আঁখিনাচন সংক্রান্ত এবং অন্যান্য

সোমদেব ঘোষ

 

আশি নব্বইয়ের দশকে আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকীতে সমরেশ মজুমদারের সত্যসন্ধানী অর্জুনের গল্প ছাপা হত। অর্জুন জলপাইগুড়িবাসী প্রাইভেট ডিটেকটিভ, মুখে চাপ দাড়ি, বয়স অল্প, বাহন লাল মোটরবাইক। বিয়েথা করেনি, মা’র সঙ্গে বাড়িতে থাকে। বিপদে পড়লে বিশেষ ঘাবড়ায় না, বা ঘাবড়ালেও সেটা শত্রুর কাছে প্রকাশ করে না। বেশ সুন্দর ছিমছাম ঘরোয়া গোয়েন্দা চরিত্র, অপারিবারিক ফেলুমিত্তির ও ভীষণভাবেই পারিবারিক ব্যোমকেশ বক্সীর মাঝামাঝি একটা ব্যাপার। সমরেশবাবুর গল্পের প্লটও ভাল, লেখাও ঝরঝরে, পড়তেও আরাম।

একদিন অর্জুনকে কোনও কারণে হঠাৎ কোথাও বেরোতে হচ্ছে। সম্ভবত গুরু অমল সোমের কাছ থেকেই জরুরী তলব এসেছে। মা’কে বলে গায়ে জামা চাপিয়ে মোটরবাইকের চাবি নিয়ে বেরোতে যাবে, এমন সময়ে মা তাকে আটকালেন।

“মা”, অর্জুন বিরক্ত হয়ে বলল, “দেরী হয়ে যাচ্ছে।”

“ওরে আজ তুই বেরোস না রে,” মা বললেন, “আজ দিনটা ভাল নয়। সকাল থেকেই ডান চোখটা নাচছে।”[[১]]

মা’র কথা শুনে অর্জুন থেমে গেলে গল্পের প্লটও থেমে যেত, সমরেশবাবুকেও এক্সট্রা খাটতে হত। সম্ভবত অমল সোমও রাগ করতেন। কিন্তু অর্জুন আধুনিক ছেলে, সে এসবে বিশ্বাস করে না। তাই বেরিয়ে সে গেল, সম্ভবত বিপদেও পড়ল, আর সেই বিপদ থেকে রক্ষাও পেল। বিপদে যে পড়ল, তার জন্য অর্জুনের মা’র ডান চোখ নাচাই দায়ী কিনা, তা অবিশ্যি সমরেশবাবু লিখে যাননি।

এটা নিছক কল্পনা। অর্জুন, অর্জুনের মা, অমল সোম সবাই কাল্পনিক চরিত্র। কিন্তু কল্পনা তো বাস্তবের ছায়ামাত্র, যেন ঘষা কাঁচের আয়নায় অস্বচ্ছ প্রতিবিম্ব। তাই আজও এই ভারতবর্ষে মা-মাসি-পিসিদের “ডান-চোখ নাচছে” শুনলে লোকে দু’বার ভাবে। কিছুই বলা যায় না, যদি কিছু অঘটন ঘটে। বেড়ালে পথ কেটেছে? ওরে বাবা, থেমে থাকো, থুথু ফেলো। নাহলে অ্যাক্সিডেন্ট হবেই হবে। কোথাও যাওয়া হচ্ছে? পেছন থেকে কেউ হেঁচে দিয়েছে? সর্বনাশ! থেমে যাও। কিছু বলার চেষ্টা করছ, এমন সময় টিকটিকি পরপর তিনবার টিক-টিক-টিক করেছে? সাক্ষাৎ তক্ষক। কথা ফলবেই।

সত্যিই কি এরকম হয়? হওয়া সম্ভব? হাঁচি তো হয় নাকে ধুলো ঢুকলে বা সর্দি হলে। তার সঙ্গে ভাগ্যের কী সম্পর্ক? বেড়াল তো আর জানে না রাস্তা পেরোলে ট্র্যাফিক আটকে যাবে। তার রাস্তা পেরনোর শখ হয়েছে, সে রাস্তা পেরোতেই পারে। যেকোনও বেড়াল-কুকুর-খরগোশ-বেজি-মানুষই রাস্তা পেরোতে পারে। তা বলে বেড়াল পেরোলেই দুর্ঘটনা ঘটবে? টিকটিকির জীবনে দুটো কাজ। এক, পোকামাকড় খাওয়া। দুই, টিউবলাইটের ফাঁকে লুকিয়ে থেকে ওপর থেকে তাক করে বোমা ফেলা। শরদিন্দুবাবু থাকলে বলতেন, টিকটিকি ডিমও পাড়ে বৈকি। কিন্তু টিকটিকি ফিলজফি বোঝে, এ প্রমাণ স্বয়ং দেকার্তেও দিতে পারবেন না।

