শেফালি ছায়া
ছাত্রী, গবেষক, আহমেদাবাদের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট
মেয়ে হিসেবে বড় হয়ে ওঠাটা ভারতে সোজা কাজ নয়। ২০২১-এর লিঙ্গ-অসাম্যতা সূচকে ১৫৬টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১৪০। লিঙ্গগুলির মধ্যে ফারাকটা ভারতে ৬২.৫ শতাংশ বেড়েছে এই কারণে যে, শ্রমশক্তির অংশগ্রহণে, আয়ের অসমতায় এবং আরও গুরুত্বপূর্ণভাবে মেয়ে ও ছেলেদের স্বাক্ষরতার অনুপাতে মেয়েদের প্রতিনিধিত্ব একেবারেই যথেষ্ট নয়। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম যাকে ২০১৭ সালে ভারতের সেরা সামাজিক উদ্যোক্তা হিসেবে ঘোষণা করেছে, সেই ডঃ উর্বশী সাহনি বলছেন, “ভারতের মেয়েরাই পৃথিবীতে সবচেয়ে অনাকাঙ্খিত, অসুরক্ষিত এবং অধীন। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ বালিকা বধূই ভারতীয়, প্রতি বছর দশ লক্ষ মেয়েকে ভ্রূণাবস্থায় মেরে ফেলা হয় এবং ভারতের পঞ্চাশ শতাংশ বিবাহিত মহিলা পিটুনির শিকার।”
ভারতের লক্ষ লক্ষ মেয়েদের অসাম্যে ভরা জীবন যাপন করতে হয়। ভারতে নারীর ক্ষমতায়নের কোনও উপায় কি আছে? কোনওভাবে তা কি সম্ভব? আমেরিকায় অবস্থিত দ্য ব্রুকলিংস সেন্টার ফর ইউনিভার্সাল এডুকেশন-এর নন-রেসিডেন্ট ফেলো ডঃ সাহনি জানাচ্ছেন তিনি কী করেছিলেন এবং আপনি কী করতে পারেন।
নিজের জীবনের উদাহরণ দিয়ে তিনি জানাচ্ছেন, ১৭ বছর বয়সে যখন তাঁর বিয়ে দেওয়া হয়, তখন ভাইয়েরা কলেজে পড়াশুনা করছেন। তিনি বারবার জানতে চেয়েছেন, কেন এমনটি হবে? এই বিষয়ে শেষ অবধি তিনি সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এটি এমন এক কাঠামোগত সামাজিক রীতি যার থেকে মুক্তি পেতে হবে। যাতে সমান এক ব্যক্তি হিসেবে চিন্তা করার নিশ্চয়তা পাওয়া যায়। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বুঝেছেন, পড়াশুনা শিখেছেন বটে, তবে তা ঠিকভাবে হয়নি। পুথিগত সেই শিক্ষায় তিনি নিজের পরিচয় জানতে পারেননি, জানতে পারেননি বইতে লেখা কৌশলগুলিকে কীভাবে বাস্তবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
অধিকাংশ মানুষই ধরে নেন নারী এবং সংখ্যালঘুরা যে যন্ত্রণার সম্মুখীন হন, তা নিরসন করার উপায় কারও জানা নেই। ডঃ সাহনি কিন্তু নিজের দর্শন শিক্ষার প্রেক্ষিতে এমন এক পঠনক্রম বানিয়েছেন যা মূল্যবোধ, স্বাধীনতা, দুর্নীতি এবং নারীর অন্যান্য জরুরি অধিকারগুলি বিষয়ে প্রশ্ন করতে শেখায়। স্কুল প্রশাসন, পাঠক্রম সংস্কার এবং মেয়েদের প্রতি বিশেষ নজর রেখে শিক্ষক-প্রশিক্ষণে তিনি এক বিশেষজ্ঞ। নিজের ব্যস্ততাকে তিনি ভালোবেসে ফেলেন যখন উনি দেখতে পান ছাত্রছাত্রীরা তাদের নিয়মিত কাজগুলির মধ্যেই অর্থপূর্ণ অভিব্যক্তিগুলি খুঁজে পেয়ে নিজেদেরকে চিনতে পারছে।
