অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রযুক্তিবিদ্যার ছাত্র ও গবেষক
একটা শব্দ আছে ইংরেজিতে, ‘ডিগনিটি’। যার বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘মর্যাদা’। যে কোনও স্থান, কাল বা পাত্রের একটা নিজস্ব মর্যাদা আছে। একটা ডিগনিটি আছে। সেই মর্যাদাতেই তার পরিচয়। ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে আমাদের মহামান্য কেন্দ্রীয় সরকার বিশেষ একটি আইন প্রণয়নের মাধ্যমে ঐতিহাসিক জালিয়ানওয়ালাবাগ সৌধটির রক্ষণাবেক্ষণের সমস্ত দায়ভার নতুন একটি ট্রাস্টের হাতে হস্তান্তরিত করে। এই আইনবলে পূর্বোক্ত ট্রাস্টে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতির পদাধিকার বলে অন্তর্ভুক্তির অধিকারকে অবলুপ্ত করা হয়। আমরা বোধহয় ভুলে যাই যে, জাতীয় কংগ্রেস মানে কেবলই গান্ধিপরিবার অথবা শচীন পাইলট, দিগ্বিজয় সিং কিংবা অধীর চৌধুরীদের কলহপ্রবণতা নয়। ভাগ্যবশত জালিয়ানওয়ালাবাগ বা এমন কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে এই দল বা সংগঠনটির যোগাযোগ ইতিহাসগতভাবে স্বীকৃত। সংখ্যার জোরে সেই ইতিহাসকেও আজ পালটিয়ে দেওয়া চলে না।
ইতিহাসকে পুনরুদ্ধার করতে হয়। পুনরাবিষ্কার করতে হয়। পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হয়। নতুন করে গালগল্প বানিয়ে তাকে চালিয়ে দেওয়াটা কখনও ইতিহাস রচনার উদ্দেশ্য হতে পারে না। অথচ আমাদের দেশে বিশেষ একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর বরাবরের উদ্দেশ্য হচ্ছে, যতবার তারা শাসকের ভূমিকাতে অবতীর্ণ হবে— ততবার, তারা ইতিহাসের অবমাননা ঘটাবে। নতুন করে তাদের ‘পার্টিলাইন’ অনুযায়ী বিকৃত ইতিহাসকে চাপিয়ে দিতে চাইবে তথ্যনিষ্ঠ, পরীক্ষালব্ধ সত্যকার ইতিহাসের উপর। এই বিকৃতিতেই তাদের পরিতৃপ্তি। ঈশ্বর তাদেরকে মার্জনা করুন।
তাদের এই ইতিহাস বিকৃতির ধারাবাহিকতা বা সেই বিকৃতির গতিপ্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য ইত্যাদিকে নিয়ে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। এই নিবেদন একেবারেই বিশেষ একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তাৎক্ষনিক একটি প্রতিক্রিয়ার মতো। সাম্প্রতিক একটি বিষয়ের প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষিত হওয়ায় এই দু-চার কথার সামান্য আয়োজন। ইতিহাস বিকৃতকরণের যে বিন্যাস, সে যে আজ আর কেবল সামান্য সরকারি পাঠ্যপুস্তক অথবা পাঠ্যক্রমের বিকৃতিতেই সীমাবদ্ধ নেই, তা যে ক্রমশই নগ্ন ও উন্মোচিত হয়ে সামাজিক পরিসরে তার প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে, সাম্প্রতিক এই ঘটনাটি থেকেই তা পরিষ্কার। অনেক বছর আগে আমার পিতৃদেব আমাকে ‘সাগরপাড়ের দুষ্টু লোকেদের’ গল্প শোনাতেন। সেই দুষ্টু লোকেদের গল্প, যারা কিনা আমাদের সামান্য লবণ তৈরির