সুরজিৎ দেব রায়
অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক; কবি, প্রাবন্ধিক, গল্পকার; সমাজকর্মী
পূর্বকথন
সমাজ পরিবর্তন ও বিকাশের ধারায় বিশ্বব্যাপী সামন্তশাসন বিলুপ্তির পথ ধরে বা ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের পথ ধরে, আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে এবং সামন্তপ্রভুদের প্রজা শব্দটির বিলুপ্তি ও ওই রাষ্ট্রের অধীনে সমস্ত মানুষের সমান অধিকার সম্বলিত ঐতিহাসিক নাগরিক শব্দটির জন্মলাভ ঘটেছে। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে ভারতবর্ষে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তিস্থাপন হতে থাকে। এরপর ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার প্রশ্নে ভারত বিভাজনের মধ্য দিয়ে ভারত ও পকিস্তান (পূর্ব, পশ্চিম) দুটি পৃথক রাষ্ট্রের জন্ম নেয়। অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে ১৫ আগস্ট দেশ স্বাধীন হওয়ার মুহূর্ত থেকে ভারতের ভৌগোলিক সীমানায় কয়েকটি দেশীয় রাজ্য ছাড়া অবশিষ্ট ব্রিটিশ অধীনস্থ এলাকার মানুষেরা সরাসরি স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের নাগরিক হয়ে পড়ল। দেশীয় রাজ্য বলতে বোঝায় ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্গত মৌখিকভাবে সার্বভৌম রাজ্য। ব্রিটিশরা সরাসরি এসব রাজ্য শাসন করত না। এসব রাজ্য ব্রিটিশ আধিপত্য মেনে নিয়ে স্থানীয় শাসক রাজা-মহারাজার অধীনে পরিচালিত হত। সমগ্র ভারত জুড়ে এরকম ৫৫৬টি দেশীয় রাজ্যের মধ্যে কেবলমাত্র ২১টিতে বাস্তবিক সরকার ছিল, যার মধ্যে চারটি ছিল বৃহত্তম— হায়দ্রাবাদ, মহীশূর, বরোদা ও কাশ্মির। ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯-এর মধ্যে এসব দেশীয় রাজ্য নবগঠিত স্বাধীন রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের সাথে একীভূত হয়ে যায়। অর্থাৎ ঐ দেশীয় রাজ্যগুলি ভারত বা পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তি ঘটায় সেখানকার মানুষেরা আর কোনও রাজার প্রজা হিসাবে থাকল না, ভারতের বা পাকিস্তানের নাগরিকত্ব অর্জন করল। প্রায় একই সময়ে দেশবিভাজন ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় আতঙ্কিত ও বিধ্বস্ত বহু মানুষ নিজ পিতৃভূমি চিরদিনের মতো ছেড়ে দেশ পরিবর্তন করল। সুতরাং ভারতের নাগরিকত্বের প্রশ্নটি বাস্তব অবস্থাতেই ছিল। বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রেরই নাগরিকত্ব আইন আছে, যার সুবাদে পাসপোর্ট ও ভিসা নির্ধারিত হয়। পাসপোর্ট ভিন্ন অন্য দেশে পদার্পণ আন্তর্জাতিকভাবেই বেআইনি। কোনও ফৌজদারি মামলায় জড়িয়ে গেলে এদের বিচার হয় সেদেশের আইনানুযায়ী, অন্যদের স্থান হয় ডিটেনশন ক্যাম্পে, পরে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের সঙ্গে কথা বলে তাদের ফেরত (পুশব্যাক) পাঠানো হয়।
সুতরাং ভারতবর্ষের সংবিধান রচয়িতাদের সামনে নাগরিকত্বের বিষয়টি নির্দিষ্ট করা এবং তার ভিত্তিতে জাতীয় নাগরিক পঞ্জিকরণ কেন্দ্রীয় সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। ১৯৫০ সালে গৃহীত সংবিধানের ১১ নং ধারায় নাগরিক নিয়ে আইন তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হল সংসদের ওপর। তারপর ১৯৫৫ সালে ভারতের সংসদে নাগরিকত্ব আইন গৃহীত হয়। ওই সম্পর্কিত বিলটি সংসদে পেশ করার সময়, ১৯৫৫ সালের ৫ আগস্ট তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গোবিন্দ বল্লভ পন্থ বলেছিলেন, “ভারতে যার জন্ম সেই ভারতের নাগরিকত্ব পাবে, এটাই যুগের দাবি। সভ্য জগতে আমরা এই মানসিকতা ও পরিবেশকেই উপহার দিতে চাই।”
সংসদে অনুমোদিত নাগরিকত্ব আইনে (১৯৫৫) উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্বের অধিকার দেওয়া হল। এর ৫ নং ধারায় বলা হল— যে ব্যক্তির মা অথবা বাবা অবিভক্ত ভারতে জন্মেছিলেন, যাকে বলা হয় ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তি, তিনি উপযুক্ত ফর্মে আনুষঙ্গিক প্রমাণপত্র সহ আবেদন করলে ভারতের নাগরিক বলে গণ্য হবেন। অর্থাৎ ভারত বিভাজনের ফলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যারা উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাদের নাগরিকত্ব পাওয়ার সমস্যা রইল না।
কিন্তু মূল বিষয় দাঁড়াল নাগরিকত্ব আইন তৈরি এবং মন্ত্রীমহাশয়দের ভাষণ যতই বর্ষিত হোক নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র দেওয়ার কোনও বিধিব্যবস্থা ছিল না। ২০০৩ সালে নাগরিক আইন সংশোধন করে তা বাধ্যতামূলক হওয়ার পরও সরকার সে কাজে হাত দেয়নি। সাধারণত পাসপোর্ট তৈরি করার সময় সংশ্লিষ্ট অফিসে রেশন কার্ড, ভোটার আইডিন্টিটি কার্ড, আধার কার্ড, প্যান কার্ড ইত্যাদির ভিত্তিতে কাজ চলে যায়। এছাড়া আমাদের কোনও কাজে নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র লাগে না, আমরাও তা নিয়ে এতদিন ভাবিনি। সেখানে ২০১৪ সালে বিজেপি কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে আপামর ভারতবাসীর মনে তার নাগরিকত্ব প্রশ্ন নিয়ে ঘন আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে বিজেপির অন্যান্য মন্ত্রী-নেতারা নাগরিক পঞ্জিকরণ নিয়ে নানারকম ভয় দেখিয়ে চলেছে। অথচ নাগরিকত্ব আইন গৃহীত হওয়ার পর বিশেষ রাজনৈতিক কারণে একমাত্র অসমেই নাগরিক পঞ্জিকরণের কাজ হয়েছে। যে পঞ্জিকরণের কাজ চলার সময় অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে ও ডিটেনশন ক্যাম্পের ভয়ে প্রায় ৩৯ জন মানুষ আত্মহত্যা করেছে, ভয়ে-ভাবনায় অসুস্থ হয়ে পড়েছে বহু মানুষ। শেষমেশ ৩০ জুলাই, ২০১৮ সালে, খসড়া নাগরিক পঞ্জিকরণ তালিকায় ৪০ লক্ষ মানুষ বেনাগরিক হয়ে যায়, এবং তাতে উল্লসিত হয়ে বিজেপি ও তার সহ-অনুগামী দলগুলি ওই তথাকথিত বেনাগরিকদের ডিটেনশন ক্যাম্প বা দেশ থেকে বহিষ্কারের হুঙ্কার ও তার প্রচারে সমগ্র দেশের মানুষের মনে প্রচণ্ড ভয়ের আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। তারই প্রতিবাদে সমগ্র দেশ জুড়ে আওয়াজ উঠেছে বন্ধ করতে হবে মানুষকে সন্ত্রস্ত করার রাজনীতি। আধার কার্ড, রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড, প্যান কার্ড কোনওটাই নাগরিকত্বের প্রমাণ নয় ইত্যাদি শব্দবাণ কেবলমাত্র মতুয়া ও মুসলমানদের ঘুম কেড়ে নিচ্ছে তা নয়, কয়েক লাখ তামিল, বনাঞ্চলের ১৫ কোটি মানুষ, নিরক্ষর শ্রমিক ও ভূমিহীন কয়েক কোটি মানুষও আতঙ্কিত। অথচ ভোটার আইডেন্টিটি, রেশন কার্ড, আধার কার্ড, প্যান কার্ড ইত্যাদিগুলির ভিত্তিতেই তৈরি হয় পাসপোর্ট এবং সেই পাসপোর্ট নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসাবেই স্বীকৃত। আর বাস্তব ঘটনা হল অসমের নাগরিক পঞ্জিকরণের সঙ্গে সংশোধিত নাগরিক আইন (২০১৯)-এর কোনও সম্পর্ক নেই। অসমের ঘটনাসমূহ নাগরিকত্ব প্রশ্নে একটা নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে, নাগরিকত্ব নিয়ে হইচইয়ের সূত্রপাতও সেখান থেকেই।