হাঁচি-টিকটিকি-বেড়াল-চোখনাচা, এগুলো কুসংস্কার। আর এক্ষুণি যে কথাগুলো লিখলাম, সেগুলো যুক্তি। জল আর তেল যেমন মেশে না, কাস্টার্ড দিয়ে যেমন কখনওই ফিশ ফিঙ্গার খাওয়া যায় না, তেমনই যুক্তি আর কুসংস্কার কখনওই একসঙ্গে চলতে পারে না। কুসংস্কার গড়ে ওঠে অশিক্ষা এবং কুশিক্ষা থেকে। বেড়াল রাস্তা কাটার খানিক পরেই গাড়িটার অ্যাক্সিডেন্ট হল। অতএব দায়ী নির্ঘাত বেড়াল। চালকের দোষ ছিল কিনা, ব্রেক ফেল করেছিল কিনা, বৃষ্টি পড়ে রাস্তা পিছল হয়েছিল কিনা এসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। আসামী তো হাতের কাছেই আছে। পরপর দুটো ঘটনা ঘটলেই যে একটার সঙ্গে অন্যটার কার্যকারণ সম্বন্ধ থাকে না, সেটা অনেকেই জানে না। বা জানলেও বিশ্বাস করে না। রাস্তায়-ট্রেনে তো আকছার দুর্ঘটনা ঘটে। গত হপ্তাতেই দু-দু’খানা ট্রেন দুর্ঘটনা হল। গাড়িতে গাড়িতে টক্কর তো হামেশা হয়। অভিনেতা বিক্রম মাতাল অবস্থায় রাসবিহারীর কাছে ল্যাম্পপোস্টে গাড়ি ধাক্কা মারলেন। সোনিকা চৌহান প্রাণ হারালেন। তাদের গাড়ির সামনেও কি বেড়াল রাস্তা কেটেছিল?

এই যে আমরা মিসগুলো, বা, দুর্ঘটনার সময়ে, হিটগুলো দেখি, এটা আমাদের ডিএনের মধ্যে রয়েছে। মানুষের মগজ এভাবেই প্রোগ্রাম করা। এর কিছু ভাল দিকও আছে, সন্দেহ নেই। সবকিছুকে একই গুরুত্ব দিলে অনেক সময়ে সত্যিকারের জরুরী ব্যাপারগুলো তলিয়ে যেতে পারে। তাই বিবর্তনই মানুষকে বাছাই করতে শিখিয়েছে। কিন্তু এর ফল কী দাঁড়ায়? এক হাজার দুর্ঘটনা ঘটল, তার একটাতে হয়ত বেড়াল রাস্তা পেরিয়েছিল, তার মানে বেড়াল রাস্তা পেরোলেই দুর্ঘটনা নিশ্চিত। বেড়াল যে হামেশা রাস্তা পেরোচ্ছে, এবং পেরোলেই যে দুর্ঘটনা হচ্ছে না, সেটাই কেউ দেখে না আর।

একটু আগে বললাম, পরপর দু’টো ঘটনা ঘটলেই যে তাদের মধ্যে কার্যকারণ সম্বন্ধ থাকতেই হবে, তার কোনও কারণ নেই। অর্থাৎ স্ট্যাটিস্টিক্সের বা পরিসংখ্যানের ভাষায় “কোরিলেশন ডাজ নট ইম্পলাই কজেশন”। দুঃখের বিষয়, স্ট্যাটিস্টিক্স বিজ্ঞানেরই একটা শাখা। আর বিজ্ঞান মানেই যুক্তি। কুসংস্কার যাঁরা মানেন তাঁরা তো আর এ’কথা শুনবেন না। কুসংস্কারের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ হয় না। সেটা করার চেষ্টা বৃথা। যেটা করা যায় তা হল বিভিন্ন জায়গায় কী কী কুসংস্কার অাছে তা খুঁজে বের করা, সেই বিশেষ কুসংস্কারের অর্থ কী বা অন্তত লোকে কী ভাবে সেটা জানে, আর এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে তা বোঝার চেষ্টা করা।

