বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
মনোজ ঘুমাচ্ছিল, পাশে সুমিতা। দুজনে দুইদিকে মুখ ফিরিয়ে। রাতে শুতে যাওয়ার আগে যদিবা একটু খোঁটাখুঁটি, তারপর মুখ আর ফেরেনি কারও। বন্ধ বাতাস ঘেমো গন্ধ নিয়ে ঘরের আনাচেকানাচে লেপটে। বাপের আমলের পুরনো ফ্যানটা ঘুরছে ঘ্যাসঘ্যাস। সুমিতার শরীরটা দয়ের আকারে গুটিয়ে, নরম হয়ে যাওয়া শাড়িটার ভাঁজ যেমন কে তেমন। মনোজ ঘুমাচ্ছিল যতিচিহ্নের মত, বুকের উপরে দুই হাতের পাতা এনে জড়ো করা। এক মুহূর্ত আগেও তার বুকের ওঠাপড়ায় ছিল নিশ্চিন্ত নিদ্রার মায়া। ডাকটায় ছন্দপতন হল। হয়তো ঘুমটা তখনও গাঢ় হয়নি। অথবা গভীর ছিল, কিন্তু বড় স্টেশনে গাড়ি ঢোকার মত গুমগুমি আওয়াজটা ঘুমের ভিতর থেকে নড়া ধরে টেনে এনেছে। ডাকটা সত্যিই গম্ভীর।
–মনোজ!
এত রাতে আবার কে এল? রাত কটা তাই বা কে জানে। চটকা ভাঙতে অভ্যস্ত দৃষ্টিপাতে টেবিলের উপর রাখা ঘড়িটায় চোখ গেল, ওটার রেডিয়াম দেওয়া কাঁটায় সময় তিরতির করছে। একটা পঁচিশ। মাঝরাতে কে খোঁজ করতে এল এখন!
–মনোজ!
আরও একবার ডেকে উঠল নাছোড়বান্দা স্বরটা। এক সময় রাত দেড়টা ছিল সন্ধে। মনোজের কাছে সেটা দূরের এক সময়, অনেক বছর আগের সেসব দিন। এখন গভীর রাতের ডাক মনের ভিতর একটা ভয় চারিয়ে দেয়, কোনও অঘটন? দেড় বছর আগে এমনি করে সমীর এসে ডেকেছিল। সেটা শীতের রাত, লেপের ওমের মধ্যে নিজেকে দৈর্ঘ্যে ছোট করে শুয়েছিল মনোজ। শাখাপলার রিনরিন শব্দে কাঁধে দ্রুত হাতে ধাক্কা দিয়েছিল সুমিতা। সঙ্গে সঙ্গে ছিলা ছেঁড়া ধনুকের মত লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়েছিল মনোজ। বিতান চলে যায় সেই রাতে। সবে পঁয়তাল্লিশ। আবার কারও কিছু হল? কে ডাকছে আজ? কেমন একটা গম্ভীর, অথচ ফিসফিসে ডাক। পাশে সুমিতার নিশ্বাস একই লয়ে চলেছে আজ। শুনতেই পায়নি। যেন শুধু মনোজকে শোনানোর জন্যেই।
তিনবারের বেলা গলার স্বরে আর একটু তাড়া—
–মনোজ!
ধ্যাত্তেরি! যেই ডাকছে, রাতের তোয়াক্কা করে না মোটেই। এবার তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে গায়ে জামা গলিয়ে চটি ফটফটিয়ে বাইরের দরজার খিল আর ছিটকিনি খুলে উঁকি দিল মনোজ।
রাতের আকাশে ছিটেফোঁটা মেঘ নেই। একধারে হেলে পড়েছে সপ্তর্ষিমণ্ডল, ঠায় দাঁড়িয়ে কালপুরুষ। আবছা কালো জালের মত অন্ধকার, সেই জালের নিচে ঝিমিয়ে আছে গোটা চৌহদ্দিটা। সেই ছায়াহীন অন্ধকার ফুঁড়ে কাউকে দেখতে পেল না মনোজ, শুধু একটা খসখস আওয়াজ উঠল আলগোছে। শ্যামলদাদের মাদী বিড়ালটা কার্নিশ ধরে হাঁটলে যেমন হয়। কে? দুবার ডাক ছাড়ল মনোজ। দ্বিতীয়বার গলাটা কি কেঁপে গেল একটু? রাতবিরেতে একসময় অনেক মড়াটড়া পুড়িয়েছে, তাকে ভয় পাওয়ানো অত সোজা নয়। অনিশ্চিতের দোটানাটা ছিল, কিন্তু কেউ যদি মাঝরাতে কোনও ত্যাঁদরামি করতে এসেছে তাকে এমনি এমনি পার পেতে দেবে সে বান্দাও মনোজ নয়। বিছানার ঘুমে ফেরার কথা একবারও মনে পড়ল না। তার বদলে চৌকাঠ পেরিয়ে ছুঁয়ে ফেলল রাস্তা। কে ডাকছে মনোজকে এই গভীর নিশীথে?
