অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
ঠান্ডা ঘর থেকে বেরুতেই চশমার কাচটা ঝাপসা হয়ে আসে। সমীরের এতে অভ্যাস হয়ে গেছে। বেশিক্ষণের ব্যাপার তো নয়। উবের আসতে যতক্ষণ। গাড়িটা কিনবে কিনবে বলে প্রায় ঠিক করেই ফেলেছিল সমীর। হঠাৎ করে লকডাউন হয়ে গেল। শেষমেশ তাই আর গাড়িটা কেনা হয়নি। এই দুটো বছর, ওয়ার্ক ফ্রম হোমের চক্করে বেশ একটা নেয়াপাতি ভুঁড়ি উঁকি দিচ্ছে সমীরের ইন করা শার্টের তলা থেকে। সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ? ফোন ঘুরিয়ে সে দেখল যে তার গাড়ি আসতে তখনও পাঁচ মিনিট। লোকেশন যা দেখাচ্ছে, তাতে গাড়িটা ওর সামনে দিয়ে চলে যাবে। তারপর কাছেই কোথাও একটা ড্রপ সেরে নিয়ে ওকে পিকআপ করতে আসবে। গাড়িটাকে দাঁড় করিয়ে উঠে পড়বে কিনা ভাবছিল সমীর। উবেরে বোধহয় তেমনটা নিয়ম নেই। ভাবতে ভাবতেই গাড়িটা তার চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল। নম্বরপ্লেটটা একঝলক দেখে নিল সমীর। এটাই। মিনিট চারেক দেখাচ্ছে এখনও। সমীর একটু ছায়াতে সরে এসে একটা সিগারেট ধরাল। অপেক্ষা করতে ওর খারাপ লাগছে না। হয়তো অনেকদিনের বিরতির শেষে এতটুকু উষ্ণতার ছোঁয়াচ নিচ্ছে ওর শরীর। দেড় বছরের এই টানা লকডাউনের কারণে, সাঁইত্রিশ ডিগ্রির উত্তাপকে গায়ে নিতে সে প্রায় ভুলেই গিয়েছে। সমীর অন্তত বেশ আরামেই আছে এখন।
অন্তত এখনও অবধি, কিন্তু এরপর?
কাছেই একটা সাইকেল রিকশ দাঁড়িয়ে। রংজ্বলা কাপড়ের সিটটার উপরে শরীরটাকে হেলিয়ে দিয়ে চালকের বসার জায়গাটায় পা রেখে, লোকটা ঝিমোচ্ছে। একটু দূরে ফুটপাথের উপরে কিছুটা বাসি ভাত পড়ে আছে। কারও টিফিন বক্স থেকে পড়ে গিয়েছে হয়তো। সাদা নয়, ভাতগুলো হলুদ। ডাল দিয়ে মাখা ছিল বোধহয়। রিকশওয়ালাটার মুখে মাস্ক রয়েছে, তবে থুতনিতে নেমে এসেছে। সমীর নিজের মনেই অল্প একটু হাসল। এই মাস্ক পরা না-পরা নিয়ে আজকাল… অফিসে আবার সমীর তার বসের একান্ত প্রিয় পাত্র হিসেবে পরিচিত। এটা সকলেরই জেনে রাখা উচিত। যেমনটা প্রায় সব গল্পের প্রোটাগোনিস্টরাই হয়ে থাকে। ভাতগুলো থেকে চোখ সরিয়ে আবার সে রিকশওয়ালাটার দিকে চোখ ফেরাল।
এদেরকেই সরকার সুপার-স্প্রেডার বলেছে। বলবে নাই বা কেন। এরা কোনও নিয়মকানুন মানে না, মানা সম্ভবও নয় বোধহয়। সে মনে মনে ভাবে। বারো-চোদ্দ ঘন্টা এই কলকাতার গরমে মাস্ক পরে রিকশ চালানো বা ভ্যান চালানোর বিষয়টা— ভাবতে গেলেই ওর দম বন্ধ হয়ে আসে। গতবছর লকডাউন রিলিফেও সমীর ওদের পাড়ার একটা এনজিওকে বেশ কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিল। রিকশওয়ালাটা চোখ পিটপিট করছে।
–ভ্যাকসিন নিতে এসেছিলেন বুঝি? আড়মোড়া ভেঙে লোকটা সমীরকে জিজ্ঞেস করে। ওপাশের ডায়গনস্টিক সেন্টারেই কোভিড ভ্যাকসিনেশন চলছে। সমীর হালকা ঘাড় নেড়ে সায় দিল।
–তোমাদের ভ্যাকসিন দিচ্ছে না? সমীর পালটা জিজ্ঞেস করে— সরকার থেকে নাকি ব্যবস্থা করবে শুনছিলাম।
–আমরাও শুনেছি। সামনের সপ্তায় আধার কার্ড নিয়ে বরো স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে লাইন দিতে বলেছে, লোকটা নিরুত্তাপ গলায় জবাব দেয়, দেখি… কোথাও যাবেন নাকি আপনি? লোকটা রিকশ থেকে নেমে আসার একটা ইঙ্গিত করে।
–না না, আমি অনেক দূরে যাব, সমীর হাত নেড়ে কথাটাকে কাটিয়ে দেয়, আমার গাড়ি এসে গেছে।
লোকটা আবার নিজের আধশোয়া অবস্থায় ফিরে গেল। বেশ! তাই তাহলে!
সমীরের কেমন যেন একটা ঘোর লাগে। ভ্যাকসিনেরই কোনও সাইড এফেক্ট নাকি?