ভারতবর্ষ দিয়েই শুরু করা যাক। যেহেতু “যা নেই ভারতে তা নেই ভারতে”, তাই মহাভারত দিয়েই আমাদের খোঁজ শুরু হোক।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ। কৌরবরা মরেটরে গেছে, পাণ্ডবরা রাজা হয়ে হস্তিনাপুরে জাঁকিয়ে বসেছে। অনেকদিন কৃষ্ণের কোনও খবর না পেয়ে অর্জুন দ্বারকা গেছে। সাত মাস হয়ে গেছে, অর্জুনেরও কোনও খবর নেই। রাজা যুধিষ্ঠির চিন্তায় আছেন। ভাইয়ের হল কী? তার কোনও খবর নেই কেন? তার সারথিও চুপ কেন? ভাই ভীম, কোনও গোলমাল হয়নি তো? আমার বাঁ হাত বাঁ উরু বাঁ চোখ বারংবার কাঁপছে কেন? ভয়ে আমার বুক ধড়ফড় করছে। এর মানে নিশ্চয় কোনও অনিষ্ট হবে। [[২]]

কাছের মানুষের কাছ থেকে অনেকদিন খবর না পেয়ে বৃদ্ধ যুধিষ্ঠিরের শারীরিক অস্বস্তি হচ্ছে, এ আর আশ্চর্য কী? অনেকদিন খোঁজ নেই, কৃষ্ণার্জুনের অনিষ্ট হতেই পারে। যুধিষ্ঠির কিন্তু এতেই থেমে থাকেননি। আরও বলেছেন, দেখ ভীম, কীভাবে সূর্য ওঠার সময় শেয়াল ডাকছে, মুখ দিয়ে তার আগুন বেরোচ্ছে। কুকুর আমাকে দেখলেই কেমন নির্ভীকভাবে ডেকে চলেছে। গরুর মতো ভাল জন্তু আমার বাঁ দিক দিয়ে যাচ্ছে, আর গাধার মতো নীচ জানোয়ার আমার চারদিকে ঘুরছে। আমার ঘোড়া আমায় দেখে কাঁদছে। পায়রা যেন মৃত্যুদূত, প্যাঁচা ও তার শত্রু কাকেদের চিৎকার শুনে আমার বুক কাঁপছে। প্রকৃতি পাগল হয়ে গেছে, হে ভীম। প্রলয় আসছে, প্রলয়!

শব্দের লিমিট আছে, তাই শেষ অংশটা সংক্ষেপে সারলাম। ইচ্ছে হলে পুরোটা নীচের লিঙ্কে গিয়ে পড়তে পারেন। প্রকৃত পাগল কে, প্রকৃতি না অন্য কেউ, সেটা বোধ করি বোঝা যাবে। আসলে এত বছর অপেক্ষা করে শেষে এত মানুষের রক্তমাখা সিংহাসনে উঠলে যেকোনও মহারথীরই মাথাটা…

যাই হোক। সেটা আলোচ্য বিষয় নয়। শরীরের বাঁ দিক কাঁপা বা গরুর বাঁ দিক থেকে যাওয়া ইত্যাদি হল অনিষ্ট বা প্রলয়ের লক্ষণ। এই কথা পুরাণে থাকলেও পুরনো নয়, এখনও একই কথা মেনে চলা হয়। অতি প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষের ডিএনএ-তে এই চিন্তাধারা এবং কুসংস্কার গেঁথে রয়েছে। তাই তার ভিত অতি শক্ত।

কুসংস্কার কি শুধু ভারতবর্ষেই আছে? না। চীন সভ্যতা ভারতের মতোই হাজার হাজার বছরের পুরনো। সেখানেও “মি শিন” বা কুসংস্কার দেখতে পাওয়া যায় বৈকি। চীনে “৪” সংখ্যাটি অত্যন্ত “বু শিং দে” বা অপয়া। তাই চীনে লিফ্টে অনেকসময়তেই চার নম্বর বোতামটা পাওয়া যায় না। হোটেল বা অন্যান্য বহুতল বাড়িতে চারতলা থাকে না, তিনতলার পর সোজা পাঁচতলা হয়ে যায়। চার অপয়া কেন তার কারণটা অদ্ভুত। চীনাভাষায় “৪”-এর উচ্চারণ হল “সি”। মুশকিল হল, মৃত্যুর উচ্চারণও “সি”, যদিও গলার স্বরের চড়াই বা উৎরাইতে ফারাক আছে। যেহেতু সংখ্যাটার উচ্চারণ শুনলেই মৃত্যুর কথা মনে পড়ে, তাই চার অতি অপয়া। এদিকে আবার “৮”-এর উচ্চারণ হল “বা”, আর ধনসম্পদ ও সমৃদ্ধির উচ্চারণ হল “ফা”। তাই আট অতি “হাও ইউন”, পয়া। ২০০৮ সালের বেজিং অলিম্পিকের উদ্ঘাটন হয়েছিল আগস্ট মাসের আট তারিখের রাত আটটা আটের সময়। অর্থাৎ রাত ৮:০৮, ৮/৮/২০০৮।

