শঙ্খিনী

সাদিয়া সুলতানা

 

১.

বিয়েশাদি পাগল ভালো করার মহৌষধ জেনেও মোনায়েম সোলায়মানের জন্য বিয়ের ঘর খোঁজে না। বিষয়টাতে মোনায়েমের স্ত্রী জয়তুন বেশ অবাক হয়। তাহের হাজীর ছেলে জহিরুল আশ্বিনী পাগলা, সে পর্যন্ত বিয়ের পর ভালো হয়ে গেল! প্রতি বছর আশ্বিন মাস এলেই জহিরুল উদোম গায়ে মতিহার বিলে গলা ডুবিয়ে ভেসে থাকত। তখন কারও সাধ্যি ছিল না যে তাকে পানি থেকে টেনে তোলে। সেই আশ্বিনী পাগলাকে বিয়ে দেবার পর সে রীতিমতো গেরস্ত পুরুষে পরিণত হয়েছে। এই বছর আশ্বিনে জহিরুলকে কেউ আর মতিহার বিলের আশেপাশে দেখেনি। বউ-ঝিদের কানাঘুষায় জয়তুন শুনেছে, জহিরুলের বউয়ের পেটে বাচ্চা। সন্তানহীন জয়তুন বাৎসল্যবোধের মমতায় সোলায়মানের দিকে তাকায়। কিন্তু এই আবেগের ক্ষণ স্বল্প সময়ের। জয়তুনের বুকের ভেতর মায়ার কুণ্ডলী মাঘ সকালের কুয়াশার মতো ঘন হয়ে পাক নিতে নিতে আবার মিলিয়ে যায়। সোলায়মানের প্রতি বাড়তি আদর-সোহাগ দেখানো তার স্বামী পছন্দ করে না। এসব আদিখ্যেতা দেখানো নিয়ে জয়তুনের প্রতি কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি আছে। সে কথা মনে পড়তেই জয়তুন মাত্র ধুয়ে আনা রুই মাছের টুকরোগুলোতে হলুদ, মরিচ গুড়ো আর লবণ দিয়ে মাখাতে মাখাতে সোলায়মানের দিকে আড়চোখে তাকায়।

পরিষ্কার নির্মেঘ আকাশে কটকটে রোদ। এই রোদে উঠোনে বেশিক্ষণ দাঁড়ানোই মুশকিল। নিম গাছের নিচে ছায়ায় সোলায়মান বাঁধা অবস্থায় বসে আছে। এই গাছটা ওদের উত্তরভিটা দক্ষিণদুয়ারী ঘর থেকে গজ পনেরো দূরে। গাছটা প্রাচীন। প্রায় তিনফুট বেড়ের গাছটির গৃহস্থালি গুরুত্বের জন্য এখনও এর জীবনাবসান ঘটেনি। সোলায়মান ডান হাতকে করাতের মতো করে নিম গাছের গোড়া কাটার ভঙ্গি করছে। রোজ এই করতে করতে ছেলেটার হাতের কব্জির কাছে চামড়া ছড়ে যায়। মাঝে মাঝে রক্তও বের হয়, তবু পাগল হাত দিয়ে গাছ কাটে।

জয়তুন এবার স্নেহমিশ্রিত ডাক দেয়,

–অমন করে না বাপ। হাত কাটব। কিছু খাইবি?

সোলায়মান চাচীর কথায় ভ্রূক্ষেপ না করে অর্থহীনভাবে হাসে। দূর থেকেও জয়তুন দেখতে পায়, সোলায়মানের লুঙ্গির প্রায় পুরোটা ভেজা। কখন প্রস্রাব করে তার উপরেই বসে আছে ছেলেটা। মায়া-মমতা উবে গিয়ে জয়তুনের মনে বিরক্তি এসে ভর করে। ‘এইসব নোংরা গু-মুত সাফ করণের লাইগাও তো একটা মানুষ লাগে! কিন্তু কারও কী সেই হুশ আছে! নাহ্ আর পারি না। এইবার একটা বেবস্থা করণই লাগব।’