অধিকারটুকুকেও হরণ করে নিয়েছিল, আর সেই দুষ্টু লোকেদের বিরুদ্ধেই আমাদের দেশের মানুষ, সাধারণ মানুষ যুদ্ধ করেছিল। আমরা সেই যুদ্ধকে ‘স্বাধীনতার যুদ্ধ’ বলে থাকি। আমার তখনও সেভাবে ‘ইতিহাস পড়া’র বয়স হয়নি। কিন্তু সেই সময় থেকেই আমার পিতৃদেব দেশ, মানুষ, লড়াই, স্বাধীনতা— এই শব্দগুলিকে আমার শিরায়-তন্ত্রীতে ঢুকিয়ে দিতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তাঁর মুখেই আরও একটি গল্প শুনেছিলাম।
আমার বাবা যখন জালিয়ানওয়ালাবাগে গিয়েছিলেন, তখনও পশ্চিমবঙ্গে প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের পাঁচ বছর হয়নি। আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগেকার সেই সময়। কিন্তু এখনও, এমনকি আজও যখন বাবাকে সেই দিনটির কথা, সেই সফরটির কথা জিজ্ঞেস করি— বাবা শুধু একটাই কথা বলেন, “ওখানে গেলে পরে মনটা সত্যিই খারাপ হয়ে যায়।”
অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা নেমে আসে কোথাও। ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষে কুখ্যাততম গণহত্যার সেই অঙ্গনে কেবল নীরবতা আর নিস্তব্ধতা ছাড়া আর কোনও কিছুরই অস্তিত্ব থাকতে নেই। বাবার মুখে শুনেছি তিনি কেমনভাবে নিজের চোখে দেখেছিলেন জালিয়ানওয়ালাবাগের দেওয়ালে সারিসারি বুলেটের ক্ষতচিহ্ন। অতলস্পর্শী বেদনার মৌন সাক্ষী সেই ইঁদারা, চারপাশের বদ্ধ চৌহদ্দি, সরুর চেয়েও সরু এক প্রবেশপথ। যে প্রবেশপথ ভিন্ন আর কোথা দিয়েও সেই বাগ থেকে বেরুনোর উপায় নেই। পৃথিবীর ইতিহাসে নিষ্ঠুরতম গণহত্যার এক অন্যতম দলিল হয়ে থাকা জালিয়ানওয়ালাবাগ।
সম্প্রতি আমাদের মহামান্য কেন্দ্রীয় সরকার সেই বাগিচাটির কিছু সংস্কার সম্পন্ন করেছে। এর পরবর্তীতে সেটি নাকি এখন ইতিহাসের হেরিটেজের চেয়েও কার্যত জেন-এক্স বা জেন-নেক্সটের সেলফি-জোনে পর্যবসিত হয়েছে। লাইট-অ্যান্ড-সাউন্ডের সমারোহে, কৃত্রিম ঘাস, বাগিচা, জলাশয়ের আতিশয্যে, লেজারের চোখ-ধাঁধানি আলোতে এখন কার্যত সেটি প্রাক-নির্বাচনী পাঞ্জাবের মেগা নির্বাচনী গিমিকের এক অন্যতম উদাহরণ হিসেবে জনসমক্ষে প্রচারিত। দেশের ইতিহাসকে এভাবে সার্কাসে পরিণত করতে আমাদের শাসক-বাবাজিদের যে কোনওপ্রকার হেলদোল নেই তা বুদ্ধিহীন এই ‘সংস্কারের’ মাধ্যমেই আজ প্রমাণিত। কিন্তু এই ‘সংস্কার’ যে কেবল রুচিবোধের অভাব তাই নয়, এমন ‘সংস্কার’ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী হেরিটেজ ক্ষেত্রগুলিকে রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার/সংরক্ষণের যে সাধারণ গাইডলাইন— তারও পরিপন্থী।