এক ধরনের খোঁজে মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে, চোখ ছুটে যায় দিকে দিকে। এখানে অন্ধকার চোখের ব্যাপ্তি কেড়ে নিয়েছে। নিজের অজান্তেই মনোজের পা এগিয়ে গেল। প্রথমে দ্বিধাগ্রস্ত পায়ে, কয়েক হাত সামনে একটা অস্পষ্ট ছায়ামূর্তিকে পেয়ে যেতেই সেই গতিতে প্রাণ এল।
–এই কে রে? কে তুই?
তিনবার ডাকের পর একেবারে নিস্তব্ধ ছিল লোকটা। এই প্রথম ওর দিক থেকে একটা আওয়াজ এল। ভরা কলসি উলটে দিলে জল যেমন বুগবুগিয়ে বেরোয়, তেমনি বিরক্তিকর একটা হিক্কাতোলা আওয়াজ নিয়ে হাসল লোকটা, চিনতে পারছ না?
–মন্টু? এই শালা, এত রাতে কী চাই রে তোর? গলাটা চিনতে পেরেই রাগটা চড়াত করে মাথায় উঠে গেল। ছিনেজোঁকের মত পিছনে লেগে আছে ছেলেটা। বেশ কদিন ঘ্যানঘ্যান করছিল, কী করছ মনোজদা ওই দোকানটা নিয়ে। রেলবাজারের মুখে এমন ঝকাস লোকেশান, আসো না দুজনে মিলে একটা মোবাইলের দোকান দিই। মনোজ এক কথায় খারিজ করে দিয়েছিল। সুমিতা ভয় পেয়েছিল যদিও। মন্টুর দাদা ছিল মস্তান, এক সময় পাড়া কাঁপাত।
সে যখন কাঁপাত, কাঁপাত। কবে সেই বান্দা কেস হয়ে গেছে, আমি কি এখন ওর ভাইকে ভয় পাব? তখন পায়নি, এখন এত রাতে অন্ধকারে মন্টুকে ভয় পেল মনোজ। বেরোনো উচিত হয়নি, কার মনে কী আছে কে জানে। আজকাল কে যে পকেটে ঘোড়া নিয়ে ঘুরছে, আগে থাকতে আন্দাজ করা মুশকিল। ফিরবে বলে ঘাড় ঘোরাচ্ছিল মনোজ। লোকটা এবার খিকখিক করে হাসল, যেন খুব মজা পেয়েছে। আমাকে মন্টু মনে হচ্ছে তোমার? চেনো আগে, তাহলে তো বুঝবে কী চাই।
–চিনব কী করে রে শালা, দাঁড়াতে পারছিস না? মন্টু না হলে কে তুই? জোরে হেঁটে হাঁফ ধরেছিল মনোজের, তাতেই মেজাজটা টং। প্রথমে ভেবেছিল একটু জোরে পা চালালেই ধরে ফেলবে। কিন্তু পরিখার মত সামনে পড়ে থাকা দূরত্বটা অতিক্রম করতে পারছিল না কিছুতেই। রোখ চেপে প্রায় দৌড়ে উঠেছিল, কিন্তু হল না। ওই লোকটাও সমান জোরে পা চালিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। কুকুরের মত জিভ বের করে হাঁফাতে হাঁফাতে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল মনোজ। দমচাপা গলায় চেঁচিয়ে উঠল, কে তুমি? দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারছ না?
সে লোকের নিজের পরিচয় দেওয়ার কোনও ইচ্ছে নেই, বরং গলায় একটা চ্যালেঞ্জের সুর। চিনতে না পেরেও রাতবিরেতে একটা অজানা লোকের ডাক শুনে চলে এলে? কেন গো?