–কোথায় যাবেন স্যার? ড্রাইভার জিজ্ঞেস করে।
–যাদবপুর, জবাব দেয় সমীর।
শরীরটা ঠিক জুতের লাগছে না। ভ্যাকসিন নিলে নাকি একটুআধটু শরীর খারাপ হতে পারে। সেজন্যই তো ওকে বসতে বলেছিল, কিন্তু এয়ারকন্ডিশনড ঘরে অত লোকের সঙ্গে অতক্ষণ বসে থাকতে সে সাহস করেনি। মিনিট পাঁচেক কোনওমতে বসেই বেরিয়ে এসেছে। সমীর গাড়ির এসিটাকে বন্ধ করে দিতে বলে হঠাৎ। জানলার কাঁচটাকে নামিয়ে নেয়। হাওয়া দিচ্ছে বেশ। চুলগুলো উড়ছে। শহরে লকডাউন। রাস্তায় কোথাও কোনও জটলা নেই। কেবল একেকটা পুলিশের পিকেট দেখা যাচ্ছে।
–ভ্যাকসিন নিতে এসেছিলেন স্যার?
সমীর একটু বিরক্তি বোধ করে। সবারই দেখি একই কৌতূহল। মানুষের একাংশ যে কতখানি ডেসপারেট হয়ে ভ্যাকসিনের জন্য দৌড়চ্ছে সে খবর তার জানা আছে। আবার সেই জনতারই আরেক অংশ যে এখনও ফ্রি ভ্যাকসিনের আশাতেই গোঁ ধরে বসে রয়েছে, এতেও তার বিরক্তি বোধ হয়। সমীর তার নিজের পরিচিত বন্ধুবান্ধবদেরই একআধজনের কথা জানে, ফ্রি ভ্যাকসিন না আসা অবধি তারা কোনওভাবেই ভ্যাকসিন নিতে রাজি নয়। তাদের কথায় তারা নিয়মিত তাদের ট্যাক্স জমা করে। কাজেই এইরকমের একেকটা মেডিক্যাল এমার্জেন্সির সময় তারা নাগরিক হিসেবে অন্তত কিছু কিছু বেনিফিটসে এলিজিবল। এই তাদের যুক্তি। সমীর একবার মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে, ড্রাইভারটা লুকিং গ্লাসের ভিতর দিয়ে তার দিকে তাকিয়েছে।
–অফিস থেকে দিল স্যার? একগাল হেসে ড্রাইভারটা জিজ্ঞেস করে— আমাদেরও কোম্পানি থেকে দেবে বলেছে, তবে দামটা নাকি পেমেন্টের সঙ্গে এ্যাডজাস্ট হয়ে যাবে। লোকটা গাড়ি চালাতে থাকে। উবের নাকি তার সমস্ত ড্রাইভার পপুলেশনকে ফ্রিতে ভ্যাকসিনেট করবে বলে এ্যানাউন্স করেছে, এমনটাই তো কাগজে পড়েছিল সমীর। তবু তার তর্কে যেতে প্রবৃত্তি হয় না। কে জানে কতরকমের যে ম্যানেজমেন্টের গল্প থাকে এসব কোম্পানিতে। সমীর নিজেও তো তেমনই একেকটা চক্করের অংশীদার হয়েছে একেকবার। ম্যানেজমেন্ট বড় কঠিন ঠাঁই।
এমবিএ ডিগ্রিটা একেকজন মানুষকে হঠাৎ করে অনেকটা ভাবলেশহীন করে দেয়। চকচকে, পেছলানো কাঁচের মতোই ঝলমলে, নীরস। সমীর মাস্কের আড়ালে একবার ঠোঁটটাকে চেটে নিল। বড্ড গরম পড়েছে।
–লিচু কত করে দিচ্ছ? সমীর জিজ্ঞেস করে। ক্যাব থেকে নামতেই লিচুওয়ালাটা সামনে পড়ে গেছে। এখনও সকালে ১০টা অবধি বাজার খোলা রাখার কথা থাকলেও, লোকজন আস্তে আস্তে তার বাইরেও ছুটকোছাটকা দোকানগুলোকে খোলা রাখতে শুরু করেছে। পুলিশও বোধহয় একটু নরম হয়েছে। আসলে লাল টকটকে রসালো লিচুগুলো দেখেই ও আর লোভ সামলাতে পারেনি। ছোটবেলায় মা বলত, বারুইপুরের লিচু আর গাছপাকা আমের গল্প। সমীর আজকাল এতটুকুও দরাদরি না করে, এইরকম একেকটা জিনিসকে অম্লানবদনে কিনে ফেলতে পারে। তাতে তার কোনও ভাবান্তর হয় না।
সাফল্য ? হয়তো তাই।
–দুশো টাকা কেজি বাবু, লোকটা কাঁচাপাকা দাড়ির ফাঁক দিয়ে বলে। দাড়িটা যেন একটু বিশেষ রকমে ছুঁচলো। সমীর অতটা খেয়াল করে না। সে যা হোক।
–দেড় কিলো নিয়ে যাও বাবু, এই সিজনের মতো লিচু শেষ এবার। সমীর পকেট থেকে নতুন তিনটে একশো টাকার কড়কড়ে নোট বের করে এগিয়ে দেয়। লোকটা পাতা আর ডালগুলোকে ছেঁটে লিচুগুলোকে যত্ন করে একটা কালো প্লাস্টিকে মুড়ে দিচ্ছে। সমীরের আবার গরম লাগছে খুব।
গলি দিয়ে হেঁটে ফিরতে ফিরতে সুশান্তর সঙ্গে সমীরের দেখা হয়ে গেল। এখানে সুশান্তর ব্যাপারে ছোট্ট করে একটু বলা দরকার। সুশান্তর চাকরিটা গত বছর চলে গেছে। সুশান্ত আর সমীর যদিও একই কোম্পানিতে ছিল। সুশান্তর লোকেশন ছিল সেক্টর ফাইভ। সমীরের বানতলা। যখন কোম্পানিতে ডাউনসাইজিং শুরু হল, সুশান্তই প্রথম সমীরকে বলেছিল। ও বোধহয় সমীরের মতো ওর বসের কাছে অতটা ফেভারিট ছিল না। কাজের ব্যাপারে ও বরাবরই চুপচাপ, নিজের মধ্যেটায় কেমন যেন একটা গুটিয়ে থাকত সবসময়। চাকরিটাও তাই চুপচাপ খুইয়ে বাড়ি ফিরেছিল। কিন্তু বসে থাকেনি। একটা কেটারিং বিজনেস চালু করেছে। রোজকার খাবারের হোম ডেলিভারিরও ব্যবস্থা রেখেছে। শুনে সমীর হেসে বলেছিল, স্টার্ট আপ! সুশান্ত হেসে জবাব দিয়েছিল, ইনভেস্ট করতে পারিস।
–কেমন চলছে রে? সমীরই জিজ্ঞেস করে— কাজকর্ম?
