সুদীপ্ত মুখোপাধ্যায় ও সোহেল ইসলাম
সুদীপ্ত লেখক ও তথ্যচিত্রনির্মাতা; সোহেল কবি, অনুবাদক, ‘উত্তরদক্ষিণ’ পত্রিকার সম্পাদক
যদি আমার শব্দেরা যুদ্ধ থামিয়ে দিতে পারত
নেমে আসতে পারত রাস্তায়
দাঁড়াতে পারত বোমার সামনে
ড্রোনের সামনে
বুলেটের সামনে
তবে ওদের শুইয়ে দিতাম
গাজার প্রতিটা শিশুর পায়ের কাছে
প্রার্থনার মতো করে বারবার শোনাতাম তাদের
যতক্ষণ না সব ভাষা ভেঙে পড়ে তার সামনে
ছড়িয়ে যায় দিনের আলোর মতোআমি শুধু মৃত্যুই গুনে গেলাম
তবুও আমার শব্দেরা চেয়েছে, আমি শান্ত থাকি
গাজায় কামানের সামনে দাঁড়িয়ে
আমি কীভাবে শান্ত থাকি
কীভাবে নীরব থাকিগ্রামকে গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে
ধোঁয়া ছাড়া কিছুই নজরে আসে না আর
ডেভিড আর দৈত্যের মাঝে দাঁড়িয়ে কীভাবে শান্ত থাকি
আমার গলায় এখনও পেট্রোলের ঝাঁঝ
ভালো করে কথা বলতে পারছি না
দাঁড়াতেও পারছি না সোজা হয়ে
তবুও আমার মেরুদণ্ডকে বলতে হচ্ছে সোজা হও, সোজা
প্যালেস্তাইনের মানচিত্রের মতো
ফুসফুসকে তৈরি করো চিৎকারের জন্য…আমার আদরের সুহা
মা আমার, আর কোনওদিন তোর সঙ্গে দেখা হবে না
মা আমার, কেন চলে গেলি এভাবে
আমি যে তোকে একটাবার অন্তত একটাবার দেখতে চাই
মা আমার, কেন চলে গেলি এভাবেচিন্তা করিস না মা। শেকল আর পাহারা সত্ত্বেও তোর মা এখনও অবিচল, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। অথচ আমি হলাম সেই দুঃখী মা, যে শেষবারের মতো তার সন্তানকে শুধু একবারের জন্য চোখের দেখা থেকেও বঞ্চিত। এটা বোধহয় শুধু প্যালেস্তাইনেই সম্ভব। আমি শুধু চেয়েছিলাম তোকে শেষবারের মতো বিদায় জানাতে, তোর কপালে চুম্বন করতে এবং বলতে চেয়েছিলাম আমি প্যালেস্তাইনকে যতটা ভালোবাসি তোকেও ভালোবাসি ততটাই। মা আমার, ক্ষমা করিস, তোর জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলাম না। এটা যে কতটা যন্ত্রণার শেষ মুহূর্তে আমি তোর পাশে পর্যন্ত থাকতে পারলাম না। আজ আমার মন, আমার ইচ্ছেরা তোকে একটাবার দেখার জন্য, তোর কপালে ঠোট ছোঁয়ানোর জন্য জেলকুঠুরির ওই ছোট্ট জানালা দিয়ে আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে। সুহা, আমার মা আমার অমূল্য রতন। ওরা তোকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। সকলের আড়ালে আমি তোকে বিদায় জানাচ্ছি। তোর চলে যাওয়া শুধু বেদনাদায়কই নয় অসহ্য যন্ত্রণার। কিন্তু তবুও আমি প্যালেস্তাইনের পাহাড়ের মতো অবিচল দৃঢ়।
এইমাত্র আপনি যে চিঠিটা শেষ করলেন তা মেয়েকে লেখা জেলবন্দি এক মার চিঠি। যে মা, মেয়ের মৃত্যুসংবাদ শোনার পর তার শেষকৃত্যে যাওয়ার জন্য অনেক আবেদন-নিবেদন করার পরেও জেলকর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনও অনুমতি পায় না। মেয়েকে শেষ দেখা থেকেও বঞ্চিত হয়। কিন্তু কেন এমন হল? কী এমন বেদ অশুদ্ধ হত যদি সেই মাকে শেষবারের জন্য তাঁর মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হত? আর কত বড়ই বা অপরাধী সেই মা? বিষয়টা কি মানবিকভাবেও একবার ভেবে দেখা যেত না?
