শ্রীজাতা গুপ্ত
গবেষক, লেখক
দক্ষিণ কাশ্মিরের গুজ্জর পরিবারের মেয়ে পাকিজা। সেনাবাহিনি হঠাৎ একদিন তার বাড়িতে ঢুকে পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে পাশের ঘরে টেনে নিয়ে যায় পাকিজাকে। ও তখন অতিথিদের জন্য চা বানাচ্ছিল, যাদের মধ্যে কয়েকজন সম্ভাব্য জঙ্গি, এইটুকুই পাকিজার দোষ। পাশের ঘরে এরপর ওর সঙ্গে ঠিক কী ঘটেছিল, সে আর মনে করতে পারে না। তবে, জরিমানার লোভে গরিব পরিবার পাকিজাকে থানায় যেতে দেয় না, পাকিজার স্বামী একটি চাকরি পায়, এবং পাকিজাকে পরিত্যাগ করে পরিবারের সম্মানরক্ষার্থে।
প্রতিরাতে ঘুমের ঘোরে আনিসা ছটফট করে ওঠে, দু হাত বাড়িয়ে ঠেকিয়ে রাখতে চায় অদৃশ্য আততায়ীকে। আনিসার শ্বশুরবাড়ির লোকজন ভাবে, তার উপর জ্বিনের কুপ্রভাব। কেবল আনিসার দিদি আমিরা জানে, বহু বছর আগের এক সন্ধ্যার স্মৃতি রোজ ফিরে আসে আনিসার ঘুমে। চোদ্দ বছর বয়সে জওয়ানদের হাতে নিজেরই বাড়িতে ধর্ষিত হয়েছিল আনিসা। গোপনসূত্রে খবর ছিল, আমিরার প্রাক্তন স্বামী হিজবুল মুজাহিদ্দিন জঙ্গি। পাকিজার মতই, অন্যের দোষের ক্ষতিপূরণ ভরতে হয়েছে আনিসাকেও।
১৫ বছর বয়সী শিরিন, পঞ্চাশোর্ধ গ্রামপ্রধানের স্ত্রী, ষোড়শী হামিদা— কাশ্মিরের ঘরে ঘরে পরিবার পরিজনের প্রতিফলিত ‘অপরাধের’ শাস্তি বাবদ এমন জীবন্ত সব ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে মেয়েরা। ব্যক্তিগতভাবে তীব্র যন্ত্রণাদায়ক এই অভিজ্ঞতাগুলি সার্বিক বিচারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের নির্মম বহিপ্রকাশ। মেদসাঁ সঁ ফ্রন্তিয়ে-র রিপোর্ট বলছে, কনফ্লিক্ট জোন-গুলির মধ্যে কাশ্মিরের মেয়েদের বয়ানে যৌননির্যাতনের ঘটনা অন্যান্য জায়গার থেকে উদ্বেগজনকভাবে বেশি।
দুই ভাইয়ের মধ্যে কাজিয়া বাধলে দাদার প্রিয় ফুলগাছটি ছিঁড়েখুঁড়ে নষ্ট করে বাঁকা পথে সতর্কবার্তা পাঠায় ভাই। ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের মধ্যে মতান্তরের ফলে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় দুই দলের চিহ্নধারী ইমারত। সম্মুখসমরে নামার আগে শিং বাগিয়ে, খুরের ঘায়ে ধুলো উড়িয়ে তেড়েফুঁড়ে ভয় দেখানো যেমন পাশবিক প্রবৃত্তি, বিরোধীপক্ষকে পরোক্ষে শাসিয়ে রাখা তেমনই ফাঁকা হুমকি। রাজায় রাজায় যুদ্ধে ক্ষতি কেবল রাজার সম্পত্তির। প্রাণ যায় উলুখাগড়ার তবে প্রাণহানির মধ্যে রয়েছে শ্রেণিবিভাজন। এক শোষিত দুর্বলতর অপর শোষিতকে প্রতিআক্রমণ করে। দাদার হাতে দু-ঘা খেয়ে অপমানের চোটে ভাই নিজের পোষা মাছের চোখ খুবলে নেয়। এই পালটা আঘাত