–এই যাত্রাপার্টি! ন্যাকা চোদাস না আমার সঙ্গে। আবার রাগে ফেটে পড়তে গিয়েই গলাটা ধরতাই দিল মনোজকে। অ্যাই সিধু! শালা, আমার সঙ্গে ফাজলামি করছিস? প্লের মহড়া দিচ্ছিস এত রাতে? ভয় ফেটে হাসি ফুটছিল মনোজের গলায়। দাঁড়া এবার, তোরই জিত। অনেক হাঁটিয়েছিস, এখন একটা বিড়ি দে।
দাঁড়িয়ে পড়েছিল মনোজ। সিধুও। এতক্ষণ বুঝতে পারেনি মনোজ, এখন হাত চালিয়ে দেখল পাজামায় একরাশ চোরকাঁটা, পা-টা বেশ কুটকুট করছিল। কোথায় এসে গেলাম রে সিধু? এই রাতবিরেতে সিনটা কী বল দেখি তোর? ভালো মাল পেয়েছিস?
সিধু আসে এমনি অনেক সময় একটা বোতল কোমরে গুঁজে, নমাসে ছমাসে একদিন। কোথাও নাটক করে ফিরছে শেষ ট্রেনে, মনোজকে এসে ডেকে তোলে। কিন্তু এমনধারা হাঁটায়নি আগে কখনও।
সত্যিই অনেকটা চলে এসেছে। অন্ধকার ঠেলে ওঠা বাড়ির আনাচকানাচ থেকে পাড়ার হদিশ করতে গিয়ে মনোজের চোখ কোথাও আটকাল না, কোনাখামচি থেকে আলোও তো ঝলকায় না মোটে। শুধু দিকে দিকে অন্ধকারের স্তূপ ধানের মড়াইয়ের মত। নাকে গন্ধ টেনে একটা হালকা পোড়া গন্ধ পেল, যেন ছানাপোড়া। সুমিষ্ট, কটু গন্ধ নয়। হাওয়া এখানে গায়ে এসে ধাক্কা মারছে বেশ, লোকালয় পেরিয়ে এলে যেমনধারা হয়। ভেজা, স্যাঁতসেঁতেও। নাক, কান, চোখ প্রাণপণে শানিয়েও খোলা ড্রেনের গন্ধ, পায়ের তলার আলগা ইট বা রাস্তার তারে নারকেল পাতার খরখরানি— সেসব কিছুই চেনা পাড়াটার পরিচয় নিয়ে হাজির হল না। দুই পা হেঁটেই এমন বদলানো কী করে সম্ভব?
–এই সিধু, কোথায় এলাম রে? সিধুর দিক থেকে কোনও সাড়া না পেয়ে এবার চেতিয়ে গেল মনোজ। কথা বলছিস না কেন? এই শালা হারামি, পুটকিতে খুব দম হয়েছে না? কোথায় নিয়ে এলি আমায়?
এবার হা হা শব্দে ফেটে পড়ল সামনের অবয়ব। আমি কেন আনব? আমি কি তোমার হাত ধরে টেনেছি না জোর করেছি। দৌড়ে দৌড়ে আসছ তো তুমিই। আবার কখনও বলছ মন্টু, কখনও সিধু।
মনোজের মনে হল সে যেন ঘুমের মধ্যে কোনও স্বপ্নের খুব গভীরে ঢুকে গেছে। স্বপ্নে যেমন সব কিছু খুব চেনা মনে হতে হতে কেমন আচেনা হয়ে যায়, এখন এই রাস্তাটা, লোকটাও— গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল মনোজের। চারপাশের অচেনা অন্ধকার ওর সব তেজে এবার জল ঢেলে দিল।
–সিধু না হলে কে তুমি? কোথায় নিয়ে যাচ্ছ আমায়?
–আমি কোথায় নিলাম? শুধু তো ডেকেছিলাম।
–কেন ডাকলে? ডাক শুনেই না তোমার পিছনে পিছনে এসেছি।
–না আসতে। কেন এসেছ আমার পিছনে? আমি কে তা না জেনেই চলে এলে? না কি মনে মনে জানতে?
লেজে খেলাচ্ছে লোকটা। কোনও গূঢ় আভিসন্ধি আছে এর। তাকে গুম করতে চায়। কিন্তু কেন? কারও সঙ্গে ইদানিং ঝামেলা হয়েছে কোনও? কই তেমন মনে পড়ছে না তো। ভেবে বের করতে না পেরে খুব অসহায় লাগল নিজেকে। কে এই লোকটা? কেন নিয়ে যাচ্ছে তাকে, কোথায়? থমকে দাঁড়াতে গিয়ে বুঝল সে হাঁটা থামাতে পারছে না। এই প্রথম মনোজ নিজের অবস্থার সীমাবদ্ধতা বুঝতে পারল। নিজের হাত দিয়ে পায়ের থাই খামচে ধরল, পায়ের বুড়ো আঙুল গেঁথে দিতে চাইল মাটিতে। সারা শরীর দিয়ে নিজেকে পিছনে টানার চেষ্টায় খিঁচ ধরে গেল। কোনও একটা গাছের গুঁড়ি টুড়ি পেলেও জাপ্টে ধরত, কিন্তু বৈঠা চালানোর মত দুহাত চালিয়েও হাওয়া ছাড়া কিছুই কাটল না। নিজের অজান্তেই একটা আর্তস্বর গলা ছিটকে বেরিয়ে এল, নিশি!