উত্তর একটাই, না। কারণ দেশটার নাম ইজরায়েল। আর সেই জেলবন্দি মায়ের সবচেয়ে বড় অপরাধ তিনি একজন প্যালেস্তিনীয়। সবচেয়ে বড় অপরাধ তাঁর নাম খালিদা জারার। সবচেয়ে বড় অপরাধ খালিদা একজন প্যালেস্তিনীয় রাজনীতিবিদ, পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্তাইন দলের প্রথম সারির নেতৃত্ব, প্যালেস্তিনীয় আইন পরিষদের সদস্য, একজন মানবাধিকার কর্মী। প্যালেস্তিনীয় নারীদের গ্রেফতারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া একজন সক্রিয় কর্মী খালিদা। এছাড়াও প্যালেস্তিনীয় বন্দিমুক্তি ও মানবাধিকার সংস্থা ‘অ্যাডামির’-এর বোর্ড সদস্য এবং দীর্ঘদিন সেই সংস্থার পরিচালকের ভূমিকায় থেকেছেন। খালিদার সবচেয়ে বড় অপরাধ তাঁর জনসংযোগ ও মানুষের সঙ্গে মিশে রাস্তায় নেমে কাজ করার ক্ষমতা, যা ইজরায়েল সরকারকে আরও প্রতিহিংসাপরায়ণ করে তুলেছে।
খালিদার অপরাধের শুরু ১৯৮৯ সালের ৮ মার্চ, সেবার ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে প্যারিসে বসবাসকারীদের আয়োজনে এক সমাবেশে বক্তব্য রেখেছিলেন তিনি এবং সেই বক্তব্যের জন্য তাঁকে সেদিনই গ্রেফতার করা হয়। সেই শুরু। তারপর সময় যত গড়িয়েছে, পরিস্থিতি হয়েছে আরও ভয়ঙ্কর, খালিদা নিজের বাড়িতে যতটা না সময় কাটিয়েছেন তারচেয়ে জেলেই কাটিয়েছেন বেশি। হারিয়েছেন দেশ ছাড়ার অনুমতি, বাজেয়াপ্ত হয়েছে পাসপোর্ট, নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে খোলা জায়গায় অর্থাৎ জনসমাবেশে বক্তব্য রাখার ওপর।
ব্যক্তিজীবনেও খালিদার অপরাধের শেষ নেই। বীরজিট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই রাজনীতিতে জড়িয়ে যান খালিদা। ভালো বক্তা হওয়ার সুবাদে খালিদার জনপ্রিয়তা ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে খুব তাড়াতাড়ি। ছাত্র রাজনীতি করতে গিয়েই ঘাসান জারার সঙ্গে পরিচয় তাঁর। পরবর্তীতে এই ঘাসান জারার সঙ্গেই ১৯৮৫ সালে খালিদার বাগদান ঘটে। ঘাসানও ছিলেন একজন সক্রিয় প্রতিবাদী ও রাজনৈতিক কর্মী, যাকে ১৪ বার ইজরায়েল পুলিশ গ্রেফতার করেছে। বিনাবিচারে জেলে কাটিয়েছেন ১০ থেকে ১১ বছর। ঘাসান খেলনার দোকান চালিয়ে সংসার চালানোর চেষ্টা করার পাশাপাশি একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে দেশ বাঁচানোর স্বপ্ন দেখেন।
এতসব অপরাধের কারণেই ২ এপ্রিল, ২০১৫, রাত ১টা ১৫ নাগাদ প্যালেস্তাইনের স্বাধীনতা, মানবাধিকার ও নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রধান মুখ খালিদার বাড়ির দরজায় একের পর এক ধাক্কা পড়তে শুরু করে। কিছুক্ষণ পর সেটা আরও দ্রুত আরও জোরে হতে থাকে, শেষপর্যন্ত দরজা ভেঙে ৫০-৬০ জন ইজরায়েলি সেনা ঢুকে পড়ে ঘরের ভেতর। কোনওরকম ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেফতার করে খালিদাকে। গ্রেফতারের পর গাড়িতে তোলার সময় দুই মেয়ে ও তাঁদের বাবার সঙ্গেও একবারের জন্যে দেখা করতে দেয়নি সেনা-কমান্ডার। শুধু খালিদা নয় বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল খালিদার বইপত্র, কম্পিউটার, এমনকি মোবাইল ফোন পর্যন্ত। খালিদাকে প্রথমে রাখা হয় হাশারন জেলে। ১৩ দিন পর অর্থাৎ ১৫ এপ্রিল খালিদাকে আদালতে তোলা হলে জানা যায় যে, আইনভঙ্গ ও নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার দায়ে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং পুলিশ কর্তৃপক্ষ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকে রিমান্ডে রাখতে চায়। শুনানি শুরু হলে সামরিক আদালতের প্রসিকিউটর ১২টা অভিযোগ চাপিয়ে খালিদাকে ওফার জেলে স্থানান্তরিত করার নির্দেশ দেন। কিন্তু বেশিদিন খালিদাকে জেলে রাখতে পারা ইজরায়েলি প্রশাসনের কাছে ছিল চ্যালেঞ্জের। কেননা খালিদা জারারের গ্রেফতারের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রতিবাদ শুরু হয়, বিক্ষোভ হতে থাকে জায়গায় জায়গায়। ওই বছরই ২১ মে সামরিক আদালত খালিদার কেসের রিভিউ করতে বাধ্য হয়। তার ফলস্বরূপ আদালত ৫১৪০ ডলারের বিনিময়ে জামিন মঞ্জুর করে এবং সঙ্গে নির্দেশ দেয় গৃহবন্দি করে রাখার।