স্টাডি হল এডুকেশন ফাউন্ডেশন (SHEF)— একটি উদ্ভাবন
স্টাডি হল এডুকেশন ফাউন্ডেশন চালু হয় ১৯৮৬ সালে। যথার্থে শিক্ষার পরিভাষা তৈরির লক্ষ্য নিয়ে একটি শিশুকে কীভাবে সামজিক ন্যায় এবং ভালোবাসার মাধ্যমে দায়িত্বসম্পন্ন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা যায়। অঙ্ক, ভাষাচর্চা এবং বিজ্ঞান বিষয়ে লিখনপঠনের পাশাপাশি সাম্য, শান্তি এবং সহমর্মিতার শিক্ষাও শিশুটিকে প্রদান করা ডঃ সাহনির জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিভিন্ন স্কুল এবং আউটরিচ প্রোগ্রামে SHEF ২৪,০০০ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয়, এবং পাঁচ লক্ষের বেশি শিশুকে এই বিষয়গুলি সম্পর্কে সচেতন করে— অধিকাংশই প্রান্তবাসী গোষ্ঠীগুলিতে বড় হয়ে ওঠা মেয়ে। SHEF সারাসরি ৪০০০ কন্যাশিশুর শিক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে। এই মেয়েরা স্কুলেতে ভারতীয় সমাজে অধিকার সংক্রান্ত বিষয়টিতে শিক্ষিত হয়েছে এবং এদের মধ্যে ৫০ শতাংশ আজ কর্মরত।
অগ্রপথিকের ভূমিকায় SHEF
ব্যক্তি হিসেবে মেয়েরা যে কারও চেয়ে কম নয়, তারাও যে অন্যের মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য এবং তাদেরও যে নিজেদের মতো জীবন বেছে নেওয়ার অধিকার আছে— এই বিষয়গুলিতে মেয়েদের শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে তিনি চালু করেছেন প্রেরণা গার্লস স্কুল। যে পাঠক্রমটি তিনি বহু দশক ধরে অধিকার-ভিত্তিক ক্ষমতায়নের দিকে মেয়েদের নিয়ে যাওয়ার জন্যে তৈরি করেছেন, তা এখানে আজ অনুসরণ করা হয়। সমালোচনামূলক নারীবাদী শিক্ষাদানে শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রীরা বৃত্তাকারে বসে নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে, অত্যাচারের ধরনগুলি নিয়ে এবং সেগুলি ঘটার কারণগুলি নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে জীবন-পরিবর্তনকারী সিদ্ধান্তে পৌঁছান। তাঁদের সাফল্যের মূল উপাদান হল ‘লিঙ্গবিষয়ক চর্চা’ যেখানে শিক্ষকদের আইনজ্ঞ হিসেবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সঙ্গে সেই সব মেয়েদের জীবন ও বক্তব্যের ভিডিও প্রদর্শন করা হয় যাঁরা আগে সাম্য এবং স্বাধীনতা বিষয়ে অন্য মেয়েদের অধিকারগুলি বুঝিয়ে তাদের নিজেদের জীবন নিজেই বেছে নেওয়ার ক্ষমতা প্রদান করেছেন। স্কুলের এমন শিক্ষাদানের ফলে মেয়েরা নিজেদের জীবন নিয়ে ভাবতে বাধ্য হয় এবং স্বতন্ত্র এক একটি ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার কৌশলগুলি আয়ত্ত করে। পরীক্ষার ফলাফলে এই শিক্ষার প্রতিফলন দেখা যায়। ৮৮ শতাংশ মেয়ে এই স্কুল থেকেই পাশ করে বেরিয়েছে, যা জাতীয় গড়ের দ্বিগুণ।
