তুহিন দেব
সমাজকর্মী, ছত্তিশগড়
সম্প্রতি, ভারত গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে ৫৫তম স্থান থেকে ১০১তম স্থানে নেমে এসেছে। আফগানিস্তান এবং ইয়েমেন— এশিয়ার দুটি মাত্র দেশ সূচকে ভারতের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। অন্য সব প্রতিবেশী দেশের অবস্থান অন্তত ভারতের চেয়ে ভালো। আরএসএস-এর আদর্শে পরিচালিত কেন্দ্রের অতি-দক্ষিণপন্থী বিজেপি সরকারের সারা বিশ্বে নিজের দেশের এই লজ্জাকর স্থানে নেমে আসার খবরে স্বাভাবিকভাবেই গায়ে জ্বালা ধরেছে। সারা পৃথিবীতে এই সরকার নানারকম দুনম্বরি পদ্ধতিতে নিজের নির্লজ্জ ঢাকঢোল পেটানোয় সবার আগে যায়। কিন্তু ক্ষুধার ওপর সারা বিশ্বে মান্য এই সূচক প্রকাশে সরকার বাহাদুর নিতান্তই ক্ষুব্ধ এবং গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সের প্রক্রিয়াটিকেই তারা ভুল বলে হাস্যকর অভিযোগ করছে। ২০১৭ সালের গ্লোবাল হাঙ্গার রিপোর্টে বলা হয়েছিল যে ভারতে ক্ষুধা একটি গুরুতর সমস্যা এবং সরকারকে সামাজিক ক্ষেত্রে এই সমস্যার মোকাবিলায় দৃঢ় এবং দায়িত্বপূর্ণ অবস্থান নিতে হবে। ভারতের সরকার ক্রমাগত শক্তিশালী অর্থনীতির ঢাক পেটালেও, আসলে বিপুল সংখ্যক মানুষ প্রতি রাতে খালি পেটে ঘুমাতে বাধ্য হচ্ছে। এই নির্লজ্জ কর্পোরেট তোষণকারী ফ্যাসিবাদী সরকারের হাতে পড়ে গত সাত বছরে দেশের মানুষের অবস্থা ক্রমাগত খারাপ থেকে খারাপতর হয়ে চলেছে। আমরা এই নিবন্ধে দেখতে চাইব যে ছত্তিশগড়ের মতো একটি ছোট আদিবাসী অধ্যুষিত রাজ্য কীভাবে বিজেপি সরকারের জনবিরোধী নীতির কারণে অপুষ্টি ও ক্ষুধার জালে নিরন্তর জড়িয়ে পড়েছে।
পটভূমি
১৯৯২ সালে, ছত্তিশগড়ের অম্বিকাপুরের বিজাকুড়া গ্রামের আদিবাসী সম্প্রদায়ের জাকলি বাই অনাহারে মারা যান। তাঁর ছেলেও অনাহারে মারা গিয়েছিল। দুজনের এই মৃত্যুর খবর মানুষকে হতবাক করে দিয়েছিল। অনেক হইচই হয়েছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওকে এখানে আসতে হয়েছিল। এবং এই ঘটনার পর-পরই জাতীয় খাদ্যনীতি প্রণীত হয়। যদিও আলাদা করে বলার কিছু নেই যে ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধামুক্ত জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা থেকে দেশ অনেক অনেক পিছিয়ে।
আবার ২০১৫ সালে, বিজেপির শাসনকালে উত্তর ছত্তিশগড়ের আদিবাসী অধ্যুষিত সুরগুজা জেলায় একটি আদিবাসী শিশু অনাহারে মারা গিয়েছিল। প্রগতিশীল গণসংগঠনগুলির অভিযোগ ছিল যে রমন সিং সরকারের প্রশাসন এই হতভাগ্য পরিবারটির রেশন কার্ড বাতিল করে দিয়েছিল। কয়েক মাস ধরে ওই গ্রামে জাতীয় কর্মসংস্থান গ্যারান্টি প্রকল্পের কাজ বন্ধ ছিল। হতভাগ্য পরিবারটি টানা ৩-৪ দিন ধরে এক দানা খাবারও জোগাড় করতে পারেনি। এই ঘটনায় অভিযোগ জানানো হয়েছিল জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও রাজ্য মানবাধিকার কমিশনে। অনাহারে মৃত্যুর এই অবস্থা তখনই হয়েছিল যখন ছত্তিশগড় ভারতের প্রথম রাজ্য হিসেবে খাদ্য নিরাপত্তা আইনটি কার্যকর করে। এর আগে, ছত্তিশগড়ের পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম (পিডিএস) সারা দেশে প্রশংসিত হয়েছিল, কিন্তু নরেন্দ্র মোদি সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর থেকে সারা দেশে পিডিএস ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এবং প্রসঙ্গত, যদি আম্বানি-আদানির নির্দেশে কৃষির কর্পোরেটায়নের উদ্দেশ্যে আনা তিনটি কৃষি আইন কার্যকর করা হয়, তবে পিডিএসের পাশাপাশি স্কুলগুলিতে মিড-ডে মিল স্কিমও বন্ধ হয়ে যাবে এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তাও শেষ হয়ে যাবে। আমরা এও জানি, বিজেপি সরকার ছত্তিশগড় সহ সারা দেশে NREGA-র অধীনে প্রাপ্য পরিমাণে কী ব্যাপকভাবে হ্রাস করেছে।
ছত্তিশগড়: এক নজরে
- জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা (NFHS-4) অনুসারে ছত্তিশগড়ের—
- মোট উপজাতি জনসংখ্যা— ৫৯.০৯ শতাংশ
- মোট চিহ্নিত অপুষ্ট শিশু— ৪.৩ লক্ষ (জানুয়ারি ২০১৯)
- ৩৭.৭ শতাংশ শিশু অপুষ্টির শিকার
- ৪৭ শতাংশ মহিলা (১৫-৪৯ বছর বয়সী) রক্তাল্পতার শিকার
- ৪৩টিরও বেশি উপজাতীয় সম্প্রদায়
- ৫টি আদিম উপজাতি গোষ্ঠী (PTGs)
- স্বাভাবিক বডি মাস ইনডেক্স (BMI)-এর নিচে নারী (শহরে ১৭.৬ শতাংশ, গ্রামে ২৯.৬ শতাংশ)
- স্বাভাবিক বডি মাস ইনডেক্স (BMI)-এর নিচে পুরুষ (শহরে ২১ শতাংশ, গ্রামে ২৫.২ শতাংশ)
বিজেপি, যে দলটি ছত্তিশগড়ে টানা ১৫ বছর ধরে জনগণকে পদদলিত করেছিল, ২০১৮ সালের নভেম্বরে বিধানসভা নির্বাচনে জনগণ তাকে উপড়ে ফেলে এবং কংগ্রেসের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। প্রবল আদিবাসী-বিরোধী বিজেপি-র পরিবর্তে সঠিক বিকল্পের অভাবে কংগ্রেসকে বেছে নিয়ে জনগণ তাদের প্রত্যাশা স্পষ্ট করেছিল। কংগ্রেস যদিও শুরুতে কিছুদিন প্রগতিশীল মনোভাব দেখিয়েছিল, কিন্তু তার পরেই তারা বিজেপির উগ্র হিন্দুত্বকে নরম হিন্দুত্ব নীতি দিয়ে প্রতিস্থাপিত করেছে এবং বিজেপির মতোই আদানি, এসার, জিন্দাল-এর মতো কর্পোরেটদের স্বার্থে নিযুক্ত রয়েছে (হাসদেও পারসার কয়লা ব্লকের জন্য আদানিকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে)।
২ অক্টোবর, ২০১৯-এ, গান্ধি জয়ন্তী উপলক্ষে, ছত্তিশগড় সরকার অপুষ্টি থেকে মুক্তির লক্ষ্যে মুখ্যমন্ত্রী সুপোষণ অভিযান নামে একটি প্রচার শুরু করেছে। সরকারের তথ্য অনুসারে, ৪ লাখ অপুষ্ট শিশুর মধ্যে এখন মাত্র ৩ লাখ শিশু অপুষ্টির শিকার। ছত্তিশগড়ের মহিলা ও শিশু উন্নয়ন দপ্তর ‘কুপোষণ ছোড় পোষণ কি ঔর, থামে ক্ষেত্রীয় ভোজন কি ডোর’ স্লোগানটির বাস্তবায়নের চেষ্টায় আছে। অপুষ্টি থেকে পরিত্রাণের কিছু পরিকল্পনা থাকলেও বাস্তবে পরিস্থিতির বড় কোনও উন্নতি