ইজরায়েলি সেনাবাহিনি আদালতের রায় অমান্য করে ২৮ মে রাতে আবার খালিদাকে গ্রেফতার করে হাশারন কারাগারে নিয়ে যায়। কিছু দিন পর অর্থাৎ ২০১৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রশাসনিক আটক থেকে মুক্তি পান খালিদা। যদিও বাইরের পরিবেশ, দুই মেয়ে ও স্বামীর সঙ্গে খালিদার ঘরে থাকা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে ভোর তিনটায় রামাল্লার বাড়ি থেকে আবার তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়ে জেলে পুরে দেওয়া হয়। এখন অবধি তিনি ড্যামন কারাগারে বন্দি। এই বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের ১১ জুলাই খালিদা জারার বড় মেয়ে সুহা জারার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়। খালিদার হাজার অনুরোধ সত্ত্বেও আদালত মেয়েকে শেষবারের মতো দেখার এমনকি শেষকৃত্যে হাজির থাকারও অনুমতি দেয়নি।
না এটা শুধু খালিদার ক্ষেত্রেই নয়, এই অমানবিকতা প্যালেস্তাইনের স্বাধীনতার জন্য, মর্যাদার জন্য লড়াই করা হাজার হাজার প্রতিবাদী নারীর সঙ্গেই প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। সেই নির্মমতা যে কতটা তা এবার নিজের চোখেই দেখুন―
গত ৫০ বছরে ইজরায়েলের মিলিটারি আদেশে প্রায় ১০০০০ প্যালেস্তিনীয় নারীকে গ্রেফতার হতে হয়েছে। প্যালেস্তিনীয় নারী বন্দিদের সাধারণত যে দুই জেলে রাখা হয় তার একটা হল হাশারন এবং অন্যটা ড্যামন। এই দুটো অঞ্চলই ১৯৬৭ সালে দখল হওয়া ইজরায়েলের দখলিকৃত অঞ্চলের বাইরে। এবং এই দুই জেলেই সুরক্ষার কারণ দেখিয়ে বন্দিদের সঙ্গে তাঁদের আইনজীবী ও পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয় না, যা আন্তর্জাতিক আইনানুসারে আরেকটা অপরাধ। তার ওপর এই দুই জেলেই নারী বন্দিদের সঙ্গে ব্যবহারে কর্তৃপক্ষ একেবারেই সংবেদনশীল নয়। এর পাশাপাশি বন্দিদের যে কঠোর পরিস্থিতির শিকার হতে হয়, তা হল কেউ অসুস্থ হলে কোনও চিকিৎসা না পাওয়া, পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে না দেওয়া, যদি কোনও ছোট বাচ্চা তার বন্দি মায়ের সঙ্গে দেখা করতে চায় সেক্ষেত্রেও অনুমতি না দেওয়া। যখন তখন যে কাউকে পাঠানো হয় নির্জন কারাবাসে, তো কাউকে পাঠানো হয় ভিড়ে ঠাসাঠাসি সেই ঘরে যেখানে প্রথম ঢোকা মাত্রই নোংরা আবর্জনা, আরশোলা আর ঘরের ভ্যাপসা গন্ধে বমি আসাটা অবধারিত… যেখানে দিনের স্বাভাবিক আলোই ভালোভাবে পৌঁছায় না। এমনকী গর্ভবতী মহিলাদের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও কর্তৃপক্ষ একইরকম উদাসীন বা বলা ভালো প্রতিহিংসাপরায়ণ।
পরিচ্ছন্নতার কথা যখন উঠলই তখন হাশারন জেলের কথা বলতেই হয়। যে জেলের তিনটে অংশের একটাতে রাখা হয় শিশু অপরাধীদের, একটাতে সিকিউরিটি প্রিজনার্স হিসেবে প্যালেস্তাইনের বন্দি শিশুদের এবং অপরটিতে প্যালেস্তাইনের বন্দি নারীদের। আর সেই জেলের সেলগুলোতে একদিকে তেলাপোকা, ঝিঁঝিপোকা, বিছের মতো পোকামাকড়ের উৎপাত আর অন্যদিকে আর্দ্রতা এতটাই বেশি যা কহতব্য নয়। আর এই অপরিচ্ছন্নতা এবং আর্দ্রতার কারণে বেশিরভাগ বন্দিই চর্মরোগে আক্রান্ত। ছোঁয়াচে সেই চর্মরোগের নাম ‘আসকাপিয়স’। এই রোগ নির্মূলের জন্য জেল কর্তৃপক্ষ কোনও ব্যবস্থা তো নেয়ই না, বন্দিদের ব্যবহারের জন্য কোনও ডিটারজেন্ট পর্যন্ত সরবরাহ করে না। এই একই পরিস্থিতি ইজরায়েলের ওফার, রামলে এবং অ্যাডমাউন জেলেও।
প্যালেস্তাইনের নারী বন্দিদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে অবমাননা হয়ে চলেছে। প্যালেস্তিনীয় নারী বন্দিদের নগ্ন তল্লাশি যেন ইজরায়েলি সেনাদের অধিকারে পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে আল-রামলে জেলের কথা না উল্লেখ করলেই নয়। ২০০৩-এর একটা রিপোর্ট থেকে আমরা জানতে পারছি সেখানে ৬৬ জন নারীকে রাখা হয়েছিল যাদের মধ্যে ৫৭ জন প্রাপ্তবয়স্ক ও ৯ জন নাবালিকা। তাদের যে পরিস্থিতিতে রাখা হয়েছিল সেটা করুণ বললেও কম বলা হয়। ১৪ বর্গমিটারের এক একটা সেল বরাদ্দ ছিল ৬ জন বন্দির জন্য। শুধু তাই নয়, ওই সব রাজনৈতিক বন্দিদের সঙ্গেই রাখা হয় ইজরায়েলি সাধারণ বন্দিদের… যারা খুন, ডাকাতি, মাদক পাচার এবং পতিতাবৃত্তির মতো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। যে ইজরায়েলি বন্দিরা সারাক্ষণ প্যালেস্তিনীয় বন্দিদের বিভিন্ন ভাবে অপদস্থ ও হুমকি দিয়ে যেত।
আল-রামলেতে বন্দিদের কীরকম টর্চার সহ্য করতে হয় তার একটা নমুনা হল— ওখানে বন্দিদের ব্যবহারের জন্য গরম জলের কোনও ব্যবস্থা নেই৷ সেকারণেই এক পরবের দিনে বন্দিরা জেল সুপারের কাছে শুধুমাত্র সে দিনের জন্য গরম জলের দাবী জানায়, যার ফলস্বরূপ নারী বন্দিদের ৬ জনকে নির্জন কারাবাসে পাঠানো হয় এবং বাকিদের প্রচন্ড মারধর করা হয়।