১৯৬৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অন মনুমেন্টস এ্যান্ড সাইটস সংস্থাটির মাধ্যমে ঘোষিত ভেনিস সনদের ৭ নম্বর ধারাটিতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, এমন একেকটি সৌধ বা ঐতিহাসিক ঘটনাস্থল “ইতিহাসের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য”। এই সনদেরই ৯ নম্বর ধারায় বলা হচ্ছে “এমন একেকটি জায়গার সংস্কার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বিশেষ প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার লক্ষ্য হল জায়গাটির ঐতিহাসিক গুরুত্বকে সম্পূর্ণভাবে রক্ষা করা এবং তথ্য ও উপযুক্ত নথির সাহায্যে জায়গাটির মৌলিকত্বকে সবদিক থেকে রক্ষা করা।” অর্থাৎ ইংরেজিতে ‘রেস্টোরেশন’ ও ‘রেনোভেশন’ এই শব্দদুটির মধ্যেকার যে সূক্ষতর ফারাক রয়েছে, সেই ফারাকটুকুকেই কাউন্সিল সনদের এই বক্তব্যের মাধ্যমে প্রকাশ করতে চেয়েছে। আমাদের ‘আর্কিওলজিস্ট’রা সংরক্ষণ ও সংস্কারের বদলে, জালিয়াওয়ালাবাগের ‘ফেস-লিফটিং’ করতেই বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, এবং তার ফল যা দাঁড়াল তা হল মারাত্মক।
জালিয়ানওয়ালাবাগে এখন যা দেখা যাচ্ছে—
- বাগের একমাত্র প্রবেশপথটির পাশাপাশি দর্শনার্থীদের জন্য এখন আরও একটি প্রস্থানপথ তৈরি করা হয়েছে। হেরিটেজ এই ক্ষেত্রটির যে মূল ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য, সেটিকেই এই ‘সংস্কারের’ মাধ্যমে আমূল বদলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
- জালিয়ানওয়ালাবাগে এখন একটি কৃত্রিম জলাশয় তৈরি করা হয়েছে। তাতে পদ্মের চাষ করা হয়েছে, এবং সেটি সেই মারণ-ইঁদারাটির চারপাশ প্রদক্ষিণ করে এসেছে।
- প্রধান এবং মূল জালিয়ানওয়ালাবাগে একমাত্র যে সরু প্রবেশপথটি ছিল, তার দুই পাশের দেওয়ালে হাস্যোজ্জ্বল, উৎসবমুখর পাঞ্জাবি জনগণের একটি ‘মর্মস্পর্শী(!)’ ম্যুরাল অঙ্কন করা হয়েছে।
এই ‘নববাগিচা’র (নাকি বলব দিল্লি কা বাদশার নয়া টিউলিপ-গার্ডেনের) নকশা-নির্মাতারা বোধ করি ভুলে গেছেন, সেদিনকার সাল-তারিখ অনুযায়ী পঞ্জাবে সেই বিশেষ দিনটিতে ‘বৈশাখী’ বা ‘পাঞ্জাবি নববর্ষ’ উদযাপনের কথা থাকলেও, জালিয়ানওয়ালাবাগে সেদিনকার আয়োজন ছিল এক শোকবিহ্বল প্রতিবাদসভার। কিছুকাল মাত্র আগে কুখ্যাত রাউলাট-আইন বিরোধী একটি শান্তিপূর্ণ মিছিলের উপর ব্রিটিশ পুলিশের নির্বিচার গুলিবর্ষণ ও হত্যালীলার প্রতিবাদে সেদিনকার সেই সমাবেশ আহুত হয়েছিল। জালিয়ানওয়ালাবাগ-মুখী মিছিল সেদিন কোনও উৎসবের মিছিল ছিল না। সেদিন উদযাপনের জলুস ছিল না। আমাদের সেলফি-সর্বস্ব প্রধানমন্ত্রী অথবা তাঁর চাটুকারদের অবশ্য এই তথ্য না জানাটাই স্বাভাবিক। তাঁরা কেবল ‘অচ্ছে দিন’-এর হাইফাই বিজ্ঞাপন, সেলফিতে ডিম্পল এবং রুপোলী পর্দাতে আত্মনির্ভরের দারুণ অভিনয় করতেই অধিক আগ্রহ বোধ করেন। ঐতিহাসিক ইরফান হাবিব ঐতিহ্যের এই ‘কর্পোরেটাইজেশন’-এর তীব্র বিরোধিতা করেছেন। তিনি জানিয়েছেন এমন একেকটি ঐতিহাসিক সৌধের পুননির্মাণ, বা রেস্টোরেশনের সময় যদি সেই ক্ষেত্রের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বা সাংস্কৃতিক বিশেষত্বকেই মান্যতা দেওয়া না হয় তাহলে সেটিকে ইতিহাসের অবমাননা ভিন্ন আর কিছুই বলা চলে না।
