বন্ধ স্কুলে ঘণ্টা বাজুক

স্বপন ভট্টাচার্য

 


গদ্যকার, প্রাবন্ধিক, প্রাক্তন অধ্যাপক

 

 

 

করোনা অতিমারি আমাদের অদৃষ্টপুর্ব দোলাচলের মধ্যে দাঁড় করিয়েছে সন্দেহ নেই। লকডাউন বস্তুটা অবশ্য দুনিয়া এই প্রথম দেখল তা নয়। একশো বছর আগের ইতিহাস ঘাঁটার দরকার নেই। ২০০২-এর সার্স (SARS) এবং ২০১৩-এর মার্স (MERS) অতিমারির কারণও ছিল করোনা ভাইরাস এবং সত্যি কথা বলতে কি সেই ভাইরাস প্রকরণ দুটো ছিল বর্তমানটির তুলনায় অনেক বেশি মারাত্মক, তাদের মারণক্ষমতা ছিল অনেক বেশি। এতদসত্ত্বেও তাদের আঞ্চলিকভাবে আটকে রাখা গেছিল এই সংস্পর্শ নিবারক অস্ত্রে— লকডাউন যার নাম। সুতরাং ২০১৯-এর ডিসেম্বরে যে ভাইরাস নজরে এল তার গতিপ্রকৃতি বুঝে উঠে বা না উঠে নিয়ন্ত্রণে রাখার এই যে নিদান, যে যতই তর্ক করুন, তা যে খুব অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত তা বলা যাবে না। অবিবেচকের মত কাজ যা হয়েছে— লক্ষ কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছে, অর্থনীতির চাকা কারও ভীমবেগে ঘুরেছে আর কারও বসে গিয়েছে, মানুষ বিনা চিকিৎসায় স্রেফ শ্বাসবায়ুর অভাবে মরে গেছে— এগুলো যতটা সরকারের অবিবেচনায় তার চেয়ে অনেক বেশি সংবেদনশীলতার অভাবে। বলতে চাইছি, যথেচ্ছাচার করেছি বলে পচন ধরেছে, কিন্তু তাই বলে নিদানটাকে কাঠগড়ায় তুলব কেন? অতএব যদি প্রশ্ন করা হয় অফিস-কাছারি-ইস্কুল-কলেজ-সভা-সমাবেশ-সিনেমা-থিয়েটার-উৎসব-মোচ্ছব সবকিছু স্ট্যান্ডবাই রেখে এই যে কোভিডের প্রথমার্ধে আমরা গুমঘরে ঢুকে বসেছিলুম সেটা কি উচিত কাজ হয়েছিল? উত্তরে কেউ যদি বলেন— কেন সুইডেনে তো বাচ্চাদের স্কুল আগাগোড়া খোলা ছিল, তাহলে কিছু বলা মুশকিল; কিন্তু যদি ভাবেন, যে দেশে দু আড়াই লক্ষ মানুষের জন্য একজনও আস্ত ডাক্তার পাওয়া যাবে না, সে দেশের সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত এবং অপরিণামদর্শী প্রশাসনের সত্যই অন্যতর কিছু ভাবার সুযোগ ছিল কি?

এ গেল প্রথমার্ধের কথা। করোনার দ্বিতীয়ার্ধে বিহার পশ্চিমবঙ্গে হই হই করে ভোট হয়ে গেল, ঝড় এল, বন্যা এল, মানুষে মানুষে নৈকট্য অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়াল, তখন কে তোয়াক্কা করতে পারে সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং-এর? তথাপি মৃত্যুহার অধুনা নিয়ন্ত্রণে, অফিসকাছারি পূর্ণ কর্মচারী সংখ্যা নিয়েই চলতে পারছে, টিকাকরণের কাজেও ল্যাজেগোবরে দশা আর চোখে পড়ছে না, কিন্তু লকআউট কেবল ইস্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে! প্রশ্ন উঠছে— আর কতদিন?

