সৈয়দ কওসর-জামাল
সৈয়দ কওসর জামালের জন্ম ১৯৫০ সালে। পড়াশুনা প্রথমে বহরমপুর ও পরে কলকাতায়। ইংরেজি সাহিত্যে এমএ। সাহিত্যচর্চা ছেলেবেলা থেকে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ১৯৭৮ সালে। এখন পর্যন্ত কাব্যগ্রন্থ দশটি। শেষ গ্রন্থ ‘পারমাণবিক বীজতলা’। কবি ও কবিতাবিষয়ক প্রবন্ধগ্রন্থ ‘কবির কথা কবিতার কথা’। অনুবাদ গ্রন্থ ‘ফরাসি কবিতা ১৯৫০-২০০০’। ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট প্রকাশ করেছে তিনটি অনুবাদগ্রন্থ। সম্প্রতি রবীন্দ্রনাথের ফরাসি সম্পর্ক বিষয়ে চর্চারত। কবিতার জন্য পেয়েছেন কয়েকটি পুরস্কার ও সম্মাননা। আকাশবাণীতে ৩৫ বছর উচ্চ পদে কাজ কাজ করেছেন। বিশ্বভারতীতে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে সাংবাদিকতা পড়িয়েছেন। বর্তমানে টেকনো ইন্ডিয়ার মিডিয়া সায়েন্স বিভাগে অধ্যাপনা করেন।
কবি বলতে তরুণ সান্যাল বুঝতেন ‘এক বিপ্লবী ব্যক্তিস্বরূপকে’। এই ব্যক্তিস্বরূপ প্রকৃতি, সমাজ, শ্রেণি ও ব্যক্তিসত্তার অন্তঃসার সংগ্রহণে অক্লান্ত। এই কবির প্রকাশভাবনায় থাকে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার ইচ্ছে। তরুণ সান্যালের ভাষায়– ‘আমার লেখা ও প্রায় প্রতিটি কবিতাই তাই নিসর্গ, প্রকৃতি, সমাজ ও আত্মবিশ্লেষণের প্রেক্ষিতে রচনা।’
তাঁর কবিতা রচনার শুরু চোদ্দ-পনের বছর বয়স থেকে। আর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ ১৯৫৬ সালে। নবীন কবি বেড়ে উঠেছেন সাম্যবাদী চেতনায় আর তাঁর সামনে আদর্শের মতো থেকেছেন বিষ্ণু দে, সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো কবিরা। সাম্যময় এক উজ্জ্বল সমাজ গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা এঁদের কবিতায় এবং মার্কসবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ এই ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারকে আত্মস্থ করেই কবি হয়ে উঠেছেন তরুণ সান্যাল। দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক অসন্তোষ ও উদ্বাস্তু সমস্যার প্রভাবে পঞ্চাশের অনেক কবিই যখন আত্মমগ্নতায় আশ্রয় খুঁজেছেন, তরুণ সান্যালের কবিতায় তখন স্পষ্ট হয়েছে প্রতিবাদী ও সমাজবিশ্লেষণের প্রবণতা। পঞ্চাশের কবিতায় এর অভিমুখটা আমরা লক্ষ করি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, রাম বসু ও অমিতাভ দাশগুপ্তের কবিতায়। এই অভিমুখটিকে ব্যাখ্যা করেছেন তরুণ সান্যাল : ‘কবিতা তো মানবসমাজের এক ভিন্ন ধরনের ভাষা। ছন্দ, চিত্র, প্রতীক এবং স্মৃতিজাগানিয়া শব্দের বা শব্দসমবায়ের ডালপালা শিকড়বাকড় দিয়েই যার স্থাপত্য ও সংগীত, বিশেষ জাতি বা সমাজ অংশে জন্ম নেওয়া স্পর্শপ্রবণ ব্যক্তির হয়ে ওঠে, যা কবিতা রচনার ভিত্তি সেসব।’
এই কাব্যভাবনা অবশ্যই পরিণত কবির কলম থেকে নিঃসৃত। কিন্তু কেমন ছিল চব্বিশ বছরের যুবক কবির রচনা ‘মাটির বেহালা’? পঞ্চাশ দশক-চিহ্নিত যৌবনের যে অতৃপ্তি ও যন্ত্রণাবোধ তা-ই যেন এ কবিতার প্রতিটি পঙক্তিতে বাকপ্রতিমা হয়ে উঠেছে। তিনি লিখেছেন:
