অবিলম্বে স্কুল খোলার জন্য সরকার, স্কুল এবং অভিভাবকদের কী কী করণীয়

চন্দ্রকান্ত লহরিয়া

 


ডঃ চন্দ্রকান্ত লহরিয়া একজন চিকিৎসক, প্রশিক্ষিত মহামারিবিদ এবং পাবলিক পলিসি বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ। এই বিষয়ে তিনি দীর্ঘ দু দশক ধরে কাজ করছেন, যাত মধ্যে ১৩ বছর যুক্ত ছিলেন রাষ্ট্রপুঞ্জের সঙ্গে। বর্তমান নিবন্ধটি স্কুল খোলার বিষয়ে চারটি নিবন্ধের একটি সিরিজ, আগস্টের ৫, ৯, ১২ এবং ২০ তারিখে এনডিটিভি এডুকেশনে প্রকাশিত হয় যথাক্রমে Why India’s Schools Should Open Immediately, What Governments Must Do To Reopen Schools Safely Amid COVID-19, What Schools Should Do To Be Ready For Reopening In COVID-19 Period এবং What Parents Need To Know, Do To Facilitate School Reopening শিরোনামে। বিষয়টির ব্যাপ্তি এবং প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে পুরো সিরিজটিই বঙ্গানুবাদ করে প্রকাশ করা হল।

কোভিড-১৯ অতিমারির কারণে যে অল্প কয়েকটি দেশে সুদীর্ঘ সময় ধরে স্কুল বন্ধ রয়েছে তাদের মধ্যে একটি হল ভারত। এ বছর জুলাই মাসের শেষের দিকে বিশ্বের ১৭৫টি দেশ স্কুল খুলে দিয়েছে। বেশ কিছু দেশ— তাদের মধ্যে ফ্রান্স, ডেনমার্ক, পর্তুগাল এবং নেদারল্যান্ডস উল্লেখযোগ্য— ভাইরাস সংক্রমণ যখন শীর্ষ পর্যায়ে ছিল তখনও সমস্ত স্কুল, বিশেষত প্রাইমারি স্কুলগুলি, সম্পূর্ণ খোলা রেখেছিল, বা হয়ত খুবই অল্প কয়েকদিনের জন্য বন্ধ রেখেছিল।

অতিমারির ফলে ১৭ মাস স্কুল বন্ধ থাকা শিশুদের যে অপূরণীয় ক্ষতি করে দিয়েছে তার ভুরিভুরি নিদর্শন আমাদের চারপাশে বিদ্যমান। ইউনেস্কোর একটা হিসেব বলছে, প্রতি এক মাস স্কুল বন্ধ থাকলে দু মাসের শিক্ষার ক্ষতি হয়।[1] সেই অনুযায়ী এই শেষ ১৭ মাস স্কুল বন্ধ থাকার দরুণ শিশুরা প্রায় ৩৪ মাস পিছিয়ে গেল। এই পিছিয়ে যাওয়ার মূল্য? এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক একটি বিশ্লেষণে দেখিয়েছে যে পড়াশোনায় এক বছর বিরতির অর্থ ভবিষ্যৎ উপার্জন ৯.৭ শতাংশ কমে যাওয়া।

স্কুল বন্ধের অভিঘাত নিয়ে অনেকগুলি গবেষণা হয়েছে। ম্যাকিনসের একটি সমীক্ষায় সিদ্ধান্ত করা হয়েছে যে ২০২০-র দ্বিতীয় কোয়ার্টারে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে যেসব ছাত্রছাত্রী ব্যক্তিগতভাবে টিউশন নিতে পেরেছে তাদের তুলনায় যারা পারেনি তারা অন্তত ছয় মাস পিছিয়ে পড়েছে। অন্যান্য বিষয়ের চেয়ে অঙ্কের ক্ষেত্রে ক্ষতিটা বেশি হয়েছে। নেদারল্যান্ডসের একটি সমীক্ষা থেকে বেরিয়ে এসেছে বাড়ি থেকে পড়াশোনা চলাকালে ৮ থেকে ১১ বছরের শিশুরা প্রায় কিছুই এগোয়নি, বা খুবই যৎসামান্য অগ্রগতি হয়েছে। আর্থসামাজিক দিক থেকে এই বিপুল ক্ষতি যথারীতি বেশি অনুভূত হয়েছে পশ্চাদপদ শ্রেণিগুলির মধ্যে।

শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যও যে সঙ্কটে পড়ছে তারও প্রচুর প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। অতিমারির সময়ে বাড়িতে বন্ধ থাকা-কালে শিশুরা পারিবারিক নানা চাপ, এমনকি অত্যাচারেরও সম্মুখীন হয়েছে। আমেরিকা এবং ব্রিটেন দু দেশেই শিশু-কিশোরদের আত্মহত্যা বেড়ে গেছে এবং তাদের মধ্যে অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট ওষুধের ব্যবহারও বৃদ্ধি পেয়েছে বলে একটি স্টাডি জানাচ্ছে। ২০২০-র মে মাসে ইউনিসেফ ইন্ডিয়ার একটি রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে প্রাইমারি স্কুলের এক-তৃতীয়াংশ এবং সেকেন্ডারি স্কুলের অর্ধেক অভিভাবক জানাচ্ছেন যে তাঁদের সন্তানরা মানসিকভাবে ভালো নেই। চাইল্ডলাইন হেল্পলাইন নাম্বারে কল আসা ৫০ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে, যার অধিকাংশই বাল্যবিবাহ সংক্রান্ত অভিযোগ বা তা প্রতিহত করার আবেদন।

কোভিড-১৯ আক্রমণ থেকে শিশুরা প্রাকৃতিকভাবেই সুরক্ষিত

সার্স কোভ-২ ভাইরাস বা করোনাভাইরাস নাক বা মুখ দিয়ে মানবশরীরে প্রবেশ করে এবং তারপর ফুসফুসে গিয়ে সাধারণ থেকে গুরুতর স্তরের অসুস্থতা ঘটায়। শিশুরাও এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে, অর্থাৎ ভাইরাস তাদের নাকে-মুখে পৌঁছতে পারে। কিন্তু শিশুদের ফুসফুসে অ্যাঞ্জিওটেনসিন কনভার্শন এনজাইম-২ বা এসিই-২ রিসেপটর যথেষ্ট পরিমাণে থাকে না, যেটি কিনা ভাইরাসকে ফুসফুসে প্রবেশ করতে এবং বাসা বাধতে সাহায্য করে।[2] এই কারণেই, আক্রান্ত হলেও শিশুদের শরীরে সংক্রমণ ঘটার সম্ভাবনা প্রায় থাকেই না। শিশু যদি সুস্থ-সবল হয়, তাহলে বয়সের তারতম্য অনুযায়ী তাদের সংক্রামিত হওয়ার সম্ভাবনা একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের তুলনায় ১০০ থেকে ৮০০০ ভাগ কম।

ব্রিটেনের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা আমেরিকা এবং ইওরোপের ১৩৭ মিলিয়ন স্কুলের শিশুদের তথ্য সংগ্রহ করে একটি সমীক্ষা করেছেন। তাঁদের সিদ্ধান্ত, স্কুলে পড়া শিশুদের কোভিড-সংক্রামিত হওয়ার ঝুঁকি মরশুমি ফ্লু-এর অর্ধেকেরও কম এবং অনভিপ্রেত আঘাত-জনিত মৃত্যুর ঝুঁকির ২০ ভাগের ১ ভাগ। সুইডেন এই গোটা অতিমারি পর্বে এখনও পর্যন্ত স্কুল বন্ধ রাখেনি এবং সে-দেশ থেকে এখনও পর্যন্ত কোভিড ১৯-এ একটিও শিশুমৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি।

এটি এবং আরও তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই এবছর জুলাই মাসে একটি যৌথ বিবৃতিতে ইউনিসেফ এবং ইউনেস্কো বলে যে, স্কুল হচ্ছে সেই জায়গা যেখানে কোভিড সংক্রান্ত বিধিনিষেধ আরোপিত হওয়া উচিত সবার শেষে, এবং বিধিনিষেধ শিথিল পর্বে সেগুলিকেই খোলা উচিত সবার আগে।[3]

এর পরে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ-এর চতুর্থ জাতীয় সেরোসার্ভে-র রিপোর্ট থেকে আমরা জানতে পারলাম, ৬৭.৬ শতাংশ ভারতীয় জনগণের শরীরে করোনাভাইরাসরোধী অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে গেছে এবং শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার হার বড়দেরই মতো।[4] নানা রাজ্যভিত্তিক এবং স্থানীয় সমীক্ষা থেকেও এর সমর্থন পাওয়া গেছে।

বাস্তবত, শিশুরা শহরের অ্যাপার্টমেন্টগুলিতে, কলোনিতে, বস্তি এলাকার অলিগলিতে বা গ্রামে একসঙ্গে অনেকে খেলাধূলা করছে। স্কুল বন্ধ থাকায় অনেকেই ব্যক্তিগত টিউশন ক্লাসগুলিতে যাচ্ছে, যেগুলিতে অনেক সময়েই বেশ ভিড়ও হচ্ছে। একমাত্র স্কুলটাই বন্ধ!