দু বছর ধরে এই যে চক-ডাস্টার-ব্ল্যাকবোর্ড-প্রেজেন্টস্যার-রেজিস্টার-শুরুর ঘণ্টা-শেষের ঘণ্টা-চটি ক্রিকেট- নিলডাউন, এসব কিছুই নেই যখন, তখন বাচ্চারা কতটা ভালো আছে? স্কুল হয়েছে ভার্চুয়াল। যে অভিভাবক ধনুর্ভঙ্গ পণ করেছিলেন— ‘মাধ্যমিক দেওয়ার আগে তোমার হাতে মোবাইল নৈব নৈব চ,’ সেই তিনিই এখন অষ্টমবর্ষীয়া কন্যার মোবাইল স্কিলে চমৎকৃত। জঁ দ্রেজ, রীতিকা খেরা, বিপুল পাকিরা প্রমুখ একটা সার্ভে করেছেন শতখানেক স্বেচ্ছাসেবীর সহায়তা নিয়ে বাংলা, বিহার, ওড়িশা, আসাম, ঝাড়খণ্ড, দিল্লি, কর্নাটক, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ এবং চণ্ডীগড় জুড়ে। সমীক্ষা দেখাল যে অতিমারিকালে গ্রামাঞ্চলের ২৮ শতাংশ বাচ্চা মোটামুটি পড়াশুনো চালালেও ৩৭ শতাংশ তার ধারপাশ দিয়েও যায়নি। শহরাঞ্চলে পরিস্থিতি একটু ভালো কিন্তু সেখানেও সমীক্ষার আওতায় থাকা ১৯ শতাংশ শিশু পড়াশুনো ছেড়ে দিয়েছে। বাস্তবে পরিস্থিতি এর চেয়েও খারাপ। মাতৃভাষায় একটা সাধারণ বাক্যের একটি শব্দও গ্রামীণ ৪৫ শতাংশ তৃতীয় শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণির পড়ুয়া ছাত্র পড়তে পারেনি। শহরে এদের অনুপাত ৩৫ শতাংশের মতো। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়াদের অবস্থাও এর চেয়ে খুব ভালো নয়। প্রশ্ন উঠতে পারে এই ফলাফলের দায় আমরা অতিমারিকে দেব কেন? সমীক্ষায় সামিল এইসব বাচ্চারা বড় সংখ্যায় প্রাইভেট স্কুলের ছাত্র যেখানকার মান এমন নজরে আসাটা তাদের ব্যবসার এতটাই পরিপন্থী যে করোনাপূর্বকালেই সে সব প্রাইভেট স্কুলের ইন্তেকাল ঘটে যাওয়ার কথা, সুতরাং পরিস্থিতি করোনার আগের তুলনায় অনেকটাই খারাপ। দ্বিতীয়ত, করোনা বহু অভিভাবককে বাধ্য করেছে সন্তানকে প্রাইভেট থেকে সরকারি স্কুলে নিয়ে আসতে। এই স্থানান্তরণের বৌদ্ধিক ও মানসিক চাপ বাচ্চাদের পাঠবিমুখ করে তুললে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এ কথা বলার উদ্দেশ্য এটা নয় যে সরকারি স্কুল মানে পড়াশুনো শিকেয়। না। মোটেও তা নয়, কিন্তু সেখানকার ছাত্রছাত্রীদের অনেকেরই এই নিউ নর্মালের মোকাবিলা করার মত উপকরণ নেই। ক্লাসে শিক্ষকশিক্ষিকার মুখোমুখি, মিড ডে মিল হোক বা না হোক, যতটুকু প্রাগ্রসরতা থাকতে পারত এই পিছিয়ে পড়া পরিবারের বাচ্চাদের মধ্যে, তা আজ দু-বছর হল অনুপস্থিত।