প্যালেস্তাইনের বেশিরভাগ বন্দিদেরই গ্রেফতারের প্রক্রিয়া চলাকালীন এক ধরনের মানসিক নির্যাতন ও দুর্ব্যবহার সহ্য করতে হয়। তার ওপর মারধর, অপমান, হুমকি, নগ্ন তল্লাশি এবং বিভিন্ন ধরনের যৌন হিংস্রতার শিকার হতে হয়। গ্রেফতারের পর নারী বন্দিদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে তাও তাদের জানানো হয় না। এবং জিজ্ঞাসাবাদের সময় খুব কমই তাদের অধিকার সম্পর্কে অবহিত করা হয়। নির্যাতন ও দুর্ব্যবহারের কৌশলগুলো কেবল প্যালেস্তিনীয় বন্দিদের ভীতি প্রদর্শন করার জন্য নয়, তাদের স্বীকারোক্তি আদায়ের বাধ্যতামূলক উপায় হিসেবে এবং অবজ্ঞা করার জন্যও ব্যবহার করা হয়। ইজরায়েলের কারা কর্তৃপক্ষ এবং সামরিক বাহিনি বন্দিদের স্থানান্তর করার সময়ই কেবল মহিলা সেনা নিয়োগ করে, যদিও সেই সেনারাও তাদের পুরুষ সঙ্গীর চেয়ে কম হিংস্র নয়।
ইজরায়েলের বিভিন্ন জেলে ডিটেনশনের নিয়মগুলো ভিন্ন ভিন্ন হলেও কোনও ক্ষেত্রেই জেলগুলো বন্দিদের প্রয়োজন বা আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলে না। বর্তমানে নেভ তির্তজা ইজরায়েলের একমাত্র জেল যেখানে নারী বন্দিদের থাকার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। সেপ্টেম্বর, ২০০০ দ্বিতীয় ইনতিফাদার পর সারা ইজরায়েল জুড়ে যে বিপুল সংখ্যক প্যালেস্তিনীয় নারীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল তাদেরকেই আটক রাখা হয় ওই জেলে। “সিকিউরিটি প্রিজনার্স” নামে একটি বিশেষ বিভাগ তৈরি করে ইজরায়েল। এবং এই বিশেষ শ্রেণিবিন্যাসের মধ্যে প্যালেস্তিনীয় রাজনৈতিক বন্দিদের ফেলা হয়।
চিকিৎসা বিষয়ে ইজরায়েল কারা কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে মুক্তির আগে অথবা পরে বন্দিদের স্বাস্থ্য পরিস্থিতির ওপর তীব্র প্রভাব পড়ে। ২০০৮-এর সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায়, ৩৮ শতাংশ প্যালেস্তিনীয় বন্দিরাই চিকিৎসাযোগ্য রোগে ভুগছে যার কোনও চিকিৎসাই করা হয় না জেলে। নিম্নমানের খাদ্য-খাবার এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাবে ওজন হ্রাস, দুর্বলতা, রক্তাল্পতা, আয়রন ঘাটতির মতো সমস্যায় ভুগতে বাধ্য হয় বন্দিরা। মানসিক চাপ, অপুষ্টি এবং পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতা বন্দিদের ঘন ঘন ঋতুস্রাবের মতো সমস্যায় ফেলে। শীতকালে সেলগুলোর ভেতরের আর্দ্রতা বেশি থাকার কারণে প্যালেস্তিনীয় বন্দিদের অনেকেই বাত এবং চর্মরোগের মতো সমস্যায় ভোগে। বন্দিদের অনেকেই হাঁপানি, ডায়াবেটিস, কিডনি, চোখের অসুখ, সিকেল সেল অ্যানিমিয়া এবং ক্যান্সারের মতো অসুখে ভুগছে কিন্তু তাদের চিকিৎসা পাওয়ার কোনও সুযোগ নেই। ন্যূনতম চিকিৎসা পাওয়ার জন্যেও দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয়। এর একটা বড় কারণ, জেলকর্তৃপক্ষ দ্বারা আরবি জানা কোনও মহিলা ডাক্তারের ব্যবস্থা না করা। যদিও সমস্ত জেলেই মেডিকেল ক্লিনিক রয়েছে এবং অনিয়মিত হলেও চিকিৎসকরা ডিউটিতে থাকেন।
গর্ভবতী প্যালেস্তিনীয় নারীরা পর্যন্ত ইজরায়েলের বেআইনি দখলদারিত্বের শাসনকালে গণগ্রেফতার থেকে রেহাই পায়নি। ২০০৩-২০০৪-এর মধ্যে ৪ জন প্যালেস্তিনীয় গর্ভবতী মহিলাকে বন্দি করেছিল ইজরায়েলি সেনা, যারা জেলের ভেতরেই সন্তান প্রসব করতে বাধ্য হয়। একজন গর্ভবতী মহিলাকে বন্দি করাটা শুধু তার জন্যেই নয় নবজাতকের বিকাশের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত ঝুঁকির বিষয়। ইজরায়েলের জেলবন্দি গর্ভবতী মহিলারা থাকা, খাওয়া বা হাসপাতালের ক্ষেত্রে কোনও প্রয়োজনীয় বা পছন্দসই ব্যবস্থা পায় না। শুধু তাই নয় হাসপাতালে পাঠানোর সময় তাদের হাত ও পা তখনও ধাতব শৃঙ্খলে বাঁধা থাকে। প্রসবের সময়টুকু ছাড়া প্রসবের ঘরে প্রবেশের আগে এবং পরে তাকে শেকলবন্দি অবস্থাতেই থাকতে হয়।
যদিও নারীদের প্রতি ইজরায়েলের সব রকম বৈষম্য বন্ধ করার জন্য যে কনভেনশন হয় তার ১২ নং অনুচ্ছেদ অনু্যায়ী ১৯৮৩-র ৩ অক্টোবর ঘোষণা করা হয় “গর্ভাবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত নারীদের উপযুক্ত সেবা দিতে হবে, প্রসবোত্তর সময়ে যখন যা প্রয়োজন তা বিনামূল্যে দিতে হবে, পাশাপাশি গর্ভাবস্থায় এবং স্তনদানের সময় পর্যন্ত পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে।”
প্যালেস্তিনীয় বন্দিদের যৌন হয়রানির শুরুটা হয় ধর্ষণের হুমকি দিয়ে, শুধু তাকেই নয়… তার পরিবারকেও ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়। দেহ তল্লাশির নামে প্যালেস্তিনীয় বন্দিদের সঙ্গে যা হয় তাতে প্রতিনিয়ত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘিত হচ্ছে। শুধু তাদের পোশাক নয়, কখনও কখনও তাদের অন্তর্বাস পর্যন্ত খুলতে বাধ্য করা হয়। স্ট্রিপ সার্চের সময় প্রায়শই বন্দিদের নগ্ন অবস্থায় বসে থাকতে বলা হয়। যারা সেনাদের এই আদেশ অমান্য করে তাদের আইসলেশনে পাঠানো হয়। এই তল্লাশি চালানো হয় মূলত আদালতের শুনানিতে স্থানান্তরের সময় অথবা মধ্যরাতে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে।