মনে রাখতে হবে ১৯৫৫ সালে গৃহীত মূল নাগরিকত্ব আইনটি পরবর্তী ১৯৮৬, ২০০৩, ২০০৫, ২০১৫ সালগুলিতে মোট চারবার সংশোধিত হয়েছে এবং সর্বশেষ হল এই ২০১৯-এর সংশোধনী। পঞ্চম সংশোধনী। আর ঘটনা হল ১৯৫৫ সালে নাগরিকত্ব আইন গৃহীত হওয়ার আগে, ১৯৫১-৫২ ভারতে প্রথম লোকসভার নির্বাচনে, ২১ বছর (১৯৮৮ সালে সংশোধিত হয়ে ১৮) এবং তদূর্ধ্ব বয়সের নাগরিকদের ভোটার তালিকাও একটি বৈধ নাগরিকপঞ্জি, কারণ বৈধ নাগরিকরাই কেবল ভোটার হতে পারেন। লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচন পরিচালনার জন্য রয়েছে নির্বাচন কমিশন। নিয়মমাফিক ভোটার তালিকা সংশোধন, সংযোজন, বিয়োজন ইত্যাদি বছরের পর বছর হয়ে আসছে। সেই ভোটার তালিকা ও জাতীয় নাগরিকপঞ্জি সংরক্ষিত রাখা এবং নির্দিষ্ট সময়ান্তরে তার আপগ্রেডেশন করা কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব।
বাংলাদেশের জন্ম ও বাংলাদেশ থেকে চলে আসা উদ্বাস্তু সমস্যা
১৯৭২ সালে জন্ম নিল বাংলাদেশ। পূর্ব-পাকিস্তান বলতে আর কিছু রইল না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা-বিরোধী রাজকার বাহিনির নৃশংস নিপীড়ন ও অত্যাচারে বহু বিপদগ্রস্ত মানুষ নিজ পিতৃভূমি ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল, এদের উদ্বাস্তু বলে চিহ্নিত করা হয়নি, এবং এদের জন্য কেন্দ্রীয় ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কোনও প্রকল্প নেই, এদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কোনও বিধি ছিল না। পরিস্থিতি অনুকূল বুঝে এদের অনেকে বাংলাদেশে ফিরে গেছে, অনেকে ভারতে বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে বসবাস করছে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে। এবং স্বাভাবিক কারণে বাংলাদশ থেকে আসা ঐ উদ্বাস্তুদের বড় অংশই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে আছে। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের সংগঠনগুলি নাগরিকত্বের দাবি তুলেছে। বিভিন্ন সময়ে সিপিএম ঐ দাবীকে সমর্থন জানিয়েছে। ২৯ ডিসেম্বর ২০১০ মতুয়া মহাসংঘের এক জনসভায় সিপিএমের গৌতম দেব সরব হয়েছিলেন। সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট ২২ মে, ২০১২, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে এক চিঠিতে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতিতদের নাগরিকত্বের আবেদন করেছেন এবং সিপিএমের ২০তম পার্টি কংগ্রেসেও এই প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। কংগ্রেসের মানস ভুঁইয়া ঐ দাবীকে সমর্থন করেছিলেন। তৃণমূল কংগ্রেসও এই দাবীকে সমর্থন করেছে। নাগরিকত্বের ৬ নং ধারায় বলা হয়েছে যে যারা অবিভক্ত ভারত থেকে বর্তমান ভারতে ১৯ জুলাই ১৯৪৮-এর মধ্যে এসেছেন তারা ভারতের নাগরিক। সুতরাং ১৯৭১ সালে বাংলাদশ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের ভারতের নাগরিক হিসাবে নাম নথিভুক্ত করতে হলে নাগরিকত্ব আইনকে তদুনুরূপ সংশোধন করতে হবে।
১৯৫৫ সালে গৃহীত মূল নাগরিকত্ব আইনটি লোকসভায় যে চারবার সংশোধিত হয়েছে, প্রতিটি সংশোধনে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব পাওয়ার বিষয়টিকেই সংশোধিত করা হয়েছে, কোনওটিতেই ১৯৪৮-এর পর আসা উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্বের বিষয় ছিল না। ঐ চারবার সংশোধিত হয়ে যা দাঁড়িয়েছে তা হল— (ক) ২৬ জানুয়ারি ১৯৫০, বা তার পরে ১ জুলাই ১৯৮৭-এর আগে যাঁদের ভারতে জন্ম তাঁরা ভারতের নাগরিক; (খ) ১৯৮৭ সালের ১ জুলাই বা তার পরে এবং ২০০৪ সালের ৩ ডিসেম্বরের আগে যাঁদের জন্ম ভারতে তাঁরা জন্মসূত্রে ভারতীয় নাগরিকত্ব পাবেন না, পেতে হলে তাঁদের পিতা-মাতার যে কোনও একজনকে সন্তানের জন্মের সময় ভারতের নাগরিক হতেই হবে; (গ) ২০০৪ সালের ৩ ডিসেম্বর বা তার পর যাদের ভারতে জন্ম তাঁদের পিতা-মাতা দুজনকেই সন্তানের জন্মের সময় ভারতীয় নাগরিক হতে হবে। উত্তরাধিকার সূত্রে নাগরিকত্ব বিষয়ে আইনে বলা আছে— ১৯৫০ সালের ডিসেম্বর বা তার পরে যদি কেউ ভারতের বাইরে জন্মগ্রহণ করেন তবে তিনিও ভারতের নাগরিকত্ব পেতে পারেন যদি তার জন্মের সময় তাঁর বাবা বা মায়ের মধ্যে যে কোনও একজন ভারতের নাগরিক হন। উত্তরাধিকার সূত্রে নাগরিকত্বের জন্য পিতা-মাতার নাগরিকত্বের প্রমাণ জরুরি, এই প্রমাণ ছাড়া কেউ উত্তরাধিকার সূত্রে ভারতীয় নাগরিকত্ব দাবি করতে পারবেন না।
২০১৯ সালে সর্বশেষ সংশোধনী আইনে বলা হল আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি, খ্রিস্টান মানুষ যারা ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪-র আগে ভারতে এসেছে এবং কেন্দ্রীয় সরকার যাদের পাসপোর্ট এবং বিদেশি আইন দুটোতেই ছাড় দিয়েছে তাঁরা অবৈধ অনুপ্রেবেশকারী বলে গণ্য হবে না। এরা নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারে। এই আইনের মাধ্যমে ২০১৪ সালের আগে উদ্বাস্তু হয়ে আসা একটা বিরাট অংশের মানুষকে নাগরিকত্বের মর্যাদা দেওয়ার ব্যবস্থা হলেও, মুসলমান ধর্মাবলম্বী উদ্বাস্তুদের প্রতি রাষ্ট্রীয় বিদ্বেষ পরিলক্ষিত হয়েছে। সংশোধনীটির মধ্যে দিয়ে মুসলিমবিরোধী মানসিকতাকে উস্কে দেওয়া হয়েছে, ধর্মের ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে বিভাজন এনে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের কাঠামোকে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। সংশোধিত আইনটির মধ্য দিয়ে আরএসএস, বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, শিবসেনা, বজরং দল ইত্যাদি উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির মুসলিম-বিদ্বেষ এবং এদেশ থেকে মুসলমান বিতারণের জিগিরকে মদত দেওয়া হয়েছে। মনে রাখতে হবে ব্রিটিশ আমলে শাসকদল নানারকম ফন্দিফিকির করে যেমন হিন্দু-মুসলমান ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়েছে তেমন জাতি-বিদ্বেষও ছড়িয়েছে, যার ফলে ১৯৪৮ সালে অসমের বিভিন্ন অংশে অসমিয়া-বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে একটা জাতিগত দাঙ্গা ঘটেছিল। অসমে বাঙালি অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে এই ধরনের দাঙ্গার একটা উত্তাপ প্রায় সবসময় মানুষকে ঘিরে রয়েছে বছরের পর বছর। সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে যে যখন পেরেছে এই জঘন্য বিকৃত মননকে উস্কে দিয়েছে। এরই প্রেক্ষাপটে অসমের নাগরিক পঞ্জিকরণের তিন দশকের ঘটনাবলি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
