অয়নেশ দাস
গোড়ার কথা
সেদিন বড়াদেও পদ্মপাতায় বসেছিলেন আর তাঁর মাথায় এল সৃষ্টির ভাবনা। তিনি চেয়ে দেখলেন তাঁর আদিগন্ত শুধু ধু-ধু জল। বড়াদেও নিজের গায়ের ময়লা থেকে সৃষ্টি করে ফেললেন একটি কাক। বাকি সৃষ্টি হবে যে কাদামাটি দিয়ে, কাক উড়ে চলল সেই কাদামাটির খোঁজে। ধু-ধু জল পেরিয়ে অনন্ত উড়ে ক্লান্ত কাক জলের মধ্যে উজানো একটি খুঁটি দেখতে পেয়ে তার ওপরে বসল। সেটি আসলে ছিল কাঁকড়ার দাঁড়া। কাঁকড়ার থেকে কাক পেল কাদামাটির খবর। পাতালের এক দৈত্যাকার কেঁচো খেয়ে ফেলেছিল জগতের সমস্ত কাদামাটি। কাকের জোরাজুরিতে কেঁচো থু-থু করে ছিটিয়ে দিল পেটের মধ্যেকার কাদামাটি আর কাক সেইসব কুড়িয়ে নিয়ে ফিরে চলল বড়াদেওর কাছে। সেই কাদামাটি দিয়ে শুরু হল বড়াদেও-র হাতের কাজ। ধু-ধু জলরাশির মধ্যে জেগে উঠল মাটি, জমে উঠল শিলা। ক্রমে সৃষ্টি হল বৃক্ষ-অরণ্য-প্রাণ। সে বড় কম দিনের কথা নয়।
মধ্য ভারতের গোন্ড উপকথার সেইসব আদি সৃষ্টি— সে অ-নে-ক পুরানো দিনের কথা। প্রাচীন মেসোআর্কিয়ান যুগ[1] থেকে প্যালিওপ্রোটেরোজ়়োয়িক যুগ[2] জুড়ে কি জমছিল বড়াদেওর সেইসব কাদামাটি? যখন ধু-ধু জলরাশির মধ্যে জেগে উঠছিল এক একটি মহাদেশ! আর সেইসব মহাদেশের কাদামাটির হাড়-পাঁজরের থাকে থাকে বড়াদেওর আপন সৃষ্টি-খেয়ালেই যেন শুরু হয়েছিল অপার মায়ার খেলা। থাকে-থাকে সে খেলায় জমছিল সভ্যতার রসদ— সভ্যতার আকর। অ-নে-ক পরে— সে প্রায় কয়েকশো কোটি বছর পরে মানুষ নামে এক প্রজাতি খুঁজে নেবে সেইসব রসদ— সেই সব আকর। মহাকাল খুঁজে নেবে তার সময়-সারণী— প্রস্তর-ব্রোঞ্জ-তাম্র-লৌহ যুগ। গড়ে উঠবে সভ্যতা। মহাদেশের তল থেকে মানুষ খুঁজে আনবে সভ্যতার যাবতীয় মহার্ঘ্য সব আকর— ব্রোঞ্জ, তামা, লোহা…।
এর মধ্যে কোনটিকে মানুষ বেছে নেবে সভ্যতার শ্রেষ্ঠতম রসদ হিসেবে? সে এক রহস্য। মানুষ যখন পাথরের ব্যবহার শিখেছিল তখনই পৃথিবীর শিলারাশি প্রাচীন হয়ে এসেছে। এ সেই সময়ের কথা যখন পৃথিবী ছিল নবীন। বড়াদেওর মায়ার খেলায় আকার পাচ্ছিল পৃথিবীর মহাদেশীয় কাঠিন্য। আকার পাচ্ছিল যত প্রাচীন স্থিতিশীল ভূত্বক (যা ভূতত্ত্বের বইতে ক্রেটার নামে পরিচিত)। যেখানে উপকথার আদিমতম কাদামাটি শিলাস্তরে জমে ম্যান্টল অবধি বিস্তৃত হল। তারপর সেইসব প্রাচীন ভূত্বকের নীচে প্রবল চাপ ও উত্তাপের যৌথ লীলায় এক্লোজাইট ও পেরিডোটাইট নামের দুই শিলা থেকে স্ফটিকাকারে আকৃতি পেল কার্বনের বিশুদ্ধতম রূপ। কেঁচোর পেটের কাদামাটি থু-থু করে ছিটিয়ে বেরোনোর মতোই পৃথিবীর কয়েকশো মাইল নীচের গর্ভ— ম্যান্টল থেকে সে সব স্ফটিকখণ্ড বেরিয়ে আসতে চাইল। সে আজকের কথা নয়, পঞ্চাশ মিলিয়ন বছর আগের কথা। এই সব উদ্গীরণের গর্ভ-পথ বেয়ে তৈরি হল এক ধূসর-সবুজ শিলার নল— কিম্বারলাইট পাইপস্। কখনও-কখনও কয়েক লক্ষ শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় ক্ষয়ে উন্মুক্ত হয়ে পড়ল এই সব ধূসর-সবুজ নল। লক্ষ বছরের হিমবাহের চলাচলে, প্রাচীন যত নদীর স্রোতে— নুড়ির ভিড়ে মিশে গেল সেই সব আশ্চর্য স্ফটিকখণ্ড। সেও এক দূর সময়ের কথা। ব্রোঞ্জ, তামা, লোহার কেজো আবিষ্কারের অনেক পরে মানুষ খুঁজে পাবে সে সব স্ফটিকখণ্ড আর প্রথম শতাব্দীর বুড়ো প্লিনির কথা মেনে কেনই বা মানুষের সভ্যতার মুকুটে চিরকালের মতো গেঁথে যাবে সেই সব স্বচ্ছ স্ফটিকখণ্ড— পৃথিবীর সবচেয়ে অমূল্য পদার্থ— হীরা!
