স্বপন ভট্টাচার্য
প্রাবন্ধিক, গদ্যকার, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক সংখ্যালঘু পীড়নের ঘটনাবলি আমাদের আহত করেছে বটে কিন্তু খুব একটা বিস্মিত করেনি এই কারণে যে এর একটা ধারাবাহিকতা রয়েছে। যতবার সে দেশ বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে জাতি হিসেবে বড় ও উদার হওয়ার প্রয়াস পেয়েছে ততবারই সামাজিক বাতাবরণ বিষাক্ত করার চেষ্টা হয়েছে, কখনও সরকারি মদতে হয়েছে, কখনও দেশের বাইরের শক্তি থেকে তা দানাপানি পেয়েছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ওপর অত্যাচার, তাদের উপাসনাস্থলের ওপর হামলা, তাদের জমি বাড়ি দখল— এ সবই একটা বৃহত্তর প্রোগ্রামের অংশ যা বিচ্ছিন্নভাবে হাতির লেজ আর হাতির শুঁড়ে হাত বুলিয়ে ধরা যাবে না। ১৯৭১-এ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সময় সে দেশে জনসমষ্টির ২৩.১ শতাংশ ছিল সংখ্যালঘু যার সিংহভাগই হিন্দু। ২০১১ সালের জনগণনার তথ্যানুযায়ী তা চল্লিশ বছরে নেমে দাঁড়িয়েছিল ৯.৬ শতাংশে। বাংলাদেশের ধর্মীয় মানচিত্রে এখন ৮.৫ শতাংশ হিন্দু, ০.৬ বৌদ্ধ এবং ০.৩ শতাংশ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষ। ধর্মীয় সংখ্যালঘু ছাড়াও সে দেশে ১.৮ শতাংশ মানুষ জনজাতির আওতাভুক্ত। মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামে এদের বাস এবং এরা মূলত চাকমা, মারমা এবং ত্রিপুরা গোষ্ঠীভুক্ত এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। সরকার ২৭টি ‘এথনিক গ্রুপ’-এর অস্তিত্ব মানলেও এদের ইন্ডিজেনাস অর্থাৎ আদিবাসী তকমা দিতে রাজি হয়নি। ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা প্রধানত সুন্নি মুসলমান, তবে এরা ছাড়াও আছে শিয়া মুসলিমরা এবং আহমদিয়া সম্প্রদায় যারা নিজেদের মুসলমান হিসেবে পরিচিতি চাইলেও সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় তা মনে করে না, সুতরাং এরাও সদর্থেই সংখ্যালঘু। এছাড়া ঢাকা শহর সহ দেশের অন্যান্য জেলায় ছড়িয়ে থাকা ১১৩টি ক্যাম্পে বসবাসকারী কয়েক লক্ষ ‘বিহারি’ অবাঙালি মুসলমান যারা বিহার থেকে ১৯৪৭-এর ভারত বিভাজনের পর স্বেচ্ছায় পূর্ব পাকিস্তানে চলে এসেছিল এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় ইসলামাবাদকে সমর্থন করেছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের পর এদের মধ্যে যারা পশ্চিমে পালাতে পারেনি তাদের ভাগ্য পাকিস্তানের পরাজয়ের ও আত্মসমর্পনের পরে এদেশের শরণার্থী শিবিরে বাঁধা পড়েছে এবং এদেরও সংখ্যালঘু গণ্য করা যায়। আগেই বলেছি, বাংলাদেশে ধর্মীয় জঙ্গিপনা এবং সাম্প্রদায়িক শক্তির উদ্ভব রাতারাতি হয়নি। যে ভাষাভিত্তিক ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা থেকে ১৯৭১ সালে লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল সে সব প্রাণকে নির্দিষ্ট কোনও ধর্মচিহ্ন দিয়ে সনাক্ত করার কথা বঙ্গবন্ধু ভাবেননি। বাঙালি জাতীয়তাবাদই ছিল সেই গর্ভ যার থেকে বাঙালিদের জন্য একখানি