প্রিয়া সামন্ত
‘শিরার ভেতর রক্ত যেভাবে বাঁচে, আমিও তেমনই কবিতায় বেঁচে থাকি।’ বন্ধু ইয়ুলিও যাদেনকে লেখা চিঠিতে লিখেছিলেন আন্তোনিয়া পোসসি। পাহাড়ের, উপত্যকা আর সবুজের প্রেমে পাগল এই মেয়েটির ডায়েরিতে লেখা ছিল—
Poetry you that give yourself only
to those who with lamenting eyes
search for themselves—
oh remake me worthy of you,
Poetry watching over me…–Pasturo, 23rd August, 1934
মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে আত্মঘাতী স্প্যানিশ এই কবির বেঁচে থাকার দিনগুলিতে, তাঁর কোনও কবিতাই প্রকাশের মুখ দেখেনি। তাঁর কবিতার পাঠক ছিল মূলত আলপাইন পর্বতমালার, গ্রিগনা পাহাড়ের কোলে অলস শুয়ে থাকা পাস্তুরো গ্রামের ঝোরাগুলি, পাহাড়ি বাঁকের মুখে ফুটে ওঠা নামহীন ফুলেরা, ছেলেবেলার বন্ধু ইয়ুলি ওয়াদেন কিংবা বন্ধুত্ব ছাপিয়ে ক্রমে ভাই হয়ে ওঠা ভিত্তোরিও সেরেনি।
বাবা আইনজীবী রবার্তো পোসসি চেয়েছিলেন মেয়ের জীবনকে নিজের শর্তে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে। মেয়ের সঙ্গে তার থেকে প্রায় চোদ্দ বছরের বড় শিক্ষক তথা বন্ধু আন্তোনিয়ো মারিয়াসার্ভি-র প্রেমের সম্পর্ককে তাই বাবা হিসাবে কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি তিনি। মিলান থেকে বারবার দূরে সরিয়ে সুদূর পাস্তুরো গ্রামে থাকতে পাঠিয়েছেন মেয়েকে। কিন্তু সেই পাস্তুরো গ্রাম, আলপাইন পর্বতের উপত্যকা, ছায়াচ্ছন্ন ঝোরা, ফসলের খেতে কাজ করতে আসা মেয়েদের দল আর তার প্রিয়তম আন্তোনেল্লো কীভাবে তার মেয়ের লেখায়, ডায়রিতে ক্রমেই ঢুকে পড়েছে, তার হদিশ পেতে রবার্তোকে অপেক্ষা করতে হয়েছে মেয়ের মৃত্যু অবধি। তবু তীব্র অধিকারবোধে নিজে হাতে পালটে দিয়েছিলেন মেয়ের সুইসাইড নোট ও অন্যান্য লেখাপত্র। অনেক পরে বন্ধুদের তৎপরতায় প্রকাশ পায় তাঁর কাব্যগ্রন্থ ও চিঠিপত্র। বর্তমান ইতালীয় সাহিত্যে আন্তোনিয়া পোসসি এক অনস্বীকার্য নাম।
আন্তোনিয়ার লেখায় ঘুরেঘুরে আসে পাহাড়, উপত্যকার বুকে ফুটে থাকা অনামা ফুল, ঝরনার জল আর ছায়ার কথা। হাওয়া আর রোদের কাটাকুটি খেলা, ফসলকুড়ানি মেয়ের ছেলে কাঁখে হাস্যমুখ দাঁড়িয়ে থাকা, দূর সমুদ্রের অন্ধকারে একলা একটা তারার জেগে থাকার কথা তিনি তুলে আনেন কবিতায়। হেমন্তের তুষারপাতে সন্ধেবেলার শহরে ফুল বিক্রি করতে আসা ক্ষীণ কিশোরী মেয়েটার কথা, তিনি না লিখে পারেন না!