তদুপরি অতিমারিকালের পরীক্ষাব্যবস্থা দেখিয়ে দিয়েছে স্কুল খোলা থাকুক বা না থাকুক, একশো শতাংশ পাশ করতে একটি নিরবধিকাল মারক ছাড়া আর কিছুই লাগে না, ফলে মেধা ও মননহীনতার সঙ্গে ফলাফলের যে ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্ক সেটাই মুছে গিয়েছে। যে কোনও দেশ, যে কোনও জাতির পক্ষে এই অবস্থা অনভিপ্রেত। সমাজ নামক এই ইঞ্জিনের ভবিষ্যৎ চালকদের মধ্যে যে বিভেদরেখা টেনে দিচ্ছে অতিমারি, তাকে একটা ‘গ্রেট ডিভাইড’ বললে কম বলা হবে। এই ফল্টলাইন আরও গভীর হলে ফলাফল হবে ভয়ঙ্কর। কোনও দেশের পাল্লাভারি-যুবসমাজ, যে কোনও অবস্থায় যদি অচলাবস্থাকে অনুকূল অবস্থা ভাবতে শুরু করে, তবে তার মাশুল দিতেই হবে অবশ্যম্ভাবীভাবে। স্কুলবিবর্জিত শিক্ষা যদি আরও দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে আমরা যে সঙ্কটের মুখোমুখি হব তার অর্থনৈতিক মূল্যায়ন অর্থনীতিবিদ করবেন, কিন্তু আমরা অনুমান করতে পারি এর ফল হতে চলেছে সুদূরপ্রসারী।

এখানে উল্লেখ করতে পারি বাংলাদেশের একটি সমীক্ষার কথাও। দেশব্যাপী ৩৯৯৭ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে চালানো এক গবেষণায় সেখানে উঠে এসেছে শতকরা ৫২.৮৭ ভাগের মধ্যে বিষণ্ণতার উপসর্গ এবং শতকরা ৪০.৯১ ভাগের মধ্যে দুর্ঘটনা পরবর্তী মানসিক বৈকল্যের উপসর্গ ছিল। আঠারো থেকে আঠাশ বছর বয়সি ৩৩৩১ শিক্ষার্থীর মধ্যে চালানো আরেক সমীক্ষায় দেখা গেছে, শতকরা ১২.৮ ভাগের মধ্যে তৈরি হয়েছে আত্মহত্যার প্রবণতা। বিষণ্ণতা, উদ্বেগ আর মানসিক চাপ ছাড়াও স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ক্রোধ, জেদ এবং একাকিত্ববোধে ভোগার মতো মানসিক অসুবিধা দেখা যাচ্ছে। সামাজিকীকরণ স্থগিত থাকার ফলে শিশুর সুস্থ মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে এবং অনেকের ক্ষেত্রেই পরিবারের দায় কাঁধে তুলে নিতে হচ্ছে অপ্রাপ্তবয়স্ক পড়ুয়াকে। অন্য একটি দিকও অবহেলার নয়। শিশুকে স্কুল যে তার সমাজ দেয় শুধু তা নয়, স্কুলশিশুকে আড়াল দেয় অনভিপ্রেত পরিবারিক অনিবার্যতা থেকে। বাবা মায়ের মধ্যে, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কলহ বিবাদ শিশুর উপস্থিতিতে সাময়িকভাবে হলেও ঘুমিয়ে থাকে। শিশুর উপস্থিতিতে যে নখরগুলি গুটিয়ে রাখার বাধ্যবাধকতা থাকত, এখন দিবারাত্র শিশুর উপস্থিতিতে তারা স্বতঃউন্মোচিত। স্কুল যে অন্তরাল দিত শিশুকে তার মনোবৈজ্ঞানিক মূল্য বড় কম নয়। শিশু বয়সে পারিবারিক হিংসাকে কাছ থেকে দেখার, অনুভব করার এবং লালন করার দুর্ভাগ্য এসেছে অতিমারির হাত ধরে। সুতরাং আর দেরি না করে বন্ধ স্কুলে ঘণ্টা বাজুক।

