সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
গদ্যকার, প্রাবন্ধিক, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক
এক রোমাঞ্চকর অভিযান…
আমার আজকের গল্প শুরু করব আকাশ এবং ঐশ্বর্যর কথা দিয়ে। এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার ভয়াল, ভয়ঙ্কর স্মৃতিকে আগলে রেখে আগামী দিনে যৌথ জীবনযাপনের অঙ্গীকার করলেন ওঁরা মন্দিরের বিগ্রহ আর হাতে গোনা কয়েকজন আত্মজনকে সাক্ষী রেখে। সামাজিক মাধ্যমে এঁদের দুজনকে নিয়ে নাকি এই মুহূর্তে তুমুল আলোচনার পর্ব চলছে। কেন এই দুই মালয়ালি তরুণ-তরুণীকে নিয়ে এমন তুমুল হইচই? অনেক অনেক রঙ্গে ভরা ভারতবর্ষে বিবাহ অনুষ্ঠানের আয়োজন নিয়ে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা আমাদের জানা আছে— কখনও আকাশে, কখনও সমুদ্রের গভীরে, কখনওবা নির্জন নিরালা দ্বীপে সন্তানদের বিবাহের আসর বসিয়ে আমজনতার নজর টানতে চেষ্টার কোনও কার্পণ্য করেন না অভিভাবকেরা। কিন্তু এমন কোনও প্রচেষ্টার আয়োজন করা মোটেই সম্ভব ছিল না আকাশ ও ঐশ্বর্যের অভিভাবকদের পক্ষে। কেরলের দক্ষিণভাগের আলাপুঝা জেলার থালাভেডি অঞ্চলের ঐশ্বর্য ও আকাশ তুমুল জলস্রোতের নাচন সামলে কয়েক কিলোমিটার জলপথ রান্না করার বড় গামলায় চেপে পাড়ি দিয়ে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন। এমনটা যে তাঁদের কোনও পূর্বপরিকল্পিত স্বেচ্ছাকৃত অভিযান নয় বরং পরিবর্তিত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়েই অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে এমনটা করতে হয়েছে তা বোধহয় অনুমান করতে পারছেন সুধী পাঠকমণ্ডলী। এই মুহূর্তে ‘ঈশ্বরের আপন দেশ’ কেরল জুড়ে চলছে প্রকৃতির মাতঙ্গ মাতন। সমস্ত খবর ছাপিয়ে দেশজুড়ে তুমুল বর্ষণজনিত বিপর্যয়ের সূত্রে কেরল এখন সংবাদ-শিরোনামে।
বিপর্যয়ের ক্রমতালিকা
মালয়ালি শব্দ ‘কেরা’— অর্থ নারকেল— থেকেই কেরল নামের উৎপত্তি। অনেক কারণেই ভারতের দক্ষিণতম প্রান্তসীমায় অবস্থিত এই রাজ্যটিকে নিয়ে একদা আমাদের দৈনন্দিন চায়ের আসরে তুমুল আলোচনা চলেছে। তবে বিগত প্রায় অর্ধ দশকে একাধিক প্রাকৃতিক অনিয়মের সুবাদে এই রাজ্যটিকে নিয়ে আমাদের উৎকণ্ঠা বাড়ছে। পর্বতময়, অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই রাজ্যটি বারংবার বন্যার কবলে পড়ে বিপর্যস্ত হয়েছে নিকট অতীতে। ২০১৮ সালের ভয়াবহ বিপর্যয়ের স্মৃতি মলিন হতে না হতেই একাদিক্রমে ২০১৯, ২০২০ এবং বর্তমান বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের বিপর্যয় ঈশ্বরের আপন দেশের মানুষের প্রতিদিনকার যাপনের মূল লড়াইয়ের ক্ষেত্রটিকে ভীষণভাবে অনিশ্চিত করে তুলেছে। ঠিক কী ঘটেছে কেরলে, বিশেষ করে বললে রাজ্যটির দক্ষিণভাগের জেলাগুলিতে? একটু আলোচনা করে নেওয়া যাক এই অবসরে।
বিপর্যস্ত কেরল, বিপন্ন মানুষ