একটি বুন্দেলখণ্ডী সংবাদ
দেশের আবারও একটি অরণ্যখণ্ড শিরোনামে। দেশজোড়া হইচইয়ের সূত্রে মধ্যপ্রদেশের ছত্তরপুর জেলার বক্সাওয়া অরণ্যের সেই টুকরোটির কথা আমাদের কিছুটা কানে এসেছে, যে টুকরোটি আসলে বক্সাওয়া তহশিলের সাগোরিয়া গ্রামটিকে ঘিরে থাকা ৩৬৪ হেক্টর অরণ্যভূমি, বছর পনেরো আগেই যার শিকড়ের নীচে ছড়িয়ে থাকা কিম্বারলাইটের মধ্যে জমে থাকা হীরকখণ্ডের সন্ধান পেয়েছিল রিও টিন্টো এক্সপ্লোরেশন ইন্ডিয়া। জঙ্গল জুড়ে বানরের আধিক্যে— যেন খানিক মজা পেয়েই অস্ট্রেলীয় প্রসপেক্টিং কোম্পানিটি টুকরোটির নামকরণ করেছিল— বান্দর ডায়মন্ড ব্লক।
যখন জমছিল বড়াদেওর কাদামাটি, ধু-ধু জলরাশির মধ্যে জেগে উঠছিল এক-একখানি মহাদেশ, তখনই তো তৈরি হয়েছিল মধ্যভারতের এই মহাদেশীয় ভূ-ভাগটিও, আজকের বুন্দেলখণ্ড ও তার প্রাচীন স্থিতিশীল ভূত্বক— বুন্দেলখণ্ড ক্রেটার। মায়ার খেলায় তার গর্ভে জমে ছিল কিম্বারলাইটস উইথ ডায়মন্ডস। হাজার বছরে সভ্যতা তার এতদিন খোঁজ পায়নি; তাই শিলাস্তরে শিকড় ছড়িয়ে সেখানে মাথা তুলতে শুরু করেছিল পর্ণমোচী মহাবৃক্ষের দল। সৃষ্টি হয়ে চলেছিল সেই সব আদিমতম অরণ্য। আর টিঁকে থাকার যুগপৎ প্রবল শক্তি এবং স্পৃহা নিয়ে যার এক টুকরো আজও টিঁকে আছে। এক টুকরো বক্সাওয়া অরণ্য।
সভ্যতা খুঁজে নেয় ঠিক। যেমন এই প্রাচীন ভূত্বক ছেনে রিও টিন্টো জেনে ফেলেছে তার অন্তর্গত ধূসর-সবুজ সেই সব কিম্বারলাইট নলের অবস্থান। এখন অবশ্য তারা নেই, আদিত্য বিড়লা গোষ্ঠীর এসেল মাইনিং আপাতত পঞ্চাশ বছরের লিজে এই আদিম ব্লকের ভূত্বক ও ভূগর্ভের যাবতীয় কিম্বারলাইটের স্বত্বাধিকারী। হীরকসন্ধান তো হয়েই গিয়েছে অনেক দিন, এখন উত্তোলনের অপেক্ষা। কতগুলি অনুমতি পেলেই দুহাজার বাইশের মাঝামাঝি শুরু হয়ে যাবে সে প্রক্রিয়া। প্রাচীন অরণ্য মুছে গিয়ে কাদামাটির তল ছেঁকে উঠে আসবে চৌত্রিশ মিলিয়ন কারাট হীরা।
এদিকে কিছু মানুষ চিপকো নারীদের মতো সেই সব প্রাচীন বৃক্ষদের আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ওরা বাঁচাতে চাইছে বড়াদেওর বেঁচে যাওয়া সৃষ্টি। সেই সব মানুষদের নাছোড় লড়াইয়ে যদি বাঁচে কাদামাটি-অরণ্য-জীববৈচিত্র্য; এই ভেবেই তো শুরু করেছিলাম এই সামান্য লেখাটি। হীরা নামে বস্তুটির প্রসঙ্গ সেখানে ছিল নিছকই গুরুত্বহীন অনুষঙ্গের মতো। কিন্তু ক্রমে তলকাটা স্ফটিক আলোর এক বিচিত্র জাল মরফিনের ধীর ক্রিয়ার মতো আমার চেতনা আচ্ছন্ন করতে থাকে। এক অনির্বচনীয় কুয়াশার মধ্যে আমার ছেলেবেলা উজিয়ে ক্রমাগত দীর্ঘতর মনোলিথের মতো ছায়াময় কিছু আত্মা জেগে উঠতে থাকে। আর তাদের মাথা ছাড়িয়ে, আমি দেখি, কুয়াশার প্রান্তে একটু একটু করে ঝাপসা আলোয় ফুটে উঠছে চাঁদের নামে নাম এক অনিবার্য পর্বতমালা। সেই পাহাড়ের দিকে মুখ করে ছেলেবেলার আল বেয়ে আমিও জড়িয়ে পড়লাম এক দুরারোগ্য প্রত্নসন্ধানে।
সে ছিল আশি, তারপর নব্বই
সে ছিল আশির দশক। সে বেশি দিনের কথা নয়। আমার নিভু-নিভু হলদে রোডলাইটের স্কুল-মাস্টারি মধ্যবিত্ত বাঙালি শৈশব-কৈশোরের চোখের পাতায় নীলচে কুয়াশা জড়িয়ে অপলক জেগে থাকত ‘চাঁদের পাহাড়’। আর সেই শৈশব-কৈশোর ভেজানো প্রতিটি টইটম্বুর স্বপ্নের আত্মায় ভর করে থাকত এক একজন অনিবার্য শঙ্কর এবং বিভূতিভূষণের কল্পনায় ডানা মেলে তামাম বাঙালির অত্যাশ্চর্য হীরকসন্ধান—
কুলিদের ঘরের একটা খুঁটিতে হেলান দিয়ে সে একদৃষ্টে সম্মুখের বিশাল জনহীণ তৃণভূমির আলো-আঁধারমাখা রূপের দিকে চেয়ে-চেয়ে কত কী ভাবছিল। ওই বাওবাব গাছটার ওদিকে অজানা দেশের সীমা কেপটাউন পর্যন্ত বিস্তৃত— মধ্যে পড়বে কত পর্বত, অরণ্য প্রাগৈতিহাসিক যুগের নগর জিম্বারি— বিশাল ও বিভীষিকাময় কালাহারি মরুভূমি, হীরকের দেশ, সোনার খনির দেশ!