বন্দিদের কী ধরনের যৌন হয়রানির শিকার হতে হয় এবার তার কিছু উদাহরণ তুলে ধরা যাক— ফতে রিভলিউশনারি কাউন্সিলের সদস্য খাওলা আল-আজারকের কয়েক দশক আগের অভিজ্ঞতা হল… ইন্টারোগেশনের সময় সেনারা চেয়ার নিয়ে পা ফাঁক করে গা ঘেঁষে বসে এবং তার দুপায়ে হাত নাড়তে থাকে এবং এভাবে তাকে সন্ত্রস্ত করে তোলে। তাছাড়া জিজ্ঞাসাবাদ চলাকালীন সেনারা আচমকা চিৎকার করে ভয় দেখায় এবং যে অপমানজনক শব্দ ব্যবহার করে সেটা যৌন লালসার প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। বিশেষত বিবাহিতদের সঙ্গে। হেনস্থার আরেক উদাহরণ হল শিরীন ইসাবী। আইনজীবী শিরীন ৫ বছর জেলে থেকেছে। তার অভিযোগও সেই একই, “সেনারা জিজ্ঞাসাবাদের সময় যৌনতার আশ্রয় নেয়।’’ আরও একটা বিষয় হল, ইন্টারোগেশন চলাকালীন একমাসেরও বেশি সময় ধরে যে ভাবে লোহার চেয়ারের সঙ্গে হাতকড়া পরিয়ে রাখা হয় তাতে অনেককেই হাত ও কোমরের ব্যথায় ভুগতে হয়। আসলে ইজরায়েল জেলে একবার ঢুকলে তার জীবনে সঙ্কটের শেষ নেই। যেমন শিরীনকে যেহেতু জেলে যেতে হয়েছিল তাই ছাড়া পাওয়ার পরও সে আইনজীবী হিসেবে কাজে যোগ দিতে পারছে না। ‘ইউনিয়ন অফ প্যালেস্তিনীয় ওম্যান্স কমিটি’র নেত্রী খিতাম সাফিনের অভিজ্ঞতা হল— ইজরায়েলি সেনারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তরুণীদের টার্গেট করে এবং স্থানান্তরের সময় গাড়িতে দীর্ঘযাত্রা চলাকালীন যৌন হয়রানি করে। না এখানেই শেষ নয়, প্যালেস্তিনীয় বন্দিরা যে কতটা চিকিৎসা সংক্রান্ত অবহেলা এবং মিথ্যে অভিযোগের শিকার তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ ইসরা জাবিস। ২০১৫-র অক্টোবরে পূর্ব জেরুজালেমের চেকপয়েন্টে বোমা বিস্ফোরণের চেষ্টা করার অভিযোগে ৩২ বছর বয়সী ইসরাকে গ্রেফতার করে ইজরায়েল। অথচ সত্যটা হল ওই বিস্ফোরণটা একটা গ্যাস সিলিন্ডারের এবং সেটাও ঘটেছিল যখন ইসরা তাঁর বাড়ি স্থানান্তর করছিল। সর্বোপরি সেই বিস্ফোরণে ইসরার শরীরের ৬৫ শতাংশ পুড়ে যায়, বিশেষত তার মুখ ও হাত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু তার চিকিৎসা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই তাকে হাশারণ জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ফলে তার কান বারবার সংক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে, পুড়ে যাওয়ার ফলে তার নাকের ফুটো এত সঙ্কীর্ণ হয়ে গেছে যে তার শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। হাত ও পায়েরও অস্ত্রপাচার দরকার। দ্রুত চোখের চিকিৎসা দরকার, চোখের জল শুকিয়ে যাচ্ছে, বারবার জলের ঝাপ্টা দিতে হয়। সবসময় ব্যথা হতে থাকে চোখে। ইসরার শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা, রাতে ঘুম আসে না, ওর দাঁত পড়ে যাচ্ছে। ইসরার চিকিৎসা দরকার কিন্তু ইজরায়েল সেসব কর্ণপাত করে না।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই একটা ধারণা করতে পারছেন ইজরায়েল জেলে প্যালেস্তিনীয় বন্দিদের কতটা নির্যাতন সহ্য করতে হয়। কতটা পাশবিকতা, নির্মমতার সঙ্গে যুঝতে হয়। কিন্তু এতকিছুর পরও খালিদাকে একচুলও দমাতে পারেনি ইজরায়েল। আর তিনি যে তাঁর লক্ষে কতটা দৃঢ় এবং অবিচল সেটা তাঁর জেলের চিঠিতেই স্পষ্ট। এবার সেটাই পড়ে দেখা যাক—
খোলা চিঠি
প্রিয় বিশ্ববাসী,
সাম্প্রতিক বেশ কয়েক বছর ধরে প্যালেস্তিনীয়দের বন্দি হওয়া… জেলে তাদের সংখ্যা, পরিস্থিতি সমস্তটাই আমি একটানা বলে চলেছি। আমি কয়েক হাজার প্যালেস্তিনীয়দের সঙ্গে কথা বলেছি যারা ১৯৬৭ থেকে ইজরায়েলের জেলে বন্দি জীবন কাটিয়েছে। আর সেই পরিসংখ্যান থেকে এটা স্পষ্ট যে চারজন প্যালেস্তিনীয়র মধ্যে অন্তত একজন তার জীবদ্দশায় অন্তত একবার জেলে গেছে। আমি গ্রেফতার হওয়া শতাধিক মহিলার সঙ্গে কথা বলেছি যাদের মধ্যে ২৪ জন এখনও জেলে রয়েছে। আমি কথা বলেছি হাজার হাজার শিশুর সঙ্গে যাদের সমস্ত ধরনের আইন এবং আন্তর্জাতিক সনদ লঙ্ঘন করে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রতি ৬০০০ প্যালেস্তিনীয় জেলবন্দিদের মধ্যে ২৪০ জন শিশু। ৫০০-রও বেশি বন্দি বিনাবিচারে জেলে রয়েছে, এমনকী তাদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ পর্যন্ত নেই। যে পরিস্থিতিটা প্যালেস্তাইনে ৭৬ বছর আগে ব্রিটিশ শাসনকালে ছিল বা ইউরোপে নাৎসিদের সময়ে ছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে যা বর্তমান সময়েও আমাদের স্মরণ করতে বাধ্য করছে।