অসমে নাগরিক পঞ্জিকরণ
১৯৬০-৭০ সময়টাতে উত্তর-পূর্ব ভারতে বাঙালিদের প্রতি অসমিয়াদের জাতি-বিদ্বেষমূলক একটি সংগঠিত অভিযান হয়েছিল যা অসমের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়েছিল। অসমের বরাক উপত্যকা বাংলাভাষী অধ্যুষিত। ১৯৬০ সালে কংগ্রেস সরকার অসম রাজ্যে একমাত্র অসমিয়া ভাষাকে সরকারি কাজে স্বীকৃতি দেয়। যার ফলে বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে উত্তাল ভাষা আন্দোলন গড়ে ওঠে, পুলিশের গুলিতে এগারোজন শহিদের মৃত্যুবরণ করেন। এবং প্রায় একই সময়ে অসমে ‘বাংলা খেদা’ আন্দোলনও বিস্তার লাভ করে। তারপর বাংলাদেশের স্বাধীনতা লড়াইয়ের সময় সেখান থেকে বহু মানুষ ভিটেমাটি ছেড়ে সীমানা অতিক্রম করে অসমেও শরণার্থী হয়ে ঢোকে। স্বাধীন বাংলাদেশ স্থাপনের অব্যবহিত পরে, ঐ শরণার্থীদের বিদেশি তকমা দিয়ে, বিদেশি বিতারণের নামে ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত আসু-র (All Assam Sudens Unon) নেতৃত্বে বিদেশি বিতারণ আন্দোলন উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে। ১৯৮০ নাগাদ অসম সংলগ্ন অন্যান্য রাজ্য যেমন মেঘালয় ও ত্রিপুরাতেও এই আবহাওয়া তৈরি হয়। আসুর আন্দোলনের ফলে প্রায় ৫০,০০০ বাঙালি অসম ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে মাথা গোঁজার ঠাই করে নেয়। আর আসুর নেতৃত্বে সেই আন্দোলনের ফসল হল ১৯৮৫ সালের অসম চুক্তি। রাজীব গান্ধি তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী। সেই চুক্তি অনুসারে আইনিভাবে অসমের ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য কাটঅফ ইয়ার ও ডেট হল ২৪ মার্চ, ১৯৭১। সিদ্ধান্ত হল ওই তারিখটিকে ভিত্তি করে অসমে নাগরিক পঞ্জিকরণ (এনআরসি) তৈরি করতে হবে। ঐ চুক্তিকে কার্যকরী করতে নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনের মধ্য দিয়ে ৬(ক) ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা শুধুমাত্র অসমের জন্যই প্রযোজ্য, এবং এটাকে কার্যকরী করার জন্য একটি ট্রাইবুনাল গঠিত হয়। সংশোধিত আইনে বলা হল, ২৪ মার্চ, ১৯৭১ সালের পর যাঁরা ভারতে এসেছেন তাঁদের আর ভারতীয় নাগরিক হিসাবে স্বীকার করা হবে না, থাকবে না তাঁদের ভোটাধিকার। চুক্তির প্রায় ২০ বছর পর নাগরিক পঞ্জিকরণের জন্য গঠিত ট্রাইবুনালের মাধ্যমে ২০০৫ সালে শুরু হয় এনআরসি পাইলট প্রজেক্ট অসমের কয়েকটি অঞ্চলে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারে তিনবার পরিবর্তন হয়ে গেছে, এবং ২০০৩ সালে বিজেপির অটলবিহারী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন নাগরিকত্ব আইনেরও আর একবার সংশোধন হয়ে গেছে।
পাইলট প্রজেক্টের সিদ্ধান্ত হল ১৯৫১ বা ১৯৭১ সালের নথি ছাড়া আর কোনও নথি নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসাবে গণ্য করা হবে না। তীব্র আন্দোলনের চাপে ঐ পাইলট প্রজেক্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপরের দশ বছর এনআরসির কোনও কাজ হল না সঙ্কীর্ণ ভোটের স্বার্থে। যারা পাসপোর্ট ছাড়া অসমে ঢুকেছে এবং নিজ ব্যবস্থাতেই হোক বা আত্মীয় বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতেই হোক কোনও না কোনও স্থানে বসবাস করছে এবং যাদের বিরুদ্ধে ভারতে কোনও রাজ্যে ফৌজদারি মামলা নেই, তাদের বিদেশি বলে চিহ্নিত করা সব সময়েই প্রশাসনের নিয়মমাফিক কাজ। সেই হিসাবে অসমে ফরেনার্স ট্রাইবুনালে ১৯৭১ সালের পর থেকে বিদেশি সন্দেহে মামলা হয়েছে ২৯৮৪৭১টি এবং বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ১৩৯৯০ জন। তাদের মধ্যে ২৯৯৮৪ জনকে বিতারণ করা হয়েছে। অসমে ডিটেনশন ক্যাম্প চালু হয়েছিল ২০০১ সালে। স্ব স্ব দেশের সঙ্গে যোগাযোগের ভিত্তিতে ৩২১ জনকে ওই ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে তাদের নিজেদের দেশে পাঠানো হয়েছে। ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত ২৫৫১ জনকে ওই ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখা হয়েছে। কোভিড সংক্রমণের কারণে সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের নির্দেশে এই ক্যাম্পগুলি থেকে ৭৫৪ জনকে জামিনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে অসমে ৬টি সেন্টারের মোট বন্দির সংখ্যা ১৮১ জন। বিভিন্ন কারণে মারা গিয়েছে ২৯ জন। বিদেশি তকমা দিয়ে যেভাবে মানুষকে বন্দি করে রাখা হয়েছে তার বিরুদ্ধে মানবাধিকার সংগঠনগুলি সোচ্চার হওয়ায় বিষয়টি যখন সুপ্রিম কোর্টে বিবেচিত হচ্ছে তখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন ভারতে কোথাও ডিটেনশন ক্যাম্প নেই। প্রধানমন্ত্রীর দাবীকে মর্যাদা দিতে ঐ ডিটেনশন ক্যাম্পের নাম পরিবর্তন করে বলা হচ্ছে, ‘ট্রানজিস্ট ক্যাম্প ফর ডিটেনশন পারপাস’।
ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যেও মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে রাজনীতির ফায়দা তুলতে বিদেশিদের চিহ্নিতকরণ ও বিতারণ করার দাবি বারবার উঠেছে। ২০০০ সালে বিজেপির অটলবিহারী বাজপেয়ি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন উত্তরাখণ্ডের দিনেশপুর রুদ্রপুর অঞ্চলে পুনর্বাসনপ্রাপ্ত বাঙালি ছাত্রছাত্রীদের ডোমিসাইল সার্টিফিকেট ব্যতিরেকে স্কুল-কলেজে ভর্তি নিতে অস্বীকার করে। ওডিশার কেন্দ্রপারার মহাকাল ব্লকে ১৫৫১ জনকে দেশত্যাগের নোটিস ধরিয়ে দেওয়া হয়। একইভাবে আন্দামান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় ইত্যাদি রাজ্যে পুনর্বাসনপ্রাপ্ত কিছু গ্রাম আক্রান্ত হয়। ওই সময়ে বিজেপির জোট এনডিএতে তৃণমূল ছিল এবং তখন পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের নেতৃত্বে রাজ্য সরকারের পরিচালনায় ভোটার লিস্টে কেন বাংলাদেশিদের নাম থাকবে এই প্রশ্ন তূলে নাগরিকত্বের বিষয় নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস খুবই সোচ্চার হয়েছিল। যাকে ভিত্তি করে মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, বর্ধমান ইত্যাদি জেলায় পুলিশি তৎপরতায় মানুষ সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। ফলে ২০০৩ সালে নাগরিকত্ব আইন সংশোধিত হয়। ২০০৩ সালে সংশোধিত আইনে বলা হয় বৈধ পাসপোর্ট ও ভিসা নিয়ে যারা ভারতে প্রবেশ করেনি, তারা সকলেই অনুপ্রবেশকারী। তারা কেউ নাগরিকত্ব অর্জনের আবেদন করার যোগ্য হবে না। এমনকি তাদের সন্তান এদেশে জন্মাগ্রহণ করলেও তারা নাগরিকত্ব পাবে না। বাংলাদেশের অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করার জন্য বলা হল বাবা এবং মা উভয়ই ভারতের নাগরিক হলে, তাদের যে সন্তান ২০০৩-এর ৩ ডিসেম্বর বা তারপর জন্মেছে তারা নাগরিকত্ব প্রাপ্তির আবেদন করতে পারে, বাবা-মাকে কিছুতেই অনুপ্রবেশকারী হলে চলবে না। আইনানুসারে ১৯৪৮ সালের ১৯ জুলাইয়ের পর আসা সকলেই এর অন্তর্ভুক্ত। এর ফলে উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেওয়া বন্ধ হলে তারা মহা সমস্যায় পড়লেন। আবার ২০০৫ সালে একটি স্বতন্ত্র রুল জারি করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যে সব হিন্দু পরিবার রাজস্থান, গুজরাটে আশ্রয় নিয়েছে এবং পাঁচ বছর সেখানে বসবাস করছে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হল। এর মধ্যে অন্য কোনও জায়গা থেকে আসা উদ্বাস্তুদের সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। এছাড়া ২০০৩ সালে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে সমগ্র ভারত জুড়ে নাগরিক পঞ্জিকরণ বাধ্যতামূলক করা হল। কিন্তু ঘটনা হল অসম রাজ্য ব্যতীত অন্য কোনও রাজ্যে এর কাজ শুরু হয়নি।
অসমে নাগরিক পঞ্জিকরণ বন্ধ হয়ে যাওয়া নিয়ে অসম পাবলিক ওয়ার্কস নামে একটি সংগঠন কর্তৃক জনস্বার্থ মামলার প্রেক্ষাপটে সুপ্রিম কোর্ট এনআরসির কাজে হস্তক্ষেপ করে। সুপ্রিম কোর্ট ২০০৫ সালের ট্রাইব্যুনেলকেই অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করে এবং ২০১৩ সাল থেকে সুপ্রিম কোর্টের মনিটরিং-এ অসমে নাগরিক পঞ্জিকরণের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার সর্বোচ্চ পর্যায়ে এক আমলার অধীনে কর্মীবাহিনি নিযুক্ত করে। নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ছিল— (১) ১৯৫১ সালে তৈরি প্রথম ভোটার লিস্ট সহ ২৪ মার্চ, ১৯৭১-এর মধ্যরাত (ডেট লাইন) পর্যন্ত প্রস্তুত যে কোনও ভোটার লিস্টে তার নাম থাকতে হবে; (২) ১৯৫৫ সালে প্রস্তুত এনআরসিতে তার নাম থাকতে হবে; (৩) ১ নং ও ২ নং তালিকায় নাম না থাকা ব্যক্তির পরবর্তী প্রজন্মের উপযুক্ত গ্রহণযোগ্য দলিল দিয়ে প্রমাণ করতে হবে।
নির্দেশে থাকলেও বিস্ময়করভাবে ১৯৫১ সালের অসম রাজ্যের ভোটার তালিকা এবং ১৯৫৫ সালে নাগরিক পঞ্জিকরণ খুঁজেই পাওয়া গেল না। এর পরে দরকার ছিল বিভিন্ন সময়ে এগুলির আপগ্রেডেশন, যা করলে অসমের মানুষদের এরকম দুর্ভোগের সামনে পড়তে হত না। যার ফলে দায়িত্বপ্রাপ্ত আমলাদের মস্তিষ্কপ্রসূত এনআরসি হয়ে দাঁড়ালো এক জটিল প্রক্রিয়া। সাধারণ মানুষের পক্ষে গোটা প্রক্রিয়া বুঝতেই প্রাণান্তকর অবস্থা। কীভাবে প্রমাণ করা যাবে আমি ভারতের নাগরিক। অস্তিত্বের সঙ্কটের প্রশ্নে বিপন্ন মানুষ তাই জান-প্রাণ ঢেলে এখানে সেখানে ছোটাছুটি করে নথিপত্র জোগাড় করতে। নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে গিয়ে সবকিছু হারানোর ভয় চেপে ধরে তাকে। ১৯৬৯ সালে জন্ম-মৃত্যু পঞ্জিকরণ চালুর আগে জন্মের কোনও প্রমাণপত্র ছিল না। জন্মপ্রমাণপত্র হিসাবে স্কুলের সার্টিফিকেটকে কি সাক্ষী করা যাবে? স্কুলটা সরকার অনুমোদিত কি না, স্কুলের সার্টিফিকেট জাল নয় তো, ইত্যাদি নানা প্রশ্ন তার দিকে ধেয়ে আসে। বাবা-মা পিতৃপুরুষের হদিশ, জমি-বাড়ির মালিকানার দলিল, ভোটার আইডেন্টিটি কার্ড, ইত্যাদি বিষয়ে আমলাশাহী বাহিনিদের সন্দেহমুক্ত করতে সাধারণ মানুষ জেরবার হয়ে গেল, ডিটেনশন ক্যাম্পের আতঙ্কে অনেকের হৃদরোগে বেড়ে গেল, অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিল। ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিজেপি তখন কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন। অসমে নাগরিক পঞ্জিকরণের কাজ জরুরি ভিত্তিতে চলতে থাকল। ঠিক দুই বছর পরে অসমে বিধানসভার নির্বাচন। অসম চুক্তির প্রায় ত্রিশ বছর অতিক্রান্ত অথচ নাগরিক পঞ্জিকরণের কাজ চলছে ধীরগতিতে। মানুষের মনে সবদিক থেকেই ক্ষোভবিক্ষোভ জমা ছিল, বিজেপি সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে নিয়ে ২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হল। এরপর বিজেপিও বিষয়টিকে এড়িয়ে যেতে পারছে না। কারণ নির্বাচনের অন্যতম ইস্যু ছিল নাগরিক পঞ্জিকরণ দ্রুত শেষ করতে হবে।
বিজেপির অভিভাবক ও মূল চালিকাশক্তি আরএসএস। ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে আরএসএস প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই তীব্র মুসলমান-বিদ্বেষী উগ্র হিন্দুত্ববাদী মৌলবাদী চিন্তায় আচ্ছন্ন। তারা কথায় কথায় মুসলমানদের পাকিস্তানে চলে যাওয়ার হুঙ্কার ছাড়ে। তাদের কথায় উইপোকার মত ওই অনুপ্রবেশকারীরা এদেশের প্রান্তে প্রান্তে বাসা বেঁধেছে, তাদের একটা একটা করে চিহ্নিত করে সীমান্তের বেড়ার ওপারে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত পাঞ্জাব নিয়ে বড় কোনও সমস্যা বাসা বাঁধেনি। আর বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে উত্তর-পূর্ব ভারতের কিছুটা, ত্রিপুরা, অসম এবং পশ্চিমবঙ্গ। কিন্তু বাস্তব ঘটনা হল ভারতবর্ষে শুধুমাত্র ঐ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ছাড়াও রয়েছে মায়নামার ও শ্রীলঙ্কা। ১৯৪৮ সালে স্বাধীন হওয়ার পর ওই দুটি দেশ থেকে ভারতীয় বংশোদ্ভূত লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু ভারতে শরণার্থী হয়ে ঢুকেছে। এই দুটি দেশ আবার মুসলিমপ্রধান দেশ নয়। ঘটনা হল ঐ দেশ থেকে শরণার্থীদের ভারত সরকার স্বাভাবিক নাগরিক হিসাবে গ্রহণ করেছে। অন্যদিকে অরুণাচলে প্রায় পঞ্চাশ হাজার চাকমা-হাজোং শরণার্থীদের বিভিন্ন রাজ্যে পাঠাতে চায় ওই রাজ্যের সরকার। যেখানে অরুণাচলের সাংসদ ও কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী কিরণ রিজিজু বলেছেন, “সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনেও ওই চাকমা-হাজোংদের নাগরিকত্ব দেওয়া যাবে না, ওদের এদেশ থেকে বিতারণ করতে হবে।” উল্লেখ্য ১৯৬২ সালে চিনের সঙ্গে যুদ্ধের পরে ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৮ সালে মধ্যে চাকমা-হাজোং শরণার্থী এবং অসম রাইফেলস পরিবারগুলিকে বিভিন্ন দুর্গম এলাকায় বসত তৈরি করে দেয় ভারত সরকার। ওদিকে ১৯৬০ সালে নেফায় আশ্রয় নেওয়া ইয়োবিন ও লিসাস জনজাতিকে নাগরিকত্ব দেওয়া হলেও চাকমা ও হাজোংদের বহিরাগত করে রাখা হয়েছে। তাদের কোনও নাগরিক অধিকার নেই। অথচ চাকমা ও হাজোংদের ৯৪ শতাংশই জন্মগতভাবে ভারতীয়। ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনানুসারে ১৯৯৮ সালে তাদের নাগরিকত্বের আবেদন গ্রাহ্য হয়নি। এখন তাদের ওই রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার হুমকির বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলা চলছে।
২০১৪ সালে লোকসভার নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে বিজেপি ভারতবর্ষকে হিন্দু রাষ্ট্রে রূপ দেওয়ার কর্মসূচিতে হাত দিল। দীর্ঘ কংগ্রেস আমলে ভা্রতবর্ষ যথার্থ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে উঠতে পারেনি। কংগ্রেস নেতৃত্বে সর্বধর্মসমন্বয়ের মলাটের তলায় নরম হিন্দুত্ব যেমন কার্যকরী ছিল, ছোটবড় বহু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রক্তও কংগ্রেসের হাত কলুষিত হয়েছে। আততায়ীর আক্রমণে ইন্দিরা গান্ধির মৃত্যুর পর দিল্লি ও পাঞ্জাবের বুকে হিন্দু-শিখ দাঙ্গা কংগ্রেস আমলে এক কলঙ্কজনক ঘটনা। সরকারি উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলির ভিত্তি স্থাপনে, দ্বার-উদঘাটনে, বরণে, আপ্যায়নে, হিন্দুধর্মীয় আচরণ-অনুষ্ঠানই বিধেয়। সরকারি ছুটিগুলিতেও হিন্দুধর্মীয়দের প্রাধান্য লক্ষ্যণীয়। হিন্দুত্বের এই উর্বর জমি পাওয়ার জন্য বিজেপি বহু বছর ধরে অপেক্ষা করছিল। কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন হয়ে বিজেপি হিন্দুত্বের আগ্রাসী মুখ-দাঁত-নখ উন্মুক্ত করতে সময় নষ্ট করেনি। প্রশাসনিক স্তরে যতটুকু আপাত নিরপেক্ষতা ছিল তা ধ্বংস করে দলীয় ও বিশ্বস্ত আনুগত্য ভিত্তিতে আমলা ও কর্মীবাহিনিকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োগ করতে থাকে। ২০১৬ সালে অসমে বিজেপি ক্ষমতাসীন হওয়ায় সেই সুযোগ আরও বৃদ্ধি পায়, নাগরিক পঞ্জিকরণের কাজ সম্পূর্ণভাবে দলীয় নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। উগ্রহিন্দুত্বের হুঙ্কারে ও মুসলিমবিদ্বেষী স্লোগানে সমগ্র অসম জুড়ে ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৭, ৯০ লক্ষ মানুষের নাম বাদ যায়। তা নিয়ে খুব হইচই হওয়ায় পুনর্যাচাই হয় এবং ৩০ জুলাই ২০১৮-র ঘোষণায় ৪০ লক্ষ মানুষ অনাগরিক ঘোষিত হয়, কিন্তু হইচই না থামায়, আবার পুঙ্খনাপুঙ্খ খুঁটিয়ে দেখা হয়। তারপর ৩১ আগস্ট, ২০১৯-এ যে পূর্ণাঙ্গ তালিকাটি প্রকাশিত হয়েছে সেখানে অনাগরিকের সংখ্যাটি দাঁড়ায় উনিশ লাখে, এতেও সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। অসম পাবলিক ওয়ার্কস সংগঠন যারা সুপ্রিম কোর্টে নাগরিক পঞ্জিকরণ সংক্রান্ত মামলাটি করেছিল, সেই সংগঠনের সভাপতি অভিজিৎ শর্শ বলেছেন— “এই এনআরসিতে হাজার হাজার অবৈধ নাগরিকের নাম ঢুকেছে। বাংলাদেশি জেহাদি হিসেবে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদেরও নাম রয়েছে। অথচ রাজ্যকে বিদেশিমুক্ত করতে এনআরসি তৈরি হওয়ার কথা ছিল। এর একশো শতাংশ রি-ভেরিফিকেশন না হলে এটা মূল্যহীন কাগজের টুকরো ছাড়া আর কিছু নয়।” প্রাক্তন এনআরসির কো-অর্ডিনেটর প্রতীক হাজেলার দুর্নীতি ও কর্তব্যে গাফিলতি নিয়ে সরব হয়ে তিনি সমগ্র এনআরসি প্রক্রিয়ায় সিবিআই তদন্তের দাবীও করেছেন।
অতীতে অসমেই ১৯৯৭ সালে প্রায় ছয় লক্ষ বাঙালি হিন্দুকে নাগরিকত্বের সঠিক প্রমাণপত্র দেখাতে না পারার জন্য ডি-ভোটার (ডাউটফুল ভোটার) ঘোষণা করা হয়েছিল। তাদের কোনও ছবি-সম্বলিত ভোটার কার্ড দেওয়া হয়নি— এবং অসমের বিভিন্ন জায়গায় স্থাপিত মধ্যযুগীয় ডিটেনশন ক্যাম্পে তাদের রেখে নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য অত্যন্ত ধীরগতিতে ফরেন ট্রাইবুনালের সামনে পেশ করা হয়েছে, এরা বেশিরভাগই নিরক্ষর, সর্বহারা, বিধবা মহিলা, স্বামীপরিত্যক্ত মহিলা, তার সঙ্গে রয়েছে এদের শিশুসন্তানরা, বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বাস্তুচ্যুত। ফরেন ট্রাইবুনালে নাগরিকত্বের প্রমাণ না দিতে পারায় এরা সবাই বিদেশি এবং অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। প্রচণ্ড আর্থিক দৈন্যতার কারণে এদের পক্ষে কোনও আদালতে বা প্রশাসনিক স্তরে তদ্বির করা সম্ভব না হওয়ায় আমৃত্যু এদের স্থান হল ডিটেনশন ক্যাম্প। নাগরিক পঞ্জিকরণের ঘটনাসমূহের বহু আগে থেকে অসম জুড়ে ডিটেনশন ক্যাম্পের অস্তিত্ব ছিল। বিজেপি সেটাকেই কাজে লাগিয়েছে।