দীর্ঘকাল স্কুল বন্ধ থাকার অভিঘাত

স্কুলের শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার বিকল্প হিসেবে অনলাইন শিক্ষা খুবই দুর্বল। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের এমন প্রচুর উদাহরণ রয়েছে যা থেকে দেখা যায় দূরবর্তী শিক্ষাপদ্ধতি শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় ঋণাত্মক অভিঘাত ফেলে। আমেরিকার অতিমারি-পূর্ব কালের একটি স্টাডি থেকে দেখা যাচ্ছে কোনও সাধারণ মানের পরীক্ষায় স্কুলে যাওয়া ছাত্রছাত্রীদের তুলনায় অনলাইন পাঠ নেওয়া ছাত্রছাত্রীরা বেশ অনেকটাই পিছিয়ে থাকে। স্কুলে না গেলে শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক শিক্ষাও হয় না। শারীরিক এবং মানসিকভাবে ভালো থাকার জন্য আচরণগত এবং সামাজিক শিক্ষাও শিক্ষার্থীরা স্কুল থেকে পায়। তারা স্কুলে পরস্পরের সঙ্গে দেখা করে, কথাবার্তা বলে, সামাজিক পরিবেশে সড়গড় হয়। সম্প্রতি ভারতের পাঁচটি রাজ্যের ৬ থেকে ১১ বছর বয়সি ১৬,০০০ শিশুদের নিয়ে আজিম প্রেমজি ফাউন্ডেশন একটি গবেষণা করেছে।[5] তাতে দেখা যাচ্ছে, ৯২ শতাংশ শিশু একটি ভাষার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে এবং ৮২ শতাংশ শিশু অঙ্কের বেশ কিছু প্রণালী ভুলে গেছে।

অতিমারির আগেও ভারতীয় স্কুলগুলির (সরকারি-বেসরকারি উভয়ত) পড়াশোনার গুণমান খুব উচ্চস্তরের বলে বিবেচিত হত না। আর এখন এই অতিমারির ধাক্কায় বিভিন্ন আর্থসামাজিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষার ফারাকটা আরও অনেক বেড়ে গেল। স্কুল বন্ধ থাকার একটা স্বাস্থ্যগত ক্ষতির দিকও রয়েছে। আমাদের দেশের প্রায় ১২ কোটি দরিদ্র পরিবারের শিশু স্কুলে রান্না করা মিড ডে মিল খেয়ে থাকে। ফলত, স্কুল বন্ধ থাকার জন্য তাদের শিক্ষাগত এবং পুষ্টিগত উভয় ক্ষেত্রেই বড়সড় ক্ষতি হচ্ছে।

তার ওপর শিশুশ্রম এবং বাল্যবিবাহের মতো সামাজিক অভিশাপগুলিও যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। এরকম আশঙ্কা পুরোদস্তুর রয়েছে যে প্রচুর গরিব পরিবারের ছেলেমেয়ে আর স্কুলে ফিরবেই না কখনও। একটা নিঃশব্দ সঙ্কট ধীরে ধীরে ভয়াবহ হয়ে উঠছে। জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া অতি-আবশ্যক।

ভারতে স্কুল খোলা সম্পর্কে অযৌক্তিক আশঙ্কা

ভারতের সরকারগুলি স্কুল খোলা নিয়ে হয় অনিচ্ছুক, নয় খুবই ধীরে চলার পক্ষপাতী। এই মনোভাবের জন্য দ্বিতীয় তরঙ্গের ভয়ঙ্কর অভিঘাত এবং সেই সূত্রেই তৃতীয় তরঙ্গের ভবিষ্যদ্বাণীগুলির একটা দায় অবশ্যই রয়েছে। যা মনে হচ্ছে, তৃতীয় তরঙ্গের অভিঘাত শিশুদের ওপর বেশি হবে— এই ফালতু এবং বর্তমানে বাতিল প্রচারটি আমাদের সরকারগুলিকেও বেশ ঘাবড়ে দিতে সক্ষম হয়েছে।[6] সংবাদপত্রগুলিও শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা নিয়ে এমন কিছু বিভ্রান্তিমূলক হেডলাইন করেছে যাতে জনমনে আরও আতঙ্ক ছড়িয়েছে। শিশুরা যে কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে এবং তাদের ভাইরাস পরীক্ষার ফলাফল পজিটিভ আসতে পারে তা কেউ অস্বীকার করছে না। কিন্তু প্রশ্নটা হল তাদের ক্ষেত্রে এই সংক্রমণ ভয়ানক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা কতটা। সেই সংখ্যাটা কিন্তু, সৌভাগ্যক্রমে, খুবই কম। এই বৈজ্ঞানিক উপলব্ধি আমাদের তৈরি হয়ে যাওয়া উচিত। যে সব শিশুরা আগে থেকেই কোনও দুরারোগ্য ব্যাধির শিকার এবং তার জন্য যাদের নিয়মিত চিকিৎসা নিতেই হয়, তাদের ক্ষেত্রেই আশঙ্কা কিছুটা বেশি থাকে। আমাদের অবশ্যই তাদের জন্য বিশেষভাবে যত্ন নিতে হবে। সুস্থ, স্বাভাবিক শিশুর ঝুঁকি প্রায় নেই-ই।

স্কুল খোলা নিয়ে আরও নানা অযৌক্তিক ভয় ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ বলছে সমস্ত শিশুদের আগে টিকা দিতে হবে, তো কেউ ভয় পাচ্ছে বাচ্চারা বাড়িতে ভাইরাস নিয়ে আসবে! এগুলোর কোনওটারই কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই। শিশুদের টিকাকরণ কখনওই স্কুল খোলার পূর্বশর্ত নয়।[7] ১৭৫টিরও বেশি দেশে স্কুল খুলে গেছে, এবং তারা কেউই ১২ বছরের কমবয়সিদের টিকাকরণ এখনও চালু করেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইটালি এবং অন্যান্য ইওরোপীয় দেশগুলির বিভিন্ন স্টাডি থেকে দেখা যাচ্ছে শিশুদের সংক্রামিত হওয়ার সম্ভাবনা স্কুলে যতটা, বাড়িতেও ততটা, এবং বাড়ি ছাড়া অন্য জায়গার তুলনায় অনেক কম।[8] শিশুদের বাড়িতে ভাইরাস বয়ে আনার ঝুঁকিও বেশ কম, এবং পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের টিকাকরণের মাধ্যমে সেটাকে আরও কমিয়ে দেওয়া যায়।

স্কুল খোলা একমাত্র যুক্তিনিষ্ঠ পদক্ষেপ এবং সময়ের দাবি

এই চলতি স্কুল বন্ধের সময়কাল তর্কাতীতভাবে ভারতের শিক্ষাক্ষেত্রে সবচেয়ে ভয়ানক এবং সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি বিপর্যয়। ভারতের দু-তৃতীয়াংশেরও বেশি পরিবার স্মার্টফোন, কম্পিউটার বা ইন্টারনেট পরিষেবা ব্যবহার করতে পারে না। তাদের কাছে অনলাইন ক্লাস এক সুদূর মরীচিকা ছাড়া কিছু নয়।

ভারত হচ্ছে সেই হাতে গোনা কয়েকটি দেশের অন্যতম যেখানে বাদবাকি সব খুলে গেলেও স্কুল বন্ধ করে রাখা হয়েছে। কিছু রাজ্য স্কুল খোলার ব্যাপারে ভাবনাচিন্তা শুরু করলেও তার গতি অত্যন্ত মন্থর। আমরা প্রয়োজনীয় সুরক্ষাবিধি মেনে আমাদের স্বাভাবিক জীবন শুরু করেছি। সেখানে শিশুদের ঝুঁকি যে সবচেয়ে কম সেটা যখন প্রমাণিত, ফলে অবিলম্বে স্কুল কেন খোলা হবে না? অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে, সেকেন্ডারি স্কুলগুলিরও আগে খোলা উচিত প্রাইমারি স্কুলগুলিকে। ভারতের কিছু শহরে সমীক্ষা করে দেখা গেছে, বিভিন্ন শহরের ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ অভিভাবক তাঁদের বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে চাইছেন।[9] যাঁরা অনলাইন শিক্ষণের সমস্ত উপকরণগুলি ব্যবহার করতে সক্ষম, তাঁরা অনলাইন শিক্ষা চালিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু আলোচনাটা তো ব্যক্তিগত নয়— সামাজিক। আমাদের প্রত্যেককে মাথায় রাখতে হবে প্রায় ৭০ শতাংশ ভারতীয় শিশু, যারা গ্রামীণ এবং শহরের বস্তি এলাকার পিছিয়ে থাকা শ্রেণিগুলির ঘরের সন্তান, তারা শিক্ষা এবং পুষ্টি দুই দিক দিয়েই এক অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হচ্ছে এই দীর্ঘমেয়াদে স্কুল বন্ধ থাকার কারণে।

কোভিড-১৯ অতিমারি একটা বাস্তবতা। এর সম্পর্কে অনেক কিছুই আমরা জানি না— যেমন জানি না এটা কতদিন পর্যন্ত থাকবে। যা বোঝা যাচ্ছে, এই সার্স-কোভ-২ ভাইরাসটি চট করে আমাদের ছেড়ে যাবে না। ফলে আমরা এমন কোনও সমাধানের অপেক্ষায় হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না যে সমাধান এখনও ভবিষ্যতের গর্ভে। ঠিক তেমনই, আমরা এই সমস্যাটাকে পাশ কাটিয়েও যেতে পারি না। এই অতিমারিতে যদি কেউ বাড়িতে বসে থাকে তারও সংক্রমণের কিছু ঝুঁকি থেকে যায়। আর অন্যদিকে, শিশুদের স্কুলে ফেরানোর উপযোগিতাটা অনেক অনেক বেশি। ফলে স্কুলগুলি কীভাবে নিরাপদে খোলা যায়, এখন আলোচনাটা সেই দিকেই কেন্দ্রীভূত হওয়া জরুরি।

২.

স্কুল খোলার বিষয়ে সরকারের দায়িত্ব বিশাল। তাকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হবে, টাস্ক ফোর্স বানাতে হবে, একটা বিস্তৃত মানোপযোগী কার্যপদ্ধতি প্রণয়ন করতে হবে, জড়িত সমস্ত পক্ষকে এক ছাতার তলায় আনতে হবে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, এবং সমস্ত ধরনের ভুল ধারণা প্রতিহত করতে হবে। সামনে মাসগুলির পরিকল্পনা করতে এখন থেকেই উদ্যোগ নিতে হবে।

স্কুল খোলা নিয়ে সব আশঙ্কাই কিন্তু ভুল ধারণা প্রসূত। অনেক অভিভাবক আবার এরকম ভাবছেন যে, স্কুল খুললে তাঁদের ছেলেমেয়েকে বাধ্যতামূলকভাবে স্কুলে পাঠাতেই হবে। অতএব, স্কুল খোলা এবং স্কুলে শিক্ষার্থীদের সুরক্ষিতভাবে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া শুরু করতে এবং সুষ্ঠুভাবে প্রক্রিয়াটি অব্যাহত রাখতে যে সরকার, স্কুল-কর্তৃপক্ষ এবং অভিভাবকদের মধ্যে একটা নিরন্তর সংলাপ চালানো প্রয়োজন, তা স্পষ্ট। এই সংলাপের মূল উদ্দেশ্য সামনে এগোনোর পথে বাধাস্বরূপ ভ্রান্ত ধারণাগুলি দূর করা। অবশ্যই সরকারকেই এই পুরো প্রক্রিয়াটিতে নেতৃত্ব দিতে হবে।

