অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রযুক্তিবিদ্যার ছাত্র, গবেষক
উত্তরাখণ্ড-বিপর্যয়ের পরবর্তীতে সাম্প্রতিক একটি আলোচনায় দূরদর্শনের পর্দা আলো করে থাকা এক সঞ্চালিকাকে ‘ছদ্ম’ দুঃখের সঙ্গে সুললিত ইংরেজিতে বলতে শুনেছি, বিপর্যয় না ঘটা অবধি আমাদের দেশে পরিবেশ-পরিবর্তন বিষয়ে কোনও আলোচনাই ওঠে না। আবার বিপর্যয় মিটে গেলে পরেই সেই সমস্ত কথোপকথনে অনিবার্য এক নীরবতা নেমে আসে। কথাটা বোধহয় ক্ষুধার ক্ষেত্রেও সত্যি। হয়তো বা আরও বেশি করেই।
অধ্যাপক অমর্ত্য সেন যেমনটা বলেইছেন, ভারতবর্ষের মতো দেশে সে অর্থে কোনওদিনই দুর্ভিক্ষ হবে না। দুর্ভিক্ষের জেরে মৃত্যুমিছিল শুরু হয়ে গিয়েছে— এমন কোনও অবস্থায় আমাদের দেশ আপাতত আর কোনওদিনই পৌঁছবে না, কারণ আমাদের দেশের নীতি-নির্ধারকেরা ঠিক তার আগেই একটি সহায়ক প্যাকেজ জাতীয় প্রকল্প ঘোষণা করে দেবেন। আমাদের দেশের সমস্যা কেবল অপুষ্টি নয়। আমাদের দেশের সমস্যা হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি অপুষ্টি এবং অর্ধাহার। অনাহারকে ঠেকানোর মতো কিছু প্যাকেজ আমাদের মতো দেশে আগে থাকতেই মজুত করা থাকে। যদিও এই নয়া ভারতের জমানাতে এখন সেগুলিতেও টান পড়েছে বলে মনে হয়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে অর্ধাহারে থাকা এই জনসংখ্যাকে, সেই কোনওমতে বেঁচে থাকা বা টিঁকে থাকার মতো অবস্থা থেকে উঠিয়ে আনতে গেলে যে কৃতিত্ব প্রয়োজন, আমাদের দেশের অর্থনীতি তা জোগাতে অপারগ। সহিষ্ণু ভারতবর্ষ আধপেটা খেয়ে বেঁচে থাকে। কেবল দীর্ঘমেয়াদে আমাদের দেশ ধুঁকতে ধুঁকতে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। আর সেকারণেই গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সের মতো একেকটি বিষয়ে আমরা না পারি উঠতে, না পারি নামতে। চলচ্ছক্তিহীন স্থবিরের মতো আমরা কেবল নিজেদের জায়গাতে অক্ষয় থাকি।
ক্ষুধা সূচকের মাপকাঠিতে ২০১৯এ আমরা ছিলাম বিশ্বে ১০২ নম্বরে, ২০২০তে কোনওভাবে সেটা গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ৯৪-এর কোঠায়। ২০২১এ আমরা আবার ১০১তম স্থানটিকে অধিকার করেছি। প্রতিক্রিয়াতে, যেমনটা ভাবা গিয়েছিল ঠিক সেই কায়দাতেই, আমাদের সরকার পরীক্ষায় খারাপ নম্বর পাওয়া ছাত্রের মতোই সমস্ত দোষটাকে ‘দুষ্ট মাস্টারমশাইদের’ ঘাড়ে চাপাতে চেষ্টা করেছেন। গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সের সমীক্ষাকে ‘শকিং!’ বলে উল্লেখ করে ভারত সরকার জানিয়েছেন বাস্তবচিত্রের সঙ্গে নাকি এর কোনও মিলই নেই। এই সমীক্ষা নাকি সম্পূর্ণভাবে ‘গ্রাউন্ড রিয়ালিটি’কে অস্বীকার করে। বেশ, তাহলে সরকারি তথ্যের নিরিখেই কিছু বক্তব্যকে এই পরিসরে উল্লেখ করা যাক।
ক্ষুধা সূচকের নিরিখে ২০১৯ থেকে ২০২১— প্রতিবারেই পাকিস্তান, বাংলাদেশ এমনকি নেপালের চেয়েও তলানিতে, আরও তলানিতে ঠাঁই হয়েছে ভারতের। এখানে রাজনৈতিকভাবে পাকিস্তান শুনলেই ‘ভক্তেরা’ বিশেষভাবে কুপিত হয়ে পড়তেই পারেন, কিন্তু তাঁদের সুবিধার্থে এও জানিয়ে দিই, ২০১৯ সালের ক্ষুধা সূচক অনুযায়ী দুর্ভিক্ষপীড়িত ইয়েমেনও আমাদের থেকে উচ্চতর অবস্থানে ছিল। কেন্দ্রীয় সরকারি রিপোর্টকেই উদ্ধৃত করে গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সের অন্যতম সহযোগী সংগঠন অক্সফ্যাম ইন্ডিয়ার তরফে জানানো হয়েছে ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সাল অবধি জন্ম নেওয়া এদেশীয় শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির হার সবচেয়ে বেশি বলে দেখা গেছে। পুষ্টি ক্ষেত্রে মোদি সরকারের বরাদ্দ কমেছে তার চেয়েও তড়িৎগতিতে। পোষণ অথবা পোষণ ২.