শাসকের উদ্দেশ্যে উঠলে সমাজে হয়ত একদিন শাসকশ্রেণি বিলুপ্তির আশা থাকত। কিন্তু, আগ্রাসন সর্বদা নিম্নগামী। দুর্বলের গায়ে হাত তোলা অনেক সহজ কাজ, ঝঞ্ঝাটবিহীন। নির্দিষ্ট কোনও শ্রেণির মানুষকে দুর্বলতম বলে চিহ্নিত করে রাখলে দু পক্ষেরই লাভ। যে বলবান সে এই চিহ্নিত শ্রেণিকে শোষণ করে বিরোধীপক্ষকে উচিৎ শিক্ষা দেবে; দুর্বল বিরোধীপক্ষ তার পরাজয়ের গ্লানি মোছার জন্য অত্যাচার চালাবে এই নির্দিষ্ট শোষিতশ্রেণির ওপরেই। মাটির স্তর-প্রস্তর গড়িয়ে নানা দিক থেকে অন্যায়ের ক্ষীণ জলধারা নিম্নতম অঞ্চলে গড়ে তুলবে হিংসার নিস্তব্ধ হ্রদ। সমাজে সেই হ্রদের দায়ভার বহন করছে মেয়েরা। হায়ারার্কির সর্বনিম্ন ধাপ চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে ওদের জন্য। মেয়েদের গায়ে হামেশাই তাই আছড়ে পড়ে পুঞ্জিভূত আক্রোশ।
আমার জীবন থেকে কান্নারা হারিয়ে গেছে
দুঃখকে জাহান্নামে পাঠিয়ে
আমি তোমার কাছে এসেছি নসিব—এই নাও আমার জন্মতারিখ,
বলো: আমার বয়স কত?
হয়ত এখনও আমার বউপুতুল খেলার বয়স
প্যালেস্তাইনের ধ্বংস হয়ে যাওয়া শহর গ্রামের উদ্বাস্তুদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চালান দারিন তাতুর— পেশায় কবি, সন্ত্রাসবাদ অপবাদে যাঁকে জেলবন্দি করেছিল ইজরায়েল রাষ্ট্র। দারিন ওঁর কবিতার মধ্যে জ্বালিয়ে রাখেন ইঙ্গিতপূর্ণ মশাল, প্রতিবাদের রাস্তার শলাপরামর্শ। এই তাঁর অপরাধ। শিশুকাল থেকে দারিন জারি রেখেছে সময়ের হিসেব,
Dareen as a child—
Lights her candles
Counts up the years contained in her.
জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর হারিয়ে যাওয়া মূল্যবান সময়ের হিসেব চাইছেন দারিন। অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাকি। অসঙ্গত ঠেকলেও, জেলখানায় কাটানো সময় দারিন তাতুর-এর কাছে খোলা আকাশের নীচে বুকভরা নিঃশ্বাস নেওয়ার মত, কারণ বন্দিদশা তাঁকে চোখে আঙুল দিয়ে শিখিয়েছে যুদ্ধাঞ্চলে নিপীড়িত নারীদের জীবনের কথা আলোয় নিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তা। সমাজ-চিহ্নিত অধস্তন অবস্থান সংঘাত অঞ্চলের মেয়েদের ওপর নির্বিকার হিংসা ও ধর্ষণের মূল কার্যকারণ। এই নির্দিষ্ট শ্রেণির প্রতি অত্যাচার দ্বন্দ্বের পরোক্ষ ফলাফল বা পরিণাম নয়। সুপরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত অস্ত্র। সরাসরিভাবে না হলেও, ধর্ষণের মত চূড়ান্ত অপরাধ করেও আইনগত সুরক্ষার নানা পথ খোলা থাকে সেনাবাহিনি ও নিরাপত্তা বাহিনির প্রতিনিধিদের জন্য। অপরাধীর বিরুদ্ধে