গোধূলি শর্মা
সুন্দরের সাথে আমার মনে রাখার মতো প্রথম পরিচয়, যখন আমার বয়স এই সাড়ে তিন কি চার। আমাদের বসার ঘরে সাদাকালো একটা ছবি ছিল, আকারে খানিক বড়। মার মুখে শুনেছি, আমি সাড়ে তিন কি চার বছরেই ওই ছবিটার সামনে একদিন দাঁড়িয়ে আদো আদো বলেছিলাম “ছুন্দল…”। ছবিটা ছিল আমার দিদিমার। তিনি ছিলেন যাকে বলে ডাকসাইটে সুন্দরী। বড় হয়ে সেটা উপলব্ধি করেছি আরও তীব্রভাবে। তবে ওই বিশেষ ছবিটার পেছনের ইতিহাসের খোঁজ যখন পেলাম, একবিংশের আধুনিকা হিসেবে অবাক হয়েছিলাম খানিকটা। দিদিমার বিয়ে হয়েছিল বছর চোদ্দয়। অলিতে গলিতে ফোটোগ্রাফার ছিল না তখন, পাড়ায় পাড়ায় স্টুডিও চলত না রমরমিয়ে। আর সবচেয়ে বড় কথা মুখার্জিবাড়ির বড় বউয়ের ছবি তুলতে বাড়ির বাইরে যাওয়ার ইচ্ছেটা স্পর্ধা মেশানো দুঃস্বপ্নের তালিকায় পড়ত। তবু দাদুর সুপ্ত ইচ্ছেয় বাড়ির গুরুজনদের অলক্ষ্যে দাদুর এক ফোটোগ্রাফার বন্ধু এসেছিলেন। সারাদিনের সংসারভারে ন্যুব্জ বছর চোদ্দর নব বিবাহিতা ভীষণ রকম লজ্জা মেখে আড়ষ্টচোখ রেখেছিল ক্যামেরায়।
সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুর মতো বিবাহ নামক জীবনের এই অতি পরিচিত সামাজিক অনুষ্ঠানের বদল ঘটেছে চোখে পড়ার মতো। প্রজাপতির মূল আকৃতি হয়তো একই রয়ে গেছে, কিন্তু তার পাখায় লেগেছে নানা স্বাদের রঙ। সময়টা যখন পুরনো ছিল বর্তমানের প্রেক্ষিতে, সেই ছায়াপথে খানিক মনোনিবেশ করা যাক প্রথমে। তখন বাড়ির গুরুজনদের সমবেত সিদ্ধান্তে ছেলেটি বা মেয়েটি বিবাহের যোগ্যতা অর্জন করত, তাদের ইচ্ছে থাকুক বা না থাকুক। নিজেদের ইচ্ছে প্রকাশের স্পর্ধা বা সাহস কেউ দেখাত না। তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছাকে কেউ তেমন আমলও দিত না। বড় জেঠুর হুংকার-– ‘এসব ব্যাপারে তোমার নাক গলাতে হবে না, নিজের চরকায় তেল দাও। ও আমরা বড়রা সব দেখে নেব।’ ভাবখানা এমন যেন বিয়ের চরকাটা ওনাদের নিজের, আমাদের কথা কইবার কোনও হকই নেই। কয়েক প্রস্থ আলোচনার পরে বাবার বড় পিসির ননদের ভগ্নিপতির ছোট বোনটিকে মনে ধরল সকলের। অদ্ভুত ব্যাপার হল, এই সকলের মধ্যে সেই দুজন মানুষই নেই যাদের একসঙ্গে চার দেওয়ালের মধ্যে কাটাতে হতে পারে আগামী বেশ কিছু দশক। তারা এইসব পর্যালোচনায় সবসময়েই ব্রাত্য। যদি কৌতূহল একেবারেই পোষ না মানত, তাহলে কখনও পর্দার আড়ালে, কখনও গুরুজনদের মধ্যে সামান্য বন্ধুস্থানীয় কাউকে বহুবার জিজ্ঞাসার পরে হয়তো নামটুকু শুনেই সন্তুষ্ট থাকতে হত। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৌকাডুবির প্রথম অধ্যায় মনে পড়ে যায়। যেখানে অন্যতম চরিত্র রমেশ আইন পরীক্ষায় পাস করে বাড়ি ফিরে জানতে পারে বিবাহের পাত্রী ও দিন দুটিই স্থির হয়ে গেছে। আর বলাই বাহুল্য, এই দুটি সিদ্ধান্তেই তার কোনও ভূমিকা ছিল না। পাত্রী দেখতে যাওয়ার আয়োজনেও পাত্রের উপস্থিতি যে আবশ্যিক তাও ছিল না। আসলে পুরো ব্যাপারটার মধ্যেই যে বিষয়টা স্পষ্ট ছিল তা হল গোপনীয়তা। দুটো মানুষের একসাথে থাকার ছাড়পত্রটি প্রাপ্তবয়স্ক বিষয়, তাই তার গায়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা হত অদ্ভুত নিষিদ্ধ মোড়ক। যে মানুষটার সঙ্গে হয়ত কিছুদিন পরে আজীবনের গেরস্থালী ভাগ করে নিতে হবে, ছোট ছোট দুঃখ কথায় বুনতে হবে নকশিকাঁথা, তাকে না দেখার অপেক্ষায় যে তীব্র উচাটন, সেটাই ছিল সেইসময়ের প্রাক বৈবাহিক থুড়ি প্রি ওয়েডিং ফোটোশ্যুট, কল্পনায়। একটাই ছবি কিম্বা অনেক অনেক ছবিকে একটা ক্যানভাসে এঁকে চলা বারবার। কবিগুরুর কথায়– “ওগো বধূ সুন্দরী, তুমি মধুমঞ্জরী/ পুলকিত চম্পার লহো অভিনন্দন…”। কিম্বা “সুন্দর হে, বরমাল্যখানি তব আনো বহে/ অবগুণ্ঠনছায়া ঘুচায়ে দিয়ে হেরো লজ্জিত স্মিতমুখ শুভ আলোকে/ বঁধূ কোন আলো লাগলো চোখে…”। লজ্জাবনত চোখদুটোকে সেই দেখা প্রথমবার শুভদৃষ্টিতে, সম্প্রদানের ঘটের আড়ালে ছুঁয়ে যাওয়া প্রথম উত্তাপ, নববধুসাজে সেই প্রথম আলাপ, সব অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে শুভ পরিণয়।
সৈয়দ আলাওল রচিত ‘পদ্মাবতীর বিবাহমঙ্গল’–এ বিয়ের প্রাক মুহূর্তে কনের মনের অবস্থা, তার লাজে রাঙা অনুভূতির বর্ণনা রয়েছে বিশদে। কবি বলছেন–
“তুমি বোলো প্রভু আছে বিবাহের স্থলে।
আমি দরশন পাই হৃদয় কমলে।।
যেই স্বামী সেই আমি নাহি ভাব ভিন।
আপনা চাহিতে প্রাণনাথ হইল লীন।।
যেই দিব্য দিলা সখী না হইত আন।
সমদৃষ্টি চাহি যদি না রহিব প্রাণ।।
ঘোঁঘট অন্তরে আঁখি মুখ হইল লুক।
সে সময় স্ত্রিয়ালাজে থাকি অধোমুখ।।
না জানি কী হয় মধু-চন্দ্রিমার কালে।
তোমার শপথ পাছে ততমাত্র ফলে।।”
আসলে তখন গোটা ব্যাপারটার ভেতরেই লজ্জার চোরাস্রোত বইত, দুপক্ষের তরফে।
