সঙ্কেত হক
লেখক পদার্থবিজ্ঞানের স্নাতকোত্তর
মৌলিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন তত্ত্বের কথা বইতে আমরা সকলেই পড়েছি। একটা সময় ছিল যখন কীভাবে কম সময়ে কম মেহনতে বেশি উৎপাদন করা যায়, সে নিয়েই বিজ্ঞানের বিভিন্ন তত্ত্বকে ব্যবহার করা হত। এখন তো আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে সহজ-সুন্দর করে তোলার পিছনে বিজ্ঞানের অবদান সর্বত্র। সব পরিসরেই যখন বিজ্ঞানের প্রয়োগ হচ্ছে, তখন খেলাধূলার জগৎই বা বাকি থাকে কেন। সদ্য টোকিওতে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক শেষ হল। সেই গত বছরের মার্চ মাস থেকে অতিমারি পরিস্থিতিতে মন খারাপের দিন কাটছে আমাদের। তারই মধ্যে বিরাট আনন্দের খবর এল। স্বাধীনতার পর অ্যাথলেটিক্সে প্রথম সোনা জিতলেন কোনও ভারতীয়; পানিপথের নীরজ চোপড়া জ্যাভলিন ছুড়ে স্বর্ণপদক নিয়ে এসছেন। প্যারালিম্পিক্সেও জ্যাভলিন ছুড়ে দেশের হয়ে সোনা জিতেছেন সুমিত অন্তিল। জ্যাভলিন বা গোদা বাংলায় আমরা যাকে বল্লম বা বর্শা বলি সেটা ছোঁড়ার পিছনে বিজ্ঞানের যে নিয়ম কাজ করে সেটা নিয়েই এই নিবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে।
শুরুতেই বল্লম নিয়ে আলোচনা করলে বিষয়টা জটিল হয়ে যায়। তাই, একটা প্রাস (Projectile) নিয়ে শুরু করা যাক। যদি কোনও বস্তুকে মাটি থেকে ছোঁড়ার সময় অনুভূমিকের সঙ্গে কোণ করে (Obliquely) ছোড়া হয়, আর তার ফলে বস্তুটি বাঁকা (Curved) পথে চলতে থাকে, তাহলে তাকে আমরা প্রাসের গতি বলি। এই প্রাসের গতি সংক্রান্ত সব প্রশ্নের উত্তর জানা যায় পদার্থবিজ্ঞানের একটি বিখ্যাত সূত্রকে কাজে লাগিয়ে— নিউটনের গতিসূত্র।
১৬৬১ সালে স্যার আইজ্যাক নিউটন কেমব্রিজ বিশ্ব-বিদ্যালয়ের অধীনে একটি কলেজে পড়তে আসেন। এখন যেমন গোটা বিশ্বে করোণার প্রকোপ চলছে, ১৬৬৫-র গ্রীষ্মে ইংল্যান্ডের শহরাঞ্চলে প্লেগ মহামারি ছড়িয়ে পড়ে। ১৬৬৫ থেকে ১৬৬৬ এই দুই বছরের প্রায় পুরোটা জুড়ে প্রতি সপ্তাহে, মৃত্যু ঘটছিল সাত-আট হাজার মানুষের। ‘লকডাউন’ শব্দটার তখন প্রচলন ছিল না। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার তখন মহামারি রুখতে ওইরকম সিদ্ধান্তই নিয়েছিলো। সরকারি নির্দেশে সব কলেজ বন্ধ হয়ে গেলো। বেশিরভাগ ছাত্র যদিও তার মাস দুই আগে থাকতেই বাড়ি চলে এসছে। নিউটনও তাই করলেন। ইংল্যান্ডের উলস্থর্প বলে একটি জায়গায় ছিলো তার গ্রামের বাড়ি। তিনি ওখানেই চলে এলেন। ১৬৬৬-র শীতের মরশুম পার হলে, মহামারির দাপট কিছুটা কমার খবর আসে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় তখনও বন্ধ। ফলে গ্রামের বাড়িতেই থেকে গেলেন নিউটন। একদম যেন এখনকার মতো পরিস্থিতি। নিউটন কিন্তু বাড়িতে বসে আমোদ করে কাটাননি। ওই সময়তে উনি বস্তুকণার গতি সংক্রান্ত ধারণা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে থাকেন। এই