ডঃ সাহনি এখানেই থামেননি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যেহেতু পিতৃতান্ত্রিক সমাজকাঠামোর মধ্যেই সমগ্র বিষয়টি নিহিত, তাই পুরুষত্বকেই পরিমার্জন করাটা একান্ত প্রয়োজন। তাই তিনি প্রেরণা বয়েজ স্কুল চালু করবার পদক্ষেপ নেন। এই স্কুলে শুধুমাত্র নিয়মমাফিক পড়াশুনাটুকুই হয় না। এখানে ছেলেদের শেখানো হয় মেয়েদেরকে সমান নজরে দেখাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনুশীলনী হিসেবে ছেলেদের বলা হয় বাড়িতে বোন থাকলে প্রতিদিন তাদের নিরীক্ষণ করতে হবে এবং বুঝতে হবে মেয়েদের পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার প্রয়াস এবং সাম্যের ধারণা প্রচারে তাদেরও সমান দায়িত্ব বর্তায়। ডঃ সাহনি প্রথমে মেয়েদের লেখাপড়ার বিষয়টি নিয়ে এগিয়েছিলেন, কারণ তাঁর মনে হয়েছিল পিতৃতান্ত্রিকতার প্রতিষেধক হিসেবে নারীশিক্ষা জরুরি। তবে ছেলেদের জন্যেও শিক্ষাদান প্রয়োজন, তা বুঝতে পেরে তিনি তাদের উঠতি বয়সেই মানসিকতা পরিবর্তনের প্রতি নজর দেন। যাতে তাদের ভাবনাচিন্তার মধ্যে এই ধারণাটিও আনা যায় যে তারা নিজেরাও পরিবর্তন আনার কাণ্ডারী। লিঙ্গনির্বিশেষে এই পৃথিবীতে এক সমান হিসেবে বাঁচবার পরিসর তৈরি করতে তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে।
কোভিড অতিমারিতে SHEF-এ কী ঘটল?
ডিজিটাল ডিভাইড স্পষ্ট হওয়ায় SHEF-এর ছাত্রছাত্রীদের সুবিধার্থে প্রযুক্তি-চালিত শিক্ষাকে ব্যবহারযোগ্য এবং সুলভ করা হল। সৃজনশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠায় শিক্ষকদের বেশি উদ্যোগ নিয়ে প্রযুক্তিকে কেমনভাবে ব্যবহার করতে হবে, তা শেখাতে হল। গোষ্ঠীকেন্দ্রিক স্বাচ্ছন্দ্যের স্বার্থে এনজিও-র এই নতুন ক্ষেত্রটিতে ঝাঁপ দেওয়ার দিকে মূল নজর দেওয়ার জন্যে ‘জ্ঞানসেতু’ নামে প্রকল্পটি কার্যকর হয়। বিভিন্ন ধরনের জ্ঞানের মধ্যে সেতু বানিয়ে ছাত্রছাত্রীদের জন্যে শিক্ষকরা গাইডের ভূমিকা নিয়েছেন। সীমাবদ্ধতাটুকুই এখানে দূর অবধি পৌঁছে যাওয়ার গণ্ডি অনেকটা বাড়িয়ে দিল।
আমাদের সামাজিক অন্তর্ভুক্তির অভাব রয়েছে, পরিকাঠামো বানাতে এবং সবার জন্যে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে সরকারের উপর আমরা নির্ভরশীল হতে পারছি না। তাই আমাদের সৃজনশীল হয়ে, উদ্যোক্তা হয়ে বড় বড় সমস্যাগুলিকে কাটাতে হবে যা এখন এবং ভবিষ্যতে অভিঘাত সৃষ্টি করবে।
বিশপ ডেসমণ্ড টুটু-র কথা দিয়েই শেষ করা যাক, “যদি আমরা পৃথিবীর যথার্থ উন্নয়ন দেখতে চাই, তাহলে আমাদের সেরা লগ্নি হলেন নারী।”
Selectively সোসাইটির একটা অংশের ক্ষমতায়ন করার মানে অন্য অংশের discouragement. কারণ জীবন অবশ্যই একটি zero sum game.