নেই। বছর দুই আগে, কংগ্রেস সরকার স্কুলের শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে মধ্যাহ্নভোজে ডিম দেওয়ার পরিকল্পনা শুরু করে, তখন এটিকে মাংসাহার বলে, জৈন সমাজ এবং কবিরপন্থীরা বিজেপির সঙ্গে মিলে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করার হুঁশিয়ারি দেয় (মজার ব্যাপার যে বেদবিরোধী মহাবীর স্বামী এবং বস্তুবাদী কবিরের শিক্ষা ভুলে উচ্চবর্ণ সমাজের ধর্মীয় নেতারা তাঁদেরই নাম ব্যবহার করে মনুবাদী হিন্দুত্বকে অনুসরণ করে চলেছে)। কংগ্রেস সরকার যখন এই ইস্যুতে নৈমিত্তিক মনোভাব গ্রহণ করেছিল, তখন প্রগতিশীল শক্তিগুলির দ্বারা প্রবলভাবে সমালোচিত হয়েছিল। কিন্তু সরকারের দিক থেকে অবস্থা কিছুই বদলায়নি, বলাই বাহুল্য।
বস্তারের কথা
বস্তার সম্পর্কে সবাই জানেন যে এর ৭টি জেলা— দান্তেওয়াড়া, বিজাপুর, নারায়ণপুর, বস্তার, কাঙ্কের, সুকমা এবং কোন্ডাগাঁও চরমপন্থী বামপন্থায় প্রভাবিত এলাকা। কিন্তু যেটা সবাই জানেন না সেটা হল ছত্তিশগড় বা বস্তরের মানুষ আসলে “আমীর ধরতি কে গরীব লোগ”। বস্তার হল লোহা, টিন, তামা, ডলোমাইট, হীরা, কয়লা প্রভৃতি খনিজ সম্পদ এবং নদী সহ গভীর বনভূমি সমৃদ্ধ একটি এলাকা। বস্তার নিয়ে একটা কথা প্রচলিত আছে— সেখানে সরকারি কর্মচারীদের বদলি হলে তারা কাঁদতে কাঁদতে গেলেও ফিরে আসে হাসতে হাসতে। তার মানে এখানে পুলিশ, বন বিভাগের কর্মকর্তা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, কর্পোরেট কোম্পানি, শাসকশ্রেণির বিভিন্ন দল-উপদল, আদিবাসীদের ও প্রাকৃতিক সম্পদ লুটের ক্রমান্বয়ে অংশীদার থেকে গেছে।
বস্তারে আধাসামরিক বাহিনির হাতে ঘটা আদিবাসীদের গণহত্যার জন্য কুখ্যাত তাড়মেটলা ঘটনার তদন্ত করার জন্য সুপ্রিম কোর্ট দ্বারা নিযুক্ত বস্তারের প্রাক্তন কালেক্টর এবং জনমত বুদ্ধিজীবী হর্ষ মন্দর আদিবাসীদের অনাহারে মৃত্যুর বিষয়টি সবার নজরে এনেছিলেন। সেই তদন্তে উঠে এসেছিল, নিরাপত্তা বাহিনির আদিবাসী গ্রামে আক্রমণ ও অগ্নিসংযোগের পরে মোরপল্লী গ্রামে অবরুদ্ধ থাকার সময় আদিবাসীরা বেশ কিছু দিন খাবার পেতে পারেনি, যার ফলে তাদের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু হয়েছিল। এমনিতে, ২০০৫ সালে বিজেপি সরকার কংগ্রেস নেতা মহেন্দ্র কর্মার সঙ্গে মিলে আদিবাসীদের নিজেদের মধ্যে লড়াই বাধানো এবং প্রাকৃতিক সম্পদের কর্পোরেট লুটের কু-উদ্দেশ্যটিকে সামনে রেখে সালওয়া জুডুম নামের জঘন্য খেলাটি শুরু করেছিল। সালওয়া জুডুম এবং অপারেশন গ্রিন হান্টে তৎকালীন কংগ্রেসের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিদাম্বরমের পূর্ণ আশীর্বাদ ছিল। এই পুরো সহিংস কর্মসূচির কারণে, লাখ লাখ আদিবাসী মানুষকে জবরদস্তি ইচ্ছেদ করা হয়েছে। এর মধ্যে অনেককেই প্রতিবেশী রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশে আশ্রয় নিতে হয়েছিল এবং হাজার হাজার লোককে বিজেপি সরকারের দয়ায় সালওয়া জুড়ুম ক্যাম্পে থাকতে হয়েছিল। নিরাপত্তা বাহিনি এবং তথাকথিত মাওবাদীদের মধ্যে সংঘর্ষে বহু নিরীহ আদিবাসী নিহত হয়েছে, হাজার হাজার মানুষকে জেলে পচতে হয়েছে।