–মন্দ নয় ভাই, আর তিনমাসের মধ্যেই মোটামুটি একটা ব্রেক-ইভনের কাছাকাছি পৌঁছতে পারব আশা করছি। সুশান্ত হাসে।
–ব্রেক-ইভন… আর প্রফিট?
–সেটা নিয়ে এখনই ভাবছি না, আরেকটু সময় যাক। তবে একটা গুডউইল তৈরি হচ্ছে ক্লায়েন্টদের মধ্যে। তাছাড়াও লোকাল কোভিড পেশেন্টদের জন্য একবেলা ফ্রি মিল সার্ভিস চালু করেছি। রাতের খাবারেও নমিনাল চার্জেস, সঙ্গে ফ্রি ডেলিভারি।
–এর মধ্যেই সিএসআর চালু করে দিলি হতভাগা! তোর আর ব্যবসাবুদ্ধি হবে না, সমীর শব্দ করে হেসে ওঠে। সুশান্ত শান্তভাবে হেসে তাকায়। ইদানীং ওর মধ্যে একটা অদ্ভুত শান্ত ভাব লক্ষ করেছে সমীর। ওর বোধহয় সে জন্য মনে মনে সুশান্তকে হিংসে হয়।
সন্ধেয় গা ধুয়ে অফিসের ল্যাপটপে বসে কাজ করছিল সমীর। ওর মা-বাবা দুজনেই বিকেলের চা খেয়ে বাইরের একফালি বারান্দাটায় গিয়ে বসেছেন। বাড়ি কেনবার সময় এই বারান্দাটার ব্যাপারে খুবই পিটপিটে ছিল সমীর। শুধু সাউথ ফেসিং হলেই হবে না, দক্ষিণ দিকটা খোলা থাকা চাই— ব্যালকনি সমেত। চওড়াতে অন্তত চার ফুট হতে হবে। নইলে আলাদা করে চেয়ার বা মোড়া ঢোকানোর কোনও মানেই থাকবে না। এমন সব হিসেব মাথায় রেখে সমীর ফ্ল্যাট দেখতে শুরু করেছিল। রিমি ওকে কম খেপিয়েছে এজন্য। ওর বোন রিমি। লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে ইকনমিকস অনার্স, ফাইনাল ইয়ার। এবারের পরীক্ষাটাও অনলাইনে হবে যা মনে হচ্ছে। তারপর পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের জন্য চেষ্টা করতে হবে। রিমি কলকাতার বাইরে কোথাও পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করতে চায়। সমীর বলেছে দিল্লিতে ওর অফিসের চেনা দু-একজন আছে। জেএনইউতে পেয়ে গেলে দিল্লিতে মেস বা থাকার জায়গা ইত্যাদির বিষয়ে কোনও অসুবিধে হবে না।
সমীর ল্যাপটপে কাজ করছিল। রিমি ওর পিছনে এসে দাঁড়াল। সমীরের একটু ঘুমঘুম পাচ্ছিল। কিন্তু এই রিপোর্টটা আজকে রাতের মধ্যে জমা না দিলেই নয়। নিজের জন্য, পরিবারের জন্য ও অনেক করেছে। একটা সুখের বুদবুদে সবসময় পুরে রাখতে চেয়েছে পরিবারকে। এখনও অবধি সে সফল। রিমি ওর চুলগুলো ঘেঁটে দিচ্ছে। ছোটবেলাটা খুব মনে পড়ে সমীরের।
–আর এক কাপ চা হবে নাকি রে?
–এই তো চা খেলি দাদা, আবার চা?
–দেখ না, লক্ষ্মী বোনটি আমার, সমীর আদুরে গলায় বলে।
–যেই আমি উঠেছি অমনিই তোর চা খাওয়ার কথা মনে হল। তাই না! কপট রাগের সুরে রিমি বলে।
–প্লিজ, এখুনি আবার প্যাট্রিয়ার্কিয়াল সমাজ, আজকালকার পুরুষেরা তো শত আধুনিক হয়েও মেয়েদেরকে তবুও রান্নাঘর ছাড়া ভাবতেই পারে না— এসব নিয়ে যেন আবার শুরু করিস না, সমীর হতাশার সুরে বলে— তোরা যা ফেমিনিস্ট!