এই দুখানা শিক্ষাবর্ষের অভিজ্ঞতা কী বলে তা একবার পর্যালোচনা করে নিতে পারি: দেখা যাচ্ছে, বাচ্চাদের সংক্রামিত হওয়ার হার বড়দের তুলনায় কম। সারা পৃথিবীতে সংক্রামিতদের মধ্যে আঠারোর কম বয়সি এখনও পর্যন্ত মাত্র ৮.৫ শতাংশ; এর চেয়ে অনেক বেশি হারে হয় ফ্লু সহ অন্যান্য অনেক সংক্রমণ। এই বয়ঃগোষ্ঠীতে কোভিডে মৃত্যু পৃথিবী জুড়েই নামমাত্র এবং অন্যান্য সংক্রমণে মৃত্যুর তুলনায় তা কিছুই না। তবে, ‘ক্রিটিক্যাল কন্ডিশন’-এর খবর রয়েছে এবং বড়দের মতই আনুষঙ্গিক উপসর্গের শিকার ছোটরাও হয়েছে, সুতরাং তেমন শিশুর জন্য উপযুক্ত সতর্কতা দরকার।

নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন ছোটরা সংক্রামিত কম হলেও পূর্ণবয়স্কদের মতই রোগ ছড়াতে পারে! উড়িয়ে দেওয়ার মত কথা বলছি না, তবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় ইংল্যান্ডের কথা বলতে পারি— করোনার প্রথমার্ধে কিছুদিন ব্যতীত নার্সারি সহ ছোটদের স্কুল একেবারে লকডাউন হতে দেয়নি তারা। কিছুদিন স্কুলে উপস্থিতি ছিল ঐচ্ছিক, পরে আবশ্যিক। এই যে ব্যবস্থা তা যদি শিশুবাহিত সংক্রমণের মডেল হিসাবে ধরি, তা হলে দুরকম ফলাফল প্রত্যাশিত। এক, স্কুল চালু হওয়ার পরে বার বার শিক্ষক-শিক্ষিকা-সহায়কদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে পুনঃ পুনঃ স্কুল বন্ধ থাকার পরিস্থিতি তৈরি হতে থাকবে অথবা শিশুদের পারস্পরিক নৈকট্য, তাদের সঙ্গে শিক্ষকদের নৈকট্য, অভিভাবকদের নৈকট্য— সব মিলিয়ে একটা দুর্লঙ্ঘ্য সংক্রমণচক্রের সন্ধান পাওয়া উচিত। সেখানকার অভিজ্ঞতায় এই দ্বিতীয় সম্ভাবনার সমর্থন মেলেনি এবং স্কুল যে চালু হওয়ার পরে বারবার সংক্রমণের কারণে বন্ধ রাখতে হয়েছে তাও নয়। আজ পর্যন্ত পৃথিবীর কোনও জায়গা থেকেই নিশ্চিতভাবে এমন কোনও পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি যাতে মনে করা যেতে পারে স্কুল খোলাটা ভয়ানক কোনও পরিণতির সঙ্কেতবাহী। কিছু বিশেষ ব্যবস্থা তো নিতেই হয়েছে তাদের। যেমন, ছাত্রসংখ্যা কমিয়ে ছোট ছোট গ্রুপে এক-একটা ক্লাসকে ভেঙে দেওয়া, এক গ্রুপের সঙ্গে অন্য গ্রুপের মেলেমেশার সুযোগ আপাতত সংযত রাখা, উঁচু ক্লাসের ছাত্রদের সান্নিধ্যে আসতে না দেওয়া এবং তার জন্য ভিন্ন ভিন্ন স্কুল টাইমিং ইত্যাদি, যা প্রায় সব দেশেই রীতিমাফিক হচ্ছে। পরিপূর্ণ ফলাফল বিশ্লেষিত হয়েছে বলে এখনও চোখে পড়েনি, কিন্তু স্কুল খুলে দেওয়ার জন্য ‘করোনা কা হাথি’ প্রমত্ত হয়ে উঠেছে— এমন কোনও নজির নেই।