অবশ্য নম্বর নিয়ে কুসংস্কার শুধু চীনে নেই। পশ্চিমা খ্রিস্টান দেশে “১৩” হল অতি অপয়া নম্বর। তেরো নম্বর শিষ্য জুডাস যীশুর সঙ্গে বেইমানি করেছিল, তাই হোটেলে তেরোতলা থাকে না, লিফটে ১৩ নম্বর বোতাম থাকে না। আবার “৬৬৬” তো সাক্ষাৎ শয়তানের নম্বর।

লেখাটা শুরু করেছিলাম চোখ নাচা নিয়ে। সেখানেই ফিরে যাওয়া যাক। আগেই বললাম, ভারতবর্ষের ডান-চোখ নাচা মানে খারাপ কিছু ঘটবে। হয় কারুর অপঘাতে মৃত্যু হবে, নয় কেউ সমস্ত টাকাপয়সা হারিয়ে পথে বসবে। এদিকে বাঁ চোখ নাচলে ব্যাপারটা পুরো উল্টো! পরীক্ষায় ছেলে পাশ করবে, লটারির টিকিট লেগে যাবে, এমনকি মোহনবাগান (বা ইস্টবেঙ্গল, যার যেমন) জিতবেই জিতবে।

চীনদেশে আবার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ উল্টো। বাঁ চোখে যদি সূক্ষ্ম স্পন্দন হয় তার মানে ভাগ্যদেবী ফিরে তাকিয়েছেন। জীবনে সুখ-শান্তি-স্বস্তি আসবে। ডান চোখ পতপত করা মানে ভাগ্যদেব মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। পতন, মূর্ছা ও মৃত্যু হতে আর দেরী নেই। শেয়ার মার্কেটে ধস নামল বলে।

ছোট্ট করে একটা চীটশীট তৈরী করা যাক।

ভারতবর্ষ : ডান চোখ নাচা ভাল, বাঁ চোখ নাচা খারাপ।

চীনদেশ : ডান চোখ নাচা খারাপ, বাঁ চোখ নাচা ভাল।

সাধে কি আর এই দুই দেশের মধ্যে এত বিরোধ?

কিন্তু এখানে একটা কিন্তু আছে। প্রথমেই বলেছি, অর্জুন (গোয়েন্দা সত্যসন্ধানী, তীরন্দাজ যোদ্ধা নয়) মা’র কথা না শুনেই বেরিয়ে গেল। মা বলেছিলেন, তাঁর ডান চোখ নাচছে। চীটশীট অনুযায়ী ডান চোখ নাচা ভাল ব্যাপার। তাহলে মা অর্জুনকে আটকাতে গেলেন কেন? ওদিকে বাঁ চোখ কাঁপতেই যে যুধিষ্ঠিরের কাঁপুনি ধরে গিছল। ব্যাপার কী?

কারণ খুবই সহজ। ওপরের যে চীটশীটটা দিয়েছি সেটা পুরুষদের জন্য। মহিলাদের ক্ষেত্রে সবই তো উল্টো, তাই পুরুষদেরটা দিলেই হত। মহিলাদের জন্য ওই চীটশীটটাকে উল্টে দিলেই হল। আগেকারদিন হলে লোকে আর এটা নিয়ে সময় বা কালি খরচ করত না। যেহেতু লেখাটা বৈদ্যুতিনভাবে প্রকাশিত হবে, কালির মামলা নেই, তাই দেওয়াই যাক।

চোখ নাচার অর্থ (মহিলাদের ক্ষেত্রে) :