অগ্রাধিকার দিতে হবে এমন কিছু বিষয়ের উল্লেখ করা যাক।

স্কুল খোলার টাস্ক ফোর্স নির্মাণ

প্রতিটি রাজ্য সরকারকে, এবং রাজ্যগুলির প্রতিটি জেলাকে স্কুল-রিওপেনিং টাস্ক ফোর্স তৈরি করতে হবে।[10] তার সদস্য হবেন শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য দপ্তরের বরিষ্ঠ সরকারি আধিকারিকরা, স্কুলশিক্ষার প্রতিটি বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা; জনস্বাস্থ্য, মহামারিবিদ্যা, গবেষক এবং শিক্ষাবিদদের প্রতিনিধিরা; স্কুল-প্রিন্সিপালরা; অভিভাবকরা এবং তাঁদের অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিরা।

এই টাস্ক ফোর্সগুলি অভিভাবকদের উদ্বেগ প্রশমন করবে, গণ-চর্চায় যাতে বিজ্ঞান প্রাধান্য পায় তা নিশ্চিত করবে, বাস্তব তথ্যপ্রমাণের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহ দেবে। এই স্কুল খোলার বিষয়ে গোটা বিশ্ব থেকে প্রতিদিনই বিভিন্ন অভিজ্ঞতা এবং তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তাই এই বিষয়ে সিদ্ধান্তগুলি যেন শুধুই সাধারণ জ্ঞান এবং মতামত-নির্ভর না হয়ে এই তথ্যগুলিকেও বিবেচনায় আনে তা নিশ্চিত করা খুব জরুরি। টাস্ক ফোর্সগুলি স্কুল খোলার ব্যাপারে সবরকম ঝুঁকি যথাসম্ভব কমিয়ে আনবে এবং সংশ্লিষ্ট সমস্ত পক্ষকে ভরসা জোগাবে।

স্কুল-খোলা: গাইডলাইন, বিকেন্দ্রীভূত সিদ্ধান্ত গ্রহণ

এই চলতি অতিমারিতে কিছুই ঝুঁকিমুক্ত নয়— বাড়িতে বসে থাকাও নয়। বেশিরভাগ বাচ্চাই বাড়িতে এখনও মূলত বাড়িতে থাকলেও বিভিন্ন সেরো-সার্ভেগুলিতে দেখা গেছে ৬০ থেকে ৭৫ শতাংশ শিশুর বিভিন্নভাবে ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।[11] সেই কারণেই স্কুল খোলার জন্য সামনের মাস এবং বছরগুলি কীভাবে চলবে সে বিষয়ে একটি পরিষ্কার রোডম্যাপ থাকা প্রয়োজন। কেন্দ্র সরকার একটি বিস্তৃত ডকুমেন্ট আগেই প্রকাশ করেছে। এখন রাজ্য সরকারগুলিকেও বিস্তৃত গাইডলাইন এবং স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং সিস্টেম (এসওপি) তৈরি করতে হবে। এই এসওপিগুলিকে অনেকগুলি জিনিস তদারক করতে হবে। যেমন, নিরাপদে খোলার জন্য স্কুলগুলির কী কী সংস্কার প্রয়োজন; ভেন্টিলেশন, শারীরিক দূরত্ববিধি, ছাত্রছাত্রী এবং স্কুলকর্মীদের প্রবেশ ও নির্গম পথ কেমন হবে; ইত্যাদি। স্কুলকর্মীদের টিকাকরণ করাতে হবে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে। স্কুল এবং ক্লাস চালানোর জন্য নানা ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। মিশ্র পদ্ধতি (সামনাসামনি এবং ভার্চুয়াল ক্লাসের সমন্বয়) এবং স্তব্ধ ক্লাস জাতীয় পদ্ধতিগুলিকেও বিবেচনা করতে হবে।

সামগ্রিক গাইডলাইন সরকারগুলি স্থির করে দিলেও পরিচালনার বিষয়টি জেলা বা উপ-জেলা স্তরে বিকেন্দ্রীভূত করে দেওয়া উচিত। স্কুল খোলা এবং বন্ধ রাখার বিষয়ে জেলার টাস্ক ফোর্সগুলি স্থানীয় অতিমারি-সূচক, যেমন ভাইরাস-টেস্ট পজিটিভ আসার হার ইত্যাদি, বিচার করে নমনীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিক। ক্লাস কতটা নিয়মিত হবে, অর্থাৎ সপ্তাহে একদিন, দুদিন না তিনদিন, সেই সিদ্ধান্ত নিতে দেওয়া হোক স্কুলকে। গ্রামে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব থাকুক গ্রামসভার ওপরে; শহরে স্কুলগুলি স্থানীয় কাউন্সিলর এবং অভিভাবক অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিক। ক্লাসগুলিকে এমনভাবেই রূপ দিতে হবে যাতে যখন দরকার তখনই সুরক্ষাব্যবস্থা বাড়ানো যায় (এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনায় পরে আসছি)।

স্কুল পুনরায় খোলা: প্রথমে প্রাইমারি, আপার-প্রাইমারি

অনেক রাজ্যই নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত একটু বড় বাচ্চাদের জন্য স্কুল খুলতে চাইছে। এই ক্লাসগুলির জন্য ১ সেপ্টেম্বর থেকে তামিলনাড়ুর স্কুল খুলছে;[12] ৯ আগস্ট থেকে দিল্লির স্কুলগুলি শুধু দশম এবং দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি, প্র্যাক্টিক্যাল কাজ এবং কিছু সমস্যা থাকলে সেগুলি আলোচনার (ডাউট ক্লিয়ারিং) জন্য খোলা হয়েছে;[13] উত্তরপ্রদেশেও ১৬ আগস্ট থেকে শুধু উঁচু ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের জন্যই স্কুল খোলা হয়েছে।[14] কিন্তু অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত প্রাইমারি এবং আপার-প্রাইমারি স্কুলগুলিকে।[15]

৬ থেকে ১১ বছর বয়ঃসীমার প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চাদের গুরুতর কোভিড সংক্রমণের সম্ভাবনা সবচেয়ে কম। তাদের শিক্ষার ক্ষতিটাও হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। একটু উঁচু ক্লাসের ছেলেমেয়েরা অনলাইন ক্লাস গ্রহণ করতে বেশি সক্ষম। তাদের জন্য তুলনামূলক বেশি স্ক্রিন-টাইমও মেনে নেওয়া হয়। তারা নিজে নিজে পড়তেও শিখে গেছে। কিন্তু ছোট বাচ্চাদের জন্য শিক্ষক-শিক্ষিকার সঙ্গে প্রত্যক্ষ নিবিড় সংযোগের কোনও বিকল্প নেই।

এরকম মনে হচ্ছে যে, প্রাইভেট স্কুলের শিশুদের উচ্চবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত অভিভাবকেরা বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানোর ব্যাপারে তুলনামূলক বেশি শঙ্কিত। সাম্প্রতিক একটি খবর থেকে জানা যাচ্ছে দিল্লির সরকারি স্কুলগুলির শিক্ষক-অভিভাবক মিটিঙে ৯০ শতাংশ অভিভাবকই তাঁদের বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে চাইছেন।[16] স্পষ্টতই এই ধরনের আলোচনা যাতে অনিচ্ছুক অভিভাবকেরা— যাঁরা সংখ্যালঘুও বটে— অন্যায়ভাবে প্রভাবিত করতে না পারেন তা নিশ্চিত করতে হবে। বিকেন্দ্রীভূত সাব-গ্রুপগুলির মধ্যেও সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিতে হবে সরকারি স্কুল খোলার বিষয়টিকে। কারণ, দরিদ্র পরিবারগুলির বিপুল সংখ্যক ছেলেমেয়ে এই স্কুলগুলিতেই পড়াশোনা করে। যেসব স্কুলে রান্না করা মিড ডে মিল দেওয়া হয়, সবার আগে খোলার জন্যে তাদের বেছে নিতে হবে।

যেসব বাচ্চাদের স্কুলিং শুরু হবে, বা কোনও নতুন স্কুলে ভর্তি হবে— যেমন কোনও বাচ্চা হয়তো প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হবে, বা কোনও শিক্ষার্থী অষ্টম শ্রেণি উত্তীর্ণ হয়ে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হতে চাইছে— তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। পাঞ্জাব হল প্রথম রাজ্য যারা সব ক্লাসের জন্যই স্কুল খুলে দিয়েছে গত ২ আগস্ট থেকে।[17] মহারাষ্ট্রের কিছু কিছু এলাকায় স্কুল খুললেও সামগ্রিকভাবে কবে স্কুল খুলবে সে নিয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি।[18]

কোভিড-১৯: ভ্রান্ত ধারণার মোকাবিলা এবং ভ্যাক্সিন-দ্বিধা মোকাবিলার কৌশল থেকে শিক্ষা

স্কুল খোলার বিভিন্ন বিষয়গুলি নিয়ে সরকারগুলিকে গণ-সচেতনতা বৃদ্ধিকারক প্রচার সামগ্রী বানাতে হবে এবং সেগুলি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে। অভিভাবক এবং অভিভাবকদের সংগঠনগুলিকে এই আশ্বাস দেওয়া জরুরি যে স্কুল খুলে যাওয়ার পরেও কেউ চাইলে শুধুই অনলাইন ক্লাস করতে পারে, বা অনলাইন-অফলাইন মিশিয়েও ক্লাস করতে পারে। অভিভাবকদের সেটা বেছে নেওয়ার পূর্ণ অধিকার থাকবে।

একইভাবে, স্কুল আবার খুলছে মানেই সব কাজকর্ম চালু হয়ে যাবে এমনটা নয়। এই বিষয়ে চূড়ান্ত নমনীয়তা প্রয়োজন। সম্ভব হলে, শহর হোক বা গ্রামে, এটি পরিকল্পনা করার এবং কার্যকরী করার পুরো দায়িত্ব প্রতিটি স্কুলকে দেওয়া উচিত। সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষক-শিক্ষিকা সহ সমস্ত স্কুল-কর্মীদের টিকাকরণ জরুরি ভিত্তিতে করে ফেলতে হবে।

