পাঁচটি কবিতা
নাবিক
তুমি তার কিছু কিছু জানো
দেখেছ আয়নায় ভেসে যাচ্ছে রাতের কল্লোলধ্বনি
এও এক সমুদ্রের কথা
যেখানে বিমূর্ত রূপ খুঁজে খুঁজে এসেছে ভয়াল
এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছি বলে
মৃত্যুকেও বন্ধু মনে হয়
মেধার কাছেও থেকে যায় নাবিকের কিছু ঋণ
আকাশ-নক্ষত্রকথা বাড়িয়েছে জ্ঞানের পরিধি
যে আলো এসেছে মর্ত্যে
তারও কোলাহলজুড়ে নিরন্তর তৃষ্ণা লিখে রাখি
লবণ লবণ শুধু সতৃষ্ণ চোখের নীচে নীল
নীল ছোপ মোছে না জ্যোৎস্নায়
এই দ্বীপে কতদিন পা ফ্যালেনি চাঁদ
এই দ্বীপে জীবিত বলতে এক নাবিকের চোখ
যার আলো সমুদ্র পেরিয়ে
তোমাকেও ছুঁতে চায় চিরচেনা প্রেমের ইঙ্গিতে
সহ্য করো, সহ্য করো নাবিকের গান
সহ্য করো উৎকণ্ঠা, অসহ্য প্রেমিক রূপকথা।
হ্রেষা
মেঘের নীচেই কালো রং নৌকোখানি থেমে আছে
আকাশের সাতরঙা ঘোড়া
কিছুটা বিষণ্ণ আর জৌলুষবিহীন
এখনও সন্ধ্যার মুখ দ্যাখেনি পৃথিবী
অত্যন্ত উদ্গ্রীব হয়ে বসে আছি কনেদেখা আলোর ভিতরে
এখনও দূরের স্পষ্ট দিগন্তের দিকে চোখ রেখে কথা বলি
বলি ওখানেই রাখি কাঁটাছেঁড়া আমার হৃদয়
কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা কয়েক সহস্র জীবনের উজ্জ্বল স্বপ্নেরা
পাহারায় থাকে এক স্কন্ধকাটা মানুষের অশরীরী ছায়া
দিগন্ত বিলীন হলে দিন আর রাত একাকার
সব অন্ধকার এর ফলে লুকোনো সম্ভব কি না
এখনই মুশকিল হবে বলা
বরং মেঘের বুক ফুঁড়ে ওঠা ঘোড়াটিকে দ্যাখো
দ্যাখো তার কেশর ফোলানো
যেন এক্ষুনি বাতাসে ভর দিয়ে নেমে আসবে নীচে
টলটলে মায়াহরিণীর দুই চোখ
জঙ্গলের সোঁদা গন্ধ গায়ে ওই দিকে চেয়ে আছে
আমাদের অত্যন্ত কুটিল মন প্রকৃতির কৃপাভিক্ষা চায়
আবার বেদনাক্লিষ্ট তার নীল মুখে হাসির খোরাক খোঁজে
এ সময় অশ্বারোহী পৃথিবীর দিকে ধাবমান
স্বরসঙ্গতি
মনখারাপ হলে দূরে বেহালার ছড়ে টান কিংবা উল্টোটাও
আমার জানার কথা স্নায়ুতন্ত্র অলসতা আমিষ শরীর
বৃষ্টি থেমে গেছে অনেকক্ষণ
হাওয়া ওঠে ঘোড়ার ডানায়
হাওয়া ঘুরছে রাজার চরের মতো এদিক-ওদিক
তাদের উদ্বেগ আর গতির ভিতরে সাদা ঘোড়া পেগাসাস
ঝরনা এনে দেয়
বৃষ্টি নিয়ে অভিযোগ নেই
তড়িৎ সংক্রমণের মুখে অঝরে নিঃশেষ হওয়াটুকু ছাড়া
ঘুম নেই এ কথাও জেনেছে সবাই
অথচ চোখের দৃষ্টি কেমন রহস্যময় দ্যাখো
রহস্য ক্রমশ ঝরতে থাকে যেন বৃষ্টি
অথচ তোমাকে ভেজায় না
আমার মনখারাপের পিঠে রোদ ঝুলে আছে জোকারের মতো
হেসো না, এক্ষুনি মেঘ এসে চেটে দেবে ঘোড়ার সতেজ দেহ
ধূসর রঙের মধ্যে আমার মুখের নির্জনতা ডুবে যায়
নির্জনতা জ্ঞানের দ্যোতক
মনখারাপ বলে কিছু নেই
দু’এক টুকরো বেহাল যন্ত্রের স্বর আচমকাই মগজে ঢুকেছে।
ট্রাপিজ
কিছুই করি না আমি, মাঝে মাঝে শুধু থাকা আর না-থাকার
মাঝখানে বাইসনের সিং-এর মতন মাথা নাড়তে নাড়তে হেঁটে যাই
মৃদু কোলাহল করে চলে যায় সুখী মানুষের ক্যারাভান
ক্ষোভ আর প্রতিশোধস্পৃহা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে অশ্রুপাত
আমি তার কতটুকু জানি
আমি শুধু বসে থাকি হাটখোলা আকাশ দরজার ধারে একা
স্থাণু নই বলে পাথরের মতো ঘুরি আর দেখি চোখের বিলাপ
কাঁদে কেউ যেন শব্দ করে ভেঙে পড়ে বিষণ্ণ লোহার সেতু
এসব কিছুই জানা ছিল না আমার, যদি না লোহার টুকরো
ছিটকে এসে পড়ত শান্ত খাবার টেবিলে
বলেছি যদিও, সাঁকো, তুমি তো ছিলেই ভাঁজ-করা আমার পকেটে
আজ কেন পেরোলে নদীটি
আজ কেন যোগসূত্র হয়ে আমি পেতে রাখি দুই হাত সমুদ্রের দিকে
এসব আমার নয়, আমি শুধু চিনি অবসন্ন চোখদুটি
সবসময় যারা আমাকে আয়নার থেকে দূরে রাখে
হেমন্তের হলুদ পাতার দিনে আমি এক শিকারীর মতো
লক্ষ্য স্থির করে বসে থাকি যেন ধনুকের টানটান ছিলা
যে কোনও মুহূর্তে ছুটে যাবে তির ঈশ্বরের অট্টহাসির দিকে
এও এক সাময়িক প্রতিক্রিয়া, হঠাৎ যেভাবে স্বপ্নে আকাশ ভেঙেছে
যেভাবে আমার অন্তর্গত কক্ষপথে জ্বলে ওঠে মায়াবী আলোরা
তারপর স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি, কিছুই করার নেই আর
পৃথিবীর জলজ সমাধি আজ— সাঁতার জানি না
ঋণ
তুমি প্রহেলিকা হলে
আমি মেনে নেব নির্দ্বিধায়
এভাবেই তৈরি করি মন
যেদিন মেনেছি নির্বাসন
মনুষ্যজীবন বলো কিংবা
আকাশকুসুম
এভাবেই ভাঙি আর গড়ি
এ জীবন পর্যটন
জেগে ওঠে নান্দনিক ধূম
যতই এগোই
দুদিক থেকেই সরে সরে
যায় মুখ ঠিকানাবিহীন
যা কিছু লুকোনো অনুরাগ
সংগোপনে, শরীর জেনেছে
তার কাছে ঋণ
স্বীকার করেছি স্থানমতো
অসম্পূর্ণ যত কথা
আজ সব প্রতিধ্বনিময়
না যদি স্বীকার করি
শূন্য তবে কবির হৃদয়!