এফআইআর করা হলে, সে মামলা কোনওদিন এগোয় না, অভিযুক্তের শাস্তি হয় না। ধর্ষণের ক্ষতিপূরণ বাবদ বড় অঙ্কের টাকা বা পরিবারের সদস্যদের জন্য চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে থানায় রিপোর্ট করাও আটকে দেওয়া যায় সহজেই। তাই, ষোলো বছরের হামিদাকে ধর্ষণের অভিযোগ যে সেনাকর্মীর বিরুদ্ধে, তার বীরসত্তাকে রাজ্যসরকার সম্বর্ধিত করে। দশকের পর দশক অভিযোগ জমা পড়ে, সেনানীদের শাস্তি হয় না। রাষ্ট্রমদতপুষ্ট যৌননিগ্রহ মান্যতা পায়। কাশ্মিরি কবি উজমা ফলক লিখে রাখছেন ইন্ধনপ্রাপ্ত এই হাতিয়ারের রোজনামচা—
অপারেশন শুট টু কিল জিন্দাবাদ
অপারেশন কাম ডাউন জিন্দাবাদ
অপারেশন সঙ্গম জিন্দাবাদ
অপারেশন অল আউট জিন্দাবাদ
দারিন বুঝেছেন, কেবল নিজের দেশের মেয়েদের কথা নয়, বলতে হবে সীমান্তের ওপারে শত্রুপক্ষের মেয়েদের গল্পগুলি। না হলে বলা হবে অর্ধসত্য, যার জোরে কোনও বিপ্লব সম্ভব নয়, বদল হবে না সমাজপরিস্থিতির। দারিনের এই বৃহত্তর উপলব্ধি অমোঘ বাস্তবের সামনে আয়না ধরে— যুযধান পক্ষের পরিচয় বদল হয়, লড়াইয়ের বাজি পালটায়, যুদ্ধের রীতিনীতি ক্রমে উন্নততর হয়— এইসব হিসেবের আড়ালে মেয়েদের উপর অন্যায়ের গল্প এক জগদ্দল ধ্রুবক। বৃহত্তর সংঘাতের অসম কুপ্রভাব থেকে সার্বিকভাবে মেয়েদের রক্ষা করার একমাত্র পথ তাদের স্বতন্ত্র সামাজিক অবস্থান পুনরুদ্ধারের করা, যা হয়ে উঠেছে দারিন-এর মত আরও অনেক যুদ্ধবিধ্বস্ত মেয়েদের একমাত্র লড়াই।
যৌনহিংসা শত্রুপক্ষের উদ্দেশ্যে খতরনাক এক হুমকি, যা ব্যক্তিগত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঊর্ধ্বে। এই ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্য ক্ষমতার নির্লজ্জ প্রদর্শনী ছাড়া আর কিছুই নয়। দুর্বলপক্ষকে অপমান করা, তাদের দলের সদস্যদের ঘুঁটি বানিয়ে এক চালে বাজিমাতের নিনাদ। মহিলাদের ইজ্জত তার জাতির পৌরুষের প্রতীক ভাবা হয়। এই ইজ্জত পুরোপুরি নারীশরীরকেন্দ্রিক। এই চিহ্নিতকরণ সম্পূর্ণরূপে আরোপিত। যুদ্ধ তর্কাতীতভাবে পৌরুষের লড়াই, আর পৌরুষের দায়ভার যদি শক্তিতে ধারণ না করে মেয়েদের শরীরে গচ্ছিত থাকে, তাহলে আক্রান্ত জাতির জমিসম্পদধনদৌলত লুঠতরাজের মত মেয়েদের ইজ্জতহানি স্বাভাবিকভাবেই হয়ে উঠছে দুর্বলকে ভয় দেখানোর বিশেষ উপায়। ইগো আঘাত করার সফলতম অস্ত্র, আত্মবিশ্বাস ভেঙে দেওয়ার নীতি। ধর্ষণ এক্ষেত্রে অবদমিত যৌনবাসনার বিকৃত বহিঃপ্রকাশ নয়। অপরপক্ষের প্রতি ঘৃণা, নিজের পরাজয়ের সম্ভাবনার ক্ষতিপূরক, খুনি হিংসাবৃত্তির অপর নাম এবং শত্রুকে পরোক্ষে আক্রমণ। জারমেইন