একই সঙ্গে ব্যাপক হারে নারী ও শিশুসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে অপুষ্টি ও ক্ষুধার সমস্যা বাড়তেই থেকেছে। বস্তারে মূল আদিবাসীরা মাড়িয়া, মুড়িয়া, গোন্ড, আবুজমাড়িয়া, ধুরভা, দান্ডামি মাড়িয়া, দোর্লা উপজাতির অন্তর্গত। তাদের মধ্যে বস্তারে, শিশুদের মধ্যে অপুষ্টিজনিত রোগের হার ৩৩.৯ শতাংশ। আদিবাসী মায়েরা কম ওজনের শিশুর জন্ম দেয়। বস্তারে ৫ বছরের কম বয়সি শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি ৩৯.৬ শতাংশ। একই বয়সের ৩৯.২ শতাংশ শিশুর ওজন কম। ৫ বছরের কম বয়সি শিশুদের অর্ধেক মৃত্যুর কারণ অপুষ্টি। যাকে আমরা অনাহারে মৃত্যু বলতে পারি।
দান্তেওয়াড়ার কাহিনি
পূর্বের দক্ষিণ বস্তার দান্তেওয়াড়া জেলা এখন বিজাপুর, সুকমা এবং দান্তেওয়াড়া এই তিন জেলায় বিভক্ত হয়েছে। দান্তেওয়াড়ার মোট জনসংখ্যা হল ২৮৩৪৭৯, যার মধ্যে ৪৮৫৭৪টি পরিবার রয়েছে। এর মধ্যে ৫৭ শতাংশ দারিদ্রসীমার নীচে (BPL)। বস্তারে অপুষ্টির হার প্রায় ৩০ শতাংশ। মানব উন্নয়ন সূচকের কোনওরকম উন্নতি না করে শুধুমাত্র অবকাঠামো তৈরি করাই সরকারি প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। বস্তারে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি ইত্যাদির মতো কল্যাণমূলক প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের বিতৃষ্ণা (সেটি যে কোনও দলের সরকারই হোক না কেন) অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে দৃশ্যমান। যেসব স্কুলেই পাকা ঘর আছে সেখানে অবধারিত নিরাপত্তা বাহিনির ক্যাম্প রয়েছে। হিংসা, নিপীড়নের কারণে অভ্যন্তরীণ এলাকায় স্কুল, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলি ঠিকমতো চলছে না। সম্প্রতি, বিজাপুরের সিলগারে আধাসামরিক বাহিনির ক্যাম্প খোলা এবং বস্তারে সামরিকীকরণের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করা আদিবাসী যুবকদের পুলিশ নির্মমভাবে দমন করেছে। মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেলও বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংয়ের মতোই একই পন্থায় গোটা বস্তারে পুলিশি শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চান। সে কারণেই আদিবাসী সমাজের বিরোধিতা সত্ত্বেও একের পর এক নতুন আধাসামরিক বাহিনি ক্যাম্প স্থাপন করেই চলেছে। এই আবহে ক্ষুধার মতো গুরুতর প্রশ্নগুলি স্বাভাবিকভাবেই পিছনের সারিতে চলে যাচ্ছে। একই সঙ্গে সরকার ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি পরিত্যাগ করে আরএসএসের লাইন অনুসরণ করে রাম বনগমন যাত্রা ও অন্যান্য ধর্মীয় পর্যটনের প্রচার করছে। যার বিরোধিতা করছে আদিবাসী সমাজ। কারণ এর ফলে চাপা পড়ে যাচ্ছে মানুষের প্রকৃত সমস্যার দিকগুলি।
