স্বর্ণেন্দু সরকার
যীশু জন্মানোর হাজার বছর আগে ভারত এই গুপ্ত মধু-বিদ্যার কথা জানত ঠিক যেমন করে জানত ব্যাবিলন ও মিশর তারও সাড়ে চার হাজার বছর আগে। পশ্চিমের দেশগুলো জানতে পারল এক রহস্যময় পুরুষের আজব কাণ্ডকারখানা দেখে। খুব সম্ভব সে ছিল রাশিয়ান, যদিও তার নাম জানা যায় না। কোথায় থাকত সে কে জানে। যে কিনা একশো বছরের অনেক বেশি বেঁচে ছিল শুধু মাত্র মধু আর ফুলের পরাগ খেয়ে। এই ঘটনাই খুব সম্ভব দুনিয়ার বাকি দেশগুলোকে অতি উৎসাহে মধু ও মৌমাছির জগতের দিকে তাকাবার অবসর এনে দেয়। কী যে অপার বিস্ময় ঘিরে আছে এই পৃথিবীতে।
শার্লক হোমস গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে কেন যে মৌমাছির সাথে সময় কাটাতে লাগলেন কে জানে। জীবনের শেষের দিকটায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন তুখোড় মৌ পালকদের একজন। যদিও তিনি এই রহস্যের কিনারা করে যেতে পারেননি, তবুও মৌমাছির মতো পতঙ্গের সাথে, যারা কিনা মানুষের বহু আগে জানত পৃথিবী আসলে জীব ও জড় জগতের গোলাকার বস্তু। যারা জ্যামিতির জটিল ধাঁধা খুঁজে বের করে ফেলতে ওস্তাদ। যেমন, অনেকগুলো রাস্তার ভিতর সবচেয়ে ছোটটা খুঁজে বের করার। দেখা যায় কম্পিউটারের থেকেও দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারে ওরা। ফুল থেকে ফুলে ওড়ার জন্য তাদের ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক দিয়ে ঠিক সেই পথটাই খুঁজে বের করে যেটা দিয়ে গেলে সময় আর পরিশ্রম সবচেয়ে কম হবে। শার্লক মজেছিলেন ওদের সামাজিকতা দেখে, যার সাথে মানুষের অদ্ভুত সাদৃশ্য আছে। যদিও সব মৌমাছির প্রজাতি সম্পূর্ণ সামাজিক নয়, যেমন মানুষ। মৌমাছিদের সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপারগুলোর একটা হচ্ছে তাদের জীবনধারা, যা রাজকীয় ষড়যন্ত্রোপাখ্যান। একটা মৌচাকে তিন ধরনের প্রাপ্তবয়ষ্ক মৌমাছি থাকে। অনেক অনেক কর্মী (সবাই নারী), কিছু পুরুষ এবং মাত্র একজন রাণী। রাণী মৌচাকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তার কারণ এই নয় যে রাণী বলেই তিনি অন্যদের নেতৃত্ব দেন। কারণ রাণীই মৌচাকের একমাত্র মহিলা যার প্রজনন ক্ষমতা আছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে মৌচাকের প্রায় সব মৌমাছির মা একজন রাণী। রাণী যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তার একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। আমরা বলে থাকি যে একজন মানুষের মৃত্যু কখনও সমগ্রজাতির ধ্বংস ডেকে আনতে পারে না। কিন্তু মৌমাছিদের ক্ষেত্রে সেটা পারে। যদি ডিম দেওয়ার আগেই রাণীর মৃত্যু হয় অথবা কোনও কারণে সময়মতো পুরুষের সাথে যৌন মিলন ঘটাতে না পারে, তাহলে বুঝতে হবে মৌচাক নির্বংশ পরবর্তী জেনারেশনেই।