–কেন, ফেমিনিস্ট হওয়া কি খারাপ? ওর চেয়ারের হাতলটার উপরে হালকা করে শরীরটা রেখে রিমি জিজ্ঞেস করে।
–উফফ, আমি সেটা কখন বললাম, সমীর কাঁদো কাঁদো মুখে তাকায়, এক কাপ চা চেয়েছি তো কেবল। প্লিজ, এরম করিস না আমার সঙ্গে… লক্ষ্মীটি আমার!
–আচ্ছা বাবা যাচ্ছি, রিমি উঠে পড়ে— ম্যানেজমেন্ট পড়ে যে কায়দায় পিআর করতে শিখেছিস, আমরা কি পারি অত!
দুহাত ছড়িয়ে রিমি রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। সমীর রিপোর্টের খুঁটিনাটির দিকে মন দিল আবার।
রাতের খাওয়ার পর রিমি আর সমীর বারান্দায় এসে বসেছিল। হাওয়া দিচ্ছে বেশ।
–নাঃ, বারান্দাটা ভালোই হয়েছে, রিমি সমীরের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হেসে বলে, তোর চয়েস আছে বলতে হবে।
–হেঃ, কত খেপাতিস তুই এই নিয়ে মনে আছে? একবার তো বলেই ফেলেছিলিস যে আমি নাকি বিএইচকে খুঁজছি না, ব্যালকনি খুঁজছি।
–আরও বলেছিলাম, যে তোর থ্রিবিএইচকের মিনিং হচ্ছে তিনটে ব্যালকনি, একটা হলঘর আর একটা কিচেন, রিমি হেসে ওঠে। হাসলে ওকে ভারী সুন্দর দেখায়।
–আজ সুশান্তর সঙ্গে দেখা হল জানিস, সমীর প্রসঙ্গ পালটায়।
–তাই? কেমন আছে সুশান্তদা? রিমি জিজ্ঞেস করে। সমীর ওর দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকায়।
–ভালো আছে রে, ছেলেটা রিয়ালি ভালো আছে মনে হল।
–নিজের পায়ে দাঁড়াতে সকলেরই ভালো লাগে।
রিমির মুখে এই জবাব শুনে একটু থমকাল সমীর— তুই বলতে চাস যে আমি নিজের পায়ে দাঁড়াইনি?
–তা কেন বলব! কিন্তু একেবারে সম্পূর্ণ একটা ইন্ডিপেন্ডেন্স— ঝুঁকি বলিস, প্রাপ্তি বলিস, সবটুকুই নিজের ইচ্ছেতে— এর মধ্যে একটা আলাদা রকমের চার্ম তো থাকেই।
–আমাকে ওর মতো মাস গেলে ব্রেক-ইভনের চিন্তা করতে হয় না রে, সমীর হাসিমুখে তাকায়।
–তা হয়তো হয় না। কিন্তু…
–কিন্তু কী?
–কিছু না, ওসব ভাবতে নেই।
–বল।
–উঁহুঃ, এখন না।
সমীর জোর করতে পারে না। বাজারে চাকরির অবস্থা যে ভালো নয় সে খবর সকলেই জানে। খবরের কাগজ খুললেই আজকাল ছাঁটাইয়ের খবর। রিমির টেনশন হওয়াটা স্বাভাবিক। সমীর শুকনো হাসে।
–ভয় নেই রে। কালই নিখিলেশদা বলছিল আমায়। ফিয়াট কোম্পানির একটা বড় প্রোজেক্ট আসছে। কলকাতা জোনের আন্ডারেই। ওটা এসে গেলে আপাতত নিশ্চিন্ত। তাছাড়া, নিখিলেশদা তো সবসময়ই আমাকে গার্ড করে এসেছে। তুই তো জানিসই। ওর মতো সিনিয়র পাওয়া কপালের ব্যাপার।
সমীর ব্যালকনি দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। একটা উল্কাপাত হল।
রিমি উঠে দাঁড়িয়েছে।
–আমার মাঝে মাঝে খুব ভয় করে, উল্কাটার নিভে যাওয়া দেখতে দেখতে রিমি বলে ওঠে— খুব ভয় করে আমার।
–ভাবিস নে, সমীর আলতো করে ওর পিঠে হাত রাখে। রিমি ওর চেয়ারটার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে— কিচ্ছুটি হবে না আমাদের। আমরা ভালো আছি। ভালো থাকব। সমীরের গলাটা কি একটু শুকিয়ে এল?
–অনেক রাত হল, এবারে শুয়ে পড় গিয়ে, সমীর রিমির পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়— কাল সকালে আবার তোর অনলাইনে ক্লাস আছে না?