–চাঁদের পাহাড়, পৃঃ ২৩।
সে ছিল ছাপোষা বাঙালি জীবনের কল্পনার হীরার খনির দুর্দমনীয় রোম্যান্টিক হাতছানি। তখনও ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক বা ডিসকভারির বদান্যতায় মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো ঘেরা বিস্তীর্ণ গেম পার্ক বাঙালির বোকা বাক্সে সাজিয়েগুছিয়ে এসে বসেনি। ডিজিটাল জটিলতার থেকে তখনও অনেক দূরে, দুই মলাটের মধ্যে এক ‘অন্ধকার’ মহাদেশের খোপে-খোপে তার জন্য সেদিনও অপেক্ষা করে ছিল অদম্য আবিষ্কারের রূপকথারা। তার আত্মায় সেদিনও ভর করে ছিল এক মাসক্যুলিন বীরগাথা কিংবা উজানি রোমাঞ্চের রোম্যান্স— এক নির্বিকল্প শঙ্কর।
তার মন উড়ে যেতে চায়। পৃথিবীর দূর, দূর দেশে— শত দুঃসাহসিক কাজের মাঝখানে। লিভিংস্টোন, স্ট্যানলির মতো, হ্যারি জনস্টন, মার্কো পোলো, রবিনসন ক্রুসোর মতো।
–চাঁদের পাহাড়, পৃ. ১১।
সত্যজিৎ রায়ের আঁকা চাঁদের পাহাড়ের প্রচ্ছদ
দশটা-পাঁচটার ক্লেদাক্ত জীবনে প্রতিস্পর্ধার রূপক হিসেবে হীরার খনির সেই হাতছানি অনেকটা সময় জুড়ে বাঙালি কিশোর-মন শাসন করতে পারলেও সাধারণ বাঙালি জীবনে বাস্তব পণ্য হিসেবে হীরার উপস্থিতি ছিল তো শুধুমাত্র রূপকথার রাজা-রানির মুকুটে, আত্তিলিও গাত্তির জুতোর লুকানো শুকতলায়, রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজের বিষ মেশানো আংটিতে, খুব বেশি হলে কোহিনূর নাম নিয়ে মধ্যযুগের ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু ওই অবধি-ই। সে জীবনের অঙ্গে ‘হীরা চিরকালের’ হয়ে ওঠেনি। সে হাতছানিরও হাফ-গেরস্ত ভূগোলের সীমানা অতিক্রম করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। বরং বছরের চাকা ক্রমাগত ঘুরতে ঘুরতে আলু-পটল-তেল-নুনের ফর্দ জুড়ে, উধাও হয়ে যাওয়া প্রভিডেন্ট ফান্ডের নেই-হিসাবের জালে, বড় জোর পুরনো সোনার মল ও দুগাছা চুরি গলিয়ে নতুন ডিজাইনের বিছেহারের তেলচিটে স্বপ্নে তারা বেল-পাকলে-কাকের-কী হয়ে কয়েক আলোকবর্ষ দূরে লুকানো তারার মতো মিলিয়ে যেত। সে ছিল আশির দশক। সে বেশিদিনের কথাও নয়।
এরপর এল নব্বই। সঙ্গে এল ডব্লিউটিও। দেখতে দেখতে গড়ে উঠল সেক্টর ফাইভ। মুক্ত বাণিজ্যের রিমঝিম ঢেউ ছুঁয়ে ফেলল এমনকি নিভু-নিভু আলোর এঁদো স্কুল-মাস্টারি গলিটাকেও। সিলিকন ভ্যালির মহার্ঘ্য মোহরে চকচকে প্রজন্মের হাতে, পাঁচতারা রেস্তরাঁর এক-একটি আলো-আঁধারি প্রোপোজ়-সন্ধ্যায়, অনামিকা ভরিয়ে উঠে এল ডি বিয়ার্স। সে এক রহস্য! কী করে যেন স্মার্ট প্রজন্মটি শিখে নিয়েছিল অবিকল— ইফ ইউ আর আ ফ্রগ, টার্ন ইয়োরসেলফ ইনটু আ প্রিন্স! ঠিক যেমন করে ১৪৭৭ সালের এক বর্ণময় মধ্যযুগীয় প্রোপোজ়-সন্ধ্যায় অস্ট্রিয়ার আর্কডিউক অব ম্যাক্সিমিলান তাঁর বাগদত্তা মেরি অব বার্গান্ডির অনামিকায় পরিয়ে দিচ্ছিলেন মহার্ঘ্য হীরার আংটি। বাজার ঝকঝক করে উঠল। হীরা ধারণ করা আর হীরার খনি খুঁজে বেড়ানো— এই দুই ব্যাকরণ যে সম্পূর্ণ আলাদা তাও হয়ত এতদিনে কিছুটা বোঝা গেল। রইল পড়ে হলদেটে ছেঁড়াখোঁড়া লুকানো হীরের খনির ম্যাপ। বাতিল কাগজের ভিড়ে মিশে হারিয়ে গেল বাঙালি কিশোরের জরাজীর্ণ স্বপ্নবিলাস। সত্যই সাড়ম্বরে আসিল নব্বই! কিশোর ক্রমে যুবক হল, বাজারে ক্রমশ উচ্চবিত্ত রাজপুত্র-রাজকন্যাদের আনাগোনা বাড়তে লাগল, অবশেষে ‘হীরা চিরকালের’ হয়ে জেঁকে বসল এমনকি আমাদের নয়া-স্মার্ট বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনেও। বেল পাকলে এবার তার আস্বাদনেও মজল কাক। সে এক রহস্য বটে!