পুরুষ মৌমাছিরা একটু আলসে প্রকৃতির। বিশেষ কোনও কাজটাজ করে না। এদের আকার ছোট, হুল নেই, শুধু আছে বড় বড় চোখ। বড় বড় চোখ দিয়ে রাণীকে তারা সহজে খুঁজে বের করতে পারে। সারাজীবন পুরুষ একটাই কাজের কাজ করে আর তা হল রাণীর সাথে মিলন ঘটানো। উড়ন্ত অবস্থায় রাণীর সাথে পুরুষের যৌন মিলন ঘটে। পুরুষের মৃত্যু হলে রাণী ডিম দেওয়া শুরু করে দিনে প্রায় ২০০০টা করে। ডিম ফুটে লার্ভা বের হয়। কর্মী লার্ভা, পুরুষ লার্ভা আর কিছু হবু রাণী বা রাজকন্যা লার্ভা। রাণী লার্ভাদের কর্মীরা সাধারণ খাবার না দিয়ে রয়্যাল জেলি খাওয়ায়, যা তাদের যৌন (এটা হয়ত অতিরিক্ত) প্রজননে সক্ষম করে ভিন্ন গঠনে গড়ে তোলে। লার্ভা থেকে পিউপা আর তা থেকে একটা রাণী মৌমাছি বের হয়েই দেয় রণহুংকার। এই রণহুংকারে মৌচাকের বাকি বাসিন্দারা বুঝতে পারে যুদ্ধের জন্য সে প্রস্তুত, কে কার থেকে বেশি শক্তিশালী আর কার পক্ষ নিতে হবে। শুরু হয় সব নতুন রাণীর যুদ্ধ! একজন আরেকজনকে খুন করে ফেলে, শেষপর্যন্ত টিঁকে থাকে একজন। যদি মৌমাছিদের মৌচাক ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রয়োজন হয়, তখন অবশ্য কর্মীরা রাণীদের যুদ্ধ নিজেরাই থামিয়ে দেয়। দল বেঁধে সবাই বাড়ি পরিবর্তন করে। তারপর রাণীরা একজন আরেকজনকে খুন কর ফেলে। ডিম দেওয়ার পর আমাদের পুরাতন রাণীসাহেবার কোনও বিশেষ কাজ থাকে না, বরঞ্চ তিনি বিপদে পড়ে যান। যতদিন রাণী কুমারী থাকেন ততদিন রাণীশূন্য অপর কোনও মৌচাকে তাদের স্বাগত জানানো হয়। কিন্তু পুরনো রাণী, যারা ইতিমধ্যেই যৌনমিলন ঘটিয়েছে, তাদের দেখলেই মৌচাকের বাসিন্দারা তেড়ে আসে। নিজের ঘরেও শান্তি নেই। নতুন রাণী নির্বাচনের সাথে কর্মীরা জোট বেঁধে পুরনো/আগের রাণীকে জাপটে ধরে। এতে রাণীর চারপাশে প্রচণ্ড উত্তাপ সৃষ্টি হয় আর সবাই মিলে পুরাতন রাণীকে এ পদ্ধতিতে মার্ডার করে ফেলে! মৌচাকের কর্মী বা শ্রমিকেরা যে মোটেও সাদাসিধে নয় বোঝাই যাচ্ছে। সংখ্যায় ওরাই বেশি এবং মৌচাকের যাবতীয় কাজকর্ম তারাই করে। বাসা বানানো থেকে শুরু করে মধু সংগ্রহ পর্যন্ত। তরুণরা থাকে মৌচাকের ভেতর আর অভিজ্ঞরা বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায়। কর্মীদের সবারই আলাদা পদ থাকে (এমনকি মৃত মৌমাছি সরানোর পর্যন্ত)। মৌমাছিদের জীবনধারা আজব সন্দেহ নেই, কিন্তু তার থেকে অবিশ্বাস্য কাজ করতে পারে এই ক্ষুদে পতঙ্গগুলো। যেমন ওরা ছবিতে মানুষের মুখ আলাদা করতে পারে। আর মৌমাছি যে ভাল মানের গণিতজ্ঞ তা আগেই বলা হয়েছে। আরও ভাল করে বোঝা যায় ওদের মৌচাক দেখলে। মৌচাক অনেকগুলো ছোট ছোট ষড়ভুজাকার খোপ নিয়ে তৈরি। প্রশ্ন হল, ষড়ভুজ কেন? কেন বৃত্ত নয়, কেন চারকোণা বা তিনকোণা নয়! উত্তরটা সহজ। মৌচাক বানানোর জন্য গাণিতিকভাবে ষড়ভুজের থেকে ভাল আকৃতি আর হতে পারে না। কোনও ফাঁকা জায়গা না রেখেই একটা ষড়ভুজের সাথে আরও ছয়টা বাহু যু্ক্ত হতে পারে, এবং যথেষ্ট মজবুতও হয়। মৌমাছির ফ্লাইং প্যাটার্ন হচ্ছে আরেকটা অবাক করার বিষয়। মৌমাছিরা যখন মধুর জন্য ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ায়, মৌচাক থেকে দূরে সরে যায়, তখন অন্যদের সাথে কেমন করে যোগাযোগ করে? কেমন করে তারা মৌচাকের দূরত্ব আর দিকের হিসেব রাখে আর একে অপরকে খবর পাঠায়? মৌমাছিরা যে প্যাটার্নে উড়ে বেড়ায়, সেটা মোটেও কোনও সাধারণ প্যাটার্ন নয়। একে বলা হয় Bee Dance/waggle dance। একটা মৌমাছির জটিল ফ্লাইং প্যাটার্ন দেখে অন্যরা বুঝতে পারে খাবার কোথায় আছে, মৌচাক কোনদিকে আছে, পথের দূরত্বই বা কত। এই নাচের প্রক্রিয়া অনেকটাই বেশ জটিল।