গবেষণার ফলই পরবর্তীকালে তার লেখা বিখ্যাত বই প্রিঙ্কিপিয়াতে (Philosophiae Naturalis Principia Mathematica) পরিণতি পেয়েছিল। নিউটনের ৩টি গতিসূত্র আছে। তবে প্রাসের গতি বোঝার জন্য আমাদের দরকার ২য়টি। এই সূত্রে নিউটন বলেছেন কোনও বস্তুর ওপর বল প্রয়োগ করলে কীভাবে তার গতিতে পরিবর্তন হয়। যদি কোনও চলন্ত বস্তুর ওপর যে বল কাজ করছে, তার পরিমাণ জানা সম্ভব হয়, তাহলে এই গাণিতিক সূত্র ধরে দু-লাইন অঙ্ক কষলেই আমরা নিখুঁতভাবে বলে দিতে পারব বস্তুর গতিপথ (Trajectory) কেমন হবে। প্রাসের ক্ষেত্রে এই অঙ্কের সিদ্ধান্ত বলে তার পাল্লা (Horizontal Range) মূলত ২টি জিনিসের ওপর নির্ভর করে: ক) কত জোরে প্রাসটিকে ছোড়া হচ্ছে অর্থাৎ ঠিক ছোড়ার সময় তার গতিবেগ (Initial Velocity) কত ছিল; খ) অনুভূমির সঙ্গে কত কোণ (Initial Throw Angle) করে ছোড়া হচ্ছে। এখন যদি এমন হয় যেখান থেকে প্রাসটিকে ছোড়া হচ্ছে (Launching Point) আর সেটি যেখানে গিয়ে পৌঁছচ্ছে (Landing Point) দুটোই মাটি থেকে একই উচ্চতায় আছে, তাহলে সমাধান সহজেই হয়ে যায়। কিন্তু অ্যাথলেটিক্সে বল্লম ছোড়ার সময় সেটা হয় না। খেলোয়াড় তার উচ্চতা অনুযায়ী মাটির খানিকটা উঁচু থেকে বল্লমটি ছোড়েন। এরপর যদ্দূর পর্যন্ত যাওয়ার পর বল্লমের ডগা মাটি ছোঁয়, সেটায় ওই খেলোয়াড়ের বল্লমের পাল্লা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। আমাদের নীরজের ক্ষেত্রে এটা ছিল প্রায় ৮৭.৫৮ মিটার। তাহলে প্রাসের আলোচনায় গ) কোন উচ্চতা থেকে সেটাকে ছোড়া হচ্ছে (Initial Throw Height) সেটার গুরুত্বও কম নয়। আবার এমন নয় অলিম্পিকে বল্লম ছোড়ার প্রতিযোগিতা যেখানে হচ্ছিল সেখানে কোনও বাতাস ছিল না। বাতাসের মধ্যে বল্লম ছুড়লে তার পাল্লা নির্ণয়ের অঙ্কটা আরও শক্ত হয়ে যায়। বাতাস কোনদিকে বইছে এবং তার গতির মানের ওপর পাল্লা নির্ভর করে। সেসব নিয়ে বিস্তর চর্চা করার জন্য পদার্থবিজ্ঞানের একটি শাখা তৈরি হয়েছে— বায়ুগতিবিদ্যা (Aerodynamics)। খাটুনি কমানোর জন্য ধরে নেওয়া যেতে পারে বাতাস না থাকলে প্রাসের পাল্লা যা হওয়া উচিত ছিল, বাতাসের বাধা থাকায় সেটা একটু কমে যাবে।
এখন অঙ্কটা করার সময় ধরে নেওয়া হল প্রাসটি ছোড়া হয়েছিল মোটামুটি ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি উচ্চতা থেকে অনুভূমির সঙ্গে ৪৫ ডিগ্রি কোণ করে। তবে, ৩টি আলাদা প্রাথমিক বেগের জন্য প্রাসের পাল্লা কী হবে গুছিয়ে ১ নং ছকে দেখানো হল।
শর্ত | বাতাসের বাধা নেই | বাতাসের বাধা আছে |
যে গতিবেগে প্রাসটি ছোড়া হচ্ছে | প্রাসের সীমা | |
৯০ কিমি প্রতি ঘণ্টা | ৬৩.৬৪ মিটার | ৬২.৯৫৭ মিটার |
১০০ কিমি প্রতি ঘণ্টা | ৭৮.৫৬৭ মিটার | ৭৭.৬৩২ মিটার |
১২০ কিমি প্রতি ঘণ্টা | ১১০.৭৮ মিটার | ১০৯.২৩ মিটার |
ছক-১
অর্থাৎ, যত বেশি জোরে ছোড়া হবে, বল্লম তত দূরে গিয়ে পড়বে।
