ইন্দ্রনীল মজুমদার
ভাই বাড়ি পাল্টেছে। ভাড়া বাড়ি। তাই দেখতে গেলাম। লোকাল ট্রেনে যাওয়াটাই একটা লাভ। কত রকমের মানুষ, কত রকমের ভাষা, কত আশ্চর্য জীবনের গল্প। আর জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেই বর্ষার ছবি। কত যে সবুজের রংবদল দেখায়। কোথা দিয়ে যে ঘন্টা দুই কেটে যায় বোঝা যায় না। নেমেই যথারীতি রিকশা। সে আবার সোজা না গিয়ে ডানদিকে ঢুকিয়ে দিল। কতদিন পরে যে এই রাস্তায় গেলাম। ষাট বছর আগে দুধারে ছায়া দেওয়া গাছ ছিল। আর ছিল একটা আইসক্রিম কল। তার সামনেই একটা একতলা বাড়ি যার লাল মেঝে ছিল। বাইরে সিঁড়ির ধাপে একটা বাচ্চা বসে থাকত। তার দুহাতে দুটো লাল মিষ্টি বরফের টুকরো। গলা আর বুক বেয়ে নামত রক্তের মতো লাল জল। রিকশা থামিয়েও সেই সিঁড়ি খুঁজে পেলাম না। শুধু বড় বড় দোতলা তিনতলা বাড়ি, নিচে দোকান। যা যায় তা একেবারেই যায়।
মসজিদের সরু গলিটা দিয়ে ঢুকেই ডানদিকে ছোট দরজা। দোতলা বাড়ির একতলা। একটা বড়, একটা ছোট লম্বাটে ঘর। বারান্দার একপাশে রান্নাঘর, একপাশে চানঘর। আলো বেশ কম। কিন্তু সিলিং বেশ উঁচু। আগেকার দিনের বাড়ির মতো। ঠিক পিছনেই মসজিদ। সদর দরজা খুললেই রাস্তা, টোটো অটো আর পর পর দোকান। ছোট ঘরটাতেই আমার বিছানা। সাদা দেওয়ালে শুধু মায়ের একটা চেনা ছবি। ঠিক মাথার ওপরে। চা খেয়ে মায়ের ছবিটার দিকে তাকিয়েছিলাম। কাচ ফ্রেম ময়লা হয়ে গেছে। নতুন করে ছবিটা বাঁধাতে হবে। সেই চশমার কাচের ভেতর থেকে কেমন করে যেন চেয়ে আছে। হয়ত নতুন জায়গা বলে রাতে ভাল ঘুম হল না। আলো ফোটার আগেই মনে হল মা কাকে ডাকছে আগের বাড়ির খোলা বারান্দাটা থেকে। উঠে পড়ে গলির দিকে খোলা জানলাটা ধরে দাঁড়ালাম। মসজিদে আজান শুরু হল। তাই শুনে গলিতে ঘুমিয়ে থাকা কুকুরটা ধড়মড় করে উঠে পড়ল। খালি গায়ে লুঙ্গি পরে যেতে যেতে এক ফর্সারং প্রৌঢ় গলি দিয়ে যেতে যেতে জানলায় আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন। চুপ করে খানিকক্ষণ আমাকে দেখতে দেখতে বললেন ‘আপনি পিন্টুর দাদা না?’ আমি মাথা নাড়তেই বললেন ‘কতদিন পরে দেখছি তো, তাই ভাবছিলাম ভুল হল কিনা।’ বুঝলাম পিন্টুর বন্ধু। কেমন আছেন কোথায় আছেন এইসব কুশল বিনিময় করে পা বাড়ালেন। আবার ফিরে এসে বললেন ‘রবি আপনার কথা খুব বলত। মারা গেছে জানেন তো?’ ভেসে উঠল রবির মুখ। তুখোড় ছাত্র ছিল। দারুণ হাসাত। একটু তোতলা ছিল। কিন্তু এঁকে এত চেনা লাগল তবু নাম মনে পড়ল না। এঁর চেহারা, কথা এমন কারও মতো যে আমার চোখের সামনে এখনই দাঁড়িয়ে গেল। কে সে? মুনির, মুনির! এতদিন, এতদিন পরে? কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল সেই মুখ যা এখন আমি মায়ের ছবিটার চেয়েও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি? ফিরে এল এই শান্ত ভোরবেলায়— যখন আজান ভাসছে গলিতে।
কলেজের প্রথম বছরে আমার সঙ্গে পড়ত। আমি তখন এনসিসির ফুলপ্যান্ট পরে কলেজ যাই, বাকি সময় হাফপ্যান্ট। মুনির মেমারি থেকে আসত। সাদা ধবধবে পাজামা আর ঢোলা পাঞ্জাবি। খুব ফর্সা আর টানাটানা চোখ, নাক। হাসলে ওকে এত সুন্দর লাগত। আমার সঙ্গে কোনও মিলই ছিল না। তবু ওকে খুব ভালোবেসে ফেলেছিলাম। কেন কে জানে। এতদিনে সে সব ভাবার সময় এল। পরে জেনেছিলাম ওর দাদু ছিলেন সৈয়দ বংশীয়, মানে বুঝতাম না তখন। ওর বাবা ছিলেন নামকরা ভেষজ ডাক্তার। অনেক রকমের লতাপাতা ওর ঝোলায় থাকত আর আমাকে সেগুলোর নাম বলে দিত, চেনাত। কত অদ্ভুত শব্দ যে ওর কাছে শুনতাম তার একটাও আজ মনে পড়ে না। মাঝে মাঝে মনে হয় যে