৩১ আগস্ট, ২০১৯-এ প্রকাশিত এনআরসি তালিকাকে বিজেপি পরিচালিত অসম রাজ্য সরকারও দাবি করেছে, ওটা সঠিক নয়। অসমে ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচন। সেদিকে তাকিয়ে বিজেপি তার ঘুঁটি সাজাচ্ছে। ওই ১৯ লক্ষের মধ্যে হিন্দুদের সংখ্যা অনেক বেশি, যেখানে বিজেপি মুসলমান বিতারণের একটা বাতাবরণ তৈরি করেছিল। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে এর পুনরায় রি-ভেরিফিকেশন করার দাবি উঠেছে এবং সে মর্মে সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা পেশ করেছে। তার ভিত্তিতে সীমান্তবর্তী জেলাগুলির ২০ শতাংশ ও অন্যান্য জেলার ১০ শতাংশ রি-ভেরিফিকেশণের দাবি করেছে রাজ্য সরকার। আবার তখনকার এনারসির কোঅর্ডিনেটর প্রতীক রাজেলা জানিয়েছিলেন প্রায় ২৭ শতাংশ রি-ভেরিফিকেশনের কাজ হয়ে গেছে। ঠিক হয়েছিল যারা বাদ পড়েছেন তারা ফরেনার্স ট্রাইবুনালে আবেদন করতে পারেন। তালিকা বের হয়ে যাওয়ার দু বছরের মধ্যেও এনআরসি-ছুটদের এখনও রিজেকশন স্লিপ দেওয়া হয়নি, যেখানে উল্লেখ থাকতে হবে বাতিলের কারণসমূহ। অথচ কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষণা ছিল ৩১ মার্চ ২০২০-এর মধ্যে অসমের নাগরিক পঞ্জিকরণের কাজ শেষ করতে হবে। এর জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ২০০টি ফরেনার্স ট্রাইবুনাল তৈরি করেছিল, যার ভিত্তিতে অসম রাজ্য সরকার তাদের পছন্দমতো ২০০ জনকে মাসিক ৯০,০০০ টাকা বেতনে ২০১৯ সালে নিয়োগ করেছিল। এবং রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় অফিস ভাড়া নিয়েছিল। সব কিছু মিলিয়ে দুই বছরে খরচ হয়েছে ৫০ কোটি টাকা, অথচ কাজের কাজ কিছুই হয়নি। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল অসমে এনআরসির জন্য কেন্দ্রীয় সরকার সর্বমোট ১৬০২ কোটি টাকা খরচ করেছে, বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে এর জন্য আর কোনও টাকা বরাদ্দ হবে না। যার জন্য সমস্ত অফিস তূলে দেওয়া হয়েছে এবং একাজে নিযুক্ত কর্মচারীদের ছাঁটাই করা হয়েছে। অথচ পাওয়া গেল না সেই এক কোটি অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশিদের। আবার উল্লেখযোগ্য বিষয় হল সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (২০১৯) কার্যকরী করার জন্য গত দু বছর ধরে কোনও নিয়মবিধি তৈরি করে উঠতে পারেনি কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র দফতর। সাধারণত একটি আইন তৈরির পরে কতদিনের মধ্যে তার বিধি তৈরি করতে হবে সে বিষয়ে সংবিধানে কোনও নির্দিষ্ট সীমা নেই। ফলে সরকারের ইচ্ছামতো বিধি তৈরিতে কোনও বাধা নেই। আইন তৈরির ক্ষেত্রে সরকারের তাড়া থাকলেও তার বিধি তৈরিতে তাড়া নেই। ওই আইন দেখিয়েই মানুষকে ভয় বিভ্রান্ত করে নির্বাচনে ফায়দা তোলার নজির দেখা গেছে ২০২১-এর অসমে ও পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে। একই সঙ্গে কেরল ও তামিলনাড়ু বিধানসভা নির্বাচন হয়েছে সেসব রাজ্যে নাগরিক পঞ্জিকরণ নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্চ্য করতে দেখা যায়নি।
জনগণণা ও নাগরিক পঞ্জিকরণ
অসমের সাধারণ মানুষ যখন এরকম বিপর্যস্ত অবস্থায়, তখন প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে অন্যান্য মন্ত্রী ও নেতারা ঘোষণা করতে থাকেন অসমের পরে ভারতবর্ষের প্রতিটি রাজ্যে নাগরিকপঞ্জি তৈরি করা হবে। ২০১৯ সালে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে নরেন্দ্র মোদি তাঁর অত্যন্ত বিশ্বস্ত কূটকৌশলী অমিত শাহকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদে নিয়ে এলেন। অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে বিজেপি নাগরিক আইন সংশোধনী (২০১৯) নিয়ে এল। এদেশের নাগরিকদের, নাগরিকত্বের কোনও কার্ড না থাকায় যে কোনও নাগরিককে রাষ্ট্রবিরোধী তকমা দিয়ে তাকে অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করে তাকে এবার এই সর্বশেষ সংশোধনী আইনানুসারে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতে পারে।
১৮৭২ সালে ব্রিটিশ আমলে এদেশের জনগণনার কাজের সূত্রপাত ঘটে। এবং ১৮৮১ সাল থেকে প্রতি দশ বছর অন্তর ওই জনগণনার কাজ চলে আসছে। ২০১১ সালে ১৬তম জনগণণা হয়ে্ছে, সেই নিয়মানুসারে পূর্ব-নির্দিষ্ট কর্মসূচি অনুযায়ী ২০২১ সালে ভারতে ১৭তম জনগণনার কাজ শেষ করতে হবে। এর জন্য বাজেটে ৩৭৬৮ কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দ হয়েছে। অতীতে এই কাজের সঙ্গে নাগরিক পঞ্জিকরণের কোনও সম্পর্ক থাকত না এবং সাধারণ নাগরিকরাও জনগণনার নিয়ে মাথা ঘামাত না। ২০২১ সালের জনগণনা নিয়ে মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও রোষ জমা হয়েছে। কারণ অত্যন্ত সুকৌশলে এই জনগণনার সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পঞ্জিকরণ যুক্ত করার যে হুঙ্কার স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কয়েকটি জনসভায় দিয়েছেন তাতে মানুষজন বিক্ষুব্ধ হয়েছে এবং অনেকের মধ্যে ত্রাসের উত্তাপ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রচার করা হয়েছে নাগরিক পঞ্জিকরণের লক্ষ্যে জনগণনায় এমন কতগুলি প্রশ্ন রাখা হয়েছে যা অতীতে ছিল না, এবং নতুন সংশোধনী আইনের বেড়াজালে মানুষকে ফাঁসাতে পারবে, এবং তার ভিত্তিতে অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে নোটিস পাঠানো এবং সব শেষে ডিটেনশন ক্যাম্প। কেন্দ্রীয় সরকারের এই গভীর ষড়যন্ত্রটি পোড়খাওয়া আন্দোলনকারীদের ধরতে অসুবিধা হয়নি, মানুষ আরও বেশি বেশি করে সংগঠিত হচ্ছে। এবারের জনগণনায় কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকায় সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত এদেশের নিম্নবিত্ত, দরিদ্র, খেটে খাওয়া কৃষিজীবী শ্রমজীবী মানুষ, জনজাতি, উপজাতি জনগোষ্ঠী সম্প্রদায়। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় বিভিন্ন প্রমাণপত্র সংগ্রহ করে আমলাবাহিনিদের কিছুটা হলেও মোকাবিলা করতে পারবে।
এই অবস্থার সুযোগ নিতে রাজনৈতিক দলের নেতারা জনগণের ত্রাতার ভুমিকায় নেমে পড়েছেন। একদিকে বিজেপি প্রচার করছে তাদের সঙ্গে থাকলে ভয়ের কিছু নেই, অন্য রাজনৈতিক দলের নেতারাও মানুষকে আশ্বস্ত করছেন তারা যতদিন রাজ্যে ক্ষমতাসীন থাকবেন, তাঁরা তাঁদের রাজ্যে এনআরসি, এনপিআর করতে দেবেন না, সিএএ তাদের স্পর্শ করতে পারবে না। অর্থাৎ পরবর্তী নির্বাচনগুলিতে জেতার আগাম কৌশলী পদক্ষেপ। মানুষের মধ্যে বিক্ষোভ চরম মাত্রায় পৌঁছানোর ফলে ভারতবর্ষের গরিষ্ঠ সংখ্যক রাজ্য, এমনকি যে সব রাজ্য সরকারগুলি বিজেপির এনডিএর সঙ্গে যুক্ত তারাও জনগণনার সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পঞ্জিকরণ না- করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে জনগণনার কাজটি এক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।
চাই সচেতন সংগঠিত আন্দোলন