গ্রিয়র লিখছেন, যে সমাজ শুরু থেকেই মেয়েদের শরীরকে ব্যক্তিগত, জাতিগত সম্পত্তি ভাবতে শেখায়, সে সমাজে পুরুষেরা সঙ্গমকে অশ্রদ্ধা ও ঘৃণা করতে বাধ্য। প্রিয়তমার শরীর ভোগ করার পরেও তাদের মনে ততখানি বিতৃষ্ণা দেখা দেয়, যতখানি ক্রোধ বেরিয়ে আসে জিঘাংসা পরিপূরক ধর্ষণের পর। এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে যৌনসঙ্গী বিষয়ে আলোচনায় পুরুষদের নিজস্ব বয়ানে।
রাষ্ট্র যে অন্যায় করে চলেছে মেয়েদের প্রতি, তার সমান দোসর সমাজব্যবস্থা।
এক পুরুষের আলিঙ্গনে
একটি মেয়ে এমন চেঁচিয়ে উঠল
যেন শরীর থেকে কিছু খসে পড়েছেথানা কেঁপে উঠল অট্টহাসিতে
কফিশপেও কিছু হাসাহাসি
রাস্তায় জনাকয়েক হকার
বেচছে এক পয়সার খবর
খুবলে নিচ্ছে বাকি শরীরটুকু
অমৃতা প্রীতমের এই কবিতার প্রতিধ্বনি পাই ‘আদালত ও একটি মেয়ে’ ছবিতেও। একবার ধর্ষিত হয়ে অন্যায়ের বিচার চেয়ে মেয়েরা লাগাতার ধর্ষিত হয় পরিবার ও সমাজের প্রশ্নবাণে। নির্যাতনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দাবী করে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় যন্ত্রণাদায়ক ঘটনার পুনঃপ্রচার, যার তলায় চাপা পড়ে থাকে মেয়েটির ক্ষতবিক্ষত মন। মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি মেনে আঘাতপূর্বক স্মৃতির দরজাগুলি বন্ধ করে রাখতে চায় মন। ফলত, ধর্ষণ-পরবর্তী বয়ানে মেয়েরা বলে থাকে, ‘এরপর আমার আর কিছু মনে নেই!’ থাকার কথাও নয়, এই সামান্য সংবেদনশীলতা দেখাতে পারে না সমাজ। বিপর্যস্ত মন দুর্ঘটনার তর্জমা মৌখিক ভাষায় করতে পারছে না, এই অক্ষমতা বরাবর সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাব মর্মে মেয়েদের বিপক্ষে কাজ করেছে। অথচ, ফ্রেনি মানেকশা কর্মসূত্রে দেখেছেন, ধর্ষণের বর্ণনা প্রকট হয়ে ওঠে মেয়েদের নীরবতায়, কখনও, সকলের চোখ এড়িয়ে, ফিরহানের আবরণ সরিয়ে কাঁধ উন্মুক্ত করে নির্বাক ইঙ্গিতে গ্রামপ্রধানের স্ত্রী বলতে চাইবেন, কী ঘটেছিল তার সঙ্গে।
যৌননিগ্রহের অভিজ্ঞতার কথা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলতে না পারার জন্য অনেকাংশে দায়ী একপ্রকার হীনম্মন্যতা ও অপরাধবোধ। নারীশরীরের ওপর যে নারী বাদে আর সকলের সমানাধিকার, এই বিশ্বাস নিয়েই বড় হয় মেয়েরা। তার পরিবার এবং বৃহত্তর সমাজের সম্মান সে গায়ে মেখে ঘুরছে, সেই সম্মান বাঁচিয়ে রাখার দায় তার একার, বিফল হলেই সে অপরাধী, বলপূর্বক তার শরীরে লুঠতরাজ চললে সমাজে হায় হায় ধ্বনি ওঠে কারণ এর ফলে সমগ্র জাতিগোষ্ঠীর মান ধূলিলুণ্ঠিত