্তায়, শিক্ষক রাস্তায়, বিদ্যালয়গুলি মিড-ডে-মিলের সামগ্রী বিলি করতে গিয়ে এখন কার্যত রেশন দোকানে পরিণত হয়েছে। এক সময় যখন বিদ্যালয় মানে শিক্ষাগ্রহণের মন্দির ছিল, তখন আজকের দিনে বিদ্যালয় মানে— কন্যাশ্রীর টাকা পাওয়া, ঐক্যশ্রীর টাকা পাওয়া, সাইকেল পাওয়া, জুতো পাওয়া, ব্যাগ পাওয়া, বই খাতা আর মিড-ডে-মিলের রেশন দোকান। যে শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, সেই মেরুদণ্ড কি শিক্ষাবিহীন ভিক্ষা পাওয়ার মন্দিরে সব ভেঙে শেষ হয়ে যাবে? এই প্রশ্ন রেখেই আমার প্রতিবেদন শেষ করলাম।