০ বলে যে দুটি প্রকল্পকে মাননীয় মোদি-শাহের সরকার দেশের পুষ্টিক্ষেত্রে যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলে ঘোষণা করে থাকেন, জেনে রাখুন তাতে গোটা দেশের জন্য সর্বমোট ব্যয়বরাদ্দ হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় বাজেটের ০.৫৭ শতাংশ মাত্র। শুধু তাই নয়, চলতি অর্থবর্ষের (২০২১-২২) বাজেটে শিশুপুষ্টির নিরিখে ব্যয়বরাদ্দ, পূর্ববর্তী অর্থবর্ষের (২০২০-২১) বাজেটের তুলনায় ১৮.৫ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। অপুষ্টির আর কীই বা দোষ বলুন। কিন্তু অচ্ছে দিনের সরকারের গত কয়েক বছরেরই বা পারফর্ম্যান্স ছিল কেমন? চোখ বুলিয়ে দেখে নেওয়া যাক সেসব।
২০১৬ সালে ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিক্যাল কমিশনের অনুমোদনক্রমে ইউনিসেফের সঙ্গে যৌথভাবে জাতীয় শিশু ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রক দেশের শিশুস্বাস্থ্যের বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষার কাজ শুরু করে। কম্প্রিহেনসিভ ন্যাশনাল নিউট্রিশন সার্ভে ওরফে সিএনএসএস নামে এই সমীক্ষার উপরে প্রাথমিক রিপোর্টটি ২০১৯ সাল নাগাদ প্রকাশিত হয়। এই সমীক্ষা অনুসারে আমাদের দেশে পাঁচ বছর বা তার চেয়ে কমবয়স্ক শিশুদের ৩৮.৪ শতাংশই দীর্ঘমেয়াদি অপুষ্টির শিকার। দুই বছর বা তার চেয়ে কমবয়স্ক শিশুদের মধ্যে মাত্র ৬.৪ শতাংশের কপালেই নূন্যতম প্রয়োজনীয় খাদ্য বা পুষ্টির সঙ্কুলান হয়। রাজ্যগুলির মধ্যে এই বিষয়ে সবচেয়ে খারাপ ফল করেছে অন্ধ্রপ্রদেশ। সেখানে এই সংখ্যাটি ১.৩ শতাংশ। সবচেয়ে ভালো ফল সিকিমের, সেখানে দুই বছর বা তার চেয়ে কমবয়স্ক শিশুদের ৩৫.৯ শতাংশের কপালেই ন্যূনতম পুষ্টির খাবার জুটতে পারে। ‘মডেল’ রাজ্য গুজরাতে এই সংখ্যা ৩.৬ শতাংশ, মহারাষ্ট্রে ২.২ শতাংশ, আমিলনাড়ুতে ৪.২ শতাংশ। এই সরকারি সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী গুজরাতে দীর্ঘমেয়াদে ভিটামিন ডি-র অভাবে ভুগছে প্রায় ২৫ শতাংশ শিশু। একই রাজ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ শিশু ভুগছে দীর্ঘমেয়াদে জিঙ্কের অভাবে। আর শিক্ষার সঙ্গে পুষ্টির যোগাযোগ? নারীশিক্ষা ও শিক্ষিত মায়েদের নিরিখে শিশুপুষ্টির হিসেবনিকেশ? সরকারি এই সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে ৪ বছর বা তার চেয়ে কমবয়সী শিশুদের মায়েদের মধ্যে ৩১ শতাংশ, ৫ থেকে ৯ বছর বয়সী শিশুদের মায়েদের ক্ষেত্রে ৪২ শতাংশ এবং ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী শিশুদের মায়েদের ক্ষেত্রে ৫৩ শতাংশ কোনওদিন স্কুলমুখো হননি। এই উজ্জ্বলতর ভারতবর্ষে দেখা যাচ্ছে যে, স্কুল না যাওয়া মায়েদের ক্ষেত্রে বেড়ে ওঠা শিশুদের মধ্যে মাত্র ১১ শতাংশই সঠিক পুষ্টির জোগান পেয়েছে। সেখানে ক্লাস টুয়েলভ পাশ করা মায়েদের ক্ষেত্রে সেই সংখ্যাটিই বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ শতাংশ। ভুললে চলবে না, এই তথ্য সম্পূর্ণভাবে সরকারি এবং প্রাক-প্যানডেমিক ভারতবর্ষের হিসেব। প্যানডেমিক পরবর্তীতে যে এই সংখ্যাগুলি কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে তা মা গঙ্গাই জানেন। কাজেই হাঙ্গার ইনডেক্সে আমাদের পারফর্ম্যান্স কি সত্যিই ‘আশানুরূপ’ নয়?