হয়— এই ধারণাগুলি দিয়ে মেয়েদের মগজধোলাই করা হয় জন্মের পর থেকেই। অতএব, ধর্ষকের অপরাধ সে হাসিমুখে নিজের বলে মানতে শেখে, পরিবার বা জাতির মুখরক্ষা করতে পারল না, সেই লজ্জায় তার মাথা নত হয়, প্রিয়জনেরা তাকে পরিত্যাগ করে অস্তিত্ব অস্বীকার করলে, সেই অনাচার ভবিতব্য মনে হয়। ধর্ষণ মেয়েদের মৌলিক অধিকারের বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া এক ঘৃণ্য অপরাধ যার কোনও দায় মেয়েদের নয়— এই আপ্তবাক্যটি প্রতিষ্ঠিত করার সাহস বা নিরাপদ জমি আজ অবধি কোনও সমাজ তৈরি করতে পারেনি। ধর্ষণের অভিঘাতে ক্ষতবিক্ষত শরীর মন সারিয়ে তোলার শুশ্রূষা জোগাতে ব্যর্থ হয়েছে দেশ, রাষ্ট্র, আত্মীয়পরিজন।
মেয়েদের শরীর দখল করে বিরোধীপক্ষের সম্পত্তিহানি করার উল্লাসেই এই গল্প শেষ হয় না। পরাধীন জাতির মেয়েদের শরীর নিজের সম্পত্তি করে গিনিপিগ বানিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চালাতে দ্বিধা করেনি শাসকদল। ইতিহাস সাক্ষী, এর ফলে চিকিৎসাশাস্ত্রে উন্নতি ঘটেছে, বিজ্ঞানের অগ্রগতির খাতে নাম কিনেছে শাসক দেশ। উত্তর আমেরিকায় দাসপ্রথা চলাকালীন ক্রীতদাসী মেয়েদের যৌনাঙ্গে অস্ত্রপচার করা হত অ্যানেস্থেসিয়া ছাড়া। আধুনিক স্ত্রীরোগবিদ্যার জনক জেমস ম্যারিওন স্মিথ এই ধরনের অস্ত্রোপচার হামেশাই করতেন আফ্রিকান-আমেরিকান দাসীদের উপর, বলাই বাহুল্য তাদের অনুমতি ছাড়া। আইনত দাসদাসীরা তখন সাদা মানুষদের সম্পত্তি, বাড়ির আসবাবপত্রের সামিল। আরামকেদারায় লাল রং হবে, না তার এক পায়া কাটা যাবে— সে কথা কেউ কেদারাকে কবে জিজ্ঞেস করল? কালো মেয়েদের শরীর ছিল যত্নে বাঁচিয়ে রাখা এক বোতল বার্বন হুইস্কিতুল্য। বন্ধুবান্ধবের আড্ডায় ভাগ করে ভোগ করার বস্তু। এইসব মেয়েদের সঙ্গী নির্বাচনের স্বাধীনতা ছিল না, তাদের সন্তানধারণের সিদ্ধান্ত নিত সাদা চামড়ার শাসকগোষ্ঠী। যে মেয়ে স্বাস্থ্যবতী, তাকে জোর করে বারংবার গর্ভবতী করা হত, আরও বেশি সংখ্যায় শক্তপোক্ত দাসদাসী ‘উৎপাদন’ করতে। যে মেয়েকে দেখে দুর্বল মনে হত, তাকে বলপূর্বক বাধ্য করা হত গর্ভপাতে। আশ্চর্যজনকভাবে, জিম ক্রো ইরা-তে যখন দাসপ্রথা আইনত নিষিদ্ধ হল, কালো মেয়েদের শরীরের উপর সম্মতিবিহীন অস্ত্রোপচারের আইনটির বদল হল না। গবেষণার অগ্রগতির নামে চলল শারীরিক নির্যাতন। বাধ্যতামূলক বন্ধ্যাত্বকরণ নীতি জারি রাখা হল। নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মেয়েদের উপর এইরূপ নির্যাতন বহাল থাকার প্রভাব পড়ল আফ্রিকান-আমেরিকান নারীস্বাস্থ্যে, যার রেশ বর্তমানেও সুস্পষ্ট। দু বছর আগে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট জানাচ্ছে, মার্কিন চিকিৎসাব্যবস্থায় কালো মেয়েদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ, অকারণ গর্ভপাতের পরামর্শ দেওয়ার ঐতিহাসিক জাড্য আজও চলছে।