স্বতন্ত্র দেশের জন্ম হল। সে দেশ জন্মের দশকেই একের পর এক রাজনৈতিক দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে লিবারেল মুসলিম নেশন থেকে এক ইসলামিক নেশনের পথে যাত্রা শুরু করেছিল। সংখ্যাগুরুবাদের সেই ধারণার সঙ্গে লিবারেল মুসলিম নেশনের ধারণার লড়াই এখনও যে জারি রয়েছে, আশার কথা সেটাই, নয়তো বাংলাদেশ হয়তো ইতিমধ্যেই পিছনে হাঁটতে শুরু করত। ১৯৭১-এ, বাংলাদেশের জন্মের সময়, পশ্চিম পাকিস্তান ছিল পূর্বের তুলনায় ৭০ শতাংশ ধনশালী দেশ আর আজ বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর উদযাপন করছে, তখন জিডিপি-র মাপে সে পাকিস্তানের তুলনায় ৪৫ শতাংশ বেশি সম্পদশালী তো বটেই এমনকি জনপ্রতি রোজগারের নিরিখে একজন বাংলাদেশির অবস্থা একজন ভারতীয়ের তুলনায় ভালো। অর্থনীতিবিদরা প্রশ্ন তুলছেন কীভাবে এখনও ব্রিকস (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চিন) অথবা সিভেটস (কলম্বিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, তুরস্ক, দক্ষিণ আফ্রিকা)-এর মত আন্তর্জাতিক ফোরামের বাইরে, এমনকি জি-২০ গোষ্ঠীর বাইরে বাংলাদেশকে রাখা সম্ভব হচ্ছে এখনও?
ধর্মের ভিত্তিতে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত হয়েছিল, সুতরাং উগ্র ধর্মীয় উন্মাদনা স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মুছে যাবে এটা ভাবা মূর্খামি, তবে পূর্ব পাকিস্তান যাত্রা শুরুই করেছিল একটা তুলনামূলক সুবিধা নিয়ে। সেখানে প্রায় সব মানুষ বাংলাভাষাভাষী, ফলে সংখ্যাগুরুত্বের চেনা ডিসকোর্স এখানে সহজে খেটে যেতে পারেনি। সুতরাং বিভাজনপূর্ব কালের অত দাঙ্গা বা রক্তপাতের পরেও পুর্বের ২২ শতাংশেরও বেশি হিন্দু প্রতিবেশীদের ওপর ভরসা রেখে থেকে গিয়েছিল সেখানে। ধর্ম নয়, ভাষার বন্ধন ছিল সে ভরসার পিলসুজ। ইসলামাবাদের শাসকরা এই ভাষাবন্ধনকে ভয় পেত বলেই ধর্মকে বাহন করতে শুরু করেছিল প্রথম থেকেই। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর থেকে একদিকে যেমন রাজনীতি হয়ে দাঁড়াল কনফ্রন্টেশনাল— সংঘর্ষময়, উল্টোদিকে তেমনই বাড়তে শুরু করল সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন। শত্রু সম্পত্তি আইন তথা অর্ডার এতে বাড়তি ইন্ধন জুগিয়েছিল। ’৭১-এ স্বাধীনতা অর্জনের পরে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে এমন আশা করাটা অমূলক ছিল না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান যে চারটি স্তম্ভের ওপর বাংলাদেশকে ‘আপন হতে বাহির হয়ে’ বাইরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তার একটি হল ধর্মনিরপেক্ষতা এবং অপর তিনটি হল গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং জাতীয়তাবাদ। যদিও বামপন্থীরা সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের সহাবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের সমানাধিকার, মানবতাবোধ এবং সামাজিক ন্যায় সুনিশ্চিত করার (in order to ensure for the people of Bangladesh equality, human