মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়
সমাজকর্মী, প্রধানশিক্ষিকা, বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত
ওপার বাংলা এপার বাংলা
মাঝখানে কাঁটাতার
গুলি খেয়ে ঝুলে থাকলে ফেলানি
বলো তো দোষটা কার?–কবীর সুমন
বছর দশেক আগের একটি ছবি গোটা দুনিয়ার মানুষকে ভয়ঙ্করভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া থেকে ঝুলছে লাল সোয়েটার পরা হাত, তার সমান্তরালে চুলের বেণী। চোদ্দ বছরের ফেলানি খাতুন। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে চৌধুরীহাট সীমান্ত চৌকির কাছে কাঁটাতার পেরোতে গিয়ে সীমা সুরক্ষা বাহিনি বিএসএফের গুলিতে মারা যায়। তার মরদেহ ঝুলে থাকে দীর্ঘ সময়, প্রায় পাঁচ ঘণ্টা। তারপর তাকে নিয়ে যায় বিএসএফ। আরও তিরিশ ঘণ্টা পর লাশ ফেরত দেয় ওপারে। ফেলানির অপরাধ? সে কি অনুপ্রবেশকারী? না, সে নিজের দেশেই ফিরছিল। এর আগের দশ বছর ভারতের নয়াদিল্লিতে গৃহকর্মীর কাজ করছিল সে তার বাবার সঙ্গে। সেদিন ফিরছিল সে তার নিজের দেশে। ফিরতে গিয়ে কাঁটাতারে তার কাপড় আটকে যায়। ভয়ে সে চিৎকার করে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে গুলি। মৃত্যুপথযাত্রী জল চেয়েছিল। জাতীয় সুরক্ষার স্বার্থে সেটুকুও তাকে দেওয়া যায়নি। ঘটনায় অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষ শেষ পর্যন্ত খালাস পেয়ে যায়। ফেলানিকে কেউ মারেনি এই কথাটি দুনিয়াজুড়ে মানবাধিকার কর্মীরা দেওয়ালে লিখেছেন। মানবাধিকার সংগঠন মাসুম ও ফেলানির বাবার করা মামলার এখনও বিচার চলছে। ফেলানির বয়স ছিল মাত্র চোদ্দ। কেন গুলি চালাতে হয়েছিল রাষ্ট্রীয় বাহিনিকে? আত্মরক্ষার জন্য? কাকে বিপন্ন করেছিল ফেলানি?
সীমান্ত নিয়ে বিপন্নতার প্রশ্নটিই আবার বড় হয়ে উঠছে কারণ সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক গেজেট নোটিফিকেশন দিয়ে বিএসএফ আইনের সংশোধন করেছে। বিএসএফের এলাকা বৃদ্ধি হয়েছে পনেরো কিলোমিটার থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার পর্যন্ত। এই অংশের মধ্যে ‘জাতীয় সুরক্ষার স্বার্থে’ বিএসএফ যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারে, দেহ তল্লাশি করতে পারে এবং তার জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করতে পারে। ভারতের তিনটি রাজ্য পাঞ্জাব, অসম এবং অবশ্যই আছে পশ্চিমবঙ্গ যার বিরাট সীমানা রয়েছে প্রতিবেশী বাংলাদেশ বরাবর। হিসেব করে দেখা যাচ্ছে এই আইনের ফলে পশ্চিমবঙ্গের এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চল কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের অধীনে চলে আসছে যার মধ্যে আছে সম্পূর্ণ উত্তরবঙ্গ। উত্তরে কার্শিয়াং আর দক্ষিণে সুন্দরবন অবধি এর বিস্তৃতি। কেন্দ্রীয় সুরক্ষা বাহিনির আওতায় পড়ছে রাজ্যের দ্বিতীয় প্রধান শহর শিলিগুড়ি যা উত্তরবঙ্গ তো বটেই সিকিমের সঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম পথ এবং