রাষ্ট্র পরিচালিত একইরকম সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস দেখা যায় বার্মা-র রোহিঙ্গা মুসলিম মেয়েদের ওপর যৌনহেনস্থা ও শারীরিক মালিকানা বিস্তারের প্রচেষ্টার মধ্যেও। গ্রামের পর গ্রাম ধরে মহিলাদের ধর্ষণ করছে নিরপত্তারক্ষী, সামরিকবাহিনী, বৌদ্ধ মৌলবাদীর দল। পাছে মুসলিম জনসংখ্যা ছাপিয়ে যায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে, এই অমূলক ভয়ের ভিত্তিতে রাষ্ট্র আইন করেছে, দুটির বেশি সন্তানধারণ রোহিঙ্গা মুসলিম মেয়েদের জন্য নিষিদ্ধ। তৃতীয়বার সন্তানসম্ভবা বহু রোহিঙ্গা মেয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গর্ভপাত করাতে গিয়ে প্রাণ হারায়, কারণ বার্মার আইনে স্বেচ্ছায় গর্ভপাত করানোও নিষিদ্ধ। উপরন্তু, অনেকেই বেআইনি পথে লুকিয়ে সন্তান প্রসব করেন, যে শিশুদের জন্ম নথিভুক্ত হয় না। অনেক মায়েরা গুপ্তপথে অন্যদেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করে থাকেন, যার ফলে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে নারী ও শিশু পাচারকারী চক্র। গোষ্ঠীগত প্রজনন নিষেধাজ্ঞা চালু হয়েছিল বার্মায় সামরিক শাসনামলে, গণতন্ত্রের দিকে দ্রুত এগিয়ে চলা বর্তমান মায়ানমারে যার কোনও পরিবর্তন হয়নি। শাসক আসে, শাসক বদলায়, শাসনভুক্ত অন্যায় অস্ত্রগুলির বদল ঘটে না।
যুদ্ধাবস্থা হোক বা যুদ্ধপরবর্তী পরিস্থিতি, দেখা যাচ্ছে হিংসার প্রকোপ মেয়েদের উপর সবসময়েই বেশি পড়ছে, কারণ সেই হিংসার উৎস আপনজন ও অপরজন উভয়পক্ষই। প্রাণীজগতে এমন হামেশাই দেখা যায়, বিহেভিয়ারাল ইকোলজির পরিভাষায় একে বলা হয় রিডাইরেক্টেড অ্যাগ্রেশন। সমাজে সর্বনিম্ন অবস্থানকারীর প্রতি আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ করে দলের সদস্যরা অথবা বাইরের দল। বিবর্তনের ইতিহাসে খুবই কার্যকর স্ট্র্যাটেজি, স্ট্রেস কমাতে অন্যের উপর অত্যাচার করা। সংঘাতবিধ্বস্ত এলাকায় মেয়েদের উপর পুঞ্জিভূত আক্রোশকেও এই নিয়মের আওতায় ফেলাই যায়। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন জাগে দুটি— মেয়েরা সার্বিকভাবে সমাজের নিম্নতম স্তরে অবস্থান করছে কেন? জৈবিক নিয়মের আওতাভুক্ত করে এই সামাজিক অন্যায় মনুষ্যসমাজে মেনে নেওয়া কতখানি যুক্তিযুক্ত?