dignity and social justice) আশ্বাস সেই সংশয়কে দূরে সরিয়ে রাখতে পেরেছিল সেই ইতিহাস মন্থনের কালে। স্বাধীনতাপ্রাপ্তির সময় বাংলাদেশের জাতীয় ভাষা ছিল, কিন্তু কোনও জাতীয় ধর্ম ছিল না। সত্তর দশকের মাঝামাঝি রক্তপাতের মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনির হাতে ক্ষমতা এলে যে আনুপূর্বিক বদলের সম্ভাবনা সে দেশের জাতীয় চরিত্রে ঘটবে বলে আশা করা গিয়েছিল ঠিক তাই হল ১৯৭৭ সালে যখন জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সংবিধানের সেকুলার ভিত্তিটিকে বর্জন করা হল। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের থেকে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের দিকে এই যাত্রা আরও সংহত ও জোরদার হল ১৯৮১তে জিয়ার হত্যাকাণ্ড ঘটে যাওয়ার পরে যখন হোসেইন মহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় এলেন। ১৯৮৮তে এরশাদ ইসলামকে বাংলাদেশের জাতীয় ধর্ম হিসাবে ঘোষণা করলেন।
১৯৭৫-এ শেখ মুজিবর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর যে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যে পরিবর্তন এল তার সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণার ওপরেই এবং তা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীদের সামাজিক ও রাজনৈতিক পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব রাজাকার, আল বদর, আল শামস হানাদাররা পাকিস্তানি বাহিনিকে সরাসরি সহায়তা করেছিল তাদের শাস্তির জন্য ১৯৭২ সালেই প্রবর্তিত হয় বাংলাদেশ কোলাবরেটরস অর্ডার, চলতি কথায় দালাল আইন। মোট ৩৭৪৭১ জনকে বন্দি করে বিচারের কাজ শুরু হয়। ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক ট্রাইবুন্যাল মোতাবেক তাদের বিরুদ্ধে প্রায় তিন হাজার মামলা রুজু করা হয়। বিচারে প্রায় ৭০ শতাংশই মুক্তি পেয়ে যায় কেননা তাদের বিরুদ্ধে কোনও সরাসরি প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ৩০ লক্ষ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সাপেক্ষে যে কোনও দেশে মানবতার এবং সুবিচারের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এটি একটি অসাধারণ দৃষ্টান্ত যার তুলনীয় ক্ষমার নজির ইতিহাসে খুব বেশি পাওয়া যাবে না। রাষ্ট্রদ্রোহিতা, দস্যুবৃত্তি বা নারীধর্ষণের মত প্রমাণিত অপরাধের জন্য ৭৫২ জন সাজা পায়। এদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাবাসের শাস্তি পাওয়া অপরাধীরা ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পর দালাল আইনটিই বাতিল হয় এবং আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে সাজাপ্রাপ্ত অনেকেই সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়। অন্যভাবে বলতে গেলে পাকিস্তান গিয়েও ফিরে আসার সুযোগ পেয়ে যায় সাধারণ্যে। ১৯৯২-তে ভারতে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে ভারত-বিরোধিতার হাওয়া তীব্রতর হয় এবং যারা মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অংশগ্রহণে