নিন্দুকেরা এও বলছে, অলাভজনক সংস্থা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ট্রাস্ট ফর আর্ট অ্যান্ড কালচারাল হেরিটেজকে বাদ দিয়ে (যাঁদের কিনা এমন ধরনের হেরিটেজ ক্ষেত্র সংরক্ষণের বিষয়ে পূর্ব-অভিজ্ঞতা রয়েছে), প্রায় কোনও আলোচনা বা যুক্তি ছাড়াই এই প্রকল্পের সমস্ত দায়িত্ব গুজরাতের একটি বিশেষ সংস্থার হাতেই তুলে দেওয়া হয়েছিল। সেই সংস্থাই নাকি সম্প্রতি ২৬ কোটি টাকার বিনিময়ে, গুজরাতের রাজকোটে একটি এমনই ঝাঁ-চকচকে গান্ধি সংগ্রহশালা তৈরি করেছে। ইতিহাসে শোনা যায়, গান্ধি নিজেও নাকি কোনও একবার শান্তিনিকেতনে এসে রবিঠাকুরের তখনকার সময়ে অসম্ভব পরিপাটি ও প্রায় বাড়াবাড়ি রকমের দৃষ্টিসুন্দর এক আয়োজনের সামনে পড়ে যারপরনাই বিব্রত বোধ করেছিলেন। সেই মহাত্মাকে আজ যদি কোনওভাবে রাজকোটের সেই আধুনিক সংগ্রহশালাতে অথবা প্রায় তেমনিভাবেই ‘রেস্টোরড’ গুজরাতের আধুনিক সবরমতীতে প্ল্যানচেটের মাধ্যমেও ফিরিয়ে আনা যায়— তখন কেবল তাঁর মুখের ভাবটুকুকে একটিবার দেখলেই জীবন সার্থক বোধ করব। ইতিহাসের কাছে নম্রভাবে যেতে হয়, ঐতিহ্যের কাছে— কষ্টের কাছে— সংগ্রামের আত্মত্যাগের কাছে মাথা নীচু করে গিয়ে দাঁড়াতে হয়। আমাদের ‘ঐতিহাসিকেরা’ সেই পাঠ-কে বোধকরি আজ একেবারে বিস্মৃত হয়েছেন।
ইউনেস্কো-সহ একাধিক সংগঠনের মাধ্যমে, বিভিন্ন সংস্থা ও সম্মেলনে বারংবার এমন সমস্ত ঐতিহাসিক ক্ষেত্র সংরক্ষণের বিষয়ে নির্দিষ্ট নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছে। ১৯৯৪ সালে নারা কনভেনশন, ১৯৭২এর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কনভেনশন, আমাদের দেশের একাধিক আইন— বারংবার ঐতিহাসিক ক্ষেত্র সংরক্ষণ ও সংস্কারের জন্য সেই স্থানগুলির ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, ভৌগোলিক ও চারিত্রিক বিশেষত্ব, এবং তথ্যনিষ্ঠতা— এই বিষয়গুলিকেই গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছে। কিন্তু আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার এসবে যে বিশেষ গুরুত্ব দিতে নারাজ তা তাদের কাজের মাধ্যমেই প্রকাশিত। আসলে ‘সনাতন বিশ্বাস’ই যদি এক এবং একমাত্র ‘ইতিহাস’ হয়ে দাঁড়ায়, তখন সেই ‘বিশ্বাসী’দের কাছ থেকে মার্জিত রুচির আশা করাটাই বোধহয় ভ্রান্তি আমাদের তরফে। এরা কেবল ‘চকচকে করে সাজানো’তে বিশ্বাসী। সংরক্ষণের প্রকৃত অর্থ এঁদের কাছে অজানা। এখন কেবল জালিয়ানওয়ালাবাগে দুরাত্তির— ইস্পেশাল হনিমুন প্যাকেজের ব্যবস্থা করে ফেলতে পারলেই, অচ্ছে দিনের ভবিষ্যৎ!
রবিঠাকুরের ছেড়ে যাওয়া নাইট উপাধিটাকেও আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কী ভাগ্যিস তিনি ১৯৪১-এই প্রয়াত। গণহত্যার এই ‘ডিজনি’ফিকেশনকে অন্তত তাঁকে আর সহ্য করতে হল না।