আপাতত ছোপ ছোপ কুয়াশা ছাপিয়ে চাঁদের আলোয় ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে আদিম পর্বতশীর্ষ। নীচে তার দুরতিক্রম্য অন্ধকার। এখন বুঝি, সেইসব কৈশোরের পিঠে নিশ্চয়ই দুটো ডানা থাকে। সেই ডানায় ভর করে অন্ধকার এড়িয়ে বারেবারে বুঝি স্পর্শ করা যায় যত পর্বতশীর্ষ। কিন্তু এখন যে তা হওয়ার উপায় নেই! যাবতীয় রহস্য ও অন্ধকার মেখে, প্রায় সারা পৃথিবী ছুঁয়ে, এখন যে আঁকাবাঁকা পথটি খুঁজে চলেছে চাঁদের পাহাড়, কৈশোরে কে জানত তার চলা শুরু হবে এই ভারতেরই কৃষ্ণা নামের এক নদীর অববাহিকা ধরে! ফলে সরাসরি চাঁদের পাহাড়ের খোঁজ শুরু করার আগে একবার সেই শুরুর হাল-হকিকত একটু জেনে নিতে পারলে ভালো। শঙ্কর ইউগান্ডা রেলওয়ের চাকরি নিয়ে চলে যেতে পেরেছিল সরাসরি। প্রায় ডানা মেলেই। এই লেখায় আমাদের সে সৌভাগ্য হবে না, কারণ ইউগান্ডায় রেলপথ পত্তনের অনেক-অনেক আগেই যে এই ইতিহাসের প্রথম মাইলস্টোনটি গাঁথা হয়েছিল। সেটা না ছুঁয়ে আমাদের রওনা দেওয়ার উপায় নেই।
সেই সব আদি ভূখণ্ড
সে অনেক-অনেক দিনের কথা। বড়াদেওর সৃষ্ট মানুষের গা থেকে তখনও কাদামাটি পুরোপুরি ধুয়ে যায়নি। সে খ্রিস্টের জন্মেরও অ-নে-ক আগের কথা। এই ভারতেরই গুহার ভিতরে, ছোট ছোট নদীর স্রোতে অথবা নদীর পাড় ধরে হঠাৎ কখনও পাওয়া যেত একধরনের কঠিন স্ফটিকখণ্ড। যার নাম বহু পরে গ্রিক শব্দ Adamas থেকে হবে Diamond। তবে মূল্য হিসেবে, অ্যাল্যুভিয়াল[3] উৎস থেকে খুঁজে পাওয়া এই সব স্ফটিকখণ্ড ঘিরে সেরকম রহস্য কিছুই তৈরি হয়নি তখনও। সাধারণভাবে প্রাচীন পূজা-অর্চনা ও কোনও কোনও ক্ষেত্রে হস্তশিল্পে প্রয়োগ ছাড়া তখন হীরা নামের বস্তুটির আর কোনও ব্যবহারমূল্যও ছিল না। এমনিতে কার্বন-জাত আরেকটি পদার্থ গ্রাফাইটের থেকে তার ভৌত পার্থক্যটিই যা আলাদা। যাই হোক, এইভাবেই খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে হীরা পৌঁছয় চিনে। সেখানে আরেকটি ব্যবহারমূল্য সে অর্জন করবে। অতুলনীয় কাঠিন্যের জন্য এনগ্রেভিং-এ তার ব্যবহার শুরু হবে। তবে এ সবই রহস্যের নাম-গন্ধহীন নিতান্ত কেজো কথা।
যদিও তার আগেই যাবতীয় কেজো হিসেবের গণ্ডি পেরিয়ে একদিন পৃথিবীর এই কঠিনতম পদার্থটির গায়ে রহস্য জমতে শুরু করেছিল। রহস্যের জাল বুনে অভিজাত মণি-মুক্তার তালিকায় পাকাপাকি জায়গা করে নিচ্ছিল সে। সে ঢের শতাব্দী আগের কথা। মহাজনপদ থেকে মহাজনপদে ধীরে ধীরে জন্ম নিচ্ছিল রত্নবিদ্যার প্রাচীন পাঠ— ‘রত্ন পরীক্ষা’। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে লেখা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে তার বয়ান থেকে যাবে।
অদ্ভুত মনে হলেও এটাই সত্যি যে, সেই প্রাচীন সময় থেকে ১৭০০ শতক পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে হীরার একমাত্র উৎস ছিল ভারতীয় উপমহাদেশ। আবার সেই অতি প্রাচীন কালেও রোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে এই উপমহাদেশ বাণিজ্যে যুক্ত ছিল, যা খ্রিস্টের জন্মের পরে আরও জোরদার হয়ে উঠবে। আর সেই প্রাচীন বাণিজ্যে হীরা এক অতি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য হয়ে উঠবে। প্লিনির লেখাতে তো বটেই, রোমান শাসনাধীন তৃতীয় শতকের সিরিয়ায় হাতেনাতে সে প্রমাণ মিলেছে। এই সময়ই লেখা হয়ে চলছিল ‘রত্নশাস্ত্র’। সে তো একজনের লেখা ছিল না। সে ছিল পরম্পরাগত। এমনকি রোমান লেখকদেরও তাতে কিছু অবদান ছিল।
অর্থশাস্ত্রে কৌটিল্য ভূগর্ভস্থ হীরার আটটি আকরিক-সমৃদ্ধ অঞ্চলের কথা বলেছিলেন— সৌরাষ্ট্র, হিমালয়, মাতঙ্গ, পৌণ্ড্র, কলিঙ্গ, কোশল, বৈণ্য উপকূল ও সুর্পার। যদিও তখনও বেশিরভাগ হীরার খনিগুলি সম্ভবত দক্ষিণ-মধ্য ভারতেই কেন্দ্রীভূত ছিল।[4] এখনও এই সব অঞ্চলে মাটি খুঁড়লে মাঝে মধ্যেই উঠে আসে প্রাচীন রোমান মুদ্রা। সে আজকের কথা নয়। সে ছিল দুই সহস্রাব্দ প্রাচীন বাণিজ্য চলাচলের যুগ। ইউরোপ ও ভারতভূমির মধ্যে জেগে থাকত দুই সহস্রাব্দ প্রাচীন দুই প্রধান বাণিজ্যপথ। দক্ষিণের পথটি ছিল আজকের এডেন, ইথিওপিয়া ও মিশরের মধ্য দিয়ে আর উত্তরের পথটি ছিল পারস্য, আরব, আর্মেনিয়া ও তুর্কির মধ্যে দিয়ে।