আবহাওয়া দপ্তরের পূর্বাভাস ছিল প্রবল বর্ষণের, তবে তা যে এমন ভয়ঙ্কর রূপ নিতে চলেছে তা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি দক্ষিণ কেরলের ইডুক্কি ও কোট্টায়াম জেলার মানুষজন। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু বর্ষার মেঘের পসরা নিয়ে কেরলের মাটি ছুঁয়েই ভারতের অন্যান্য প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে। তাই বৃষ্টির সঙ্গে প্রায় এক তারেই বাঁধা এই দক্ষিণি মানুষজনের আনন্দময় জীবনছন্দ। নানা কারণেই যে সেই চেনা বর্ষার চরিত্র বদলে যাচ্ছে তা বেশ টের পাচ্ছিলেন এই রাজ্যের অধিবাসীরা। আবহাওয়া দপ্তর আগাম সর্তকতা জারি করে জানিয়ে দিয়েছিল ভারী থেকে অতি-ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনার কথা। সরকারের তরফে উপকূলবর্তী অঞ্চল সহ ছয়টি জেলায় লাল সঙ্কেত দেখিয়ে পর্যটক চলাচলের ওপর কড়া বিধিনিষেধ কার্যকর করা হয়েছিল। মানা করা হয়েছিল পর্বতের উচ্চতর অংশে ভ্রমণ বিষয়ে। রাজ্যের নয়টি জলাধার থেকে শুরু হয়েছিল জল ছাড়ার কাজ, কেননা বর্ষার জলে টইটম্বুর হয়ে থাকা জলাধারগুলির জলধারণ ক্ষমতা ইতোমধ্যেই বিপদসীমার কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। স্থানীয় প্রশাসনের তরফে সংশ্লিষ্ট জেলার মানুষজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজও শুরু করা হয়েছিল, কিন্তু প্রবল মেঘভাঙা বৃষ্টির সঙ্গে হড়পা বানের তাণ্ডব সব হিসেব-নিকেশ উলটে দিল। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসা জল ভূমিধসের প্রবণতা বাড়িয়ে দেওয়ায় ফল হল মারাত্মক। জলের তোড়ে মানুষজনের ভেসে যাওয়ার ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভূমিপাত। ভূমিধসের কারণে লাফিয়ে বাড়ছে প্রাণহানির ঘটনা। এক বিষাদময় পরিণতি। কুট্টিকালের এক পরিবারের ছয়জন প্রাণ হারিয়েছেন বাড়ির উপর পাহাড় থেকে বড় বড় গাছ ও পাথুরে চাঙড় ভেঙে পড়ার কারণে। কোক্কায়ারের চেরিপুরাথ ফৌজিয়া বাড়ির পাশ দিয়ে প্রবল গতিতে বয়ে যাওয়া জলস্রোতের ছবি মোবাইল ক্যামেরায় বন্দি করার পরের মুহূর্তেই দুই কন্যাসহ প্রবল ভূমিধসের কবলে পড়েন। তাঁদের কী হল তা অবশ্য অজ্ঞাত।
এমন ঘটনার ফলে ঠিক কতজন মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে তার সঠিক সংখ্যা এখনও জানা যায়নি। তবে প্রাথমিকভাবে অনুমান করা হচ্ছে যে মৃত্যুর সংখ্যা ৫০-এর বেশি হবে। এই সংখ্যাটি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে থামবে তা বলা এখনই সম্ভব নয়। তবে এই বিপর্যয় এক গভীর স্থায়ী ক্ষতচিহ্ন রেখে গেল ঈশ্বরের সাজানো উদ্যানে।
অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রবল প্রকোপ সামলে দেশ যখন খানিকটা স্বাভাবিকতার পথে হাঁটতে চলেছে ধীরে ধীরে তখনই এমন এক আকস্মিক বিপর্যয়ের ঘনঘটা সমস্ত ইতিবাচক কর্মদ্যোগের প্রয়াসকেই বড় প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। আবহাওয়ার খানিকটা উন্নতি হলেও বৃষ্টিপাতের পরিমাণ আবার বাড়তে পারে বলে আবহাওয়া দপ্তরের পক্ষে জানানো হয়েছে। আবহাওয়া বিভাগের মতে দক্ষিণ-পূর্ব আরব সাগরের বুকে সৃষ্ট নিম্নচাপের যে ক্ষেত্রটি কেরলের উপকূল অংশের একেবারে গা ঘেঁষে অবস্থান করছিল তা এখন কর্নাটকের মধ্যভাগ থেকে তামিলনাড়ুর পূর্বভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত বায়ুমণ্ডলের নিম্নতর অংশে একটি দীর্ঘ চাপ-অক্ষের আকারে প্রসারিত রয়েছে। এই অক্ষের প্রভাবেই পূবালি বায়ুর প্রবেশ এবং প্রবল বৃষ্টিপাত। শীতাগমের প্রাক্কালে এমন প্রবল বৃষ্টিপাত কেবল কেরলবাসী মানুষের বিপদের কারণ হয়েছে তা নয়, গোটা দেশজুড়েই বিগত কয়েকদিন ধরে চলেছে প্রবল বর্ষণের দাপট। ঈশ্বরের বাগানের সঙ্গে সঙ্গে ‘দেবরোষে দেবভূমি’। উত্তরাখণ্ডের অবস্থাও রীতিমত ভয়ঙ্কর। আমাদের রাজ্যের পার্বত্য জেলাগুলিও প্রবল বৃষ্টিপাত সহ ব্যাপক ধসের প্রভাবে বিপর্যস্ত। বাদ যায়নি উত্তরের সিকিম ও প্রতিবেশী নেপাল। সবক্ষেত্রেই মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও তার অব্যবহিত ফলাফল হিসেবে ধস নামার দরুণ জনজীবন বিপর্যস্ত হচ্ছে বারংবার। প্রশ্ন উঠছে এমন সৃষ্টিছাড়া বর্ষণ কি বিশ্ব-উষ্ণায়নের কারণে?
বিশ্ব-উষ্ণায়নের প্রতিফল?
এমনই এক ঘটনার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বিশ্ব-উষ্ণায়নের প্রভাব নিয়ে নতুন করে ভাবতে বসেছেন বিজ্ঞানীরা। বহু বছর আগেই আইপিসিসি তাদের প্রতিবেদনে বিশ্ব-উষ্ণায়নের গভীরতর প্রতিক্রিয়া বিষয়ে গোটা দুনিয়াকেই সতর্ক করেছে। মানবজাতির ক্রমবর্ধমান ক্রিয়া-কলাপ পার্থিব বাতাবরণের ভারসাম্যকে নিরন্তর বিশৃঙ্খল করে চলেছে। মৌসুমি বৃষ্টিপাতের সুষম বণ্টনের ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে ভারত তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। আজ বিশ্ব-উষ্ণায়নের কারণে মৌসুমি বায়ুর এতদিনকার চেনা শৃঙ্খলাতেই লেগেছে অনিয়মের হাওয়া। এই বছরের কথাই ধরা যাক। এবার মৌসুমি বায়ুর প্রস্থানের পর্বটি যে বিলম্বিত হতে চলেছে তার আভাস দিয়েছিল আবহাওয়া দপ্তর। এই বিলম্বিত প্রস্থানপর্বটি এবছর ৬ অক্টোবরের পর শুরু হয়। মৌসুমি বায়ু ভারতে ঢোকে দক্ষিণ দুয়ার দিয়ে, তারপর নিম্নচাপ অক্ষের উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে ধীরে ধীরে দেশের অন্দরমহলে প্রবেশ করে। কিন্তু বিদায়বেলার পদ্ধতিটি সম্পূর্ণ বিপরীত। অর্থাৎ বর্ষা আগে দেশের উত্তর, উত্তর-পশ্চিমভাগের মাটি ছাড়ে, তারপর দক্ষিণভাগ অতিক্রম করে চলে যায়। কিন্তু এবছর নিম্নচাপ অক্ষটি খানিকটা স্থাণু হয়ে ছিল উপদ্বীপীয় ভারতের ওপর। ফলে বিগত কয়েকদিনে কেরল, তামিলনাড়ু, কর্নাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানায় বৃষ্টিপাত ছাপিয়ে গিয়েছে পূর্ববর্তী সময়ের সব রেকর্ডকে। কেরলে ১৪২ শতাংশ বৃষ্টিপাত বেড়েছে নির্দিষ্ট পরিমাণের তুলনায়। উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর হাতে ব্যাটন তুলে দেওয়ার