কৈশোর গেছে উনপঞ্চাশী বজ্রে
সে যে কী জ্বালার দুঃসহতম ভ্রান্তি
আকাশে আগুনে নিষ্ফলা আশা গর্জে,
প্রাক-যৌবনে দেখা দিল পথশ্রান্তি
(সংলাপ)
কাব্যপ্রকরণের দিক থেকে কবির যে অভিনিবেশ শুরু থেকেই ছিল এবং তা ভালোভাবে আত্মস্থ করেই যে তিনি কবিতা রচনায় মনোনিবেশ করেছেন, তা এই গ্রন্থে স্পষ্ট। শব্দ ও শব্দ-প্রকরণ, ছন্দ ও ধ্বনিময়তার বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি ছিল না। প্রেমের কবিতাতেও তিনি জানাতে ভোলেন না: ‘মানুষের শত ক্ষুধিত মিছিলে মুক্ত/ প্রবাহের ধ্বনি শুনেছি।’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্ব ও স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের অশেষ আশার অযুত অভিব্যক্তি হৃদয়ে অনুভব করেছেন কবি। যখন ‘মানুষ দুঃসহ ক্রোধে মাথা ঠোকে রাতের তিমিরে’, প্রার্থনা শুধু রৌদ্রের। এ সময় প্রেমই একমাত্র সান্ত্বনার ধ্বনি – ‘তোমার সান্ত্বনা নিয়ে সূর্যোদয় বুক ভরে নিই’। মাটির পৃথিবীর শরীরিনীর সঙ্গে সম্প্রচারিনীর মিল খুঁজতে গিয়ে অমিল উপলব্ধির বেদনাবোধ— ‘তোমাকেই দীর্ণ দীন জীবনের নক্ষত্রবিলাসে/ বারবার উন্মোচন করি’। ব্যক্তিগত বেদনার সঙ্গে মানুষের বেদনা মিশে সর্বজনীন হয়ে ওঠে যখন কবি লেখেন– ‘এমন অকাল মৃত্যু স্বদেশের স্বকীয় শিবিরে/ জুড়ে আছে।’ তবু আশা জাগে– ‘আমার বিশ্বাসে প্রেম/আমার সত্তায় বিজয়িনী।’ প্রথম কাব্যগ্রন্থেই কী অসাধারণ সব চিত্রকল্প তৈরি হয়েছে:
১)
বেদনার নিখিলে মিশিয়ে
আমার কুণ্ঠিত প্রেম এককোণে শিশিরের জলে
কালের পাষাণে ম্লান ছবি আঁকে
২)
রোদ্দুরের খ্যাপা ঘোড়ার বর্গীখুরের সামনে
মেলে ধরি শ্রাবনের গভীর পরিখা
‘মাটির বেহালা’-র উচ্ছাস ও যৌবনাবেগ ধাতস্থ করে রচিত হচ্ছে ‘অন্ধকার উদ্যানে যে নদী’ (১৯৬১) ও ‘রণক্ষেত্রে দীর্ঘবেলা একা’ (১৯৬৮) কাব্যগ্রন্থদু’টি। ভাষায় উচ্চকিত ভাব নেই। আর এখানেই ‘অতি ব্যক্তিগত’ কথারা ফুটে ওঠে:
বাতাস দিয়ো না আমার শিওরে দোলা,
শোনো টুপটাপ রাতের শিশির ঝরে,
কার হৃদয়ের দুয়ার এখনও খোলা
আলোছায়া মুখ, কার মুখ মনে পড়ে
(কয়েকটি অতি ব্যক্তিগত কবিতা)
কিংবা
ভালোবাসা সবুজ কলম, ঠোঁটে কালি
কিন্তু আলো যদি ছোঁয় তোমার চিবুক
সব কালি ম্লান হয়ে যায়।
(ঐ)
প্রণয় যেন এক সংগ্রামের মতো, একসময় তা সমাপ্ত হয়। তখন যে সংগ্রামের শুরু, তার নাম জীবন। প্রেমের আততি সমাপ্ত হয় না– ‘আমি যাকে প্রেম বলে মানি সেই প্রেত পিণ্ডদানে আমার শিকড়, মাটি, অস্তিত্ব/ সব ধুয়ে নেবে’ (আবর্তনে)। প্রেমের পরিধিই হল ‘জীবনের আকাশ স্পর্শের মতো কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা’, তবু সকল উৎসব থেকে ছুটি নিয়ে চলে যায় যৌবনের প্রেম। ‘রণক্ষেত্রে দীর্ঘবেলা একা’ থাকার যে পথপরিক্রমা, তা জীবনের উত্তরণের দিকে :
হে স্রোত, হে কীর্তিনাশা, হে প্রলয়, হে অস্ত্র সংঘাত,
সূর্য চন্দ্র গ্রহ উল্কা নক্ষত্র নীহার নীহারিকা…
হে সময় আমার সময়
পথিবীর শ্যাম-রুক্ষ রণক্ষেত্রে শুয়ে আছি মাথা রেখে
বাহুর ধনুকে দীর্ঘবেলা