বাণিজ্যকেন্দ্র। পশ্চিমবঙ্গের দশটি জেলায় আন্তর্জাতিক সীমানা রয়েছে। যে অংশগুলি বিএসএফের নিয়ন্ত্রণে আসতে চলেছে তার মধ্যে পড়ছে রাজ্যের লোকসভা কেন্দ্রগুলির অর্ধেক আর তার একুশটি বিধানসভা কেন্দ্র। এর ফলে উত্তরের কালিম্পং আর আলিপুরদুয়ার বাদে সমস্ত জেলা এসে গেল কেন্দ্রীয় বাহিনির সরাসরি তত্ত্বাবধানে। সুবৃহৎ উত্তর ২৪ পরগনার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ হাবরা অশোকনগর বসিরহাট সহ আর দক্ষিণ ২৪ পরগণার এক-তৃতীয়াংশ। এই সমস্ত এলাকায় স্থানীয় পুলিশকে না জানিয়েই যেকোনও ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে বিএসএফ।
একই আইন জারি হয়েছে পাঞ্জাবে এবং পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী চরণজিৎ সিং তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, রাজ্যের অভ্যন্তরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক এতখানি ঢুকে পড়লে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে দ্বন্দ্বে এদেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বিপর্যস্ত হবে এবং রাজ্যগুলি সার্বভৌমত্ব হারাবে।
বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী সীমান্ত ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন নয়, অনেকের মতে পরিসংখ্যানের নিরিখে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সীমান্ত ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত, যেখানে টানা দুই হাজার মাইল জুড়ে আছে কাঁটাতার। প্রতিদিন এখানে মানুষের প্রাণ যায়। কারা মরে? জঙ্গিদলের সন্ত্রাসবাদী? না, তারাই যারা পেটের দায়ে বাধ্য হয় সীমানা পেরোতে।
সীমান্তের অন্যতম সমস্যা হিসাবে যা তুলে ধরা হয় তা হল পাচার। কী পাচার হয়? মাদক, অস্ত্র, গবাদি পশু এবং অবশ্যই মানুষ। মাদকের প্রসঙ্গে দেখা যাচ্ছে ২০১৯-২০ সালে উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, তেলেঙ্গানা এবং তামিলনাড়ুতে সবচেয়ে বেশি মাদক ধরা পড়েছে। শাহরুখ খানের ছেলে মাদক নিচ্ছে এই নিয়ে চেঁচামেচি শুরু হলে আরেকটি সত্য উঁকি দিল যে কিছুদিন আগে গুজরাটের একটি বন্দরে উদ্ধার হয়েছে ৩০০০০ কেজি হেরোইন। কিন্তু সেই গুজরাতেই নজরদারির সীমানা কমিয়ে আনা হল। অতএব প্রশ্ন তৈরি হতে থাকে।
ভারতের সংবিধান অনুযায়ী রাজ্যের অধীনে আছে রাজ্যের পুলিশিব্যবস্থা। ১৯৬৮ সালে সীমা সুরক্ষা বাহিনি বিএসএফ যখন তৈরি হয় তখন তাকে কিছুটা পুলিশের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল কারণ তখন যোগাযোগব্যবস্থা এত ভালো ছিল না, এক ফোনে চারিদিকে খবর ছড়াত না, নজরদারির জন্য ড্রোনের ব্যবস্থা ছিল না। বিএসএফ কিন্তু কখনওই তার কার্যকলাপে স্থানীয় মানুষের বন্ধু হয়ে উঠতে পারেনি। বারবার তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে অন্যায়ভাবে মানুষকে আটক করা, নানারকম হয়রানি করা, তার ওপর মোটা টাকার বিনিময়ে যে কাজ আটকাতে তাদের মোতায়েন করা সেই কাজকেই সাহায্য করা। পশ্চিমবঙ্গের সীমানা বরাবর জেলাগুলিতে একটু প্রান্তিক অংশে যাদের বন্ধুবান্ধব আত্মীয় আছেন তাঁরা সবাই জানেন কীভাবে টাকা দিয়ে পারাপার করা যায়।