আগে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর এমন অভাবিত বিধ্বংসী আচরণ সম্পূর্ণত বিশ্ব-উষ্ণায়নের ফল বলে অভিমত ভারতের আবহাওয়া সর্বেক্ষণ বিভাগের মহানির্দেশক মৃত্যুঞ্জয় মহাপাত্রের। তাঁর মতে, বিশ্ব-উষ্ণায়নের ফলে বারংবার বায়ুমণ্ডলের চেনা সুর-তাল-লয়-ছন্দের পরিবর্তন ঘটছে, বাড়ছে বিপর্যয়মূলক পরিস্থিতির পৌনঃপুনিকতা। কোনও বিশেষ ঋতুতে নয়, সারা বছরের নানা সময়েই এমনটা ঘটছে। এর ফলে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির বোঝা বইতে হচ্ছে প্রভাবিত অঞ্চলের মানুষজনকে। বিদায়ী বর্ষার এমন বল্গাহীন আচরণ এই বিষয়ে যে নতুন করে চিন্তা বাড়িয়ে দিয়ে গেল, তা বলা বাহুল্য।
মেঘভাঙা বৃষ্টি ও ভূমিধস
কেরলে প্রবল বর্ষণের সঙ্গে অভিশাপ হয়ে নেমে এসেছে প্রবল ভূমিধস। এ পর্যন্ত পাওয়া খবর থেকে জানা যাচ্ছে যে প্রাণহানির যতগুলি ঘটনা এখনও অবধি নথিভুক্ত হয়েছে, তার সিংহভাগই ঘটেছে ভূমিধসের কারণে। খুব সহজ কথায় বলি— এই ধস হল একটি পুঞ্জচলন প্রক্রিয়া। প্রাকৃতিক শক্তিগুলির কার্যকারণ প্রভাবে পার্বত্য ঢালের বিচূর্ণীকরণ ও ক্ষয়ের ফলে যে বিপুল পরিমাণ অবস্করের সৃষ্টি হয় তা যখন মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে ঢাল বরাবর গড়িয়ে নিচে নেমে আসে তখন তাকে বলা হয় পুঞ্জচলন। সাধারণভাবে ধীরে সংঘটিত এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া জলের সংস্পর্শে তীব্রতর হয়ে ওঠে। এখানে জলের ভূমিকা পিচ্ছিলকারকের, অর্থাৎ বৃষ্টির জল ঢাল বরাবর নেমে আসার সময় ঢালের উপর জমে থাকা অবস্করসমূহকে দ্রুততর গতিতে নেমে আসতে সাহায্য করে। এই বস্তুভারের আকস্মিক স্খলন বা পতন পাহাড়ের পাদপীঠে অবস্থিত জনপদের জীবনকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। কেরলের ইডুক্কি, এর্নাকুলাম, কোল্লাম এবং কোট্টায়াম জেলায় ভয়ঙ্কর ধসের কারণেই মারা গিয়েছেন অধিকাংশ মানুষ। ঢালের সুস্থিতিকে নষ্ট করে ফেলার কারণেই বিপর্যয়ের তীব্রতা বাড়ছে। আর এই কারণেই বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে প্রকৃতির রুদ্রাণী রূপের কথার সঙ্গেসঙ্গেই মানুষের সীমাহীন লোভের কথা উঠে আসছে বারংবার।
কাঠগড়ায় উন্নয়ন
কেরলের এই বিপর্যয়ের পর মানুষের কার্যকলাপের প্রতি আবারও আঙুল উঠছে। একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে কেরলে কাগজে-কলমে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। তাও কেন এই বিপর্যয়? পরিমিত বর্ষার অপরিমেয় দানে ভরপুর কেরলের প্রকৃতি। যেদিকে তাকানো যায় সেদিকেই দেখা যায় সবুজের বিপুল সমারোহ। কিন্তু সম্পদ থাকলেই বাড়ে তাকে যথেচ্ছ আহরণের লোভ। দুর্ভাগ্য এখানেই বুঝি ঘুমন্ত ঘাতকের মত ওঁত পেতে থাকে। পাহাড়ের ওপর থেকে সবুজের প্রাকৃতিক আচ্ছাদনকে সরিয়ে নেওয়া, লক্ষ লক্ষ হেক্টর জমিতে কর্পোরেট সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় বাগিচা কৃষির