একটি সরকারি প্রকল্পের দিকে চোখ রাখা যাক। পাইলট প্রকল্প হিসাবে দান্তেওয়াড়া জেলায় অপুষ্টি দূরীকরণের জন্য, কংগ্রেস সরকার জেলা খনিজ তহবিলের (DMF) সহায়তায় মুখ্যমন্ত্রীর সুপোষণ অভিযান চালাচ্ছে। এই কর্মসূচির অধীনে রান্না করা খাবারের ৩০০টি আহার কেন্দ্র খোলা হয়েছে যাতে ৫ বছর বয়সি ছোট শিশু, গর্ভবতী মহিলা এবং অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলির সঙ্গে সংযুক্ত মেয়েদের পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করা যেতে পারে। কেন্দ্রগুলি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে (SHG)। খুব ভালো কথা। কিন্তু এই মহান প্রকল্পের জন্য স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কী বরাদ্দ থাকে? জনপ্রতি মাত্র ৩ টাকা ৫০ পয়সা! দান্তেওয়াড়া জেলা প্রশাসন অবশ্য এই প্রকল্পের সাফল্য সম্পর্কে অনেক প্রচার করে।
ছত্তিশগড়ে দশম শ্রেণির সামাজিক বিজ্ঞানের নতুন সিলেবাসে ‘খাদ্য সুরক্ষা’ বিষয়ক একটি অধ্যায় রয়েছে। কিন্তু এই একই ছত্তিশগড়ে ২৯ জুন, ২০২০, করোনার প্রথম তরঙ্গের সময়, ধমতারির হরদেব সিং নামে এক ব্যক্তি রায়পুরে মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেলের বাড়ির সামনে আত্মহনন করেন, যিনি বহুদিন ধরে ক্ষুধার্ত ছিলেন। বাস্তব হল সরকার পরিবর্তন করলেও শোষক ব্যবস্থার কোনও পরিবর্তন হয় না। আমলাতন্ত্রের গরিব বিরোধী, দলিত-আদিবাসী বিরোধী মনোভাব বদলায় না। পৃথিবীর আদিবাসী জনসংখ্যার অর্ধেকের বাসভূমি হল ভারতবর্ষ। আদিবাসী জনসংখ্যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৯ শতাংশ কিন্তু তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে ৫৫ শতাংশ আদিবাসী জনসংখ্যা আজ বাস্তুচ্যুতির শিকার। বাস্তুচ্যুত মানুষের জীবনে অপুষ্টি একটি অতি স্বাভাবিক প্রপঞ্চ। অপুষ্টি একটি নীরব সঙ্কট (Silent emergency) যা সমাজকে ক্রমশ অনাহারের মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। দারিদ্র্য-অপুষ্টি-রোগ, তারপর আবার দারিদ্র— এই ভিশাস সার্কেল ক্রমশ প্রতিটি দরিদ্র, উপজাতি, দলিত, সংখ্যালঘু ও মেহনতি দেশবাসীর নিয়তি হয়ে উঠেছে।
আপনি যদি বস্তারকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখেন তবে আপনি দেখতে পাবেন যে তথাকথিত মাওবাদ বা বামপন্থী চরমপন্থা নির্মূলে সরকার যতটা জোর দেয়, দারিদ্র্য, অপুষ্টি এবং ক্ষুধা থেকে মুক্তির ওপর জোর দেওয়া হয় না।