রিমি হেসে তাকায়— সব খেয়াল রাখিস তুই।
–আমিও শুয়ে পড়ব, একটা মেল পাঠাতে হবে কেবল। শরীরটা বড় ম্যাজ ম্যাজ করছে, সমীরও উঠে দাঁড়াল। ল্যাপটপটা খুলতে যদিও তার এতটুকুও ইচ্ছে করছে না। তবুও, সে যে রিপোর্টটা পাঠিয়েছে তার অন্তত একটা এ্যাকনলেজমেন্ট আসা দরকার। ল্যাপটপটার পাশে আলো জ্বলছে। চার্জারে বসানো ছিল এতক্ষণ।
***
অনেকগুলো আলো জ্বলছে। বাইরের আকাশটা যদিও অনেকটা ফরসা হয়ে এসেছে। কাল রাত্তিরে তেড়ে বৃষ্টি নেমেছিল কলকাতায়। রিমির খুব শীত করছিল। ওই দুর্যোগের মধ্যেও সে যে কীভাবে শেষ পর্যন্ত একটা এ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করেছিল, সেটা ভাবতে এখনও রিমির গা-হাত-পা বরফ হয়ে আসছে। এমনিতেও এই পাঁচতারা হাসপাতালের ভিতরটা সেন্ট্রালি এয়ারকন্ডিশনড। কোভিড-সেকশনটা ওরা উল্টোদিকের উইংটাতে শিফট করে নিয়েছে। যাতে নন-কোভিড পেশেন্টদের কোনও সমস্যা না হয়। তবুও বাবা-মাকে এইসময়ে হাসপাতালে আসতে রিমি বারণ করেছে। এমনিতেও দাদার অফিস থেকে এই হাসপাতাল চেনটার সঙ্গে ক্যাশলেস ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা আছে। কাজেই কোনও অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু প্রথম এ্যাটাকের ওই প্রথম কয়েকটা মিনিট। ভাগ্যিস রিমি সে সময়ে জল খেতে উঠেছিল। হাসপাতালে ফোন করতেই ওরা বলেছিল এ্যাম্বুলেন্স পাঠাচ্ছে। সে আসতে আসতে আরও আধঘণ্টা। তার ওপরে ওই তুমুল বৃষ্টি। রিমিদের বাড়ির ডিরেকশনটা বোঝাতে গিয়ে আরও পনেরো মিনিট মতো সময় লেগে গিয়েছিল। ভয়ঙ্কর ঠান্ডা লাগছে ওর। এসিটাকে কমাতে বলা যাবে না। রিসেপশনের সাজানো গোছানো মেয়েগুলোর দিকে তাকাতেই রিমির কেমন ভয় করছে। এগারোটায় ডাক্তার রাউন্ড দিয়ে এসে পেশেন্ট পার্টির সঙ্গে কথা বলবেন। একজন নার্স এসে শুধু বলে গেছে যে সমীর এখন স্টেবল। ব্লাড প্রেশার নর্ম্যাল হতে শুরু করেছে। হার্টবিট এখনও সামান্য বেশি। ডাক্তার এসে দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন। আজই হয়তো এ্যাঞ্জিওগ্রাফি করা হবে। রিমির গাটা গুলিয়ে উঠল কেমন। হাসপাতালের টপ ফ্লোরে নাকি একটা কাফেটেরিয়া আছে। সেখানে গিয়ে অল্প কিছু খেয়ে নিলে মন্দ হয় না। টেনশনে রিমির খুব দুর্বল লাগে। এখন তো অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করারও নেই।
কাফেটেরিয়ার দিকে যাওয়ার করিডরটায় তার আগেই বাঁদিকে পাশাপাশি তিনটে দরজা। নারী, পুরুষ এবং বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের জন্য। পাশাপাশি তিনটে রেস্টরুম। দাদাই ওকে শিখিয়েছিল, বাথরুম বলতে নেই— বলবি রেস্টরুম। যারা বাথরুম সাফ করে, তাদেরকে বলবি জ্যানিটর। দাদাকে অনসাইটে শিকাগো পাঠাবে বলেছিল নিখিলেশদা। তারপর…
–এক্সকিউজ মি ম্যাডাম, মুখ ধোওয়ার পরে আপন মনেই বিশাল আয়নাটার সামনে অনেকক্ষণ ভাবলেশহীন চোখে রিমি দাঁড়িয়েছিল। জ্যানিটর মেয়েটির বাকি বেসিনগুলো ধোয়া হয়ে গেছে। তাই এই মৃদু অনুরোধ। চাপা গলায় “ওহ সিওর” বলে সরে আসে রিমি। মেয়েটা ওরই বয়সী। কনুই সমান গ্লাভস দুহাতে, মুখে মাস্ক, মাথায় শাওয়ার ক্যাপ। টিস্যু ঘষে ঘষে বেসিনটা মুছে দিল। সুগন্ধী স্যানিটাইজারের সুবাস। রিমি ঘরটা থেকে বেরিয়ে এল। একটু ফ্রেশ লাগছে এবার। জ্যানিটর মেয়েটিও বেরিয়ে এসেছে।