ভ্যাক্সিন-জনিত দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।[19] ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয় যে, যেকোনও টিকা নিয়ে জনগণ সবসময়ই প্রথমে দ্বিধাগ্রস্ত থাকেন। এর একমাত্র কারণ, প্রাথমিক অবস্থায় তাঁদের কাছে যথেষ্ট তথ্য থাকে না। কিন্তু যখনই তাঁরা তাঁদের প্রশ্নগুলির উত্তর পেয়ে যান, টিকা নিতে তাঁদের আর কোনও জড়তা থাকে না। অভিভাবকদের বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানো নিয়ে যে শঙ্কার কথা আমরা আলোচনা করছি, এই পরিস্থিতিটাও একইরকম। ফলে ভ্যাক্সিন-দ্বিধা কাটানোর জন্য যা যা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছিল, তার সঙ্গে সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলিকে ব্যবহার করে তথ্য দেওয়া, প্রচার করা, প্রভাবশালী মানুষদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা এবং বাড়ানো— এই সমস্ত পথগুলিকেই ব্যবহার করা দরকার। অভিভাবকদের আশঙ্কা আরও ভালো করে বোঝার জন্য পদক্ষেপগুলি যেন বিবেচক হয় সে বিষয়ে নজর রাখা দরকার। গণ-সচেতনতা বৃদ্ধিকারক প্রচারগুলিও ব্যাপক করতে হবে। সেই প্রচারগুলিতে অভিভাবকদের সাধারণ উদ্বেগগুলি নিরসন করতে হবে, গুজবগুলি খণ্ডন করতে হবে, এবং শিশুদের কোভিড-১৯ টিকা সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় জানাতে হবে। যেমন, অনেক অভিভাবকই এরকম শুনেছেন যে, কোভিড-১৯ ঠেকানোর জন্য বাচ্চাদের ফ্লু-এর টিকা দিতে হবে। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে ফ্লু-এর টিকা ফ্লু-এর জন্যই কার্যকরী, কোভিড-১৯ ভাইরাস ঠেকাতে তার কোনও উপযোগিতা আছে কি না, সে ব্যাপারে কোনও তথ্য নেই।

শিক্ষায় এতদিনের ক্ষতির ঘাটতি-পূরণ: প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ কাজের

অতিমারির এই সময়কালে শিক্ষার বিপুল ক্ষতি হয়েছে। সমস্ত দেশকেই এই ক্ষতি পূরণ করতে হবে। বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে এনজিও এবং স্বেচ্ছাসেবকদের যুক্ত করা জরুরি।

এ বিষয়ে নানা সৃজনশীল পন্থা ভাবতে হবে। কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাসের জন্য ছোট ছোট ব্রিজ কোর্স বা কনডেন্সড প্রোগ্রাম একটা বিকল্প হতে পারে। অন্যান্য সব দেশ থেকেও এ ব্যাপারে অনেক কিছু শেখা যায়। ব্রিটেন এবং ঘানা ন্যাশনাল টিউটরিং প্রোগ্রাম ঘোষণা করেছে। আমেরিকাও বিভিন্ন ধরনের প্রোগ্রাম নিয়ে চর্চা করছে। ইটালিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ওয়ান-অন-ওয়ান ক্লাস চালাচ্ছে। কিছু দেশ অন্যরকম দৃষ্টিভঙ্গিতে সমস্যা মোকাবিলার চেষ্টা করছে। যেমন, কেনিয়া সরকার সব ক্লাসের জন্যই শিক্ষাবর্ষটিকে পুনরাবৃত্তি করার কথা ঘোষণা করেছে। ফিলিপাইন্স কর্মসময় বাড়িয়ে অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়ার কথা প্রস্তাব করেছে।

ভারতীয় রাজ্যগুলিকে এইসব অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে হবে, এবং এই প্রক্রিয়াকে যাতে কার্যকরী করা যায় সেইজন্য শিক্ষা নিয়ে কাজ করে এমন এনজিওগুলির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে হবে। রাজ্যগুলিকে পরস্পরের থেকেও শিক্ষা নিতে হবে। যেমন, পাঞ্জাব দেশের প্রথম রাজ্য যারা সব শ্রেণির জন্য স্কুল খুলে দিয়েছে। ওডিশাতেও এই ধরনের কাজ সফল করার জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার নজির আছে।

করোনাভাইরাস, স্কুল, এবং ভবিষ্যৎ

অতিমারি আরও কিছু মাস থাকবে এবং এই ভাইরাস তো বেশ কিছু বছর থাকবে। অতএব এই স্কুল বন্ধের সময়কালের শিক্ষা নিয়েই আমাদের আগামী মাসগুলির প্রস্তুতি নিতে হবে।

এক, স্কুল-পরিষেবাকে জরুরি পরিষেবার মর্যাদা দিতে হবে এবং স্কুল-কর্মীদের জরুরি পরিষেবাদাতা কর্মী হিসেবে গণ্য করতে হবে। অতঃপর, স্কুলকর্মীদের টিকা দেওয়ার কাজকে প্রাধান্য দিতে হবে। স্কুল খোলা এবং বন্ধের বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে জরুরি পরিষেবা হিসেবে— যেমন, তখনই স্কুল বন্ধের কথা ভাবতে হবে যখন সেই এলাকার সবচেয়ে বড় হাসপাতালটির আউটডোর বন্ধ করতে হচ্ছে। রাজ্য এবং জেলাস্তরের বিপর্যয় মোকাবিলা কর্তৃপক্ষ এই কোভিড-১৯ সংক্রান্ত কন্টেনমেন্ট এবং আনলক নিয়ে যে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, স্কুলের পুনরায় খোলা এবং বন্ধের বিষয়টি যেন সেই আলোচনার অংশ হয়।

দুই, ভারতের সমস্ত স্কুলে ইন্টারনেট এবং ব্রডব্যান্ড পরিষেবা উন্নত করতে হবে। সমীক্ষা বলছে, দেশের এক-চতুর্থাংশ স্কুলেও বাচ্চাদের জন্য ইন্টারনেট পরিষেবা নেই। সমস্ত রাজ্য সরকারগুলির ইন্টারনেট পরিষেবার পরিধি বাড়ানোর এবং অনলাইন শিক্ষণের দক্ষতা বাড়ানোর সময় এসে গেছে।

তিন, শিক্ষকদের সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। আমাদের দেশে অনলাইন শিক্ষার মান খুবই খারাপ। এর কারণ, সমীক্ষাতে দেখা যাচ্ছে, শিক্ষকদের অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করার দক্ষতা খুব মানোপযোগী নয়। যেহেতু আমাদের ধরে নিতে হচ্ছে যে, এই ভার্চুয়াল শিক্ষণ পদ্ধতি বেশ দীর্ঘমেয়াদে চলবে, তাই শিক্ষকদের অনলাইন এবং মিশ্র পদ্ধতিতে শিক্ষকতা করার ক্ষমতা বাড়াতে হবে।

চার, স্কুলের গতিপ্রকৃতির বিষয়ে একটা ড্যাশবোর্ড তৈরি করা হোক। প্রতিটি রাজ্য এবং জেলাস্তরের প্রশাসন এবং প্রধান সংবাদপত্রগুলি এই ড্যাশবোর্ড তৈরি করুক। স্কুলশিক্ষা কতটা স্বাভাবিকতায় ফিরল, সেটাই নথিবদ্ধ করা হবে এই ড্যাশবোর্ডগুলিতে। কত শতাংশ স্কুল খোলা থাকছে, কত শতাংশ শিক্ষার্থী স্কুলের ক্লাসে আসছে এবং কত শতাংশ আসছে না— এই সবেরই রেকর্ড রাখতে হবে। এই তথ্যগুলি ব্যবহার করেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রী এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষামন্ত্রী স্তর থেকে সমস্ত স্তরের টাস্ক ফোর্সগুলি এই ড্যাশবোর্ডগুলি তদারক করবে।

পাঁচ, স্কুলগুলিকে স্বাভাবিকতায় ফিরিয়ে আনা, তাদের নিউ-নর্মাল পরিস্থিতি আয়ত্ত করা, অফলাইন-অনলাইন মিশ্রিত ক্লাস নেওয়ার উপযোগী পরিকাঠামো গড়ে তোলা, স্কুলে ভেন্টিলেশনের জন্য প্রয়োজনীয় রদবদল করা, শিক্ষার্থীদের যে ঘাটতি পড়ে গেছে সেগুলি পূরণ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া— ইত্যাদির জন্য সরকারকে একটি শিক্ষা তহবিল জাতীয় আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করতে হবে। বিশেষভাবে স্কুলের স্বাস্থ্য পরিষেবা কার্যকরী এবং শক্তিশালী করতে হবে। এগুলির হাল কিন্তু খুবই দুর্বল। চলতি বছরের জুলাই মাসে সরকার যে ২৩.০০০ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছে,[20] এই প্যাকেজটিও তার অনুসারী হবে।

সিদ্ধান্ত

যেদিন থেকে স্কুল বন্ধ হয়েছে সেদিন থেকেই স্কুল খোলা নিয়ে আলোচনা এবং পরিকল্পনাগুলি করা উচিত ছিল। আমরা সেই আলোচনা শুরুই করলাম ১৭ মাস দেরি করে। ফলে এটা পরিষ্কার— ইতিমধ্যেই যথেষ্ট সময় নষ্ট হয়েছে, আরও সময় নষ্ট করার বিলাসিতা আমরা দেখাতে পারি না। স্কুল খোলার চর্চাটা হতে হবে কোভিড-১৯ টিকাকরণের মতো করে— এতটাই নিয়মিতভাবে। কিছু স্কুল বন্ধের ঘটনা এড়ানো না গেলেও মনে রাখতে হবে, শিশুরা যতদিন স্কুলের বাইরে থাকবে, তত তারা যেসব জিনিসগুলি অনুশীলন করছে না সেগুলি ভুলতে থাকবে। সরকারকে অবশ্যই এই দায়িত্ব নিতে হবে এবং নিরাপদে ও জরুরি ভিত্তিতে স্কুল খোলার ব্যবস্থা করতে হবে।

৩.