একথা ঠিক, সমস্ত ছাত্র-শিক্ষক নিয়ে একলপ্তে সব স্কুল চালু করে দেওয়াটা হয়ত সম্ভব হবে না। সব অঞ্চলে তো রোগের প্রকোপ সমান নয়। কলকাতাতে যে প্রোটোকল মানা দরকার জঙ্গলমহলেও সেটাই মানতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা থাকার কথা কোনও বিশেষজ্ঞই বলবেন না আশা করি। যে প্রশ্নটা স্বাভাবিকভাবেই উঠবে  তা হল বাচ্চারাও কি মাস্ক পরে থাকবে স্কুলে? এক্ষেত্রেও, যুক্তরাজ্যের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি অন্তত প্রাইমারির বাচ্চাদের সেখানে স্কুলে মুখাবরণ আবশ্যিক করা হয়নি। সেটা খুব সঠিকভাবে প্রায়োগিক সাফল্য পেত বলে মনে হয় না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বলছে যেখানে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সেখানে পাঁচ বছর অবধি বয়স যাদের তাদের তো বটেই, পাঁচ থেকে এগারো অবধি বয়স যাদের তাদেরও নেহাৎ সতর্কতার প্রয়োজনে বিদ্যালয়ে মাস্ক আবশ্যিক করার দরকার নেই। ছাত্রদের কারও কারও মধ্যে, বস্তুতপক্ষে তাদের অভিভাবকদের মধ্যে, যদি এই সচেতনতা থাকে তাহলে খারাপ কী? নিউ নর্মালের মধ্য দিয়ে তাদেরও তো বেড়ে উঠতে হল। আমাদের দেশ গাঁয়ের ঘাম-জলের বাচ্চারা এতাবৎকাল মুখ খুলে রেখে বুক ভরা বদ বাতাস নিয়ে এবং মাটি মাখা হাতে তথাকথিত ‘অখাদ্য-কুখাদ্য’ খেয়েই অনাক্রম্যতা অর্জন করে এসেছে, জ্বর-সর্দি-কাশি তাদের হয় না তা নয়, কিন্তু কাবু হওয়া আটকাতে তাদের গুচ্ছের অ্যান্টিবায়োটিক খেতে বলে না কেউ, সে সব ছাড়াই সামলে ওঠার ক্ষমতা তাদের অনেক বেশি। কিন্তু, এই পরিস্থিতি অভূতপূর্ব বলেই সতর্কতা রাখতেই হবে এবং সকলের জন্যেই তা থাকতে হবে। সুতরাং শহর গ্রাম নির্বিশেষে ছাত্রসংখ্যা সীমাবদ্ধ রেখে, আলাদা আলাদা সময়ে বাচ্চাদের ও বড়দের ক্লাসের সময় বেঁধে দিয়ে এবং উপযুক্ত স্বাস্থ্য-সচেতনতা মেনে স্কুল চালু করা গেলে তা খুব অবৈজ্ঞানিক কাজ হবে না।