ভারতবর্ষ : ডান চোখ নাচা খারাপ, বাঁ চোখ নাচা ভাল।

চীনদেশ : ডান চোখ নাচা ভাল, বাঁ চোখ নাচা খারাপ।

সেকেন্ডক্লাস সিটিজেনদের ব্যাপারস্যাপার শেষ। এবার এগোনো যাক।

চোখের পাতা কাঁপা মানে ভালমন্দ কিছু একটা হয়ে যেতে পারে, এই কুসংস্কার শুধু চীন বা ভারতে আছে ভাবলে ভুল হবে। আফ্রিকার কিছু কিছু স্থানে বা হাওয়াইতেও চোখ নাচার অর্থ বের করা হয়। কোথাও চোখের ওপরের পাতা কাঁপা হল পয়া, কোথাও বা উল্টোটা। বাঁ চোখের ওপরের পাতাটা তিনবার কেঁপে পাঁচ সেকেন্ড থেমে ফের সাত বার কাঁপল? নিশ্চয় কোন মৃত্যু আসন্ন। যে কারুর মৃত্যু। পৃথিবীর যেকোনও স্থানে। সে মৃত্যু আজও ঘটতে পারে, সাতদিন-তিনমাস-দুশো বছর পরেও ঘটতে পারে। ঘটবেই যে, এ কথা নিশ্চিত। সাক্ষাত মরণকে কি কেউ আটকাতে পারে?

বাঁ চোখ বা ডান চোখ নাচলে ভালমন্দ কী কী ঘটতে পারে তা তো বোঝা গেল। কিন্তু চোখের পাতা আদপে কাঁপে কেন, সে উত্তর কোথায় পাব? এইসব অলুক্ষুণে ঘটনা ঘটে বলেই চোখের পাতা কাঁপে, নাকি চোখের পাতা কাঁপে বলেই এইসব ঘটনা ঘটে? চোখের পাতা কি এক ধরনের ভবিষ্যতদ্রষ্টা রেডার? পশুপাখি যেমন ভূমিকম্প টের পায়, চোখের পাতাও কি সেরকম ভাগ্যকম্প টের পায়?

আজ্ঞে না। দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, এরকম সুপারপাওয়ার (এখনও) মানুষের মধ্যে দেখা যায়নি।

চোখের পাতা কেন কাঁপে তার বৈজ্ঞানিক উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের প্রথমে পেশী বা মাংশপেশী কীভাবে কাজ করে বুঝতে হবে। মস্তিষ্ক বা মগজাস্ত্রের কাজ ছাড়া বাকি প্রায় সমস্ত দৈনন্দিন কাজেই কোনও না কোনও মাংসপেশীর প্রয়োজন হচ্ছে আপনার। এই লেখাটা পড়ছেন? আপনার চোখ নড়ছে, চোখের পাতা পড়ছে, আপনি নিঃশ্বাস নিচ্ছেন, আপনার হার্ট ধুকপুক করছে। হাঁটতে গেলে পেশী, বসতে গেলে পেশী, লিখতে (বা টাইপাতে) গেলে পেশী, এমনকি বিশ্বশ্রী গুণময় বাগচীর ভূমিকায় অভিনয় করতে গেলেও পেশী। কিন্তু এই পেশী কাজ করে কীভাবে? যারা জিমেটিমে যায় তাদের হাত বেঁকিয়ে বাইসেপ ফোলাতে দেখা যায়। এই পেশী “ফোলানো” ব্যাপারটা কী? কীভাবে হয়?

মাংশপেশী বহু প্রকারের। তার মধ্যে অন্যতম স্কেলিটাল পেশী, বাংলায় যাকে বলে ঐচ্ছিক বা কঙ্কাল পেশী। হাড়ের সঙ্গে লিগামেন্ট দিয়ে আটকানো থাকে এই পেশী। ঐচ্ছিক পেশী সঙ্কোচন বা পেশী কনট্র্যাক্ট করা হলে কান টানলে মাথা আসার মতো লিগামেন্ট দিয়ে লাগানো হাড়খানিও নড়ে ওঠে। পেশী শিথিল করলে হাড় নিজের অবস্থায় ফিরে যায়। হাতের হাড়ের কথাই ধরা যাক। কনুই থেকে নীচের অংশ ভাঁজ করতে চান? তাহলে বাইসেপকে সঙ্কুচিত করতে হবে। এর পর ফের হাত সোজা করতে চান? ট্রাইসেপ (বাইসেপের উল্টোদিকে হাতের পেছনে থাকে) সঙ্কুচিত করতে হবে, একইসঙ্গে বাইসেপ শিথিল করতে হবে। ব্যস! সহজ ব্যাপার, তাই না?