প্যালেস্তাইনের মুক্তিসংগ্রামের উদ্দেশ্যে ৯ বছরের বেশি সময় ধরে প্যালেস্তিনীয় জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সদস্য হিসেবে প্যালেস্তাইনের আইন পরিষদে সভাপতির দায়িত্ব পালন করছি, পাশাপাশি ইজরায়েল জেলে প্যালেস্তিনীয় বন্দিদের সমস্যাও দেখভাল করে আসছি। এর আগে ১৩ বছর ধরে আমি বন্দিদের সমর্থনে তৈরি মানবাধিকার সংগঠন অ্যাডমিরের ডিরেক্টর ছিলাম, যে সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল বন্দিদের সুরক্ষা। এর অর্থ হল আমি আমার জীবনের শেষ ২০ বছর ইজরায়েলি জেলে আটক স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ে নিয়োজিত প্যালেস্তিনীয় বন্দিদের সমর্থনে উৎসর্গ করেছি।
সেই সমস্ত বছরগুলোতে বিশেষত নির্বাচনের পর জনগণের প্রতিনিধি হওয়ার পর থেকে আমি আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে বন্দিদের অধিকার নিয়ে, বেআইনি গ্রেফতারির বিরুদ্ধে, ইন্টারোগেশন পদ্ধতির বিরুদ্ধে, স্বীকারোক্তি আদায়ের সময় যে টর্চার করা হয় তার বিরুদ্ধে এবং সমস্ত মিথ্যা অভিযোগের থেকে তাদের রক্ষা করার চেষ্টা করেছি। যাতে তারা চিকিৎসা, পরিষেবা, জীবন ও স্বাধীনতার অধিকার পায় তার চেষ্টা করেছি। কারণ তারা কেবল নিপীড়িত মানুষের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে, কেন তাদের দোষী সাব্যস্ত করা হবে? যে লড়াই আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত।
আমি সারা বিশ্বজুড়ে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের, বিভিন্ন দেশের সরকারের প্রতিনিধিদের এবং রাষ্ট্রপতিদের প্যালেস্তিনীয় বন্দিদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য অনুরোধ করছি, যে বন্দিরা ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা, মূল্যবোধ, মানবাধিকারের জন্য লড়ছে তাদের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য অনুরোধ করেছি। আমি সর্বদা ইজরায়েলি দখলদারিত্বের নীতিকে ভৎর্সনা জানিয়েছি, দাবি জানিয়েছি এর অনুমোদন বাতিলের এবং এই দখলদারিত্বের সমাপ্তি ঘোষণার। আমি বিশ্বাস করি এটা যেমন আমাদের সকলের দায়িত্ব, তেমনি আপনাদেরও দায়িত্ব প্যালেস্তাইনের পাশে দাঁড়ানোর।
আজও আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, আমার অবস্থান, আমার বিশ্বাস সেই একই জায়গায় রয়েছে। যদিও আমার বর্তমান পরিস্থিতি বদলে গেছে। তবে আমি বিষয়টি অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি এবং সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়গুলো আরও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। ২৪ জন নারী বন্দিদের মধ্যে এখন আমিও একজন। যে ৬০০০ বন্দির কথা আমি আগে উল্লেখ করেছি, তাদের মধ্যে অনেকেই জেলের হিংসার শিকার, তারা প্রত্যেকেই প্রতিদিন, প্রতি ঘন্টায়, প্রতি মুহূর্তে অন্যায়ের ভার বহন করে চলেছে।
পরিবার ও স্বামীর সামনে গ্রেফতার হওয়ার পর আমি আমার পরিবারকে সেবা করার দায়িত্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছি। মধ্যরাতে ইজরায়েলি সেনারা কীভাবে কোনও বাড়িতে চড়াও হয়, কীভাবে হাতকড়া পরিয়ে, চোখে কাপড় বেঁধে কাউকে নিয়ে যায়, তা যেমন ভালোভাবে জেনেছি, সেই সঙ্গে জেনেছি ইজরায়েলি সেনাদের অস্বাভাবিক বিকৃত আচরণ, যা আগে জানতাম না।
আজ আমাকে জানানো হয়েছে, আমার ডিটেনশনের বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে গেছে। এবং যে আইনবলে এটা করা হয়েছে তা শুধু পুরেনো তাই নয়, একইসঙ্গে এ সময়ের মানবতার আইনি তালিকা বহির্ভূত। আরও একটা মজার বিষয় হল আমার এই নির্বোধ গ্রেফতারির জন্য সারা বিশ্বের মুক্তমনা মানুষ যে নিন্দাপ্রস্তাব এনেছেন তাতে ইজরায়েল সরকার কাঁপতে শুরু করেছে। এতে অবশ্য দখলদার ইজরায়েল তাদের বর্ণবাদী আইন প্রয়োগ থেকে পিছু হটেনি। সেকারণেই আমাকে এমন একটা আদালতে পাঠানো হয়েছিল যা সম্পূর্ণভাবে অবৈধ। ফলে আমাদের অক্ষমতা স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। কারণ কোনও অপরাধী কখনওই তার শাসকের বিচারক হতে পারে না।