শিক্ষার উপযোগিতা ব্যক্তিগত এবং সামাজিক— দুই ক্ষেত্রেই। ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে এর উপযোগিতা ভবিষ্যতে ভালো চাকরি, ভালো বেতন এবং ভালো জীবনযাপন নিশ্চিত করাতে। সামাজিক ক্ষেত্রে এর উপযোগিতা সমাজের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে এবং দেশের সমাজ-অর্থনীতির উন্নয়নে। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য মানবসম্পদ তৈরি করে। কোভিড-১৯ অতিমারি এই দুই ক্ষেত্রেই থাবা বসিয়েছে। আমরা স্বাস্থ্য-পরিষেবা শক্তিশালী করার দিকে কিছুটা মনোযোগ দিলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে বড় দীর্ঘসময় ধরে বন্ধ করে রেখেছি।

স্কুল খোলা নিয়ে আলোচনা কিছুদিন শুরু হলেও তার মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব-জড়তা খুবই স্পষ্ট। এখনও পর্যন্ত ভারতের ১৪টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হয় আংশিক স্কুল খুলেছে বা স্কুল খোলার বিষয়ে নিজেদের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে। তার মধ্যে অধিকাংশই কেবল নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির জন্য। আশা করা যাচ্ছে, সামনের কিছু সপ্তাহের মধ্যেই আরও কিছু রাজ্য আরও বেশি শ্রেণির জন্য স্কুল খুলবে। এবং সেটা হওয়ার পরে বাচ্চাদের আবার নিরাপদে স্কুলে নিয়ে আসা হল সবচেয়ে গুরুদায়িত্ব। এটি সুষ্ঠুভাবে হওয়া অবশ্যই সবচেয়ে বেশি স্কুলের দায়িত্ব, এবং তার সঙ্গে জড়িত সমস্ত পক্ষের অংশগ্রহণের ওপরেও নির্ভরশীল।

স্কুলগুলি ছাত্রছাত্রীদের স্বাগত জানাতে কীরকম প্রস্তুতি নিচ্ছে তার ওপরেই সব কিছু নির্ভর করছে। প্রস্তুতি, সংযুক্তি, নতুন চিন্তাভাবনা এবং উন্নতি (Prepare, Engage, Reimagine and Improvise— PERI)— এই সুসংবদ্ধ প্রক্রিয়ায় চিন্তাভাবনা করলে সুবিধা হতে পারে।

স্কুল আবার খোলার প্রস্তুতি

কাজের সাফল্য নির্ভর করছে স্কুল-নেতৃত্বের ওপর। প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য প্রথমেই স্কুলের নেতৃত্বকে সারা বিশ্বের দৃষ্টান্ত (প্রথম পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য) থেকে এটা বিশ্বাস করতে হবে যে স্কুল একটি নিরাপদ জায়গা এবং একসঙ্গে কাজ করলে সামান্যতম যে ঝুঁকি আছে সেটাকেও প্রশমিত করা যায়।

আবার স্কুল খোলাটা বাইনারি হিসেবে (সবকিছুই স্কুলে শুরু হবে বা সবকিছুই বন্ধ থাকবে) বা একমুখী প্রক্রিয়া হিসেবে (একবার খোলা হলে, খোলাই থাকবে) দেখলে হবে না। এখন থেকে অনেকগুলি মাস পর্যন্ত স্থানীয় সংক্রমণের পরিস্থিতি অনুযায়ী এই বিষয়ে চূড়ান্ত নমনীয় এবং গতিশীল থাকতে হবে। প্রথমত, স্কুলগুলিকে খুলতে হবে, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের স্কুলে আসা শুরু করতে হবে, স্কুল থেকেই তাঁদের অনলাইন ক্লাসগুলি চালাতে সড়গড় হতে হবে। এতে সমস্যাগুলিও বোঝা যাবে, এবং সবাই নতুন পদ্ধতিতে অভ্যস্তও হবেন। স্কুলগুলিকে এইজন্য প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এবং ব্যবস্থা করতে হবে। এরপরে বাচ্চারা আসা শুরু করবে।

যে সমস্ত জিনিসগুলি বেশি স্পর্শ করা হয়ে স্কুলগুলিকে সেগুলি স্যানিটাইজ করার ব্যবস্থা করতে হবে, ভেন্টিলেশন বাড়াতে হবে, ক্লাসের আকার কমাতে হবে বা ক্লাসগুলি ভেঙে ভেঙে দিতে হবে। স্কুলবাস জাতীয় পরিবহন মাধ্যমগুলিরও যথাযোগ্য পরিবর্তন করতে হবে। লাঞ্চ এবং অন্যান্য বিরতিগুলিকেও নতুনভাবে সাজাতে হবে।

সারা বিশ্বের বাস্তব নিদর্শনগুলি অভিভাবকদের জানানো এবং শিশুদের নিরাপত্তা সম্পর্কে তাঁদের আশ্বস্ত করা স্কুল কর্তৃপক্ষের (প্রিন্সিপাল এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাদের) দায়িত্ব। স্কুলটিকে নিরাপদ বানাতে শিক্ষকদের বড় ভূমিকা নিতে হবে। ফলে তাঁদের কাছে অবশ্যই সঠিক তথ্যগুলি থাকতে হবে। সেগুলির সাহায্যে তাঁরা নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে পারবেন; সঠিক কোভিড-১৯ আচরণবিধি আয়ত্ত করতে পারবেন; আর যেহেতু তাঁরাই স্কুল এবং অভিভাবকদের মধ্যে যোগাযোগের প্রাথমিক সেতু, ফলে অভিভাবকদের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য তাঁরা যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসীও থাকতে পারবেন। স্কুলে ক্লাস শুরু করার জন্য শিক্ষক-শিক্ষিকা, অভিভাবক এবং ছাত্রদের কাউন্সেলিং করা এবং তাদের কাছে সঠিক তথ্যের জোগান থাকা খুবই প্রয়োজন।

স্কুল নিরাপদে আবার খোলার জন্য সংলাপ শুরু করতে সরকারের (যারা নীতি নির্ধারণ করবে) পরে স্কুলের দায়িত্বই সবচেয়ে বেশি।

স্কুল খোলার পরে মিশ্রিত রূপে ক্লাস নেওয়া একটা নতুন চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে। কিছু ছাত্রছাত্রী থাকবে ক্লাসরুমে আর কিছু অনলাইনে। এই রূপান্তরটা যাতে মসৃণ হয়, তার জন্যও শিক্ষকদের সক্ষম হতে হবে। এর জন্যও প্রস্তুতি প্রয়োজন।

ক্লাসরুমগুলিকে খোলামেলা করার জন্য যা যা পরিবর্তন করা দরকার, প্রতিটি স্কুলকেই তা করতে হবে। ওপরে ছাউনি আছে এমন কোনও খোলা জায়গায় ক্লাস নেওয়ার কথা ভাবা যেতে পারে। কিছুদিন পরপরই স্কুলকর্মী, ছাত্রছাত্রী এবং অভিভাবকদের কোভিডোপযোগী আচরণ সম্পর্কে অবহিত করতে থাকাটা একটা অবশ্যকরণীয় কাজ।

আমেরিকা এবং ইটালির দৃষ্টান্ত থেকে পরিষ্কার— স্কুল সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায় না। স্টাডি থেকে জানা যাচ্ছে শিশু-থেকে-শিশু, শিশু-থেকে-শিক্ষক এবং শিক্ষক-থেকে-শিশু সংক্রমণের ঝুঁকি অন্য সব পরিস্থিতির তুলনায় কম বা সমান। যদিও স্কুলে শিক্ষক-থেকে-শিক্ষক সংক্রমণের ঝুঁকিটা বেশি থাকে।

আগেই বলেছি, দিল্লির ৯০ শতাংশ পিতামাতা তাঁদের সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে চাইছেন।[21] অন্যান্য রাজ্যেও পরিস্থিতিটা একইরকম হওয়ার সম্ভাবনা। এই পরিস্থিতিতে সরকারি স্কুলগুলির নেতৃত্ব দেওয়ার একটা চমৎকার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এই স্কুলগুলিতে মূলত পিছিয়ে-থাকা পরিবারের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে। অনেকেরই বাড়িতে পড়া দেখিয়ে দেওয়ার মতো কেউ নেই। এই স্কুলগুলির অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত, এবং এই স্কুলগুলিরও খুব দ্রুতগতিতে পরিকল্পনা করে ফেলা উচিত।

অভিভাবকদের আশ্বস্ত করার জন্য প্রাইমারি স্কুলগুলিকে বেশি ভালো করে প্রস্তুতি নিতে হবে। এই বয়ঃসীমার বাচ্চাদের ঝুঁকি যে সবচেয়ে কম, এবং তাদের যে শিক্ষার ক্ষতিটা সবচেয়ে বেশি হচ্ছে সেগুলি আগেই আলোচনা হয়েছে। আবারও মনে করিয়ে দিই, শিক্ষকের প্রত্যক্ষ সান্নিধ্য এই বাচ্চাদেরই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে স্কুলগুলির যোগাযোগ শক্তিশালী করতে হবে। সুরক্ষাবিধি পর্যবেক্ষণ এবং স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত আলোচনাগুলিকে রুটিন কার্যক্রমের অংশ করে ফেলতে হবে। স্কুলগুলি একজন ডাক্তার বা স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ নিয়োগ করার কথাও ভাবতে পারে যিনি স্কুল খোলার বিষয়টি তদারক করবেন এবং অভিভাবক ও শিক্ষকদের নানাবিধ প্রশ্নের জবাব দেবেন।

স্কুল ছাত্রছাত্রীদের প্রস্তুত হতে বলে থাকে। এখন সময় এসেছে ছাত্রছাত্রীদের চেয়ে স্কুলেরই বেশি করে প্রস্তুতি নেওয়ার হবে।

সংযোগ (সমস্ত অভিভাবক এবং সংশ্লিষ্ট সমস্ত পক্ষের সঙ্গে)

নিজেদের প্রস্তুত করার সঙ্গে সঙ্গে স্কুলগুলিকে সংশ্লিষ্ট সমস্ত পক্ষের সঙ্গে সংযুক্ত হতে হবে, এবং সেটা প্রতিটি স্কুল-স্তরেই হতে হবে। ছাত্রছাত্রী এবং অভিভাবকরা যেহেতু মূল দুই পক্ষ, অবশ্যই তাদের সঙ্গে সংযুক্ত হতে হবে এবং তাদেরকে পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির কাজে সামিল করতে হবে।

অভিভাবকদের বুঝতে হবে যে একটি স্কুলে অনেক বাচ্চা পড়ে। অতএব যে বাবা-মারা তাঁদের বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে চাইছেন, তাঁদের জন্য স্কুল খুলতেই হবে। অভিভাবকদের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকতে হবে যে তাঁরা তাঁদের বাচ্চাদের জন্য কী ধরনের শিক্ষাপদ্ধতি বেছে নেবেন— কেবলমাত্র অনলাইন পদ্ধতি, না কি অনলাইন-অফলাইন মিশ্র পদ্ধতি। সেই পদ্ধতিগুলিকে চালু করার সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবকদের প্রতিটি দুশ্চিন্তা এবং আতঙ্ক নিরসন করাও স্কুলের অবশ্যকর্তব্য হবে।