দুপুরে ভাত খাওয়ার পর জয়তুন ভয়ে ভয়ে স্বামীর কাছে কথাটা পাড়ে। ভয়ের সাথে সমীহের আঁচ টের পেয়ে মোনায়েম কঠিন গলায় স্ত্রীকে ধমক দিতে গিয়েও দেয় না। স্ত্রীর নির্বুদ্ধিতায় তাকে মৃদু ভর্ৎসনা করে বলে,

–কী বুদ্ধি! পাগলটারে বিয়া দেই আর হেয় আরও একখান পাগল পয়দা কইরা বহুক! আর ঘরে খানেওয়ালা বাড়ুক আরেকজন।

–এই বাড়িত কি আর খাওনের অভাব?

স্ত্রীর মূর্খামিতে প্রচণ্ড রাগে মোনায়েমের মুখের পান বিস্বাদ লাগে। সে থু থু করে পান উঠানের পুব পাশে ফেলে দেয়। এইবার স্বামীর মেজাজ টের পেয়ে জয়তুন কথা না বাড়িয়ে ঘরে ঢুকে যায়। কিন্তু তার কেমন বেদিশের মতো লাগে। স্বামীর জন্য নতুন পান সাজাবে নাকি পানি দিবে কুলকুচা করতে তা ঠাহর করতে না পেরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আঁচলের খুঁট আঙুলের সাথে প্যাঁচাতে থাকে।

–লোকে কিন্তু আমাগো মন্দ কয়। বিয়া দিলেও তো পাগল পাগলের লাহানও থাকতে পারে। অত মন্দ কতা শোনার কাম কী?

–লোকের কতায় পিছা মারি।

–তা মারেন মারেন। কিন্তু হারাদিনতো আর মফুর মায়রে পাই না যে পাগলের গু-মুত সাফ করামু। দিনে কয়বার আমারেও হাত লাগাইতে হয়। আমার এসব ভাল্লাগে না। ঘিন্নাপিত্তা বইলা তো কিছু আছে। তারচে ওর বউ আইসা এইসব সাফ করুক।

এইবার কেন যেন মোনায়েম জয়তুনের কথাটা বরাবরের মতো ফেলতে পারে না। গ্রামের মানুষজন আজকাল চালাক-চতুর হয়ে উঠেছে। মানুষের মুখ বন্ধ করতে হলেও পাগলটার একটা ব্যবস্থা করা দরকার। মোনায়েম জানে টাকা ছড়ালে সোলায়মানের জন্য মেয়ে পেতে তার বেশি বেগ পেতে হবে না। যদিও এই গ্রামের প্রায় সবাই বলাবলি করে যে সোলায়মানকে তার চাচা মোনায়েম শেখ পাগল বানিয়ে রেখেছে। পাগলের স্থায়ী টোটকার জন্য এখনও মাঝে মধ্যে মোনায়েম ভিন গাঁয়ে যায় সেটাও এ গাঁয়ের লোকের কম-বেশি জানা। সুলতানবাদ গ্রামের গহর ফকিরের কাছে যে পাগল বানানো আর ভালো করার টোটকা-টাটকি, গাছ-গাছালির শিকড় বাকড় পাওয়া যায় তা জানা সত্ত্বেও মোনায়েম লোকচক্ষুর আড়ালে গিয়ে প্রয়োজনীয় খরচাপাতি করে ওষুধ নিয়ে আসে।