ছোটবেলায় শীতের রাতে ভূতের গল্প বলা শেষ করে মনোজের কান অবধি লেপ টেনে দিয়ে দিদি বলত, মনু! খবরদার বিছানা ছাড়বি না। চুপটি করে ঘুমিয়ে যা। কেউ ডাকলে তিনবারের আগে সাড়া দিবি না।
–কে ডাকবে রে দিদি?
–নিশি।
দিদির থমথমে গলা হ্যারিকেনের পলতের সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে উঠত যেন। সাড়া দিলে কী হবে? এই কথাটা সাহস করে জিজ্ঞেস করতে পারেনি সেদিনের মনোজ, বরং আরও গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়েছে। নিশির ডাক না শুনতে চাওয়ার প্রাণপণ চেষ্টায় ঘুমিয়েও পড়েছে চটজলদি।
–নিশি ডেকে কোথায় নিয়ে যায় রে দিদি? জিজ্ঞেস করেছে দিনের বেলায়।
–কোনও এক অন্ধকার গুহায়। কিংবা নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয় অতল খাদের সামনে।
–তারপর? শুনতে শুনতে গলা শুকিয়ে যেত মনোজের।
–আবার কী, সেই লোকটা তখন লাফ দিয়ে পড়ত ওই খাদে। শেষ।
–তুই কী করে জানলি দিদি? বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মাঝখানে দুলত মনোজ।
–সবাই জানে।
–কচু জানে! কাউকে ডেকে নিয়ে যেতে শুনেছিস?
–শুনবি না রে। নিশি যাকে ডেকে নিয়ে যায়, তাকে আর কেউ মনে রাখতে পারে না। আর কোত্থাও থাকে না সেই লোকটা। হয়তো আমাদের পাড়ায় আরও অনেক লোক ছিল, কেউ কেউ চলে গেছে। তাদের কথা কারও মনেই নেই।
একটা একটা করে পাড়ার সব কটা বাড়ির কথা ভাবত মনোজ। কে ছিল, কে চলে গেছে? কিছুতেই বুঝতে পারত না। অথচ দিদি এমনভাবে বলত যেন এমনটাই হওয়ার কথা। ভয়ে অন্তরাত্মা শুকিয়ে যেত মনোজের। একেবারে হাপিস করে দেবে নিশি? একদম! এমনকি কেউ মনেও রাখবে না। বাড়িতে সবাই খেতে বসবে, কেউ একবার ভাববেও না মনোজ বলে কেউ তাদের সঙ্গে বসে খেত কোনওদিন? এমন গোটাগুটি নিপাত্তা হওয়ার সম্ভাবনায় ভয়ে আধমরা হয়ে থাকত মনোজ। অনেকদিন অবধি কানে বালিশচাপা দিয়ে শুয়েছে, যাতে ডাক শুনতে না হয়। তারপর এক সময় ভুলেও গেছে।
আজ বিয়াল্লিশ বছর বাদে শেষ অবধি শুনেই ফেলল সেই ডাক? তবে কি তার নিপাত্তা হওয়ার সময় হয়েছে? সে চলে গেলে কী হবে সুমিতা আর টিঙ্কুর? এমন কিছু সম্বল তো করে উঠতে পারেনি মনোজ এখনও। আর, তার নিজের কী হবে? এক্কেবারে মরে যাবে? এত তাড়াতাড়ি? পিছনে ছেড়ে রেখে আসা ভয়টা একলাফে এসে মনোজের শরীর কবজা করে নিল। কথা বলতে গিয়ে গলার আওয়াজ বিচ্ছিরি রকমের ফ্যাঁসফেঁসে শোনাল। এতদিন না ডেকে আজ কেন ডাকলে নিশি?
এবার নিজের পরিচয় নিয়ে কোনও প্রতিবাদ করল না লোকটা। বলল, ডাক চলতেই থাকে, সময় না হলে কেউ শুনতে পায় না।
–কিসের সময়? অসহায় রাগটা তেড়েফুঁড়ে উঠতে চাইছিল গলা দিয়ে। বেশ জোরেই তো ছিল তোমার ডাক। কানে কালা তো নই। আগে ডাকলে শুনতে পেতাম ঠিক।
–কান কি শোনে? ওটা তো দরজা। মনে নৈঃশব্দ তৈরি হতে হয়, নাহলে আমার ডাক বসার জায়গা পাবে কোথায়?