ভাষায় কথা বলি লিখি তা নতুন কিছু, সাজানো কিছু। আমার সঙ্গে ইংরিজি পড়বে বলে আমার বাড়িতে প্রায়ই এসে সারাদিন থাকত। সে কলেজ থাক আর নাই থাক। ওর কাঁধের ঝোলায় কোনও না কোনও চারা বা গাছের শেকড় থাকত। মায়ের সঙ্গে ওর বেজায় ভাব। মা বলে ডাকত। চোখের সামনে দেখতে পাই মা তালের বড়া ভেজে তুলে তুলে ওর প্লেটে দিচ্ছে। সেই প্লেট ও খুব পরিপাটি করে ধুয়ে মুছে দিত। মা তাল জোগাড় হলেই ওকে ডাকত। বিশেষত নন্দোৎসবের দিন। মায়ের কাছে সেদিনই আমার জন্মদিন। অন্য তারিখ মা জানত না। সেদিন বা বিজয়া দশমীর দিনেই শুধু নয়। যখনই আসত মাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করত। আমি হাসলে বলত প্রণাম মানে মাটিকেও প্রণাম করতে হয়। একদিন দেখি মা উনুনের সামনে পিঁড়িতে বসে। মুনির সামনে উবু হয়ে বসে মায়ের হাত ধরে রেখাবিচার করছে। দেখার পরে ও উঠে পড়ে মাথায় সাদা একটা কাপড় বেঁধে নিল। তারপর স্কুলমাঠের দিকে মুখ করে আজান দেওয়ার ভঙ্গিতে বসে পড়ল। কিছু বলছিল ও বিড়বিড় করে। অবাক হয়ে গেলাম। ঘরে এলে বললাম কী বলছিলি রে? ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে চুপ করিয়ে দিল। কিছুক্ষণ পরে বলল মাকে তুই দেখিস, দেখবি তো? কথাটা মনে এল আজ। না আমি দেখিনি তো। শেষ দেখাটুকুও হয়নি। হলেই বা কী হত? তখন তো কোনও বোধই নেই। সে দিনের পরে আর ও আসেনি। কলেজেও না। তারপর অপেক্ষা করে করে নন্দোৎসবের দিন মায়ের দেওয়া তালের বড়া কাগজে মুড়ে নিয়ে গেলাম কলেজে। বিকেলবেলায় সেই কাগজের পুঁটলি কলেজের সামনে শায়রের জলে ফেলে দিয়ে সেই সিঁড়িতেই বসেছিলাম রাত অব্দি। মাকে ফিরে গিয়ে কী বলব তাই ভাবছিলাম। পরে একটা পোস্টকার্ড পেয়েছিলাম। ওর আব্বাজান হঠাৎ চলে যাওয়ার কথা, কলেজ ছেড়ে দেওয়ার কথা জানিয়ে। মাকে বলিনি। মা আবার ওর জন্যে কাঁদবে তাই। তখন বোধহয় সেকেন্ড ইয়ার। এখনই আজানের রেশ, লাল কালো তালের বড়ার গন্ধ, মুনিরের মনভোলানো হাসি সব একসঙ্গে মাথায় তুবড়ির বড় বড় ফুলের মতো ফেটে পড়তে লাগল। মুনির খুব ভাল তুবড়ি বানাত, আমাকে বলেছিল। এতদিন পরে আমার মাথার ভেতরে নিঃশব্দে ফুটছিল তুবড়ির ফুল— মুনিরের। মায়ের মলিন ছবিটা শুধু তাকিয়েই ছিল।
পিন্টু নিজে চা করে দু হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকল। আমার ফাঁকা বিছানাটায় চাদর টান করে দিয়ে বসল। বললাম ‘জানিস এখন যখনই কলেজ স্ট্রিট যাই মেডিকাল সার্জিকাল দোকানগুলোতে দেখি কতরকম ফোল্ডিং সুবিধামতো পাল্টে নেওয়ার চেয়ার-কমোড পাওয়া যায়। শুধুই বেডপ্যানের দিন আর নেই!’ মায়ের ছবিটার কথা বলতেই ও নামিয়ে নিয়ে মুছতে লাগল যত্ন করে। ঠিক এইভাবে ও কোলে তুলে মাকে বাথরুমে নিয়ে যেত প্রথমদিকে। তারপর তো ওর দোকান ব্যবসায় যেতেই পারত না ঠিকমতো। ‘মায়ের পেনশান তো আর নেই। তোর খুব কষ্ট হচ্ছে, না?’ ও কোনও উত্তর না দিয়ে মায়ের ছবিটা মুছেই যাচ্ছিল। ও খুব স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারে না। আমি জানি। ওর মুখের দিকে চেয়ে থাকি। ও যেন আমার চেয়েও বুড়ো হয়ে গেছে। সাদা কালো না-কাটা দাড়ি খোঁচা খোঁচা হয়ে আছে। চুল এখনও শক্ত সোজা সোজা সজারুর কাঁটার মতো। চোখের নীচ থেকে গাল পর্যন্ত একটা লম্বা কালো দাগ। বাজি ফাটাতে গিয়ে মুখ নিচু করতেই ফেটে গিয়েছিল তুবড়ি। মা তারপর খুব যত্ন করেছিল। রোজ নিমহলুদের ক্বাথ লেপে দিত রাত্রে। মাকে বলি ‘দেখছ চোখের দাগটা কেমন বসে গেছে কালো হয়ে।’ মা কি উত্তর দিল? ‘দাগ কি মিলিয়ে যায়? আরও বসে বসে যায়।’