(রণক্ষেত্রে দীর্ঘবেলা একা)
তবু উত্তরণের দিনে মানুষের অন্তর্লীন প্রাণশক্তি উদ্ভিদের মতো লতায়পাতায় পত্রে পুষ্পে ফলে বিকশিত হয়ে ওঠে। ‘যেমন উদ্ভিদ’-এর কবি দ্যাখেন ‘ফুল থেকে বীজ উন্মোচন’, দ্যাখেন ‘প্রতি বন্যাশেষে মৃতের করোটি ঢেকে পলি আর শস্যে উত্তরণ’। এই দার্শনিকতায় মৃত্যুর ভূমিকাও কম নয়। মনে হয়:
ভয় ও আনন্দ যেন প্রেমের প্রথম স্পর্শ
সে কি মৃত্যু, নাকি বোধ
যার পায়ে নিরবধি কবির জীবন পড়ে আছে।
(সে)
কিংবা
মৃত্যুর দক্ষিণ দরজা
ঘুরে এসে আবার তোমাকে ছুঁই
ফের ছুঁয়ে ফেলি।
এইভাবেই মানুষের জীবনীশক্তি নিজেকে উজ্জীবিত করে চলে। তবু নিঃসঙ্গতা কবিজীবনের সঙ্গী। বিশ্বাসের দৃঢ় ভূমি টলে যায়, বিভ্রান্তি জাগে। চারপাশের নৈরাজ্যের ভিতরে দাঁড়িয়ে তাঁর বেদনাহত মুখভঙ্গিটিও আমরা লক্ষ করি:
১)
আর প্রতারণা সয় না, হয় তুমি মৃত্যু হও
নয় ছিঁড়ে ওড়াও হাওয়ায় ইস্তেহার
(দেবীপক্ষে)
২)
ভয় ভাঙতে ঢের কথা বলেছি, এখন
আমারই বুকের মধ্যে ভয়
(জল্লাদ)
৩)
বলছো যাচ্ছো, যাচ্ছো না কি
কোথায় যাচ্ছো ঠিক জানো তো?
(পিছুটান)
৪)
এখন পাথর শুধুই পাথর লোকটা ছিল দুঃখে কাতর
এখন বয়স বাঘের থাবার আঁচড়
দ্যাখ শুয়ে ঐ ভুল মানুষটা শনসাদা চুল নেই হুঁসটাও
ভাবছে বজ্র ঠিক বানাচ্ছে পাঁজর।
(ভুল মানুষ)
চতুর্থ পেরেক (১৯৮১), কায়া নৌকায় (১৯৮৯), নিতান্ত পুঁতির টায়রা (১৯৯০) এবং কবি এক জাগে (১৯৯৫) কাব্যগ্রন্থগুলিতে প্রায়শই আশাহতের বেদনা জাগে। আমরা বুঝতে পারি কোথাও বিশ্বাসের মধ্যে তৈরি হচ্ছে সন্দেহ ও অবিশ্বাস। যে মার্ক্সবাদী ধারণায় তাঁর বেড়ে ওঠা, যে চেতনায় তৈরি হয়েছে তাঁর জীবনবোধ ও কাব্যভাবনা, সব যেন প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়েছে। আচ্ছন্ন কবির মন দোলাচলে, সংশয়ে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি থেকে সমাজতন্ত্রী সরকারের উচ্ছেদ, দুনিয়াজোড়া অবাধ বাজারনীতি যে কবিকে বিষণ্ণ করেছে, তা এই পর্যায়ের কবিতায় প্রতিফলিত। এই পর্বের কবিতায় আমরা দেখতে পাই অন্য এক তরুণ সান্যালকে, যিনি নিজেকে বদলেছেন। আর এই বদল লক্ষ করি তাঁর ভাষায়, প্রকাশভঙ্গিতে, ছন্দে।
পঞ্চাশের কবি তরুণ সান্যালের কাব্যভাষা তাঁর বৈদগ্ধের নিরন্তর চর্চার ফসল– এ ভাষা পঞ্চাশের অন্য কবিদের থেকে শত যোজন দূরে। সব মিলিয়ে, তিনি তাঁর সময়ের মধ্যেই এক স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর।
শ্রেণি ও সমাজের প্রতি তাঁর যে দায়বদ্ধতা, তা শুধু কাব্যজীবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, যে কোনও সামাজিক ও রাজনৈতিক বিচ্যুতি তাঁকে উদ্বেল করেছে, আর আমরা পেয়েছি এক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে, যিনি নির্দ্বিধায় জনতার মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছেন তাঁর ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ভূমি থেকেই। এই দিক থেকে সম্প্রতি তাঁর প্রয়াণ আমাদের নিঃস্ব করে গেল।
যথার্থ স্মরণ…. চমৎকার…
খুব জরুরী লেখা