খাদে লাফিয়ে বা অন্ধকারে মিলিয়ে গিয়ে চিরকালের মত শেষ হয়ে যাবে, এই ভয়টা জেঁকে ধরেছিল। কিন্তু লোকটার হেঁয়ালিতে মরার ভয় কমে রাগ চড়ল মনোজের। সকালে উঠে দোকান খুলতে হবে, এখন মাঝরাতে কি এমন বলার ছিল যে হাঁক পাড়তে হয়েছে ওকে? কী বলবে বলে ফেলো চটপট।
–আমি তো কিছু বলব না।
–মানে? বলবে না তো ডাকলে কেন রাতবিরেতে? পেঁয়াজি করছ?
–সে তো তোমাকে জাগানোর জন্য।
–ঘুমের থেকে জাগাবে তুমি? ইচ্ছে হল এক লাফে লোকটার ঘাড়ে উঠে টুঁটি চিপে ধরে। মাঝের দূরত্বটা পেরোতে পারলে তবে না!
–ঘুম থেকে জাগাইনি, স্থবিরতাকে নাড়া দিয়েছি।
–এঁঃ! স্থবির ফলাচ্ছে ? কেন আমি কি লুলা না ল্যাংড়া, হাঁটতে পারি না? দোকানে বসে থাকতে হয় ঠায় সারাটা দিন। তার মানেই কি হাঁটুর কল খারাপ? রোজ বলে কত জায়গায় যেতে হয়!
–আচ্ছা, বেশ। কোথায় যাও?
–দোকান বাজার যাচ্ছি না রোজ? মেয়েকে সাইকেলে করে ইস্কুলে পৌঁছে দিই। দোকানের মাল আনতে সপ্তাহে একদিন বড়বাজার যাই। খাতায় হিসাব লেখার মত ফিরিস্তি দেয় মনোজ।
–এত যে যাও, পৌঁছালে কোথাও?
–তুমি কি ধাঁধা করছ? যখন যেখানে পৌঁছানোর পৌঁছে যাচ্ছি সেখানেই। লোকটার ঘাড়ের কাছে টাই টাই করে দুটো চড় হাঁকড়াতে ইচ্ছে হল মনোজের। রাতদুপুরে ঘুম থেকে তুলে এনে খিল্লি করছে। এইরকম সবজান্তা খাঞ্জা খাঁ টাইপের লোক পেলেই হাত নিশপিশ করে ওঠে মনোজের।
–মানুষের জীবনটা কি? সেটাও তো একটা ধাঁধা।
–ধাঁধা নয় ধান্দা। জীবন মানেই ধান্দা। তোমার কী ধান্দা বলো তো এবার?
–ধান্দা না ধাঁধা। ধাঁধা মানে পাজল। অনেকগুলো অংশ জুড়ে জুড়ে একটা গোটা মানুষ। পাজল নয় তো কী?
টিঙ্কুকে একটা পাজল কিনে দিয়েছিল, চৌষট্টি টুকরোর। ঠিক ঠিক জোড়া লাগালেই গোটা তাজমহল। চৌষট্টির কথায় মনে পড়ল সতীর থানের হিসাব, শিবের চক্রে চৌষট্টি টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল সতীর শরীর। তার শরীরেও কি এমনি চৌষট্টিটা অংশ? যত্তসব, আজগুবি ঘ্যানঘ্যানানি মাঝরাতে ঘুম ভাঙিয়ে! ঘুমের ছিটেফোঁটাও আর চোখের কোলে লেগে নেই যদিও।
–তোমার সব কটা অংশ পেয়েছ? না কি ছড়িয়েছিটিয়ে ছত্রখান?
মুখ ফুটে না বললেও এই তেএঁটে লোকটা ঠিক মনের কথা টেনে বের করে আনে। আমার কি টুকরো হয়েছে, যে পেতে হবে?
–হয় নি? তোমার যে টুকরোটা সুমিতার সঙ্গে বসে ডাল ভাত খায়, সেটাই কি মন্দিরাকে ছাতা মাথায় বাসস্টপ অবধি পৌঁছে দিয়েছিল সেদিন?