এবার একটা অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। ধরা যাক, প্রাসটিকে আগের মত উচ্চতা থেকেই ঘণ্টায় ১০৮ কিমি বেগে ছোড়া হল। তাহলে কোন কোণে প্রাস ছোড়া হলে পাল্লা কেমন হবে সেটা ২ নং ছকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
শর্ত | বাতাসের বাধা নেই | বাতাসের বাধা আছে |
যে কোণে প্রাসটি ছোড়া হচ্ছে | প্রাসের সীমা | |
৬০ ডিগ্রি | ৭৮ মিটার | ৭৬.৭৯৬ মিটার |
৪৫ ডিগ্রি | ৯১.২১৭ মিটার | ৯০.০৫ মিটার |
২০ ডিগ্রি | ৬২.০২ মিটার | ৬১.৬১২ মিটার |
ছক-২
তার মানে ৪৫ ডিগ্রিই হল সেই উপযুক্ত কোণ যাতে প্রাসের পাল্লা সবচেয়ে বেশি হয়। তার চেয়ে কমবেশি হলেই পাল্লা কমে যাবে।
আবার যদি ধরে নিই প্রাসটি যখন অনুভূমির সঙ্গে ৪৫ ডিগ্রি কোণ করে ছোঁড়া হয়েছিল তখন তার প্রাথমিক গতিবেগ ছিল ১০৮ কিমি প্রতি ঘণ্টা। তাহলে দুটি ভিন্ন উচ্চতার ক্ষেত্রে প্রাসের পাল্লার মাপ ৩ নং ছকে দেখা যাক।
শর্ত | বাতাসের বাধা নেই | বাতাসের বাধা আছে |
যে উচ্চতা থেকে প্রাসটি ছোড়া হচ্ছে | প্রাসের সীমা | |
৪ ফুট | ৮৯.০৯ মিটার | ৮৭.৯৮ মিটার |
৮ ফুট | ৯১.২১৭ মিটার | ৯০.০৫ মিটার |
ছক-৩
অর্থাৎ, দেখা যাচ্ছে ৪ ফুটের চেয়ে ফুট দুই বেশি উচ্চতা থেকে একই বেগে একই কোণে প্রাস ছুড়লে তার পাল্লা প্রায় ২ মিটার বেড়ে যাবে।
তা বলে এমন নয় যে প্রাসকে বেশি দূরে ছুড়তে গেলে তাকে বেশি উচ্চতা থেকেই ছুড়তে হবে। কম উচ্চতা থেকে ছুড়েও একই পাল্লা পাওয়া যায় যদি ছোড়ার সময় গতিবেগ বাড়ানো যায় কিংবা প্রক্ষেপ কোণ পালটানো হয়।
ধরা যাক কেউ ৭ ফুট উচ্চতা থেকে একটা প্রাস ৪৫ ডিগ্রি কোণে ১০৬.৭৪২২ কিমি প্রতি ঘণ্টা গতিবেগে ছুড়ল। অঙ্ক বলছে এর সীমা হবে ৯০ মিটার। এখন ঐ প্রাসটিকেই যদি ৫ ফুট উচ্চতা থেকে ছোড়া হয়, তবে একই সীমা পেতে হলে বেগের মান বাড়িয়ে ঘন্টায় ১০৭.০৯৬৭ কি.মি. (৪ নং ছবি) করতে হবে। মানে আরও বেশি জোরে ছুড়তে হবে। এখানে মনে হতেই পারে পাল্লার এত কম পার্থক্য নিয়ে মাথা ঘামানোর কারণ কী? কারণ অবশ্যই আছে। অলিম্পিকের মত আর্ন্তজাতিক স্তরের প্রতিযোগিতায় কয়েক মিলিমিটারের তফাতে পদক হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।
এবার প্রাসের জন্য আমরা যে গণনাটা করলাম, সেটাকে বল্লম ছোড়ার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যাক। প্রথমেই আমাদের মাথায় রাখতে হবে বল্লম বা অ্যাথলিট কেউই একটা বস্তুকণা নয়, অনেকগুলো বস্তুকণার সমবায়ে গড়া একটি বিস্তৃত দৃঢ় বস্তু (Extended Rigid Body)। তাই ছোঁড়ার সময় যখন অ্যাথলিট বল্লমের ওপর বল প্রয়োগ করেন, তখন গোটা বল্লমের ওপর প্রযুক্ত বলের প্রভাব হিসেব করা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু, যদি ধরে নেওয়া হয় যে বল্লমের সমস্ত বস্তুকণার ভর সঙ্কুচিত হয়ে তার ভরকেন্দ্রে (Centre of Mass) জমা আছে, তাহলে গোটা বল্লমের গতিটাকে শুধুমাত্র তার