অবশ্য ‘উপযুক্ত স্বাস্থ্য-সচেতনতা’ বাক্যবন্ধখানি এক সোনার পাথরবাটি গোছের লাগে। সরকারি শিক্ষা মানচিত্রে এই জায়গাটা যে ঠিক কোথায় তা ঠাহর করা যায় না, অথচ বাচ্চাদের সুস্থ রাখতে গেলে, বিশেষ করে কন্যাসন্তানের সাধারণ এবং রিপ্রোডাক্টিভ হেলথের জন্য যেটুকু ন্যূনতম দরকার তার ব্যবস্থা আজও হয়ে ওঠেনি। আচ্ছা, এই দু-বছরের যতিকালে সব স্কুলে ছেলে ও মেয়েদের জন্য সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে শৌচাগার তৈরির কাজটা কি হতে পারত না? স্কুল খুলে রাখা যেমন দরকার তেমনই প্রতিক্রিয়াগুলোর জন্যও তৈরি থাকা দরকার। সেগুলো কী? যদি দেখা যায় স্কুল চালু হওয়ার পরে বাচ্চাদের মধ্যে সংক্রমণ বাড়ছে তাহলে তাদের জন্য হাসপাতালে শয্যা হাতড়াতে হবে না তো? নিও-নেটাল আইসিইউ ব্যবস্থা জেলা হসপাতালেই অপ্রতুল, গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তা কোথায়? সেজন্য গ্রামের স্কুলগুলিকে সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন দিতে হবে যাতে প্রয়োজন হলে তারা অসুস্থ ছাত্রছাত্রীর জন্য নির্ধারিত কেন্দ্রে যোগাযোগ করতে পারে। একই কথা স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের জন্য, শিক্ষাকর্মীদের জন্য এবং অভিভাবকদের জন্যও প্রযোজ্য। স্কুল সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিলনক্ষেত্র, সেটাকে চালু করতে গেলে এবং চালু রাখতে গেলে শুধু সরকারের কী কী দায় তা বলে খালাস হলেই চলবে না, নিকট ও বৃহত্তর সমাজকে অনেক দায়িত্বশীল হতে হবে। প্রস্তুতি একটা বিজ্ঞানসম্মত ব্যাপার, শুধু আবেগের ব্যাপার তা নয়, কিন্তু এখনও পর্যন্ত যা দেখছি তাতে আমলাতন্ত্র শিক্ষকসমাজকে আলোচনার অংশীদার করার উদ্যোগ নিয়েছেন বলে বুঝতে পারিনি। এই কারণেই মনে হচ্ছে আশু বন্ধ স্কুলে ঘণ্টা বাজার সম্ভাবনা নেই, কিন্তু কোনও প্রস্তুতি ছাড়াই হঠাৎ করে একদিন ঘোষণা হয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