–আয়্যাম সরি ম্যাডাম, বাট আপনাকে খুব টায়ার্ড লাগছে। আপনি কি কাফেটেরিয়াতে গিয়ে একটু বসবেন? সোজা এগিয়ে এলেই বাঁ হাতে পড়বে। মেয়েটি মিষ্টি গলায় বলে ওঠে। রিমি ওর চোখের দিকে তাকায়। একেকজন মানুষের চোখ বড় সুন্দর। সমীরেরও অমনই সুন্দর চোখ ছিল। এঃ! ছিল বলছে কেন, রিমির খুব রাগ হয় নিজের উপর। সমীরের কিচ্ছুটি হয়নি, কিছুই হয়নি। শুধু মানুষটা, মানুষটা একটু; রিমি হেসে ঘাড় নাড়ে। মেয়েটার বুকের উপরে ধাতব ফলকে নাম লেখা রয়েছে, ঝুমুর পাল। রিমি মাথা নামিয়ে কাফেটেরিয়ার দিকে এগোয়, একটু পরে গিয়ে পিছন ফিরে দেখে ঝুমুর বলে মেয়েটি এবার বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের জন্য বরাদ্দ দরজাটায় আলতো করে টোকা দিচ্ছে। এটিকেট ব্যাপারটা এখন এদেরই জিনিস হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাঙ্ক ব্যালান্সের গরম থাকলে আজকাল এটিকেটের দরকার পড়ে না। রিমি এসব ভাবতে চাইছে না। অজস্র কোণ থেকে, অজস্র অজস্র ছবির জন্ম হচ্ছে। রিমি ঝুমুরকে ভুলে যেতে চেষ্টা করল।
–নিখিলেশদা! সমীর আলতো করে বিছানায় উঠে বসতে চেষ্টা করে। পারে না। নিখিলেশ ব্যস্ত হয়ে হাত তুলে আশ্বস্ত করেন। নার্স একটা টুল এনে দিয়েছে।
–কী ব্যাপার বল তো তোর, নিখিলেশ স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে দরাজ গলায় জিজ্ঞেস করেন— একটা মেল পেয়েছিস কি পাসনি একেবারে ডাক্তার-হাসপাতাল বাধিয়ে বসলি! নিখিলেশের এই গলার স্বরটাকে চেনে সমীর। এর আগে অন্তত পাঁচ থেকে ছবার নিখিলেশকে এমন দরাজ গলায় লোককে আশ্বস্ত করতে শুনেছে সমীর।
–আমি তো আছি নাকি! নিখিলেশ আবার বলেন— আমার তো একটা দায়িত্ব আছে।
–জানি নিখিলেশদা কিন্তু… সমীর বলতে চেষ্টা করে।
–কিন্তু ওই মেলটার কি প্রয়োজন ছিল, এই তো? নিখিলেশ একগাল হাসেন— ওতে যে তিনমাস সময় দেওয়া হয়েছে সেটা কি তুই দেখিসনি? কোম্পানি তোকে তিনমাস সময় দিয়েছে কাজ খুঁজে নিতে। তুই কি ভাবছিস এই সময়ের মধ্যে নিখিলেশ সেন হাত গুটিয়ে বসে থাকবে?
সমীর শূন্য দৃষ্টিতে তাকায়। সুশান্তকেও তো নিখিলেশদা হুবহু এই কথাগুলোই বলেছিল, গতবছর। কিন্তু সুশান্তর সঙ্গে আর সমীরের সঙ্গে নিখিলেশদার সম্পর্ক কি এক হল! সমীর ভাবতে চেষ্টা করে।
–আপাতত তুই সুস্থ হয়ে ওঠ দেখি। কোম্পানিটাও হয়েছে তেমন, কী যে সব শুরু হয়েছে আজকাল। যাকে তাকে যখন পারছে একটা করে নোটিস ধরিয়ে দিচ্ছে, নিখিলেশ স্বগতোক্তি করেন— তাও দেখ, তিনমাস সময় দিয়েছে বলেই তো তোর এই হাসপাতালের খরচাপাতিগুলোও কোম্পানি থেকে ব্যবস্থা হয়ে যাবে, নিখিলেশ আবার নিজের স্বরে ফিরে এসেছেন— অলওয়েজ সি দ্য ব্রাইটার সাইড মাই বয়, অলওয়েজ দ্য সিলভার লাইনিং, নিখিলেশ আলতো করে সমীরের হাতের উপরে একটা হাত রাখেন। তারপরেই মৃদু হেসে বলে ওঠেন— ভয় নেই সমীর, আমার হাত স্যানিটাইজ করা আছে। নইলে কি ওরা আমাকে আর এই আইসিইউ কেবিনে ঢুকতে দিত?
সমীরও হাসতে চেষ্টা করে। সমীরের হাসি পাচ্ছে না।
রিমির অনেকটা নিশ্চিন্ত লাগছে। নিখিলেশ সেন বেরুবার সময় ওকে অনেকটা স্বস্তি দিয়ে গেছেন। বলেছেন যে সমীরের ব্যাপারটা উনি নিজে দেখবেন। হাতে যখন তিনমাস সময় আছে এখনও, এর মধ্যে নিখিলেশ সেন নিশ্চয় একটা কিছু করে ফেলতে পারবেন। এইটুকু বিশ্বাস অন্তত রিমি তাঁর উপরে রাখতে পারে। এছাড়াও রিমির হাত ধরে নিখিলেশ ওকে আরও বলেছেন যে দিল্লিতে ওঁর পিসি-পিসেমশাইয়েরা সব থাকেন। ওঁর পিসতুতো ভাইয়ের নাকি মোটামুটি রিমিরই আশেপাশে বয়স। কাজেই রিমি যদি পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করতে দিল্লিতে যাওয়ার কথা ভাবে, উনিই ওর যাতায়াত, থাকা-খাওয়ার সমস্ত ব্যবস্থা করে দেবেন। এমনকি কাফেটেরিয়াতে কফি আর স্যান্ডুইচের দামটাও উনি রিমিকে মেটাতে দেননি। বরং মিষ্টি করে প্রায় একটা ধমকই দিয়েছেন রিমিকে। বেরুবার সময় তাড়াহুড়োতে রেস্টরুমগুলোর সামনে ঝুমুরের সঙ্গে নিখিলেশের প্রায় একটা ধাক্কা লাগতে যাচ্ছিল। শেষ মুহূর্তে নিজেকে অদ্ভুত কায়দায় সামলে নিয়ে অত্যন্ত ভদ্রভাবে ঝুমুরের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন ভদ্রলোক। রিমির এখন অনেকটা নিশ্চিন্ত লাগছে।
***
–রিমি! তুমি এখানে?
হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য রিমি ওর ফোন থেকে একটা ক্যাব বুক করতে চেষ্টা করছিল। এমন সময় সিলভার গ্রে কালারের আধপুরনো হন্ডা সিটিটা হঠাৎ ওর সামনে এসে দাঁড়াল।
–সুশান্তদা তুমি! রিমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
–আরে উঠে এসো, উঠে এসো তাড়াতাড়ি। বাড়ি যাচ্ছ তো? সিগনাল খোলা আছে এখন, সামনের দরজাটা ঝুঁকে পড়ে খুলে দিতে দিতে সুশান্ত বলে ওঠে— পিছনে নয়, সামনে সামনে। পিছনের গাড়ি হর্ন দিচ্ছে, রিমি চটপট!
গাড়িতে আসতে আসতে সুশান্ত মুখ বুজে সবটা শুনে যায়। কোনও মন্তব্য করে না। বাড়ির সামনে রিমিকে নামাতে নামাতে শুধু বলে— এই গাড়িটা এখন আমাদের ফুড ডেলিভারির কাজে লাগে। তোমার যদি দরকার হয় শুধু জানিও। সকালে তুমি কখন হাসপাতালে যাবে জানি না। ফেরার সময় তো ডেফিনিটলি আমি তোমাকে তুলে আনতে পারি। ওই রুটেই আমাদের বেশ কিছু ক্লায়েন্টস আছে। সো, চিন্তা কোরো না একদম। কেমন?
রিমি আলতো হেসে মৃদু একটা থ্যাঙ্কস জানিয়েছিল কেবল। সমস্ত ক্রাইসিসটা যে, সে এতটা স্মুথলি হ্যান্ডল করতে পারবে, রিমির এটা বিশ্বাস হচ্ছিল না।
এক সপ্তাহ কেটে গেছে। কাল সমীরকে ডিসচার্জ করবে। মেডিকেল এ্যালাওয়েন্স হিসেবে ওর কোম্পানি থেকে সমীর যা পায় তার থেকে সতেরশো টাকা মতো বেশি বিল হয়েছে। নিখিলেশ সেন বলেছেন কোম্পানি সবটাই এ্যাডজাস্ট করে দেবে, রিমিদের এক পয়সাও হাসপাতালে পেমেন্ট করতে হবে না। এছাড়া সমীরের ব্যাপারটা নিয়ে উনি ওঁর এইচআর টিমের সঙ্গে ইতিমধ্যেই কথা বলেছেন, দরকার হলে চেন্নাইতে কোম্পানির যিনি এমডি আছেন, তাঁকেও উনি পার্সোনালি রিকোয়েস্ট করবেন। রিমি-সমীরের মা বাবার সঙ্গেও একদিন ওদের বাড়িতে এসে নিখিলেশ দেখা করেছেন। এদিকে রিমির সঙ্গে ঝুমুরের বেশ ভাব হয়ে গেছে। রোজ রোজ কাফেটেরিয়ার খাবার খাওয়া রিমির পক্ষে সম্ভব ছিল না। শেষ তিনচারদিন টিফিন ক্যারিয়ারে করে বাড়ি থেকে ভাত নিয়ে আসত সে। ঝুমুর কাছেই একটা খোলা ভাতের হোটেলে ওকে নিয়ে যেত। তরকারি বা মাছ জাতীয় একটু কিছু সেখান থেকেও সে নিয়ে নিত ভাতের সঙ্গে। দুজনে মিলে একসঙ্গে খেত। কাঁটা বেছে রিমি পাতে রাখত। ঝুমুর মাটিতে ফেলত। একটা হুলো বেড়াল এসে সেগুলো খেত। ঝুমুর বলত— তোমার পাতের কাঁটাগুলোও ওর পেটেই শেষমেশ যাবে গো দিদিমণি, আমি আগেভাগে দিয়ে দিই কেবল। নাহলে যদি দোকানদার ওর থেকেও কমিশন কাটে, বলেই হিহি করে হেসে গড়িয়ে পড়ত ঝুমুর। দোকানের মালিকও কপট রাগের চোখে ওর দিকে তাকাত। কেমন যেন একটা হাড় বের করা চেহারা, ফাটা গেঞ্জি আর ময়লা হাফপ্যান্ট পরা বুড়োগোছের একটা লোক। চোখদুটো সবসময় জ্বলজ্বল করছে। কমিশন কথাটা শুনলেই লোকটার চোখেমুখে কীরকম যেন একটা বিশ্রী হাসি ফুটে উঠত। রিমি অতটাও খেয়াল করত না। ঝুমুরের কথা শুনে ও বুঝেছে কমিশনের দাপট সর্বত্র। সবকিছুতে, সবজায়গাতেই এখন কমিশন চলে। চলে আসার সময় রিমি দেখত যে বেঞ্চিতে বসে ওরা খেয়েছে তার নীচে মাটির উপরে উপরে দু-এক টুকরো ভাত পড়ে আছে। সাদা নয়, ভাতগুলো হলুদ।
–সুশান্তর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে রে, রিমির হাতদুটো ধরে ওকে বলে সমীর।
–তোর নিখিলেশদা তো বলেছেন যে উনি ঠিক একটা কিছু ব্যবস্থা করবেন। তাহলে তুই এই নিয়ে এত চিন্তা করছিস কেন? সে দাদাকে জিজ্ঞেস করে।