সামনের দিনগুলিতে সহযোগী হিসেবে স্কুলের কাজ চালানোর জন্য শিক্ষকদের সঙ্গে অভিভাবকদের সংযোগ দৃঢ় করতে হবে। অভিভাবকরা যখনই সংক্রমণ বাড়ার খবর পাবেন— পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তেই হোক— স্বভাবতই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়বেন। স্কুলকেই এই উদ্বেগগুলির সম্মুখীন হতে হবে। ফলে এই ধরনের যোগাযোগগুলির জন্য নিয়মিত এবং নির্দিষ্ট ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এগুলিতে ভ্রান্ত ধারণা কাটানোর জন্য এবং প্রশ্ন ও উদ্বেগগুলির উত্তর দেওয়ার জন্য যখনই সুযোগ পাওয়া যাবে, বিশেষজ্ঞদের আনতে হবে।

স্কুলগুলিকে অন্যান্য স্কুলেদের সঙ্গে সংযুক্ত হতে হবে এবং একে অপরের থেকে শিখতে হবে। স্কুলেদের পরস্পরের মধ্যে মিটিংগুলিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া যেতে পারে। বিভিন্ন স্কুলের অভিজ্ঞতা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে, এবং এই সমস্ত বাস্তব তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই রাজ্য এবং জেলাস্তরের টাস্ক ফোর্সগুলিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অন্য রাজ্যের অভিজ্ঞতা থেকেও শিক্ষা নিতে হবে। এই ধরনের সংযোগগুলি যথাযথ তৈরি হলেই আলোচনায় স্বচ্ছতা আসবে এবং নিছক মৌখিক আশ্বাস বা চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্যের চেয়ে তা অনেক বেশি কার্যকরী হবে।

স্কুলগুলিকে নাগরিক সমাজ এবং কমিউনিটি মেম্বারদের সঙ্গেও সংযোগ স্থাপন করতে হবে। এঁরাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ— কারণ, এঁরা স্কুলা খোলা সংক্রান্ত আলোচনা প্রভাবিত করতে পারেন।

নতুন চিন্তাভাবনা, উদ্ভাবন

স্কুল চলা এবং শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির জন্য যদি সৃজনশীল চিন্তাভাবনা এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতা প্রয়োগের এখনই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে অতিমারির এই সময়টাকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেওয়া উচিত। ছাত্রছাত্রীদের থেকেই নানা সৃজনশীল চিন্তাভাবনা আহ্বান করা যেতে পারে। ভারত সরকার গত বছর নয়া শিক্ষানীতি ঘোষণা করেছে। স্কুল আবার খোলার বিষয়টি সেদিক থেকেও একটা সুযোগ হতে পারে।

বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে স্কুল কেমনভাবে চলবে সে নিয়ে অনেক আইডিয়া আসছে। খোলার পর আগেকার রুটিনের চেয়ে ক্লাসের সংখ্যা কম হবে— একদিন অন্তর ক্লাস হতে পারে, তিনদিনে একবার হতে পারে, এমনকি সপ্তাহে একদিনও হতে পারে— মাঝে যথযোগ্য বিরতি দিয়ে কয়েক শিফটেও স্কুল চলতে পারে। মূল কথা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের আবার স্কুলে ফেরানো এবং স্কুল ও শিক্ষকশিক্ষিকার সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগের পরিসরটা আবার তৈরি করা। শ্রেণিকক্ষে ক্লাস এবং অনলাইন শিক্ষণের একটা মিশ্র পদ্ধতি চালাতেই হবে যেখানে অভিভাবকদের বেছে নেওয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে। স্কুলে এসে ক্লাস করার বিষয়টিকে বাধ্যতামূলক করা যাবে না।

অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনা করে স্কুল কর্তৃপক্ষকে স্থির করতে হবে একেক দিনে কত শতাংশ ছাত্রছাত্রী স্কুলে উপস্থিত থাকবে। স্কুল জৈব সুরক্ষা বলয়ের মতো একটি পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। যেখানে কোনও নির্দিষ্ট ক্লাসের ছেলেমেয়েরা তার বাইরে আর কারও সংস্পর্শে আসবে না।

স্কুল একবার খোলার পর উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগানোর জন্য অনেক ক্ষেত্র রয়েছে। বাচ্চারা এক দীর্ঘ বিরতির পর স্কুলে ফিরবে। শিক্ষার একটা বিরাট পার্থক্য দেখা দেবে এমনকি একই ক্লাসের বিভিন্ন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে। এই জায়গাতেই প্রচুর উদ্ভাবন ক্ষমতা দেখাতে হবে। এ নিয়ে ব্রিজ কোর্স জাতীয় পদ্ধতি, অন্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে শেখা— এগুলি সবই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। শুধু সিলেবাস শেষ করা সংক্রান্ত নির্দেশ দিলেই হবে না, বরং গণিত এবং ভাষাশিক্ষার দক্ষতা কীভাবে বাড়ানো যায়, এমনকি সামাজিক, আচরণগত এবং যোগাযোগের দক্ষতাও কীভাবে বাড়ানো যায় সেই সব বিষয়ই সৃজনশীলভাবে ভাবতে হবে।

একটা অভিনব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে চলেছে স্কুলগুলি। একই ক্লাসের মধ্যে শেখার মাত্রা অনুযায়ী বিভিন্ন স্তরের ছাত্রছাত্রী থাকবে। সবাইকে পাশ করিয়ে দেওয়া হয়তো হবে, কিন্তু তাতে শিক্ষার দিক থেকে সম মান অর্জন করা যাবে না। ফলে এইরকম শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কাজ করার জন্য শিক্ষকশিক্ষিকাদের বিশেষ ট্রেনিং প্রয়োজন। এই ১৭ মাসের শিক্ষার অভাব পূরণ করার জন্য স্কুলগুলিকে সবার সঙ্গে কাজ করার ভাবতে হবে হবে। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী হতে পারেন, এনজিও স্বেচ্ছাসেবক হতে পারেন, অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক হতে পারেন। অর্থাৎ যাঁরাই এই বিষয়ে শিক্ষকদের চাপ ভাগ করে নিতে আগ্রহী এবং সক্ষম, তাঁদেরকেই সামিল করতে হবে। আমাদের সৃজনশীল হতেই হবে ব্যাপকভাবে।

উন্নতি

একটা কাটছাঁট করা সিলেবাস পড়ানো বা যেগুলি বাদ পড়েছে খুব দ্রুত সেগুলি শেষ করিয়ে দেওয়া— স্কুল খোলার পর এর কোনওটাই সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি হবে না। শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং স্কুল প্রিন্সিপালদের দায়িত্বটা বড় এবং তাঁদের সে দায়িত্ব পালন করতে হবে। যে ছেলেমেয়েদের বিশেষ মনোযোগ দরকার তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সবাইকে যুক্ত করতে হবে।

আগামী প্রায় তিন বছর এই শিক্ষা-ঘাটতি পূরণ করার জন্য সুসংবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। পিছিয়ে থাকা শ্রেণিগুলির বাচ্চাদের প্রতি বিশেষ করে নজর দিতে হবে। স্বেচ্ছাসেবকদের কাজে লাগিয়ে সপ্তাহান্তে সাপোর্ট ক্লাসের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বস্তুত, অনেক বাবা-মা এবং বড় ভাইবোনেরাও এই ধরনের কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবেন। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং পেশাদার কাউন্সেলরদের সঙ্গে নিয়মিত সেশনের কথাও ভাবতে হবে। স্কুল ছাড়াও অন্যান্য সেট-আপগুলির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন এবং তাদের ভালো অনুশীলনগুলি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করাও খুব জরুরি।

শিক্ষার ক্ষতি

অতিমারির কারণে দীর্ঘমেয়াদে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা তর্কসাপেক্ষে শিশুদের শিক্ষাতেই হল। যে কোনও দেশের কাছেই ভবিষ্যতের জন্য এটাই সম্ভবত সবচেয়ে বড় সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি। ফলে একটা সমাজ হিসেবেই স্কুল খোলার জন্য যা যা করা দরকার আমাদের করতে হবে। সবাইকে মিলেই এটা করতে হবে— ছাত্রছাত্রীদের নিরপত্তার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে হবে, অভিভাবকদের আশঙ্কা দূর করতে হবে, এবং স্কুলগুলিকে যাবতীয় সুরক্ষাবিধির প্রতি অনুগত্য দেখাতে হবে।

যে সমস্ত অভিভাবকরা তাঁদের বাচ্চাদের ব্রডব্যান্ড কানেকশন এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিতে পারেছেন তারা অনলাইন শিক্ষার সঙ্গে সড়গড় হতে পারছে। কিন্তু তারা খুবই সংখ্যালঘু। ভারতে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ছাত্রছাত্রীই ওইগুলি ব্যবহার করতে পারে না। ফলে তাদের শিক্ষা ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। মনে রাখতে হবে সমাজের প্রতিটি শিশুর স্কুলে যাওয়া জরুরি, এবং স্কুলগুলিও কেবল একটি বাড়ি মাত্র নয়। ভার্চুয়াল শিক্ষাব্যবস্থা কখনওই তার বিকল্প হতে পারে না। স্কুল একটি সমাজের যৌথ সচেতনতার প্রতীক।

সহজলভ্যতা, সামর্থ্য এবং শিক্ষার গুণমান (এগুলি স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রেও একইরকম প্রযোজ্য) দেখিয়ে দেয় একটি সমাজ তার শিশুদের প্রতি কতটা যত্নশীল। অতএব, যা যা করণীয় আমাদের করতে হবে। এখন আমাদের স্কুলগুলির নেতৃত্ব দেওয়ার সময় এসেছে।

৪.