অবশ্যই নয়। এই ছোট্ট সাধারণ দৈনন্দিন কাজের মধ্যেই যে কত জটিলতা লুকিয়ে আছে তা শুনলে চোখ কপালে উঠবে। প্রথমত, পেশীচালনা করতে গেলে তার কাছে ঠিকঠাক নির্দেশ পাঠাতে হবে। তাকে ঠিক সময় সঙ্কুচিত হতে বলতে হবে, আবার কাজ হলে গেলে শিথিল হতেও বলতে হবে। তার তো আর নিজের মাথাবুদ্ধি কিছু নেই যে আপনার মনে কী আছে টেলিপ্যাথিকালি বুঝে ফেলে টুক করে নিজের কাজ করবে। এই নির্দেশ কে দেবে? অবশ্যই আপনি। কিন্তু “আপনি” মানে কী? মস্তিষ্ক, তাই তো? পেশীকে কখন কী করতে হবে সেই নির্দেশ পাঠায় আপনার মস্তিষ্ক এবং, কোনও কোনও ক্ষেত্রে, আপনার শিরদাঁড়া। সেদিক থেকে মস্তিষ্ক হল চিত্রপরিচালক, আর মাংসপেশী অভিনেতা।

সিনেমায় “অ্যাকশন” বা “কাট্” বলতে হলে পরিচালককে গলা তুলতে হয় বা মুখে মেগাফোন লাগাতে হয়। সেই শব্দ হাওয়ায় ভর করে অভিনেতা এবং আরও বিভিন্ন সিনেমাকর্মীর কানে গেলে তারা সেই নির্দেশ মেনে কাজ শুরু বা বন্ধ করেন। মস্তিষ্কের গলা নেই, মেগাফোনও নেই। তার পক্ষে মাংসপেশীর কাছে খবর বা নির্দেশ পৌঁছনর কি কোনও উপায়ই নেই?

নার্ভাস হবেন না। উপায় আছে বৈকি। না থাকলে এ লেখা লেখাই হত না।

আমাদের শরীরে বহু বিভিন্ন ধরনের সেল বা কোষ আছে। এদের মধ্যে স্নায়ুকোষ বা নার্ভ সেল অন্যতম। এদের আরেক নাম নিউরন। এই নিউরনই হল মস্তিষ্কের মেগাফোন। এদের কাজ শুধু মস্তিষ্ক থেকে পেশীতে নির্দেশ ফেরি করা নয়, শরীরের কী অবস্থা তার পুঙ্খানুপুঙ্খ ধারাবিবরণী প্রতি মুহূর্তে মস্তিষ্কে সাপ্লাই দেওয়াটাও এদের দৈনিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। এরা শুধু মেগাফোন নয়, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সঞ্জয়ও বটে। ট্রেনের কামরাটা গরম না ঠাণ্ডা? কম্বলটা নরম না কুটকুটে? রেলের খাবারটা অখাদ্য না খাওয়ার অযোগ্য? বাথরুমে যেতে হলে নাকে রুমাল চাপা দেবেন না গ্যাসমাস্ক? এই সমস্ত তথ্য মস্তিষ্ক সরবরাহের দায়িত্বে আছে শ্রীমান নিউরন। নিউরন প্রধানত তিন প্রকারের। সঞ্জয়রূপী নিউরনদের বলা হয় সেন্সরি নিউরন। মেগাফোন হল মোটর নিউরন। আর যেসব নিউরন দুই নিউরনের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে সেই সেতু বা দালাল নিউরনদের বলে ইন্টারনিউরন। এই লেখায় মেগাফোন বা মোটর নিউরনরাই হিরো। তাই তাদের কথায় আসি এবার।

সঞ্জয় বা দালাল নিউরনদের মতোই মোটর নিউরনেরও প্রধান কাজ তথ্য সরবরাহ করা। মস্তিষ্ক হয়ত বাইসেপকে নির্দেশ দিতে চাইছে, হাত ভাঁজ করো। অমনি সেই নির্দেশ ইলেক্ট্রোকেমিক্যাল সঙ্কেতের রূপ ধরে মোটর নিউরন বেয়ে প্রতি ঘণ্টায় ৭২০ কিমি বা সেকেন্ডে ২০০ মিটার বেগে ধেয়ে যায় বাইসেপের দিকে। [[৩]] নিউরনের প্রান্তে এই সঙ্কেত পৌঁছলে সেখান থেকে নিউরোট্রান্সমিটার বেরিয়ে নিউরন আর পেশীর মধ্যেকার সিন্যাপ্সের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। পেশীর গোড়াতেও রিসেপ্টর আছে, তাতে নিউরোট্রান্সমিটার আটক হওয়ামাত্রই পেশী সঙ্কুচিত হওয়ার নির্দেশ পায়। বাইসেপ ফুলে ওঠে, হাতও ভাঁজ হয়।