মোনায়েম ধূর্ত লোক, তার কাজের ধরন আলাদা। সাক্ষী রেখে কাজ করা তার পছন্দ না। উটকো ঝামেলা এড়ানো ও অন্যকে ঝামেলায় ফেলার ফন্দিফিকির মোনায়েমের ভালোই জানা। বাতাসে রহস্য ভেসে বেড়াবে আর তার উৎসমূলের খোঁজ কেউ পাবে না, এই ধরনের কাজ করার একটা ভিন্ন মাদকতা আছে। মোনায়েমের ভাষায় জোশ আছে। তাই জবরদস্ত পরিকল্পনা মাফিক কাজ করে মোনায়েম। কোর্টকাচারিতে ঘুরে ঘুরে এই সব কিছু মোনায়েমের নখদর্পণে এসেছে। ভাইয়ের বিরুদ্ধে নারী কেলেংকারির মামলা দিতে গিয়ে সে নিজে নাজির উকিলের মুহুরি হয়ে দীর্ঘ তেরো বছর কাজ করেছে। অবশ্য আজকাল তার কোর্টে যাবার প্রয়োজন পড়ে না। আর্থিক সঙ্গতির সাথে সাথে শরীরে আভিজাত্যের আলস্যও লেগেছে। তাছাড়া রোড-অ্যাক্সিডেন্টে বাপ-মা হারা তেইশ বছর বয়সী পাগল ভাতিজার পিতৃত্যক্ত সম্পত্তিটুকু সামলানোর গুরুদায়িত্ব কাঁধে চাপার পর থেকে মোনায়েম ধর্মে-কর্মে, দান-ছদকায় বেশ মনোনিবেশ করেছে। সে জানে দুই দিনের দুনিয়া দম ফুরাইলে শ্যাষ। দুই কাঁধের দুই ফেরেস্তা অবিরত পাপ পুন্যের হিসেব লিখে চলেছে। আজকাল কিরামান কাতিবিনের দম ফেলার সময় নেই। সর্বক্ষণ ব্যস্ত হয়ে কলম পিষেই চলেছে।

গহর ফকিরকে এসব কথা বোঝাতে গিয়ে বার বার মোনায়েমের দীর্ঘশ্বাস পড়ছিল। গহর এসেছে অনেকক্ষণ। মাঝে মাঝে গহর এ বাড়িতে আসে, সোলায়মানের খোঁজখবর নেয়। আজ সোলায়মানের জন্য সে একটা অব্যর্থ টোটকা নিয়ে এসেছে। গহরের আগ্রহে পানি ঢেলে মোনায়েম বলে,

–অইসব ভ্যাজাল ব্যবসা বাদ-ছাদ দিয়া গহর আল্লাহ খোদার নাম নে। আমরা পাপী তাপী তিনিই মাপ করনেওয়ালা।

–আমি আবার পাপ করি কই!

–এই তো তুই অখনই নিশ্চিত হইয়া বইসা রইছোস যে, তুই পাপ করোস না, এইডাই তো মহাপাপ। ইয়া আল্লাহ মাবুদ হেদায়েত কর তোমার পাপী বান্দাগোরে।

–করলে তো জাইনা শুইনা করি না।

–তুই তো মহা পাপিষ্ঠরে! নিজের পাপের খবর নিজে রাখোস না!

আবেগে মোনায়েমের চোখ ভিজে আসে। গলার স্বর কাঁপতে থাকে। খানিকক্ষণ জিকির করতে করতে মোনায়েম দিন দুনিয়া থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেয়। গহর ফকিরের বয়স পঞ্চাশোর্ধ্ব। যদিও শ্রেণিতত্ত্বের কারণে মোনায়েম তাকে তুই তোকারি করে। অবশ্য গহরের বাপ নহর ফকিরকে গ্রামের সবাই সমীহ করত। গাছ, লতা, পাতার কবিরাজী বিদ্যেতে গহর নহরের নখের সমতুল্যও হতে পারেনি। বরং বাজারে গুজব আছে যে, তার ভুলভাল ওষুধ খেয়ে দুজন মানুষ মারা গেছে। তাই গ্রামের দুএকজন গহরের ব্যবসা বন্ধ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।

