অর্ণব বসু
তখন সদ্য সদ্য ছবি দেখা শুরু করেছি, ছবি নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে, এমন সময় একটা বই এল হাতে, নাম ‘ছবির চশমা’। বইটার এই অদ্ভুত নামকরণ আমাকে বেশ ভাবিয়েছিল, বিশেষত এই চশমা শব্দটি দ্ব্যর্থক এবং ব্যঞ্জনাময়। পরবর্তীকালে ছবিকে আরও বেশি করে জানার জন্য এই বইটির ভূমিকা অনস্বীকার্য। তারও বেশ কিছু দিন পর, অশোক মিত্রের ‘ছবি কাকে বলে’ পড়িয়েছিল আমার এক ফটোগ্রাফার বন্ধু, তীর্থেন্দু। এক্ষেত্রে ছবি বলতে বলে রাখা ভালো, সম্পূর্ণ ভিজুয়াল আর্টের কথাই আমি বলতে চাইছি। সেটা পেন্টিং, ফটোগ্রাফ, ভাস্কর্য বা অন্য যে কোনও ভিজুয়াল মাধ্যম হতে পারে।
তখনও ছবি তোলা নিয়ে খুব সিরিয়াস হইনি, বরং ছবির বই পড়তে ও ছবি দেখতেই বেশি মনোযোগী ছিলাম। পরবর্তীকালে এই পাঠ অবশ্য নানাভাবে পরিবর্তিত ও আবর্তিত হয়েছে৷ ছবি ও জীবন কখন যে একসঙ্গে মিলে গেছে, টের পাইনি। উত্তর কলকাতা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বহু মানুষকে পাশে পেয়েছি, তারা নানা চেনা-অচেনা গলিতে নিয়ে গেছে, চিনিয়েছে শহরের রূপ-রস-গন্ধ৷ এ সিরিজটিতে মূলত সেই সব দৃশ্যের কাছে আমি বারবার ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেছি, প্রবেশ করার চেষ্টা করেছি এক দরজা দিয়ে আরেক দরজায়।
হৃদয়ের যে ছবি তার কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করেছি বরাবর, শহরের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখেছি অজস্র রকমের দৃশ্য, সেসব দৃশ্যের ভেতরে ঢুকলে যেন একটা আস্ত কবিতা বেরিয়ে আসে। দৃশ্যের বর্ণ, গন্ধ অনুভব করতে করতে উত্তর কলকাতার গলি, তস্য গলি হেঁটে চলেছি। এ হাঁটা যেন জীবনানন্দের ভাষায় হাজার বছরের … এর কোনও শেষ নেই। কাল যে দেওয়ালের রঙ জীর্ণ হয়ে গেছিল, আজ এসে কেউ যেন তার ওপর রং লাগিয়ে গেছে খানিক। দীর্ঘ এক লাল রং, এঁকে বেঁকে দেওয়াল বেয়ে হাওয়া হয়ে গেছে মাথার সিঁদুরের মত।
এই সিরিজটা করার সময় আমি মূলত দেওয়াল, দরজা, জানলা এসবকেই বেছে নিয়েছিলাম। দরজার ভেতর যে দীর্ঘ মায়া, তা ধরার চেষ্টা করেছি ছবির মধ্যে দিয়ে। মানুষের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে আমার চিরকাল দরজাকে বড় বেশি প্রাচীন মনে হয়েছে। দেওয়াল ও দরজাকে যতদূর বিশ্বাস করেছি, মানুষকে পারিনি, এ হয়ত আমারই ব্যর্থতা। দরজার ফর্ম, তার টেক্সচার ও ব্যঞ্জনার ভেতর যেন কেউ গুমড়ে পড়ে আছে বহুকাল। ওই তার অবয়ব, বর্ণনাবিহীন, অনেকক্ষণ ধরে দেখলে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বেশ কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন সময় ধরে এই ছবিগুলো তোলা, খানিকটা রেওয়াজের মতো করেই, শেখার প্রথম পাঠ বলতে পারেন। স্পর্শের, অনুভূতির প্রথম শিক্ষা, যা চারিদিক থেকে মুহুর্মুহু আসতে থাকে। যে রং খুঁজেছি যে সময়, তখনই তা পেয়েছি, দরজার কোণে, রাস্তায়, আলো-অন্ধকার কে যেন আগে থেকে ভাগ করে রেখেছিল দেখার জন্য, আমি কেবল সেসব খোঁজার চেষ্টা করেছি।
