তিনটি কবিতা
শবসাধনা
আনমনা এক দানবশিশুর তুলি যখন চাঁদের ’পরে একপোঁচ কালো রং বুলিয়ে দেয় বেশি কিছু না ভেবেই, তখন নিরালায় শুরু হয় কোনও তান্ত্রিকের গোপন শবসাধনা। কালিঝুলিমাখা রাতে ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া মড়ার পিঠে ঘোড়সওয়ারের দক্ষতায় চেপে বসে যোগী, অথবা নিঃস্পন্দ ওই মৃতদেহ তার ঘাড়ে বেতাল সেজে পা ঝুলিয়ে বসে। আকাশ চিরে অপদেবতার আঁকাবাঁকা হস্তাক্ষরের মত বিদ্যুৎ ঝলসে উঠলে মন্ত্রমগ্ন সাধকের দুই চোখের তারায় প্রতিফলিত হয় বিভীষিকা— ফণিনীর চকিত চুম্বনের ভয়, মস্তিষ্কবিহীন কাটাকবন্ধের বাহুবলের আতঙ্ক, বিধবার সিঁথির মত একেবারে ফাঁকা সাদার ত্রাস! গুহ্য সাধনের প্রতি পদে পদে কাঁটা; স্ত্রীর বেশে এসে হাঁকিনী-ডাকিনীর পায়ে ধরে সাধা, কুমারী ষোড়শীর সহস্রদল পদ্মহাতে কোমল ইশারা। শেষ প্রহরে একটু যেন নড়ে ওঠে শব, মৃদু করে বলে— খাদ্য দে, পানীয় দে। পূজারী তখন পৌষের ধানের শিষের মত নধর দুটো উপমা গুঁজে দেয় তার মুখে, আঁজলা ভরে পান করায় পরিশ্রমের সদ্যক্ষরিত স্বেদ, সামাজিকতার বর্শাবিদ্ধ বক্ষ থেকে চুইয়ে পরা দুএক ফোঁটা লাল রংও মিশে থাকে তাতে। সামনে-পাশে সারি সারি নৃমুণ্ডের হিংস্র চাহনি, পুকুরের পচা পাঁকের মত ধ্বংসের তীব্র কটু গন্ধ, তেজস্ক্রিয় আকাশ যেন ধূসর চিল সমেত ভেঙে পড়তে চায় মাথার ওপর, খলখল হেসে আড়াল থেকে পিশাচী উন্মাদিনী খোনা সুরে বলে— হাল ছেড়ে দে, পারবি না, তুই কিছুতেই পারবি না; তবু বামাচারী অটল আপন প্রকৃতিবিশ্বাসে, আজ সে পিশাচসিদ্ধ হবেই, শক্ত মুঠোয় গর্ত থেকে তুলবে টেনে নিদ্রিত শাঁখামুটি, সরু খাত কেটে দেবলোক থেকে গঙ্গা নামাবে শঙ্খ বাজিয়ে, যাই হোক তাই হোক, আজ সে মৃত পৃষ্ঠার দেহে প্রাণ জাগাবেই শব্দের কিছু শুকিয়ে যাওয়া জবাফুল উপচারে।
২৫শে ডিসেম্বর
তারপর অতলান্তিক দুপুর তলিয়ে যায় আলটপকা তরুণী বৌটার হাত থেকে পড়ে। এতক্ষণ ধরে হাপিত্যেশ করা বাঁকা সারস টুপ করে সেটা গিলে ফেলেই ফের চোখ বোজে আয়েশে। পুকুর পাড়ে আরাম করে আগুন পোহায় পোড়ামাটির প্যাঁচা। পাশেই মাতা মেরির ফাঁকা থানে ধূপের ছাই সরিয়ে কাপড়ের পুতুল সাজায় অশীতিপর পোঁটলাবুড়ি। এমানুয়েল টুডুর কাঁচা কবর থেকে দিনের শেষ ওমটুকু শুষে নিয়ে ঘরের পানে ছুট লাগায় সাদার ওপর কালো ছোপছোপ, ধর্ম নামের কুকুরছানা। তার মাথার ওপর দিয়ে রঙিন সুতো ছড়িয়ে উড়ে যায় একচোখো প্রজাপতি। বেওয়ারিশ যত বাচ্চারা কুড়িয়ে পাওয়া ময়াল সাপের খোলস নিয়ে টানাটানি খেলা করে অযথাই। আধবুড়ো জোয়ানরা জুয়া খেলার আসর জমায় যিশুকে বাজি রেখে। বাদরটুপি পরা একটা পাগল কালিঝুলিমাখা আকাশের ছবিটা নীচে নামিয়ে এনে ঝাড়পোঁছ করে একমনে। ঝুনো বেদনারা বাগানের ডালে ডালে বাধ্য মেয়ের মত ঝুলে থাকে মাথা নিচু করে। এইসব মাদারির খেল দেখে বোতলের পায়রা, শিশির শালিক ফের বস্তায় পুরে খুশিখুশি মুখে পথ চলে এক ভিনদেশি ফিরিওলা।
মনমরা গির্জার মাঠে তখন রানি আঁতোয়ানেতের মত নিচু বিকেল সবে পার হচ্ছে।
ভগ্নবেদি
কোনও বন্ধ্যা পাহাড়ের গর্ভে আচমকা প্রস্তর ঈশ্বরের জন্ম হয়। খনিজগন্ধময় শীতল গুহায় অকালমৃত শ্রমণের মুখের ছাপ মিশে থাকে। এলোমেলো শুয়ে থাকা গৌণ দেবতার অর্ধভুক্ত শবের ওপর রুগ্ণ শ্যাওলা জাগে, জাগে অনিন্দ্যসুন্দর ঘাতকের ফুল। পাললিক স্তরে প্রাচীন পোকার মত মৃত্যু জমাট বাঁধলে প্রায়ান্ধ গন্ধগোকুল তা চেটে চেটে খায়, তার শূন্য উদরে মোমবাতির আলোয় মাকড়সার ছায়ার মাপের একদলা কোঁচকানো অন্ধকার ঢুকে পড়ে। বিশ হাতের চৈত্য জুড়ে তিরবিদ্ধ রাজহংসের মত অবিরাম দাপাদাপি করে পৃথুলা অপ্সরা, জোনাকির আলো, স্বর্গভ্রষ্ট এক দেবদূত, গোটাকতক চামচিকে, আর বিষণ্ণ বামনের দল। তথাগতের মূর্তির পায়ের কাছে হত্যা দিয়ে পড়ে থাকে ধূলিময় শিকারি বেড়াল, তার অধিকার পেতে মিথুনবদ্ধ হয়ে আমৃত্যু লড়ে যায় উদ্ধত দুই দুধগোখরো; দেবদত্ত ও সুজাতা। গৌতম স্মিত হাসেন, বাম হাত তুলে বরাভয় দেখান বারবার। তবু সদ্যমৃতের হাসির মত ফ্যাকাশে চাঁদের আলোয় আবছা রাষ্ট্রকূট বিবরে রক্তের দাগ ক্রমশ জমা হতে থাকে। আর হাজার মাইল দূরে শূন্যসিঁথি এক বাঙালি মহিলা তখনই— ঠিক তক্ষুনি ভোররাতের ঘুম ভেঙে আচমকা খাটে উঠে বসে।
Very nice