–নিখিলেশদা যে সুশান্তকেও একই কথা বলেছিল গতবছর।
রিমি চুপ করে যায়।
–আসলে আমাদের ভ্যাকসিনেশন হয়ে যাওয়াটা দরকার ছিল বোধহয়, সমীর আপন মনে বলে চলে— ভ্যাকসিন কথাটার মানে জানিস তো রিমি? ওর মানে হচ্ছে প্রতিষেধক। সমাজের সমস্ত মিথ্যে, অভিনয়, আশ্বাসের বিরুদ্ধে নিরুত্তাপ হয়ে কাজ করে চলার প্রতিষেধক। বিশ্বাস করতে বাধা নেই, কিন্তু সেই বিশ্বাস ভাঙলে যেন ভেঙে না পড়তে হয়, সেই ভেঙে পড়ার বিরুদ্ধে প্রতিষেধক। আর সমস্তরকম অন্যায়কে শুষে নিয়ে এগিয়ে চলার প্রতিষেধক। সেই নোংরা আবর্জনাগুলোকে শরীরের সেই প্রতিষেধক শুষে নেবে। আর তার নেগেটিভ এফেক্টগুলোকে কাজ করতে দেবে না। শুধু নিজের কাজটুকুকে বুঝে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। সমাজের অন্ধকারগুলোর বিরুদ্ধে আনপারটার্বড হয়ে সারভাইভ করে যাওয়ার প্রতিষেধক, সমীর হাসে, অন্ধকারগুলোর বিরুদ্ধে আনপারটার্বড থাকতে হলে যে প্রতিষেধক ছাড়া গতি নেই। সমীর খাটের ওপরে উঠে বসে— যেদিন চাকরিতে প্রথম প্রোমোশন পেয়েছিলাম সেদিনই এই ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ আমার শরীরে ঢুকেছিল। আজ বুঝতে পারছি। এই টার্মিনেশন লেটারটার মধ্যে দিয়ে ডোজ কমপ্লিট হল আমার। তোর ডোজ শুরু হতে বোধহয় বাকি আছে এখনও। কিন্তু আবার, কে জানে হয়তো বা ভিতরে ভিতরে অলরেডি সেসব নেয়া হয়ে গিয়ে তার কাজও শুরু হয়ে গেছে। কেউ জানতে পারে না এসব। সমীর হাসে আবার— ভুল বকছি আমি। তাই না রে?
রিমি দাদার হাতের উপরে হাত রেখে বলল— ঘুমো এখন। কাল ছুটি করে বাড়ি নিয়ে যাব।
সমীর আবার একগাল হেসে বিছানায় শুয়ে পড়ে। রিমি আরও খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল।
***
মাসখানেক কেটে গেছে। সুশান্ত আর রিমি ফিরছিল। এখন সন্ধের দিকে খাবার ডেলিভারিগুলো করবার সময় রিমি সুশান্তকে সাহায্য করে। সমীর বেশ একটা মোটা টাকাই ইনভেস্ট করেছে সুশান্তর ইনিশিয়েটিভটায়। ফিফটি-ফিফটি পার্টনারশিপে কাজ হচ্ছে। শুধু সন্ধেটা রিমিকে কখনও-সখনও দরকার পড়ছে এই ডেলিভারিগুলোর জন্য। একটু হাত লাগাতে হচ্ছে। নয়তো সকালে কখনও সমীর অথবা কখনও পাড়ার একটি ছেলে আছে সে, এরা সুশান্তের সঙ্গে হাত লাগিয়ে দুপুরের ডেলিভারিগুলো ঠিক করে ফেলে। সন্ধেয় আবার সমীরের ইন্টারভিউ পড়ে মাঝে মাঝে। তাকে নিজেকেও একটু পড়াশুনোর মধ্যে থাকতে হয়। রিমি তার পড়াগুলোকে সব পালটে সকালে করে নিয়েছে। গাড়িটা সিগনালে দাঁড়াল। সুশান্ত তার হাতটা রিমির পায়ের উপরে আলতো করে রেখেছে। হাঁটুরও ওপরে।
হাতটা একটু উঠল।
–তিন হাজার ছশো একুশ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু-কিশোর, এই প্যানডেমিকের দ্বিতীয় ঢেউতে মা-বাবাকে হারিয়ে সম্পূর্ণ অনাথ হয়ে গেছে। মা অথবা বাবার মধ্যে অন্তত একজনকে হারিয়েছে ছাব্বিশ হাজার জন। অল উইদিন এ মান্থ, সুশান্ত রিমির দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকায়। ওর হাতটা আরও একটু উঠল। কিছুদূরে ফুটপাথের উপরে একটা সাইকেল রিকশ দাঁড়িয়ে। রংজ্বলা কাপড়ের সিটটার উপরে শরীরটাকে হেলিয়ে দিয়ে চালকের বসার জায়গাটায় পা রেখে, রিকশওয়ালাটা ঝিমোচ্ছে। অন্ধকার। সিগনালের আলো লাল থেকে হলুদ হয়। রিমির এখন এসবে অভ্যেস হয়ে গেছে। ও এখন ভ্যাকসিনেটেড। পুরোপুরি ভ্যাকসিনেটেড। সুশান্তর হাতটা আরও খানিক উপরে উঠে এল…