এরপর ১২০০ শতক পর্যন্ত ইউরোপের সঙ্গে এই বাণিজ্যিক যোগাযোগ কতকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যদিও তার অনেকগুলিই সম্ভাব্য কারণ ছিল। কিন্তু সে আরেক গল্প। এই সময়টায় সম্ভবত শুধুমাত্র ভারতের বিত্তশালী অভিজাত শ্রেণিকে কেন্দ্র করেই হীরার এই প্রাচীন অভ্যন্তরীণ বাজার সীমিত ছিল।
এদিকে সময় বদলায়। বেঁচে ওঠে মধ্যযুগের ইউরোপের সঙ্গে যোগাযোগ। ভারতীয় পণ্য এবার উঁকি দিতে শুরু করল ভেনিসের বাজারে। এদিকে ১৪৫৬ সালে অ্যান্টওয়ার্পের এক ফ্লেমিশ মণিকার লোডউইক ভ্যান বের্কেন তৈরি করে ফেলল হীরা পালিশের চাকা। এই আপাত সাধারণ আবিষ্কারটি কিন্তু হীরা পালিশের ইতিহাসটাকেই বদলে দিয়েছিল। ইউরোপের হীরার চাহিদায় এক নতুন মাত্রা যোগ হল। সূক্ষ্মতর কাটের ভারতীয় হীরায় মাতোয়ারা হল ইউরোপের অভিজাত।
তারও কয়েক দশক পর খুলে যাবে এক নতুন দিগন্ত। কালিকটের তীরে নোঙর ফেলবে ভাস্কো-ডা-গামার চার মাস্তুলের জাহাজ সাও গাব্রিয়েল। ভারতের মাটিতে সূত্রপাত ঘটে যাবে ঔপনিবেশিক শাসনের। একই সঙ্গে পর্তুগিজ আর ওলন্দাজ জাহাজে চেপে উত্তমাশা অন্তরীপের ঝড়-ঝাপটা পেরিয়ে ইউরোপ পাড়ি দিতে শুরু করবে ভারতীয় হীরা। সেটা ছিল ইউরোপের সঙ্গে বহু-আকাঙ্খিত সরাসরি বাণিজ্যপথ। অবশ্য কিছুদিনের মধ্যেই এই সমুদ্র বাণিজ্যের বেশিরভাগ দখল চলে যাবে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে।
অবশেষে ঔপনিবেশিক অভীপ্সার দিন গোনা শেষ হল। হাতের মুঠোয় এল ভারতবর্ষ নামের রত্ন-গুহা। চিচিং ফাঁক ছিল সময়ের অপেক্ষা। একটা উদাহরণ দিই। ১৬০০ শতক নাগাদ কোম্পানির কর্মচারী উইলিয়াম হকিন্স-এর হিসেবমতো আগ্রায় মুঘল বাদশা জাহাঙ্গীরের কোষাগার আলো করে ছিল এক অপরিমিত ১৩৫,০০০ ক্যারাট অকর্তিত হীরার ভাণ্ডার। সাতশো হাতি, চার হাজার উট আর বারো হাজার ঘোড়ার কাফিলায় লুটের মাল বয়ে নিয়ে যাওয়া সে এক নাদির শাহ্কে বাদ দিলে তার অনেকটাই শেষপর্যন্ত চলে গিয়েছিল ঔপনিবেশিক শাসনের পেটে। শাহজাহানের ময়ূর সিংহাসনের শিরতাজ কোহিনূর মণিরও প্রথমে নাদির শাহ, মাঝে কিছুদিন আফগান দুরানি এবং অতঃপর পাঞ্জাবকেশরী রঞ্জিত সিং-এর হাত ঘুরে শেষপর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতযশে জায়গা হয় ইংলন্ডেশ্বরীর মুকুটে। সে রহস্যের বিস্তারে আর যাচ্ছি না। তার জন্য উইলিয়াম ডালরিম্পল[5] আছেন।
অন্যদিকে, ইউরোপীয় অভিজাতদের চাহিদা মেটানোর বড় তাগিদ ছিল। ভারতের মানচিত্রে হীরার মতোই অনিবার্য জ্বলজ্বল করে উঠল ১৬০০ শতকের কুতুবশাহী গোলকোন্ডা আর তার হীরার খনি। বুন্দেলখণ্ড ক্রেটারের মতোই আরেকটি প্রাচীনতম ভূত্বক— ধারোয়ার ক্রেটার ধরে ছড়িয়েছিটিয়ে যেন এক হীরক রাজার দেশ। সেই সময়ের গোলকোন্ডার ছবি যাঁদের লেখায় পাই, তার মধ্যে ফরাসি পর্যটক জঁ-ব্যাপটিস্ট ট্যাভার্নিয়ের ছিলেন সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য। এই শতকের মাঝামাঝি ট্যাভার্নিয়ের কৃষ্ণার খাত ধরে প্রায় ষাট হাজার মানুষকে এই খনিগুলোতে কাজ করতে দেখেছিলেন। গোলকোন্ডার প্রতি ছিল এই ভূ-পর্যটকের আশ্চর্য টান। সারা জীবনের জন্য দুর্বার আসক্ত করেছিল তাঁকে গোলকোন্ডার বারবণিতা— দম কি মছলি সঙ্গে খুবানি কা মিঠা— আর অতি অবশ্যই হীরা। মুঘল ও ইউরোপীয় রাজাদের হীরা বিক্রয় করে বিপুল সম্পত্তি করেছিলেন ট্যাভার্নিয়ের। গোলকোন্ডা থেকেই নিয়ে যাওয়া বিখ্যাত ‘ব্লু ডায়মন্ড’ নামের হীরকখণ্ডটির বিনিময়ে রাজা লুই-এর কাছ থেকে আদায় করেছিলেন ২২০০০০ লিভর্, আজকের দিনে যা দুই লক্ষ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি। তা দিয়ে ১৬৬০ সাল নাগাদই সুইটজ়়ারল্যান্ডে কেনা হয়ে গিয়েছিল পুরো একটি কাস্ল্। স্বাভাবিক, বাকি জীবনে ‘হিরাওয়ালা’ ট্যাভার্নিয়ের বারবার ফিরে আসতে চেয়েছিলেন ভারতে, বিশেষত গোলকোন্ডায়। কিন্তু সে আরেক গল্প।
১৬০০ শতকের গোলকোন্ডার হীরার খনি