–ও চাচা আমাকে এট্টু অষুধ দিবানি। গলগলা অষুদ না, মিষ্টি হোমিপথি বড়ির লাহান।

সোলায়মানের হাতে ললি পপ। ললি পপ পেলে ম্যাজিকের মতো কাজ হয়। হৈ হুল্লোড় পাগলামি বন্ধ করে সোলায়মান ললি পপ চোষে। ঠোঁটের দু পাশে গড়িয়ে পড়া মিষ্টি লাল চুষে চুষে খায়। সকালেই মোনায়েম সোলায়মানের পায়ের কয়রায় রশি লাগিয়ে তাকে নিম গাছের সাথে বেঁধে রেখেছে। গত পাঁচ বছর ধরে এই ভাবে সোলায়মানের সকাল শুরু হয়। বেঁধে না রাখলে সোলায়মান রান্না ঘর থেকে বঁটি এনে একে ওকে মারতে ছোটে। একবার ওর চাচীকে মারতে যাওয়ার পর থেকে বাধ্য হয়ে আপৎকালীন এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। মোনায়েম ছাড়া অবশ্য সেই ঘটনার আর কোনও প্রত্যক্ষদর্শী নাই।

সোলায়মানের উপদ্রব সহ্য করার জন্য তার বাবা মাও দুনিয়ায় নেই। সোলায়মান মোটামুটি সারা বছর ভালোই থাকে। শুধু ভাদ্র মাসের উচাটন সময়ে ও আরও উচাটন হয়। কতক্ষণ পরপর হাতকে করাতের মতো করে ব্যস্ত ভঙ্গিতে নিম গাছের গোড়া কাটতে থাকে। গাছের সাথে ঘষায় ঘষায় সোলায়মানের হাতের চামড়া ছিলে গেলেও ওর বিকার হয় না। মোনায়েম দুই একবার চেষ্টা করেছে ওকে লোকচক্ষুর আড়ালে কলপাড়ের পাশের নারিকেল গাছে বেঁধে রাখার। কিন্তু সেখানে জয়তুন থালা-বাসন ধুতে বসলে সোলায়মান চাচীর গায়ে থুতু মারে। তাই নিতান্ত বাধ্য হয়েই বাড়ির উঠানের এই নিম গাছের সাথেই সোলায়মানকে বেঁধে রাখতে হয়। গহরকে নিশ্চুপ দেখে সোলায়মান ছটফট করে।

–ও চাচা অষুধ দিবা না?

প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে প্রশ্নকর্তার ভীষণ রাগ হয়। কিন্তু মিনিট খানেক সময় নিয়ে সে মুচকি হেসে গাল ফোলায়। তারপর এক দলা থুতু মারে গহরের গায়ে। ঘটনার আকস্মিকতায় গহর সরে বসার সময় পায় না। থপ করে থুতুর দলা গহরের শার্টে এসে পড়ে। আধ ময়লা হলুদ শার্টের মধ্যে থুতুর অবস্থান দৃশ্যমান হয় না। কিন্তু অপমানে লাল হয়ে গহর উঠে দাঁড়ায়।

–হালার পাগলচোদা। তোর লাইগ্যা রইছি এই হানে। আর তুই আমারে ছেপ মারস?

মোনায়েমের মুখের চিকন হাসি দাড়ির কারণে বেশি বিস্তৃত হয় না।

–অত বোগলে রইছস ক্যা? জানস না হালায় পাগল?

গহরের বিনীত ভঙ্গি উদ্ধত হয়ে ওঠে।

–হালায় আসলেই একখান পাগল।

মোনায়েম গলার খুশি খুশি ভাবটা যতটা সম্ভব আড়াল করে সান্ত্বনার ভঙ্গিতে বলে,

–যা গহর বাড়ি যা। সোলায়মানের কথা ভাবিস না। অরে ভালো করণের অষুদ তর কাছে নাই। তর অষুদে তো গেরামের কোনও রোগী ভালো হইতে আজ পজ্জন্ত দেহি নাই। তুই খালি পুলাডার লেইগা আল্লার কাছে হাত তুইলা দোয়া করিস। নবাবগঞ্জ পীরের তন পানি পড়া আনছি। এইবার আমার বাজানের মাথাটা ঠাণ্ডা হইব।