বুকের ভিতর তিতির পাখিটা আধখোলা ডানা নিয়ে একটা ছোট্ট ঝাঁপ মারল। যে মনোজ প্রতি সপ্তাহে সুমিতার সঙ্গে টাকার চুলচেরা হিসাব করে আর যে লোকটা খরিদ্দার আসবে না জেনেও সাড়ে আটটার মধ্যে দোকানের ঝাঁপ খোলে মন্দিরার কলেজ যাওয়ার সময়টা ধরতে, তারা মাছের কোল আর ল্যাজার মত আলাদা টুকরো তো বটেই।
এই যে সেদিন ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে দোকান বন্ধ করে বাড়ি না ফিরে সাইকেল করে পোল পার করে চলে গেলে, কিসের খোঁজে?
লোকটা তার সব খবর রাখে? কেন, তার মতন একটা অতি সাধারণ লোকের ঠিকুজিকুলুজিতে কিসের কার কী এসে যায়?
–তোমার এসে যায়। মনোজের মনের ভাবনা বের করে টাঙিয়ে দিল লোকটা। দোকানের বেঞ্চিতে পা ঝুলিয়ে বসে যখন বাজারের সব লোককে এদিক ওদিক ছুটে যেতে দ্যাখো, তোমার কোথাও একটা যেতে ইচ্ছে করে কি না? মনটা কেমন গ্রীষ্মের দুপুরের মত থম মেরে থাকে কিনা?
বেশ ধকের কথা বলছে কিন্তু! মানতেই হল মনোজকে। লোকটার কথা মাথায় ঘুঁটি সাজাতে শুরু করেছে এবার। কতগুলো বছর পেরিয়ে এসেছে, কেমনভাবে আজকের মনোজ হয়ে দাঁড়িয়েছে সে। তার বাইরে কিছু কি আছে? কোথাও কি পড়ে আছে ফেলে আসা কোনও টুকরোটাকরা? অথবা কক্ষনওই না পাওয়া কোনও স্বাদ, গন্ধ, ভালোবাসা! ভাবনাগুলো থমকে থমকে বেরোয় মনোজের মগজের বাইরে। কীভাবে পাব সেই টুকরোটা? পেলেও জানব কীভাবে পেয়েছি কি না?
–কেউ পায় না, এদিক ওদিক থেকে গলতা রয়েই যাবে। বেশি কি কম, এইটাই ফারাক।
–কখনওই ফাঁক ভরবে না? পাওয়া যাবে না আধপাওয়া অংশ? নিজের না পাওয়া টুকরোটার জন্য একটা হাহাকার দানা বাঁধল গলায়।
–এগিয়ে যেতে হবে। আলো, হাওয়া, শব্দ, গন্ধ ছেনে খুঁজে আনতে হবে বাকি টুকরোটা।
–খুঁজে পাওয়ার পর, তখন কি গোটা মানুষ? কথাটা বলেই কেমন বোকা বোকা লাগল নিজেকে, যেন স্বীকার করে নেওয়া যে সে গোটা নয়। আসলে বলেওনি কথাটা মুখ ফুটে, মনের মধ্যে ছুটছে যে রেলগাড়ি তাকে রেড সিগন্যাল দেখাবে কেমন করে?
লোকটা হেঁচকি তুলে হাসল। এ তোমার মেয়ের চৌষট্টি টুকরোর পাজল নয় হে। ভাঙা কাচের গেলাস, কোনও টুকরোটা চৌকির পায়ার সঙ্গে গা মিশিয়ে রয়ে গেছে, একদিন পায়ের তলায় কাটবে বলে, জানবে কী করে সেটা?
–সেটা খুব পারি। ভাঙা টুকরোগুলো জুড়ে জুড়ে দেখে নিলেই হল পুরো হিসাব মিলল কি না।
খিকখিক করে হাসল নিশি। মানুষের জীবন কি কাচের গ্লাস, নিটোল, নিখাদ? তারপর ধরো, ভরলে একটা ফাঁক, খুলে যাবে আর একটা কন্দর। তখন সেটা ভরাট করার খোঁজ পড়বে।
অনিশ্চিতের সম্ভাবনায় মনোজ আবার শামুকখোল। যে পাওয়ার কোনও ঠিকঠিকানা নেই যাবে কেন তার পিছনে? সে কি খ্যাপা!
–কেন বেফালতু খুঁজতে যাব যদি এর কোনও শেষ না থাকে। না খুঁজলে কী হয়? নিজের ক্ষমতায় থাকলে ওখানেই থেমে যেত মনোজ, দাঁড়িয়ে যেত ঠরশ্রী হয়ে। কিন্তু হাঁটা থামাতে পারছে কই!