গুহাবাসী মানুষকে যখন পেশির তাকতে বন্যজন্তু মেরে খাদ্যসংগ্রহ করতে হত বা সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হত, শারীরিক গঠনগত কারণে পুরুষের থেকে মেয়েরা সেই কাজে কম উপযুক্ত ছিল। তাই, শিকার করবে পুরুষেরা, শিকার করা জন্তু বাসায় আনার পর তার প্রস্তুতির ভার মেয়েদের। ঘুরে ঘুরে খাবার খুঁজে আনবে পুরুষেরা, এক জায়গায় থেকে সন্তান দেখভালের দায়িত্ব নিল মেয়েরা। এই দু ধরনের কাজের মধ্যে কোনও তুল্যমূল্য বিচার তখনও আসেনি। জাতিকে সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে কাজগুলি যুক্তি দিয়ে লিঙ্গভিত্তিক ভাগ হয়েছিল। এরপর বুদ্ধি খাটিয়ে মানুষ অস্ত্র বানাল, কৃষিকাজ শিখল। খালি হাতে শিকার করার দিন শেষ। বর্শা ছুড়ে হরিণ শিকার বা কোদাল চালিয়ে ফসল ফলানোর শক্তি মেয়ে-পুরুষ দুই বাহুতেই সমান। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে লিঙ্গভিত্তিক শারীরিক শক্তির ব্যবধান যে ঘুচে গেল, সেই হিসেবটা পরিবর্তিত ব্যবস্থায় কেউ জোর গলায় ঘোষণা করল না। শিকারিরা চাইল প্রতিযোগীর সংখ্যা কম থাকাই ভালো। আর, ততদিনে পুরুষেরা বুঝে গেছে দলে মূল প্রদানকারীর ভূমিকা-ই ক্ষমতার উৎস। একসঙ্গে অনেক নারীকে নিজের অধীনে রাখতে পারলে পুরুষের প্রজননক্ষমতা বহুগুণ বাড়বে, প্রতিপত্তি বিস্তার হবে। নিজের জেনেটিক জ্ঞাতিগুষ্টি যত বিস্তৃত হবে, লোকবল বাড়বে, অন্য পুরুষদের হারিয়ে ছিনিয়ে নেওয়া যাবে আরও খাবার, আরও জমি। মেয়েরা শিকার করতে নামলে সন্তান প্রতিপালনে সময় কমে যাবে। অতএব, তারা ঘরেই থাক। এক কালে যে গৃহকেন্দ্রিক কাজ ও সন্তানপালনের দায়িত্ব নারীর সামাজিক অপরিহার্যতার নির্ণায়ক ছিল, সেই কাজগুলিকেই ক্রমে ব্যবহার করা হল তাদের জীবন সীমাবদ্ধ করতে; পুরুষের ক্ষমতাপ্রসারের বাসনায়। এইখানেই ব্যক্তিগত সম্পত্তির উৎস, এইখানেই নারীর পুরুষের সম্পত্তি হয়ে ওঠার আদি। পরিবারকে গৌরবান্বিত করে নারীর ওপর সেই গৌরবের দায়িত্ব আরোপ করে ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’ বেড়ি বাঁধার বীজ বোনা থাকল ইতিহাসে। কখনওই বলা হল না, লাঙল চালিয়ে খাদ্য উৎপাদন ক্ষমতা তোমার আমার এক, অতএব ‘আমি প্রদানকারী— তুমি উপভোগী’, এই বাইনারিতে ইতি টানা উচিত। কম্পিউটারে চারটে বোতাম টিপতে বা বন্দুকের ট্রিগার টানতে প্রয়োজনীয় পেশিশক্তি নারী-পুরুষের সমান; গ্যাসের নব ঘুরিয়ে বা মাইক্রোওয়েভ আভেনে রান্না সেরে নেওয়ার ক্ষমতার মধ্যেও কোনও বিভেদ নেই। কেউ বলল না, ‘নারী পুরুষের চেয়ে দুর্বল’, এই উপসংহারের আদিম কার্যকারণ বিলুপ্ত হয়েছে লক্ষাধিক বছর আগে। এই মিথ্যাচার আজও রমরম করে চলছে এবং বহুব্যবহারে সত্য বলে মান্যতা পাচ্ছে। অতএব, সারাদিন ডেস্কে বসে চাকরি করা উপার্জন আজও হাড়ভাঙা পরিশ্রমের নামান্তর, আর কাঠ কেটে উনুনের তাপে হাত পুড়িয়ে রান্না সারাদিন শুয়ে বসে থাকার সমতুল্য। ফলত, সমাজের রিডাইরেক্টেড অ্যাগ্রেশনসমূহ যে সামাজের দাগিয়ে দেওয়া দুর্বলতম গোষ্ঠী নারীদের উদ্দেশ্যেই থাকবে, এ আর আশ্চর্যের কী! নারীশরীর, নারীজীবন পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি— এই বিশ্বাসের মূলে রয়েছে প্রাগৈতাহাসিক ভুল এবং সেই ভুল না শুধরোতে পারার লজ্জাজনক ব্যর্থতা।