আসলে আমরা আমাদের স্বাধীনতার জন্য, মর্যাদার জন্য এই মূল্য দিয়ে চলেছি। আজ আমি আপনাদের কাছে এক বন্দি হিসেবে এই চিঠি লিখছি, যে জানে না তার ভাগ্যে কী লেখা আছে! যে জানে না মানুষ থাকার এমন অনুপযুক্ত নোংরা কারাগারে তাঁকে আর কতকাল থাকতে হবে! যে জানে না যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে তবে উপযুক্ত কোনও ডাক্তার পাবে কি না! যে জানে না তাঁকে যে খাবার দেওয়া হচ্ছে তা বিষাক্ত কি না, পানীয় জল দূষিত কি না! আমি জানি না কখন জেলার আমাকে ঘুম থেকে টেনে তুলতে বা আমার এই নিজের সঙ্গে নিজের অন্তরঙ্গ পরিবেশ ভঙ্গ করতে চলে আসবে। আমি জানি না, আমার দুই মেয়ে ইয়াফা আর সুহাকে আমি আবার কবে জড়িয়ে ধরতে পারব। আমি জানি না কবে আমি আবার আমার স্বামীর ঠোঁটে ঠোঁট রাখতে পারব, জড়িয়ে ধরতে পারব মাকে, বাবার কপালে কবে চুম্বন করতে পারব! আমি কেবলমাত্র এটাই জানি যে এই সবকিছু বাস্তবায়িত করতে হলে আমার আপনাদের প্রয়োজন, বিশ্বের প্রতিটি মুক্তকণ্ঠকে আমার সঙ্গে প্যালেস্তিনীয়দের সঙ্গে সোচ্চার হতে হবে, যাতে “এই দখলদারি থেকে মুক্ত হয়ে প্যালেস্তাইনের জনগণ তাদের স্বাধীনতা ফিরে পায়।”
আপনাদের
খালিদা
২ জুন, ২০১৫
হাদারিম কারাগার
খালিদার কথা উঠলেই যে বিষয়টা সামনে চলে আসে তা হল গত এক দশক জুড়ে ইজরায়েলে প্যালেস্তিনীয় মানবাধিকার কর্মীদের পরিস্থিতি। ইজরায়েল অধিকৃত প্যালেস্তাইন ভূখণ্ডে মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মীরা বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার এবং আন্তর্জাতিক কনভেনশন মোতাবেক তাদের যে সুরক্ষাই থাকুক না কেন বিশেষত সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত মানবাধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতা ও সুরক্ষার অধিকার তা থেকে তারা বঞ্চিত। ২০১৫, অক্টোবরের পর থেকে ইজরায়েল প্যালেস্তিনীয় মানবাধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে বিচারপ্রক্রিয়া আরও জোরদার হয়েছে। যার মূল লক্ষ্যই হল ওদের চুপ করিয়ে দেওয়া, যাতে প্যালেস্তিনীয় জনগণের বিরুদ্ধে ইজরায়েলের সংঘটিত অপরাধ প্রকাশ্যে না আসে। যে সমস্ত প্যালেস্তিনীয় এপারথেড ওয়াল ও ইজরায়েলি বসতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভের আয়োজন করে এবং অংশগ্রহণ করে, যারা ইজরায়েলের মানবাধিকার এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন, প্যালেস্তাইনের ভূমিদখল, ঘরবাড়ি ধূলিসাৎ করে দেওয়া এবং প্যালেস্তিনীয়দের চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞার অবসানের লক্ষ্যে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ প্রতিরোধে নাগরিক সমাজকে যুক্ত করার চেষ্টা করে, তারা প্যালেস্তাইনে ব্যাপকভাবে মানবাধিকার কর্মী হিসেবে স্বীকৃত। আর সেই কারণেই ইজরায়েল তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতার, আটক, ভয় দেখানো, হুমকি এবং বিভিন্ন ধরনের শাস্তির নীতি গ্রহণ করেছে। নেতৃস্থানীয় প্যালেস্তিনীয় মানবাধিকার কর্মীদের মধ্যে অনেকেই তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে যথেষ্ট স্বনামধন্য বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। তাদের মধ্যে কেউ মেয়র, কেউ শিক্ষক, কেউ বা জনপ্রিয় কোনও কমিটির সদস্য। প্রায়ই ইজরায়েলে মানবাধিকার কর্মীদের ব্যক্তিগতভাবে টার্গেট করা হয় এবং প্রতিবাদ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য ও প্রতিবাদের প্রচেষ্টাকে দমিয়ে রাখার জন্য বিভিন্ন আইনি মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে স্থানীয় ফটোগ্রাফারদের পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমের সদস্যদেরও টার্গেট করা হয়। ২০১১ সালে মানবাধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে নথিভুক্ত মামলার সংখ্যা ছিল ২৯৫টি, যার মধ্যে ৫৮টি ১৮ বছরের কম বয়সীদের বিরুদ্ধে। কতটা হাস্যকর। ইজরায়েল যখন কেস সাজাচ্ছে একবারে জন্যও বয়সটাকে খেলায় করছে না। ১৮ বছরের কম বয়সীকেও মানবাধিকার কর্মী বলে জেলে পাঠাচ্ছে। নির্দিষ্ট প্রমাণের অভাব এবং মানবাধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে অস্পষ্ট আরোপিত অভিযোগ সত্ত্বেও বিপুল সংখ্যক কর্মী সিকিউরিটি অফেন্সের অজুহাতে জেলের চার দেয়ালের ভেতর দিন কাটাচ্ছে। ইজরায়েলি সামরিক আদালতে অভিযুক্তের কোনও ধরনের অধিকারই মান্যতা পায় না। ইজরায়েলি সেনাদের সাক্ষ্য এবং বিক্ষোভে কোনও ব্যক্তির অংশগ্রহণের একটি মাত্র ছবি কাউকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য যথেষ্ট। তাছাড়া যেকোনও বন্দিকেই স্বীকারোক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়। ২০১৫-তে ইজরায়েলি দখলদার বাহিনি সাতজন প্যালেস্তিনীয় সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করে। যার ফলে ইজরায়েলি জেলে আটক সাংবাদিকদের সংখ্যাটা হয়ে দাঁড়ায় ১৮, যাদের মধ্যে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ২০১৪-তে। ২০১৭-তে গ্রেপ্তার হওয়া সাংবাদিকদের সংখ্যাটা ছিল ১১। যদিও ওই সময়কালে বন্দি মানবাধিকার কর্মীদের সংখ্যাটা ছিল কয়েক ডজন যাদের অধিকাংশই প্রশাসনিক আটক আদেশের কারণে গ্রেপ্তার হয়েছিল। গ্রেপ্তার হওয়া সেই সব সাংবাদিকদের মধ্যে রয়েছেন আহমেদ কোয়াতামিশ, হাম্মাম আটিলি, ওমর আল-আমর, নিদাল আবু আকের, নিদাল আমরো, হাসান সাফাদি, ওসামা সাহেন ও আরও অনেকে।
নারী মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিকরা কে কবে কী পরিস্থিতিতে ইজরায়েলি দখলদার বাহিনির হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে সেটা এক নজরে দেখে নেওয়া যাক। ২০২০-র ২ নভেম্বর খেতাম শাফিনকে নিজের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে বাহিনি। ২০১৭-তেও অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ডিটেনশনে তাকে তিন মাস জেলে পাঠানো হয়েছিল। ২০২০-র নভেম্বরে রামাল্লা থেকে নাবলুস যাওয়ার পথে সাংবাদিক বুশরা আল-তাওয়েলকে গ্রেফতার করে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ডিটেনশনে পাঠায় ইজরায়েলি সরকার। যদিও তাঁর বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ ছিল না। ২০১৯-র ডিসেম্বর থেকে ২০২০ জুলাই মোট ২৩০ দিন কোনও অভিযোগ ছাড়াই তাঁকে আটকে রাখা হয়। ৪২ বছর বয়সী ৫ সন্তানের মা লেখিকা লামা খাতেরকে ইজরায়েলি দখলদার বাহিনি ২০১৮-তে গ্রেফতার করে তার লেখনীর জন্য। ২০২১-এর ৩১ মে বাড়ি থেকে গ্রেফতার হয়ে ৫ দিন জেলে থাকার পর সাংবাদিক জিনিয়া হালুয়ানিকে জেরুজালেম আদালত ৪০০০ শেকল জরিমানার বিনিময়ে শর্তসাপেক্ষে জামিন দেয়। এবং সেইসঙ্গে তাঁকে এক মাস গৃহবন্দি থাকার নির্দেশ দেয়। নির্দেশ দেয় তিনি যেন তাঁর ক্যামেরামানের সঙ্গে আগামী ১৫ মাস কোনও যোগাযোগ না রাখেন। ৩৯ বছর বয়সী ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক সুজন ওয়েইউইকে ২০১৮-র ৫ জুন হেব্রনে তাঁর বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় বাহিনি। হেব্রন পৌরসভার সদস্য সুজানকে টানা একমাস ধরে জিজ্ঞাসাবাদ চালানো হয় এবং সেইসঙ্গে ঘুমোতে না দেওয়া ও নির্জন কারাবাসের শিকার হতে হয় তাকে। মূলত সেনাদের উপস্থিতিতে প্যালেস্তিনীয়দের ওপর ইজরায়েলি সেটলারদের আক্রমণ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশের জন্য তাকে গ্রেফতার করা হয়। আরেক সাংবাদিক লিনা খাতাব। ২০১৪-র ১৩ ডিসেম্বর সাংবাদিক লিনাকে রামাল্লা থেকে গ্রেফতার করে ইজরায়েলি সেনা। গ্রেফতারের সময় বিশাল সংখ্যক সেনা আচমকা ঝড়ের গতিতে তাকে গ্রেফতার করে এবং প্রায় টেনে-হিঁচড়ে মিলিটারি জিপে নিয়ে গিয়ে তোলে, সেনাদের ভাবটা এমন ছিল যেন তারা কোনও দীর্ঘ সময় ধরে খুঁজে চলা সন্ত্রাসবাদীকে গ্রেফতার করতে এসেছে। বর্তমানে সোশাল মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশের জন্যেও ২৬ জন প্যালেস্তিনীয় সাংবাদিককে আটক করেছে ইজরায়েল। সব মিলিয়ে সারা ইজরায়েলটাই প্যালেস্তিনীয়দের জন্য আস্ত একটা কারাগার। আর এই কারাগার থেকেই নিজেকে, নিজের দেশবাসীকে, দেশকে মুক্ত করার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে প্যালেস্তাইনের হাজার হাজার খালিদা। কিন্তু প্যালেস্তাইনকে মুক্ত করার জন্য খালিদাদের লড়াই যথেষ্ট নয়, খালিদার স্বরে স্বর মিলিয়েই বলি বিশ্বের প্রতিটি মুক্তকণ্ঠকে প্যালেস্তিনীয়দের সঙ্গে সোচ্চার হতে হবে। তবেই মিলবে প্যালেস্তাইনের স্বাধীনতা। এ লেখা সেই জনমত গঠনের জন্যই, এ লেখা আপনাকে পাশে পাওয়ার জন্যই। আসুন আমরা সকলে মিলে একই স্বরে বলে উঠি…
এবার অন্তত স্ট্যান্ড নিতে শিখুন
ভেতরের মানুষটাকে প্রশ্ন করুন
কোনও যুক্তিতেই
শিশুহত্যা জায়েজ হতে পারে না
ওরা ক্রমাগত আমাদের একটু একটু করে সীমানার বাইরে ঠেলে দিচ্ছে
আকাশ থেকে ফেলছে বোমা
ছোট ছোট পুতুলের মতো খণ্ড-খণ্ড শরীর পড়ে আছে রাস্তায়
হাসপাতালে লাশ রাখার জায়গা নেই
ওষুধ নেই
জল নেই
বিদ্যুৎ নেই
আছে শুধু অন্ধকার
আর অন্ধকারআমরা চাই
আমাদের কথাগুলো মশাল হয়ে জ্বলে উঠুক
এসো হাতে হাত রেখে শান্তি কামনা করি
শান্তি কামনা করি যুদ্ধবাজদের কাছেরেহাই দাও
এবার গাজাকে কথা বলতে দাও
কথা বলতে দাও জেরুজালেমকে
প্যালেস্তাইনকেআমাদের মৃত্যু তোমাদের টুইটারের জন্য নয়
তোমাদের ফেসবুক স্ট্যাটাসের জন্য নয়
লাইক আর শেয়ারের জন্যও নয়আমরা গেয়ে উঠতে চাই স্বাধীনতার গান
গাজার প্রতিটি ভবনের দেওয়ালে লিখে দিতে চাই স্বাধীনতা
রাস্তায় রাস্তায় লিখে যেতে চাই স্বাধীনতা(কবিতা: রাফিফ জিয়াদ)