যাই হোক, পুরো এই শতক জুড়েই সারা পৃথিবীতে রাজত্ব করেছে গোলকোন্ডার হীরা। মসুলিপটনমে বেশ কয়েকবছর কাটিয়েছিল উইলিয়ম মেথওয়ল্ড নামে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক প্রশাসক। তহবিল তছরুপের দায়ে তাকে দেশে ফিরে যেতে হয়। মূল অভিযোগটি তার বিরুদ্ধে ছিল এইরকম— কোম্পানি নিযুক্ত হয়েও মেথওয়ল্ড ব্যক্তিগত উদ্যোগের বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছিল আর সেই বাণিজ্যটি ছিল, বলাই বাহুল্য, হীরার। এহেন মেথওয়ল্ডের জবানি— পাশাপাশি সমস্ত দেশের রত্নব্যবসায়ী ও মণিকারদের ভিড়ে ভরে থাকত কুতুবশাহী রাজ্য। মেথওয়ল্ড দেখেছিল কারওয়ান শহর, যা আজকের দিনে পুরনো হায়দরাবাদের অংশ, তখন ছিল পৃথিবীর ব্যস্ততম হীরা কাটার ও বাণিজ্যের কেন্দ্র। সেই সময়ে ওই অঞ্চলে আটত্রিশটির মতো খনিতে উৎপাদিত হত প্রায় ১২ মিলিয়ন কারাট হীরা। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত খনিটি ছিল কোলুর।
ট্যাভার্নিয়ের, মেথওয়ল্ড ছাড়াও মার্কো পোলোর মতো পর্যটক, মুহামেদ আল-ইদ্রিশির মতো মধ্যযুগীয় কার্টোগ্রাফারের লেখাপত্তরে, বিভিন্ন ফরাসি ও পর্তুগিজ পর্যটক আর শখের হীরা-ব্যবসায়ীদের জার্নালে উঠে এসেছিল সেই সময়কার গোলকোন্ডা। জঁ দ্য থেভেনো, ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের-এর মতো ফরাসি পর্যটকরাও ট্যাভার্নিয়েরের মতোই গোলকোন্ডায় সরাসরি কেনাবেচায় লিপ্ত ছিলেন। ভারতে পর্তুগিজ উপনিবেশের ভরকেন্দ্র ছিল গোয়া। পর্তুগিজ বাণিজ্যের পুরোটাই তখন গোয়ার মধ্যে দিয়েই হত। গোয়া থেকে সুরাট হয়ে এই পর্তুগিজ হীরা-বাণিজ্যের চলাচল বিস্তারিত ছিল সরাসরি ইউরোপ পর্যন্ত। হীরাবাহী পর্তুগিজ জাহাজে ভিড় হয়ে থাকত আরব সাগরের বাণিজ্যপথ। জাহাজডুবি ছিল তখন এক নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা। তবে পর্তুগিজরা হীরা থেকে এত লাভ করত যে শত জাহাজডুবিতেও তাদের কিছুই এসে যেত না। এই অমিত সরবরাহ অক্ষুন্ন রাখায় এক গোলকোন্ডাই যথেষ্ট ছিল। পৃথিবীর বৈভব ইতিহাসের বিখ্যাত সমস্ত হীরকখণ্ডের আদি উৎস ছিল এই গোলকোন্ডাই। কোহিনূর, নাসাক, হোপ, দরিয়া-ই-নূর, রিজেন্ট, ড্রেসডেন গ্রিন, অর্লভ, নিজ়াম, জেকব, এ ছাড়াও হারিয়ে যাওয়া ফ্লোরেন্টাইন ইয়েলো, আকবর শাহ, গ্রেট মুঘল… এ তালিকা শেষ হওয়ার নয়। একই সঙ্গে শেষ হওয়ার নয় ঔপনিবেশিক লুণ্ঠনের তালিকা।
কিন্তু সময় যে আবারও বদলে চলে! সতেরোশো শতক। আর এক উপনিবেশ। ব্রাজিলের মিনাস গেরাইসে নদীর স্রোতে অ্যালুভিয়াল হীরার উৎস আবিষ্কারের পরে পরেই গোলকোন্ডা তথা ভারতীয় হীরার দিন শেষ হয়ে এল। এরপর দেড়শো বছর ধরে পৃথিবীর হীরার উৎপাদন শাসন করেছিল মিনাস গেরাইস, মাতো গ্রোসো। আরায়াল ডো টিজুকো নামের যে গ্রামটির কাছে নদীখাতে প্রথম ব্রাজিলীয় হীরকখণ্ড আবিষ্কার করে খনিজীবী কারিগরের দল, সেই গ্রামটির নামই হয়ে গিয়েছিল পরে ‘ডায়ম্যান্টিনা’।
ঊনবিংশ শতকে ব্রাজিলীয় হীরার খনি
কিন্তু শুরুতে বিষয়টি ছিল বেশ অন্যরকম। সারা লাতিন আমেরিকা, বিশেষত ব্রাজিল জুড়ে চলছিল সোনার খোঁজ— গোল্ড রাশ। সোনা খুঁজে পাওয়ার নেশায় বুঁদ স্বর্ণসন্ধানীদের পাত্তাই পায়নি পাহাড়ি নদীর স্রোতে ভেসে আসা একধরনের ছোট ছোট স্ফটিকখণ্ড। সে ১৭০০ শতকের প্রথমার্ধ। মাইনারদের সান্ধ্য তাসের আসরে মার্কার হিসেবে ব্যবহৃত হত সেই সব স্ফটিকখণ্ড। এক খেলুড়ে সংগ্রহ করে ফেলেছিল বেশ কিছু এইরকম মার্কার। গোলকোন্ডা-ফেরত এক অভিজ্ঞ মাইনারের চোখে পড়ে গেল সেই সংগ্রহ, তারপর ইতিহাস যেন সরে এল ব্রাজিলের মাটিতে। ডায়ম্যান্টিনা হয়ে উঠল পর্তুগিজ উপনিবেশের জমজমাট পিকচারেস্ক হীরক-কেন্দ্র। জনবিরল প্রকৃতিতে প্রয়োজনীয় শ্রম কোথা থেকে আসবে? উপায় ছিল। ট্রান্স আটলান্টিক স্লেভ ট্রেড। জাহাজের খোল ভরিয়ে আফ্রিকার অ্যাঙ্গোলা, কঙ্গো বা মোজাম্বিক থেকে আমদানি করা কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসের ঘাম-রক্তে ভিজে গেল মিনাস গেরাইস। সে ছিল দুঃসহ দুর্ভাগ্যের আরেক যন্ত্রণাময় আখ্যান। ওদিকে লিসবনের কপাল যত ঝকমক করে উঠল, রহস্য কৃষ্ণার খাত ছেড়ে জেকুইতিনহোনা নদীর খাতে এসে বাসা বাঁধল। কিন্তু তাও বা আর কত দিন!
ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি যত বেশি করে পৃথিবীর ভূখণ্ড দখলে আনতে পারছিল ততই যেন উন্মোচিত হচ্ছিল লুণ্ঠনের জন্য প্রস্তুত অমিত সম্পদের সম্ভাবনা। আর জীর্ণ-পরিত্যক্ত নৌকার মত একে-একে অন্ধকারের গর্ভে তলিয়ে যাচ্ছিল গোলকুন্ডা, মিনাস গেরাইস, মাতো গ্রোসো। উপনিবেশবাদ তো তাই-ই। সভ্যতার তাপ গলিয়ে দেয় কাদামাটির অনাবিল যাপনস্তর। অতলান্ত সম্পদক্ষুধা রহস্য হয়ে দানা বাঁধে উপনিবেশ থেকে উপনিবেশে, কুয়াশা হয়ে ছড়িয়ে পড়ে পাহাড়-উপত্যকা-অরণ্য-নদীতীরে। তারপরে একদিন হঠাৎ কুয়াশার চাদর সরে যায়। উন্মুক্ত কঙ্কালের মতো পড়ে থাকে ধ্বংসের মানচিত্র— চুর-চুর হয়ে পড়ে থাকে লক্ষ বছরের কাদামাটি দিয়ে বড়াদেওর যা কিছু সৃষ্টি। স্প্যানিয়ার্ডরা যখন অ্যাজ়়টেকদের ধ্বংস করছিল, তখন স্প্যানিয়ার্ডদের নিষ্ঠুরতার থেকেও অন্য কিছু যেন বেশি অবাক করছিল কাদামাটির অ্যাজ়়টেক মানুষদের।
“ওরা এমনভাবে পাগলের মতো সোনাগুলিকে তুলে নিচ্ছিল, ঠিক লোভী বাঁদরের মতো। চোখমুখ থেকে ওদের আনন্দ ঠিকরে বেরোচ্ছিল; যেন ওদের ভিতরে আগুন জ্বলছিল। যেন অনন্তকাল এর জন্যই ওরা আকণ্ঠ তৃষ্ণার্ত ছিল। সোনার লোভে ওরা তরতাজা হয়ে উঠছিল হিংস্র শুয়োরের মত।”
এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার পর এই তালিকায় জুড়তে বাকি ছিল আর একটি নাম, আর একটি রহস্য। আবার সময় বদলে চলে আর তালিকায় জুড়ে যায় সেই নতুন রহস্যের মহাদেশ— আফ্রিকা। কৃষ্ণা, জেকুইতিনহোনার পর রহস্য খুঁজে নিল আরেকটি নদীতীর— তার নাম অরেঞ্জ। তখনও শঙ্করের ইউগান্ডায় চাকরির উদ্দেশ্যে যাত্রা করার অর্ধ শতক বাকি।
অবশেষে ওয়েকড আপ ইন কিম্বার্লি
একজন বড় স্বর্ণান্বেষী পর্যটক যেতে-যেতে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন। যে পাথরটাতে লেগে হোঁচট খেলেন সেটা হাতে তুলে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখলেন, তার সঙ্গে সোনা মেশানো রয়েচে। সে জায়গায় বড় একটা সোনার খনি বেরিয়ে পড়ল। এ ধরনের গল্প সে কত পড়েচে দেশে থাকতে।
–চাঁদের পাহাড়, পৃ. ২৩।
আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণ প্রান্ত। ১৮৬৬-র কেপ অব গুড হোপ কলোনির এক ঝকঝকে সকাল। হোপটাউনের বসতি ছেড়ে অরেঞ্জ যেদিকে ভাল নদীতে মিশেছে, সেদিকেই খানিক দূরে কয়েক ফার্লং জমিতে দরিদ্র বোঅর[6] কৃষক ড্যানিয়েল জেকবের ফার্ম ‘ডি কাল্ক’। বছর পনেরোর এরাসমুস জেকব অরেঞ্জের দক্ষিণ তীর বরাবর তার বাবার ফার্মের দিকেই আসছিল। ফার্মের ভিতরেই একটু উঁচু পাথুরে বাঁকটায় চোখে পড়ল এক অচেনা স্বচ্ছ পাথর। এরাসমুসের মা সেটিকে কথায়-কথায় দেখিয়ে ফেলে আরেক কৃষক প্রতিবেশী শাল্ক ভ্যান নিকার্ক-কে। অজানা পাথরখণ্ডটির হয়তো কোনও বিশেষত্ব থাকতে পারে আন্দাজ করে নিকার্ক সেটি কিনতে চায়। কুড়িয়ে পাওয়া একটি স্বচ্ছ পাথরখণ্ডের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিরক্ষর বোঅর চাষি-রমণীর কোনও ধারণাই ছিল না। কতকটা মজা করেই সে নিকার্ক-কে পাথরটি একেবারেই দিয়ে দেয়। চাষি নিকার্ক কিছু মূল্যের আশায় হোপটাউন ও কোলসবার্গের দরজায় দরজায় ঘুরে, কোথাও পাত্তা না পেয়ে হতোদ্যম হয়ে শেষমেশ পৌঁছয় কোলসবার্গের সিভিল কমিশনার লোরেঞ্জো বয়েসের কাছে। এই বয়েসের মাধ্যমেই অবশেষে সেই স্বচ্ছ শিলাখণ্ড পৌঁছয় শখের ভূতাত্বিক, গ্রাহামস্টাউনের ডাক্তার ডব্লিউ জি আথারস্টোনের শখের ল্যাবরেটরিতে। তারপর? পৃথিবীর এতদিনের যাবতীয় হীরা-ইতিহাস ও রহস্যের চরিত্র এক মুহূর্তে বদলে দিল এই আবিষ্কার। কিশোর এরাসমুস যে স্বচ্ছ স্ফটিকখণ্ডটি কুড়িয়েছিল, সেটি ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম হীরকখণ্ড— ২১.২৫ কারাটের ‘ইউরেকা’।
এরপর অরেঞ্জ আর ভাল নদীতীর ধরে ছোট ছোট টিলায় ভরা যেন এক পোড়া সিপিয়া ভূখণ্ডের ল্যান্ডস্কেপ অসহ্য গরম-দুর্গন্ধ-মহামারি-ধুলো-মাছি-জুয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভরে গেল অর্ধলক্ষ ডিগারের হর্ষধ্বনি-আর্তনাদ, চালুনি আর বেলচার কর্কশ আওয়াজে। সে মাত্র দেড়খানা শতাব্দী আগের কথা, যখন সে ভিড়ে মিশে ছিল এক-একজন সত্যি ডিয়েগো আলভারেজ, এক-একজন সত্যি জিম কার্টার। এবং সে ভাগ্যান্বেষী সত্যি আলভারেজ, সত্যি জিম কার্টারদের ভিড়ে— অবশ্যই বিভূতিভূষণের কল্পনার অ্যাডভেঞ্চার ছাপিয়ে, শঙ্করের আত্মায় ভর করা রোমান্স ছাপিয়ে— আমরা হিসেব রাখিনি— কতখানি লেগেছিল বিজবিজে রক্ত-কান্না-লোভ-ক্ষুধা আর ধ্বংসের পিউপা-লার্ভা।