ভারতবর্ষের বেশ কয়েকটি রাজ্যে কিন্তু ইতিমধ্যেই বন্ধ স্কুলে ঘণ্টা বেজেছে। একই নিয়মে সব জায়গায় এই সিদ্ধান্ত প্রযুক্ত হচ্ছে তাও নয়। যেমন, রাজস্থানে ২০ সেপ্টেম্বর থেকে স্কুলে আসতে পেরেছে প্রথমে প্রাইমারি নয়, বরং মাঝারি ক্লাসের পড়ুয়ারা। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম পর্যন্ত পঞ্চাশ শতাংশ উপস্থিতি বেঁধে রেখে সপ্তাহে পাঁচদিন ক্লাস শুরু হয়। প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক হওয়ার ফলে প্রথম থেকে পঞ্চমের ক্লাস শুরু হয়েছে ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে। ফের বন্ধ করে দেওয়ার মত কিছু তো চোখে পড়েনি সংবাদমাধ্যমে। উত্তরপ্রদেশে স্কুল খুলেছে প্রথমে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির জন্য আগস্ট মাসের ১৬ তারিখে, ষষ্ঠ থেকে অষ্টমের জন্য ওই আগস্টেরই ২৩ থেকে। পয়লা সেপ্টেম্বর প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস শুরু হয়েছে সেখানে। অসমে দশম শ্রেণিকে দিয়ে শুরু হয়েছে ২০ সেপ্টেম্বর। সেখানে উল্লেখযোগ্যভাবে বোর্ডিং স্কুল ও হাই মাদ্রাসাগুলিও উঁচু ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের জন্য খুলেছে। মহারাষ্ট্র ৪ অক্টোবর থেকে প্রথমে গ্রামীণ অঞ্চলের বিদ্যালয়ের দরজা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পঞ্চম থেকে দ্বাদশের ছাত্রছাত্রীরা প্রথম দফায় আসার কথা, কিন্তু এ লেখা লেখার সময় পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত সারা রাজ্য জুড়ে লাগু করা যাবে, এমনটা নাও হতে পারে। পুনে মিউনিসিপ্যালিটি যেমন দ্বিধাগ্রস্ত বলে জানিয়েছে। স্থানিক সংক্রমণহার বিবেচনা করে কোনও বিশেষ অংশের বিদ্যালয়ের জন্য অন্যতর সিদ্ধান্ত নিতে হতেই পারে এবং সেটাই যুক্তিসঙ্গত। র্নাটকে দশেরার পরে প্রথম থেকে পঞ্চমের জন্য স্কুল খুলবে বলে ঘোষিত হয়েছে। সম্ভবত অক্টোবরের ২০ তারিখের পর যেকোনও সময় তারা স্কুলে যাবে। ১ সেপ্টেম্বর থেকে সেখানে উঁচু ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস চালু হয়েছে গ্রামাঞ্চলে এবং এক শতাংশের কম সংক্রমণহার বজায় আছে এমন সব জায়গায়। শনি এবং রবিবার প্রায় সব জায়গাতেই স্কুলে স্যানিটাইজেশন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মিউনিসিপ্যালিটি বা পঞ্চায়েতের ওপর নির্দেশ জারি করা হয়েছে এই দায়িত্ব নিতে। গুজরাটে স্কুল খুলেছে ২ সেপ্টেম্বর থেকে। তারা প্রথমে ঠিক করেছিল ২৬ জুলাই নবম থেকে একাদশ শ্রেণির ক্লাস চালু করে দেবে কিন্তু পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করা যায়নি। পঞ্চাশ শতাংশের বেশি উপস্থিতির ওপর বিধিনিষেধ থাকছে সেখানেও। তেলেঙ্গানাতে ঐচ্ছিকভাবে ক্লাস চালু হয়েছে ১লা সেপ্টেম্বর থেকে। সেখানকার একটা পরিসংখ্যান খুব কৌতূহলোদ্দীপক। তেলেঙ্গানায় ২০২০ শিক্ষাবর্ষে প্রায় ৮৫,০০০ ছাত্রছাত্রী এবং ২০২১ শিক্ষাবর্ষে ১.২৫ লক্ষ ছাত্রছাত্রী বেসরকারি প্রাইভেট স্কুল থেকে সরকারি স্কুলের অঙ্গনে চলে এসেছে। এই ‘রিভার্স মাইগ্রেশন’ কোভিডকালের অর্থনীতির একটা নমুনা-প্রতিফলন। এমন নয় যে সরকারি স্কুলের ওপর আস্থা হঠাৎ করে ফিরে পেয়েছেন অভিভাবকেরা। এই বিপরীত পরিযান প্রায় সম্পূর্ণতই অভিভাবকদের কাজ হারানো, মাইনে বন্ধ হওয়া, সন্তানের স্কুলের মাইনে দিতে না পারার কারণে। পশ্চিমবঙ্গে এখনও পর্যন্ত স্কুল কলেজ খোলবার কোনও সম্ভাব্য দিন ঘোষিত হয়নি। নবম দশমের ক্লাস চালু করার কথা একবার বলেও পিছিয়ে আসতে হয়েছে। ‘ভাবিয়া করিও কাজ’-এর মধ্যে বিচক্ষণতার পরিচয় আছে যদি সেটা সমস্ত কাজের মধ্যে প্রতিফলিত হয়। নির্বাচনের জন্য স্কুলবাড়ি ছেড়ে দিতে হয়েছিল সারা রাজ্যেই। মেশিনগানধারী নিরাপত্তারক্ষীদের আবাসস্থল ছিল অনেকগুলোই এবং নিদেনপক্ষে পোলিং বুথ হয়নি এমন স্কুল পাওয়াই মুশকিল। কিন্তু তারপরে অনেকটা সময় ইতিমধ্যেই অতিক্রান্ত। অন্ততপক্ষে একটা পরিকল্পনা সামনে আনা যায় না যাতে অভিভাবকেরা এবং ছাত্রছাত্রীরা সেটার সঙ্গে পরিচিত হতে পারে? সব কিছুই কেবল একজনই ভাববেন এভাবে শিক্ষাব্যবস্থাকে দেখা চলে না। শিক্ষা দশের বোঝা এবং দশেরই লাঠি। শিক্ষক-অভিভাবক-কর্তৃপক্ষ-সরকার এদের কোনওটাকে বাদ দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের জন্য কোনও পরিকল্পনা ফলপ্রদ তো হতেই পারে না বরং ব্যাকফায়ার করতে পারে।