মৌমাছি যে খুব সুন্দর তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু তবু্ও আমরা মৌমাছি ভয় পাই। কারণ আর কিছু নয়, এর হুল। যদিও মৌমাছি কারণ ছাড়া কারও গায়ে হুল ফোটায় না, যদি না কেউ মৌমাছিকে চাপা দিতে চায় নয়তো মৌচাক ধ্বংস করতে যায়। কর্মী মৌমাছিরা আসলে জীবনে মাত্র একবার হুল ফোটাতে পারে। আর যার গায়ে হুল ফোটায় সে যদি মোটা চামড়ার কোনও প্রাণী হয় তাহলে মৌমাছি নিজেই মরে যায়। হুল ফোটালে প্রচণ্ড ব্যথা হয় ঠিক কিন্তু মৌমাছির বিষ এতটা শক্তিশালী নয় যে আমরা মারা যাব। ব্যতিক্রম হল আফ্রিকান খুনে মৌমাছি! সাধারণ মৌমাছিকে একদল মানুষ আফ্রিকা থেকে ট্রপিক্যাল অঞ্চলে (দক্ষিণ আমেরিকা) নিয়ে গিয়েছিল মধু উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য। সেই মৌমাছির একটা দল দুর্ঘটনার কারণে মুক্ত হয়ে যায় আর বনেই আবাস শুরু করে। যাই হোক, তাদের ধারণা ভুল ছিল না। ট্রপিক্যাল অঞ্চলে এসে তাদের মধু উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে যায়। কিন্তু সমস্যা হল, তার সাথে আরও অনেক কিছুই বেড়ে যায়। দলছুট মৌমাছিগুলো দেখা গেল জঙ্গলে বাস করতে করতে এমনভাবে অভিযোজিত হয়ে গেল, যা তাদের অনেকগুণ বেশি বিপজ্জনক আর মারমুখো করে তুলল। আস্তে আস্তে সামান্য একটা দল প্রায় সমগ্র অঞ্চলে ছড়িয়ে গিয়েছে। এদের হুলে মানুষের মৃত্যুর অনেক রেকর্ড আছে। ধারণা করা হয় মৌমাছির বিবর্তন হয়েছে শিকারী বোলতা থেকে। কিন্তু তাদের সামাজিকতার বিবর্তনের ক্ষেত্রে একটা সামান্য ফাঁকিও থেকে গেছে।
কিছু কিছু মৌমাছি সন্ন্যাসীদের মতো মৌচাক ছেড়ে একা একা অজানার উদ্দেশ্যে বের হয়ে যায়। কোনও দিন তারা ফিরে আসে না। মৌমাছিদের এই সমস্ত আচরণে শার্লক অভিভূত হয়ে উঠত। হয়তো গোয়েন্দারা অন্য গুপ্তচরের দিকে চিরকাল এভাবেই তাকিয়ে থেকেছে। কেননা মৌমাছিদের ভেতরেও আছে গুপ্তচরদের শিবির। যাদের কাজ মূলত সংবাদ যোগাড় করা, খাবার ও পর্যাপ্ত রসদের সন্ধান, জলের জায়গা খুঁজে বের করা, শত্রু শিবিরের গতিবিধি লক্ষ করা, বিপদের আগাম সংকেত জানানো। জীবনের ৪৯টা বছর কাটিয়ে জটিল মানুষের বিষয়ে সত্য সন্ধান ছেড়ে শার্লক হোমস এই অতি তুচ্ছ প্রাণের জীবন গল্পে নিজের মস্তিষ্কের খোরাক খুঁজে নিচ্ছিল হয়তো, কে জানে। লোভ প্রবঞ্চনা তঞ্চকতা ষড়যন্ত্র হত্যা নিখুঁত বুদ্ধি ও শ্রম করার প্রবল শক্তি আর অজানা নানা রহস্য কিংবা সত্যানুসন্ধানে মস্তিষ্কের যে ক্ষতি হয়েছিল হয়তো মেরামত করা হল কিছুটা এভাবেই।
আপাতভাবে মনে হতে পারে এত সব কিছু নিখুঁত পরিচালনা করছে কে, রাণী এখানে শুধুই পলিটিক্সের জগন্নাথ। কার নির্দেশে কারা কখন এই কাজ সেরে ফেলতে চাইছে। গুম খুনের পরে লাশ ফেলে আসছে নির্জনে বা দ্বাররক্ষীকে কে উপঢৌকন দিয়ে অন্দরের সব কথা জেনে নিচ্ছে চুপিচুপি। কর্মীদের নিপুণ কারসাজির কারবারি করে তোলার অলক্ষ্যে কে লুকিয়ে আছে শার্লক? আমার মন যেন কর্মীদের দিকে ছুটে যেতে চাইছে। শার্লক তখন পাইপ ঠোঁটের ফাঁকে রেখে আগুন ধরানোর সময় নজর করল, দূরে একা দাঁড়িয়ে আছে রাণী। শার্লককে দেখামাত্রই যে বলে উঠল; গুড মর্নিং মিঃ হোমস।
খুব আনন্দ পেয়েছি লেখাটা পড়ে।মৌচাকের ভেতর স্বয়ং শার্লক হোমস্ ঢুকে পড়েছেন!জমে গেছেটলটলে মধু!!
Informative though free flowing article! Want to know more!