ভারতের যে রাজনৈতিক দলগুলি সংসদীয় গণতন্ত্রের ধ্বজা ওড়ায় তারা প্রায় সবাই কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন থাকার সময়ে ভারতের নাগরিকত্বের বিষয়টিতে নাক গলিয়েছে, কিন্তু দুঃখের বিষয় হল তারা নিরপেক্ষ দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ প্রশাসন প্রতিষ্ঠা না করে, প্রশাসনকে সঙ্কীর্ণ দলীয় কাজে নিযুক্ত ও ব্যবহার করেছে, এবং এভাবেই প্রশাসন জনমুখী না হয়ে কর্তামুখী ও কর্তাভজা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলির কর্তব্যজ্ঞানহীনতা, চরম উদাসীনতা, সাধারণ মানুষের প্রতি ন্যূনতম দরদবোধের অভাবে, ১৯৫১ সালের প্রথম ভোটার তালিকা ও অসমের প্রথম নাগরিকপঞ্জি সুরক্ষিত রাখার জন্য তারা আমলাবাহিনিকে পরিচালনা করেনি। ভারতের কোনও নাগরিকের কাছে নাগরিকত্বের প্রামাণ্য-কার্ড নেই, পাসপোর্টের প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি নথির ভিত্তিতে বাড়তি কিছু টাকায় দালাল ধরে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি আধিকারিককে সন্তুষ্ট করতে পারলেই পাসপোর্ট প্রাপ্তি ঘটে। তা ছাড়া নাগরিকত্বের বিষয়টি কোথাও প্রয়োজন না পড়ায় এ নিয়ে ভাবনার জায়গাও ছিল না। সমস্ত অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করার জন্য সংশোধনী নাগরিকত্ব আইনে (২০০৩), জাতীয় নাগরিক পঞ্জিকরণ এবং প্রতিটি নাগরিকের জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করার সিদ্ধান্ত হলেও সে কাজে হাতই দেওয়া হয়নি। সোমনাথ চ্যাটার্জী স্পিকার (২০০৪-২০০৯) থাকাকালীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের অনুপ্রবেশকারী ইস্যুতে লোকসভা তুলকালাম করেছিলেন, এরপর তিনি দীর্ঘ দশ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, তিনি বা তৃণমূল কংগ্রেস লোকসভায় এ বিষয়ে নিশ্চুপ থাকলেন। একদিকে কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিম কোর্টে হলফনামায় জাতীয় নাগরিক পঞ্জিকরণ নিয়ে সওয়াল করছেন আর অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিবৃতি দিয়েছেন, জাতীয় নাগরিকপঞ্জি নিয়ে সরকার কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। অন্যদিকে কেবলমাত্র প্রশাসনিক নির্দেশে ভিসা সম্পর্কিত বিষয়ে নতুন সিদ্ধান্তে, ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর অবস্থানকারীদের হিন্দু-মুসলমান ভেদে জরিমানা আদায় হচ্ছে। ৯০ দিনের কম হলে হিন্দুদের জন্য ধার্য ১০০ টাকা, যেখানে মুসলমানদের জন্য ২১০০ টাকা।
এদেশের পুঁজিপতিশ্রেণির আশীর্বাদধন্য, আস্থাভাজন ও বিশ্বস্ত দল কংগ্রেসের শাসনে একদিকে যেমন ধনকুবেরদের এবং মুষ্টিমেয় ধনী সম্প্রদায়ের সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে, রাজনৈতিক অভিসন্ধি চরিতার্থ করতে প্রশাসনের সর্বস্তরে কর্তাভজা, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনিক ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর অন্যদিকে অবস্থান করছে বিশাল সংখ্যক নিঃস্ব, দরিদ্র, নিম্নমধ্যবিত্ত, নির্যাতিত, নিপীড়িত অন্য এক ভারত। গরিবি হঠাও, মেরা ভারত মহান, দেশ এগিয়ে চলেছে, ভারত নির্মাণ ইত্যাদি স্লোগানে মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছে বারে বারে। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ আঁচ করে এদেশের পুঁজিপতিশ্রেণি কংগ্রেসের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বিজেপিকেই তাদের ত্রাতা হিসাবে বেছে নিয়েছে। অচ্ছে দিনের স্লোগান, কালো টাকা উদ্ধার, মানুষকে বিমোহিত করে বিজেপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ক্ষমতাসীন হয়েই তাদের উগ্র হিন্দুত্বের মুখ-নখ-দাঁত উন্মোচিত করতে কোনও সময় নষ্ট করেনি। বছর গড়াতেই মানুষ অচ্ছে দিনের ধোঁকা বুঝতে শুরু করল, কালো টাকা উদ্ধার ও জাল নোটের কারবারীদের শায়েস্তা করতে নোটবন্দির খেলার পর্যায়ও শেষ হল, না খায়ুঙ্গা না খানে দুঙ্গার পর্যায়ে মানুষ দেখল ব্যাঙ্ক লুঠ করে বিজয় মালিয়া, নীরব মোদি প্রমুখদের বিদেশে নিরাপদে পলায়ন। জীবনসংগ্রামে জেরবার মানুষকে আবার কোমর বেঁধে আন্দোলনের পথে নামতে হল। ফসলের ন্যায়সঙ্গত দাম ও ঋণমকুবের জন্য কৃষকদের মিছিল সমাবেশ, সংগঠিত ও অসংগঠিত শ্রমিকশ্রেণির দাবী আদায়ে সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন, বেকার সমস্যা সমাধানে যুবসমাজের সংগঠিত লড়াই, শিক্ষায় বেসরকারিকরণ- বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে লড়াই, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে মহিলাদের আন্দোলন, দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের আন্দোলন— শাসকদলের কপালে ভাঁজ পড়ল। আন্দোলনগুলিকে বিপথগামী করার এক নতুন কৌশলী চাল নিয়ে পুঁজিপতিশ্রেণির অন্যতম বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজন বিজেপি মানুষে মানুষে বিভাজনের খেলায় প্রচার করা শুরু করল, কোটি কোটি মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের তাড়াতে পারলেই সকল সমস্যার সমাধান হবে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, “ভারতবর্ষ একটি ধর্মশালা নয়, যে সবাইকে আশ্রয় দিতে হবে।” সে কারণেই জাতীয় নাগরিক পঞ্জিকরণ ভীষণ জরুরি, সরকার সেকাজকেই প্রাধান্য দিয়েছে। অথচ জাতীয় ক্রাইম ব্যুরো রিপোর্ট বলছে ২০১৭ সালে, ভারতে মাত্র ১,৪০৩ অনুপ্রবেশকারী ধরা পড়েছে। ভারতজুড়ে সাধারণ মানুষ যেমন অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের বিতারণ চায়, সুষ্ঠুভাবে শরণার্থীদের সমস্যারও সমাধান চায়, সম্প্রীতির পরিবেশে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে চায়। নাগরিকত্ব কার্ড সেই অর্থে খুব জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে, না হলে অনুপ্রবাশকারী বলে চিহ্নিত হতে হবে।