ভরকেন্দ্রের গতি হিসেবে ভাবা যাবে। অ্যাথলিটের গতির ক্ষেত্রেও একই নিয়ম খাটবে। অলিম্পিকে দেখা যায় সাধারণত অ্যাথলিটরা ঘন্টায় প্রায় ২০ কিমি বেগে ছুটে এসে বল্লম ছোড়েন। ছোড়ার সময় অ্যাথলিট তার শরীরের সমস্ত শক্তি কাঁধ হয়ে কনুইয়ের মাধ্যমে বল্লমে পাঠান। তাই, মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা কোনও পর্যবক্ষকের সাপেক্ষে ঠিক ছোড়ার মুহূর্তে বল্লমের ভরকেন্দ্রের গতিবেগের মান ২টো জিনিসের ওপর নির্ভর করে: ক) ছোড়ার মুহূর্তে অ্যাথলিটের ভরকেন্দ্রের গতিবেগ; আর খ) অ্যাথলিটের কব্জির গতিবেগ। এই দুই বেগের যোগফল (Resultant) থেকে বল্লমের প্রাথমিক বেগ চূড়ান্তভাবে নির্ণয় করা হয়। বেগের যেহেতু মান ও দিক দুই আছে, তাই এই যোগ বীজগণিতের সাধারণ নিয়ম মেনে হয় না; ভেক্টর সংযোজনের নিয়ম অনুযায়ী হয়।
এ তো গেল বোঝানোর সুবিধের জন্য সহজ একটা তুলনা। কিন্তু আসল বল্লম ছোড়ার সময় আরও অনেকগুলো বিষয় চলে আসে। বল্লমের মাপ, গঠন, রং করার পর সব জায়গা সমান মসৃণ কিনা… এই সবকিছু বল্লমের গতিপথের পাল্লাকে প্রভাবিত করে। এই জন্যেই অলিম্পিকে প্রতিযোগীদের বল্লমের ওজন, দৈর্ঘ্য কী হবে সব ঠিক করে দেওয়া থাকে। এসব ধরে অঙ্ক কষতে গেলে আর হাতে করে হয় না, আধুনিক কম্পিউটারের সাহায্য নিতে হয়। মুম্বাইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ-এর বিজ্ঞানী ডঃ অর্ণব ভট্টাচার্য সবকিছু নিয়ে হিসেব করে দেখিয়েছেন মাটি থেকে প্রায় ৩৬ ডিগ্রি কোণ করে বল্লম ছুঁড়লে তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে সন্তোষজনক ফল পাওয়া যায়।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে নিউটনের ২য় গতিসুত্রকে কাজে লাগিয়ে সূক্ষ্ম মাপজোক করলে একজন অ্যাথলিট নিখুঁত ধারণা পেয়ে যাবেন কীভাবে ছুড়লে বল্লম সবচেয়ে বেশি দূরে গিয়ে পড়বে। অ্যাথলিটের শুধু পেশির জোর থাকলেই চলবে না; শক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছোড়ার কৌশলও শেখা চাই। সেই অনুযায়ী অনুশীলন দরকার। তবেই সাফল্য আসবে। নিউটন যখন এই সূত্র দিয়েছিলেন তিনি হয়তো ভাবতেই পারেননি তার সূত্রকে কাজে লাগিয়ে এত কিছু হবে। তাই, দেশের সরকারের উচিত মৌলিক বিজ্ঞানের গবেষণাকে গুরুত্বহীন না করে তাকে আরও বেশি করে উৎসাহিত করা। তাতে রাতারাতি তেলের দাম কমবে না ঠিকই, কিন্তু ভবিষ্যতে অনেক কাজ দেবে।
তথ্যসূত্র:
- ভাওয়াল, রাতুল। ফেসবুক পোস্ট। ৮ আগস্ট, ২০২১।
- গাণিতিক গণনা করার সময় ধরে নেওয়া হয়েছে: পৃথিবীর অভিকর্ষ ত্বরণের মান S.I. এককে ১০; বাতাসের বাধা প্রাসের গতিবেগের তাৎক্ষণিক মানের সাথে সমানুপাতিক (FAir v); আপেক্ষিক সমানুপাতিক ধ্রুবকের মান S.I. এককে ০.০০৬।
- Jalalabadi, Yousef et al. Analyzing, investigating and calculating… TZK. Vol-5, Issue-1, 31 March 2019.
- Bhattacharya, Arnab. Tweet. 8 August 2021.