সংক্ষেপে এটাই ঘটে। পরীক্ষায় তিন নম্বরের জন্য যথেষ্ট। বিস্তারিত ভাবে আট নম্বরের প্রশ্নের উত্তর চাইলে পরের অংশটা পড়ুন। অবিশ্যি চাইলে স্বচ্ছন্দে টপকে তার পরের অংশেও যেতে পারেন।

আমাদের শরীরের প্রতিটা কোষের ভেতর ও বাইরের মধ্যে একটা ভোল্টেজ (বৈজ্ঞানিক নাম মেমব্রেন পোটেনশিয়াল) থাকে। ঘাবড়াবেন না, খুবই কম, -৭০ মিলিভোল্টের মতো। বেশিরভাগ কোষে এই ভোল্টেজ একই থাকে। নিউরন বা পেশী এই ভোল্টেজ চাইলে পাল্টাতে পারে। নিউরনের দুটো অংশ থাকে। মাথার দিকটা থ্যাবড়া টাইপের, নাম ডেনড্রন। লেজটা ভীষণ লম্বা হয়, নাম অ্যাক্সন। [[৪]] ডেনড্রনের গায়ে ডেনড্রাইট (না, আঠা নয়) নামক কিছু অ্যান্টেনা জাতীয় জিনিস থাকে, সেখান থেকেই নিউরন তার নির্দেশ পায়। নির্দেশ পাওয়ামাত্র ডেনড্রনের মেমব্রেন পোটেনশিয়াল পাল্টাতে থাকে। -৭০ মিলিভোল্ট থেকে উঠে এক নিমেষে (এক মিলিসেকেন্ড) +৪০ মিলিভোল্ট হয়ে যায়। ফের পরমুহূর্তেই নামতে থাকে, আরও এক মিলিসেকেন্ডের মধ্যে কমে দাঁড়ায় -৯০ মিলিভোল্ট। এর পর আরও দু’মিলিসেকেন্ড বাদে ফের সেই -৭০ মিলিভোল্টে ফিরে আসে। এই ওঠানামাকে বলা হয় অ্যাকশন পোটেনশিয়াল। একবার ডেনড্রনে অ্যাকশন পোটেনশিয়াল তৈরী হলে সে অ্যাক্সন বেয়ে তীব্রগতিতে ছোট ছোট লাফ মেরে এগোতে থাকে অ্যাক্সনের অন্যপ্রান্তের দিকে। সে প্রান্তে পৌঁছনো মাত্র তরল রাসায়নিক পদার্থ সিন্যাপ্সে ছড়িয়ে যায়। উল্টোদিকে পেশীর রিসেপ্টরে এই নিউরোট্রান্সমিটার ধরা পড়া মাত্র আরেকটা অ্যাকশন পোটেনশিয়ালের সৃষ্টি হয়। সেই অ্যাকশন পোটেনশিয়াল পেশীর পুরোটায় ছড়িয়ে গিয়ে পেশী সঙ্কোচন করায়। হাতও ভাঁজ হয়। যতক্ষণ মস্তিষ্ক থেকে নির্দেশ আসছে, ততক্ষণ অ্যাকশন পোটেনশিয়ালও থাকে। নির্দেশ আসা শেষ হওয়া মাত্র “কাট্”।

তা তো হল, কিন্তু তার সঙ্গে চোখের পাতা কাঁপার কী সম্পর্ক?

চোখের পাতাতেও পেশী আছে। সেই পেশী সঙ্কুচিত এবং শিথিল হলে চোখের পাতাও পড়ে। বেশিরভাগ সময়ে চোখের পাতা পড়া আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না, আপনা থেকেই মিনিটে বার পনেরো পাতা পড়তে থাকে। এটা স্বাভাবিক, এভাবেই চোখ পরিষ্কার থাকে, শুকিয়ে যাওয়া থেকেও রক্ষা পায়। কিন্তু কখনও কখনও এই সুশৃঙ্খল পদ্ধতিতে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। মস্তিষ্কের কোনও নির্দেশ ছাড়াই নিউরনের প্রান্তে হঠাৎ নিজে থেকেই অ্যাকশন পোটেনশিয়াল তৈরী হতে থাকে, আর তাই পেশীও আপনা-আপনিই ভাঁজ হতে থাকে। এরকম অ্যাকশন পোটেনশিয়াল বাড়াকমার জন্যই চোখের পাতা দপদপ করে কাঁপতে থাকে।