২০১৯ সালের সর্বশেষ ৫ম সংশোধনীটির বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির বিক্ষোভ যেমন সংগঠিত হচ্ছে, তার বাইরে এদেশের সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফুর্ত আন্দোলন ও বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন, উল্লেখযোগ্যভাবে ছাত্রছাত্রীদের এবং মহিলাদের এরকম স্বতঃস্ফুর্ত বিশাল মিছিল, বিশাল সমাবেশ, বিক্ষোভ অতীতে কখনও দেখা যায়নি। দিল্লির শাহিনবাগে মহিলাদের অবস্থান তো ভারতের প্রান্তে প্রান্তে শাহিনবাগ তৈরি করে চলেছে। আন্দোলনকে বিধ্বস্ত করে গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য সরকার মদতপুষ্ট গুন্ডাবাহিনির আক্রমণে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা ও আন্দোলন দমনে পুলিশ প্রশাসনের সর্বত্র নির্মমভাবে লাঠিগুলি চালনা উল্লেখযোগ্য, একমাত্র উত্তরপ্রদেশেই পুলিশের গুলিতে ২৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন। সরকারবিরোধী বক্তব্যকে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে জামিন অযোগ্য মামলায় অভিযুক্ত করা হচ্ছে। সংশোধনীটির বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে প্রায় দেড়শোটি জনস্বার্থ মামলা সুপ্রিম কোর্টে জমা পড়েছে। প্রবাসী ভারতীয়দের প্রত্যেকেরই ওভারসিজ সিটিজেন অফ ইন্ডিয়া কার্ড রয়েছে। নতুন নাগরিক সংশোধনী আইনে কেন্দ্রীয় সরকারকে, ওসিআই কার্ডধারীদের সম্পর্কে নতুন নিয়মবিধি প্রণয়ণ ও প্রয়োজনে তাদের কার্ড বাতিল করতে পারার অধিকার দেওয়া হয়েছে। ফলে প্রবাসী ভারতীয়রাও বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, তারাও সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন। ইউরোপ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক সংগঠনগুলি ভারতের এই সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। বিশিষ্ট কূটনীতিবিদ ও ঢাকায় ভারতের প্রাক্তন হাইকমিশনার দেব মুখার্জী কর্তৃক “দেব মুখার্জী ও অন্যান্য বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া” মামলায় জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশন মিশেল ব্যাচেলে “আদালত বন্ধু” হতে আবেদন করেছেন। আবেদনে নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন— (ক) সিএএ-তে ধর্মের ভিত্তিতে ভেদাভেদ কি যুক্তিসঙ্গত? (খ) আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনানুসারে নিপীড়নের সম্ভাবনা জেনে একজন অভিবাসীকে তার দেশে ফেরানোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, সে ক্ষেত্রে শুধু ধর্মীয় নিপীড়ন ভিত্তিতে ভেদাভেদ কি যুক্তিসঙ্গত? ভারতের সুপ্রিম কোর্ট মামলাগুলি নিয়ে কবে শুনানি প্রক্রিয়া শুরু করবে এবং চূড়ান্ত রায় দেবে তা ভবিষ্যতের বিষয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল ভারতের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অন্যান্য মন্ত্রীরা কেউই লোকসভা, রাজ্যসভা বা অন্য কোনও স্থানে এই সংশোধনী এবং তার সঙ্গে যুক্ত করে কেন্দ্রীয় সরকার যে জাতীয় নাগরিক পঞ্জিকরণ নিয়ে সিদ্ধান্ত করেছেন সেগুলি নিয়ে কোনও প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিচ্ছেন না। একটা ধোঁয়াশা তৈরি করে চলেছেন, বিরোধী দলগুলিকে কটাক্ষ ও দোষারোপ করছেন, আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে হুঙ্কার ছাড়ছেন, এবং স্ববিরোধী এমনকি পরস্পরবিরোধী বক্তব্য রাখছেন। সুতরাং সমগ্র বিষয়টার প্রেক্ষাপট এবং ক্ষমতাসীন দলের মূল রাজনীতির পর্যালোচনা খুবই জরুরি।
মিথ্যাচার, উগ্র ধর্মান্ধতা, অন্ধ আনুগত্য, অবৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা, মুক্তিদাতা অবতারের আবির্ভাব ইত্যাদি লক্ষণ নিয়ে ইতিহাসের বুকে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটেছে ইটালিতে, জার্মানিতে। জার্মানের ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কয়েক কোটি মানুষের হত্যার সর্বাধিনায়ক হিটলারকে আরএসএস সর্বতোভাবে সমর্থন করেছিল, এবং সেই পথে ভারতবর্ষকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা সফল করতে বিজেপি মরিয়া। পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদকে রক্ষা পেতে হলে তার সর্বশেষ আশ্রয় হল ফ্যসিবাদ। স্বৈরাচারী বা মিলিটারি শাসনের মাধ্যমে যেমন ফ্যাসিস্ট শক্তির উত্থানের সম্ভাবনা থাকে, অন্যদিকে সংসদীয় গণতান্ত্রিক কাঠামোকে হাতিয়ার করেই হিটলারের আবির্ভাব ঘটেছে। মানবতার শত্রু ফ্যাসিবাদ। ফ্যাসিস্টরা মনুষ্যত্বহীন মানবশরীরী পশুর মত। ভারতের বুকে কয়েক বছর ধরে তাদের হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে। মানুষের সচেতন আন্দোলনই এটাকে রুখে দিতে পারে। দুর্ধর্ষ শাসকেরা মনে করে তাদের ক্ষমতা অপরিসীম, অমর, অক্ষয়। ইতিহাস তা বলে না। মানুষের বিস্ফোরণ কীভাবে ঘটবে, কে সেই বিস্ফোরণ ঘটাবে, কে সেই স্পার্টাকাস, রাষ্ট্রযন্ত্র তার হদিসও পায় না।
ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতার কারণে আমাদের দেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম হিন্দু জাতীয়তাবাদ হিসাবে গড়ে উঠেছিল। পাশ্চাত্য নবজাগরণের ধর্মনিরপেক্ষ দার্শনিক চিন্তা আদর্শ নিয়ে ভারতের যে মনিষীরা চর্চা ও অনুশীলন করতে চেয়েছিলেন, সেই রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আদর্শ, চিন্তাভাবনা জনমানসে ব্যাপ্ত না হয়ে, প্রাচীন ধর্মীয় বিশ্বাস, কুসংস্কার, অন্ধ-আনুগত্য সম্বলিত হিন্দুধর্মভিত্তিক মনিষীদের জীবনচর্চা ও অনুশীলন সাধারণ জনজীবনকে আকৃষ্ট করেছে। বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ উপন্যাসে হিন্দু সন্ন্যাসীদের নতুন ভারত সৃষ্টির আহ্বান এবং বন্দে মাতরম, স্বামী বিবেকানন্দ, অরবিন্দ, দয়ানন্দ স্বরস্বতী প্রমুখদের দার্শনিক চিন্তা স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবীদেরও অনুপ্রাণিত করেছিল। গান্ধিজি সর্বধর্মসমন্বয়ে শ্রদ্ধাশীল হলেও, রাম তার আরাধ্য দেবতা, জীবনচর্চা ছিল হিন্দুধর্মভিত্তিক। আবার বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলন ও সোভিয়েতের ভূমিকা বিপ্লবীদের অনুপ্রাণিত করেছিল। শরৎচন্দ্র, নজরুল, প্রেমচাঁদ, জ্যোতিরাও ফুলে, নেতাজি সুভাষচন্দ্র, ভগৎ সিং প্রমুখদের প্রভাব আজও ভারতবাসীকে অনুপ্রাণিত করে। রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ ভাবনা ও তার ভিত্তিতে “ভারততীর্থ” ভারতবর্ষের বহু ধর্ম-জাত-বর্ণ সম্মিলিত এক ঐক্যবদ্ধ ভারত, ‘আমরা সবাই ভারতীয়’ ভাবনা, এদেশের মানুষজনদের মধ্যে একপ্রকার স্থায়িত্ব লাভ করেছে। ভারতের পুঁজিপতিশ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী দলগুলি এই ঐক্যবদ্ধ ভারতকে ভাঙতে চেয়েছে বারবার। মানুষের সচেতন আন্দোলন তা রুখে দিয়েছে। অতীতের আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে সচেতন মানুষই আগামী দিনে যোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবে।