সুব্রত ভৌমিক
বোল্লা
টানা বাইশ দিন গরমের ছুটির পর ক্ষুদে ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা জানলা-দরজাগুলো খুলতেই ক্লাসরুমগুলো হেসে উঠল। সার সার ফাঁকা বেঞ্চগুলো বেজায় খুশি। টালিখোলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বেঁটেখাটো প্রধানশিক্ষকটি উঁচু বাস-রাস্তা থেকে ঢাল বেয়ে স্কুলমাঠে নামতেই সবাই ছুটতে ছুটতে এসে তাকে ঘিরে ধরে জানাল, স্যার, বোল্লা!
–বোল্লা মানে! বোলতা? কোথায়?
–উপরের ঘরে।
উপরের ঘরেই তার অফিস। গন্তব্য। প্রধানশিক্ষক থমকালেন। রশিদবাবুর জন্য অপেক্ষা করলেন। রশিদবাবু স্থানীয়, প্যারাটিচার। এসে শুনল। কিচ্ছু বলল না। প্রার্থনা শেষ করে চুপচাপ উপরে উঠতে লাগল। দেখে প্রধানশিক্ষক আঁতকে উঠলেন।
–এ কী! খালি হাতে যাবেন নাকি! কামড়াবে তো!
রশিদবাবু মুচকে হাসল। ফের উঠতে লাগল।
ফিরে জানাল,
–যান, চলে গেছে।
আশ্চর্য, রুমগুলো সত্যিই এখন কামড়হীন!
টিফিন আওয়ারে সবাইকে অফিসঘরে মেলে। রাজনীতির কথা হয়, সমাজের গল্প ওঠে। এভাবে মৌচাকের কথা এল। সহশিক্ষক স্বদেশ মজুমদার বলল,
–স্যার, রশিদবাবুর কিন্তু সত্যিই একটা অলৌকিক ক্ষমতা আছে।
স্যার সম্মত হলেন। তারপর ডাকলেন,
–রশিদবাবু?
–বলেন।
–কী করে তাড়ালেন ওদের?
–মন্ত্র পড়ে।
–কী মন্ত্র?
–বিশ্বাসের। ভালো আত্মা হলি খাটে।
–এমন মন্ত্রে গ্রামের মধুচক্রটা ভাঙতে পারেন না?
রশিদবাবু থমকালেন। তারপর বললেন, দেখি।
বলে আর খবর নেই।
বাতাসে বিষাক্ত বোলতা। ফুলেরা গন্ধহীন।
একদিন শোনা গেল, মধুচক্রটা ভেঙে গেছে। গ্রামটা ফের সুগন্ধি। কিন্তু এ কী! রশিদবাবুর চোখমুখ এমন বীভৎস ফোলা কেন! কে কামড়েছে!
উত্তর এল,
–বোল্লা।
ডানা
শেষমেষ মেয়েটা রাজি হল। ছুটন্ত ট্রেনটার ভারী চাকাগুলোকে বেছে নিল। পায়ের কাছে রাখা ব্যাগ, আটপৌরে শাড়িটা দুরন্ত ঢেউয়ে ঢেউয়ে লেপটে, প্ল্যাটফর্মটার একেবারে ধার ঘেঁষে অল্প ঝুঁকে দাঁড়ানো।
ট্রেনটা ঢুকছে।
বডিটা ক-টুকরো হতে আর ক-সেকেন্ড।
কিন্তু না। লাইনটার উপর যেই ঝাঁপাতে যাবে, এক হেঁচকায় পিছন থেকে টেনে নিল একটা লোক। তারপর প্ল্যাটফর্মটার উপর ছিটকে পড়ে একেবারে বুকের ভেতর। এত ভেতরে কে থাকে! তার সঙ্গে দেখা হয় না? তো সেখান থেকে মুখ তুলেই সপাটে একটা চড় কষাল মেয়েটি। তারপর সশব্দ ফণা ওঠাল,
–কেন বাঁচালেন আমায়?
লোকটা নিরুত্তর। হাঁপাচ্ছে।
মেয়েটি শান্ত হল। গেল-রাতে ফের রেপড হয়ে গেছে। কোল্ডড্রিঙ্কসের বোতলের ভেতর পাইপ ঢুকিয়ে সবটুকু টেনে নেওয়ার মতো মেয়েটা খালি হয়ে গেলে স্বামীটি মুখ মোছে। তারপর গলা তোলে। পাল্টা স্বরে খেপে যায়। গলা-ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় মাঝরাতে।
এভাবে মাঝেমধ্যেই ছিটকে বাপের বাড়ি।
তবে বেরোতে পারে না।
ক-দিন বাদে ফের মাথা নামিয়ে স্বামীগৃহে।
কিন্তু বাপের বাড়িটি এবার থুম। হয়তো আগেভাগেই পাকাপাকি আসার খবরটা পেয়ে গিয়েছিল। এত ডাকাডাকি, কড়া নাড়া— কিছুতে কারও ঘুম ভাঙে না। মেয়েটি আপাদমস্তক কেঁপে ওঠে। কান্না পায়। শেষমেশ রাজি। কিন্তু কে এই লোকটা! পথে এইরকম কেউ পড়ে? পড়ার কথা?
প্ল্যাটফর্মটা থেকে বেরিয়ে এসেছে। লোকটার পাশে পাশে হাঁটছে। শাড়ির ভাঁজটা আস্তে ভাঙছে পায়ের কাছে। হঠাৎই পাশে প্রশ্ন ঠেলল,
–কী করেন?
–বাঁচি।
–মানে!
–বাড়ি বাড়ি পাখি কিনি।
–কেন?
–উড়িয়ে দিই।
মেয়েটির চোখে জল।
–মানুষ ওড়াতে পারেন?
লোকটা থমকাল। ফের হাঁটতে লাগল। শহরটা থেকে এখন অনেকটা দূর। দূরে সীমানা ছাড়িয়ে এক মাঠ, আকাশ, অন্য জীবন। লোকটা সেখানে পাখি ওড়ায়।
দুজনে সেদিকে হাঁটছে।
দূরে সরে যাচ্ছে শাঁখা, পলা, একটা রেললাইন…
ঘর
সন্ধে নাগাদ রিংটোনটা বেজে উঠল, সেই তো আবার কাছে এলে…। দিব্য মোবাইল তুলল— হ্যালো।
কান্নারুদ্ধ এক নারীকণ্ঠ এল,
–বিট্টুর খুব শরীর খারাপ।
–কী হয়েছে?
–জানি না।
–দাদাদের বলেছ?
–না।
এই দাদারাই তাকে ডিভোর্স-পেপারে সই করিয়েছিল। বোনকে বুঝিয়েছিল, বাউণ্ডুলের সঙ্গে ঘর বাঁধা যায় না।
মানুষ ঘর বাঁধে কী দিয়ে?
কানে ফোন, দিব্য আলনা থেকে জামা টানছে।