সম্প্রসারণ, পাহাড় ফাটিয়ে খনিজ আহরণ, পর্যটন শিল্পের প্রসারের নামে সহ্যাদ্রি পর্বতের বাস্তু-পরিবেশের ধ্বংসসাধন— সবই চলছে অবাধে মানুষের কল্যাণ ও উন্নয়নের নামে। আজকের মালয়ালি বিপর্যয়ের এই হল অন্যতম বাস্তব প্রেক্ষাপট। প্রকৃতির সঙ্গে, প্রকৃতির নিয়ম মেনে সহাবস্থান করার পরিবর্তে আমরা বুঝি লড়াইয়ে নেমেছি প্রকৃতির বিরুদ্ধে। আর তাই বারবার এমন বিপর্যয় ঘটে চলেছে। অতীতের ঘটনা থেকে কোনও শিক্ষাই আমরা নিইনি। আর তাই ২০১৮-র মহাপ্লাবনের পর থেকে প্রায় প্রতিবছর একইরকম প্রাকৃতিক অভিঘাতের শিকার হচ্ছে দক্ষিণি রাজ্যটি। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে তরতরিয়ে ওপরে ওঠা গরম, আর্দ্র বাতাস ঘনীভূত হয়ে ভেঙে গিয়ে মেঘভাঙা বৃষ্টির সৃষ্টি করছে। এমন বৃষ্টির আকস্মিকতায় বিপর্যয় নেমে আসছে প্রতিবছর। আমরা কেউ শিখিনি। কেরলও শিখল না, শিখছে না। এটাই বুঝি এক স্থায়ী দুঃখের ক্ষত হয়ে রয়ে যাবে আমাদের স্মৃতিতে।
পুনিয়াম্মা ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
আজকের কথা শেষ করব পুনিয়াম্মার গল্প দিয়ে। পুনিয়াম্মা কোনও বিখ্যাত, নামজাদা মানুষী নন। এক অতি সাধারণ সহনাগরিক। তাঁর সঙ্গে আমার মাত্র কয়েক মিনিটের কথালাপ ২০১৯ সালে উত্তর কেরল ভ্রমণের অবকাশে। এক মন্দিরের সামনে গাড়ি থামিয়ে চালক যুবকটি আমাদের বলেছিল আমরা তার সঙ্গে আয়াপ্পান স্বামীর মন্দিরে যাব কিনা? আমরা এক কথাতেই রাজি। কেননা সদর রাস্তা ছেড়ে এই সুযোগে পাহাড়তলির ছোট্ট গ্রামটিতেও ঘুরে আসা যাবে। মন্দিরের বিগ্রহ দর্শন করে বাইরে আসতেই দেখি এক প্রবীণা মহিলা সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। ভেবেছিলাম হয়তো কিছু সাহায্য চাইছেন। চালক বন্ধুটি জানাল উনি পুনিয়াম্মা। বন্যায় বিধ্বস্ত গ্রামের পাঠশালাটিকে পুনর্নির্মাণের জন্য তিনি অর্থ সংগ্রহ করছেন মন্দির দর্শনে আগত পুণ্যার্থীদের কাছ থেকে। ভাষার ব্যবধান ঘুচিয়ে মনকথা আশ মিটিয়ে বলতে পারিনি, কিন্তু সজল চোখে বিধ্বস্ত স্কুলবাড়ির দিকে তাকিয়ে পুনিয়াম্মা যা বলতে চেয়েছিলেন তার মর্মার্থ— একদিন এই জনপদের গৌরব হারিয়ে যাবে চিরকালের মতো। মানুষের সীমাহীন লোভের কারণে প্রকৃতি প্রতিদিন নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হচ্ছে। মা যদি রিক্ত হন তাহলে তার সন্তানরা কখনও ভালো থাকতে পারে! আয়াপ্পান স্বামী আমাদের রক্ষক। কিন্তু তিনিও যে বিরূপ হয়ে উঠছেন। না হলে ফি-বছর এমন ঘটনা বারবার ঘটে! বিকাশের নামে আর কত বিপর্যয় ডেকে আনব আমরা!
পুনিয়াম্মারা ভালো থাকুন!
২০২১ সালের পর আবারও কেরালা শিরোনামে। তখনই আশঙ্কা করেছিলাম ভবিষ্যতে হয়তো এমন বিপর্যয়ের শিকার হবে ঈশ্বরের আপন দেশ। এতে খুশি হবার অবকাশ নেই বরং উন্নয়নের ঘোড়া এভাবে ছোটানোর ফলে আরও কিছু ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়তো আগামীদিনে আমাদের হবে। ওয়েনাড় তথা কেরলের মানুষের জন্য গভীর সমবেদনা রইলো।