যে ইতিহাস আজ অবধি লেখা হয়েছে, যে দাবীর সত্যাসত্য নিয়ে প্রশ্ন না তুলে অন্ধ প্রবাদের মত মেনে নিয়েছে সমাজ, তার নেপথ্যে রয়েছে বিকল্প এক ইতিহাস। যার মধ্যে প্রোথিত রয়েছে মেয়েদের সামাজিক অবস্থান এবং অধিকার পুনরুদ্ধারের অস্ত্র। সিমোন দ্য ব্যুভোয়া history of materialism আলোচনায় বলছেন, বর্তমানে মেয়েদের অধস্তন অবস্থান এবং সামাজিক বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকার প্রক্রিয়া বোঝাতে নিয়মিত উঠে আসে ব্যক্তিগত মালিকানার তত্ত্ব এবং তার পিছনের জৈবিক ব্যাখ্যা। সিমোন বলছেন, মেয়েদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয়ে ওঠার ইতিহাসের গোড়ায় গলদটি নিয়ে বরং বিস্তারিত আলোচনা জরুরি। এর সূক্ষ্ম বোঝাপড়ায় স্পষ্ট হবে যে মেয়েদের অবদমনে ব্যবহৃত জৈবিক ব্যাখ্যাটি আজকের পরিপ্রেক্ষিতে তাৎপর্য হারিয়েছে। শারীরিক শক্তির ভিত্তিতে নারী পুরুষের ব্যবধান সমানাধিকার ও মানবাধিকারের নিরিখে আসলে অপ্রাসঙ্গিক সেই আদিযুগ থেকেই, যখন মানুষ গুহা ছেড়ে গার্হস্থে প্রবেশ করল। এ কথাটি বারবার বলতে হবে, চিৎকার জরে দাবী করতে হবে, শতাব্দীপ্রাচীন অপসত্যকে তথ্য দিয়ে প্রতিস্থাপিত করত। রাষ্ট্রসঙ্ঘের বৈঠকে উপসংহারে উঠে আসে একই সমাধান পথ। যুযুধান রাষ্ট্রের তরফে মেয়েদের প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর দরকার। দ্বন্দ সমাধানের বুদ্ধিমতা এবং ক্ষমতায় নারী পুরুষ সমান, সেখানে মেয়েরা আরও বেশি করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পদে প্রতিষ্ঠিত হলে সংঘাতময় পরিস্থিতিতে মেয়েদের যুদ্ধের কূটনীতির ঘুঁটি না বানিয়ে তাদের মৌলিক মানবাধিকারকে প্রাধান্য পাবে, এমনটাই আশা। মানুষ হিসেবে নিজেদের অবস্থান পুনরুদ্ধার করে নিতে পারবে মেয়েরাই, ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে। ইতিহাসের দোহাই দিয়ে, জীববিজ্ঞানের ভুল তর্জমা করে অযৌক্তিক অন্যায়কে প্রশ্রয়ে ইতি টানতে হবে। ‘মেয়েরা সমাজের দুর্বল প্রজাতি’ এই মিথ থেকে প্রস্থান সম্ভব ইতিহাসের পূর্ব ইতিহাসে ফিরতে পারলে।
তথ্যসূত্র:
- দারিন তাতুর ও উজমা ফলকের কবিতা অনুবাদ: সোহেল ইসলাম
- অমৃতা প্রীতমের কবিতা অনুবাদ: অমৃতা সরকার
- Behold, I Shine: Narratives of Kashmir’s Women and Children — Freny Manecksha
- The Second Sex — Simone de Beauvoir
- The Female Eunuch — Germaine Greer
- Women Suffer Disproportionately During and After War — Security Council meeting, UN, 2003
- Racism, African American Women, and their Sexual and Reproductive Health: A Review of Historical and Contemporary Evidence and Implications for Health Equality — Cynthia Panther et al., 2018
- Myanmar’s Democratic Struggle: The Impact of Communal Violence upon Rohingya Women and Youth — Engy Abdelkader, 2014
চমৎকার লিখেছেন শ্রীজাতা । আরও লিখুন।