এ লেখার শুরু করেছিলাম জঁ দ্রেজ এবং সহযোগীদের সমীক্ষা দিয়ে। শেষেও সেই সমীক্ষায় ফিরি আর একবার। কোভিডের সব চাইতে কুৎসিত অবদান হল স্মার্টফোন-নির্ভর শিক্ষা। এই পোড়া দেশে যেখানে অন্নচিন্তাই একমাত্র চিন্তা এক-তৃতীয়াংশ মানুষের, সেখানে স্মার্টফোনে পাঠদান যদি একমাত্র বিকল্প হয় তাহলে যেটা স্বাভাবিকভাবেই হওয়ার কথা তা হল প্রকারান্তরে তাদের বাচ্চাদের ‘অনেক হয়েছে আর নয়’ বলে কাজে পাঠানোর পথ মসৃণ করা। সমীক্ষায় দেখা গেছে, গ্রামাঞ্চলে ৪৯ শতাংশ বাড়িতে এবং শহরাঞ্চলে ২৩ শতাংশ বাড়িতে কোনও স্মার্টফোন নেই। এই সংখ্যাকে কোভিডকালে নিয়মিতভাবে পড়াশুনো চালাচ্ছে এমন পড়ুয়াদের সংখ্যার সঙ্গে মেলালে ভয়াবহ বাস্তবের ছবি উঠে আসে। শহরাঞ্চলের ২৪ শতাংশ এবং গ্রামাঞ্চলের মাত্র ৮ শতাংশ পড়ুয়া পড়াশুনার মধ্যে আছে। বাকিরা স্কুল ছাড়েনি হয়ত কিন্তু পড়াশুনোয় তাদের অনীহা চলে এসেছে। এই পিছিয়ে পড়াদের আবার সমমানে নিয়ে আসা প্রায় দুঃসাধ্য, কিন্তু মানের ক্রমোন্নয়ন সম্ভব। তার জন্য বিশেষ পরিকল্পনা দরকার। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দরকার। যখন ছেলেমেয়েরা বিদ্যালয়ে ফিরবে তখন সব সহপাঠীই একই ক্লাসরুমে ফিরবে, কিন্তু মানের দিক থেকে তাদের মধ্যে যে ব্যবধান লক্ষ করবেন পাঠদানকারীরা তাও অভূতপূর্ব বটে। এই দুস্তর পারাবার, মনে রাখতে হবে, অতিমারি এবং ডিজিট্যাল ডিভাইডের যোগফল। আগামী দিনে দেশের প্রগতি ও বিকাশের পথে, অর্থনৈতিক সাফল্যের পথে এর চেয়ে বড় বাধা কিছু থাকবে বলে আমি অনুমান করতে পারি না। তাই বন্ধ স্কুলে ঘণ্টা বাজুক, কোলাহলে হেসে উঠুক ক্লাসরুমে কারাবন্দি নিঃসঙ্গ বিষাদবাতাস।


তথ্যসূত্র:

  1. Survey underscores alarming levels of learning in unprivileged kids by Basant Kumar Mahanty. The Telegraph. 7 Sept 2021.
  2. আজহারুল ইসলাম। শিক্ষার্থীদের ‘ঘরে’ ও ‘মনের ঘরে’ করোনার প্রভাব। ২১-০৫-২০২১
  3. One Month Of ‘Offline’ School… NDTV. 29 September 2021.
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...