চোখের পাতা কখন কাঁপে? ঘুম কম হলে, ক্যাফিন বেশি খেলে, বা খুব বেশি শারীরিক পরিশ্রম বা এক্সারসাইজ করলে চোখের পাতা কাঁপতে পারে। জীবনে খুব স্ট্রেস বা চাপ থাকলে হতে পারে, চোখে কিছু পড়লে বা কোনওরকম ইরিটেশন হলে কাঁপতে পারে। অনেকক্ষণ টিভি বা কম্প্যুটারের স্ক্রীনের দিকে তাকালেও হতে পারে। এ ছাড়াও কোনও নার্ভ জখম হলেও অনেকসময় ভুল সিগনাল দিতে পারে। সবশেষে কোনও স্নায়বিক ব্যাধি বা রোগ থাকলেও চোখের পাতায় কাঁপুনি আসতে পারে।

চোখের পাতায় কাঁপুনি কি খারাপ? সেটা নির্ভর করছে আপনি তাতে কতটা বিরক্ত হচ্ছেন তার ওপর। চোখ ব্যবহার করে কোনও সূক্ষ্ম কাজ করার সময় এরকম কাঁপুনি দিলে মুশকিল, কিন্তু তা ছাড়া এটা খুব একটা মারাত্মক সমস্যা নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটু ভাল ঘুম দিয়ে নিলেই চলে যায়। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে ব্লেফারোস্প্যাজম। আমি বলি দস্যু মোহন। কোথা থেকে আসে, আর কোথায় কীভাবে পালিয়ে যায়, কিসুই বোঝা যায় না।

ফুটনোট

[[১]] : স্মৃতি খুবই আজব জিনিস। কোনও এক চরিত্রের মা “সকাল থেকে বাঁ-চোখটা নাচছে” এ কথা বলেছিলেন, এটা স্পষ্ট মনে আছে। কিন্তু তিনি অর্জুনের মা, নাকি তোপসের মা, নাকি পাণ্ডবগোয়েন্দার লীডার বাবলুর মা, সেটা বেমালুম ভুলে গেছি। অবিশ্যি এই ছোট্ট ডিটেলটা এই আলোচনায় খুব একটা প্রাসঙ্গিক নয়।

[[২]] : এটা ঠিক মহাভারত নয়। এটা পেয়েছি ভাগবৎ পুরাণ থেকে। নীচে রেফারেন্স বিভাগে লিঙ্ক দিলাম।

[[৩]] : না, ভুল পড়েননি। সেকেন্ডে ২০০ মিটার বা ঘণ্টায় ৭২০ কিমি স্পীডই বটে। একজন গড় মানুষের মাথা থেকে পা অবধি এই সঙ্কেত যেতে সময় নেবে ৯ মিলিসেকেন্ড।

[[৪]] : আমাদের পায়ে যেসব নিউরন থাকে তার অ্যাক্সন অনেকসময় এক মিটার বা প্রায় তিন ফুট অবধি লম্বা হয়।

অসম্পূর্ণ রেফারেন্স আর বিবলিওগ্রাফি

ভাগবত পুরাণ, যুধিষ্ঠিরের ভয় পাওয়া : https://www.vedabase.com/en/sb/1/14/chapter-view

চীনদেশের কুসংস্কার : https://blogs.transparent.com/chinese/very-superstitious/

আঁখিনাচন কুসংস্কার : http://www.holestoheavens.com/left-eye-twitching/

ব্লেফারোস্প্যাজম কেন হয় :

(১) http://www.buzzle.com/articles/eyelid-twitching-causes.html

(২) http://www.allaboutvision.com/conditions/eye-twitching.htm

(৩) http://www.allaboutvision.com/conditions/eye-twitching-infographic.htm

(৪) https://www.youtube.com/watch?v=HOlxlPqJpnU

নিউরন ও মাংসপেশীর কাণ্ডকারখানা :

(১) https://en.wikipedia.org/wiki/Muscle_contraction#Neuromuscular_junction

(২) https://en.wikipedia.org/wiki/Action_potential

(৩) https://en.wikipedia.org/wiki/Saltatory_conduction

(৪) https://en.wikipedia.org/wiki/File:1009_Motor_End_Plate_and_Innervation.jpg

(৫) http://education.ucf.edu/litsymposium/resources2013/crittenden_handout1.pdf

(৬) https://classconnection.s3.amazonaws.com/116028/flashcards/691844/jpg/synapse.jpg

(৭) https://www.khanacademy.org/science/biology/membranes-and-transport/bulk-transport/v/exocytosis

(৮) http://cshperspectives.cshlp.org/content/3/12/a005637.full

(৯) https://en.wikipedia.org/wiki/Synapse#/media/File:SynapseSchematic_lines.svg

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...