যদিও বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেল ঘোষণা করেছেন যে নকশালবাদের চেয়ে অপুষ্টি একটি বড় সমস্যা, কিন্তু আজও বস্তারে, গর্ভাবস্থায় মা ও শিশুর ভালো যত্ন, উভয়েরই সঠিক টিকাদান, আইসিডিএস প্রকল্পের অধীনে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলির সম্প্রসারণ ও তাদের শক্তিশালী করে তোলা এবং ঘরে ঘরে পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য থেকে সরকার এখনও অনেকটাই দূরে। আদিবাসী এলাকার খারাপ আর্থ-সামাজিক অবস্থা আজও বদলায়নি।
যে কোনও জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব হল জনগণকে দারিদ্র, ক্ষুধা, বেকারত্ব থেকে মুক্ত করা এবং বিনামূল্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিশুদ্ধ পানীয় জল ও পুষ্টি সরবরাহ করা। এর জন্য এই রাজ্য সরকারকে অবিলম্বে পূর্ববর্তী বিজেপি সরকারের তুমুল আদিবাসী বিরোধী নীতি এবং কর্পোরেট হাউসদের স্বার্থে ক্রমাগত সামরিকীকরণ বন্ধ করতে হবে। বস্তারে শান্তি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিপ্লবী ভূমিসংস্কারের মাধ্যমে প্রতিটি আদিবাসী পরিবারকে এক টুকরো জমি দিতে হবে। বছরে ৩৬৫ দিন কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে, NREGA-এর মতো প্রকল্পগুলি আরও জোরালোভাবে বাস্তবায়িত করতে হবে। শুধু দান্তেওয়াড়া নয়, বস্তার অঞ্চলের সাতটি জেলাতেও অপুষ্টির বিরুদ্ধে অবিচ্ছিন্ন প্রচার চালাতে হবে। স্কুল ও অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র থেকে নিরাপত্তা বাহিনির ক্যাম্প সরিয়ে দিতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কর্মসূচিকে সামনে রাখতে হবে। আদিবাসীদের জন্য নিঃশর্ত ঋণমুক্তি ঘোষণা করতে হবে। PDS কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। কোনও নাগরিককে রেশন কার্ড ও খাদ্যশস্য প্রকল্প থেকে বঞ্চিত করা চলবে না। যদি প্রত্যন্ত আদিবাসী অঞ্চলেও অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলির যথাযথ সম্প্রসারণ এবং সহায়ক খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করা যায়, মা ও শিশুদের স্বাস্থ্য, পরিচ্ছন্নতা ও পুষ্টির জন্য কর্মসূচিগুলি যুদ্ধের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়, তবেই এই পরিস্থিতিতে একটি বড় পরিবর্তন ঘটতে পারে। আদিবাসী লোকনৃত্য মহোৎসব চালু করে বা নাম কে ওয়াস্তে কোনও জেলায় হঠাৎ কোনও প্রকল্প হঠাৎ চালু করে কোনও কাজের কাজ হবে না। ১৯৪২-৪৫ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল যেভাবে মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষের মাধ্যমে লাখ লাখ বাংলার মানুষকে হত্যা করেছিলেন, একইভাবে কর্পোরেট হাউসের দালাল বিজেপি-র মোদি সরকার ভারতের মানুষকে আবারও সেই অন্ধকার নিয়তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই অবস্থায় বস্তারের মতো সংবেদনশীল এলাকায় কর্পোরেট উন্নয়নের মাধ্যমে ধ্বংস নয়, সমাজের ৯০ শতাংশ সাধারণ মানুষের জন্য জনমুখী উন্নয়ন এখন প্রকৃত সময়ের দাবি।