মূলত শোভাবাজার থেকে বাগবাজার আমার হাঁটার পথ, এই পথে অজস্র দরজা ভিড় করে এসেছে পথের মাঝে। আমি দরজাকে ততটা নজর করিনি যতটা দরজা আমায় বরাবর করে এসেছে। তার নানান রং, দীর্ঘ দিনের জল লেগে লেগে সে যেন পুনর্জীবন ফিরে পেয়েছে।
দেখেছি দরজা কতটা মানুষকেন্দ্রিক, প্রতিটা মুহূর্তে টের পাচ্ছে আমাদের যাতায়াত, মুখ নীচু করে ভেতরে ঢুকে পড়া। এমনকী, অনন্ত হাওয়া সামলে ভেঙে পড়ে দরজা, গলির ভেতর। মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা দরজার রূপ দেখি, খুঁজি দাগের ভেতরে লুকিয়ে থাকা আলো। স্পেস খুঁজি, দরজার ভেতরে ও বাইরে। এসব দেখতে দেখতে দরজা ও আমি দুজনেই বন্ধুত্ব করে ফেলি অনায়াসে। মধ্যবর্তী কথাবার্তা, বন্ধুত্বের ছবি ধরে রাখার চেষ্টা এই ছবিগুলোতে। চিরকালীন সম্পর্ক রাখবে এমন আশ্বাসে দরজাকে যত কাছ থেকে পেরেছি, আঁকড়ে ধরেছি। সে আমায় কখনও খালি হাতে ফেরায়নি, তার অলঙ্কার বরাবর মুগ্ধ করেছে।
দরজার গায়ে কতকালের জামা, ঝুলিয়ে রেখেছে কেউ। রংচটা হলুদ, জীবনের মত ততটা সুন্দর নয়, ছেঁড়া-ছেঁড়া। বিভিন্ন দরজায়, জানলায় শুকোতে দেওয়া হয়েছে ভেজা মাস্ক, জামা-কাপড়। গোটা লকডাউনের মধ্যে রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা ছিল, ফলে মানুষের সঙ্গে ততটা সখ্য হয়নি আমার, কিন্তু দরজার কাছে আমি তার স্পন্দন টের পাই। আর কতবছর এসব ছবি উত্তর কলকাতা জুড়ে থাকবে জানি না, কিন্তু হাঁটার পথ কোনওদিন ফুরোবে না। একটা দরজা বন্ধ হলে আরেকটি খুলে যাবে, জীবন যেরকম।
দরজার যে সত্যরূপ তার পাশাপাশি ধরার চেষ্টা করেছি কলকাতার রং ও সমকাল। ছবিতে জড় অস্তিত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করেছি, তার আকার এবং রঙের মধ্যে দিয়ে। আমার হাঁটার পথের সঙ্গী ও দরজাকে চিনতে এই ছবিগুলো আপনাদের কাছে রেখে গেলাম…
একটি অনবদ্য লেখা পড়লাম অর্ণব বসুর কলমে।
শহর কলকাতার অজস্র পুরণো বাড়ির সদর দরজা এবং জানলার ছবি নিয়ে বিচিত্র এক প্রতিবেদন যা আক্ষরিক অর্থে নতুন করে ছবি দেখার দরজা খুলে দিল। জন্ম নিল নতুন এক ভাবনার।
এই ফোটোগ্রাফগুলির সঙ্গে সখ্য আজ বেশ কিছুদিনের। লেখা সেগুলিকে একটা অনুপূরকতা দিতে পারে এমন প্রত্যাশাও জন্মেছিল। এই লেখাটি সেই প্রত্যাশা পূরণ করল। সখ্য নিবিড়তর হল বলা যায়।