অখুশি ছিল তাদের আওয়াজগুলি অতঃপর তীব্রতার সঙ্গে শ্রাব্য হতে থাকে। পুরনো খবর ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে সেই সময় ব্যাপকভাবে হিন্দুদের ধর্মস্থান, দোকানপাট ভাংচুর, লুঠ এবং সংখ্যালঘু নারীদের সম্ভ্রমহানির ঘটনা ঘটে এবং অন্তত দশজন নিহত হন। ১৯৯৬-তে আওয়ামী লিগ ক্ষমতা দখলের আগে এবং পরে ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনা প্রণিধানযোগ্য। মৌলবাদীরা প্রথমবার আন্তর্জাতিকভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয় যখন তসলিমা নাসরিন ইসলামে অনুমোদনযোগ্য নয় এমন লেখার অভিযোগে ১৯৯৩-তে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। বস্তুত তাঁর বিরুদ্ধে গজিয়ে ওঠা ঘৃণা সে দেশে এবং এই বাংলাতেও ‘যে জন আছে মাঝখানে’ থাকা মুসলমান সাধারণ্যে এখনও যথেষ্ট সমর্থন পেয়ে আসছে। দ্বিতীয় ঘটনাটি হল ১৯৯৯-তে কবি শামসুর রহমানকে হত্যার চেষ্টা। সে ক্ষেত্রে আক্রমণকারীরা ধরা পড়ার পরে যে সিজার লিস্ট আদালতে জমা পড়ে তাতে তসলিমা নাসরিন ও শামসুর রহমানসহ বিভিন্ন বুদ্ধিজীবীর নামের তালিকাও ছিল যাদের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করা হয়েছিল। ২০০৪-এর ফেব্রুয়ারিতে কবি লেখক ও অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ওপর প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে হামলা হয়। পরবর্তীকালে আওয়ামী লিগ যখন বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে তখনও মুক্তচিন্তার ওপর আঘাতের ধারাবাহিকতায় যতি পড়েনি।
বলতে হয় জামাতের কথাও। জামাতের জন্ম অবিভক্ত ভারতে ১৯৪১ সালে মৌলানা আবুল আল মৌদুদ্দীর হাত ধরে দেওবন্দী দারুল-উলম ভাবধারায় দীক্ষিত হয়ে। সিপাহি বিদ্রোহের ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিমদের মধ্যে যে জাতীয় চেতনার উদ্ভব ঘটে তার থেকেই জন্ম জামাতের। উগ্র ধর্মীয় মেরুকরণ তাদের অ্যাজেন্ডায় গোড়া থেকে ছিল না। কিন্তু জামাত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়ায় যেহেতু ইসলামি রাষ্ট্র বনাম বাঙালি জাতীয়তাবাদের মধ্যে তুল্যমূল্য বিচারে তা্দের কাছে প্রথমটিই মান্য ছিল সন্দেহাতীতভাবে। স্বাধীন বাংলাদেশের ধারণার সঙ্গেই যাদের আড়াআড়ি সম্পর্ক ছিল এবং যাদের অনেকের বিরুদ্ধে নরহত্যারও অভিযোগ ছিল তারা যেভাবেই হোক না কেন দেশ ছেড়ে পালাতে পেরেছিল এবং পশ্চিম পাকিস্তানে আশ্রয় পেয়েছিল। তারা পুনরায় ফেরার সুযোগ পায় প্রেসিডেন্ট এরশাদের সময় এবং ধরাই যেতে পারে আওয়ামী লিগের প্রতিস্পর্ধী একটি শক্তি হিসেবেই তারা আমন্ত্রিত হয়ে থাকবে। জামাত নির্বাচনে অংশ নেয় ১৯৯৬ সালে এবং মাত্র তিনটি আসনে জিতে এলেও দেখা গেল তাদের পিছনে প্রায় নয় শতাংশ মানুষের জনসমর্থন আছে। ২০০১-এর সাধারণ নির্বাচনে দেশের চতুর্থ বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে উঠে আসে বাংলাদেশ জামাত-এ-ইসলামি পার্টি। মাত্র সাড়ে চার শতাংশ ভোট শেয়ার থাকলেও ১৭টি আসনে জেতে তারা। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন চার দলের কোয়ালিশনের অংশ হিসেবে মন্ত্রীসভার কৃষিমন্ত্রী হন তৎকালীন জামাতপ্রধান মতিউর রহমান নিজামী। মুক্তিযোদ্ধার সেনানীরা বিক্ষোভ দেখিয়ে, কুশপুত্তলিকা পুড়িয়ে বিক্ষোভ জানিয়েছিলেন সেই সময় কেননা তাঁদের চোখে নিজামী ছিলেন যুদ্ধাপরাধী। তথাপি বোঝা যাচ্ছিল যে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্মের একটা অংশের কাছে মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা বা ধর্মনিরপেক্ষতার আহ্বানের গুরুত্ব হ্রাস পেয়েছে।
এর পরবর্তী তিনটি নির্বাচনে, যথাক্রমে ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮তে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লিগ উত্তরোত্তর শক্তিবৃদ্ধি করেছে। ৩০০ আসনের জাতীয় সংসদে এককভাবে আওয়ামী লিগের আসনসংখ্যা ২৫৭ এবং প্রায় ৭৫ শতাংশ ভোট শেয়ার তাদের। কিন্তু তা সাম্প্রদায়িকতার বীজ নির্মূল করতে পারেনি। হাসিনা কঠোর হয়েছেন প্রতিশ্রুতিমতো মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি। সংবাদমাধ্যমে আমরা জেনেছি জামাতের কর্মকর্তা আবদুল কাদের মোল্লা, মহম্মদ কামরুজ্জামান, আলি আহসান মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে। ব্লগার অভিজিৎ রায়ের খুনে সামিল পাঁচ হত্যাকারীকে সর্বোচ্চ আদালত মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। কিন্তু এরই পাশাপাশি ২০১৩ থেকে ২০১৬ এর মধ্যেকার সময়— পিরিয়ড অফ টার্বুলেন্স— উথালপাথাল সময় বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত কারণে বিশ্ববাসীর নজরে এনে দিয়েছে। রাজীব হায়দার, অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয় দাস, ওয়াশিকুর রহমান, নিলয় চ্যাটার্জি, ফয়সল আরেফিন দীপন— তালিকা দীর্ঘ। মুক্তমনা মানুষ, ঈশ্বরবিশ্বাসী নয় এমন মানুষ, ভিন্নতর যৌনরুচির মানুষ, সে সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘু যাই হোন না কেন, বারবার আক্রমণের লক্ষ হয়েছেন। ১ জুলাই ২০১৬তে সংঘটিত ঢাকার আর্টিসান কাফে হত্যাকাণ্ডর মত ইসলামিক স্টেট গোছের ভয়াবহতার মোকাবিলা করতে হয়েছে এই সরকারকে, যে হামলায় বিদেশি নাগরিকও মারা পড়েছিল। মৌলবাদের যে স্পেস বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে তাকে অস্বীকার করার চেষ্টা করছেন না সে দেশের বুদ্ধিজীবীরাও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক আবুল বরকতের অভিমত উল্লেখ করে বলা যায় জামাত সেখানে একটা রাষ্ট্রের ভিতর রাষ্ট্র এবং অর্থনীতির মধ্যে অর্থনীতি। অধ্যাপক বরকতের মতে জামাত পরিচালিত বিজনেস ভেঞ্চারগুলির মোট অবদান জাতীয় উন্নয়ন বাজেটের ৮.৬২ শতাংশ বিন্দু এবং তাদের অর্থনীতি বৃদ্ধির হার জাতীয় আয়ের থেকে বেশি।