কিছুদিন পর। ১৮৭১। কোলসবার্গ কোপি (Copje) অর্থাৎ কোলসবার্গের ঢিপির নীচে আস্তানা গেড়েছিল এরকমই রেড-ক্যাপ পার্টি বলে একটি হীরা-সন্ধানী দল। ফ্লিটউড রস্টোর্ন ছিল এই দলের নেতা। এসাউ ড্যামোয়েন্স ছিল সেই দলের পাকা রাঁধুনি। পূর্বকৃত অপকর্মের শাস্তি হিসেবে এসাউকে একদিন ঢিপির পাথর খুঁড়তে পাঠানো হয়েছিল আর সেদিনই এসাউ ঢিপির মাথায় পেল হীরার খোঁজ। ভুরুইতজ়়িক্ট নামের এই ফার্মের আসল মালিক ছিল দুই বোঅর ভাই দিদেরিক ও নিকোলাস ডি বিয়ার। খবর ছড়িয়ে পড়ল বিদ্যুৎগতিতে। পরের একমাস দুই-তিন হাজার মানুষের পায়ের চাপে ঢিপি ধসে গিয়ে প্রায় নিজে থেকেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল যে খনি— স্বাভাবিকভাবেই মুখে-মুখে তার নাম হয়ে উঠল ‘নিউ রাশ’। পুরনো ‘রাশ’টি শুরু হয়েছিল ইউরেকা আবিষ্কারের হাত ধরে। এখন ‘নিউ রাশ’-এর উন্মাদনায় কয়েক মাসের মধ্যেই তৈরি হয়ে গেল একটি আস্ত শহর।
কোলসবার্গ কোপির উপর ফ্লিটউড রস্টোর্নের ব্যস্ত রেড ক্যাপ পার্টি
এরপরে কি আর হাত গুটিয়ে রাখতে পারে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার? প্রথমেই লন্ডনে বসে সেক্রেটারি অব স্টেট ফর দ্য কলোনিজ়়, লর্ড কিম্বার্লি (জন ওডহাউস, ফার্স্ট আর্ল অব কিম্বার্লি) অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত করে ‘নিউ রাশ’ নামটিকে বাতিল করলেন। এমনকি আগের ওলন্দাজ নামটিও, অর্থাৎ ‘ভুরুইতজ়়িক্ট’-ও বাতিল হল লর্ডের জিহ্বায় তা উচ্চারণের অযোগ্য হওয়ায়। এরপর একটিই নাম থাকতে পারে। হলও তাই। উপনিবেশ, ইতিহাস ও হীরা হাত-ধরাধরি করে ছড়িয়ে পড়ল ‘কিম্বার্লি’ খনিতে। যদিও ডিগারদের নিজস্ব সংবাদপত্র— ‘ডায়মন্ড ফিল্ড’-এর পাতায় ঝরে পড়েছিল অনিবার্য দীর্ঘশ্বাস—
উই ওয়েন্ট টু স্লিপ ইন নিউ রাশ অ্যান্ড ওয়েকড্ আপ ইন কিম্বার্লি অ্যান্ড সো আওয়ার ড্রিম ওয়জ়় গন।
ব্যক্তিগত উদ্যোগের খনন প্রায় শেষ হল কিম্বার্লি অঞ্চলে। ছড়িয়েছিটিয়ে তারপরেও হঠাৎ তাদের দেখা পাওয়া যেত নিশ্চয়ই— কোনও নিঃসঙ্গ ভেল্ডে, অথবা নামিবিয়ার মরু-বালিয়াড়ির আড়ালে অথবা কঙ্গো অববাহিকায়— কিন্তু প্রকৃতপ্রস্তাবে অতঃপর ডিয়েগো আলভারেজ, জিম কার্টারদের ক্রমে স্থান হল দুই মলাটের মধ্যে কিশোর পৃথিবীর যত রাত-জাগানিয়া ‘চাঁদের পাহাড়’-এ।
সে খুব বেশি দিনের কথা নয়। ১৮৮৮ সালে তৈরি হল ডি বিয়ার্স কনসলিডেটেড মাইনস, এন এম রথসচাইল্ড অ্যান্ড সন্সের পৃষ্ঠপোষকতায় ডি বিয়ার্সের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা সিসিল রোডস হয়ে উঠল ঔপনিবেশিক দুনিয়ার মাথার ওপরে ঘনাতে থাকা এক সম্পূর্ণ নতুন রহস্যের জাদুকর। দু-মুখওলা দৈত্যের মুখ থেকে বেরোতে থাকা আগুনের হলকার মতো সেই জাদুকরের হাত থেকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল দুই ভিন্ন রহস্যের রংমশাল। সাদা ইউরোপ-আমেরিকার আকাশে যখন তারা ছড়িয়ে পড়ল রূপকথা হয়ে, জমাট রক্ত হয়ে তারা ঢেকে দিল কালো আফ্রিকার কাদামাটির আকাশ।
[ক্রমশ]
[1] মেসোআর্কিয়ান যুগ: ৩২০০ মিলিয়ন থেকে ২৮০০ মিলিয়ন বছর আগের পৃথিবী।
[2] প্যালিওপ্রোটেরোজ়়োয়িক যুগ: ২৫০০ মিলিয়ন থেকে ১৬০০ মিলিয়ন বছর আগের পৃথিবী।
[3] অ্যাল্যুভিয়াল: জলধারায় পলি, বালি, নুড়ি ইত্যাদি ভেসে এসে নদীর গতিপথে অথবা প্লাবনভূমিতে জমা হতে থাকে। এদের বলে অ্যাল্যুভিয়াল ডিপোজিট।
[4] রত্নশাস্ত্রে যাদের বলা হয়েছে আকর (ākara) অর্থাৎ খনি আর এই খনিগুলিকে কেন্দ্র করে যে নগরগুলি গড়ে উঠেছিল তারা ছিল আকরাবন্তী (ākarāvanti)। সেই সময় ‘অবন্তী’-র অর্থ খনি-শহর।
[5] পড়ে দেখতে পারেন অনিতা আনন্দ ও উইলিয়ম ডালরিম্পলের লেখা Juggernaut Books প্রকাশিত বই Kohinoor: The Story of the World’s Most Infamous Diamond.
[6] সপ্তদশ শতক থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রান্সভাল ও অরেঞ্জ ফ্রি স্টেট-এ বসবাস করতে শুরু করে ওলন্দাজ, জার্মান ও ফরাসি হিউগেনট বংশোদ্ভূত এক মিশ্র জনগোষ্ঠী। এরাই বোঅর জনগোষ্ঠী।
নাম টা বুঢ়া দেও হবে। এই রকমই বস্তারের ও সৃষ্টির আখ্যান আছে, নাম- ‘লিঙ্গো’র আখ্যান’ ( Lingo ki kahani ).
খুব ভালো লাগলো!
ধন্যবাদ বোধিসত্ত্ব। আমার নিজের যাওয়ার সুযোগ হয়নি। ইংরেজি লেখায় উল্লেখ পেয়েছিলাম। আমারই অজ্ঞতা ও জানার পরিধির সীমাবদ্ধতা হেতু এই ভুল। ধরিয়ে দেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। ভবিষ্যতে এরকম ভাবেই ঋদ্ধ করতে থাকলে ভীষণই উৎসাহ পাবো।