হাতে ধরে রাখা ওষুধের পোটলাটা খোলার আগ্রহ গহর হারিয়ে ফেলেছে। মোনায়েমের কথা মানার কোনও ইচ্ছা নিয়ে যদিও সে এই বাড়িতে আসেনি। তবু এখন আর তার কোনও আগ্রহ নাই। পরনের শার্টটা খুলতে খুলতে সে বলে,

–না গো, এই শয়তানরে আমি অষুদ দিমু না।

মোনায়েম মুখ কুঞ্চিত করে।

–দিলে দিস। না করুম না। কমতো কবিরাজি করলাম না। পোলাটা যদি এট্টু ভাল হয়। বয়স হইতাছে। কই পোলা আমাগো দেখবো তা না, আমরাই ওরে দেহি।

মোনায়েমের কান্না মিশ্রিত কণ্ঠস্বর এখন আর গহরের কানে কপট লাগে না। গহর বিদেয় হতেই মোনায়েম জয়তুনকে ডেকে ছাতা দিতে বলে। এখন একটু পুব পাড়ার জমিগুলো দেখতে যাবে। আকাশের দিকে তাকায় মোনায়েম। রোদ নেমে গিয়ে আকাশ জুড়ে এখন সাদা সাদা মেঘ। মেঘগুলো খুব পলকা। যেন এক্ষুণি উড়ে এসে শরীর জুড়ে বসবে। রোদের আঁচও কমে এসেছে। তবু অভ্যেসবশত ছাতাটা বগলের নিচে গুঁজে নিয়ে মোনায়েম বাড়ির বাইরে পা রাখে।

২.

গৃহস্থালি কাজকর্ম শেষ হলে এই সময়টাতে হীরার শরীর একেবারে ভেঙে আসে। বিছানায় ক্লান্ত শরীর ছেড়ে দিলে তা দশগুণ ভারি হয়ে তোশকের মধ্যে ডুবতে থাকে। শরীরকে ভারশূন্য করার তাগিদে তখন ওর দুই চোখে ঘুমও আসে না। ঘরের বাইরে থেমে থেমে হওয়া চেনা-অচেনা শব্দে ও তখন চমকে চমকে ওঠে। রাত গাঢ় হয় আর বাইরের সূচিভেদ্য অন্ধকার ঘন হবার সাথে সাথে জাগতিক শব্দগুলো যেন আরও প্রকট হয়ে হীরার কানের মধ্যে প্রবেশ করতে থাকে। তখন ওর খুব ইচ্ছে করে ও কারও বুকে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকে। কিন্তু এই সময় নিজের সঙ্গীহীন শরীরকে অবশ করে শুয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না ওর। হীরা তাই অর্ধমৃতের মতো বিছানায় শরীর এলিয়ে থাকে।