আমরা সবাই বাচ্চাদের ভালোর কথা ভাবি। এই যে স্কুল বন্ধ রাখা হয়েছে, তা বাচ্চাদের ভালোর কথা ভেবেই। এখন স্কুলগুলিকে যে আবার খুলতেই হবে, সেও ওই একই কারণে— বাচ্চাদের ভালোর কথা ভেবে। অতিমারির শুরুর সময় আর এখন, এই ১৭ মাস পর, মূল তফাত হচ্ছে, আমরা বুঝতে পেরেছি কোভিড-১৯-এর জন্য স্কুল বন্ধ রাখার কোনও কারণ নেই। আগেই বলেছি, বাড়িতে বসে থাকলেও শিশুরা বয়স্কদের মতোই একই হারে ভাইরাস-আক্রান্ত হয়েছে। বিষয়টা আক্রান্ত হওয়ার নয়, সংক্রমণের তীব্রতার। আমরা এটা জেনেছি যে শিশুদের সংক্রমণ তীব্র হওয়ার সম্ভাবনা বয়স্কদের চেয়ে ১০০ কি ১০০০ গুণ কম। কিন্তু স্কুল বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষা এবং পুষ্টির ক্ষেত্রে বিপুল ক্ষতি স্বীকার করতে হচ্ছে তাদের। এই সমস্ত বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণাদির ভিত্তিতেই ইউনিসেফ এবং ইউনেস্কো একযোগে জানিয়েছে অতিমারিজনিত বিধিনিষেধ শিথিল হলে প্রথমেই যেটা খুলতে হবে সেটা হল স্কুল। কিন্তু আমাদের দেশ পুরো উল্টো পথে হাঁটছে। এখানে স্কুল ছাড়া আর প্রায় সবকিছুই খোলা।

মিথ এবং ভ্রান্ত ধারণার প্রাধান্য

কোভিড-ঝুঁকি এবং স্কুল খোলা নিয়ে চর্চার বেশিটাই দাঁড়িয়ে আছে অসম্পূর্ণ তথ্যের ওপর। এই দীর্ঘমেয়াদি স্কুল বন্ধের মূল কারণ অসংখ্য গুজব এবং ভ্রান্ত ধারণা। বহু বাবা-মাই তাঁদের বাচ্চাদের কোভিড সংক্রমণ হবে এই ভয়ে সক্রিয়ভাবে স্কুল খোলার বিরোধিতা করছেন।

প্রথমত, বাবা-মারা ভাবছেন স্কুল খুললে তাঁদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোটা বাধ্যতামূলক হবে। ঘটনা কিন্তু তা নয়। অন্তত বেশ কিছু মাস স্কুলে হাজিরা দেওয়ার কোনও বাধ্যতা থাকবে না। শুধু অনলাইন ক্লাসই করবে, নাকি অনলাইন-অফলাইন মিশ্র পদ্ধতিতে ক্লাস করবে, সেই সিদ্ধান্ত একান্তভাবেই ছাত্রছাত্রীর এবং তাদের অভিভাবকের। যারা স্কুলে গিয়ে ক্লাস করতে ইচ্ছুক, স্কুল শুধু তাদের জন্যই খোলা থাকবে।

দ্বিতীয়ত, অনেক অভিভাবকই ভাবছেন আবার স্কুলে যাওয়ার আগে বাচ্চাদের টিকা দিয়ে নিতে হবে। এটা বিজ্ঞানসম্মত ভাবনা নয়। আগেই বলেছি, ১৭৫টিরও বেশি দেশ স্কুল খুলে দিয়েছে এবং তারা কেউই ১২ বছরের কমবয়সিদের টিকাকরণ করেনি। যেসব কোভিড-১৯-এর টিকা দেওয়া হচ্ছে সেগুলি সাধারণ থেকে বেশি মাত্রার সংক্রমণ রোধ করে, বাচ্চাদের যে ধরনের সংক্রমণের ঝুঁকি এমনিতেই খুব কম। বর্তমান টিকাগুলি যে ভাইরাস আক্রমণ রোধ করে তার এখনও কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ফলে শিশুদের টিকা দিয়ে আলাদা করে খুব বেশি উপকার নেই। বরং ভাইরাস আক্রমণ ঠেকাতে সক্ষম এমন টিকা যদি ভবিষ্যতে আবিষ্কৃত হয়, তখন শিশুদের টিকাকরণ উপকারী হতে পারে। কিন্তু তখনও সেটা হবে একটা সহায়ক বিশেষ, কখনওই স্কুলে যাওয়ার পূর্বশর্ত নয়।

তৃতীয়ত, অনেক বাবা-মার ধারণা স্কুল খুললে সেগুলি ভাইরাসের এক-একটা সুপারস্প্রেডিং স্পট হয়ে উঠবে। এই ধারণারও কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। স্কুল খোলা আছে এবং বন্ধ আছে এরকম দুই জায়গার তুলনামূলক স্টাডি করে দেখা গেছে যেসব বাচ্চারা স্কুল যাচ্ছে তারা মোটেও ভাইরাস ছড়ানোর ঝুঁকি বাড়ায় না। ফলে, স্কুল খুললে অতিমারির আরেকটা তরঙ্গ চলে আসবে এমন ভাবনা পুরোদস্তুর ভ্রান্ত।

চতুর্থত, অনেক অভিভাবক ভাবছেন আগে উঁচু ক্লাসের জন্য স্কুল খোলা উচিত। কিন্তু বৈজ্ঞানিক তথ্য বলছে, বয়স যত কম হবে, ঝুঁকিও তত কম হবে এবং ৬-১২ বছর বয়সি শিশুদের ঝুঁকি সবচেয়ে কম। সেইজন্যই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাইমারি এবং আপার প্রাইমারি আগে খোলা উচিত।

কেন স্কুল খুলতে হবে?

এ বিষয়ে প্রথম পরিচ্ছেদে বিশদে আলোচনা করা হয়েছে। আবারও বলা যাক, স্কুলে শুধু টেক্সট বই পড়তেই শেখে না ছেলেমেয়েরা, সেখানে তারা ভাষা শেখে, সামাজিক আচার-আচরণ শেখে, পরস্পরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে শেখে। এই সব শিক্ষাই তাদের শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিকভাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। অনলাইন শিক্ষা কখনওই সেই সামগ্রিক শিক্ষা দিতে পারে না। ফলে এই স্কুল বন্ধ থাকায় ভবিষ্যতের জন্য যে কত বড় ক্ষতি হচ্ছে আমরা এখন পুরোটা বুঝতেও পারছি না।

শিক্ষার ক্ষতি শিশুর বয়সের সঙ্গে ব্যস্তানুপাতে সম্পর্কিত। বাচ্চা যত ছোট, ক্ষতিটা তত বেশি। যেসব বাচ্চাদের স্কুলিং সবে শুরু হোয়ার কথা তাদের ক্ষেত্রে ক্ষতিটা আরও ভয়াবহ। আবার আর্থসামাজিক স্তরবিন্যাসে নিম্ন এবং মধ্যস্তরের পরিবারের বাচ্চাদের ক্ষতিটা সবচেয়ে বেশি। ফলে জরুরি ভিত্তিতে কেন এখনই স্কুল খোলা দরকার, তার প্রচুর কারণ রয়েছে।

ইউনেস্কোর সতর্কবাণীর কথা আমরা আগে বলেছি। আজকের পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এটা বলা মোটেই অত্যুক্তি হবে না যে, প্রতিটি শিশুই তাদের প্রকৃত ক্ষমতার বেশ কয়েক ধাপ পেছনে পড়ে গেছে। এটা খুবই দুশ্চিন্তার বিষয়। একটি শিশু যখন পিছিয়ে পড়ে তার পক্ষে পড়াশোনা ব্যাপারটাই তখন বেশ কঠিন হয়ে যায়, এবং এর পরিণতিতে তার শিক্ষার হার স্থায়ীভাবেই কমে যায়। প্রাইমারি এবং আপার প্রাইমারি স্কুলগুলিকে আগে খুলতে বলার এটাও একটা বড় কারণ।

খবর ভুল পথে চালিত করতে পারে

টিভি এবং সংবাদপত্রে বাচ্চাদের সংক্রামিত হওয়ার খবরগুলি বাবা-মাকে আরও শঙ্কিত করছে। হ্যাঁ, কিছু বাচ্চার সংক্রমণ হচ্ছে, কারও কারও সে সংক্রমণ মারাত্মক স্তরেও যাচ্ছে— কিন্তু সেই সংখ্যাগুলি খুবই সামান্য। কিন্তু সংবাদপত্রের শিরোনামগুলি এমন হয়, যে তাতে বিভ্রান্তি ছড়ায়, বাবা-মারা আশঙ্কিত হন। সম্প্রতি যেমন একটা খবর বেরিয়েছে যে ইন্দোনেশিয়ায় প্রচুর বাচ্চা কোভিড সংক্রমণে মারা যাচ্ছে। খবরটি মিথ্যে নয়, কিন্তু আবার ঠিকভাবে বলাও নয়। ২০২১-এর জুলাইয়ের শেষ পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়ায় মোট কোভিড-মৃত্যুর সংখ্যা ৮৩,০০০। তার মধ্যে ০-১৮ বছর বয়সি ছেলেমেয়ের সংখ্যা ৮০০। ১ শতাংশেরও কম। আগস্টে নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি নিবন্ধে কোভিড-মৃত্যুর সংখ্যাগুলি বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে ধনী দেশগুলির সমস্ত কোভিড-মৃত্যুর প্রতি ১৫০০ জনে ১ জন হল শিশু; আর গরীব দেশগুলিতে সেই অনুপাত প্রতি ৫০০ বা ১০০০ জনে ১ জন।[22] যেখানে মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ থেকে এল-তৃতীয়াংশ হল শিশু, সেখানে এই মৃত্যুহার খুবই কম বলাই বাহুল্য। নিউ ইয়র্ক টাইমসের উক্ত রিপোর্টটি আরও বলছে আমাদের দেশে প্রায় ৪,৩০,০০০ কোভিড-মৃত্যুর মধ্যে শিশুর সংখ্যা হল ১,৫০০। অর্থাৎ ০.৩৩ শতাংশ। যেখানে আমাদের মোট জনসংখ্যায় শিশুদের অনুপাত ৪০ শতাংশ। এটাও মনে রাখতে হবে, যে সমস্ত শিশুরা কোভিডে প্রাণ হারিয়েছে তাদের অনেকেরই আগে থেকে কোনও বড় অসুস্থতা ছিল।

আবার, জুলাইয়ের শেষের দিকে এবং আগস্টের প্রথম দিকে ভারতের বেশ কিছু রাজ্যে স্কুল খুলতেই রিপোর্ট আসা শুরু হল যে বাচ্চারা কোভিড-আক্রান্ত হচ্ছে। প্রসঙ্গ-বহির্ভূতভাবে দেখলে এটা স্কুল খোলার ফল হিসেবেই মনে হবে— যদিও ঘটনা আদৌ তা নয়। বাচ্চারা আক্রান্ত বরাবরই হচ্ছে। আগে উল্লিখিত চতুর্থ ন্যাশনাল সেরো-সার্ভে যখন হয়েছে, তখন লকডাউন চলছিল এবং বাচ্চারা বাড়িতে ছিল। তখনই ৬০ শতাংশ ভারতীয় শিশুদের মধ্যে কোভিড-১৯ অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছিল। স্কুল খোলায় রাজ্যগুলি বাচ্চাদের পরীক্ষা করতে সক্রিয়তা দেখাচ্ছে, যার ফলে এই আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। ফলে এই খবরের পেছনে আসল কারণ ব্যাপক পরীক্ষা হওয়া— স্কুল খোলা নয়।