১৯১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ছিল তাঁর জন্ম। আর ২ ডিসেম্বর, ১৯৩৮-এ মিলান থেকে খানিক দূরে বরফের মধ্যে তাঁর দেহ পাওয়া গিয়েছিল। ড্রাগ ওভারডোজ। পরের দিন থেকে আন্তোনিয়া অতীতের দখলদারি পেয়েছিলেন। আর আমরা দায়িত্ব পেয়েছিলাম তাঁর লেখাকে ভালোবেসে আগলে রাখার।
আন্তোনিয়া আমার ডিসেম্বরের অনুবাদ। আমার বরফ দেশের বন্ধু। আন্তোনিয়া চেয়েছিলেন মৃত্যুর পর অনেক দূরে চলে গেলে যখন পৃথিবীতে তাঁর আর কোনও চিহ্ন থাকবে না, তারপরেও যতটুকু ভগ্নাংশ তাঁর রয়ে যাবে, সেটুকুর স্মৃতিতে কেউ অন্তত একখানা ক্রিসেন্থিমাম যেন রাখে! তাঁরই লেখার কয়েকটি অনুবাদ তাই রইল। তাঁর প্রতি আমার নিজস্ব ক্রিসেন্থিমাম।
November
আর তারপর — কখনও যদি এমন ঘটে যে আমি চলে গেছি অনেক দূরে—
আমার সম্পর্কিত কিছু তবু রয়ে যাবে
আমারই পৃথিবীতে—
নৈঃশব্দের শীর্ণ এক ছাপ
থেকে যাবে উচ্চারণের মাঝে মাঝে
শুভ্রতার এক ক্ষীণ শ্বাস যেন, নীলাভ হৃদয় জুড়ে—
এবং এক নভেম্বরের সন্ধ্যায়
ভাঙাচোরা এক ছোট্ট মতো মেয়ে
রাস্তার এক কোণে অসংখ্য ক্রিসেন্থিমাম বিক্রি করবে
আর সেখানেই থাকবে
আদিম সবুজ যত বরফের মতো তারারা—
যেন কেউ কেঁদে ফেলবে
কে জানে কোথায়; কোথায়, কে জানে—
কেউ বা হয়তো ক্রিসেন্থিমামের খোঁজ করবে
আমারই জন্য
এই পৃথিবীতে
এমনটা যখন ঘটবে
তখন আমায় যেতেই হবে,
যেখান থেকে আর ফেরার কথা নেই।
মিলান, অক্টোবর ২৯, ১৯৩০
Reflections
শব্দরাশি— এমন এক কাচ যেন
বিশ্বাসঘাতকের মতো আমার আকাশকে
প্রতিফলিত করে তোলে—
সূর্যাস্ত পেরিয়ে গেলে
তোমার কথা ভাবি।
যেমন অন্ধকার নামা এক রাস্তায়
পাথরের উপর এসে ভেঙে পড়া জানলার কাচের
টুকরোটাকরা অবশিষ্ট অংশেরা
ছড়িয়ে দেয় ছিন্নভিন্ন ছেঁড়াখোড়া আলো—
সেপ্টেম্বর ২৬, ১৯৩৩
Thoughts
সুদীর্ঘ দুটি ছায়ার ডানা
তোমার ব্যথার পিঠে মুড়ে রাখি
ছায়া হব বলে,
তোমার ম্লান হাসির পাশে
সন্ধের নির্জনতা হতে চেয়ে।
মে, ১৯৩৪
Scent of Green
সবুজের গন্ধ—
আমার নিখোঁজ শৈশব
যখন ছাল ওঠা হাঁটু নিয়ে বেশ গর্ববোধ হত আমার—
অনর্থক ফুল কিংবা পথের পাশের ঘাস ছিঁড়তাম,
সবই আবার ছুড়েও দিতাম দূরে
আমার হাতকে জোড়া রাখত যে—
আগস্টের কোনও দুপুরে— ঘন অরণ্যের গন্ধ
যখন, ঝলসে যাওয়া মুখে, আমরা ঊর্ণজাল
ছিঁড়তে ছিঁড়তে এগোতাম—
হেঁটে যাওয়া যাবে এমন স্রোত, লাফিয়ে চলা পাথরে
জলের গভীরে ডুব দেয় পা
তীব্র ফলার মতো শিরায় শিরায় হিম ঢুকে আসে—
সূর্যালোক, আমার উন্মুক্ত পিঠের উপর পড়ে থাকা সূর্যের মতো
এক আলো, যা তোমায় করে তোলে এক সোনালি চুলের মেয়ে—
মাটির গভীর থেকে উঠে আসা গন্ধ,
যেন আমার হারিয়ে ফেলা বালিকাবয়স।
পাস্তুরো, আগস্ট, ১৯৩৪
Via Dei Cinquecento
আমাদের ভেতর ভার হয়ে থাকে অব্যক্ত কথারা
আর যত অতৃপ্ত খিদে,
অসন্তুষ্ট শিশুদের চিৎকার আর ক্ষয়িষ্ণু মায়েদের বুক
আর সেই গন্ধ,
ছেঁড়া কাঁথা, অমেধ্য আর মৃত্যুর গন্ধ—
বিষণ্ণ দালান জুড়ে ঘোরাফেরা করে
তোমার আমার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা এক বেড়ার মতো
আমি বাতাসের কাছে গুঙিয়ে উঠি।
বাইরে তবু
কুয়াশাচ্ছন্ন তারাদের নীচে অপূর্ব দুই আলো, বলে
প্রশস্ত পথ আর
গ্রামের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা এক জলের কথা;
আর আলোর প্রতিটি ফলক, আকাশের প্রেক্ষাপটে
ফুটে ওঠা প্রতিটি পুরনো গির্জা, হতভাগ্য
ছেঁড়া জুতোর প্রতিটি পদক্ষেপ
নিয়ে আসে আমায় হাওয়ার রাস্তা ধরে
নিষ্ঠা ভরে
তোমার কাছে আনে।
ফেব্রুয়ারি ২৭, ১৯৩৮