কান পাতলে শোনা যায় পুবের বাঁশঝাড়ের মধ্যে জুয়াড়িদের ঝগড়া-ফ্যাসাদের অশ্রাব্য শব্দ। হীরার অস্থির লাগে। যে মেয়ের স্বামী বদ্ধ উন্মাদ তার শরীরের প্রয়োজনীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বাড়তি ভার বয়ে চলার দায় এই জগৎসংসারের লোকজনকে বোঝানো মুশকিল। বিষয়টা আবিষ্কার করতে হীরার নিজেরও দীর্ঘ দিন লেগেছে। মনের উচাটন ভাবের সাথে শরীরের অতৃপ্তিবোধের যন্ত্রণা আবিষ্কার করে নিজেই লজ্জায় অবনত হয়েছে। ওর শরীর-মনের এই বিচিত্র অনুভূতির ভাগীদার হবার মতো মানুষ এই বাড়িতে নেই। হীরার স্বামী সোলায়মান এইসব জাগতিক অনুভূতির ধার ধারে না। যদিও এই মানুষটাকে ওর মাঝে মাঝে খুব আবেগী মনে হয়। বিয়ের আগে হীরার স্বামী কী ধরনের পাগলামি করত তা হীরা নিজের চোখে দেখেনি, তবু এই বাড়িতে পা দেবার পর থেকে ও এই পাগল মানুষটাকে কখনও সে রকম কোনও পাগলামি করতে দেখেনি। এই যে দেখতে দেখেতে পাঁচ মাস হয়ে গেল, কখনওই সোলায়মানকে ও ক্ষেপে উঠতে দেখেনি। বঁটি, দা নিয়ে কাউকে আক্রমণ করতে দেখেনি। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে রোজ সকালে মোনায়েম চাচা সোলায়মানের পায়ের কয়রায় রশি লাগিয়ে তাকে নিম গাছের সাথে বেঁধে রাখে। এই দৃশ্য দেখে দেখে সারাদিনে হীরা কতবার যে কাঁদে। নিজের দুর্ভাগ্যের জন্য কাউকে দায়ী না করে ও নিজের স্বামীর দুর্গতির জন্য বার বার সৃষ্টিকর্তাকে দায়ী করে। আবার হঠাৎ হঠাৎ ওর মনে হয়, মানুষটা পুরোপুরি সুস্থ। বিশেষত হীরার হাতে ভাত খেতে খেতে লোকটা যখন বলে, ‘তুই কিন্তু আমার বউ। তোরে আমি ভাণ্ডারির মেলায় নিয়া যামু, তোরে আমি ম্যালা কিছু কিন্যা দিমু। নাকফুল, ঘুড়ি, মিঠাই, ম্যালা কিছু।’ ভাতের থালায় পানি পড়লে গেরস্তের অকল্যাণ হয় ভেবে হীরা স্বামীর কথা শুনে ভালো মতো কাঁদতেও পারে না।

কান্নার সেই ক্ষতিপূরণটুকু তাই সে নিজের ঘরে এসে করে নেয়। মোনায়েম চাচা ওদের দুজনের থাকার জন্য আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করেছে। বিষয়টা হীরা টের পেয়েছে বিয়ের পরের দিন। বিয়ের প্রথম রাতে স্বামীকে ঘরে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় দেখতে পেয়ে হীরার মন বিতৃষ্ণায় ভরে গিয়েছিল। বাড়ির নারী অতিথিরা অশ্লীল কৌতুক করতে করতে যখন ওকে স্বামীর ঘরের ভেতর ঠেলে দিয়েছিল তখনও ও ভাবতে পারেনি ভেতরে ওর জন্য কী অপেক্ষা করছে। যদিও বিয়ের সময়ই মায়ের কান্না থেকে জেনেছে যে পেটে-ভাতে থাকবে বলে মেয়েকে বাবা পাগলের সংসারে গছিয়ে দিয়েছে। বাবার উপর অন্ধরাগে সেদিন বার বার হীরার মনে হয়েছিল তক্ষুণিই গলায় ফাঁস নিয়ে কড়িকাঠে ঝুলে পড়ে। কিন্তু ও পারেনি। বাসর রাতে পাগল মানুষটা হীরাকে দেখে জোঁকের মুখে লবণ পড়ার মতো মিইয়ে গিয়েছিল। তখনই হীরা বুঝেছিল এই সংসার ছেড়ে ওর বের হবার আর কোনও উপায় নেই। সেই রাতে সব মেহমান চলে যাবার পর মোনায়েম ভাস্তেকে নিয়ে পাশের ঘরে তালা দিয়েছিল। নতুন বউকে একলা ফেলে রেখে যেতে হচ্ছে দেখে সোলায়মান একবারও উচ্চবাচ্য করেনি। চাচার পিছু পিছু পোষা বিড়ালের মতো আলাদা ঘরে ঘুমাতে গিয়েছিল। সেই থেকেই এভাবে চলছে।