এখন তো ছত্রাকের মতো ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইটের দৌলতে সম্পূর্ণ অচেনা দুজন ছেলে মেয়ে কত সহজে নিজেদের কাছাকাছি চলে আসে। দেখা করে রেস্তোরায়, নিজেরাই বেছে নেয় একে অপরকে। শুধুমাত্র নিজেদের মধ্যেই তৈরি হয়ে যায় সিদ্ধান্ত। আগে আপিসে খবর হত সান্যালবাবুর বিয়ে হয়ে গেছে, যখন তিনি বেশ কিছুদিনের ছুটি কাটিয়ে হাতে এক হাঁড়ি রসগোল্লা নিয়ে নতুন ধুতি-পাঞ্জাবি-পামশুতে দেশের বাড়ি থেকে সোজা শহরের আপিস-বাড়িতে পা রাখতেন। এখন সোশাল নেটওয়ার্কের আশীর্বাদে ছেলেটি যে মেয়েটির সাথে দেখা করতে গেল প্রথমবার, সেই স্টেটাসেই চারশ লাইক আর পঞ্চাশের ওপর কমেন্ট। তারপর বিয়ের দিন পর্যন্ত তাদের একসাথে সিনেমা দেখা থেকে শপিং মলে ঘুরে বেড়ানো প্রতিটা গতিবিধিই বাকি পৃথিবীর চায়ের কাপের গসিপ-বিস্কুট। বিয়ের আগেই তারা নিজেদের মতো প্রি ওয়েডিং ফোটোশ্যুটে ব্যস্ত, স্বছন্দও বটে। সক্কাল সক্কাল শাড়ি, পাঞ্জাবিতে ছেয়ে ফেলছে ভিক্টোরিয়া, রেড রোডের ট্রামলাইন, প্রিন্সেপ ঘাট, পার্ক, রেস্তোরা-– গোটা শহর। সমস্ত কুণ্ঠা, অবগুণ্ঠন সরিয়ে ফেলছে এক লহমায়। পুরো শীতকাল জুড়ে বিয়ের মরশুমে উড্-বী দম্পতিরা তিলোত্তমার আনাচে কানাচে ভাসিয়ে দিচ্ছে নিজেদের নিভৃতি। পুরুষ নারীর পরস্পরের পাশাপাশি আসার ছায়াপথে যে দ্বিধা দ্বন্দ্ব শাসন করত একসময়, এখন তারা বড্ড বেশি অপ্রাসঙ্গিক। এর পেছনে একটা প্রধান কারণ বিভিন্ন রকমের সোশাল মিডিয়ায় নারী পুরুষের ক্রমবর্ধমান অবাধ বিচরণ। একটা ছোট্ট ক্লিকে ভর করে মিলিয়ে যাচ্ছে সমস্ত ভৌগোলিক সীমারেখা। গতকাল পর্যন্তও যে মেয়েটি ছেলেটির দূরসম্পর্কের বন্ধুতালিকায় ছিল না কোথাও, কয়েক দিনের মধ্যেই তারা স্বতঃস্ফূর্ততায় হারিয়ে যাচ্ছে নিজেদের মধ্যে।
শংকর সেনগুপ্ত ‘বাঙ্গালী জীবনে বিবাহ’ বইতে বলেছেন– “বিবাহ একটি অত্যন্ত ব্যক্তিগত বিষয়”। ফেসবুক, ট্যুইটার, ইন্সটাগ্রাম আরও হাজারো ইথার তরঙ্গের ভিড়ে আজ তা প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি সামাজিক। এই সামাজিকতায় পরিবার, পরিজনের কাছাকাছি আসার থেকেও জায়গা করে নিয়েছে জাহির করার প্রবণতা। আগে ফোটোগ্রাফারকে বারবার বলতে হত– আরও একটু কাছে আসুন, আপনারা একে অপরের স্বামী-স্ত্রী, আরও একটু দূরত্ব কমতেই পারে। আর এই একবিংশে ‘মুখবই’-এর দেওয়াল জুড়ে হবু দম্পতি পাবলিক অ্যালবামে মেলে ধরে নিজেদের।
পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী এবং অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু তার ভালো-মন্দের আঁচে পুড়তে থাকে সমাজ জীবন, চিরকাল। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির হাত ধরে সবকিছু এখন সহজলভ্য, হাতের মুঠোয়, অর্থ থেকে সম্পর্ক, এর সুবিধের পাশাপাশি প্রতিক্রিয়াটাও বেশ প্রকট। অনায়াসে গড়ে উঠছে অন্তরঙ্গতা, তার স্থায়িত্ব নিয়েও উঠছে নানা প্রশ্ন। সেকালে ধৈর্য্য ছিল অনেক বেশি। এক্কেবারে অপরিচিত এক ব্যক্তিকে একবারের জন্যও না দেখে জীবনের সবচাইতে গোপনীয়তার মালিকানায় ভাগ বসাতে দেওয়ার ঝুঁকি নিতে গেলে যতটা সাহস এবং সহনশীলতা প্রয়োজন হয়, সেইসময়ের জলহাওয়ায় তার উপাদান ছিল। অসুবিধে তখনও ছিল, হয়ত ক’ছটাক বেশি। সাধারণ জীবনযাত্রা, যৌথ পরিবারের দীর্ঘ নিয়মকানুনের বেড়াজালে নিজেদের কতিপয় মুহূর্ত বাঁচিয়ে নেওয়ার চেষ্টা, বেশিরভাগ সময়েই যা সফল হত না। তবু দাম্পত্যে পূর্ণচ্ছেদ টানবার ভাবনা দুঃস্বপ্নেও উঁকি দিত না। অবিচল থেকে পরম যত্নে সমস্ত ঝড়ঝাপটা নিম্নচাপের শক্তি প্রশমিত করার তাগিদ ছিল। সাম্প্রতিক কালের বেড়ে চলা বিবাহ বিচ্ছেদে বদলে যাচ্ছে সম্পর্কের সমীকরণ। খুব অল্পদিনের ঘরবাঁধা ভেঙে যাচ্ছে তুচ্ছ কারণে। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, একবার সমস্যা শুরু হলে, স্বামী বা স্ত্রী কেউই সেভাবে ব্যয় করতে চাইছে না বেশি সময়। মুছে ফেলতে চাইছে “যদিদং হৃদয়ং তব” সূত্র। এভাবে চলতে থাকলে খুব অল্পদিনের মধেই বিয়ে শুধুমাত্র একটি ভারচুয়াল ইনস্টিটিউশনে পরিণত হবে। এর থেকে বাঙালির নিস্তার কী হতে পারে সে প্রসঙ্গে শংকর সেনগুপ্তর ‘বাঙ্গালী জীবনে বিবাহ’ বইতে লেখা চেতাবনি হয়ত বাঁচিয়ে রাখতে পারে আমাদের–
“সম্প্রতি বাঙালির অধোগতি চতুর্দিকে। চতুর্দিকে অসন্তোষ এবং চিত্ত বিক্ষোভ। এই বিক্ষোভের নানা কারণ এবং নানা দিকে তার গতি… সমাজ বিক্ষোভের অন্যতম কারণ সুখী গৃহকোণের অভাব। সুখী গৃহকোণের প্রধান অবলম্বন সুস্থ বিবাহ। প্রাচীনযুগ থেকে অদ্যবধি বাঙালি কী ভাবে সুখী গৃহকোণের জন্য বিবাহব্যবস্থা বা বিধি অনুসরণ করে চলেছে সেই তথ্য ও কাহিনী জানতে পারলে বিবাহ ব্যাপারে বিক্ষুব্ধ বাঙালি জীবনের নতুন এক স্বাদ ও উদ্যম ফিরে পেতে পারে…”