পৃথিবীর দ্রুততম দেশবিভাগের কারিগর র্যাডক্লিফ মহাশয় সম্পর্কে এই গল্প শোনা যায় যে দেশভাগের লাইন টানতে টানতে বোধহয় ঝিমুনি এসেছিল, তার ফলে লাইনের এপার-ওপারের মাঝখানে যে সমস্ত জমি পড়ে গিয়েছিল বাস্তবে তাদের চাষ করতে প্রতিদিনই এদিকের মানুষকে বিএসএফের কাছে নিজস্ব পরিচয়পত্র জমা দিয়ে সেই না-মানুষি জমিতে যেতে হয়। এই নিয়ে বিএসএফ তাঁদের নিরন্তর অনেক ঝামেলায় ফেলে। যাঁরা সীমান্তে থাকেন তারা সবাই ভুক্তভোগী। যে কোনও সীমানায় মানবপাচার এক ভয়াবহ সত্য। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে ২০২০ সালের মানবপাচারের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে মহারাষ্ট্রে। মানবপাচারের সঙ্গে শুধু সীমানা যুক্ত থাকে না, থাকে চিরাচরিত কারণ দারিদ্র্য এবং একটু সুখের হাতছানি।
অতএব হাতে থাকল সেই কারণটি যাকে বলে অনুপ্রবেশ। যে শব্দটি এখন রাজনৈতিক ভারে ক্লান্ত। আর ঢুকে পড়ে এনআরসির প্রসঙ্গ। সীমান্ত পেরিয়ে যে আসে সে আর শুধু মানুষ থাকে না, হয়ে যায় হিন্দু অথবা মুসলমান। শরণার্থী বা অনুপ্রবেশকারী— বিবিধ সংজ্ঞায় তাকে বাঁধা হয়।
কেন্দ্রে যে দল এখন শাসন করে, যে কোনও রাজ্যকে খণ্ডিত করায় তাদের যে আগ্রহ, এই নীতি হয়তোবা তাদের কাজে লাগবে। ইতিমধ্যেই উত্তরবঙ্গকে আলাদা করার কথা হয়েছে। উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চল কেন্দ্রীয় বাহিনির কবলে এলে সেখানে অনুপ্রবেশকারীর ধুয়ো তুলতে সুবিধা হতে পারে। ইতিমধ্যেই সেখান থেকে দুজন মন্ত্রী হয়েছেন। সংসদে এই নিয়ে প্রস্তাব নেওয়া যেতে পারে।
আজ সেই বিতর্ককে মাথায় নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তরের তরফে পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা সরাসরি কেন্দ্রীয় শাসনের আওতায় আনার মূল উদ্দেশ্য যে রাজনৈতিক তা বুঝতে রাজনৈতিক বুদ্ধির প্রয়োজন নেই। কেন্দ্রীয় শক্তি, বিপুল অর্থ, সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়ি দিয়েও বঙ্গবিজয় হয়নি। তাই অন্য পথ। রাজ্যশুদ্ধ মানুষকে ধরপাকড়ের আতঙ্কে রাখা, প্রতিবাদীকে পাচার কেসে জড়িয়ে দেওয়া আইনের অবশ্যম্ভাবী ফল হতে চলেছে। এক এনআইএ-তেই জ্বালিয়ে রাখছে, তার সঙ্গে যুক্ত হল বিএসফের নতুন ক্ষমতা। কাশ্মিরের মত অচিরেই এখানে দুয়ারে সেনা দেখতে পাওয়া যাবে।
ভাবতে অবাক লাগছে যে এত বড় একটা বদল রাজ্যের ভিতরে ঘটতে চলেছে, কিন্তু এদিকে বাঙালিদের একমাত্র চিন্তার বিষয় হল ওদিকে দুর্গাপুজো নিয়ে কী ঘটছে। এই নিষ্ক্রিয়তা সমস্যাটিকে আরও জটিল করে তুলছে।
গুলজার একটি কবিতায় বলেছিলেন—
সীমান্তে এই নীরবতা কেন?
সীমান্তে কেন এই নীরবতা? প্রতারক এই নীরবতা…
এই সময়ে শুধু সীমান্ত নয়, রাজ্যজুড়ে এই নীরবতা আত্মঘাতী হতে চলেছে।
অত্যন্ত জরুরি। চমৎকার লেখা।
হীরক সেনগুপ্ত