–আমরা সবাই নদী হয়ে জন্মেছি হে, তবে মরা সোঁতা হতে চাইলে কে আটকাবে।
–যত বড় বড় বুকনি তোমার, তুমি কি যাত্রা দলের বিবেক? ভেঙিয়ে উঠল মনোজ। কথা বলতে বলতে মনোজের মনে হল আসলে সে ঘুমের মধ্যেই আছে, স্বপ্ন ছাড়া কিছু নয় এইসব। এই ভাবনাটা বেশ সাহস জোগাল, পালটা জবাব হাজির হল ঠোঁটে। হলাম না হয় মরা সোঁতা, তাতে খুশি থাকে না লোকে?
–থাকে তো।
–আমিও তো খুশিই ছিলাম। ছিলাম কথাটা খট করে নিজের কানেই লাগল মনোজের, তাড়াতাড়ি শুধরে নিল। খুশি আছি। ভালো আছি আমি।
লোকটা অবশ্য অতীত বা বর্তমান নিয়ে কোনও মন্তব্য করল না। বরং বিচারের রায় শোনানোর মত সাদাসাপটা বলে দিল, ছিলে না।
–ইল্লি, সব জেনে বসে আছেন উনি!
–না হলে আমার ডাক শুনতে পেতে না। আমি তো সবাইকে ডাক দিয়ে যাই। কই, আর কেউ শুনতে পায়নি তো।
–যা ব্বাবা, ওমনি ভারী গলায় ডাক ছাড়লে তুমি, আর আমার শোনাটা দোষের হয়ে গেল?
–দোষ নয়, নৈঃশব্দ। ফাঁকা জায়গা না পেলে আমার ডাক ঢুকবে কোথা দিয়ে।
–দেখো সোজা কথার সোজা হিসাব, আমি তোমার ডাক শুনতে চাইনি।
–শুনলে তো।
–বেশ করেছি! গলা ছেড়ে চিৎকার করে রাতের অন্ধকার ফালা ফালা করে দিল মনোজ। ঢের হয়েছে, এবার ফিরে যাব।
–অতীতে কি ফেরা যায়?
–মানে? কোনটা অতীত?
–ওই যেখানে ছিলে।
–নিজের বাড়ির বিছানায় শুয়েছিলাম, এই খানিক আগে। বিছানার নীল চেক চাদরে এখনও না শুকোনো ঘাম থেবড়ে আছে। পাশের ঘরে শুয়ে আছে বারো বছরের মেয়ে টিঙ্কু। সেটা হয়ে গেল অতীত? তুমি কোথাকার বর্তমান এসেছ হে চাঁদু?
–সেটা তোমার অতীতই ছিল। অতীত মানে কী বলো? যেখানে আর নতুন কোনও ঘটনা ঘটানো যায় না, সেটাই অতীত। মৃত। বেরিয়ে আসার আগেও জলজ্যান্ত সেই অতীতেই ছিলে তুমি।
–হোক অতীত, আমার বাঁচা মরা অতীত বর্তমান, সব আমি দেখে নেব। ফোটো তো এবার, আমি ফিরে যাব।
–যাও না যেখানে খুশি। আমি কি তোমাকে আটকেছি? একবার ছুঁয়েও তো দেখিনি।
–কীভাবে যাব? এলাকাটা অদ্ভুতভাবে আচেনা লাগছিল মনোজের। কথা বলতে বলতে ভয়টা ছেড়ে গিয়েছিল। চারপাশটাকে চিনতে না পাড়ার ভয় দ্বিগুণ জোরে এসে টুঁটি চিপে ধরল এবার। কেমনভাবে ফিরব আমি? আমাকে নিয়ে চলো! আমি এদিকটা কিচ্ছু চিনতে পারছি না।
–বললাম না আমি অতীতে নিয়ে যেতে পারি না, আমি শুধু এগিয়ে দিতে পারি।
–কোথায় এগিয়ে দেবে?
–আলোর দিকে।
–আলো? কিসের আলো? এত রাতে আলো কোত্থেকে আসবে।
–অন্ধকার পেরিয়ে আলো তো একসময় আসেই।
–রাত ফুটলে? সেই আলোয় কী পাব আমি?