হীরা ছটফট করে। ওর ঘুম আসে না। রাতের শুনশান নীরবতা ছিন্ন করে চেনা-অচেনা পাখির ডাক ভেসে আসে। পাশের ঘরে নাক ডেকে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে সোলায়মান। হঠাৎ হীরা সন্ধানী কান পাতে। এখন আর মানুষের চলাচলের কোনও শব্দ নেই। তাড়া খাওয়া শেয়াল-কুকুরের ডাক, গোয়াল থেকে গরুর নিঃশ্বাসের শব্দ ভেসে আসছে কেবল। অতি সন্তর্পণে ঘরের দরজা খুলে ও বাইরে যায়। এরপর কোনও শব্দতরঙ্গের ঢেউ না তুলে দক্ষ চোরের মতো হীরা স্বামীর ঘরের দরজার তালা খুলে ভেতরে ঢোকে। বিকালে এই ঘরের চাবিটা সরিয়েছে ও। ঘর ঝাড় দেবার নাম করে চাচার ঘরে ঢুকে বালিশের নিচ থেকে চাবিটা সঙ্গোপনে তুলে এনেছে। আলগোছে দরজার খিল তুলে হীরা বিছানার কাছে আসে। আধো আলো-ছায়ায় সে স্বামীর দিকে তাকায়। সোলায়মানের ঘুমে বিভোর নির্বিকার ঈষৎ হাঁ করা মুখটা দেখে হীরার বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়। হীরা স্বামীর পাশে শুয়ে সস্নেহে মানুষটাকে বুকে টেনে নেয়।

রাতের আঁধারে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কত কী ঘটে যায় সবার হয়তো তা চোখে পড়ে না। দিনের আলোতে সেসব ঘটনা কারও সন্ধানী চোখে ধরা পড়ে আবার কারও কারও কাছে সেসব রহস্যের ঘেরাটোপে নজরের বাইরেই থেকে যায়। তবে মোনায়েমের ধূর্ত চোখকে ফাঁকি দেয়া মুশকিল কাজ। জয়তুন টের না পেলেও মোনায়েম ঠিকই টের পায়, এই বাড়িতে তার চোখের আড়ালে কিছু ঘটে চলছে। দিনে দিনে হীরার ভেতরের পরিবর্তন লক্ষ করে মোনায়েমের ভ্রূকুটি বাড়ে। মেয়েটা কেমন লকলকিয়ে উঠেছে। শরীরে শঙ্খিনীর বাঁক তুলে এঘর-ওঘর করে। অযথা হাসি কল্লোলে হীরার চোখে-মুখে অচেনা আলো যেন ঠিকরে পড়ে। কাজের অবসরে মোনায়েম বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে আড়চোখে হীরার দিকে তাকায়। তারপর হঠাৎ একদিন হীরা ধরা পড়ে যায়।

ঘটনাটা আজ রাতেই ঘটে। তখন ঘুমন্ত স্বামীর পাশে শুয়ে তার বুকে-পিঠে তর্জনী দিয়ে সুখের মানচিত্রের আঁকিবুকিতে হীরা মোহচ্ছন্নতায় বুঁদ হয়েছিল। ঘরের দরজার বাইরের ফিসফাস, খুটখাট আওয়াজে ওর সেই মোহ সুতোকাটা ঘুড়ির মতো পাক খেয়ে মাটিতে পড়ে যায় আচমকা। হঠাৎ ঝড়ের মতো তাল-লয়যুক্ত শব্দগুচ্ছ কানে ভেসে আসতেই হীরা স্বামীর আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু ও যতই নিজেকে ছাড়াতে চায়, মানুষটা ততই ওকে আঁকড়ে ধরে। একসময় স্বামীকে ঠেলে দিয়ে হীরা দৌড়ে ঘর থেকে বের হতে গিয়ে একটা অঘটন ঘটে যায়। দরজার সাথে বাড়ি খেয়ে ও কপালে-নাকে-ঠোঁটে প্রচণ্ডভাবে ব্যথা পায় কিন্তু শরীরের আঘাতের অনুভূতি উপেক্ষা করে ও ভীত পাখির মতো দরজার বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু রাতের অন্ধকারে উঠোনের মাঝে একটা কুকুরের হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না ওর। কিন্তু ততক্ষণে যা ঘটার ঘটে যায়।