এই লেখার শেষে আর একবার অধ্যাপক আবুল বরকতের লেখার কাছে ফিরতে হচ্ছে। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন কেবলমাত্র ধর্মীয় বিভেদ থেকে সংখ্যালঘুদের এই পরিণতি হয়েছে তা মনে করলে ভুল হবে। এর কেন্দ্রে ছিল জমি। অধ্যাপক বরকত দেখিয়েছেন পূর্বতন এনিমি প্রপার্টি তথা ভেস্টেড প্রপার্টি অ্যাক্ট-এর বলে স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম দুটি সরকারের আমলে বাংলাদেশের হিন্দুদের হাতে থাকা জমির ৫৩ শতাংশ হস্তান্তরিত হয়ে যায়। এই জমির মোট পরিমাণ ৬৬৪০ বর্গ কিলোমিটার। এই হিসেব স্বাধীনতা উত্তরকালের। অধ্যাপক বরকতের মতে ১৯৪৮ থেকে শুরু করে এই আইনের বলে দেশের ৭৫ শতাংশ হিন্দু সংখ্যালঘুর জমি হতান্তরিত হয়ে যায়। তিনি দেখিয়েছেন এই মালিকানা বদলের সুবিধা যারা নিয়েছে তাদের পার্টি চরিত্রে চোখে পড়ার মত বৈচিত্র আছে, কে আছে না বলে কে নেই বলা ভালো, যদিও আওয়ামী লিগ তাদের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে না। বরকত সাহেবের চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো পরিসংখ্যান আরও অবাক করে যখন দেখি এই তথাকথিত বিতর্কিত আইন থেকে সুবিধে পাওয়া লোকের সংখ্যা সে দেশের মাত্র ০.৪ শতাংশ বিন্দুর সমান। হাসিনা সরকার ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে এই আইন বাতিল করলে পরিস্থিতির যে স্থিতাবস্থায় পৌঁছানোর সম্ভাবনা তৈরি হয় তার প্রায়োগিক নিদর্শন খুব একটা নেই। সুতরাং, সংখ্যালঘু পীড়নের ঘটনাগুলিকে জমি দখলের সমস্যা থেকে আলাদা করে দেখার সুযোগ অন্তত এখনও নেই। এখনকার ফেসবুক ইন্সটাগ্রাম যুগে গুজব আলোর চেয়েও তীব্রতর গতিতে ছোটে। ফলে মানুষকে বেছে বেছে নিশানা করা সহজ। এর পিছনে জমির সমীকরণ থাকার সম্ভাবনা থেকেই যায়। তাই কুমিল্লার ঘটনার পরে শেখ হাসিনার ভাষণটিতে এই প্রসঙ্গে বিশেষ জোর দিতে শুনেছি তাঁকে, শত্রু সম্পত্তি আইনের একদেশদর্শী উপাদানগুলি মুছে ফেলা হয়েছে— এ বার্তা তিনি জোরের সঙ্গে দিতে চেয়েছেন, মনে হয়েছে যে কারণগুলোর জন্য ধর্মের জিগির— তার মধ্যে জমি যে একটা, এটা তাঁকে উদ্বিগ্ন করছে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এবং সামাজিক ক্ষেত্রে যে উন্নতি হয়েছে তা চোখে পড়ার মত। যে দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে এত কাণ্ড ঘটে গেল সেটাকেই একটা সামাজিক আস্থার মাপকাঠি করা যায় কিনা দেখতে গিয়ে পরিসংখ্যান পেলাম ২০১৭ সালে সে দেশে ২৯ হাজার ৭৪টি মণ্ডপে প্রতিমার পূজা হয়েছিল। মাত্র এক বছর পরেই ২০১৮তে সেই সংখ্যা প্রায় ৩৪ হাজারে পৌঁছায়। সরকারে এবং মানুষে আস্থা ছাড়া এই হাজার পাঁচেক পূজা একটি মাত্র বছরে নতুন করে পত্তন হওয়া এপার বাংলাতেও বিরল মনে হয়। আমরা এই বঙ্গে পূজা উপলক্ষে সরকারি খয়রাত দেখে আসছি কিন্তু খুব কম লোকই জানি বাংলাদেশে প্রতিটি পূজা কমিটিকে চাল এবং নগদ টাকা দিয়ে সাহায্য করার নজির রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ওয়াজেদ। নেত্রীর প্রতি আস্থা এবং মানবতায় বিশ্বাসী সাধারণ ধর্মপ্রাণ সৌভ্রাতৃত্বে বিশ্বাসী সহনাগরিকের প্রতি বিশ্বাস— এগুলি বড় পুঁজি সে দেশের হিন্দুদের। মুক্তিযুদ্ধে হিন্দুহত্যার জঘন্য অপরাধীরা অনেকেই শাস্তি পেয়েছে। ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল ঝাড়ুয়ার বিলে ১৪০০ হিন্দু নিধনের আসামি জামাতের পদাধিকারী আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। একই অপরাধে জামাত সদস্য মহম্মদ মুজাহিদ এবং সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা অন্তত রাষ্ট্রীয় স্তরে এবং বিচারব্যবস্থায় ছাড় পাবে না তার অনেক নজির বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যেই দিয়েছেন। আর দু বছর পরেই সেদেশে নির্বাচন। সংখ্যালঘুরা আওয়ামী লিগের নিশ্চিত ভোটব্যাঙ্ক, সুতরাং ভয় হয় আগামী দিনে তাদেরও এক উথালপাথাল সময়ের ভিতর দিয়ে যেতে হবে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্রমশ যতই উজ্জ্বল হতে থাকবে ততই ভিতর এবং বাইরে থেকে তা চূর্ণ করার চেষ্টা জারি থাকবে। তবুও নেতৃত্বের স্পষ্ট উচ্চারণ এবং সে দেশের ছাত্র-যুবকদের মধ্যে থেকে উৎসারিত সুচেতনা— এগুলি কেবল সংখ্যালঘু মানুষটির নয়, সারা দেশেরই পাথেয় হয়ে উঠবে এমন ভাবতে ইচ্ছে করে। ভয়ও করে এই ভেবে যে মৌলবাদ ধর্মে ধর্মে যতই বিভেদ তৈরি করুক, সেখানে প্রতিস্পর্ধীরা একে অন্যের থেকে রসদ আহরণ করে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভারতেও মৌলবাদীদের কাছে পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা তুরুপের তাস। এদেশে অসহিষ্ণুতা যত বাড়বে ওদেশে ততই এদেশে ফণা তুলবার সুযোগ পাবে সাম্প্রদায়িকতা এবং এহ বাহ্য, ভারতেও লোকসভা নির্বাচন বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনের পরে পরেই। সমস্ত উপমহাদেশের রাজনীতি প্রভাবিত হতে পারে এই দুই প্রতিবেশী দেশের যে কোনও অংশে ঘটে যাওয়া যে কোনও অনভিপ্রেত ঘটনায়। ফলে শ্রীমতী হাসিনাকে সরু দড়ির ওপর দিয়েই হাঁটতে হচ্ছে। আফগানিস্তানে তালিবানি শাসন কায়েম হওয়ার পরে তা আরও কঠিন হয়েছে অনুমান করা যায়। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা, নারীশক্তির বিকাশ এবং বিশ্বনাগরিক হয়ে ওঠার স্বপ্ন— এই নিয়ে এগোচ্ছে আজকের বাংলাদেশ। ধর্মের জিগির তুলে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ আসলে একটা বৃহত্তর কৌমী ভাবনার প্রকাশ যা সফল হলে বাংলাদেশ ভিতর থেকে দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। এটা সে দেশের নাগরিক সমাজ বুঝতে পারছেন তার পরিচয় পাচ্ছি কুমিল্লার ঘটনা ঘটে যাবার পর থেকে প্রায় প্রতিদিন। আবার মুখর হয়ে উঠেছে শাহবাগ। দুই ধর্মের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ প্রতিবাদ মিছিল সংগঠিত করছেন দেশজুড়ে। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সারা বিশ্বের বাংলাভাষাভাষী মানুষের কাছে সেটাই ভরসার জায়গা।
সূত্র:
- https://minorityrights.org/ Bangladesh
- Bertil Linter (2001)
- Abul Barkat (2001) An Inquiry Into Causes and Consequences of Deprivation of Hindu Minorities in Bangladesh Through the Vested Property Act: Framework for a Realistic Solution. PRIP publications