–জানি না তো। তোমার না পাওয়া অংশ খুঁজে পেতে পারো। আবার নাও পেতে পারো। আমার জানা নেই। আমি শুধু এগিয়ে দেওয়ার কাজ করেছি, এর পর তুমি যত দূর যেতে পারো, যাও না। আলো ফুটে গেলে আমাকে আর পাবেও না। তার পরের পথ তোমাকে খুঁজে নিতে হবে।
এই আপদটা বিদেয় হলেই ভালো। এক রাতে আর কত মাইলই বা চলেছে। বড় জোর পাঁচ, দশ, পনেরো? একসময় সাইকেলে ঘুরে ঘুরে মাল বিক্রি করত মনোজ। অনেক দূর দূর চেনা আছে। হোক না সে বছর পনেরো আগের কথা, যখন দোকানটা ছিল না। কত আর বদলেছে চারপাশ। আলো ফুটলেই পৌঁছে যাব আমার বাড়ি, হেরে গেলে নিশি। আমাকে হাপিস করতে পারলে না। উত্তেজনায় গলা চড়ছিল মনোজের।
আবার গলা ছেড়ে হাসল নিশি। কান শোনে সময়ের ঘণ্টা, আমার ডাক শোনার পর শুনেছ সেই প্রহরের ঘণ্টা?
–না তো।
–চোখ দেয় ব্যাপ্তি, পথে বেরিয়ে মনে গাঁথার মত দেখেছ কিছু চোখে?
–না। এবারে না বলাটা প্রশ্নচিহ্ন হয়ে বাতাস ভারী করে ঝুলে রইল অন্ধকারে।
–মন ধরে রাখে পরিচয়, যদি কোথাও পরিচিত কিছু না দেখতে পাও, তাহলে তোমার মন যে আবার সাদা পাতা হে।
অন্ধকারে হাসির আওয়াজ শোনা না গেলেও মনোজ নিশ্চিত লোকটা হাসছে, যেন খুব মজা পেয়েছে। পাক মজা। ভয় পায় না সে। আলো ফুটলেই দেখতে পাব, চিনতে পারব পথঘাট।
–বেশ, তাহলে তো চুকেই গেল, খুঁজে নাও তোমার রাস্তা।
অন্ধকার আর আগের মত গাঢ় ছিল না। স্পষ্ট কিছুই দেখা যায় না যদিও, আন্দাজ করার মত আলো। কিন্তু মনোজ দেখল সে আন্দাজ করতে পারছে না। কী শয়তান লোকটা! ওর মন বিবশ করে দিয়েছে, সে কিছু মনে করতে পারছে না। না মনে করতে পারছে, কিন্তু যা অনুভব করছে তার সঙ্গে কিছু মেলাতে পারছে না। এ কোথায় নিয়ে এল লোকটা?
রেগে তেড়ে যেতে গিয়েই আর সামনের ছায়ামূর্তিটাকে পেল না কোথাও। মনোজ আর্তস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, নিশি! নিশি!
বিস্তীর্ণ চরাচরে মনোজ একা। বাতাসে সকালের ঘ্রাণ জড়িয়ে যাচ্ছে, সে ঘ্রাণ তার চেনা গলির গন্ধ নিয়ে এল না। পাখির ডাক নিয়ে আকাশ জাগছে, কিন্তু ওই সুরেলা পাখির ডাক মনোজ চেনে না। কী করবে এখন? তার সঙ্গেই কেন এমন হল? নেহাতই ছাপোষা এক লোক সে, মনোহারি দোকানের দিন আনি দিন খাওয়া দোকানদার। তাকেই কেন বেছে নিল এই নিশি না কে? এই নিশি কি ভগবান? যম তো নয়, কারণ মরেনি, বেঁচেই আছে। কোনও খাদে লাফ দেয়নি, ঢোকেনি কোনও অন্ধকার গুহায়। কিন্তু তার জীবনটা কি এখনও তার জীবনই আছে? থাকবে?
মনোজ জোরে দম নিয়ে হাঁটা শুরু করল আবার, যেটাকে সামনে মনে হল সেই দিকে। ভোর হওয়ার আগের আলো, অন্ধকারের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে এখনও। পথের দিশা দেখানো নিশি নেই কোনওখানে। তবু মনোজ দেখল ওর ভয় খুব তাড়তাড়ি পেছনে চলে যাচ্ছে। তার জায়গায় বাইরের ফুরফুরে বাতাস বুকে ঢুকে পড়েছে, কী দেখবে, চিনতে পারবে কি পারবে না এইসব ভাবনায় শরীরে রোমাঞ্চ জাগছে। বেশ ভালোই লাগছে হাঁটতে এখন। আলো ফুটলে কেমন দেখবে চারপাশ, কোথায় পাবে নিজেকে, সেটা কি সম্পূর্ণ আলাদা একটা জীবন হবে? সুমিতা আর রিঙ্কুর কী হবে? কেমন করে ফিরবে তাদের কাছে? মনের এইসব দোটানা ছাপিয়ে একটা কথা তবু হাউইয়ের মত উপরে উঠে এল।
বেঁচে থাকার প্রতিটা মুহূর্তই আসলে বিস্ময়কর হতে পারে!