পরের দিন হীরার জন্য যে শাস্তি নির্ধারিত হয় তা শুনে ও অবাক হয় না। বরং শাস্তির ফিরিস্তি শুনে ও গা জ্বালানো হাসি হাসে। সেই হাসিতে হীরার দাঁত শঙ্খের মতো ঝকঝক করে ওঠে। তারপর কী মনে হতেই ও মুখে আঁচল চাপা দেয়। হীরার আঁচল চাপা বেলাজ হাসিমিশ্রিত মুখখানা দেখে মোনায়েমের শরীরের রক্তপ্রবাহে রাগের ঢেউ উন্মত্ত হয়ে ওঠে। হীরা তাতে পরোয়া না করে রান্নাঘরে ঢুকে ভাতের ডেকচি থেকে একথালা ভাত নিয়ে তাতে এক মগ দুধ ঢেলে নিয়ে পাটালি গুড়ের বড় একটা টুকরো চটকাতে চটকাতে নিমতলায় এসে স্বামীকে খাওয়াতে বসে।

–তুই সোলায়মানের ঘরে রাতে শুইছিলি? কয়দিন গেছস ওর ঘরে? আমারে না জিগায় গেছস ক্যান?

–চাচা, এসব কী কন আপনে, শরম করে না? আমরা কী আপনারে জিগাইছি আপনে চাচীর লগে শোন ক্যান?

–অসভ্য, নির্লজ্জ মাইয়া। আজ থেইকা তোর ঘরেও তালা ঝুলব।

শাস্তির বিবরণ শুনে নদীর পাড় ভাঙা হাসিতে হীরার শরীর দুলে দুলে ওঠে। তা দেখে মোনায়েমের আপাদমস্তকে অন্ধ ক্রোধ এসে ভর করে। দৌড়ে গিয়ে মোনায়েম হীরার হাত থেকে ভাতের থালা ফেলে দেয়।

–আর কোনওদিন যদি দেহি, এক্কেরে মাটিত গাইড়া থুমু।

হীরা আচমকা আক্রমণে তাল সামলাতে না পেরে কাত হয়ে মাটিতে বসে পড়ে। ওর ঠোঁটে-মুখে তবু কাদামাটির মতো হাসি মেখে থাকে। ছোটবেলা থেকে অভাবের সাথে যুদ্ধমুখর দিন কাটাতে গিয়ে মানুষের মনের কম কানাগলি দেখেনি সে, তাই আজ ফুঁসে ওঠার বদলে কেমন একটা বিবাগী আনন্দ ভর করে ওর মনে ও মগজে। মোনায়েম গর্জে উঠে সোলায়মানের চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকি মারে।

–তোর সাহস কত! তোর পাগলামিও আইজ আমি ছুটামু।

এবার হীরার মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। ওর মুখটা কেমন বিকৃত দেখায়। খানিক আগের চটুল ভাব উবে গিয়ে কেমন কাতর দেখায় ওর মুখ। বোঝা যায় কোনও এক শারিরীক অস্বস্তিতে ওর শরীর কুঁকড়ে গেছে। কায়দা করে উঠে দাঁড়িয়ে হীরা স্বামীর কাছে ছুটে যাবার বদলে দৌড়ে কলপাড়ে যায়। কলপাড়ের পানি যাওয়ার ঢালু মতো সরু রাস্তার কাছে বসে ও বমি করতে থাকে।

পিছন থেকে সোলায়মান কান্না ভেজা গলায় বলে,

–হায় হায় আমার বউয়ের কী হইলরে! আমার বউয়ের কী হইলরে!

হীরা স্বামীর দিকে তাকিয়ে রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসে। পরক্ষণেই, ‘কিছু না’ বলে হীরা মুখে আঁচল চেপে হাসতে থাকে। সোলায়মানের চুলের মুঠি ছেড়ে মোনায়েম এবার হীরার দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

3 Comments

  1. ধন্যবাদ দাদা। কিন্তু অাপনাদের লেখা যখন পড়ি তখন মনে হয় কিচ্ছুটি হচ্ছে না।

আপনার মতামত...