একটি প্রেক্ষিত নির্মাণ

সতেরো মাস কেটে গেছে এই অতিমারিতে। আরও কতদিন যে কাটবে, এই ভাইরাস আরও কতদিন আমাদের সঙ্গী হয়ে থাকবে, সেসব কেউই বলতে পারছে না। এটুকু নিশ্চিত— এই সংক্রমণ এবং অসুস্থতা এখনও অনেক বছর আমাদের সঙ্গে থাকবে। ফলে আমাদের একটা পরিষ্কার প্রেক্ষিত এবং ঝুঁকি মূল্যায়নের একটা বোধ তৈরি করা দরকার। অভিভাবকদের আশঙ্কার সঙ্গত কারণ আছে। সেই কারণেই স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা নিয়ে একটি সুষম পরিপ্রেক্ষিত নির্মাণ আরও আবশ্যক হয়ে উঠছে। এটা তখনই সম্ভব, যখন তথ্যসূত্রগুলি নির্ভরযোগ্য হবে। যেমন কিছু সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ বলছে— অনেক অভিভাবকই জানলে আশ্চর্য হবেন— মরশুমি ফ্লু-তে শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি কোভিড-১৯-এর দ্বিগুণ। একইভাবে, ডায়েরিয়া এবং শ্বাসনালীর সংক্রমণও এই কোভিড-১৯-এর চেয়ে অনেক বড় শিশু-হন্তারক; ম্যালেরিয়া এবং ডেঙ্গুও ফি বছর আমাদের শহরগুলিতে হানা দিয়ে থাকে। কিন্তু এগুলির জন্য আমরা কিছু সুরক্ষাব্যবস্থা নিয়ে থাকি, বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানো বন্ধ করে দিই না। কোনও কিছুই ঝুঁকিমুক্ত নয়। আমরা একসঙ্গে কাজ করে ঝুঁকিগুলিকে কমিয়ে আনার চেষ্টা করে থাকি। কোভিড-১৯ নিয়েও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি একই হওয়া উচিত।

সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত এবং অভিভাবকদের পছন্দ

প্রতিটি অভিভাবককে যেমন তাঁদের নিজেদের সন্তানের ভালোমন্দ বুঝতে হবে, তেমনি সমাজের প্রতিটি শিশুর কথাও ভাবতে হবে। যেসব বাবা-মারা নিজেদের সন্তানদের জন্য স্কুলে না গিয়েও শিক্ষার অন্য পদ্ধতি ব্যবহার করতে সক্ষম তাঁদের অবশ্যই সেইসব বাচ্চাদের কথা ভাবতে হবে যাদের সে সামর্থ্য নেই।

কিছু সমীক্ষা বলছে সরকারি স্কুলের ৯০ শতাংশ অভিভাবকই চাইছেন তাঁদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে। এই বাচ্চাদের জন্য অবিলম্বে স্কুল খোলা উচিত। কিন্তু এই বাবা-মাদের নিজেদের কথা শোনানোর কোনও প্ল্যাটফর্ম নেই— তাঁরা টিভি-বিতর্কে আসেন না, খবরের কাগজে লেখেন না। ফলে সমাজের শেষতম শিশুটির বিষয়েও প্রতিটি বাবা-মার সজাগ এবং যত্নবান হওয়ার দায়িত্ব থেকে যায়।

স্কুল খোলার উপকারিতা এবং ঝুঁকি সম্পর্কে সর্ব স্তরে স্বচ্ছতার সঙ্গে আলোচনা শুরু হওয়া প্রয়োজন। অভিভাবকদের গ্রুপগুলি স্থানীয় প্রশাসনের কাছে দাবি করুক স্কুল খোলার বিষয়ে পরিকল্পনা করতে এবং তা কার্যকরী করতে। যেসব বাবা-মারা বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে চাইবেন না, তাঁরা বাড়িতে ভার্চুয়াল ক্লাসই চালিয়ে যাবেন, সে ব্যাপারে তাঁদের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে।

বাড়িতে ভাইরাস নিয়ে আসার ঝুঁকি: সেলফ অ্যাসেসমেন্ট গাইড

বাচ্চাদের ঝুঁকি এমনিতেই কম এবং সেই স্বল্প ঝুঁকিও আরও কমিয়ে ফেলা যায় স্কুলে ভেন্টিলেশনের সুব্যবস্থা করে এবং ঠিকঠাক কোভিড-বিধি পালন করে। কিন্তু ভয়টা হচ্ছে, বাচ্চারা বাড়িতে ভাইরাস নিয়ে আসবে এবং পরিবারের অন্য সদস্যরা তা থেকে সংক্রামিত হবে। এটা সত্যিই উদ্বেগের বিষয়। এই ঝুঁকি কমানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হল পরিবারের সব সদস্যের, যাদের টিকাকরণ সম্ভব, টিকাকরণের কাজটা সেরে ফেলা।

নীচে প্রতিটি পরিবারের ঝুঁকি কতটা তার একটা স্বকৃত মূল্যায়ন (সেলফ অ্যাসেসমেন্ট) গাইড টেবিল দেওয়া হল। টেবিলটি আমার বিবেচনা অনুযায়ী করা। যেসব পরিবারে বেশিরভাগ সদস্যের ঝুঁকিই খুব কম সেগুলি সবুজ বক্স। কিছু পরিবারে কিছু সদস্য আগে থেকেই এমন একটি সাব-গ্রুপে রয়েছেন যাঁদের কিছু ঝুঁকি আছে এবং বাচ্চারা স্কুলে গেলে যার কোনও তারতম্য হবে না। তাঁরা হলুদ বক্স। তারও পরে খুব সামান্য একাংশ পরিবার পাওয়া যাবে যেসব পরিবারে এমন কিছু মানুষ আছেন বাচ্চারা স্কুলে গেলে যাঁদের ঝুঁকি বাড়বে। তাঁরা লাল বক্স।

যেসব পরিবারের সমস্ত সদস্যরাই সবুজ বক্সে রয়েছেন তাঁরা কোনও ঝুঁকি ছাড়াই বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে পারেন। যে পরিবারের একজন সদস্য হলুদ বা লাল বক্সে রয়েছেন তাদের এটা নিশ্চিত করতে হবে যে তাঁদের ঝুঁকি যেন কোনওভাবেই শিশুদের শিক্ষার প্রতিবন্ধক না হয়ে দাঁড়ায়। বাচ্চাকে স্কুলে পাঠানোর জন্য এই পরিবারগুলিকে প্রয়োজনীয় সতর্কতা নিতে হবে। যেমন, ঝুঁকিপূর্ণ সদস্যটির টিকাকরণ সম্পূর্ণ করা, তাঁর মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা, ইত্যাদি। অবশ্যই অনলাইন শিক্ষাও একটি বিকল্প, তবে এটি শেষতম বিকল্প হওয়াই বাঞ্ছনীয়।

স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা— একসঙ্গে

স্বাস্থ্য এবং শিশুদের সুরক্ষাই হল মূল উদ্বেগের জায়গা। চলতি অতিমারিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হল শিশুরা যেখানে কিনা তাদের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি সবচেয়ে কম ছিল। শিক্ষার এই ক্ষতি ঠেকাতে স্কুল অবিলম্বে খুলতেই হবে। আমাদের হাতে যা বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণ আছে তার সাহায্যে শিশুদের আবার স্কুলে ফিরিয়ে আনার জন্য একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা অবশ্যই করা যায়। এই অতিমারির সময়ে আমাদের জীবনের সব ক্ষেত্রেই একটা ব্যালান্স করে চলতে হচ্ছে। সেইখানে অভিভাবক এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হিসেবে শিশুদের সম্পর্কে আমাদের অতি-সাবধানী হয়ে পড়ছি। যার পরিণতি হচ্ছে শিশুদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে রাখা। এটা মেনে নেওয়া যায় না। বস্তুত, স্কুল খোলা এবং শিক্ষাব্যবস্থাকে আবার সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য এখন অভিভাবকদের সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা উচিত। আমাদের সন্তানেরা আমাদের কাছ থেকে কিন্তু অনেক কিছু আশা করে।


[1] Mordani, Sneha. IIT professors, doctors, parents issue open letter to CMs of three states demanding reopening of schools. India Today. 31 July 2021.
[2] Lahariya, Chandrakant. Why there is no reason to believe that a ‘child wave’ is coming. TOI. 5 June 2021.
[3] Reopening schools cannot wait. UNICEF. 9 July 2021.
[4] Lahariya, Chandrakant. Making sense of the fourth national sero-survey. The New Indian Express. 26 July 2021.
[5] Loss of Learning during the Pandemic. Azim Premji University. February 2021.
[6] দ্রষ্টব্য, টীকা ২
[7] Chandrakant Lahariya Blogs. TOI.
[8] Guidance for Covid-19 Prevention in K-12 Schools. CDC. 5 August 2021.
[9] Nair, Sandhya. Over 75% parents in Maharashtra want schools to re-open: Survey. TOI. Updated 12 July 2021.
[10] Lahariya, Chandrakant. To reopen schools, we don’t have to wait for kids to get vaccinated. TOI. 1 August 2021.
[11] দ্রষ্টব্য, টীকা ৪
[12] Tamil Nadu Schools To Reopen For Classes 9-12 On September 1. NDTV. Updated: 6 August 2021.
[13] Delhi Schools Reopen For Classes 10, 12 Admissions, Practical Activities. NDTV. Updated: 8 August 2021.
[14] UP Schools To Reopen For Classes 9-12 From August 16 With 50% Attendance. NDTV. Updated: 2 August 2021.
[15] Lahariya, Chandrakant. It’s time to consider re-opening schools. The New Indian Express. 14 July 2021.
[16] Delhi govt forms panel to plan school opening. TOI. 7 August 2021.
[17] Schools Reopen For All Classes In Punjab; Children Happy, But Many Parents Apprehensive. NDTV. Updated: 2 August 2021.
[18] Maharashtra: Parents From Some Districts Want Primary Schools, Classes 5-7 To Resume. NDTV. Updated: 7 August 2021.
[19] Lahariya, Chandrakant. Time to tackle COVID-19 vaccine delivery bottlenecks. The Hindu. Updated: 3 July 2021.
[20] Lahariya, Chandrakant. A cardinal omission in the COVID-19 package. The Hindu. 22 July 2021.
[21] Delhi govt. bats for reopening schools. The Hindu. August 7 2021.
[22] Poverty, Disease, Customs: Why So Many Indonesian Children Die Of Covid. NYT. August 2021.

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...