বিশেষ করে কেন প্যানডেমিক পূর্ববর্তী সময়ের তথ্য উল্লেখ করছি, তার কারণ হল— কোনওভাবেই যাতে এই সরকার নিজেদের ব্যর্থতার দায় অতিমারির ঘাড়ে চাপাতে না পারে। হাঙ্গার ইনডেক্সের তথ্য ভয়াবহ, এবং সেই ভয়াবহ তথ্য সম্পূর্ণরূপে সত্য এবং সেই ভয়াবহতার দায় সরকারের, নীতিপ্রণেতাদের এবং ভ্রান্ত রাজনীতিতে দেশবাসীকে ভুলিয়ে রাখার অপচেষ্টায় লিপ্ত সেই সব রাজনীতিকদের। যাঁরা চোখের পাতাটুকুও অবধি না কাঁপিয়ে এই সমস্ত রিপোর্টকেই বাজে কাগজের ঝুড়িতে নিক্ষেপ করতে ভালোবাসেন।
যোজনা কমিশনের প্রাক্তন সদস্য, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ সেন একটি প্রবন্ধে মন্তব্য করেছিলেন— কোনও মানুষ, বিশেষত গ্রামীণ অঞ্চলের মানুষ যদি নিত্যদিনের খাবারের ক্ষেত্রেও খরচ কমিয়ে আনার লক্ষণ দেখায়, তাহলে বুঝতে হবে সেই দেশে দারিদ্র ও অপুষ্টি ভয়াবহ আকার নিতে চলেছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে আগেই দ্য হিন্দু পত্রিকায় ফাঁস হয়ে যাওয়া ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিক্যাল অফিস বা এনএসও-র একটি রিপোর্টে বলা হয়েছিল যে গত পঁয়তাল্লিশ বছরে মোদির ভারতবর্ষে বেকারত্ব নাকি সবচেয়ে খারাপ জায়গাতে পৌঁছেছে। ২০১৯-এরই শেষ দিকে সেই একই ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিক্যাল অফিস বা এনএসও-রই আরেকটি সমীক্ষা, কনজ্যুমার এক্সপেন্ডিচার সার্ভে অনুযায়ী জানা যাচ্ছে, ১৯৭২-৭৪ সালের পর এই প্রথমবার দেশের মানুষ খাদ্যের পিছনে তাঁদের যে মাসিক খরচ, সেটি কমাতে বাধ্য হয়েছেন। এই সমীক্ষার রিপোর্টটি অবশ্য সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করার মতো সাহস সরকার দেখায়নি। পদ্ধতিগত ত্রুটির কথা বলে রিপোর্টটিকে ঠান্ডা ঘরে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু এই রিপোর্টে লেখা ছিল যে, ২০১১-১২-র সাপেক্ষে ২০১৭-১৮-তে একজন ভারতীয়ের গড় মাসিক খরচ ১৫০১ টাকা থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ১৪৪৬ টাকায়। গ্রামীণ ভারতবর্ষে এই মাসিক খরচ হ্রাসের হার প্রায় ৮.৮ শতাংশ। আগে যেখানে গ্রামীণ ভারতবর্ষের কোনও একজন নাগরিক মাসে ৬৪৩ টাকা খাবারের পিছনে ব্যয় করতেন, এখন সেটি কমে দাঁড়িয়েছে ৫৮০ টাকায়। এই প্রতিটি তথ্য অতিমারি-পূর্ব ভারতবর্ষের সরকারি দস্তাবেজ থেকে আহরিত। এরপরেও কি দেশের সরকার, প্যানডেমিক-পরবর্তী পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সের রিপোর্টকে বাস্তবের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ বলে দাবি করবে? হিসেব তো মিলছে না।
অতএব আমরা কেবল দীর্ঘনিঃশ্বাসের সঙ্গে আবৃত্তি করব,
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি!
আর মনে মনে দুষতে চাইব পাশ্চাত্যশিক্ষায় শিক্ষিত সেই সমস্ত শত্রুদের, যাঁরা কিনা এই সমস্ত ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ রিপোর্ট তুলে এনে শহুরে বিচ্ছিন্নতাবাদীদেরকে অক্সিজেন জোগান। আমাদের দেশে কোনওদিন দুর্ভিক্ষ হবে না। সহিষ্ণু আমাদের দেশে, অপুষ্টি আমাদের ভিত্তি, অর্ধাহার প্রতি প্রজন্মের ভবিষ্যৎ…